Sandhya Sangeet – Rabindranath Tagore’s classic composition: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্মে যে শাশ্বত মানবিক আবেগ ও চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে, তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হল “সন্ধ্যাসংগীত”। এই কালজয়ী রচনা একদিকে যেমন সন্ধ্যার নীরবতায় ভেসে আসা হৃদয়ের অনুভূতিকে ধরতে পেরেছে, অন্যদিকে তেমনি জীবন, প্রকৃতি এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে এক গভীর সংলাপ প্রতিষ্ঠা করেছে। “সন্ধ্যাসংগীত” রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য গানের মতোই আমাদের চিন্তাধারা এবং অনুভূতির জগতে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। এই গানগুলি শুধুমাত্র সঙ্গীতের এক শৈল্পিক প্রকাশ নয়, বরং তা জীবন ও প্রকৃতির সাথে এক অন্তর্নিহিত সম্পর্কের দার্শনিক প্রতিফলন।
Sandhya Sangeet l সন্ধ্যাসংগীত – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী রচনা
সন্ধ্যা (ayi sandhye)
অয়ি সন্ধ্যে,
অনন্ত আকাশতলে বসি একাকিনী,
কেশ এলাইয়া
মৃদু মৃদু ও কী কথা কহিস আপন মনে
গান গেয়ে গেয়ে,
নিখিলের মুখপানে চেয়ে।
প্রতিদিন শুনিয়াছি, আজও তোর কথা
নারিনু বুঝিতে।
প্রতিদিন শুনিয়াছি, আজও তোর গান
নারিনু শিখিতে।
চোখে লাগে ঘুমঘোর,
প্রাণ শুধু ভাবে হয় ভোর।
হৃদয়ের অতিদূর দূর দূরান্তরে
মিলাইয়া কণ্ঠস্বর তোর কন্ঠস্বরে
উদাসী প্রবাসী যেন
তোর সাথে তোরি গান করে।
অয়ি সন্ধ্যা, তোরি যেন স্বদেশের প্রতিবেশী
তোরি যেন আপনার ভাই
প্রাণের প্রবাসে মোর দিশা হারাইয়া
বেড়ায় সদাই।
শোনে যেন স্বদেশের গান,
দূর হতে কার পায় সাড়া
খুলে দেয় প্রাণ।
যেন কী পুরোনো স্মৃতি
জাগিয়া উঠে রে ওই গানে।
ওই তারকার মাঝে যেন তার গৃহ ছিল,
হাসিত কাঁদিত ওইখানে।
আর বার ফিরে যেতে চায়
পথ তবু খুঁজি না পায়।
কত-না পুরানো কথা, কত-না হারানো গান,
কত না প্রাণের দীর্ঘশ্বাস,
শরমের আধো হাসি, সোহাগের আধো বাণী,
প্রণয়ের আধো মৃদু ভাষ,
সন্ধ্যা, তোর ওই অন্ধকারে
হারাইয়া গেছে একেবারে।
পূর্ণ করি অন্ধকার তোর
তারা সবে ভাসিয়া বেড়ায়
যুগান্তের প্রশান্ত হৃদয়ে
ভাঙাচোরা জগতের প্রায়।
যবে এই নদীতীরে বসি তোর পদতলে
তারা সবে দলে দলে আসে
প্রাণেরে ঘেরিয়া চারি পাশে;
হয়তো একটি হাসি একটি আধেক হাসি
সমুখেতে ভাসিয়া বেড়ায়,
কভু ফোটে কভু বা মিলায়।
আজি আসিয়াছি সন্ধ্যা, বসি তোর অন্ধকারে
মুদিয়া নয়ন
সাধ গেছে গাহিবারে–মৃদু স্বরে শুনাবারে
দু-চারিটি গান।
যেথায় পুরোনো গান যেথায় হারানো হাসি
যেথা আছে বিস্মৃত স্বপন
সেইখানে সযতনে রেখে দিস গানগুলি,
রচে দিস সমাধিশয়ন।
জানি সন্ধ্যা, জানি তোর স্নেহ,
গোপনে ঢাকিবি তার দেহ
বসিয়া সমাধি-‘পরে নিষ্ঠুরকৌতুকভরে
দেখিস হাসে না যেন কেহ।
ধীরে শুধু ঝরিবে শিশির,
মৃদু শ্বাস ফেলিবে সমীর।
স্তব্ধতা কপোলে হাত দিয়ে
একা সেথা রহিবে বসিয়া,
মাঝে মাঝে দু-একটি তারা
সেথা আসি পড়িবে খসিয়া।
ছোটদের গল্প জাদুকর – হুমায়ূন আহমেদ
গান আরম্ভ (gaan aarambha)
চারি দিকে খেলিতেছে মেঘ,
বায়ু আসি করিছে চুম্বন —
সীমাহারা নভস্তল দুই বাহু পসারিয়া
হৃদয়ে করিছে আলিঙ্গন।
অনন্ত এ আকাশের কোলে
টলমল মেঘের মাঝার
এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর
তোর তরে কবিতা আমার!
যবে আমি আসিব হেথায়
মন্ত্র পড়ি ডাকিব তোমায়।
বাতাসে উড়িবে তোর বাস,
ছড়ায়ে পড়িবে কেশপাশ,
ঈষৎ মেলিয়া আঁখি-পাতা
মৃদু হাসি পড়িবে ফুটিয়া–
হৃদয়ের মৃদুল কিরণ
অধরেতে পড়িবে লুটিয়া।
এলো থেলো কেশপাশ লয়ে
বসে বসে ,খেলিবি হেথায়,
উষার অলক দুলাইয়া
সমীরণ যেমন খেলায়।
চুমিয়া চুমিয়া ফুটাইব
আধোফোটা হাসির কুসুম,
মুখ লয়ে বুকের মাঝারে
গান গেয়ে পাড়াইব ঘুম।
কৌতুকে করিয়া কোলাকুলি
আসিবে মেঘের শিশুশুলি,
ঘিরিয়া দাঁড়াবে তারা সবে
অবাক হইয়া চেয়ে রবে।
মেঘ হতে নেমে ধীরে ধীরে
আয় লো কবিতা, মোর বামে–
চম্পক-অঙ্গুলি দুটি দিয়ে
অন্ধকার ধীরে সরাইয়ে
যেমন করিয়া উষা নামে।
বায়ু হতে আয় লো কবিতা,
আসিয়া বসিবি মোর পাশে–
কে জানে, বনের কোথা হতে
ভেসে ভেসে সমীরণস্রোতে
সৌরভ যেমন করে আসে।
হৃদয়ের অন্তঃপুর হতে
বধূ মোর, ধীরে ধীরে আয়–
ভীরু প্রেম যেমন করিয়া
ধীরে উঠে হৃদয় ধরিয়া,
বঁধুর পায়ের কাছে গিয়ে
অমনি মুরছি পড়ে যায়।
অথবা শিথিল কলেবরে
এসো তুমি, বোসো মোর পাশে–
মরণ যেমন করে আসে,
শিশির রেমনে করে ঝরে,
পশ্চিমের আঁধারসাগরে
তারাটি যেমন করে যায়
অতি ধীরে মৃদু হেসে সিঁদুর সীমান্তদেশে?
দিবা সে যেমন করে আসে
মরিবারে স্বামীর চিতায়
পশ্চিমের জ্বলন্ত শিখায়।
পরবাসী ক্ষীণ-আয়ু একটি মুমূর্ষু বায়ু
শেষ কথা বলিতে বলিতে
তখনি যেমন মরে যায়
তেমনি, তেমনি করে এসো–
কবিতা রে, বধূটি আমার,
দুটি শুধু পড়িবে নিশ্বাস,
দুটি শুধু বাহিরিবে বাণী,
বাহু দুটি হৃদয়ে জড়ায়ে
মরমে রাখিব মুখখানি।
তারকার আত্মহত্যা (taarakaar aatmahatyaa)
জ্যোতির্ময় তীর হতে আঁধার সাগরে
ঝাঁপায়ে পড়িল এক তারা,
একেবারে উন্মাদের পারা।
চৌদিকে অসংখ্য তারা রহিল চাহিয়া
অবাক হইয়া–
এই-যে জ্যোতির বিন্দু আছিল তাদের মাঝে
মুহুর্তে সে গেল মিশাইয়া।
যে সমূদ্রতলে
মনোদুঃখে আত্মঘাতী
চির-নির্বাপিত-ভাতি
শত মৃত তারকার
মৃতদেহ রয়েছে শয়ান
সেথায় সে করেছে পয়ান।
কেন গো, কী হয়েছিল তার।
একরার শুধালে না কেহ–
কী লাগি সে তেয়াগিল দেহ।
যদি কেহ শুধাইতো
আমি জানি কী যে সে কহিত।
যতদিন বেঁচে ছিল
আমি জানি কী তারে দহিত।
সে কেবল হাসির যন্ত্রণা,
আর কিছু না!
জ্বলন্ত অঙ্গারখণ্ড ঢাকিতে আঁধার হৃদি
অনিবার হাসিতেই রহে,
যত হাসে ততই সে দহে।
তেমনি, তেমনি তারে হাসির অনল
দারুণ উজ্জল–
দহিত, দহিত তারে, দহিত, কেবল।
জ্যোতির্ময় তারাপূর্ণ বিজন তেয়াগি
তাই আজ ছুটেছে সে নিতান্ত মনের ক্লেশে
আঁধারের তারাহীন বিজনের লাগি।
কেন গো তোমরা যত তারা
উপহাস করি তার হাসিছ অমন ধারা।
তোমাদের হয় নি তো ক্ষতি,
যেমন আছিল আগে তেমনি রয়েছে জ্যোতি।
সে কি কভু ভেবেছিল মনে-
(এত গর্ব আছিল কি তার)।
আপনারে নিবাইয়া তোমাদের করিবে আঁধার।
গেল, গেল, ডুবে গেল, তারা এক ডুবে গেল,
আঁধারসাগরে–
গভীর নিশীথে
অতল আকাশে।
হৃদয়, হৃদয় মোর, সাধ কি রে যায় তোর
ঘুমাইতে ওই মৃত তারাটির পাশে
ওই আঁধারসাগরে
এই গভীর নিশীথে
ওই অতল আকাশে।
আশার নৈরাশ্য (aashaar nairaashya)
ওরে আশা, কেন তোর হেন দীনবেশ!
নিরাশারই মতো যেন বিষণ্ণ বদন কেন–
যেন অতি সংগোপনে
যেন অতি সন্তর্পণে
অতি ভয়ে ভয়ে প্রাণে করিস প্রবেশ।
ফিরিবি কি প্রবেশিবি ভাবিয়া না পাস,
কেন, আশা,কেন তোর কিসের তরাস।
আজ আসিয়াছ দিতে যে সুখ-আশ্বাস,
নিজে তাহা কর না বিশ্বাস,
তাই হেন মৃদু গতি,
তাই উঠিতেছে ধীরে দুখের নিশ্বাস।
বসিয়া মরমস্থলে কহিছ চোখের জলে–
“বুঝি হেন দিন রহিবে না,
আজ যাবে, আসিবে তো কাল,
দুঃখ যাবে, ঘুচিবে যাতনা।”
কেন, আশা, মোরে কেন হেন প্রতারণা।
দুঃখক্লেশে আমি কি ডরাই,
আমি কি তাদেব চিনি নাই।
তারা সবে আমারি কি নয়।
তবে, আশা, কেন এত ভয়।
তবে কেন বসি মোর পাশ
মোরে, আশা, দিতেছ আশ্বাস।
বলো, আশা, বসি মোর চিতে,
“আরো দুঃখ হইবে বহিতে,
হৃদয়ের যে প্রদেশ হয়েছিল ভস্মশেষ
আর যারে হত না সহিতে,
আবার নূতন প্রাণ পেয়ে
সেও পুন থাকিবে দহিতে।
করিয়ো না ভয়,
দুঃখ-জ্বালা আমারি কি নয়?
তবে কেন হেন ম্লান মুখ
তবে কেন হেন দীন বেশ?
তবে কেন এত ভয়ে ভয়ে
এ হৃদয়ে করিস প্রবেশ?
পরিত্যক্ত (parityakta)
চলে গেল, আর কিছু নাই কহিবার।
চলে গেল, আর কিছু নাই গাহিবার।
শুধু গাহিতেছে আর শুধু কাঁদিতেছে
দীনহীন হৃদয় আমার, শুধু বলিতেছে,
“চলে গেল সকলেই চলে গেল গো,
বুক শুধু ভেঙে গেল দ’লে গেল গো।”
বসন্ত চলিয়া গেলে বর্ষা কেঁদে কেঁদে বলে,
“ফুল গেল, পাখি গেল–
আমি শুধু রহিলাম, সবই গেল গো।”
দিবস ফুরালে রাতি স্তব্ধ হয়ে রহে,
শুধু কেঁদে কহে,
“দিন গেল, আলো গেল, রবি গেল গো–
কেবল একেলা আমি, সবই গেল গো।”
উত্তরবায়ুর সম প্রাণের বিজনে মম
কে যেন কাঁদিছে শুধু
“চলে গেল, চলে গেল,
সকলেই চলে গেল গো।”
উৎসব ফুরায়ে গেলে ছিন্ন শুষ্ক মালা
পড়ে থাকে হেথায় হোথায়–
তৈলহীন শিখাহীন ভগ্ন দীপগুলি
ধুলায় লুটায়–
একবার ফিরে কেহ দেখে নাকো ভুলি,
সবে চলে যায়।
পুরানো মলিন ছিন্ন বসনের মতো
মোরে ফেলে গেল,
কাতর নয়নে চেয়ে রহিলাম কত–
সাথে না লইল।
তাই প্রাণ গাহে শুধু, কাঁদে শুধু, কহে শুধু,
“মোরে ফেলে গেল,
সকলেই মোরে ফেলে গেল,
সকলেই চলে গেল গো।”
একবার ফিরে তারা চেয়েছিল কি?
