Famous Religious Poem of Rabindranath Tagore: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্মীয় কবিতা বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য সম্পদ, যেখানে গভীর আধ্যাত্মিকতা এবং মানবতার প্রতি তাঁর অপার বিশ্বাস ফুটে ওঠে। তাঁর কবিতাগুলিতে ঈশ্বরের প্রতি অপরিসীম ভক্তি, প্রেম, এবং জীবন দর্শনের গভীর দিকগুলি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় কবিতায় শুধু ঈশ্বরের প্রতি আস্থা নয়, বরং মানবজীবনের অন্তর্নিহিত সত্য, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ, এবং পরম মুক্তির সন্ধান প্রতিফলিত হয়।
এই ব্লগে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ধর্মীয় কবিতাগুলির উপর আলোকপাত করব, যেখানে তিনি ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্ক, আধ্যাত্মিকতা, এবং মানবতার সার্বজনীনতাকে অসামান্যভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতাগুলি যুগ যুগ ধরে পাঠকদের অনুপ্রাণিত করেছে এবং করবে, কারণ তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে হয় আমাদের হৃদয়ের গভীরে, প্রতিদিনের জীবনযাত্রার মধ্যে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ধর্মীয় কবিতা l Famous Religious Poem of Rabindranath Tagore 2024
Table of Contents
ধর্মমোহ
ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে ।
নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর ,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর ।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো ,
শাস্ত্রে মানে না , মানে মানুষের ভালো ।
বিধর্ম বলি মারে পরধর্মেরে ,
নিজ ধর্মের অপমান করি ফেরে ,
পিতার নামেতে হানে তাঁর সন্তানে ,
আচার লইয়া বিচার নাহিকো জানে ,
পূজাগৃহে তোলে রক্তমাখানো ধ্বজা —
দেবতার নামে এ যে শয়তান ভজা ।
অনেক যুগের লজ্জা ও লাঞ্ছনা ,
বর্বরতার বিকার বিড়ম্বনা
ধর্মের মাঝে আশ্রয় দিল যারা
আবর্জনায় রচে তারা নিজ কারা । —
প্রলয়ের ওই শুনি শৃঙ্গধ্বনি ,
মহাকাল আসে লয়ে সম্মার্জনী ।
যে দেবে মুক্তি তারে খুঁটিরূপে গাড়া ,
যে মিলাবে তারে করিল ভেদের খাঁড়া ,
যে আনিবে প্রেম অমৃত-উৎস হতে
তারি নামে ধরা ভাসায় বিষের স্রোতে ,
তরী ফুটা করি পার হতে গিয়ে ডোবে —
তবু এরা কারে অপবাদ দেয় ক্ষোভে ।
হে ধর্মরাজ , ধর্মবিকার নাশি
ধর্মমূঢ়জনেরে বাঁচাও আসি ।
যে পূজার বেদি রক্তে গিয়েছে ভেসে
ভাঙো ভাঙো , আজি ভাঙো তারে নিঃশেষে —
ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো ,
এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো ।
আত্মসমর্পণ
তোমার আনন্দগানে আমি দিব সুর
যাহা জানি দু-একটি প্রীতি-সুমধুর
অন্তরের ছন্দোগাথা; দুঃখের ক্রন্দনে
বাজিবে আমার কণ্ঠ বিষাদবিধুর
তোমার কণ্ঠের সনে; কুসুমে চন্দনে
তোমারে পূজিব আমি; পরাব সিন্দূর
তোমার সীমন্তে ভালে; বিচিত্র বন্ধনে
তোমারে বাঁধিব আমি, প্রমোদসিন্ধুর
তরঙ্গেতে দিব দোলা নব ছন্দে তানে।
মানব-আত্মার গর্ব আর নাহি মোর,
চেয়ে তোর স্নিগ্ধশ্যাম মাতৃমুখ-পানে
ভালোবাসিয়াছি আমি ধূলিমাটি তোর।
জন্মেছি যে মর্ত-কোলে ঘৃণা করি তারে
ছুটিব না স্বর্গ আর মুক্তি খুঁজিবারে।
৫ অগ্রহায়ণ ১৩০০
মুক্তি
চক্ষু কর্ণ বুদ্ধি মন সব রুদ্ধ করি,
বিমুখ হইয়া সর্ব জগতের পানে,
শুদ্ধ আপনার ক্ষুদ্র আত্মাটিরে ধরি
মুক্তি-আশে সন্তরিব কোথায় কে জানে!
