Raater Alo

Kalratri by Samaresh Majumdar 2024l কালরাত্রি – সমরেশ মজুমদার

Kalratri by Samaresh Majumdar 2024l কালরাত্রি – সমরেশ মজুমদার

Kalratri by Samaresh Majumdar 2024l কালরাত্রি – সমরেশ মজুমদার: সমরেশ মজুমদার, বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি তাঁর অনন্য সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে পাঠকদের হৃদয়কে স্পর্শ করেছেন। তাঁর লেখনীতে বাস্তব জীবনের কাহিনী এবং সমসাময়িক সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। সমরেশ মজুমদারের রচনা মানেই পাঠকের মনে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন।

“কালরাত্রি” সমরেশ মজুমদারের এক বিশেষ সৃষ্টি, যা পাঠকদের জন্য এক গভীর এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। এই উপন্যাসে তিনি সমাজের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট এবং মানবমনের গভীরতম অনুভূতিগুলোকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন, যা পাঠককে মুগ্ধ করে রাখে। কালরাত্রি কেবল একটি গল্প নয়, এটি এক জীবন্ত চিত্র, যেখানে প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি দৃশ্য যেন বাস্তবের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

এই উপন্যাসের মাধ্যমে সমরেশ মজুমদার পাঠকদের এক অন্ধকার এবং রহস্যময় রাত্রির ভ্রমণে নিয়ে যান, যেখানে প্রত্যেকটি মুহূর্তে নতুন চমক অপেক্ষা করে। কালরাত্রির প্রতিটি পাতা উল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে পাঠক এক নতুন রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়ে, যা তাকে শেষ পর্যন্ত আটকে রাখে।

সমরেশ মজুমদারের “কালরাত্রি” সেই সকল পাঠকদের জন্য, যারা সাহিত্যের মাধ্যমে জীবনের নানা দিককে অন্বেষণ করতে ভালোবাসেন। এটি একটি এমন উপন্যাস, যা পড়ে শেষ করলে মনে হয়, সত্যিই এক অসাধারণ সাহিত্যের সাক্ষাৎ পেলাম। কালরাত্রি সমরেশ মজুমদারের সাহিত্যকীর্তির এক উজ্জ্বল নিদর্শন, যা বাংলা সাহিত্যে একটি স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।

Kalratri by Samaresh Majumdar 2024l কালরাত্রি – সমরেশ মজুমদার

টিফিনের সময় ক্লাসে কেউই থাকে না। কাত্যায়নী টিফিনের বাক্স বের করে সুবর্ণাকে ডাকল, আয় ভাই, টিফিনটা সেরে নিই।

সুবর্ণা তার ঝোলা থেকে একটি সুদৃশ্য কৌটো বের করল, এখানে না খেয়ে মেয়েদের কমনরুমে। চল। সেই হাঁদাকান্ত প্যাটপেটিয়ে চেয়ে আছে।

কাত্যায়নীর মুখে গরম হাওয়া লাগল, দেখুক। এটা আমাদের ক্লাস, আমরা খাব।

দুই সুন্দরী যখন মনোযোগ দিয়ে আহার শুরু করতে যাচ্ছে তখন কিঞ্চিৎ দূরে বসা শ্যামাকান্ত আর পারল না। তার বুক কেঁপে উঠল এবং দুই নাসারন্ধ্র কাঁপিয়ে বাতাস বেরিয়ে এল। ক্লাসরুমে একটা চমৎকার গন্ধ পাক খাছে। সেই গন্ধ যেন শ্যামাকান্তের সমস্ত ইন্দ্রিয়কে আঘাত শুরু করল। শ্যামাকান্ত উঠল। তার শরীর বলবান কিন্তু সেই সঙ্গে মেদের আধিক্য থাকায় বেশি ভারী দেখায়। প্রথমে সে প্যান্ট-শার্ট পরত। ইদানীং এক বন্ধুর পরামর্শে ধুতি পরে। মধু যেমন মৌমাছিকে টানে শ্যামাকান্ত সেই মতো হাজির হল সুন্দরীদের সামনে। আর তখনই কাত্যায়নী বলে উঠল, এই রে সেরেছে!

সুবর্ণা মুখ তুলে তাকালেই শ্যামাকান্ত বলল, বড় মিষ্টি গন্ধ। আমাদের বাড়িতে তো আর এসব হয় না! গন্ধে-গন্ধে চলে এলাম।

কাত্যায়নী মুখঝামাটা দিল, কেন হয় না?

কে করবে? আমাদের বাড়ি তো মরুভূমি।

মরুভূমি মানে?

বলছি। ওটা বুঝি ডিমের ডেভিল? আঙুল বাড়িয়ে সুবর্ণার কৌটো দেখাল শ্যামাকান্ত।

সুবর্ণা হকচকিয়ে গেল, আপনি খাবেন?

ডিম আমার প্রিয়। খুব প্রিয়। আমি প্রায়ই ডিমের স্বপ্ন দেখি। সার-সার ডিম, নাদুসনুদুস, নিটোল। আমি ডিমের ওপর শুয়ে আছি–।

আপনি শুলে কোনও ডিমই আর আস্ত থাকবে না। কাত্যায়নী মুখ ফেরাল।

সুবর্ণা একটু ইতস্তত করে ডিমের ডেভিল তুলে দিল শ্যামাকান্তর হাতে। খাদ্যদ্রব্য একটি মানুষের মুখ কতটা প্রফুল্ল করতে পারে এর আগে সে জানত না। শ্যামাকান্ত চিবোতে চিবোতে অস্পষ্ট গলায় বলল, নুনটা একটু কম কিন্তু জিনিসটা জম্পেশ।

কাত্যায়নীর যেন একটু কৌতুক বোধ হল। সে একটা বড় আবার খাব সন্দেশ এগিয়ে দিল, মরুভূমির কথা কি যেন বলছিলেন?