বুঝি চেয়েছিল।
একবার ভুলে তারা কেঁদেছিল কি?
বুঝি কেঁদেছিল।
বুঝি ভেবেছিল–
লয়ে যাই–নিতান্ত কি একেলা কাঁদিবে?
তাই বুঝি ভেবেছিল।
তাই চেয়েছিল।
তার পরে? তার পরে!
তার পরে বুঝি হেসেছিল।
একফোঁটা অশ্রুবারি মুহূর্তেই শুকাইল।
তার পরে? তার পরে!
চলে গেল।
তার পরে? তার পরে!
ফুল গেল, পাখি গেল, আলো গেল, রবি গেল,
সবাই গেল, সবই গেল গো–
হৃদয় নিশ্বাস ছাড়ি কাঁদিয়া কহিল,
“সকলেই চলে গেল গো,
আমারেই ফেলে গেল গো।”
সুখের বিলাপ (sukher bilaap)
অবশ নয়ন নিমীলিয়া
সুখ কহে নিশ্বাস ফেলিয়া,
“এমন জোছনা সুমধুর,
বাঁশরি বাজিছে দূর দূর,
যামিনীর হসিত নয়নে
লেগেছে মৃদুল, ঘুমঘোর।
নদীতে উঠেছে মৃদু ঢেউ,
গাছেতে নড়িছে মৃদু পাতা,
লতায় ফুটিয়া ফুল দুটি
পাতায় লুকায় তার মাথা
মলয় সুদূর বনভূমে
কাঁপায়ে গাছের ছায়াগুলি
লাজুক ফুলের মুখ হতে
ঘোমটা দিতেছে খুলি খুলি।
এমন মধুর রজনীতে
একেলা রয়েছি বসিয়া,
যামিনীর হৃদয় হইতে
জোছনা পড়িছে খসিয়া।”
হৃদয়ে একেলা শুয়ে শুয়ে
সুখ শুধু এই গান গায়,
“নিতান্ত একেলা আমি যে
কেহ, কেহ, কেহ নাই হায়।”
আমি তারে শুধাইনু গিয়া,
“কেন, সুখ, কার কর আশা?”
সুখ শুধু কাঁদিয়া কহিল,
“ভালোবাসা, ভালোবাসা গো।
সকলি, সকলি হেথা আছে–
কুসুম ফুটেছে গাছে গাছে,
আকাশে তারকা রাশি রাশি,
জোছনা ঘুমায় হাসি হাসি।
সকলি, সকলি হেথা আছে-
সেই শুধু, সেই শুধু নাই,
ভালোবাসা নাই শুধু কাছে।”
অবশ নয়ন নিমীলিয়া
সুখ কহে নিশ্বাস ফেলিয়া,
“এই তটিনীর ধারে, এই শুভ্র জোছ্নায়,
এই কুসুমিত বনে, এই বসন্তের বায়,
কেহ মোর নাই একেবারে,
তাই সাধ গেছে কাঁদিবারে।
তাই সাধ যায় মনে মনে–
মিশাব এ যামিনীর সনে,
কিছুই রবে না আর প্রাতে,
শিশির রহিবে পাতে পাতে।
সাধ যায় মেঘটির মতো
কাঁদিয়া মরিয়া গিয়া আজি
অশ্রুজলে হই পরিণত।”
সুখ বলে, “এ জন্ম ঘুচায়ে
সাধ যায় হইতে বিষাদ।”
“কেন সুখ, কেন হেন সাধ?”
“নিতান্ত একা যে আমি গো
কেহ যে, কেহ যে নাই মোর।”
“সুখ, কারে চায় প্রাণ তোর?
সুখ, কার করিস রে আশা?”
সুখ শুধু কেঁদে কেঁদে বলে,
“ভালোবাসা, ভালোবাসা গো।”
হৃদয়ের গীতিধ্বনি (hridayer geetidwani)
ও কী সুরে গান গাস, হৃদয় আমার?
শীত নাই গ্রীষ্ম নাই, বসন্ত শরৎ নাই,
দিন নাই রাত্রি নাই — অবিরাম অনিবার
ও কী সুরে গান গাস, হৃদয় আমার?
বিরলে বিজন বনে বসিয়া আপন মনে
ভূমি-পানে চেয়ে চেয়ে, একই গান গেয়ে গেয়ে–
দিন যায়, রাত যায়, শীত যায়, গ্রীষ্ম যায়,
তবু গান ফুরায় না আর?
মাথায় পড়িছে পাতা, পড়িছে শুকানো ফুল,
পড়িছে শিশিরকণা, পড়িছে রবির কর,
পড়িছে বরষা-জল ঝরঝর ঝরঝর,
কেবলি মাথার ‘পরে করিতেছে সমস্বরে
বাতাসে শুকানো পাতা মরমর মরমর–
বসিয়া বসিয়া সেথা, বিশীর্ণ মলিন প্রাণ
গাহিতেছে একই গান একই গান একই গান।
পারি নে শুনিতে আর একই গান একই গান।
কখন থামিবি তুই, বল্ মোরে বল্ প্রাণ!
একেলা ঘুমায়ে আছি–
সহসা স্বপন টুটি
সহসা জাগিয়া উঠি
সহসা শুনিতে পাই
হৃদয়ের এক ধারে
সেই স্বর ফুটিতেছে,
সেই গান উঠিতেছে–
কেহ শুনিছে না যবে
চারি দিকে স্তব্ধ সবে
সেই স্বর সেই গান অবিরাম অবিশ্রাম
অচেতন আঁধারের শিরে শিরে চেতনা সঞ্চারে।
দিবসে মগন কাজে, চারি দিকে দলবল,
চারি দিকে কোলাহল।
সহসা পাতিলে কান শুনিতে পাই সে গান,
নানাশব্দময় সেই জনকোলাহল।
তাহারি প্রাণের মাঝে একমাত্র শব্দ বাজে–
এক সুর, এক ধ্বনি, অবিরাম অবিরল–
যেন সে কোলাহলের হৃদয়ম্পন্দন-ধ্বনি–
সমস্ত ভুলিয়া যাই, বসে বসে তাই গনি।
ঘুমাই বা জেগে থাকি, মনের দ্বারের কাছে
কে যেন বিষণ্ণ প্রাণী দিনরাত বসে আছে–
চিরদিন করিতেছে বাস,
তারি শুনিতেছি যেন নিশ্বাস-প্রশ্বাস।
এ প্রাণের ভাঙা ভিতে স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে
ঘুঘু এক বসে বসে গায় একস্বরে,
কে জানে কেন সে গান গায়।
বলি সে কাতর স্বরে স্তব্ধতা কাঁদিয়া মরে,
প্রতিধ্বনি করে হায়-হায়।
হৃদয় রে, আর কিছু শিখিলি নে তুই,
শুধু ওই গান!
প্রকৃতির শত শত রাগিণীর মাঝে
শুধু ওই তান!
তবে থাম্ থাম্ ওরে প্রাণ,
পারি নে শুনিতে আর একই গান, একই গান।
দুঃখ-আবাহন (duhkha aabaahan)
আয় দুঃখ, আয় তুই,
তোর তরে পেতেছি আসন,
হৃদয়ের প্রতি শিরা টানি টানি উপাড়িয়া
বিচ্ছিন্ন শিরার মুখে তৃষিত অধর দিয়া
বিন্দু বিন্দু রক্ত তুই করিস শোষণ;
জননীর স্নেহে তোরে করিব পোষণ।
হৃদয়ে আয় রে তুই হৃদয়ের ধন।
নিভৃতে ঘুমাবি তুই হৃদয়ের নীড়ে;
অতি শুরু তোর ভার–
দু-একটি শিরা তাহে যাবে বুঝি ছিঁড়ে,
যাক ছিঁড়ে।
জননীর স্নেহে তোরে করিব বহন
দুর্বল বুকের ‘পরে করিব ধারণ,
একেলা বসিয়া ঘরে অবিরল একস্বরে
গাব তোর কানে কানে ঘুম পাড়াবার গান।
মুদিয়া আসিবে তোর শ্রান্ত দু-নয়ান।
প্রাণের ভিতর হতে উঠিয়া নিশ্বাস,
শ্রান্ত কপালেতে তোর করিবে বাতাস,
তুই নীরবে ঘুমাস।
আয়, দুঃখ,আয় তুই, ব্যাকুল এ হিয়া।
দুই হাতে মুখ চাপি হৃদয়ের ভূমি-‘পরে
পড়্ আছাড়িয়া।
সমস্ত হৃদয় ব্যাপি একবার উচ্চস্বরে
অনাথ শিশুর মতো ওঠ্ রে কাঁদিয়া
প্রাণের মর্মের কাছে
একটি যে ভাঙা বাদ্য আছে
দুই হাতে ডুলে নে রে, সবলে বাজায়ে দে রে
নিতান্ত উন্মাদ-সম ঝন্ ঝন্ ঝন্ ঝন্।
ভাঙ্গে তো ভাঙ্গিবে বাদ্য, ছেঁড়ে তো ছিঁড়িবে তন্ত্রী —
নে রে তবে তুলে নে রে, সবলে বাজায়ে দে রে
নিতান্ত উন্মাদ-সম ঝন্ ঝন্ ঝন্ ঝন্।
দারুণ আহত হয়ে দারুণ শব্দের ঘায়,
যত আছে প্রতিধ্বনি বিষম প্রমাদ গনি
একেবারে সমস্বরে
কাঁদিয়া উঠিবে যন্ত্রণায়-
দুঃখ, তুই আয় তুই আয়।
নিতান্ত একেলা এ হৃদয়।
আর কিছু নয়,
কাছে আয় একবার, তুলে ধর্ মুখ তার,
ঘুমে তার আঁখি দুটি রাখ্
একদৃষ্টে চেয়ে শুধু থাক্।
আর কিছু নয়,
নিরালয় এ হৃদয়
শুধু এক সহচর চায়।
তুই দুঃখ তুই কাছে আয়।
কথা না কহিস যদি বসে থাক্ নিরবধি
হৃদয়ের পাশে দিনরাতি।
যখনি খেলাতে চাস হৃদয়ের কাছে যাস,
হৃদয় আমার চায় খেলাবার সাথি।
আয় দুঃখ হৃদয়ের ধন,
এই হেথা পেতেছি আসন।
প্রাণের মর্মের কাছে
এখনো যা রক্ত আছে
তাই তুই করিস শোষণ।
শান্তিগীত (shantigeet)
ঘুমা দুঃখ হৃদয়ের ধন,
ঘুমা তুই ঘুমা রে এমন।
সুখে সারা দিনমান শোণিত করিয়া পান
এখন তো মিটেছে তিয়াষ?
দুঃখ, তুই সুখেতে ঘুমাস।
আজ জোছনার রাত্রে বসন্তপবনে,
অতীতের পরলোক ত্যজি শূন্যমনে,
বিগত দিবসগুলি শুধু একবার
পুরানো খেলার ঠাঁই দেখিতে এসেছে
এই হৃদয়ে আমার–
যবে বেঁচেছিল তারা এই এ শ্মশানে
দিন গেলে প্রতিদিন পুড়াত যেখানে
একেকটি আশা আর একেকটি সুখ,
সেইখানে আসি তারা বসিয়া রয়েছে
অতি ম্লান মুখ।
সেখানে বসিয়া তারা সকলে মিলিয়া
অতি মৃদু স্বরে
পুরানো কালের গীতি নয়ন মুদিয়া
ধীরে গান করে।
দুঃখ, তুই ঘুমা।
ধীরে উঠিতেছে গান,
ক্রমে ছাইতেছে প্রাণ,
নীরবতা ছায় যথা সন্ধ্যোর গগন।
গানের প্রাণের মাঝে তোর তীব্র কণ্ঠস্বর
ছুরির মতন।
তুই থাম্ দুঃখ, থাম্।
তুই ঘুমা দুঃখ, ঘুমা।
কাল উঠিস আবার,
খেলিস দুরন্ত খেলা হৃদয়ে আমার;
হৃদয়ের শিরাগুলি ছিঁড়ি ছিঁড়ি মোর
তাইতে রচিস তন্ত্রী বীণাটির তোর,
সারাদিন বাজাস বসিয়া
ধ্বনিয়া হৃদয়।
আজ রাত্রে রব শুধু চাহিয়া চাঁদের পানে,
আর কিছু নয়।
অসহ্য ভালবাসা (asahya bhaalabaasaa)
বুঝেছি গো বুঝেছি সজনি,
কী ভাব তোমার মনে জাগে,
বুক-ফাটা প্রাণ-ফাটা মোর ভালোবাসা
এত বুঝি ভালো নাহি লাগে।
এত ভালোবাসা বুঝি পার না সহিতে,
এত বুঝি পার না বহিতে।
যখনি গো নেহারি তোমায়–
মুখ দিয়া আঁখি দিয়া বাহিরিতে চায় হিয়া,
শিরার শৃঙ্খলগুলি ছিঁড়িয়া ফেলিতে চায়,
ওই মুখ বুকে ঢাকে, ওই হাতে হাত রাখে,
কী করিবে ভাবিয়া না পায়,
যেন তুমি কোথা আছ খুঁজিয়া না পায়।
মন মোর পাগলের হেন প্রাণপণে শুধায় যেন,
“প্রাণের প্রাণের মাঝে কী করিলে তোমারে গো পাই,
যে ঠাঁই রয়েছে শূন্য, কী করিলে সে শূন্য পুরাই।”
এইরূপে দেহের দুয়ারে
মন যবে থাকে যুঝিবারে,
তুমি চেয়ে দেখ মুখ-বাগে–
এত বুঝি ভালো নাহি লাগে।
তুমি চাও যবে মাঝে মাঝে
অবসর পাবে তুমি কাজে
আমারে ডাকিবে একবার–
কাছে গিয়া বসিব তোমার,
মৃদু মৃদু সুমধুর বাণী
কব তব কানে কানে রানী।
তুমিও কহিবে মৃদু ভাষ,
তুমিও হাসিবে মৃদু হাস,
হৃদয়ের মৃদু খেলাখেলি–
ফুলেতে ফুলেতে হেলাহেলি।
চাও তুমি দুঃখহীন প্রেম
ছুটে যেথা ফুলের সুবাস,
উঠে যেথা জোছনালহরী,
বহে যেথা বসন্তবাতাস।
নাহি চাও আত্মহারা প্রেম
আছে যেথা অনন্ত পিয়াস,
বহে যেথা চোখের সলিল,
উঠে যেথা দুখের নিশ্বাস।
প্রাণ যেথা কথা ভুলে যায়,
আপনারে ভুলে যায় হিয়া,
অচেতন চেতনা যেথায়,
চরাচর, ফেলে হারাইয়া।
এমন কি কেহ নাই, বল্ মোরে বল্ আশা,
মার্জনা করিবে মোর অতি–অতি ভালোবাসা!
