Babu by Bankim Chandra Chattopadhyay: বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধসমূহ এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। তাঁর ব্যঙ্গ, সমাজচিন্তা ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের অনন্য নিদর্শন হলো Bangla Popular Articles Babu। এই ব্লগে আলোচিত হয়েছে বহুল পঠিত ও চিন্তাজাগানিয়া প্রবন্ধ বাংলা জনপ্রিয় প্রবন্ধ বাবু, যা Babu by Bankim Chandra Chattopadhyay নামে বাংলা সাহিত্যে আজও সমান প্রাসঙ্গিক। Bankim Chandra Chattopadhyay Essays-এর মধ্যে ‘বাবু’ প্রবন্ধটি সমাজের তথাকথিত বাবু-সংস্কৃতি, কৃত্রিম আভিজাত্য ও মানসিক দীনতার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ তুলে ধরে।
এই লেখায় আমরা আলোচনা করেছি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধ হিসেবে ‘বাবু’-র সাহিত্যিক মূল্য ও সামাজিক তাৎপর্য। বাবু প্রবন্ধ বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের ঔপনিবেশিক সমাজের এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরে, যেখানে বাহ্যিক চাকচিক্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে আত্মপরিচয়ের সংকট। Babu Essay in Bengali শুধু একটি ব্যঙ্গরচনা নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী Bangla Literary Essay Babu, যা পাঠককে সমাজ ও নিজের অবস্থান নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক ধারার অন্তর্ভুক্ত এই রচনা Classic Bengali Essays ও Bengali Prose by Bankim Chandra-এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই ব্লগে আমরা Bankim Chandra Chattopadhyay Articles হিসেবে ‘বাবু’ প্রবন্ধের মূল ভাব, ভাষাশৈলী ও ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করেছি। যারা বাংলা সাহিত্য প্রবন্ধ বা Bengali Literature Essay নিয়ে পড়াশোনা করছেন, তাঁদের জন্য এই আলোচনা বিশেষভাবে সহায়ক হবে।
এছাড়াও এখানে তুলে ধরা হয়েছে কেন ‘বাবু’কে Bankim Chandra Famous Essays-এর অন্যতম বলা হয়, এবং Babu Bengali Article Analysis কীভাবে আমাদের সমাজের ভণ্ডামি ও শ্রেণিচেতনার মুখোশ উন্মোচন করে। Babus in Bengali Literature প্রসঙ্গে এই প্রবন্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও প্রভাবও আলোচনা করা হয়েছে। যারা Bengali Classic Article Babu, Bankim Chandra Chattopadhyay Writings বা Bangla Essay on Babu সম্পর্কে গভীর ধারণা পেতে চান, তাঁদের জন্য এই ব্লগ একটি পূর্ণাঙ্গ ও সহজবোধ্য গাইড। শেষে দেওয়া Babu Essay Summary Bengali অংশটি পাঠকদের দ্রুত বিষয়বস্তু বোঝার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
Babu Essay in Bengali