ততক্ষণে সন্দেশ চালান হয়ে গেছে। শ্যামাকান্তর দুই চোখ আবেগে বুজে আসছিল, কেউ নেই। শুধু বাবা দাদারা আর আমি। আমরা সবাই মা-মরা। বোনও নেই। রান্না করে হরিদা। পোস্তর। ঘ্যাঁট আর ভাত। থার্ড আইটেম জানে না। মাছ আসে না বাড়িতে, জানেন? সেকি? কেন? সুবর্ণার ঠোঁট থেকে শব্দ দুটো ছিটকে এল।

বাবা বলেন তিনি মরলে মা বিধবা হতেন। মা কি তখন মাছ খেতেন? খেতেন না। এখন মা নেই তাই বাবা সেই অনারে মাছ খাবেন না। মেজদা ঠাট্টা করে বলে, বাবার নিশচয়ই অল ইন্ডিয়া বিধবা অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হওয়ার ইচ্ছে।

কাত্যায়নী ফোঁস করল, ইসস। আর কি বলব! বাড়িতে রোজ ভোরে চিরতার জল, দুটি বিস্কুট এবং হরলিক্স, নো চা। তারপর ফল, ফলের রস। তারপর পোস্ত অ্যান্ড ভাত! আর একটা মিষ্টি হবে? কথা বলতে-বলতে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়ায় সুবর্ণা প্রথমে ধরতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত নিজের সন্দেশ তুলে দিল সে শ্যামাকান্তর হাতে।

শ্যামাকান্ত বলল, আমার না, কারও সঙ্গে এখনও ভাব হল না। নতুন ক্লাস তো।

কাত্যায়নী জানতে চাইল, আপনি বাড়ি থেকে টিফিন আনেন না কেন?

কে করে দেবে? হরিদা টাইম পায় না। বাবা রোজ একটা করে টাকা দেয়, তা সেটা কলেজে আসার আগেই শেষ হয়ে যায়। এক টাকার কোনও দাম আছে, বলুন?

দুই সুন্দরী স্বীকার করতে বাধ্য, না নেই।

পরদিন কলেজে বের হওয়ার আগে সুবর্ণা তার মাকে বলল, মা আজ টিফিন একটু বেশি করে দিও।

কেন রে?

আর বলো না। আমাদের ক্লাসে এক হাঁদাকান্ত আছে, খাওয়ার সময় এমন জুলজুল করে চেয়ে থাকে না যে খাওয়া যায় না।

সেকি? চেয়ে থাকে কেন?

কাল আমার সব খাবার খেয়ে নিয়েছে। মা বেঁচে নেই। বোধহয় পেটুক।

সুবর্ণার ছোটবোন শুনছিল, বলে উঠল, ওর সামনে খাস কেন? অন্য জায়গায় গিয়ে খেতে পারিস না? হাঁদাকান্ত ওর সত্যিকারের নাম?

সুবর্ণা হাসল, কাত্যায়নী ওকে তাই বলে। হাঁদা নয়, শ্যামা–শ্যামাকান্ত।

সুবর্ণারা থাকে মফস্বলে। বালিব্রিজ পেরিয়ে গেলেই তো মফসসল। সেখানকার মানুষ শ্যামবাজারে যাওয়ার সময় এখনও বলেন  কলকাতায় যাচ্ছি। তাকে কলেজে আসতে হয় রীতিমতো পরিশ্রম করে। দু-বার বাস পালটাতে হয়। কাত্যায়নী থাকে বাগবাজারে। নতুন কলেজে এই দুজনের খুব বন্ধুত্ব হয়েছে। পরদিন টিফিনের সময় শ্যামাকান্তকে আর ডাকতে হল। কৌটো খোলার আগেই সে সটান চলে এল। কাত্যায়নী বলল, আজ আবার কী মনে করে?

বাঃ, কাল বলে দিলাম না। শ্যামাকান্ত বিন্দুমাত্র নিষ্প্রভ নয়।

সুবর্ণা হেসে বলল, আপনি খুব খেতে ভালোবাসেন, না?

সমরেশ মজুমদার উপন্যাস l সমরেশ মজুমদারের শ্রেষ্ঠ রচনা

খুউব। তবে একেবারে বেশি নয়। একটু-একটু করে। দু-তিন ঘণ্টা পরপর খিদে পেয়ে যায় আমার। কী আছে আজ?

সুবর্ণার কৌটোয় যদি ডিমের ওমলেট বের হল তো কাত্যায়নী একদম ডিমসেদ্ধ, নুন মরিচ মাখানো। সুবর্ণা লক্ষ করল ডিম দেখামাত্র শ্যামাকান্তর চোখ চকচক করে উঠল। একটা অপার্থিব খুশি ফুটে উঠল তার মেদজমা মুখে। যেন পৃথিবীর জাগতিক সুখ-দুঃখের বাইরে চলে গেছে সে এই মুহূর্তে। ঘাড় কাত করে বলল, দুজনেই ডিম। এত খাওয়া যায়? দিন, একটু-একটু করে খাই।

দুই সপ্তদশী দেখল একটি মানুষের তৃপ্তি কিসে হয়। শ্যামাকান্তর চোখ বন্ধ, দুই চোয়াল নড়ছে। কাত্যয়নী জিজ্ঞাসা করল, বাগবাজারের রসগোল্লা খেয়েছেন?