পার্শ্ব দিয়ে ভেসে যাবে বিশ্বমহাতরী
অম্বর আকুল করি যাত্রীদের গানে,
শুভ্র কিরণের পালে দশ দিক ভরি’,
বিচিত্র সৌন্দর্যে পূর্ণ অসংখ্য পরানে।
ধীরে ধীরে চলে যাবে দূর হতে দূরে
অখিল ক্রন্দন-হাসি আঁধার-আলোক,
বহে যাবে শূন্যপথে সকরুণ সুরে
অনন্ত-জগৎ-ভরা যত দুঃখশোক।
বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে
আমি একা বসে রব মুক্তি-সমাধিতে?
একটি নমস্কারে, প্রভু
একটি নমস্কারে, প্রভু,
একটি নমস্কারে
সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক
তোমার এ সংসারে।
ঘন শ্রাবণ-মেঘের মতো
রসের ভারে নম্র নত
একটি নমস্কারে, প্রভু,
একটি নমস্কারে
সমস্ত মন পড়িয়া থাক্
তব ভবন-দ্বারে।
নানা সুরের আকুল ধারা
মিলিয়ে দিয়ে আত্মহারা
একটি নমস্কারে, প্রভু,
একটি নমস্কারে
সমস্ত গান সমাপ্ত হোক
নীরব পারাবারে।
হংস যেমন মানসযাত্রী,
তেমনি সারা দিবসরাত্রি
একটি নমস্কারে, প্রভু,
একটি নমস্কারে
সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক
মহামরণ-পারে।
২৩ শ্রাবণ, ১৩১৭
তোমার দয়া যদি
তোমার দয়া যদি
চাহিতে নাও জানি
তবুও দয়া করে
চরণে নিয়ো টানি।
আমি যা গড়ে তুলে
আরামে থাকি ভুলে
সুখের উপাসনা
করি গো ফলে ফুলে–
সে ধুলা-খেলাঘরে
রেখো না ঘৃণাভরে,
জাগায়ো দয়া করে
বহ্নি-শেল হানি।
সত্য মুদে আছে
দ্বিধার মাঝখানে,
তাহারে তুমি ছাড়া
ফুটাতে কে বা জানে।
মৃত্যু ভেদ করি’
অমৃত পড়ে ঝরি’,
অতল দীনতার
শূন্য উঠে ভরি’
পতন-ব্যথা মাঝে
চেতনা আসি বাজে,
বিরোধ কোলাহলে
গভীর তব বাণী।
২২ শ্রাবণ, ১৩১৭
আমার নামটা দিয়ে ঢেকে রাখি যারে
আমার নামটা দিয়ে ঢেকে রাখি যারে
মরছে সে এই নামের কারাগারে।
সকল ভুলে যতই দিবারাতি
নামটারে ওই আকাশপানে গাঁথি,
ততই আমার নামের অন্ধকারে
হারাই আমার সত্য আপনারে।
জড়ো করে ধূলির ‘পরে ধূলি
নামটারে মোর উচ্চ করে তুলি।
ছিদ্র পাছে হয় রে কোনোখানে
চিত্ত মম বিরাম নাহি মানে,
যতন করি যতই এ মিথ্যারে
ততই আমি হারাই আপনারে।
২১ শ্রাবণ, ১৩১৭
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি
আমার আমি সেইটুকু থাক্ বাকি।
তোমায় আমি হেরি সকল দিশি,
সকল দিয়ে তোমার মাঝে মিশি,
তোমারে প্রেম জোগাই দিবানিশি,
ইচ্ছা আমার সেইটুকু থাক্ বাকি–
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি।
তোমায় আমি কোথাও নাহি ঢাকি
কেবল আমার সেইটুকু থাক্ বাকি।
তোমার লীলা হবে এ প্রাণ ভরে
এ সংসারে রেখেছ তাই ধরে,
রইব বাঁধা তোমার বাহুডোরে
বাঁধন আমার সেইটুকু থাক্ বাকি–
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি।
১৫ শ্রাবণ, ১৩১৭
তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর
তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর,
যবে আমার জনম হবে ভোর।
চলে যাব নবজীবন-লোকে,
নূতন দেখা জাগবে আমার চোখে,
নবীন হয়ে নূতন সে আলোকে
