রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশাত্মবোধক কবিতা l Famous Patriotic Poem by Rabindranath Tagore in Bengali 2024

By raateralo.com

Published on:

Patriotic Poem by Rabindranath Tagore in Bengali 2024 l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশাত্মবোধক কবিতা

Patriotic Poem by Rabindranath Tagore in Bengali 2024: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশাত্মবোধক কবিতা বাংলা সাহিত্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে দেশপ্রেমের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। তাঁর কবিতাগুলি কেবল সাহিত্যিক উৎকর্ষের নিদর্শন নয়, বরং জাতীয় চেতনার প্রতীক, যা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এবং তার পরেও মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা যেমন “ভারত-তীর্থ,” “বঙ্গমাতা,” এবং “সার্থক জনম আমার” জাতীয়তাবাদী চেতনায় পরিপূর্ণ এবং এক নতুন সূর্যোদয়ের আশ্বাস বহন করে।

আধুনিক সমাজে, রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক কবিতাগুলি আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই কবিতাগুলি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও মূল্যবোধের বীজ বপন করতে পারে। সামাজিক আন্দোলন বা ব্যক্তিগত সংগ্রামের সময়ে, এই কবিতাগুলি আমাদের মনোবলকে উজ্জীবিত করে এবং ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করতে অনুপ্রাণিত করে। এমনকি দৈনন্দিন জীবনে এই কবিতাগুলি আমাদের চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে, আমাদের মধ্যে মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা ও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলে।

Patriotic Poem by Rabindranath Tagore in Bengali 2024 l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশাত্মবোধক কবিতা

সার্থক জনম আমার

সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।
সার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে ॥
জানি নে তোর ধনরতন আছে কি না রানীর মতন,
শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে ॥
কোন্‌ বনেতে জানি নে ফুল গন্ধে এমন করে আকুল,
কোন্‌ গগনে ওঠে রে চাঁদ এমন হাসি হেসে।
আঁখি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়ালো,
ওই আলোতেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে ॥

বঙ্গমাতা
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালোছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে।
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।


ও আমার দেশের মাটি

ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা ॥
তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে,
তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে,
তোমার ওই শ্যামলবরন কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা ॥
ওগো মা, তোমার কোলে জনম আমার, মরণ তোমার বুকে।
তোমার ‘পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে।
তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে,
তুমি শীতল জলে জুড়াইলে,
তুমি যে সকল-সহা সকল-বহা মাতার মাতা ॥
ও মা, অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা–
তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!
আমার জনম গেল বৃথা কাজে,
আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে–
তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা ॥

বাংলার মাটি বাংলার জল

বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল–
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ॥
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ–
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান ॥
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা–
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান ॥
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন–
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান ॥

জনগণমন-অধিনায়ক

জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ
তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিস মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে ॥

অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী
পরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা।
জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে ॥

পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রী।
হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।
দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে
সঙ্কটদুঃখত্রাতা।
জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥

ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে
জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।
দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে
স্নেহময়ী তুমি মাতা।
জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে ॥

রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে–
গাহে বিহঙ্গম, পুণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।
তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে
তব চরণে নত মাথা।
জয় জয় জয় হে, জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা!
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে ॥

অক্ষমা
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


যেখানে এসেছি আমি, আমি সেথাকার,
দরিদ্র সন্তান আমি দীন ধরণীর।
জন্মাবধি যা পেয়েছি সুখদুঃখভার
বহু ভাগ্য বলে তাই করিয়াছি স্থির।
অসীম ঐশ্বর্যরাশি নাই তোর হাতে,
হে শ্যামলা সর্বসহা জননী মৃন্ময়ী।
সকলের মুখে অন্ন চাহিস জোগাতে,
পারিস নে কত বার — ‘কই অন্ন কই ‘
কাঁদে তোর সন্তানেরা ম্লান শুষ্ক মুখ।
জানি মা গো , তোর হাতে অসম্পূর্ণ সুখ—
যা কিছু গড়িয়া দিস ভেঙে ভেঙে যায় ,
সব-তাতে হাত দেয় মৃত্যু সর্বভুক ,
সব আশা মিটাইতে পারিস নে হায়—
তা বলে কি ছেড়ে যাব তোর তপ্ত বুক!