হলাহল (halaahal)
এমন ক’দিন কাটে আর!
ললিত গলিত হাস, জাগরণ, দীর্ঘশ্বাস,
সোহাগ, কটাক্ষ, মান, নয়নসলিলধার,
মৃদু হাসি–মৃদৃ কথা –আদরের, উপেক্ষার–
এই শুধু, এই শুধু, দিনরাত এই শুধু–
এমন কদিন কাটে আর!
কটাক্ষে মরিয়া যায়, কটাক্ষে বাঁচিয়া উঠে,
হাসিতে হৃদয় জুড়ে, হাসিতে হৃদয় টুটে,
ভীরুর মতন আসে দাঁড়ায়ে রহে গো পাশে,
ভয়ে ভয়ে মৃদু হাসে, ভয়ে ভয়ে মুখ ফুটে,
একটু আদর পেলে অমনি চরণে লুটে,
অমনি হাসিটি জাগে মলিন অধরপুটে,
একটু কটাক্ষ হেরি অমনি সরিয়া যায়–
অমনি জগৎ যেন শূন্য, মরুভূমি-হেন,
অমনি মরণ যেন প্রাণের অধিক ভায়।
প্রণয় অমৃত এ কি? এ যে ঘোর হলাহল–
হৃদয়ের শিরে শিরে প্রবেশিয়া ধীরে ধীরে
অবশ করেছে দেহ, শোণিত করেছে জল।
কাজ নাই, কর্ম নাই, বসে আছে এক ঠাঁই,
হাসি ও কটাক্ষ লয়ে খেলেনা গড়িছে যত,
কভু ঢুলে-পড়া আঁখি কভু অশ্রুভারে নত।
দূর করো, দূর করো, বিকৃত এ ভালোবাসা
জীবনদায়িনী নহে, এ যে গো হৃদয়নাশা।
কোথায় প্রণয়ে মন যৌবনে ভরিয়া উঠে,
জগতের অধরেতে হাসির জোছনা ফুটে,
চোখেতে সকলি ঠেকে বসন্তহিল্লোলময়,
হৃদয়ের শিরে শিরে শোণিত সতেজে বয়–
তা নয়, একি এ হল, একি এ জর্জর মন!
হাসিহীন দু অধর, জোতিহীন দু নয়ন!
দূরে যাও, দূরে যাও, হৃদয় রে দূরে যাও–
ভূলে যাও, ভুলে যাও, ছেলেখেলা ভুলে যাও।
দূর করো, দূর করো, বিকৃত এ ভালোবাসা–
জীবনদায়িনী নহে, এ যে গো হৃদয়নাশা।
অনুগ্রহ (anugraha)
এই-যে জগৎ হেরি আমি,
মহাশক্তি জগতের স্বামী,
এ কি হে তোমার অনুগ্রহ?
হে বিধাতা কহো মোরে কহো।
ওই-যে সমুখে সিন্ধু, এ কি অনুগ্রহবিন্দু?
ওই-যে আকাশে শোভে চন্দ্র সূর্য গ্রহ,
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তব অনুগ্রহ?
ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্র একজন
আমারে যে করেছ সৃজন,
এ কি শুধু অনুগ্রহ করে
ঋণপাশে বাঁধিবারে মোরে?
করিতে করিতে যেন খেলা
কটাক্ষে করিয়া অবহেলা,
হেসে ক্ষমতার হাসি অসীম ক্ষমতা হতে
ব্যয় কয়িয়াছ এক রতি
অনুগ্রহ করে মোর প্রতি?
শুভ্র শুভ্র জুঁই দুটি ওই-যে রয়েছে ফুটি
ও কি তব অতি শুভ্র ভালোবাসা নয়?
বলো মোরে, মহাশক্তিময়,
ওই-যে জোছনা-হাসি ওই-যে তারকারাশি,
আকাশে হাসিয়া ফুটে রয়,
ও কি তব ভালোবাসা নয়?
ও কি তব অনুগ্রহ-হাসি
কঠোর পাষাণ লৌহময়?
তবে হে হৃদয়হীন দেব,
জগতের রাজ-অধিরাজ,
হানো তব হাসিময় বাজ,
মহা অনুগ্রহ হতে তব
মুছে তুমি ফেলহ আমারে–
চাহি না থাকিতে এ সংসারে।
ভালোবাসি আপনা ভুলিয়া,
গান গাহি হৃদয় খুলিয়া,
ভক্তি করি পৃথিবীর মতো,
স্নেহ করি আকাশের প্রায়।
আপনারে দিয়েছি ফেলিয়া
আপনারে গিয়েছি ভুলিয়া
যারে ভালোবাসি তার কাছে
প্রাণ শুধু ভালোবাসা চায়।
সাক্ষী আছ তুমি অন্তর্যামী
কতখানি ভালোবাসি আমি,
দেখি যবে তার মুখ হৃদয়ে দারুণ সুখ
ভেঙে ফেলে হৃদয়ের দ্বার,
বলে, “এ কী ঘোর কারাগার!”
প্রাণ বলে, “পারি নে সহিতে,
এ দুরন্ত সুখেরে বহিতে।”
আকাশে হেরিলে শশী আনন্দে উথলি উঠি
দেয় যথা মহাপারাবার
অসীম আনন্দ উপহার,
তেমনি সমুদ্র-ভরা আনন্দ তাহারে দিই
হৃদয় যাহারে ভালোবাসে,
হৃদয়ের প্রতি ঢেউ উথলি গাহিয়া উঠে
আকাশ পুরিয়া গীতোচ্ছ্বাসে।
ভেঙে ফেলি উপকূল পৃথিবী ডুবাতে চাহে,
আকাশে উঠিতে চায় প্রাণ–
আপনারে ভুলে গিয়ে হৃদয় হইতে চাহে
একটি জগতব্যাপী গান।
তাহারে কবির অশ্রু হাসি
দিয়েছি কত-না রাশি রাশি,
তাহারি কিরণে ফুটিতেছে
হৃদয়ের আশা ও ভরসা
তাহারি হাসি ও অশ্রুজল
এ প্রাণের বসন্ত বরষা।
ভালোবাসি, আর গান গাই–
কবি হয়ে জন্মেছি ধরায়
রাত্রি এত ভালো নাহি বাসে,
উষা এত গান নাহি গায়।
ভালোবাসা স্বাধীন মহান,
ভালোবাসা পর্বতসমান।
ভিক্ষাবৃত্তি করে না তপন
পৃথিবীরে চাহে সে যখন–
সে চাহে উজ্জ্বল করিবারে,
সে চাহে উর্বর করিবারে,
জীবন করিতে প্রবাহিত,
কুসুম করিতে বিকশিত।
চাহে সে বাসিতে শুধু ভালো
চাহে সে করিতে শুধু আলো
স্বপ্নেও কি ভাবে কভু ধরা,
তপনেরে অনুগ্রহ করা?
যবে আমি যাই তার কাছে
সে কি মনে ভাবে গো তখন
অনুগ্রহ ভিক্ষা মাগিবারে
এসেছে ভিক্ষুক একজন?
অনুগ্রহ পাষাণমমতা
করুণার কঙ্কাল কেবল,
ভাবহীন বজ্রে গড়া হাসি–
স্ফটিককঠিন অশ্রু-জল।
অনুগ্রহ বিলাসী গবিত,
অনুগ্রহ দয়ালু-কৃপণ–
বহু কষ্টে অশ্রুবিন্দু দেয়
শুষ্ক আঁখি করিয়া মন্থন।
নীচ হীন দীন অনুগ্রহ
কাছে যবে আসিবারে চায়
প্রণয় বিলাপ করি উঠে–
গীতগান ঘৃণায় পলায়।
হে দেবতা, অনুগ্রহ হতে
রক্ষা করো অভাগা কবিরে,
অপযশ অপমান দাও–
দুঃখ জ্বালা বহিব এ শিরে।
সম্পদের স্বর্ণকারাগারে,
গরবের অন্ধকার-মাঝ,
অনুগ্রহ রাজার মতন
চিরকাল করুক বিরাজ।
সোনার শৃঙ্খল ঝংকারিয়া
গরবের স্ফীত দেহ লয়ে
অনুগ্রহ আসে নাকো যেন
আমাদের স্বাধীন আলয়ে।
গান আসে ব’লে গান গাই,
ভালোবাসি ব’লে ভালোবাসি,
কেহ ,যেন মনে নাহি করে
মোরা কারো কৃপার প্রয়াসী।
নাহয় শুনো না মোর গান,
ভালেবাসা ঢাকা রবে মনে।
অনুগ্রহ করে এই কোরো–
অনুগ্রহ কোরো না এ জনে।
আবার (aabaar)
তুমি কেন আসিলে হেথায়
এ আমার সাধের আবাসে?
এ আলয়ে যে নিবাসী থাকে,
এ আলয়ে যে অতিথি আসে,
সবাই আমার সখা, সবাই আমার বঁধু,
সবারেই আমি ভালোবাসি,
তারাও আমারে ভালোবাসে–
তুমি তবে কেন এলে হেথা
এ আমার সাধের আবাসে?
এ আমার প্রেমের আলয়,
এ মোর স্নেহের নিকেতন;
বেছে বেছে কুসুম তুলিয়া
রচিয়াছি কোমল আসন।
কেহ হেথা নাইকো নিষ্ঠুর,
কিছু হেথা নাইকো কঠিন,
কবিতা আমার প্রণয়িনী
এইখানে আসে প্রতিদিন।
সমীর কোমল-মন আসে হেথা অনুক্ষণ,
যখনি সে পায় অবকাশ
যখনি প্রভাত ফুটে, যখনি সে জেগে উঠে,
ছুটিয়া সে আসে মোর পাশে;
দুই বাহু প্রসারিয়া আমারে বুকেতে নিয়া
কত শত বারতা শুধায়,
সখা মোর প্রভাতের বায়।
আকাশেতে তুলে আঁখি বাতায়নে বসে থাকি
নিশি যবে পোহায়-পোহায়;
উষার আলোকে হারা সখী মোর শুকতারা
আমার এ মুখপানে চায়।
নীরবে চাহিয়া রহে, নীরব নয়নে কহে,
“সখা, আজ বিদায়, বিদায়।”
ধীরে ধীরে সন্ধ্যার বাতাস
প্রতিদিন আসে মোর পাশ।
দেখে, আমি বাতায়নে, অশ্রু ঝরে দু নয়নে,
ফেলিতেছি দুখের নিশ্বাস।
অতি ধীরে আলিঙ্গন করে,
কথা কহে সকরুণ স্বরে,
কানে কানে বলে, “হায় হায়।”
কোমল কপোল দিয়া কপোল চুম্বন করি
অশ্রু বিন্দু সুধীরে শুকায়।
সবাই আমার মন বুঝে,
সবাই আমার দুঃখ জানে,
সবাই করুণ আঁখি মেলি
চেয়ে থাকে এই মুখপানে।
যে কেহ আমার ঘরে আসে
সবাই আমারে ভালোবাসে–
তবে কেন তুমি এলে হেথা
এ আমার সাধের আবাসে?