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা “বাবু” প্রবন্ধটি তাঁর বিখ্যাত ব্যঙ্গাত্মক ও হাস্যরসাত্মক প্রবন্ধ সংকলন ‘লোকরহস্য’ গ্রন্থের একটি অংশ। এই প্রবন্ধে তিনি উনিশ শতকের কলকাতার ‘বাবু’ সমাজ বা তথাকথিত শহুরে বাঙালি ভদ্রলোকদের চরিত্রকে অত্যন্ত সরস এবং তীব্র ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন।
প্রবন্ধটির মূল বিষয়বস্তু:
- “বাবু” চরিত্র: এই প্রবন্ধে ‘বাবু’ বলতে এমন এক ধরনের পুরুষকে বোঝানো হয়েছে, যারা বাহ্যিকভাবে শিক্ষিত ও আধুনিকতার ভান করলেও আসলে কর্মবিমুখ, ভোগবিলাসী এবং নৈতিকভাবে দুর্বল।
- ব্যঙ্গ ও সমালোচনা: বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সরস ও ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় এই বাবুদের জীবনযাপন, তাদের আচরণ এবং সমাজের উপর তাদের নেতিবাচক প্রভাব তুলে ধরেছেন।
- রূপকধর্মী উপস্থাপনা: প্রবন্ধটি সরাসরি সমালোচনা না করে জনমেজয় ও মহর্ষির কথোপকথনের মাধ্যমে একটি পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা বিষয়টিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
- ‘লোকরহস্য’ সংকলন: এটি বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত ব্যঙ্গ-প্রবন্ধ সংকলন ‘লোকরহস্য’-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা তাঁর সমাজ সচেতনতা ও সাহিত্যিক দক্ষতার পরিচয় দেয়।
গুরুত্ব:
- এই প্রবন্ধটি তৎকালীন সমাজের ‘বাবু’ সংস্কৃতির একটি নিখুঁত চিত্র তুলে ধরে এবং পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে বাবু-বিরোধী ধারাকে প্রভাবিত করে।
- বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এই ধরনের সামাজিক ভণ্ডামির বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন, ‘বাবু’ প্রবন্ধটি তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
Table of Contents
বাবু – Babu
জনমেজয় কহিলেন, হে মহর্ষে! আপনি কহিলেন যে, কলিযুগে বাবু নামে এক প্রকার মনুষ্যেরা পৃথিবীতে আবির্ভূত হইবেন। তাঁহারা কি প্রকার মনুষ্য হইবেন এবং পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কি কার্য্য করিবেন, তাহা শুনিতে বড় কৌতূহল জন্মিতেছে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া সবিস্তারে বর্ণন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরবর! আমি সেই বিচিত্রবুদ্ধি; আহারনিদ্রাকুশলী বাবুগণকে আখ্যাত করিব, আপনি শ্রবণ করুন। আমি সেই চস্মাঅলঙ্কৃত, উদরচরিত্র, বহুভাষী, সন্দেশপ্রিয় বাবুদিগের চরিত্র কীর্ত্তিত করিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন। হে রাজন্, যাঁহারা চিত্রবসনাবৃত, বেত্রহস্ত, রঞ্জিতকুন্তল, এবং মহাপাদুক, তাঁহারাই বাবু। যাঁহারা বাক্যে অজেয়, পরভাষাপারদর্শী, মাতৃভাষাবিরোধী, তাঁহারাই বাবু। মহারাজ! এমন অনেক মহাবুদ্ধিসম্পন্ন বাবু জন্মিবেন যে, তাঁহারা মাতৃভাষায় বাক্যালাপে অসমর্থ হইবেন। যাঁহাদিগের দশেন্দ্রিয় প্রকৃতিস্থ, অতএব অপরিশুদ্ধ, যাঁহাদিগের কেবল রসনেন্দ্রিয় পরজাতিনিষ্ঠীবনে পবিত্র, তাঁহারাই