হোক্‌ ভারতের জয়

এসো এসো ভ্রাতৃগণ! সরল অন্তরে
সরল প্রীতির ভরে
সবে মিলি পরস্পরে
আলিঙ্গন করি আজ বহুদিন পরে।
এসেছে জাতীয় মেলা ভারতভূষণ,
ভারত সমাজে তবে
হৃদয় খুলিয়া সবে
এসো এসো এসো করি প্রিয়সম্ভাষণ।
দূর করো আত্মভেদ বিপদ-অঙ্কুর,
দূর করো মলিনতা
বিলাসিতা অলসতা,
হীনতা ক্ষীণতা দোষ করো সবে দূর।
ভীরুতা বঙ্গীয়জন-কলঙ্ক-প্রধান —
সে-কলঙ্ক দূর করো,
সাহসিক তেজ ধরো,
স্বকার্যকুশল হও হয়ে একতান।
হল না কিছুই করা যা করিতে এলে —
এই দেখো হিন্দুমেলা,
তবে কেন কর হেলা?
কী হবে কী হবে আর তুচ্ছ খেলা খেলে?
সাগরের স্রোতসম যাইছে সময়।
তুচ্ছ কাজে কেন রও,
স্বদেশহিতৈষী হও —
স্বদেশের জনগণে দাও রে অভয়।
নাহি আর জননীর পূর্বসুতগণ —
হরিশ্চন্দ্র যুধিষ্ঠির
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ বীর,
অনন্তজলধিতলে হয়েছে মগন।

নাহি সেই রাম আদি সম্রাট প্রাচীন,
বিক্রম-আদিত্যরাজ,
কালিদাস কবিরাজ,
পরাশর পারাশর পণ্ডিত প্রবীণ।
সকলেই জল বায়ু তেজ মৃত্তিকায়
মিশাইয়া নিজদেহ
অনন্ত ব্রহ্মের গেহ
পশেছে কীর্তিরে শুধু রাখিয়ে ধরায়।
আদরে সে প্রিয় সখী আচ্ছাদি গগনে
সে লোকবিশ্রুত নাম
সে বিশ্ববিজয়ী ধাম
নির্ঘোষে ঘুষিছে সদা অখিল ভুবনে।
যবনের রাজ্যকালে কীর্তির আধার
চিতোর-নগর নাম
অতুলবীরত্বধাম,
কেমন ছিল রে মনে ভাবো একবার।
এইরূপ কত শত নগর প্রাচীন
সুকীর্তি-তপন-করে
ভারত উজ্জ্বল ক’রে
অনন্ত কালের গর্ভে হয়েছে বিলীন।
নাহি সেই ভারতের একতা-বিভব,
পাষাণ বাঁধিয়া গলে
সকলের পদতলে
লুটাইছে আর্যগণ হইয়া নীরব।
গেল, হায়, সব সুখ অভাগী মাতার —
ছিল যত মনোআশা
নিল কাল সর্বনাশা,
প্রসন্ন বদন হল বিষণ্ণ তাঁহার।
কী আর হইবে মাতা খুলিয়া বদন।
দীপ্তভানু অস্ত গেল,
এবে কালরাত্রি এল,বসনে আবরি মুখ কাঁদো সর্বক্ষণ।
বিশাল অপার সিন্ধু, গভীর নিস্বনে
যেখানে যেখানে যাও
কাঁদিতে কাঁদিতে গাও —
ডুবিল ভারতরবি অনন্ত জীবনে।
সুবিখ্যাত গৌড় যেই বঙ্গের রতন —
তার কীর্তিপ্রতিভায়
খ্যাতাপন্ন এ ধরায়
হয়েছিল একদিন বঙ্গবাসিগণ।
গেল সে বঙ্গের জ্যোতিঃ কিছুকাল পরে —
কোনো চিহ্ন নাহি তার,
পরিয়া হীনতাহার,
ডুবিয়াছে এবে বঙ্গ কলঙ্কসাগরে।
হিন্দুজনভ্রাতৃগণ! করি হে বিনয় —
একতা উৎসাহ ধরো,
জাতীয় উন্নতি করো,
ঘুষুক ভুবনে সবে ভারতের জয়।
জগদীশ! তুমি, নাথ, নিত্য-নিরাময়
করো কৃপা বিতরণ,
অধিবাসিজনগণ,
করুক উন্নতি — হোক্‌ ভারতের জয়!