ফেরো ফেরো, ও নয়নরসহীন ও বয়ন
আনিয়ো না এ মোর আলয়ে,
আমরা সখারা মিলি আছি হেথা নিরিবিলি
আপনার মনোদুঃখ লয়ে।
এমনি হয়েছে শান্ত মন,
ঘুচেছে দুঃখের কঠোরতা;
ভালো লাগে বিহঙ্গের গান,
ভালো লাগে তটিনীর কথা।
ভালো লাগে কাননে দেখিতে
বসন্তের কুসুমের মেলা,
ভালো লাগে সারাদিন বসে
দেখিতে মেঘের ছেলেখেলা।
এইরূপে সায়াহ্নের কোলে
রচেছি গোধূলি-নিকেতন,
দিবসের অবসান-কালে
পশে হেথা রবির কিরণ।
আসে হেথা অতি দূর হতে
পাখিদের বিরামের তান,
ম্রিয়মাণ সন্ধ্যা-বাতাসের
থেকে থেকে মরণের গান।
পরিশ্রান্ত অবশ পরানে
বসিয়া রয়েছি এইখানে।
যাও মোরে যাও ছেড়ে নিয়ো না নিয়ো না কেড়ে,
নিয়ো না নিয়ো না মন মোর;
সখাদের কাছ হতে ছিনিয়া নিয়ো না মোরে,
ছিঁড়ো না এ প্রণয়ের ডোর।
আবার হারাই যদি এই গিরি, এই নদী,
মেঘ বায়ু কানন নির্ঝর,
আবার স্বপন ছুটে একেবারে যায় টুটে
এ আমার গোধূলির ঘর।
আবার আশ্রয়হারা, ঘুরে ঘুরে হই সারা
ঝটিকার মেঘখণ্ড-সম,
দুঃখের বিদ্যুৎ-ফণা ভীষণ ভুজঙ্গ এক
পোষণ করিয়া বক্ষে মম–
তাহা হলে এ জনমে, নিরাশ্রয়ে এ জীবনে
ভাঙা ঘর আর গড়িবে না,
ভাঙা হৃদয় আর জুড়িবে না!
কাল সবে গড়েছি আলয়,
কাল সবে জুড়েছি হৃদয়;
আজি তা দিয়ো না যেন ভেঙে,
রাখো তুমি রাখো এ বিনয়ে।
পাষাণী (paashhaanee)
জগতের বাতাস করুণা,
করুণা যে রবিশশীতারা,
জগতের শিশির করুণা–
জগতের বৃষ্টিবারিধারা।
জননীর স্নেহধারা-সম
এই-যে জাহ্নবী বহিতেছে,
মধুরে তটের কানে কানে
আশ্বাস-বচন কহিতেছে–
এও সেই বিমল করুণা
হৃদয় ঢালিয়া বহে যায়,
জগতের তৃষা নিবারিয়া
গান গাহে করুণ ভাষায়।
কাননের ছায়া সে করুণা,
করুণা সে উষার কিরণ,
করুণা সে জননীর আঁখি,
করুণা সে প্রেমিকের মন।
এমন যে মধুর করুণা,
এমন যে কোমল করুণা,
জগতের হৃদয়জড়ানো
এমন যে বিমল করুণা–
দিন দিন বুক ফেটে যায়,
দিন দিন দেখিবারে পাই,
যারে ভালোবাসি প্রাণপণে
সে করুণা তার মনে নাই।
পরের নয়নজলে তার না হৃদয় গলে,
দুখেরে সে করে উপহাস,
দুখেরে সে করে অবিশ্বাস।
দেখিয়া হৃদয় মোর তরাসে শিহরি উঠে,
প্রেমের কোমল প্রাণে শত শত শেল ফুটে,
হৃদয় কাতর হয়ে নয়ন মুদিতে চায়,
কাঁদিয়া সে বলে, ” হায় হায়,
এ তো নহে আমার দেবতা,
তবে কেন রয়েছে হেথায়?”
তুমি নও সে জন তো নও,
তবে তুমি কোথা হতে এলে?
এলে যদি এসো তবে কাছে,
এ হৃদয়ে যত অশ্রু আছে
একবার সব দিই ঢেলে,
তোমার সে কঠিন পরান
যদি তাহে একতিল গলে,
কোমল হইয়া আসে মন
সিক্ত হয়ে অশ্রুজলে-জলে।
কাঁদিবারে শিখাই তোমায়–
পরদুঃখে ফেলিতে নিশ্বাস,
করুণার সৌন্দর্য অতুল
ও নয়নে করে যেন বাস।
প্রতিদিন দেখিয়াছি আমি
করুণারে করেছ পীড়ন,
প্রতিদিন ওই মুখ হতে
ভেঙে গেছে রূপের মোহন।
কুবলয়-আঁখির মাঝারে
সৌন্দর্য পাই না দেখিবারে,
হাসি তব আলোকের প্রায়
কোমলতা নাহি যেন তায়,
তাই মন প্রতিদিন কহে,
“নহে নহে, এ জন সে নহে।”
শোনো বন্ধু, শোনো, আমি করুণারে ভালোবাসি।
সে যদি না থাকে তবে ধূলিময় রূপরাশি।
তোমারে যে পূজা করি, তোমারে যে দিই ফুল,
ভালোবাসি বলে যেন কখনো কোরো না ভুল।
যে জন দেবতা মোর কোথা সে আছে না জানি,
তুমি তো কেবল তার পাষাণপ্রতিমাখানি।
তোমার হৃদয় নাই, চোখে নাই অশ্রু-ধার,
কেবল রয়েছে তব পাষাণ-আকার তার।
দুদিন (dudin)
আরম্ভিছে শীতকাল, পরিছে নীহারজাল,
শীর্ণ বৃক্ষশাখা যত ফুলপত্রহীন,
মৃতপ্রায় পৃথিবীর মুখের উপরে
বিষাদে প্রকৃতিমাতা শুভ্র বাম্পজালে-গাঁথা
কুজ্ঝটি-বসনখানি দেছেন টানিয়া।
পশ্চিমে গিয়েছে রবি, স্তব্ধ সন্ধ্যাবেলা
বিদেশে আসিনু শ্রান্ত পথিক একেলা।
রহিনু দুদিন।
এখনো রয়েছে শীত, বিহব গাহে না গীত,
এখনো ঝরিছে পাতা, পড়িছে তুহিন।
বসন্তের প্রাণভরা চুম্বন-পরশে
সর্ব অঙ্গ শিহরিয়া পুলকে-আকুল-হিয়া
মৃত্যুশয়্যা হতে ধরা জাগে নি হরষে।
এক দিন দুই দিন ফুরাইল শেষে,
আবার উঠিতে হল, চলিনু বিদেশে।
এই-যে ফিরানু মুখ, চলিনু পুরবে,
আর কি রে এ জীবনে ফিরে আসা হবে।
কত মুখ দেখিয়াছি দেখিব না আর।
ঘটনা ঘটিবে কত, বরষ বরষ শত
জিবনের ‘পর দিয়া হয়ে যাবে পার–
হয়তো-বা একদিন অতি দূর দেশে,
আছিয়াছে সন্ধ্যা হয়ে, বাতাস যেতেছে বয়ে,
একেলা নদীর ধারে রহিয়াছি বসে–
হু হু করে উঠিবেক সহসা এ হিয়া,
সহসা এ মেঘাচ্ছন্ন স্মৃতি উজলিয়া
একটি অস্ফুট রেখা–সহসা দিবে যে দেখা,
একটি মুখের ছবি উঠিবে জাগিয়া,
একটি গানের ছত্র পড়িবেক মনে,
দু-একটি সুর তার উদিবে স্মরণে,
অবশেষে একেবারে সহসা সবলে
বিস্মৃতির বাঁধগুলি ভাঙিয়া চুর্ণিয়া ফেলি
সেদিনের কথাগুলি বন্যার মতন
একেবারে বিপ্লাবিয়া ফেলিবে এ মন।
শতফুলদলে গড়া সেই মুখ তার
স্বপনেতে প্রতিনিশি হৃদয়ে উদিবে আসি
এলানো আকুল কেশে, আকুল নয়নে।
সেই মুখ সঙ্গী মোর হইবে বিজনে
নিশীথের অন্ধকার আকাশের পটে
নক্ষত্র-গ্রহের মতো উঠবেক ফুটে
ধীরে ধীরে রেখা রেখা সেই মুখ তার
নিঃশব্দে মুখের পানে চাহিয়া আমার।
চমকি উঠিব জাগি শুনি ঘুমঘোরে
“যাবে তবে? যাবে?” সেই ভাঙা-ভাঙা স্বরে।
ফুরাল দুদিন–
শরতে যে শাখা হয়েছিল পত্রহীন
এ দু’দিনে সে শাথা উঠে নি মুকুলিয়া,
অচল শিখর-‘পরি যে তুষার ছিল পড়ি
এ দুদিনে কণা তার যায় নি গলিয়া,
কিন্তু এ দু’দিন তার শত বাহু দিয়া
চিরটি জীবন মোর রহিবে বেষ্টিয়া।
দু’দিনের পদচিহ্ন চিরদিন-তরে
অঙ্কিত রহিবে শত বরষের শিরে।
পরাজয়-সঙ্গীত (paraajay sangeet)
ভালো করে যুঝিলি নে, হল তোরি পরাজয়–
কী আর ভাবিতেছিস, ম্রিয়মাণ, হা হৃদয়!
কাঁদ্ তুই, কাঁদ্ ,হেথা আয়,
একা বসে বিজনে বিদেশে।
জানিতাম জানিতাম হা রে
এমনি ঘটিবে অবশেষে।
সংসারে যাহারা ছিল সকলেই জয়ী হল,
তোরি শুধু হল পরাজয়–
প্রতি রণে প্রতি পদে একে একে ছেড়ে দিলি
জীবনের রাজ্য সমুদয়।
যতবার প্রতিজ্ঞা করিলি
ততবার পড়িল টুটিয়া,
ছিন্ন আশা বাঁধিয়া তুলিলি
বার বার পড়িল লুটিয়া ।
“সান্ত্বনা সান্ত্বনা” করি ফিরি
সান্ত্বনা কি মিলিল রে মন?
জুড়াইতে ক্ষত বক্ষঃস্থল
ছুরিরে করিলি আলিঙ্গন।
ইচ্ছা,সাধ, আশা যাহা ছিল
অদৃষ্ট সকলি লুটে নিল।
মনে হইতেছে আজি জীবন হারায়ে গেছে,
মরণ হারায়ে গেছে হায়!
কে জানে এ কী এ ভাব? শূন্যপানে চেয়ে আছি
মৃত্যুহীন মরণের প্রায়।
পরাজিত এ হৃদয় জীবনের দুর্গ মম
মরণে করিল সমর্পণ,
তাই আজ জীবনে মরণ!
জাগ্ জাগ্ জাগ্ ওরে, গ্রাসিতে এসেছে তোরে
নিদারুণ শূন্যতার ছায়া,
আকাশ-গরাসী তার কায়া।
গেল তোর চন্দ্র সূর্য, গেল তোর গ্রহ তারা,
গেল,তোর আত্ম আর পর।
এই বেলা প্রাণপণ কর্।
এইবেলা ফিরে দাঁড়া তুই,
স্রোতোমুখে ভাসিস নে আর।
যাহা পাস আঁকড়িয়া ধর্–
সম্মুখে অসীম পারাবার,
সম্মুখেতে চির অমানিশি,
সম্মুখেতে মরণ বিনাশ!
গেল, গেল, বুঝি নিয়ে গেল
আবর্ত করিল বুঝি গ্রাস!
শিশির (shishir)
শিশির কাঁদিয়া শুধু বলে,
“কেন মোর হেন ক্ষুদ্র প্রাণ–
শিশুটির কল্পনার মতো
জনমি অমনি অবসান?
ঘুম-ভাঙা উষা-মেয়েটির
একটি সুখের অশ্রু হায়,
হাসি তার ফুরাতে ফুরাতে
এ অশ্রুটি শুকাইয়া যায়।
টুকটুকে মুখখানি নিয়ে
গোলাপ হাসিছে মুচকিয়ে,
বকুল প্রাণের সুধা দিয়ে,
বায়ুর মাতাল করি তুলে–
প্রজাপতি ভাবিয়া না পায়
কাহারে তাহার প্রাণ চায়,
তুলিয়া অলস পাখা দুটি
ভ্রমিতেছে ফুল হতে ফুলে–
সেই হাসি-রাশির মাঝারে
আমি কেন থাকিতে না পাই!
যেমনি নয়ন মেলি, হায়,
সুখের নিমেষটির প্রায়,
অতৃপ্ত হাসিটি মুখে লয়ে
অমনি কেন গো মরে যাই।”
শুয়ে শুয়ে অশোক-পাতায়
মুমূর্ষু শিশির বলে,”হায়,
কোনো সুখ ফুরায় নি যার
তার কেন জীবন ফুরায়?”
“আমি কেন হই নি শিশির?”
কহে কবি নিশ্বাস ফেলিয়া।
“প্রভাতেই যেতেম শুকায়ে
প্রভাতেই নয়ন মেলিয়া।
হে বিধাতা, শিশিরের মতো
গড়েছ আমার এই প্রাণ,
শিশিরের মরণটি কেন
আমারে কর নি তবে দান?”