শ্যামাকান্ত সেই অবস্থায় ঘাড় নাড়ল। তারপর নিশ্বাস ফেলে বলল, গিরিশ ঘোষের বাড়ির ঠিক উলটোদিকের গলিতে একটা দোকান আছে। সেখানে যা রসগোল্লা করে না। অনেকদিন। খাইনি।

ওটা আমাদের পাড়া। কাত্যায়নী সগর্বে জানাল।

তাই? একদিন আনবেন তো!

ইস! রসগোল্লা বয়ে আনব! খেতে হলে যেতে হবে।

যাব। কবে যাব? আমার কাছে কিন্তু পয়সা নেই।

কাত্যায়নী খিলখিল করে হেসে উঠল। সুবর্ণার মনে হল ছেলেটি সত্যি সরল। কিন্তু খাওয়া ছাড়া সতেরো-আঠারো বছরের ছেলের অন্য কোনও আকাঙ্খা থাকবে না এ কেমন কথা! সেইসঙ্গে কাত্যায়নীর ঝরনা হাসি তাকে কিঞ্চিৎ গম্ভীর করল। পয়সা নেই শুনে অত হাসির কি আছে?

বাগবাজারের পথটুকু শেষ হতে সময় লাগল না। কলেজ শেষ হলে সুবর্ণা বেশি দেরি করে না বাড়ি ফিরতে, আজ কাত্যায়নীর চাপে এল। গিরিশ ঘোষের বাড়ির কাছে সেই মিষ্টির দোকান দেখে হতভম্ব হল সে। কাত্যায়নীর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল এই জীর্ণ দোকানটিকে সে আগে দ্যাখেনি। কিন্তু সারা রাস্তা বকরবকর করতে-করতে আসা শ্যামাকান্ত বলল, হে-হে, এদের রসগোল্লা যেমন তুলতুলে তেমন টাইট। মুখে দিলেই টের পাবেন।

মিষ্টিতে মেয়েদের সচরাচর আগ্রহ হয় না। দুই সপ্তদশী শ্যামাকান্তর অনুরোধ রাখতে পারল না। এক ডজন রাসগোল্লা খেয়ে শ্যামাকান্ত বলল, আজ এই অবধি থাক। বেশি খেলে স্বাদটা ঠিক পাওয়া যায় না।

কাত্যায়নীর বাড়ি বেশিদূর নয়। সুবর্ণাকে শ্যামবাজার থেকে বাস ধরিয়ে দিতে শ্যামাকান্ত হাঁটছিল। হাঁটতে-হাঁটতে জিজ্ঞাসা করল, নকুড়ের সন্দেশ খেয়েছেন?

ঘাড় নাড়ল সুবর্ণা, না।

আঃ, ফার্স্ট ক্লাস! কিন্তু বড্ড দাম।

কত করে?

দু-টাকা আড়াইটাকার নিচে কড়াপাক মুখে দেওয়া যায় না। আপনি বুঝি খুব মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন?

কেন, একথা মনে হল কেন?

বয়সের তুলনায় আপনি বেশি মোটা, আর সবসময় মিষ্টি-মিষ্টি করছেন!

তা যদি বলেন আমি ঝালটাকেও বেশ ভালোবাসি। ওই যেমন শ্যামবাজারের মোড়ে একটা কষা মাংষের দোকান আছে, দারুণ! গ্রে স্ট্রিট আর সেন্টাল এভিন্যুর মোড়ে একটা দোকানে চিংড়ি মাছের ফ্রাই করে। খেলে মুখ জুড়িয়ে যায়। তারপর ধরুন বৌবাজারে–।

সুবর্ণা তাকে থামিয়ে দিল, থাক। এটুকু বুঝেছি  কলকাতায় যেখানে ভালো খাবার পাওয়া যায় তার সব হদিশ আপনি জানেন। আমি তো থাকি বালিতে। সেখানে কি ভালো পাওয়া যায় বলুন তো?

শ্যামাকান্ত ঘাড় চুলকাল। বালির খবর তার জানা নেই। সে বলল, ঠিক আছে। দুদিন সময় দিন। তবে ভালো জিনিস না হলে বলব না।

শ্যামাকান্তের পরিবারের সবসময় কর্তা তার পিতা কৃষ্ণকান্ত। পাকানো চেহারার এই মানুষটির জীবিকা ওকালতি। চারটি সন্তান হওয়ার পর স্ত্রী গত হলে আর বিয়ে করেননি। কিন্তু অত্যন্ত সতর্কভাবে সন্তানদের মানুষ করতে চেষ্টা করছেন। তাঁর পরিবারে বেশ কিছু নিয়ম আছে। স্ত্রীজাতি সম্পর্কে অনাগ্রহ তাঁর একটি। বড় তিন ছেলে জীবনে প্রতিষ্ঠিত কিংবা হতে চলেছে। তাদের বিয়ে দেওয়ার কথা এখনও ভাবেননি কৃষ্ণকান্ত। ছেলেরাও বাবাকে ভক্তি এবং ভয় করে। কৃষ্ণকান্তর একমাত্র দুশ্চিন্তা কনিষ্ঠ শ্যামাকান্তকে নিয়ে। পড়াশুনায় মতি নেই। ইংরেজি কিংবা ইকনমিক্সের বদলে বাংলায় অনার্স নিয়ে ভরতি হয়েছে। ভবিষ্যৎ ঝরঝরে। কলেজের ক্লাস শেষ হলেই বাড়ি ফিরে আসার কথা, কিন্তু সে প্রায়ই দেরি করছে। এবং চাকর হরি তাকে জানিয়েছে শ্যামাকান্ত বৈকালিক জলযোগ বাড়িতে করতে চায় না। পি সি রায় বলেছিলেন, মুড়ি অতি প্রয়োজনীয় খাদ্যবস্তু। শ্যামাকান্ত কিছুদিন হল সেই মুড়ি স্পর্শ করছে না। অথচ পেটুক এই ছেলেটি উপবাসে থাকার পাত্র নয়–এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত কৃষ্ণকান্ত। তাঁর কেবলই মনে হয়। শ্যামাকান্ত মায়ের পাত নিয়ে জন্মেছে। যখন বেঁচে ছিল তখন নিয়ত কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে ঝগড়া করত। মরে গিয়ে সে তাকে টাইট দিয়ে গেল। কিন্তু কে কাকে টাইট দেয়!