অবর্জিত
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমি চলে গেলে ফেলে রেখে যাব পিছু
চিরকাল মনে রাখিবে, এমন কিছু,
মূঢ়তা করা তা নিয়ে মিথ্যে ভেবে।
ধুলোর খাজনা শোধ করে নেবে ধুলো,
চুকে গিয়ে তবু বাকি রবে যতগুলো
গরজ যাদের তারাই তা খুঁজে নেবে।
আমি শুধু ভাবি, নিজেরে কেমনে ক্ষমি–
পুঞ্জ পুঞ্জ বকুনি উঠেছে জমি,
কোন্‌ সৎকারে করি তার সদ্‌গতি।
কবির গর্ব নেই মোর হেন নয়–
কবির লজ্জা পাশাপাশি তারি রয়,
ভারতীর আছে এই দয়া মোর প্রতি।
লিখিতে লিখিতে কেবলি গিয়েছি ছেপে,
সময় রাখি নি ওজন দেখিতে মেপে,
কীর্তি এবং কুকীর্তি গেছে মিশে।
ছাপার কালিতে অস্থায়ী হয় স্থায়ী,
এ অপরাধের জন্যে যে-জন দায়ী
তার বোঝা আজ লঘু করা যায় কিসে।
বিপদ ঘটাতে শুধু নেই ছাপাখানা,
বিদ্যানুরাগী বন্ধু রয়েছে নানা–
আবর্জনারে বর্জন করি যদি
চারি দিক হতে গর্জন করি উঠে,
“ঐতিহাসিক সূত্র দিবে কি টুটে,
যা ঘটেছে তারে রাখা চাই নিরবধি।”
ইতিহাস বুড়ো, বেড়াজাল তার পাতা,
সঙ্গে রয়েছে হিসাবের মোটা খাতা–
ধরা যাহা পড়ে ফর্দে সকলি আছে।
হয় আর নয়, খোঁজ রাখে শুধু এই,
ভালোমন্দর দরদ কিছুই নেই,
মূল্যের ভেদ তুল্য তাহার কাছে।
বিধাতাপুরুষ ঐতিহাসিক হলে
চেহারা লইয়া ঋতুরা পড়িত গোলে,
অঘ্রাণ তবে ফাগুন রহিত ব্যেপে।
পুরানো পাতারা ঝরিতে যাইত ভুলে,
কচি পাতাদের আঁকড়ি রহিত ঝুলে,
পুরাণ ধরিত কাব্যের টুঁটি চেপে।
জোড়হাত করে আমি বলি, “শোনো কথা,
সৃষ্টির কাজে প্রকাশেরি ব্যগ্রতা,
ইতিহাসটারে গোপন করে সে রাখে।
জীবনলক্ষ্মী মেলিয়া রঙের রেখা
ধরার অঙ্গে আঁকিছে পত্রলেখা,
ভূতত্ত্ব তার কঙ্কালে ঢাকা থাকে।
বিশ্বকবির লেখা যত হয় ছাপা
প্রুফ্‌শিটে তার দশগুণ পড়ে চাপা,
নব এডিশনে নূতন করিয়া তুলে।
দাগি যাহা, যাহে বিকার, যাহাতে ক্ষতি,
মমতামাত্র নাহি তো তাহার প্রতি–
বাঁধা নাহি থাকে ভুলে আর নির্ভুলে।
সৃষ্টির কাজ লুপ্তির সাথে চলে,
ছাপাযন্ত্রের ষড়যন্ত্রের বলে
এ বিধান যদি পদে পদে পায় বাধা–
জীর্ণ ছিন্ন মলিনের সাথে গোঁজা
কৃপণপাড়ার রাশীকৃত নিয়ে বোঝা
সাহিত্য হবে শুধু কি ধোপার গাধা।
যাহা কিছু লেখে সেরা নাহি হয় সবি,
তা নিয়ে লজ্জা না করুক কোনো কবি–
প্রকৃতির কাজে কত হয় ভুলচুক;
কিন্তু, হেয় যা শ্রেয়ের কোঠায় ফেলে
তারেও রক্ষা করিবার ভূতে পেলে
কালের সভায় কেমনে দেখাবে মুখ।
ভাবী কালে মোর কী দান শ্রদ্ধা পাবে,
খ্যাতিধারা মোর কত দূর চলে যাবে,
সে লাগি চিন্তা করার অর্থ নাহি।
বর্তমানের ভরি অর্ঘ্যের ডালি
অদেয় যা দিনু মাখায়ে ছাপার কালি
তাহারি লাগিয়া মার্জনা আমি চাহি।