পরব তব নবমিলন-ডোর।
তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর।
তোমার অন্ত নাই গো অন্ত নাই,
বারে বারে নূতন লীলা তাই।
আবার তুমি জানি নে কোন্ বেশে
পথের মাঝে দাঁড়াবে, নাথ, হেসে,
আমার এ হাত ধরবে কাছে এসে,
লাগবে প্রাণে নূতন ভাবের ঘোর।
তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর।
১০ শ্রাবণ, ১৩১৭
ভজন পূজন সাধন আরাধনা
ভজন পূজন সাধন আরাধনা
সমস্ত থাক্ পড়ে।
রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে
কেন আছিস ওরে।
অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে
কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে,
নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে
দেবতা নাই ঘরে।
তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে
করছে চাষা চাষ–
পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,
খাটছে বারো মাস।
রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে,
ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে;
তাঁরি মতন শুচি বসন ছাড়ি
আয় রে ধুলার ‘পরে।
মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি,
মুক্তি কোথায় আছে।
আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন ‘পরে
বাঁধা সবার কাছে
রাখো রে ধ্যান, থাক্ রে ফুলের ডালি,
ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুক ধুলাবালি,
কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে
ঘর্ম পড়ুক ঝরে।
কয়া। গোরাই, ২৭ আষাঢ়, ১৩১৭
মরণ যেদিন দিনের শেষে আসবে তোমার দুয়ারে
মরণ যেদিন দিনের শেষে আসবে তোমার দুয়ারে
সেদিন তুমি কী ধন দিবে উহারে।
ভরা আমার পরানখানি
সম্মুখে তার দিব আনি,
শূন্য বিদায় করব না তো উহারে–
মরণ যেদিন আসবে আমার দুয়ারে।
কত শরৎ-বসন্ত-রাত,
কত সন্ধ্যা, কত প্রভাত
জীবনপাত্রে কত যে রস বরষে;
কতই ফলে কতই ফুলে
হৃদয় আমার ভরি তুলে
দুঃখসুখের আলোছায়ার পরশে।
যা-কিছু মোর সঞ্চিত ধন
এতদিনের সব আয়োজন
চরমদিনে সাজিয়ে দিব উহারে–
মরণ যেদিন আসবে আমার দুয়ারে।
শিলাইদহ, ২৫ আষাঢ়, ১৩১৭
গর্ব করে নিই নে ও নাম, জান অন্তর্যামী
গর্ব করে নিই নে ও নাম, জান অন্তর্যামী,
আমার মুখে তোমার নাম কি সাজে।
যখন সবাই উপহাসে তখন ভাবি আমি
আমার কণ্ঠে তোমার নাম কি বাজে।
তোমা হতে অনেক দূরে থাকি
সে যেন মোর জানতে না রয় বাকি,
নামগানের এই ছদ্মবেশে দিই পরিচয় পাছে
মনে মনে মরি যে সেই লাজে।
অহংকারের মিথ্যা হতে বাঁচাও দয়া করে
রাখো আমায় যেথা আমার স্থান।
আর-সকলের দৃষ্টি হতে সরিয়ে দিয়ে মোরে
করো তোমার নত নয়ন দান।
আমার পূজা দয়া পাবার তরে,
মান যেন সে না পায় করো ঘরে,
নিত্য তোমায় ডাকি আমি ধুলার ‘পরে বসে
নিত্যনূতন অপরাধের মাঝে।
রেলপথ। ই। বি। এস। আর, ২২ আষাঢ়, ১৩১৭