সংগ্রাম-সংগীত (sangraam sangeet)
হৃদয়ের সাথে আজি
করিব রে করিব সংগ্রাম।
এতদিন কিছু না করিনু
এতদিন বসে রহিলাম,
আজি এই হৃদয়ের সাথে
একবার করিব সংগ্রাম।
বিদ্রোহী এ হৃদয় আমার
জগৎ করিছে ছারখার।
গ্রাসিছে চাঁদের কায়া ফেলিয়া আঁধার ছায়া
সুবিশাল রাহুর আকার।
মেলিয়া আঁধার গ্রাস দিনেরে দিতেছে ত্রাস
মলিন করিছে মুখ তার।
উষার মুখের হাসি লয়েছে কাড়িয়া,
গভীর বিরামময় সন্ধ্যার প্রাণের মাঝে
দুরন্ত অশান্তি এক দিয়াছে ছাড়িয়া।
প্রাণ হতে মুছিতেছে অরুণের রাগ,
দিতেছে প্রাণের মাঝে কলঙ্কের দাগ।
প্রাণের পাখির গান দিয়াছে থামায়ে,
বেড়ায় যে সাধগুলি মেঘের দোলায় দুলি
তাদের দিয়াছে হায় ভূতলে নামায়ে।
ক্রমশই বিছাইছে অন্ধকার পাখা,
আঁখি হতে সবকিছু পড়িতেছে ঢাকা।
ফুল ফুটে, আমি আর দেখিতে না পাই,
পাখী গাহে, মোর কাছে গাহে না সে আর;
দিন হল, আলো হল, তবু দিন নাই,
আমি শুধু নেহারি পাখার অন্ধকার।
মিছা বসে রহিব না আর
চরাচর হারায় আমার।
রাজ্যহারা ভিখারির সাজে
দগ্ধ ধ্বংস-ভস্ম-‘পরি ভ্রমিব কি হাহা করি
জগতের মরুভূমি-মাঝে?
আজ তবে হৃদয়ের সাথে
একবার করিব সংগ্রাম।
ফিরে নেব, কেড়ে নেব আমি
জগতের একেকটি গ্রাম।
ফিরে নেব রষিশশীতারা,
ফিরে নেব সন্ধ্যা আর উষা
পৃথিবীর শ্যামল যৌবন,
কাননের ফুলময় ভূষা।
ফিরে নেব হারানো সংগীত,
ফিরে নেব মৃতের জীবন,
জগতের ললাট হইতে
আঁধার করিব প্রক্ষালন।
আমি হব সংগ্রামে বিজয়ী,
হৃদয়ের হবে পরাজয়,
জগতের দূর হবে ভয়।
হৃদয়েরে রেখে দেব বেঁধে,
বিরলে মরিবে কেঁদে কেঁদে।
দুঃখে বিঁধি কষ্টে বিঁধি জর্জর করিব হৃদি–
বন্দী হয়ে কাটাবে দিবস,
অবশেষে হইবে সে বশ,
জগতে রটিবে মোর যশ।
বিশ্বচরাচরময় উচ্ছ্বসিবে জয় জয়,
উল্লাসে পুরিবে চারি ধার,
গাবে রবি, গাবে শশী, গাবে তারা শূন্যে বসি,
গাবে বায়ু শত শত বার।
চারি দিকে দিবে হুলুধ্বনি,
বরষিষে কুসুম-আসার,
বেঁধে দেব বিজয়ের মালা
শান্তিময় ললাটে আমার।
আমি-হারা (aami haaraa)
হায় হায়,
জীবনের তরুণ বেলায়,
কে ছিল রে হৃদয়-মাঝারে,
দুলিত রে অরুণ-দোলায়!
হাসি তার ললাটে ফুটিত,
হাসি তার ভাসিত নয়নে,
হাসি তার ঘুমায়ে পড়িত
সুকোমল অধরশয়নে।
ঘুমাইলে, নন্দনবালিকা
গেঁথে দিত স্বপনমালিকা;
জাগরণে, নয়নে তাহার
ছায়াময় স্বপন জাগিত;
আশা তার পাখা প্রসারিয়া
উড়ে যেত উধাও হইয়া,
চাঁদের পায়ের কাছে গিয়ে
জ্যোৎস্নাময় অমৃত মাগিত।
বনে সে তুলিত শুধু ফুল,
শিশির করিত শুধু পান,
প্রভাতের পাখিটির মতো
হরষে করিত শুধু গান।
কে গো সেই, কে গো হায় হায়,
জীবনের তরুণ বেলায়
খেলাইত হৃদয়-মাঝারে
দুলিত রে অরুণ-দোলায়?
সচেতন অরুণকিরণ
কে সে প্রাণে এসেছিল নামি?
সে আমার শৈশবের কুঁড়ি,
সে আমার সুকুমার আমি।
প্রতিদিন বাড়িল আঁধার,
পথমাঝে উড়িল রে ধূলি,
হৃদয়ের অরণ্য-আঁধারে
দুজনে আইনু পথ ভুলি।
নয়নে পড়িছে তার রেণু,
শাখা বাজে সুকুমার কায়,
ঘন ঘন বহিছে নিশ্বাস
কাঁটা বিঁধে সুকোমল পায়।
ধুলায় মলিন হল দেহ,
সভয়ে মলিন হল মুখ
কেঁদে সে চাহিল মুখপানে
দেখে মোর ফেটে গেলে বুক।
কেঁদে সে কহিল মুখ চাহি,
“ওগো মোরে আনিলে কোথায়?
পায় পায় বাজিতেছে বাধা,
তরুশাখা লাগিছে মাথায়।
চারি দিকে মলিন আঁধার,
কিছু হেথা নাহি যে সুন্দর,
কোথা গো শিশির-মাখা ফুল,
কোথা গো প্রভাতরবিকর?”
কেঁদে কেঁদে সাথে সে চলিল,
কহিল সে সকরুণ স্বর,
“কোথা গো শিশির-মাখা ফুল,
কোথা গো প্রভাত রবিকর।”
প্রতিদিন বাড়িল আঁধার
পথ হল পঙ্কিল মলিন–
মুখে তার কথাটিও নাই,
দেহ তার হল বলহীন।
অবশেষে একদিন, কেমনে, কোথায়, কবে
কিছুই যে জানি নে গো হায়,
হারাইয়া গেল সে কোথায়।
রাখো দেব, রাখো, মোরে রাখো,
তোমার স্নেহেতে মোরে ঢাকো
আজি চারি দিকে মোর এ কী অন্ধকার ঘোর,
একবার নাম ধরে ডাকো।
পারি না যে সামালিতে, কাঁদি গো আকুল চিতে,
কত রব মৃত্তিকা বহিয়া।
ধূলিময় দেহখানি ধুলায় আনিছে টানি,
ধুলায় দিতেছে ঢাকি হিয়া।
হারায়েছি আমার আমারে,
আজি আমি ভ্রমি অন্ধকারে।
কখনো বা সন্ধ্যাবেলা আমার পুরানো সাথি
মুহূর্তের তরে আসে প্রাণে,
চারি দিকে নিরখে নয়ানে।
প্রণয়ীর শ্মশানেতে একেলা বিরলে আসি
প্রণয়ী যেমন কেঁদে যায়,
নিজের সমাধি-‘পরে নিজে বসি উপছায়া
যেমন নিশ্বাস ফেলে হায়,
কুসুম শুকায়ে গেলে যেমন সৌরভ তার
কাছে কাছে কাঁদিয়া বেড়ায়,
সুখ ফুরাইয়া গেলে একটি মলিন হাসি
অধরে বসিয়া কেঁদে চায়,
তেমনি সে আসে প্রাণে– চায় চারি দিক-পানে,
কাঁদে, আর কেঁদে চলে যায়।
বলে শুধূ, “কী ছিল, কী হল,
সে-সব কোথায় চলে গেল!”
বহুদিন দেখি নাই তারে,
আসে নি এ হৃদয়-মাঝারে।
মনে করি মনে আনি তার সেই মুখখানি,
ভালো করে মনে পড়িছে না।
হৃদয়ে যে ছবি ছিল ধুলায় মলিন হল,
আর তাহা নাহি যায় চেনা।
ভুলে গেছি কী খেলা খেলিত,
ভুলে গেছি কী কথা বলিত।
যে গান গাহিত সদা সুর তার মনে আছে,
কথা তার নাহি পড়ে মনে।
যে আশা হৃদয়ে লয়ে উড়িত সে মেঘ চেয়ে
আর তাহা পড়ে না স্মরণে।
শুধু যবে হৃদি-মাঝে চাই
মনে পড়ে–কী ছিল, কী নাই।
গান-সমাপন (gaan samaapan)
জনমিয়া এ সংসারে কিছুই শিখি নি আর,
শুধু গাই গান।
স্নেহময়ী মার কাছে শৈশবে শিখিয়াছিনু।
দু-একটি তান।
শুধু জানি তাই,
দিবানিশি তাই শুধু গাই।
শতছিদ্রময় এই হৃদয়-বাঁশিটি লয়ে।
বাজাই সতত–
দূঃখের কঠোর স্বর রাগিনী হইয়া যায়,
মৃদূল নিশ্বাসে পরিণত।
আঁধার জলদ যেন ইন্দ্রধনু হয়ে যায়।
ভুলে যাই সকল যাতনা।
ভালো যদি না লাগে সে গান
ভালো সখা, তাও গাহিব না।
এমন পণ্ডিত কত রয়েছেন শত শত
এ সংসারতলে,
আকাশের দৈতাবালা উন্মাদিনী চপলারে
বেঁধে রাখে দাসত্বের লোহার শিকলে।
আকাশ ধরিয়া হাতে নক্ষত্র-অক্ষর দেখি
গ্রন্থ পাঠ করিছেন তাঁরা,
জ্ঞানের বন্ধন যত ছিন্ন করে দিতেছেন
ভাঙি ফেলি অতীতের কারা।
আমি তার কিছুই করি না,
আমি তার কিছুই জানি না।
এমন মহান্ এ সংসারে
জ্ঞানরত্নরাশির মাঝারে
আমি দীন শুধু গান গাই,
তোমাদের মুখপানে চাই।
ভালো যদি না লাগে সে গান
ভালো সখা, তাও গাহিব না।
বড়ো ভয় হয়, পাছে কেহই না দেখে তারে
যে জন কিছুই শেখে নাই।
ওগো সখা, ভয়ে ভয়ে তাই
যাহা জানি সেই গান গাই,
তোমাদের মুখপানে চাই।
শ্রান্ত দেহ হীনবল, নয়নে পড়িছে জল,
রক্ত ঝরে চরণে আমার,
নিশ্বাস বহিছে বেগে, হৃদয়-বাঁশিটি মম
বাজে না বাজে না বুঝি আর।
দিন গেল, সন্ধ্যা গেল, কেহ দেখিলে না চেয়ে।
যত গান গাই।
বুঝি কারো অবসর নাই।
বুঝি কারো ভালো নাহি লাগে–
ভালো সখা, আর গাহিব না।
উপহার (upahaar)
ভুলে গেছি কবে তুমি ছেলেবেলা একদিন
মরমের কাছে এসেছিলে,
স্নেহময় ছায়াময় সন্ধ্যাসম আঁখি মেলি
একবার বুঝি হেসেছিলে।
বুঝি গো সন্ধ্যার কাছে শিখেছে সন্ধ্যার মায়া
ওই আঁখি দুটি–
চাহিলে হৃদয়পানে মরমেতে পড়ে ছায়া,
তারা উঠে ফুটি।
আগে কে জানিত বলো কত কী লুকানো ছিল
হৃদয়নিভৃতে,
তোমার নয়ন দিয়া আমার নিজের হিয়া
পাইনু দেখিতে।
কখনো গাও নি তুমি কেবল নীরবে রহি
শিখায়েছ গান–
স্বপ্নময় শান্তিময় পূরবীরাগিনী-তানে
বাঁধিয়াছ প্রাণ।
আকাশের পানে চাই, সেই সুরে গান গাই
একেলা বসিয়া।
একে একে সুরগুলি, অনন্তে হারায়ে যায়
আঁধারে পশিয়া।
বলো দেখি কতদিন আস নি এ শূন্য প্রাণে।
বলো দেখি কতদিন চাও নি হৃদয়পানে,
বলো দেখি কতদিন শোনো নি এ মোর গান–
তবে সখী গান-গাওয়া হল বুঝি অবসান।
যে রাগ শিখায়েছিলে সে কি আমি গেছি ভুলে?
তার সাথে মিলিছে না সুর?
তাই কি আস না প্রাণে, তাই কি শোন না গান–
তাই সখী, রয়েছ কি দূর?
ভালো সখী, আবার শিখাও,
আরবার মুখপানে চাও,
একবার ফেলো অশ্রুজল,
আঁখিপানে দুটি আঁখি তুলি।
তা হলে পুরানো সুর আবার পড়িবে মনে,
আর কভু যাইব না ভুলি।
সেই পুরাতন চোখে মাঝে মাঝে চেয়ো সখী,
উজলিয়া স্মৃতির মন্দির।
এই পুরাতন প্রাণে মাঝে মাঝে এসো সখী,
শূন্য আছে প্রাণের কুটির।
নহিলে আঁধার মেঘরাশি
হৃদয়ের আলোক নিবাবে,
একে একে ভুলে যাব সুর,
গান গাওয়া সাঙ্গ হয়ে যাবে।
সন্ধ্যা (byathaa barho baajiyaachhe praane)
ব্যথা বড়ো বাজিয়াছে প্রাণে,
সন্ধ্যা তুই ধীরে ধীরে আয়!