আমাদের ছোট নদী
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।
আর-পারে আমবন তালবন চলে,
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।
সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।
বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।
আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।

আমার সোনার বাংলা
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে–
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো–
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে–
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি ॥
তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে,
তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে–
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি ॥
ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে,
সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে–
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি ॥
ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে–
দে গো তোর পায়ের ধূলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
মরি হায়, হায় রে–
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব’লে গলার ফাঁসি ॥

গৃহশত্রু
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আমি একাকিনী যবে চলি রাজপথে
নব অভিসারসাজে,
নিশীথে নীরব নিখিল ভুবন,
না গাহে বিহগ, না চলে পবন,
মৌন সকল পৌর ভবন
সুপ্তনগরমাঝে–
শুধু আমার নূপুর আমারি চরণে
বিমরি বিমরি বাজে।
অধীর মুখর শুনিয়া সে স্বর
পদে পদে মরি লাজে।
আমি চরণশব্দ শুনিব বলিয়া
বসি বাতায়নকাছে–
অনিমেষ তারা নিবিড় নিশায়,
লহরীর লেশ নাহি যমুনায়,
জনহীন পথ আঁধারে মিশায়,
পাতাটি কাঁপে না গাছে–
শুধু আমারি উরসে আমারি হৃদয়
উলসি বিলসি নাচে।
উতলা পাগল করে কলরোল,
বাঁধন টুটিলে বাঁচে।
আমি কুসুমশয়নে মিলাই শরমে,
মধুর মিলনরাতি–
স্তব্ধ যামিনী ঢাকে চারিধার,
নির্বাণ দীপ, রুদ্ধ দুয়ার,
শ্রাবণগগন করে হাহাকার
তিমিরশয়ন পাতি–
শুধু আমার মানিক আমারি বক্ষে
জ্বালায়ে রেখেছে বাতি।
কোথায় লুকাই, কেমনে নিবাই
নিলাজ ভূষণভাতি।
আমি আমার গোপন মরমের কথা
রেখেছি মরমতলে।
মলয় কহিছে আপন কাহিনী,
কোকিল গাহিছে আপন রাগিণী,
নদী বহি চলে কাঁদি একাকিনী
আপনার কলকলে–
শুধু আমার কোলের আমারি বীণাটি
গীতঝংকারছলে
যে কথা যখন করিব গোপন
সে কথা তখনি বলে।

ঝড়ের দিনে
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আজি এই আকুল আশ্বিনে
মেঘে-ঢাকা দুরন্ত দুর্দিনে
হেমন্ত-ধানের খেতে বাতাস উঠেছে মেতে,
কেমনে চলিবে পথ চিনে?
আজি এই দুরন্ত দুর্দিনে!
দেখিছ না ওগো সাহসিকা,
ঝিকিমিকি বিদ্যুতের শিখা!
মনে ভেবে দেখো তবে এ ঝড়ে কি বাঁধা রবে
কবরীর শেফালিমালিকা।
ভেবে দেখো ওগো সাহসিকা!
আজিকার এমন ঝঞ্ঝায়
নূপুর বাঁধে কি কেহ পায়?
যদি আজি বৃষ্টির জল ধুয়ে দেয় নীলাঞ্চল
গ্রামপথে যাবে কি লজ্জায়
আজিকার এমন ঝঞ্ঝায়?
হে উতলা শোনো কথা শোনো,
দুয়ার কি খোলা আছে কোনো?
এ বাঁকা পথের শেষে মাঠ যেথা মেঘে মেশে
বসে কেহ আছে কি এখনো?
এ দুর্যোগে, শোনো ওগো শোনো!
আজ যদি দীপ জ্বালে দ্বারে
নিবে কি যাবে না বারে বারে?
আজ যদি বাজে বাঁশি গান কি যাবে না ভাসি
আশ্বিনের অসীম আঁধারে
ঝড়ের ঝাপটে বারে বারে?