মা-মরা ছেলেটির ওপর সুবর্ণার মায়ের বেশ স্নেহ পড়েছে। মেয়েকে তিনি ধমকেছেন, একটু না। হয় খেতে ভালোবাসে তাই নিয়ে অত ঠাট্টা কিসের! নিজের হাতে শ্যামাকান্তকে লুচি বেগুনভাজা খাইয়ে বলেছিলেন, সময় পেলেই এসো বাবা।

খুব খুশি হয়েছিল শ্যামাকান্ত। সুবর্ণাকে বলেছিল, তোমার চেয়ে তোমার মা অনেক বেশি ভালো। ঠিক মা-মা ভাব।

সুবর্ণা চোখ তুলেছিল ওপরে, ওমা, এই যে আপনাকে সারা  কলকাতায় ঘুরে-ঘুরে চপ কাটলেট ফ্রাই মিষ্টি খাওয়াচ্ছি তার কোনও মূল্য নেই, না?

তা বলিনি, তা বলিনি। শ্যামাকান্ত ঢোঁক গিলল।

আর কি বলতে বাকি রেখেছেন। কাত্যায়নী আজকাল আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না, জানেন?

কেন, কেন? কথা বলে না কেন? এই তো পরশু, তোমাকে ফড়েপুকুরের দই খাওয়াল। বাসস্টপে দেখা হতেই বলল, কী খাবেন? তা ওখানে তো দই ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না।

আপনি দই খেলেন? সুবর্ণা আঁতকে উঠল, কেন, আমাকে বললে আমি দই খাওয়াতে পারতাম না? সারারাজ্য ঘুরে-ঘুরে কত কী খাওয়াচ্ছি আর সামান্য দই পেয়ে তা-ই খেতে যাওয়া হল! ছি ছি-ছি! যান আর আপনাকে আমি কিছু খাওয়াব না।

কিন্তু কাকু তো আপনার বন্ধু।

ইস, আবার কাতু বলা হচ্ছে আদর করে! না, খাওয়ানোর ব্যাপারে কোনও বন্ধুটন্ধু নেই। খাওয়ানো ইজ খাওয়ানো। ওকে কাতু বললেন, আমাকে কী বলে ডাকবেন? তীব্র গলায় জিজ্ঞাসা করল সে।

কি বলে, সুবর্ণা! না, না। সুবু! সুবু! ঠিক আছে?

ঠিক আছে। কী কথা হল?

এই খাওয়া-দাওয়ার কথা। খিদিরপুরে। ওই যা, আপনাকে একটা কথা বলতে খুব ভুলে গিয়েছিলাম! বলব?

কী?

দক্ষিণেশ্বর স্টেশন থেকে নেমেই একটা দোকান পাবেন। চমৎকার ছানার জিলিপি করে। এরকম ছানার জিলিপি জীবনে খাননি।

সুবর্ণা ঘাড় কাত করে তাকে দেখল। তারপর বলল, চলুন। আপনাকে আজ ছানার জিলিপি খাওয়াব। তারপর হেঁটে বালিব্রিজ পেরিয়ে বাড়ি ফিরব।

এক ডজন ছানার জিলিপি কম নয়। সুবর্ণা দেখল শ্যামাকান্তর সেটা শেষ করতে বিলম্ব হল না। সে নিজে একটির বেশি খেতে পারেনি। এত মিষ্টি যে শরীর গুলিয়ে ওঠে। খাওয়া শেষ হলে ওরা হাঁটতে লাগল। হাঁটতে-হাঁটতে সুবর্ণা বলল, আপনি এত খবর পান কি করে, কোথায় কি আছে–।

এইটেই তো আসল কথা। পেতে হয়। শ্যামাকান্ত হাসল।

আচ্ছা কাত্যায়নী আর আমি–কে বেশি ভালো?