কাছে আয়–আরো কাছে আয়–
সঙ্গীহারা হৃদয় আমার
তোর বুকে লুকাইতে চায়।
আমার ব্যথার তুই ব্যথী,
তুই মোর একমাত্র সাথী,
সন্ধ্যা তুই আমার আলয়,
তোরে আমি বড়ো ভালবাসি–
সারাদিন ঘুরে ঘুরে ঘুরে
তোর কোলে ঘুমাইতে আসি,
তোর কাছে ফেলি রে নিশ্বাস,
তোর কাছে কহি মনোকথা,
তোর কাছে করি প্রসারিত
প্রাণের নিভৃত নীরবতা।
তোর গান শুনিতে শুনিতে
তোর তারা গুনিতে গুনিতে,
নয়ন মুদিয়া আসে মোর,
হৃদয় হইয়া আসে ভোর–
স্বপন-গোধূলিময় প্রাণ
হারায় প্রাণের মাঝে তোর!
একটি কথাও নাই মুখে,
চেয়ে শুধু রোস মুখপানে
অনিমেষ আনত নয়ানে।
ধীরে শুধু ফেলিস নিশ্বাস,
ধীরে শুধু কানে কানে গাস
ঘুম-পাড়াবার মৃদু গান,
কোমল কমল কর দিয়ে
ঢেকে শুধু দিস দুনয়ান,
ভুলে যাই সকল যাতনা
জুড়াইয়া আসে মোর প্রাণ!
তাই তোরে ডাকি একবার
সঙ্গীহারা হৃদয় আমার,
তোর বুকে লুকাইয়া মাথা
তোর কোলে ঘুমাইতে চায়,
সন্ধ্যা তুই ধীরে ধীরে আয়।
আঁধার আঁচল দিয়ে তোর
আমার দুখেরে ঢেকে রাখ,
বল তারে ঘুমাইতে বল
কপালেতে হাতখানি রাখ,
জগতেরে ক’রে দে আড়াল,
কোলাহল করিয়া দে দূর–
দুখেরে কোলেতে করে নিয়ে
র’চে দে নিভৃত অন্তঃপুর।
তা হলে সে কাঁদিবে বসিয়া,
কল্পনার খেলেনা গড়িবে,
খেলিয়া আপন মনে কাঁদিয়া কাঁদিয়া, শেষে
আপনি সে ঘুমায়ে পড়িবে।
আয় সন্ধ্যা ধীরে ধীরে আয়,
হাতে লয়ে স্বপনের ডালা
গুন্ গুন্ মন্ত্র পড়ি পড়ি
গাঁথিয়া দে স্বপনের মালা,
জড়ায়ে দে আমার মাথায়,
স্নেহ-হস্ত বুলায়ে দে গায়!
স্রোতস্বিনী ঘুমঘোরে, গাবে কুলু কুলু করে
ঘুমেতে জড়িত আধো গান,
ঝিল্লিরা ধরিবে একতান,
দিনশ্রমে শ্রান্ত বায়ু গৃহমুখে যেতে যেতে
গান গাবে অতি মৃদু স্বরে,
পদশব্দ শুনি তার তন্দ্রা ভাঙি লতা পাতা
র্ভৎসনা করিবে মরমরে।
ভাঙা ভাঙা গানগুলি মিলিয়া হৃদয়-মাঝে
মিশে যাবে স্বপনের সাথে,
নানাবিধ রূপ ধরি ভ্রমিয়া বেড়াবে তারা,
হৃদয়ের গুহাতে গুহাতে!
আয় সন্ধ্যা ধীরে ধীরে আয়,
আন তোর স্বর্ণ মেঘজাল,
পশ্চিমের সুবর্ণ প্রাঙ্গণে
খেলিবি মেঘের ইন্দ্রজাল!
ওই তোর ভাঙা মেঘগুলি,
হৃদয়ের খেলেনা আমার,
ওইগুলি কোলে করে নিয়ে
সাধ যায় খেলি অনিবার।
ওই তোর জলদের ‘পর
বাঁধি আমি কত শত ঘর!
সাধ যায় হোথায় লুটাই,
অস্তগামী রবির মতন,
লুটায়ে লুটায়ে পড়ি শেষে
সাগরের ওই প্রান্তদেশে
তরল কনক নিকেতন!
ছোটো ছোটো ওই তারাগুলি,
ডাকে মোরে আঁখি-পাতা খুলি।
স্নেহময় আঁখিগুলি যেন
আছে শুধু মোর পথ চেয়ে,
সন্ধ্যার আঁধারে বসি বসি
কহে যেন গান গেয়ে গেয়ে,
“কবে তুমি আসিবে হেথায়
অন্ধকার নিভৃত-নিলয়ে,
জগতের অতি প্রান্তদেশে
প্রদীপটি রেখেছি জ্বালায়ে!
বিজনেতে রয়েছি বসিয়া
কবে তুমি আসিবে হেথায়!’
সন্ধ্যা হলে মোর মুখ চেয়ে
তারাগুলি এই গান গায়!
আয় সন্ধ্যা ধীরে ধীরে আয়,
জগতের নয়ন ঢেকে দে–
আঁধার আঁচল পেতে দিয়ে
কোলেতে মাথাটি রেখে দে!
কেন গান গাই (kena gaan gaai)
গুরুভার মন লয়ে কত বা বেড়াবি ব’য়ে?
এমন কি কেহ তোর নাই,
যাহার হৃদয়-‘পরে মিলিবে মুহূর্ত তরে
হৃদয়টি রাখিবার ঠাঁই?
“কেহ না, কেহ না!’
সংসারে যে দিকে ফিরে চাই
এমন কি কেহ তোর নাই–
তোর দিন শেষ হলে, স্মৃতিখানি লয়ে কোলে,
শোয়াইয়া বিষাদের কোমল শয়নে,
বিমল শিশির-মাখা প্রেম-ফুলে দিয়ে ঢাকা
চেয়ে রবে আনত নয়নে?
হৃদয়েতে রেখে দিবে তুলে,
প্রতিদিন ঢেকে দিবে ফুলে,
মনোমাঝে প্রবেশিয়ে বিন্দু বিন্দু অশ্রু দিয়ে
বৃন্ত-ছিন্ন প্রেম-ফুলগুলি
রাখিবেক জিয়াইয়া তুলি?
এমন কি কেহ তোর নাই?
“কেহ না, কেহ না!’
প্রাণ তুই খুলে দিলি ভালোবাসা বিলাইলি
কেহ তাহা তুলে না লইল,
ভূমিতলে পড়িয়া রহিল;
ভালোবাসা কেন দিলি তবে
কেহ যদি কুড়ায়ে না লবে?
কেন সখা কেন?
“জানি না, জানি না!’
বিজনে বনের মাঝে ফুল এক আছে ফুটে
শুধাইতে গেনু তার কাছে,
“ফুল, তুই এ আঁধারে পরিমল দিস কারে,
এ কাননে কে বা তোর আছে!
যখন পড়িবি তুই ঝরে,
শুকাইয়া দলগুলি ধূলিতে হইবে ধূলি,
মনে কি করিবে কেহ তোরে!
তবে কেন পরিমল ঢেলে দিস অবিরল
ছোটো মনখানি ভ’রে ভ’রে?
কেন, ফুল, কেন?
সেও বলে, “জানি না। জানি না!’
সখা, তুমি গান গাও কেন?
কেহ যদি শুনিতে না চায়?
ওই দেখো পথমাঝে যে যাহার নিজ কাজে
আপনার মনে চলে যায়।
কেহ যদি শুনিতে না চায়
কেন তবে, কেন গাও গান,
আকাশে ঢালিয়া দাও প্রাণ?
গান তব ফুরাইবে যবে,
রাগিণী কারো কি মনে রবে?
বাতাসেতে স্বরধার খেলিয়াছে অনিবার,
বাতাসে সমাধি তার হবে।
কাহারো মনেও নাহি রবে,
কেন সখা গান গাও তবে?
কেন, সখা, কেন?
“জানি না, জানি না!’
বিজন তরুর শাখে একাকি পাখিটি ডাকে,
শুধাইতে গেনু তার কাছে,
“পাখি তুই এ আঁধারে গান শুনাইবি কারে?
এ কাননে কে বা তোর আছে!
যখনি ফুরাবে তোর প্রাণ,
যখনি থামিবে তোর গান,
বন ছিল যেমন নীরবে,
তেমনি নীরব পুন হবে।
যেমনি থামিবে গীত, অমনি সে সচকিত
প্রতিধ্বনি আকাশে মিলাবে,
তোর গান তোরি সাথে যাবে!
আকাশে ঢালিয়া দিয়া প্রাণ,
তবে, পাখি, কেন গাস গান?
কেন, পাখি, কেন?
সেও বলে, “জানি না, জানি না!’
কেন গান শুনাই (kena gaan shunaai)
এসো সখি, এসো মোর কাছে,
কথা এক শুধাবার আছে!
চেয়ে তব মুখপানে ব’সে এই ঠাঁই–
প্রতিদিন যত গান তোমারে শুনাই,
বুঝিতে কি পার সখি কেন যে তা গাই?
শুধু কি তা পশে কানে? কথাগুলি তার
কোথা হতে উঠিতেছে ভাবো একবার?
বুঝ না কি হৃদয়ের
কোন্খানে শেল ফুটে
তবে প্রতি কথাগুলি
আর্তনাদ করি উঠে!
যখন নয়নে উঠে বিন্দু অশ্রুজল,
তখন কি তাই তুই দেখিস কেবল?
দেখ না কি কী সমুদ্র হৃদয়েতে উথলিছে,
শুধু কণামাত্র তার আঁখিপ্রান্তে বিগলিছে!
যখন একটি শুধু উঠে রে নিশ্বাস,
তখন কি তাই শুধু শুনিবারে পাস?
শুনিস না কী ঝটিকা হৃদয়ে বেড়ায় ছুটে
একটি উচ্ছ্বাস শুধু বাহিরেতে ফুটে!
যে কথাটি বলি আমি শোনো শুধু তাই?
শোনো না কি যত কথা বলা হইল না?
যত কথা বলিবারে চাই?
আমি কি শুনাই গান
ভালো মন্দ করিতে বিচার?
যবে এ নয়ন হতে বহে অশ্রুধার–
শুধু কি রে দেখিবি তখন
সে অশ্রু উজ্জ্বল কি না হীরার মতন?
আমার এ গান তোরে যখন শুনাই
নিন্দা বা প্রশংসা আমি কিছু নাহি চাই–
যে হৃদি দিয়েছি তোরে
তাই তোরে দেখাবারে চাই,
তারি ভাষা বুঝাবারে চাই,
তারি ব্যথা জানাবারে চাই,
আর কিবা চাই?
সেই হৃদি দেখিলি যখন,
তারি ভাষা বুঝিলি যখন,
তারি ব্যথা জানিলি যখন
তখন একটি বিন্দু অশ্রুবারি চাই!
(আর কিবা চাই! )
আয় সখি কাছে মোর আয়,
কথা এক শুধাব তোমায়–
এত গান শুনালেম এত অনুরাগে
কথা তার বুকে কি লো লাগে?
একটি নিশ্বাস কি লো জাগে?
কথা শুধু শুনিয়া কি যাস?
ভালো মন্দ বুঝিস কেবল?
প্রাণের ভিতর হতে
উঠে না একটি অশ্রুজল?
বিষ ও সুধা (bishh o sudhaa)
অস্ত গেল দিনমণি। সন্ধ্যা আসি ধীরে
দিবসের অন্ধকার সমাধির ‘পরে
তারকার ফুলরাশি দিল ছড়াইয়া।
সাবধানে অতি ধীরে নায়ক যেমন
ঘুমন্ত প্রিয়ার মুখ করয়ে চুম্বন,
দিন-পরিশ্রমে ক্লান্ত পৃথিবীর দেহ
অতি ধীরে পরশিল সায়াহ্নের বায়ু।
দুরন্ত তরঙ্গগুলি যমুনার কোলে
সারাদিন খেলা করি পড়েছে ঘুমায়ে।
ভগ্ন দেবালয়খানি যমুনার ধারে,
শিকড়ে শিকড়ে তার ছায়ি জীর্ণ দেহ
বট অশত্থের গাছ জড়াজড়ি করি
আঁধারিয়া রাখিয়াছে ভগন হৃদয়,
দুয়েকটি বায়ূচ্ছ্বাস পথ ভুলি গিয়া
আঁধার আলয়ে তার হয়েছে আটক,
অধীর হইয়া তারা হেথায় হোথায়
হু হু করি বেড়াইছে পথ খুঁজি খুঁজি!
শুন সন্ধ্যে! আবার এসেছি আমি হেথা,
নীরব আঁধারে তব বসিয়া বসিয়া
তটিনীর কলধ্বনি শুনিতে এয়েছি।
হে তটিনী, ও কি গান গাইতেছ তুমি!
দিন নাই, রাত্রি নাই, এক তানে শুধু
এক সুরে এক গান গাইছ সতত–
এত মৃদুস্বরে ধীরে, যেন ভয় করি
সন্ধ্যার প্রশান্ত স্বপ্ন ভেঙে যায় পাছে!
এ নীরব সন্ধ্যাকালে তব মৃদু গান
একতান ধ্বনি তব শুনে মনে হয়
এ হৃদি-গানেরি যেন শুনি প্রতিধ্বনি!