দেশান্তরী
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


প্রাণ-ধারণের বোঝাখানা বাঁধা পিঠের ‘পরে,
আকাল পড়ল, দিন চলে না, চলল দেশান্তরে।
দূর শহরে একটা কিছু যাবেই যাবে জুটে,
এই আশাতেই লগ্ন দেখে ভোরবেলাতে উঠে
দুর্গা ব’লে বুক বেঁধে সে চলল ভাগ্যজয়ে,
মা ডাকে না পিছুর ডাকে অমঙ্গলের ভয়ে।
স্ত্রী দাঁড়িয়ে দুয়ার ধরে দুচোখ শুধু মোছে,
আজ সকালে জীবনটা তার কিছুতেই না রোচে।
ছেলে গেছে জাম কুড়োতে দিঘির পাড়ে উঠি,
মা তারে আজ ভুলে আছে তাই পেয়েছে ছুটি।
স্ত্রী বলেছে বারে বারে, যে ক’রে হোক খেটে
সংসারটা চালাবে সে, দিন যাবে তার কেটে।
ঘর ছাইতে খড়ের আঁঠির জোগান দেবে সে যে,
গোবর দিয়ে নিকিয়ে দেবে দেয়াল পাঁচিল মেঝে।
মাঠের থেকে খড়কে কাঠি আনবে বেছে বেছে,
ঝাঁটা বেঁধে কুমোরটুলির হাটে আসবে বেচে।
ঢেঁকিতে ধান ভেনে দেবে বামুনদিদির ঘরে,
খুদকুঁড়ো যা জুটবে তাতেই চলবে দুর্বছরে।
দূর দেশেতে বসে বসে মিথ্যা অকারণে
কোনোমতেই ভাব্‌না যেন না রয় স্বামীর মনে।
সময় হল, ঐ তো এল খেয়াঘাটের মাঝি,
দিন না যেতে রহিমগঞ্জে যেতেই হবে আজি।
সেইখানেতে চৌকিদারি করে ওদের জ্ঞাতি,
মহেশখুড়োর মেঝো জামাই, নিতাই দাসের নাতি।
নতুন নতুন গাঁ পেরিয়ে অজানা এই পথে
পৌঁছবে পাঁচদিনের পরে শহর কোনোমতে।
সেইখানে কোন্‌ হালসিবাগান, ওদের গ্রামের কালো,
শর্ষেতেলের দোকান সেথায় চালাচ্ছে খুব ভালো।
গেলে সেথায় কালুর খবর সবাই বলে দেবে–
তারপরে সব সহজ হবে, কী হবে আর ভেবে।
স্ত্রী বললে, “কালুদাকে খবরটা এই দিয়ো,
ওদের গাঁয়ের বাদল পালের জাঠতুত ভাই প্রিয়
বিয়ে করতে আসবে আমার ভাইঝি মল্লিকাকে
উনত্রিশে বৈশাখে।”

দুর্ভাগা দেশ
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
মানুষের অধিকারে
বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
বিধাতার রুদ্ররোষে
দুর্ভিক্ষের-দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে
সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে।
চরণে দলিত হয়ে
ধূলায় সে যায় বয়ে –
সেই নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ।
অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান।
যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অজ্ঞানের অন্ধকারে
আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার,
মানুষের নারায়ণে তবুও কর না নমস্কার।
তবু নত করি আঁখি
দেখিবার পাও না কি
নেমেছে ধূলার তলে হীনপতিতের ভগবান।
অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান।
দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে –
অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।
সবারে না যদি ডাকো,
এখনো সরিয়া থাকো,
আপনারে বেঁধে রাখো চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান –
মৃত্যু-মাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান।