আপনি।

কেন? সুবর্ণার বুকের রক্ত চলকে উঠল।

আপনি রোজ আমায় খাওয়ান। মাসিমা কি ভালো খাবার করেন।

বাংলা সাহিত্যের কালরাত্রি l সমরেশ মজুমদার কালরাত্রি l কালরাত্রি উপন্যাস

বালিব্রিজের ওপর ওরা দাঁড়াল। পাশাপাশি। রেলিং-এ হাত রেখে সুবর্ণা ঝুঁকে নদী দেখছিল। গঙ্গার বুক থেকে জলো গন্ধ উঠছে। বাতাসে হিমভাব। নৌকো ভাসছে ইতস্তত। দূরে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির দেখা যাচ্ছে। পবিত্র সময়। শ্যামাকান্তও নদী দেখছিল। দেখতে-দেখতে খেয়াল হল বাবা বলেছেন যে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে। আজও দেরি হবে। কিন্তু ছানার। জিলিপি বাবার চেয়ে বেশি মিষ্টি। সে কী করবে? সে শুনল সুর্বণা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে গুনগুন করছে। রবীন্দ্রনাথের গান। সে নিজে অবশ্য একটা গান জানে। সেটা এইসময় গাওয়া ঠিক নয়। পেটভরতি খাওয়ার পর গান গাইলে তাড়াতাড়ি হজম হয়ে যায়। শ্যামাকান্ত বাঁ দিকে তাকাতেই সুবর্ণার কনুই এবং জামার ঠিক নিচের হাত দেখতে পেল। এবং তখনই তার চোখ স্থির হল। কনুই-এর ওপরে কিছু একটা আটকে আছে। মিষ্টির দোকানে যখন টেবিলে হাত রেখে সুবর্ণা বসেছিল তখনই কি ওটা হাতে লেগে গিয়েছিল। সুবর্ণাকে বলতে সঙ্কোচ হল শ্যামাকান্তর। তার কেবলই মনে হচ্ছিল ওটা ছানার জিলিপির একটা টুকরো। দুটো হাত ভাঁজ করে রেলিং-এর ওপর রেখে সে দাঁড়িয়েছিল। চোখ সামনে রেখে সে ডান হাত বাঁ দিকে একটু বাড়িয়ে দিল। না, তবু নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। সে আঙুলগুলো প্রসারিত করল। তারপর আরও চেষ্টার পর শরীর না নাড়িয়ে সে সুবর্ণার কনুই স্পর্শ করামাত্র একটা কম্পন টের পেল।

সে দেখল সুবর্ণা আচমকা ঘুরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার চোখমুখ আরক্ত। যথাসম্ভব দূরে সরে গিয়ে সে ফোঁস করে উঠল, আপনি আমার হাত ধরলেন যে? কী পেয়েছেন আপনি? আমি ফালতু?

না, না। শ্যামাকান্ত তোতলাতে লাগল।

তাহলে? বলুন, কেন আমার হাত ধরলেন?

মানে–ইয়ে–ছানার–মানে আমি আপনার বন্ধু–।

বন্ধু? ওরকম বন্ধুত্ব আমি চাই না। আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?

শ্যামাকান্ত নিমেষে স্থির হয়ে গেল। তার চোখের সামনে অজস্র জিলিপি, রসগোল্লা, সন্দেশ, ফ্রাই এবং বেগুনভাজা নুয়ে-নুয়ে পড়তে লাগল। সে চকিতে সেইসব খাদ্যবস্তুর বাগানে সুবর্ণাকে। বেনারসির ঘোমটা পরিয়ে টিয়ে নিয়ে এল। এইসময় সুবর্ণা আর একবার তর্জন করতেই তার ধন্দ কাটল। সে অত্যন্ত নিরীহ হয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

যাঃ, চকিতে আরক্ত হল সুবর্ণা। গঙ্গার ওপরে বড় বেশি ঝুঁকে পড়ে বলল, আপনি একটা যাচ্ছেতাই। অত মোটা ছেলেকে আমি–। তার চেয়ে কাতুর কাছে যান।

কাতু? বিড়বিড় করল শ্যামাকান্ত। সে কিছুই বুঝতে পারছিল না।

খবরদার, কাল থেকে ওর সঙ্গে গম্ভীর হয়ে কথা বলবেন।

শ্যামাকান্ত যে ঘনঘন বালি যাচ্ছে এখবর কৃষ্ণকান্ত পেয়ে গেলেন। পেলেন পুত্রের মুখ থেকেই। সেদিন একটা বিশেষ দরকারে বেলুড়ে যাচ্ছিলেন তিনি, পথে ওদের দেখতে পেলেন। শ্যামাকান্ত এবং একটি সপ্তদশী বোকা-বোকা ভাঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে। এই ভঙ্গিটা খুবই মারাত্মক।

কৃষ্ণকান্ত। তুমি আজ বিকেলে কোথায় ছিলে?

শ্যামাকান্ত। বিকেলের কোন সময়ে বলছেন?

কৃষ্ণকান্ত। বালিব্রিজে কী করছিলে?

শ্যামাকান্ত। বালিতে যাচ্ছিলাম বাবা।

কৃষ্ণকান্ত। আমাকে না বলে তুমি বালিতে যাচ্ছিলে? তোমার এত পরিবর্তন? ছি-ছি!

শ্যামাকান্ত। ছি কেন বাবা! বালিতে যাওয়া কি অন্যায়।

কৃষ্ণকান্ত। নিশ্চয়ই। সঙ্গে স্ত্রীলোক থাকলে তো বটেই। সেখানে কী দরকার?

শ্যামাকান্ত। সুবর্ণাদের বাড়ি। সুবর্ণার মা আজ আমাকে দুধপুলি খাইয়েছেন। পুলিটা যা জমেছিল না!

কৃষ্ণকান্ত। সুবর্ণা! ওটি কে?

শ্যামাকান্ত। আমার ক্লাসে পড়ে। খুব ভালো মেয়ে। তুমি লাউ-চিড়িং খেতে ভালোবাস শুনে বলেছে শিখে নেবে।

কৃষ্ণকান্ত। চুপ করো। দ্যাখো শ্যামা, তুমি জন্মমাত্র মাতৃহারা, আমিই তোমার পিতামাতা। কখনও এইসব স্ত্রীলোকের পাল্লায় পড়ো না। নারী নরকের দ্বারী। ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবে। তোমার কোনও দাদা স্ত্রীলোকের ছায়া মাড়ায়নি। তুমি উনিশবছর বয়সেই! আর যেন শুনি! তুমি ওই মেয়েটির সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করো, এই আমার আদেশ।