মনে হয় যেন তুমি আমারি মতন
কী এক প্রাণের ধন ফেলেছ হারায়ে।
এসো স্মৃতি, এসো তুমি এ ভগ্ন হৃদয়ে–
সায়াহ্ন-রবির মৃদু শেষ রশ্মিরেখা
যেমন পড়েছে ওই অন্ধকার মেঘে
তেমনি ঢালো এ হৃদে অতীত-স্বপন!
কাঁদিতে হয়েছে সাধ বিরলে বসিয়া,
কাঁদি একবার, দাও সে ক্ষমতা মোরে!
যাহা কিছু মনে পড়ে ছেলেবেলাকার
সমস্ত মালতীময়–মালতী কেবল
শৈশবকালের মোর স্মৃতির প্রতিমা।
দুই ভাই বোনে মোরা আছিনু কেমন!
আমি ছিনু ধীর শান্ত গম্ভীর-প্রকৃতি,
মালতী প্রফুল্ল অতি সদা হাসি হাসি।
ছিল না সে উচ্ছ্বসিনী নির্ঝরিণী সম
শৈশব-তরঙ্গবেগে চঞ্চলা সুন্দরী,
ছিল না সে লজ্জাবতী লতাটির মতো
শরম-সৌন্দর্যভরে ম্রিয়মাণ-পারা।
আছিল সে প্রভাতের ফুলের মতন,
প্রশান্ত হরষে সদা মাখানো মুখানি;
সে হাসি গাহিত শুধু উষার সংগীত–
সকলি নবীন আর সকলি বিমল।
মালতীর শান্ত সেই হাসিটির সাথে
হৃদয়ে জাগিত যেন প্রভাত পবন,
নূতন জীবন যেন সঞ্চরিত মনে!
ছেলেবেলাকার যত কবিতা আমার
সে হাসির কিরণেতে উঠেছিল ফুটি।
মালতী ছুঁইত মোর হৃদয়ের তার,
তাইতে শৈশব-গান উঠিত বাজিয়া।
এমনি আসিত সন্ধ্যা; শ্রান্ত জগতেরে
স্নেহময় কোলে তার ঘুম পাড়াইতে।
সুবর্ণ-সলিলসিক্ত সায়াহ্ন-অম্বরে
গোধূলির অন্ধকার নিঃশব্দ চরণে
ছোটো ছোটো তারাগুলি দিত ফুটাইয়া,
নন্দনবনের যেন চাঁপা ফুল দিয়ে
ফুলশয্যা সাজাইত সুরবালাদের।
মালতীরে লয়ে পাশে আসিতাম হেথা;
সন্ধ্যার সংগীতস্বরে মিলাইয়া স্বর
মৃদুস্বরে শুনাতেম শৈশব-কবিতা।
হর্ষময় গর্বে তার আঁখি উজলিত–
অবাক ভক্তির ভাবে ধরি মোর হাত
একদৃষ্টে মুখপানে রহিত চাহিয়া।
তার সে হরষ হেরি আমারো হৃদয়ে
কেমন মধুর গর্ব উঠিত উথলি!
ক্ষুদ্র এক কুটির আছিল আমাদের,
নিস্তব্ধ-মধ্যাহ্নে আর নীরব সন্ধ্যায়
দূর হতে তটিনীর কলস্বর আসি
শান্ত কুটিরের প্রাণে প্রবেশিয়া ধীরে
করিত সে কুটিরের স্বপন রচনা।
দুই জনে ছিনু মোরা কল্পনার শিশু–
বনে ভ্রমিতাম যবে, সুদূর নির্ঝরে
বনশ্রীর পদধ্বনি পেতাম শুনিতে।
যাহা কিছু দেখিতাম সকলেরি মাঝে
জীবন্ত প্রতিমা যেন পেতেম দেখিতে!
কত জোছনার রাত্রে মিলি দুই জনে
ভ্রমিতাম যমুনার পুলিনে পুলিনে,
মনে হত এ রজনী পোহাতে চাবে না,
সহসা কোকিল-রব শুনিয়া উষায়,
সহসা যখনি শ্যামা গাহিয়া উঠিত,
চমকিয়া উঠিতাম, কহিতাম মোরা,
“এ কী হোল! এরি মধ্যে পোহাল রজনী!’
দেখিতাম পূর্ব দিকে উঠেছে ফুটিয়া
শুকতারা, রজনীর বিদায়ের পথে,
প্রভাতের বায়ু ধীরে উঠিছে জাগিয়া,
আসিছে মলিন হয়ে আঁধারের মুখ।
তখন আলয়ে দোঁহে আসিতাম ফিরি,
আসিতে আসিতে পথে শুনিতাম মোরা
গাইছে বিজনকুঞ্জে বউ-কথা-কও।
ক্রমশ বালককাল হল অবসান,
নীরদের প্রেমদৃষ্টে পড়িল মালতী,
নীরদের সাথে তার হইল বিবাহ।
মাঝে মাঝে যাইতাম তাদের আলয়ে;
দেখিতাম মালতীর শান্ত সে হাসিতে
কুটিরেতে রাখিয়াছে প্রভাত ফুটায়ে!
সঙ্গীহারা হয়ে আমি ভ্রমিতাম একা,
নিরাশ্রয় এ-হৃদয় অশান্ত হইয়া
কাঁদিয়া উঠিত যেন অধীর উচ্ছ্বাসে।
কোথাও পেত না যেন আরাম বিশ্রাম।
অন্যমনে আছি যবে, হৃদয় আমার
সহসা স্বপন ভাঙি উঠিত চমকি।
সহসা পেত না ভেবে, পেত না খুঁজিয়া
আগে কী ছিল রে যেন এখন তা নাই।
প্রকৃতির কি-যেন কী গিয়াছে হারায়ে
মনে তাহা পড়িছে না। ছেলেবেলা হতে
প্রকৃতির যেই ছন্দ এসেছি শুনিয়া
সেই ছন্দোভঙ্গ যেন হয়েছে তাহার,
সেই ছন্দে কী কথার পড়েছে অভাব–
কানেতে সহসা তাই উঠিত বাজিয়া,
হৃদয় সহসা তাই উঠিত চমকি।
জানি না কিসের তরে, কী মনের দুখে
দুয়েকটি দীর্ঘশ্বাস উঠিত উচ্ছ্বসি।
শিখর হতে শিখরে, বন হতে বনে,
অন্যমনে একেলাই বেড়াতাম ভ্রমি–
সহসা চেতন পেয়ে উঠিয়া চমকি
সবিস্ময়ে ভাবিতাম, কেন ভ্রমিতেছি,
কেন ভ্রমিতেছি তাহা পেতেম না ভাবি!
একদিন নবীন বসন্ত-সমীরণে
বউ-কথা-কও যবে খুলেছে হৃদয়,
বিষাদে সুখেতে মাখা প্রশান্ত কী ভাব
প্রাণের ভিতরে যবে রয়েছে ঘুমায়ে,
দেখিনু বালিকা এক, নির্ঝরের ধারে
বনফুল তুলিতেছে আঁচল ভরিয়া।
দুপাশে কুন্তলজাল পড়েছে এলায়ে,
মুখেতে পড়েছে তার উষার কিরণ।
কাছেতে গেলাম তার, কাঁটা বাছি ফেলি
কানন-গোলাপ তারে দিলাম তুলিয়া।
প্রতিদিন সেইখানে আসিত দামিনী
তুলিয়া দিতাম ফুল, শুনাতেম গান,
কহিতাম বালিকারে কত কী কাহিনী,
শুনি সে হাসিত কভু, শুনিত না কভু,
আমি ফুল তুলে দিলে ফেলিত ছিঁড়িয়া।
ভর্ৎসনার অভিনয়ে কহিত কত কী!
কভু বা ভ্রূকুটি করি রহিত বসিয়া,
হাসিতে হাসিতে কভু যাইত পলায়ে,
অলীক শরমে কভু হইত অধীর।
কিন্তু তার ভ্রূকুটিতে, শরমে, সংকোচে,
লুকানো প্রেমেরি কথা করিত প্রকাশ!
এইরূপে প্রতি উষা যাইত কাটিয়া।
একদিন সে-বালিকা না আসিত যদি
হৃদয় কেমন যেন হইত বিকল–
প্রভাত কেমন যেন যেত না কাটিয়া–
দিন যেত অতি ধীরে নিরাশ-চরণে!
বর্ষচক্র আর বার আসিল ফিরিয়া,
নূতন বসন্তে পুনঃ হাসিল ধরণী,
প্রভাতে অলস ভাবে, বসি তরুতলে,
দামিনীরে শুধালেম কথায় কথায়
“দামিনী, তুমি কি মোরে ভালোবাস বালা?’
অলীক-শরম-রোষে ভ্রূকুটি করিয়া
ছুটে সে পলায়ে গেল দূর বনান্তরে–
জানি না কী ভাবি পুনঃ ছুটিয়া আসিয়া
“ভালোবাসি– ভালোবাসি–‘ কহিয়া অমনি
শরমে-মাখানো মুখ লুকালো এ বুকে।
এইরূপে দিন যেত স্বপ্ন-খেলা খেলি।
কত ক্ষুদ্র অভিমানে কাঁদিত বালিকা,
কত ক্ষুদ্র কথা লয়ে হাসিত হরষে–
কিন্তু জানিতাম কি রে এই ভালোবাসা
দুদিনের ছেলেখেলা, আর কিছু নয়?
কে জানিত প্রভাতের নবীন কিরণে
এমন শতেক ফুল উঠে রে ফুটিয়া
প্রভাতের বায়ু সনে খেলা সাঙ্গ হলে
আপনি শুকায়ে শেষে ঝরে পড়ে যায়–
ওই ফুলে থুয়েছিনু হৃদয়ের আশা,
ওই কুসুমের সাথে খসে পড়ে গেল!
আর কিছুকাল পরে এই দামিনীরে
যে কথা বলিয়াছিনু আজো মনে আছে।
“দামিনী, মনে কি পড়ে সে দিনের কথা?
বলো দেখি কত দিন ওই মুখখানি
দেখি নি তোমার? তাই দেখিতে এয়েছি!
জোছনার রাত্রে যবে বসেছি কাননে,
দুয়েকটি তারা কভু পড়িছে খসিয়া,
হতবুদ্ধি দুয়েকটি পথহারা মেঘ
অনন্ত আকাশ-রাজ্যে ভ্রমিছে কেবল,
সে নিস্তব্ধ রজনীতে হৃদয়ে যেমন
একে একে সব কথা উঠে গো জাগিয়া,
তেমনি দেখিনু যেই ওই মুখখানি
স্মৃতি-জাগরণকারী রাগিণীর মতো
ওই মুখখানি তব দেখিনু যেমনি
একে একে পুরাতন সব স্মৃতিগুলি
জীবন্ত হইয়া যেন জাগিল হৃদয়ে।
মনে আছে সেই সখি আর-এক দিন
এমনি গম্ভীর সন্ধ্যা, এই নদীতীর,
এইখানে এই হাত ধরিয়া তোমার
কাতরে কহেছি আমি নয়নের জলে,
“বিদায় দাও গো এবে চলিনু বিদেশে,
দেখো সখি এত দিন বাসিয়াছ ভালো,
দুদিন না দেখে যেন যেয়ো না ভুলিয়া!
সংসারের কর্ম হতে অবসর লয়ে
আবার ফিরিয়া যবে আসিব দামিনী,
নব-অতিথির মতো ভেবো না আমারে
সম্ভ্রমের অভিনয় কোরো না বালিকা!’
কিছুই উত্তর তার দিলে না তখন,
শুধু মুখপানে চেয়ে কাতর নয়নে
ভর্ৎসনার অশ্রুজল করিলে বর্ষণ।
যেন এই নিদারুণ সন্দেহের মোর
অশ্রুজল ছাড়া আর নাইকো উত্তর!
আবার কহিনু আমি ওই মুখ চেয়ে,
“কে জানে মনের মধ্যে কি হয়েছে মোর
আশঙ্কা হতেছে যেন হৃদয়ে আমার
ওই স্নেহ-সুধামাখা মুখখানি তোর
এ জনমে আর বুঝি পাব না দেখিতে।’
নীরব গম্ভীর সেই সন্ধ্যার আঁধারে
সমস্ত জগৎ যেন দিল প্রতিধ্বনি
“এ জনমে আর বুঝি পাব না দেখিতে।’
গভীর নিশীথে যথা আধো ঘুমঘোরে
সুদূর শ্মশান হতে মরণের রব
শুনিলে হৃদয় উঠে কাঁপিয়া কেমন,
তেমনি বিজন সেই তটিনীর তীরে
একাকী আঁধারে যেন শুনিনু কী কথা,
সমস্ত হৃদয় যেন উঠিল শিহরি!
আর বার কহিলাম, “বিদায়–ভুলো না।’
তখন কি জানিতাম এই নদীতীরে
এই সন্ধ্যাকালে আর তোমারি সমুখে
এমনি মনের দুখে হইবে কাঁদিতে?