হোক ভারতের জয়
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


এসো এসো ভ্রাতৃগণ! সরল অন্তরে
সরল প্রীতির ভরে
সবে মিলি পরস্পরে
আলিঙ্গন করি আজ বহুদিন পরে ।
এসেছে জাতীয় মেলা ভারতভূষণ ,
ভারত সমাজে তবে
হৃদয় খুলিয়া সবে
এসো এসো এসো করি প্রিয়সম্ভাষণ ।
দূর করো আত্মভেদ বিপদ-অঙ্কুর ,
দূর করো মলিনতা
বিলাসিতা অলসতা ,
হীনতা ক্ষীণতা দোষ করো সবে দূর ।
ভীরুতা বঙ্গীয়জন-কলঙ্ক-প্রধান —
সে-কলঙ্ক দূর করো ,
সাহসিক তেজ ধরো ,
স্বকার্যকুশল হও হয়ে একতান ।
হল না কিছুই করা যা করিতে এলে —
এই দেখো হিন্দুমেলা ,
তবে কেন কর হেলা ?
কী হবে কী হবে আর তুচ্ছ খেলা খেলে ?
সাগরের স্রোতসম যাইছে সময় ।
তুচ্ছ কাজে কেন রও ,
স্বদেশহিতৈষী হও —
স্বদেশের জনগণে দাও রে অভয় ।
নাহি আর জননীর পূর্বসুতগণ —
হরিশ্চন্দ্র যুধিষ্ঠির
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ বীর ,
অনন্তজলধিতলে হয়েছে মগন ।
নাহি সেই রাম আদি সম্রাট প্রাচীন ,
বিক্রম-আদিত্যরাজ ,
কালিদাস কবিরাজ ,
পরাশর পারাশর পণ্ডিত প্রবীণ ।
সকলেই জল বায়ু তেজ মৃত্তিকায়
মিশাইয়া নিজদেহ
অনন্ত ব্রহ্মের গেহ
পশেছে কীর্তিরে শুধু রাখিয়ে ধরায় ।
আদরে সে প্রিয় সখী আচ্ছাদি গগনে
সে লোকবিশ্রুত নাম
সে বিশ্ববিজয়ী ধাম
নির্ঘোষে ঘুষিছে সদা অখিল ভুবনে ।
যবনের রাজ্যকালে কীর্তির আধার
চিতোর-নগর নাম
অতুলবীরত্বধাম ,
কেমন ছিল রে মনে ভাবো একবার ।
এইরূপ কত শত নগর প্রাচীন
সুকীর্তি-তপন-করে
ভারত উজ্জ্বল ক ‘ রে
অনন্ত কালের গর্ভে হয়েছে বিলীন ।
নাহি সেই ভারতের একতা-বিভব ,
পাষাণ বাঁধিয়া গলে
সকলের পদতলে
লুটাইছে আর্যগণ হইয়া নীরব ।
গেল , হায় , সব সুখ অভাগী মাতার —
ছিল যত মনোআশা
নিল কাল সর্বনাশা ,
প্রসন্ন বদন হল বিষণ্ন তাঁহার ।
কী আর হইবে মাতা খুলিয়া বদন ।
দীপ্তভানু অস্ত গেল ,
এবে কালরাত্রি এল ,
বসনে আবরি মুখ কাঁদো সর্বক্ষণ ।
বিশাল অপার সিন্ধু , গভীর নিস্বনে
যেখানে যেখানে যাও
কাঁদিতে কাঁদিতে গাও —
ডুবিল ভারতরবি অনন্ত জীবনে ।
সুবিখ্যাত গৌড় যেই বঙ্গের রতন —
তার কীর্তিপ্রতিভায়
খ্যাতাপন্ন এ ধরায়
হয়েছিল একদিন বঙ্গবাসিগণ ।
গেল সে বঙ্গের জ্যোতিঃ কিছুকাল পরে —
কোনো চিহ্ন নাহি তার ,
পরিয়া হীনতাহার ,
ডুবিয়াছে এবে বঙ্গ কলঙ্কসাগরে ।
হিন্দুজনভ্রাতৃগণ! করি হে বিনয় —
একতা উৎসাহ ধরো ,
জাতীয় উন্নতি করো ,
ঘুষুক ভুবনে সবে ভারতের জয় ।
জগদীশ! তুমি , নাথ , নিত্য-নিরাময়
করো কৃপা বিতরণ ,
অধিবাসিজনগণ ,
করুক উন্নতি — হোক্‌ ভারতের জয়!