শ্যামাকান্ত নিষ্প্রভ হয়ে বসে রইল। সে সুবর্ণাকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর ওই বাড়িতে তার খাতির দশগুণ বেড়ে গিয়েছে। নিত্য কত রকমের খাওয়া দাওয়া। বাবার হুকুম পালন করতে গেলে সুবর্ণাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তুলে নিতে হবে। ব্যাস, সঙ্গে-সঙ্গে এতসব খাবারদাবার–। শ্যামাকান্তর মন খারাপ হয়ে গেল। কৃষ্ণকান্তর বিরুদ্ধে। বিদ্রোহ করার সাহস হচ্ছে না। সে ঠিক করল শেষবার সুবর্ণার বাড়িতে যাবে। গিয়ে বলে আসবে আর নয়, এই শেষ।

আজ কলেজের ছুটি। কৃষ্ণকান্ত আদালতে বেরিয়ে যাওয়ামাত্র বেরিয়ে পড়ল। কলেজ না থাকলে পয়সা পাওয়া যায় না। অতএব হাঁটা শুরু। পথে তার তিনরকম প্রিয় খাবারের দোকান পড়ল। পকেটে পয়সা নেই, পাশে সুবর্ণাও নেই। শ্যামাকান্তর বুক টনটন করছিল।

ভরদুপুরে শ্যামাকান্তকে দেখে একই সঙ্গে আনন্দ এবং লজ্জা পেল সুবর্ণা। ঘরে বসতে বলে জিজ্ঞাসা করল, খেয়ে এসেছ?

শ্যামাকান্ত মাথা নেড়ে না বলল। সুবর্ণার মা আড়ালে ছিলেন। শুনে বললেন, সেকি! হাতমুখ ধুয়ে নাও। আজ মুরগির মাংস আছে, তাই—।

শ্যামাকান্ত সুবর্ণার তৃপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মত পালটাল। এখনই বলা ঠিক হবে না। খাওয়া দাওয়া সারা হোক। অনেক সময় পাওয়া যাবে।

অপরাহ্নে শ্যামাকান্তর মনে হল আর বিলম্ব করা ঠিক নয়। জলখাবারটা এলেই বলে ফেলবে। ঠিক তখনই সুবর্ণা বলল, ঠাকুমা বায়না ধরেছে। মা বলছেন তোমাদের বাড়িতে লোক যাবে। এ মাসেই যদি লগ্ন ঠিক হয়–।

শ্যামাকান্ত। লগ্ন? কিসের লগ্ন?

সুবর্ণা। আহা ঢং। লগ্ন কিসের তা জানেন না?

শ্যামাকান্ত। মাইরি বলছি, আমাদের বাড়িতে এইসব কথা কেউ বলে না।

সুবর্ণা। ঠিক আছে। তোক গিয়ে যখন পিতৃদেবকে বলবে তখন জানবেন।

শ্যামাকান্ত। পিতৃদেব? ওরে বাবা, কেউ যেন বাবার কাছে না যায়। বাবা এসব পছন্দ করেন না। খুব রাগি। উনি আমাকে বলে দিয়েছেন কোনওরকম সম্পর্ক যেন তোমার সঙ্গে না রাখি।

সুবর্ণা। বলে দিয়েছেন?

শ্যামাকান্ত। হ্যাঁ। আজই এই বাড়িতে আমার শেষ খাওয়া।

সুবর্ণা। তার মানে?

শ্যামাকান্ত। আমি আর আসব, না। সুবর্ণা।

সুবর্ণা। বেশ, তাহলে আপনি এই মুহূর্তে বেরিয়ে যান এখান থেকে।

সুবর্ণা দ্রুত ঘর থেকে চলে যাওয়ার পর কিছু সময় চুপচাপ বসে থাকল শ্যামাকান্ত। জলখাবারের আগেই কথাটা বলা ঠিক হয়নি। এরপর আর অপেক্ষা করা উচিত নয় বলে সে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল। তার পা ভারী, হৃদয় ভারাক্রান্ত।

গলি থেকে বের হওয়ার আগেই সে নিজের নাম শুনতে পেল। পেছন ফিরে দেখল সুবর্ণার বোন হাঁপাচ্ছে, শ্যামাদা, শিগগির আসুন, দিদি কুয়োর ওপর উঠে বসেছে আর কাঁদছে।

শ্যামাকান্ত বলল, যাঃ!

মাইরি বলছি। এই না মাইরি বললাম, চলুন গিয়ে নিজের চোখে দেখবেন। মেয়েটি ছটফট করতে লাগল।

শ্যামাকান্তর শরীর অবশ হয়ে গেল। সুবর্ণা কুয়োর ওপরে কেন? সম্বিত ফেরামাত্র সে ছুটে গেল বাড়ির পেছনে। সেখানে একটি ডুমুরগাছের ছায়ায় কুয়োর ওপরে দুপা তুলে উদাসীন ভঙ্গিতে সুবর্ণা বসে আছে। যেন পৃথিবীর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। শ্যামাকান্ত মৃদু গলায় ডাকল। এই, ওখানে কেন?

সুবর্ণা মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখে নিচের দিকে তাকাল। সেখানে কালো জল।

শ্যামাকান্ত। নেমে এসো। আঃ, কী হচ্ছে কী?

সুবর্ণা। কেন, নামব কেন?

শ্যামাকান্ত। জলে আমার খুব ভয়! সাঁতার জানি না।

সুবর্ণা। বসে আছি তো আমি। যেখানে যাওয়া হচ্ছিল সেখানেই যাওয়া হোক। আসতে কে বলেছে!

শ্যামাকান্ত। তাই বলে তুমি আত্মঘাতী হবে?