তখনো আমার এই বাল্যজীবনের
প্রভাত-নীরদ হতে নব-রক্তরাগ
যায় নি মিলায়ে সখি, তখনো হৃদয়
মরীচিকা দেখিতেছিল দূর শূন্যপটে।
নামিনু সংসারক্ষেত্রে যুঝিনু একাকী,
যাহা কিছু চাহিলাম পাইনু সকলি।
তখন ভাবিনু যাই প্রেমের ছায়ায়
এতদিনকার শ্রান্তি যাবে দূর হয়ে।
সন্ধ্যাকালে মরুভূমে পথিক যেমন
নিরখিয়া দেখে যবে সম্মুখে পশ্চাতে
সুদূরে দেখিতে পায় প্রান্ত দিগন্তের
সুবর্ণ জলদজালে মণ্ডিত কেমন,
সে-দিকে তারকাগুলি চুম্বিছে প্রান্তর,
সায়াহ্নবালার সেথা পূর্ণতম শোভা,
কিন্তু পদতলে তার অসীম বালুকা
সারাদিন জ্বলি জ্বলি তপন-কিরণে
ফেলিছে সায়াহ্নকালে জ্বলন্ত নিশ্বাস।
তেমনি এ সংসারের পথিক যাহারা
ভবিষ্যৎ অতীতের দিগন্তের পানে
চাহি দেখে স্বর্গ সেথা হাসিছে কেবল
পদতলে বর্তমান মরুভূমি সম।
স্মৃতি আর আশা ছাড়া সত্যকার সুখ
মানুষের ভাগ্যে সখি ঘটে নাকো বুঝি!
বিদেশ হইতে যবে আইসে ফিরিয়া
অতি হতভাগা যেও সেও ভাবে মনে
যারে যারে ভালোবাসে সকলেই বুঝি
রহিয়াছে তার তরে আকুল-হৃদয়ে!
তেমনি কতই সখি করেছিনু আশা,
মনে মনে ভেবেছিনু কত-না হরষে
দামিনী আমার বুঝি তৃষিতনয়নে
পথপানে চেয়ে আছে আমারি আশায়।
আমি গিয়ে কব তারে হরষে কাঁদিয়া,
“মুছ অশ্রুজল সখি, বহু দিন পরে
এসেছে বিদেশ হতে ললিত তোমার’।
অমনি দামিনী বুঝি আহ্লাদে উথলি
নীরব অশ্রুর জলে কবে কত কথা।
ফিরিয়া আসিনু যবে–এ কী হল জ্বালা!
কিছুতে নয়নজল নারি সামালিতে।
ফেরো ফেরো চাহিয়ো না এ আঁখির পানে,
প্রাণে বাজে অশ্রুজল দেখাতে তোমায়!
জেনো গো রমণি, জেনো, এত দিন পরে
কাঁদিয়া প্রণয় ভিক্ষা করিতে আসি নি,
এ অশ্রু দুঃখের অশ্রু– এ নহে ভিক্ষার!
কখনো কখনো সখি অন্য মনে যবে
সুবিজন বাতায়নে রয়েছ বসিয়া
সম্মুখে যেতেছে দেখা বিজন প্রান্তর
হেথা হোথা দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন কুটির
হু হু করি বহিতেছে যমুনার বায়ু–
তখন কি সে-দিনের দুয়েকটি কথা
সহসা মনের মধ্যে উঠে না জাগিয়া?
কখন যে জাগি উঠে পার না জানিতে!
দূরতম রাখালের বাঁশিস্বর সম
কভু কভু দুয়েকটি ভাঙা-ভাঙা সুর
অতি মৃদু পশিতেছে শ্রবণবিবরে;
আধো জেগে আধো ঘুমে স্বপ্ন আধো-ভোলা–
তেমনি কি সে-দিনের দুয়েকটি কথা
সহসা মনের মধ্যে উঠে না জাগিয়া?
স্মৃতির নির্ঝর হতে অলক্ষ্যে গোপনে,
পথহারা দুয়েকটি অশ্রুবারিধারা
সহসা পড়ে না ঝরি নেত্রপ্রান্ত হতে,
পড়িছে কি না পড়িছে পার না জানিতে!
একাকী বিজনে কভু অন্য মনে যবে
বসে থাকি, কত কী যে আইসে ভাবনা,
সহসা মুহূর্ত-পরে লভিয়া চেতন
কী কথা ভাবিতেছিনু নাহি পড়ে মনে
অথচ মনের মধ্যে বিষণ্ণ কী ভাব
কেমন আঁধার করি রহে যেন চাপি,
হৃদয়ের সেই ভাবে কখনো কি সখি
সে-দিনের কোনো ছায়া পড়ে না স্মরণে?
ছেলেবেলাকার কোনো বন্ধুর মরণ
স্মরিলে যেমন লাগে হৃদয়ে আঘাত,
তেমনি কি সখি কভু মনে নাহি হয়
সে-সকল দিন কেন গেল গো চলিয়া
যে দিন এ-জন্মে আর আসিবে না ফিরি!
পুরাতন বন্ধু তারা, কত কাল আহা
খেলা করিয়াছি মোরা তাহাদের সাথে,
কত সুখে হাসিয়াছি দুঃখে কাঁদিয়াছি,
সে-সকল সুখ দুঃখ হাসি কান্না লয়ে
মিশাইয়া গেল তারা আঁধার অতীতে!
চলিনু দামিনী পুনঃ চলিনু বিদেশে–
ভাবিলাম একবার দেখিব মুখানি,
একবার শুনাইব মরমের ব্যথা,
তাই আসিয়াছি সখি, এ জনমে আর
আসিব না দিতে তব শান্তিতে ব্যাঘাত,
এ জন্মের তরে সখি কহো একবার
একটি স্নেহের বাণী অভাগার ‘পরে,
ভ্রমিয়া বেড়াব যবে সুদূর বিদেশে
সে-কথার প্রতিধ্বনি বাজিবে হৃদয়ে!’
থামো স্মৃতি–থামো তুমি, থামো এইখানে,
সম্মুখে তোমার ও কি দৃশ্য মর্মভেদী?
মালতী তোমার সেই প্রাণের ভগিনী,
শৈশবকালের মোর খেলাবার সাথী
যৌবনকালের মোর আশ্রয়ের ছায়া,
প্রতি দুঃখ প্রতি সুখ প্রতি মনোভাব
যার কাছে না বলিলে বুক যেত ফেটে,
সেই সে মালতী মোর হয়েছে বিধবা!
আপনার দুঃখে মগ্ন স্বার্থপর আমি
ভালো করে পারিনু না করিতে সান্ত্বনা!
নিজের চোখের জলে অন্ধ এ নয়নে
পরের চোখের জল পেনু না দেখিতে!
ছেলেবেলাকার সেই পুরানো কুটিরে
হাসিতে হাসিতে এল মালতী আমার,
সে-হাসির চেয়ে ভালো তীব্র অশ্রুজল!
কে জানিত সে-হাসির অন্তরে অন্তরে
কালরাত্রি অন্ধকার রয়েছে লুকায়ে!
একদিনো বলে নি সে কোনো দুঃখ-কথা,
একদিনো কাঁদে নি সে সমুখে আমার!
জানি জানি মালতী সে স্বর্গের দেবতা!
নিজের প্রাণের বহ্নি করিয়া গোপন,
পরের চোখের জল দিত সে মুছায়ে।
ছেলেবেলাকার সেই হাসিটি তাহার
সমস্ত আনন তার রাখিত উজ্জ্বলি,
কত-না করিত যত্ন করিত সান্ত্বনা।
হাসিতে হাসিতে কত করিত আদর!
কিন্তু হা, শ্মশানে যথা চাঁদের জোছনা
শ্মশানের ভীষণতা বাড়ায় দ্বিগুণ–
মালতীর সেই হাসি দেখিয়া তেমনি
নিজের এ হৃদয়ের ভগ্ন-অবশেষ
দ্বিগুণ পড়িত যেন নয়নে আমার!
তাহার আদর পেয়ে ভুলিনু যাতনা,
কিন্তু হায়, দেখি নাই, বিজন-শয্যায়
কত দিন কাঁদিয়াছে মালতী গোপনে!
সে যখন দেখিত, তাহার বাল্যসখা
দিনে দিনে অবসাদে হইছে মলিন,
দিনে দিনে মন তার যেতেছে ভাঙিয়া,
তখন আকুলা বালা রাত্রে একাকিনী
কাঁদিয়া দেবতা কাছে করেছে প্রার্থনা–
বালিকার অশ্রুময় সে প্রার্থনাগুলি
আর কেহ শুনে নাই অন্তর্যামী ছাড়া!
দেখি নাই কত রাত্রি একাকিনী গিয়া
যমুনার তীরে বসি কাঁদিত বিরলে!
একাকিনী কেঁদে কেঁদে হইত প্রভাত,
এলোথেলো কেশপাশে পড়িত শিশির,
চাহিয়া রহিত উষা ম্লান মুখপানে!
বিষময়, বহ্নিময়, বজ্রময় প্রেম,
এ স্নেহের কাছে তুই ঢাক মুখ ঢাক।
তুই মরণের কীট, জীবনের রাহু,
সৌন্দর্য-কুসুম-বনে তুই দাবানল,
হৃদয়ের রোগ তুই, প্রাণের মাঝারে
সতত রাখিস তুই পিপাসা পুষিয়া,
ভুজঙ্গ বাহুর পাকে মর্ম জড়াইয়া
কেবলি ফেলিস তুই বিষাক্ত নিশ্বাস,
আগ্নেয় নিশ্বাসে তোর জ্বলিয়া জ্বলিয়া
হৃদয়ে ফুটিতে থাকে তপ্ত রক্তস্রোত।
জরজর কলেবর, আবেশে অসাড়,
শিথিল শিরার গ্রন্থি, অচেতন প্রাণ,
স্খলিত জড়িত বাণী, অবশ নয়ন,
আশা ও নিরাশা-পাকে ঘুরিছে হৃদয়,
ঘুরিছে চোখের ‘পরে জগতসংসার!
এই প্রেম, এই বিষ, বজ্র-হতাশন
কবে রে পৃথিবী হতে যাবে দূর হয়ে!
আয় স্নেহ, আয় তোর স্নিগ্ধসুধা ঢালি
এ জ্বলন্ত বহ্নিরাশি দে রে নিবাইয়া!
অগ্নিময় বৃশ্চিকের আলিঙ্গন হতে,
সুধাসিক্ত কোলে তোর তুলে নে তুলে নে!
প্রেম-ধূমকেতু ওই উঠেছে আকাশে,
ঝলসি দিতেছে, হায়, যৌবনের আঁখি,
কোথা তুমি ধ্রুবতারা ওঠো একবার,
ঢালো এ জ্বলন্ত নেত্রে স্নিগ্ধ-মৃদু-জ্যোতি।
তুমি সুধা, তুমি ছায়া, তুমি জ্যোৎস্নাধারা,
তুমি স্রোতস্বিনী, তুমি উষার বাতাস,
তুমি হাসি, তুমি আশা, মৃদু অশ্রুজল,
এসো তুমি এ প্রেমেরে দাও নিভাইয়া।
একটি মালতী যার আছে এ সংসারে
সহস্র দামিনী তার ধূলিমুষ্টি নয়!
ক্রমশ হৃদয় মোর এল শান্ত হয়ে
যন্ত্রণা বিষাদে আসি হল পরিণত।
নিস্তরঙ্গ সরসীর প্রশান্ত হৃদয়ে
নিশীথের শান্ত বায়ু ভ্রমে গো যখন,
এত শান্ত এত মৃদু পদক্ষেপ তার
একটি চরণচিহ্ন পড়ে না সরসে,
তেমনি প্রশান্ত হৃদে প্রশান্ত বিষাদ
ফেলিতে লগিল ধীরে মৃদুল নিশ্বাস।
নিরখিয়া নিদারুণ ঝটিকার মাঝে
হাসিময় শান্ত সেই মালতী কুসুমে
ক্রমশ হৃদয় মোর এল শান্ত হয়ে।
কিন্তু হায় কে জানিত সেই হাসিময়
সুকুমার ফুলটির মর্মের মাঝারে
মরণের কীট পশি করিতেছে ক্ষয়!
হইল প্রফুল্লতর মুখখানি তার,
হইল প্রশান্ততর হাসিটি তাহার,
দিবা যবে যায় যায়, হাসিময় মেঘে
দূর আঁধারের মুখ করয়ে উজ্জ্বল–
এ হাসি তেমনি হাসি কে জানিত তাহা!
একদা পূর্ণিমারাত্রে নিস্তব্ধ গভীর
মুখপানে চেয়ে বালা, হাত ধরি মোর
কহিল মৃদুলস্বরে–“যাই তবে ভাই!’
কোথা গেলি–কোথা গেলি মালতী আমার
অভাগা ভ্রাতারে তোর রাখিয়া হেথায়!
দুঃখের কণ্টকময় সংসারের পথে
মালতী, কে লয়ে যাবে হাত ধরি মোর?
সংসারের ধ্রুবতারা ডুবিল আমার।
তেমন পূর্ণিমা রাত্রি দেখি নি কখনো,
পৃথিবী ঘুমাইতেছে শান্ত জোছনায়;
কহিনু পাগল হয়ে– “রাক্ষসী পৃথিবী
এত রূপ তোরে কভু সাজে না সাজে না!’
মালতী শুকায়ে গেল, সুবাস তাহার
এখনো রয়েছে কিন্তু ভরিয়া কুটির।
তাহার মনের ছায়া এখনো যেন রে
সে কুটিরে শান্তিরসে রেখেছে ডুবায়ে!
সে শান্ত প্রতিমা মম মনের মন্দির
রেখেছে পবিত্র করি রেখেছে উজ্জ্বলি!