হে যক্ষ সেদিন প্রেম তোমাদের
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


হে যক্ষ, সেদিন প্রেম তোমাদের
বৃদ্ধ ছিল আপনাতেই
পদ্মকুঁড়ির মতো।
সেদিন সংকীর্ণ সংসারে
একান্তে ছিল তোমার প্রেয়সী
যুগলের নির্জন উৎসবে,
সে ঢাকা ছিল তোমার আপনাকে দিয়ে,
শ্রাবণের মেঘমালা
যেমন হারিয়ে ফেলে চাঁদকে
আপনারি আলিঙ্গনের
আচ্ছাদনে।
এমন সময়ে প্রভুর শাপ এল
বর হয়ে,
কাছে থাকার বেড়া-জাল গেল ছিঁড়ে।
খুলে গেল প্রেমের আপনাতে-বাঁধা
পাপড়িগুলি,
সে-প্রেম নিজের পূর্ণ রূপের দেখা পেল
বিশ্বের মাঝখানে।
বৃষ্টির জলে ভিজে’ সন্ধ্যাবেলাকার জুঁই
তাকে দিল গন্ধের অঞ্জলি।
রেণুর ভারে মন্থর বাতাস
তাকে জানিয়ে দিল
নীপ-নিকুঞ্জের আকুতি।
সেদিন অশ্রুধৌত সৌম্য বিষাদের
দীক্ষা পেলে তুমি;
নিজের অন্তর-আঙিনায়
গড়ে তুললে অপূর্ব মূর্তিখানি
স্বর্গীয় গরিমায় কান্তিমতী।
যে ছিল নিভৃত ঘরের সঙ্গিনী
তার রসরূপটিকে আসন দিলে
অনন্তের আনন্দমন্দিরে
ছন্দের শঙ্খ বাজিয়ে।
আজ তোমার প্রেম পেয়েছে ভাষা,
আজ তুমি হয়েছ কবি,
ধ্যানোদ্ভবা প্রিয়া
বক্ষ ছেড়ে বসেছে তোমার মর্মতলে
বিরহের বীণা হাতে।
আজ সে তোমার আপন সৃষ্টি
বিশ্বের কাছে উৎসর্গ-করা।

হিন্দুস্থান
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


মোরে হিন্দুস্থান
বারবার করেছে আহ্বান
কোন্ শিশুকাল হতে পশ্চিমদিগন্ত-পানে
ভারতের ভাগ্য যেথা নৃত্যলীলা করেছে শ্মশানে,
কালে কালে
তাণ্ডবের তালে তালে,
দিল্লিতে আগ্রাতে
মঞ্জীরঝংকার আর দূর শকুনির ধ্বনি-সাথে;
কালের মন্থনদণ্ডঘাতে
উচ্ছলি উঠেছে যেথা পাথরের ফেনস্তূপে
অদৃষ্টের অট্টহাস্য অভ্রভেদী প্রাসাদের রূপে।
লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর দুই বিপরীত পথে
রথে প্রতিরথে
ধূলিতে ধূলিতে যেথা পাকে পাকে করেছে রচনা
জটিল রেখার জালে শুভ-অশুভের আল্‌পনা।
নব নব ধ্বজা হাতে নব নব সৈনিকবাহিনী
এক কাহিনীর সূত্র ছিন্ন করি আরেক কাহিনী
বারংবার গ্রন্থি দিয়ে করেছে যোজন।
প্রাঙ্গণপ্রাচীর যার অকস্মাৎ করেছে লঙ্ঘন
দস্যুদল,
অর্ধরাত্রে দ্বার ভেঙে জাগিয়েছে আর্ত কোলাহল,
করেছে আসন-কাড়াকাড়ি,
ক্ষুধিতের অন্নথালি নিয়েছে উজাড়ি।
রাত্রিরে ভুলিল তারা ঐশ্বর্যের মশাল-আলোয়–
পীড়িত পীড়নকারী দোঁহে মিলি সাদায় কালোয়
যেখানে রচিয়াছিল দ্যূতখেলাঘর,
অবশেষে সেথা আজ একমাত্র বিরাট কবর
প্রান্ত হতে প্রান্তে প্রসারিত;
সেথা জয়ী আর পরাজিত
একত্রে করেছে অবসান
বহু শতাব্দীর যত মান অসম্মান।
ভগ্নজানু প্রতাপের ছায়া সেথা শীর্ণ যমুনায়
প্রেতের আহ্বান বহি চলে যায়,
বলে যায়–
আরো ছায়া ঘনাইছে অস্তদিগন্তের
জীর্ণ যুগান্তের।