সুবর্ণা। ভালোই তো। শ্রাদ্ধ খেতে পাবে।

শ্যামাকান্ত আর এক পা এগোল, সুবু নেমে এসো।

সুবর্ণা কোনও কথা বলল না। তাকে আরও উদাসীন দেখাল। কিন্তু চোখে জল দেখা দিল। মুহূর্তে কৃষ্ণকান্তর মুখ বিস্মৃত হল শ্যামাকান্ত। এই বিশ্বরাচরের সব দৃশ্য মুছে গিয়ে শুধু সুবর্ণার চোখের। জল বড় হয়ে উঠল। গভীর আবেগে সে বলল, সুবু, তুমি নেমে এসো, আমি তোমাকে বিয়ে করব।

সুবর্ণা বলল, ভ্যাট।

শ্যামাকান্ত বলল, সত্যি বলছি, বিশ্বাস করো।

সেদিন বিকেলে কৃষ্ণকান্ত খবরের কাগজ পড়ছিলেন। শ্যামাকান্ত তাঁর পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসতেই তিনি প্রশ্ন করলেন, চললে কোথায়?

বালি। কম্পিত গলায় উত্তর হল।

আবার বালি? কাগজ রেখে সোজা হয়ে বসলেন কৃষ্ণকান্ত, তোমাকে সেখানে যেতে নিষেধ করিনি নির্বোধ?

হ্যাঁ, সেইটে বলতেই যাচ্ছি। একবার তো জানানো দরকার আর আমি যাব না। আপনি তো অভদ্র হতে বলেননি।

হুঁ। বেশ, জানিয়ে এসো। আর হরিকে দুধপুলি করতে বলেছি।

শ্যামবাজারের মোড়ে এসে মন খারাপ হয়ে গেল শ্যামাকান্তর। দুধপুলি তার প্রিয় এবং সেটা থেকে আজ বঞ্চিত হতে হচ্ছে। এইসময় সে বন্ধুদের প্রত্যাশা করছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়েও কাউকে সে দেখল না। সে প্রত্যেক বন্ধুকে বলেছিল ধুতি পাঞ্জাবি এবং দশটা টাকা পকেটে নিয়ে আসতে। তারা বরযাত্রী যাবে। আজ শ্যামাকান্তর বিয়ে।

সুবর্ণার এক মামা থাকেন আলিপুরে। তিনি সব শুনে এই বিয়েতে উঠেপড়ে লেগেছেন। তাঁর মতে ছেলের বাড়ি যদি কড়া হয় তাতে কোনও অসুবিধে নেই। একবার বিয়েটা চুকিয়ে ফেললেই সবাই সুড়সুড় করে মেনে নেবে। সুবর্ণার বাড়ির কারও-কারও কিন্তু কিন্তু ভাব ছিল, মামা সেটাকে উড়িয়ে দিলেন এই বলে, আঠারো বছরের ছেলেমেয়ের মনের মিলটাই আসল কথা।

শ্যামাকান্ত আজ বন্ধুদের তাই সেজেগুঁজে আসতে বলেছিল কিন্তু কেউ এল না। সে নিজে কৃষ্ণকান্তের কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হবে বলে ভালো পোশাক পরেনি। পকেটে একটাকা বারো আনা পড়ে রয়েছে। এটা তার জমানো পয়সা, তাই নিয়ে সে বাসে চাপল।

বালিতে নামতেই মহাকাণ্ড। একটা গাড়ি অপেক্ষা করছিল, মামা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে সেটায় তুললেন। তোমার বরযাত্রীরা কোথায়?

শ্যামাকান্ত বিরস গলায় জানাল, কেউ আসেনি।

মামা বললেন, কোই পরোয়া নেহি। আমি বরযাত্রী রেডি করে রেখেছি!

শ্যামাকান্ত খুব নার্ভাস। কৃষ্ণকান্তর মুখ বারংবার সামনে ভাসছে। সেটাকে মুছিয়ে সুবর্ণাকে আনতে চেষ্টা করেও পারছিল না। গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল এক অচেনা বাড়ির সামনে। সেখানে দুজন সুন্দরী মহিলা অপেক্ষা করছিলেন, তাঁরা বললেন, বাবা শ্যামাকান্ত, যাও স্নান করে নাও। সেখানে পোশাক আছে।

আমি কোথায়–? হরিণের মতো প্রশ্ন করল শ্যামাকান্ত।

এখান থেকেই বিয়ে করতে যাবে।

চারধারে সুন্দরী রমণীদের ভিড়, সুগন্ধ এবং মুগ্ধ দৃষ্টিতে মোহিত হয়ে গেল শ্যামাকান্ত। জীবনে প্রথমবার সিল্কের পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতি, সোনার বোতাম এবং আংটি পরে নিজেকে রাজকুমার বলে মনে হচ্ছিল। বিয়ের পর সুবর্ণা গর্বিতা রাজকুমারীর মতো তার পাশে বসে ফিসফিস করে বলল, এখন যা খাবার দেবে তার দিকে বেশি নজর দিও না।

তার মানে?

নতুন বরের বেশি খেতে নেই।

কথাটা মনে ধরল না। মহিলারা যখন খাওয়াতে এলেন মনে হল এতদিন কেন তার বিয়ে হয়নি! এত খাবার! এত সুন্দরীর খোঁপায় ফুল! আঃ!

সেইরাত্রে কেউ ঘর থেকে যাচ্ছিল না। মধ্যরাত্রে শ্যামাকান্তর খুব ইচ্ছে করছিল সুবর্ণার হাত ধরতে। এই হাত তাকে এখানে এনেছে। কিন্তু প্রকাশ্যে সে হাত ধরে কি করে? কে যেন ফোড়ন কাটল, জামাই কিভাবে তাকিয়ে আছে দ্যাখ, যেন ছানার জিলিপি খাবে।

রাতটা কাটল। কিন্তু খুবই ক্ষিপ্ত হল শ্যামাকান্ত। এবং তখনই তার মনে হল এই প্রথম সে একটা গোটা রাত বাড়ির বাইরে না বলে কাটাল। এখন কৃষ্ণকান্তর সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তার নেই। সকালের জলখাবারের ব্যবস্থা দেখার পর স্থির করল বাবার সামনে দাঁড়াবার দরকার নেই। এত আরাম এত খাবার ছেড়ে কোন পাগল সেখানে যায়!