বাবু। যাঁহাদিগের চরণ মাংসাস্থিবিহীন শুষ্ক কাষ্ঠের ন্যায় হইলেও পলায়নে সক্ষম;-হস্ত দুর্ব্বল হইলেও লেখনীধারণে এবং বেতনগ্রহণে সুপটু;-চর্ম্ম কোমল হইলেও সাগরপারনির্ম্মিত দ্রব্যবিশেষের প্রহারসহিষ্ণু; যাঁহাদিগের ইন্দ্রিয়মাত্রেরই ঐরূপ প্রশংসা করা যাইতে পারে, তাঁহারাই বাবু। যাঁহারা বিনা উদ্দেশ্যে সঞ্চয় করিবেন, সঞ্চয়ের জন্য উপার্জ্জন করিবেন, উপার্জ্জনের জন্য বিদ্যাধ্যয়ন করিবেন, বিদ্যাধ্যয়নের জন্য প্রশ্ন চুরি করিবেন, তাঁহারাই বাবু।
মহারাজ! বাবু শব্দ নানার্থ হইবে। যাঁহারা কলিযুগে ভারতবর্ষে রাজ্যাভিষিক্ত হইয়া, ইংরাজ নামে খ্যাত হইবেন, তাঁহাদিগের নিকট “বাবু” অর্থে কেরাণী বা বাজারসরকার বুঝাইবে। নির্ধনদিগের নিকটে “বাবু” শব্দে অপেক্ষাকৃত ধনী বুঝাইবে। ভৃত্যের নিকট “বাবু” অর্থে প্রভু বুঝাইবে। এ সকল হইতে পৃথক্, কেবল বাবুজন্মনির্ব্বাহাভিলাষী কতকগুলিন মনুষ্য জন্মিবেন। আমি কেবল তাঁহাদিগেরই গুণকীর্ত্তন করিতেছি। যিনি বিপরীতার্থ করিবেন, তাঁহার এই মহাভারত শ্রবণ নিষ্ফল হইবে। তিনি গোজন্ম গ্রহণ করিয়া বাবুদিগের ভক্ষ্য হইবেন।
হে নরাধিপ! বাবুগণ দ্বিতীয় অগস্ত্যের ন্যায় সমুদ্ররূপী বরুণকে শোষণ করিবেন, স্ফাটিক পাত্র ইঁহাদিগের গণ্ডূষ। অগ্নি ইঁহাদিগের আজ্ঞাবহ হইবেন-“তামাকু” এবং “চুরুট” নামক দুইটি অভিনব খাণ্ডবকে আশ্রয় করিয়া রাত্রি দিন ইঁহাদিগের মুখে লাগিয়া থাকিবেন। ইঁহাদিগের যেমন মুখে অগ্নি, তেমন জঠরেও অগ্নি জ্বলিবেন। এবং রাত্রি তৃতীয় প্রহর পর্য্যন্ত ইঁহাদিগের রথস্থ যুগল প্রদীপে জ্বলিবেন। আলোচিত সঙ্গীতে এবং কাব্যেও অগ্নিদেব থাকিবেন। তথায় তিনি “মদন আগুন” এবং “মনাগুন” রূপে পরিণত হইবেন। বারবিলাসিনীদিগের মতে ইঁহাদিগের কপালেও অগ্নিদেব বিরাজ করিবেন। বায়ুকেই ইঁহারা ভক্ষণ করিবেন-ভদ্রতা করিয়া সেই দুর্দ্দর্ষ কার্য্যর নাম রাখিবেন, “বায়ুসেবন”। চন্দ্র ইঁহাদের গৃহে এবং গৃহের বাহিরে নিত্য বিরাজমান থাকিবেন-কদাপি অবগুণ্ঠনাবৃত। কেহ প্রথম রাত্রে কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্র, শেষ রাত্রে শুক্লপক্ষের চন্দ্র দেখিবেন, কেহ তদ্বিপরীত করিবেন। সূর্য্য ইঁহাদিগকে দেখিতে পাইবেন না। যম ইঁহাদিগকে ভুলিয়া থাকিবেন। কেবল অশ্বিনীকুমারদিগকে ইঁহারা পূজা করিবেন। অশ্বিনীকুমারদিগের মন্দিরের নাম হইবে “আস্তাবল”।
হে নরশ্রেষ্ঠ! যিনি কাব্যরসাদিতে বঞ্চিত, সঙ্গীতে দগ্ধ কোকিলাহারী, যাঁহার পাণ্ডিত্য শৈশবাভ্যস্ত গ্রন্থগত, যিনি আপনাকে অনন্তজ্ঞানী বিবেচনা করিবেন, তিনিই বাবু। যিনি কাব্যের কিছুই বুঝিবেন না, অথচ কাব্যপাঠে এবং সমালোচনায় প্রবৃত্ত, যিনি বারযোষিতের চীৎকার মাত্রকেই সঙ্গীত বিবেচনা করিবেন, যিনি আপনাকে অভ্রান্ত বলিয়া জানিবেন, তিনিই বাবু। যিনি রূপে কার্ত্তিকেয়ের কনিষ্ঠ, গুণে নির্গুণ পদার্থ, কর্ম্মে জড় ভরত, এবং বাক্যে সরস্বতী, তিনিই বাবু। যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতীপূজা করিবেন, এবং পাঁটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু। যাঁহার গমন বিচিত্র রথে, শয়ন সাধারণ গৃহে, পান দ্রাক্ষারস, এবং আহার কদলী দগ্ধ, তিনিই বাবু। যিনি মহাদেবের তুল্য মাদকপ্রিয়, ব্রহ্মার তুল্য প্রজাসিসৃক্ষু, এবং বিষ্ণুর তুল্য লীলা-পটু, তিনিই বাবু। হে কুরুকুলভূষণ! বিষ্ণুর সহিত এই বাবুদিগের বিশেষ সাদৃশ্য হইবে। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহাদের লক্ষ্মী এবং সরস্বতী উভয়ই থাকিবেন। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহারাও অনন্তশয্যাশায়ী হইবেন। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহাদিগেরও দশ অবতার-যথা, কেরাণী, মাষ্টার, ব্রাহ্ম, মুৎসুদ্দী, ডাক্তার, উকিল, হাকিম, জমিদার, সম্বাদপত্রসম্পাদক এবং নিষ্কর্ম্মা। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহারা সকল অবতারেই অমিতবলপরাক্রম অসুরগণকে বধ করিবেন। কেরাণী অবতারে বধ্য অসুর দপ্তরী; মাষ্টার অবতারে বধ্য ছাত্র, ষ্টেশ্যন মাষ্টার অবতারে বধ্য টিকেটহীন পথিক; ব্রাহ্মাবতারে বধ্য চালকলাপ্রত্যাশী পুরোহিত; মুৎসুদ্দী অবতারে বধ্য বণিক্ ইংরাজ; ডাক্তার অবতারে বধ্য রোগী; উকিল অবতারে বধ্য মোয়াক্কল; হাকিম অবতারে বধ্য বিচারার্থী; জমিদার অবতারে বধ্য প্রজা; সম্পাদক অবতারে বধ্য ভদ্রলোক এবং নিষ্কর্ম্মাবতারে বধ্য পুষ্করিণীর মৎস্য।
মহারাজ! পুনশ্চ শ্রবণ করুন। যাঁহার বাক্য মনোমধ্যে এক, কথনে দশ, লিখনে শত এবং কলহে সহস্র তিনিই বাবু। যাঁহার বল হস্তে একগুণ, মুখে দশগুণ, পৃষ্ঠে শতগুণ এবং কার্য্যকালে অদৃশ্য, তিনিই বাবু। যাঁহার বুদ্ধি বাল্যে পুস্তকমধ্যে, যৌবনে বোতলমধ্যে, বার্দ্ধক্যে গৃহিণীর অঞ্চলে, তিনিই বাবু। যাঁহার ইষ্টদেবতা ইংরাজ, গুরু ব্রাহ্মধর্ম্মবেত্তা, বেদ দেশী সম্বাদপত্র এবং তীর্থ “ন্যাশনাল থিয়েটার,” তিনিই বাবু। যিনি মিসনরির নিকট খ্রীষ্টিয়ান, কেশবচন্দ্রের নিকট ব্রাহ্ম, পিতার নিকট হিন্দু, এবং ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের নিকট নাস্তিক, তিনিই বাবু। যিনি নিজগৃহে জল খান, বন্ধুগৃহে মদ খান, বেশ্যাগৃহে গালি খান, এবং মুনিব সাহেবের গৃহে গলাধাক্কা খান, তিনিই বাবু। যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহারকালে আপন অঙ্গুলিকে ঘৃণা এবং কথোপকথনকালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা, তিনিই বাবু। যাঁহার যত্ন কেবল পরিচ্ছদে, তৎপরতা কেবল উমেদারিতে, ভক্তি কেবল গৃহিণী বা উপগৃহিণীতে, এবং রাগ কেবল সদ্গ্রন্থের উপর, নিঃসন্দেহে তিনিই বাবু।
হে নরনাথ! আমি যাঁহাদিগের কথা বলিলাম, তাঁহাদিগের মনে মনে বিশ্বাস জন্মিবে যে, আমরা তাম্বূল চর্ব্বণ করিয়া উপাধান অবলম্বন করিয়া দ্বৈভাষিকী কথা কহিয়া, এবং তামাকু সেবন করিয়া ভারতবর্ষের পুনরুদ্ধার করিব।
জনমেজয় কহিলেন, হে মুনিপুঙ্গব! বাবুদিগের জয় হউক, আপনি অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করুন।