ভারতী
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


শুধাই অয়ি গো ভারতী তোমায়
তোমার ও বীণা নীরব কেন?
কবির বিজন মরমে লুকায়ে
নীরবে কেন গো কাঁদিছ হেন?
অযতনে, আহা, সাধের বীণাটি
ঘুমায়ে রয়েছে কোলের কাছে,
অযতনে, আহা, এলোথেলো চুল
এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে আছে।
কেন গো আজিকে এ-ভাব তোমার
কমলবাসিনী ভারতী রানী–
মলিন মলিন বসন ভূষণ
মলিন বদনে নাহিকো বাণী।
তবে কি জননি অমৃতভাষিণি
তোমার ও বীণা নীরব হবে?
ভারতের এই গগন ভরিয়া
ও বীণা আর না বাজিবে তবে?
দেখো তবে মাতা দেখো গো চাহিয়া
তোমার ভারত শ্মশান-পারা,
ঘুমায়ে দেখিছে সুখের স্বপন
নরনারী সব চেতনহারা।
যাহা-কিছু ছিল সকলি গিয়াছে,
সে-দিনের আর কিছুই নাই,
বিশাল ভারত গভীর নীরব,
গভীর আঁধার যে-দিকে চাই।
তোমারো কি বীণা ভারতি জননী,
তোমারো কি বীণা নীরব হবে?
ভারতের এই গগন ভরিয়া
ও-বীণা আর না বাজিবে তবে?
না না গো, ভারতী, নিবেদি চরণে
কোলে তুলে লও মোহিনী বীণা।
বিলাপের ধ্বনি উঠাও জননি,
দেখিব ভারত জাগিবে কি না।
অযুত অযুত ভারতনিবাসী
কাঁদিয়া উঠিবে দারুণ শোকে,
সে রোদনধ্বনি পৃথিবী ভরিয়া
উঠিবে, জননি, দেবতালোকে।
তা যদি না হয় তা হলে, ভারতি,
তুলিয়া লও বিজয়ভেরী,
বাজাও জলদগভীর গরজে
অসীম আকাশ ধ্বনিত করি।
গাও গো হুতাশ-পূরিত গান,
জ্বলিয়া উঠুক অযুত প্রাণ,
উথলি উঠুক ভারত-জলধি–
কাঁপিয়া উঠুক অচলা ধরা।
দেখিব তখন প্রতিভাহীনা
এ ভারতভূমি জাগিবে কি না,
ঢাকিয়া বয়ান আছে যে শয়ান
শরমে হইয়া মরমে-মরা!
এই ভারতের আসনে বসিয়া
তুমিই ভারতী গেয়েছ গান,
ছেয়েছে ধরার আঁধার গগন
তোমারি বীণার মোহন তান।
আজও তুমি, মাতা, বীণাটি লইয়া
মরম বিঁধিয়া গাও গো গান–
হীনবল সেও হইবে সবল,
মৃতদেহ সেও পাইবে প্রাণ।

raateralo.com

Leave a Comment