কিন্তু বেলা বাড়ার পর বিয়েবাড়িতে ব্যস্ততা দেখা দিল। মামা এসে বললেন, তৈরি হয়ে নাও। বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে তো।

বাড়ি? কার বাড়ি?

কেন? তোমার বাড়ি?

মাথা খারাপ! আমি সেখানে যেতে পারব না।

সেকি! বউ না নিয়ে গেলে লোকে বলবে কি? আহা, বাবার ভয় পাচ্ছ কেন?বউ নিয়ে গেলে দেখবে তিনি জল হয়ে গেছেন।

আমি আমার বাবাকে চিনি। আর এমন তো কথা ছিল না।

মানে?

আমার বিয়ে করার কথা ছিল, বউ নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা ছিল না।

কোথায় থাকবে?

এখানে।

Affordable Laptop for Students

[Smart Choice] Lenovo IdeaPad Gaming 3 Laptop AMD Ryzen 5 5500H 15.6″ (39.62cm) FHD IPS 300nits 144Hz (8GB/512GB SSD/Win 11/NVIDIA RTX 2050 4GB/Alexa/3 Month Game Pass/Shadow Black/2.32Kg), 82K20289IN

সঙ্গে-সঙ্গে রুদ্ধদ্বার সভা বসল আত্মীয়-অতিথিদের কান বাঁচিয়ে। বর বাড়ি ফিরছে না শুনলে টি ঢি পড়ে যাবে। কি করা যায়। মামা বললেন, ঠিক হ্যায়। আমি আমার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা এমনভাবে বের করে দিন যেন ও বউ নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। পাড়ার লোক টের পাবে না।

বিকেলে শ্যামাকান্ত বরবেশে সুবর্ণার পাশে বসে চলে এল আলিপুরে। বিশাল ফ্ল্যাট। নির্জন। সুবর্ণার মামা বললেন, এখানে কিছুদিন থাকো, এর মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।

মামি বললেন, বাবার কাছে ক্ষমা চাইলেই–।

শ্যামাকান্ত মাথা নাড়ল, সে আমি জানি না। আমার বিয়ে করার, করেছি।

মামা-মামির মুখে মেঘ জমল।

সে রাতে বৃষ্টি নামল। সুখাদ্য খাওয়ার পর শ্যামাকান্ত দেখল সুবর্ণা নেই। সে দরজায় দাঁড়াল, ঘুম পেয়েছে।

মামি বললেন, আহা, পাবেই তো। কত খাটুনি গেল। শুয়ে পড়ো বাবা।

সুবর্ণা কোথায়?

সে শুয়ে পড়েছে।

ওমা, আমি বিয়ে করে একা শোব?

জিভ কাটলেন মামি, আজ তো বাবা কালরাত্রি। স্বামী-স্ত্রীতে মুখ দেখাদেখি নেই।

আমি ওসব কালরাত্রি মানি না। ওকে ডেকে দিন। শ্যামাকান্ত ঘরে ফিরে বিছানায় গ্যাঁট হয়ে বসল।

মামা এলেন, বাবা শ্যামাকান্ত, হিন্দুধর্মের নিয়ম–অত অস্থির হয়ো না।

ধর্মটর্ম আবার কী? আমি কি নিয়ম মেনে বিয়ে করেছি?

করোনি?

মোটেই না। আমার বাবা জানে না দাদারা জানে না। আমি কালরাত্রি মানি না।

শেষপর্যন্ত সুবর্ণা এল, কি পাগলামি করছ? আজ আলাদা শুতে হয়।

শ্যামাকান্ত। আমি পারব না। কাল থেকে আমি তুই আলাদা নই।

সুবর্ণা। এতে খারাপ হবে।

শ্যামাকান্ত। হয় হোক, আমি তোমাকে ছাড়ব না।

সুবর্ণা। একসঙ্গে শুয়ে কি হবে তোমার?

শ্যামাকান্ত জবাব দিতে পারল না। তার তীব্র ইচ্ছে হচ্ছে একসঙ্গে শুতে। কিন্তু তাতে কি হবে তা সে জানে না। সে বলল, তোমার হাত ধরব।

সুবর্ণা হাসল, পাগল।

আলো নিভিয়ে সুবর্ণা বয়স্কা নারীর মতো তার পাশে শুয়ে পড়ল। বালকের ভঙ্গিতে শ্যামাকান্ত সুবর্ণার হাত দুই হাতে নিয়ে বুকে চেপে বলল, আঃ! অতিরিক্ত চিন্তা এবং পরিশ্রমে সে অচিরেই ঘুমিয়ে পড়ল।

মধ্যরাতে তার মনে হল হাতটা নেই। ঘর অন্ধকার। এবং সে ক্রমশ বিছানার একপ্রান্তে চলে এসেছে। তার নিম্নভাগ ঝুলছে। এবং বিছানার ওধার থেকে তীব্র নাসিকাগর্জন ভেসে আসছে। সে দুহাতে সুবর্ণাকে জড়িয়ে ধরে মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলতে গেল, মেয়েদের নাক ডাকতে নেই, কিন্তু সেই মুহূর্তে সে একটি পুরুষ্টু গোঁফের খোঁচা পেল। সুবর্ণা নেই। দরজা খোলা। তার বিকল্প মামা ঘুমের ঘোরে মামিকে উদ্দেশ করে বললেন, আঃ, বিরক্ত করো না!

Exit mobile version