“শিশিরের জল” সমরেশ মজুমদারের একটি অনন্য গল্প, যা তার লেখনীর গভীরতা এবং মানবিক অনুভূতির সূক্ষ্ম প্রকাশের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। সমরেশ মজুমদার, যিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে সমাদৃত, “শিশিরের জল” গল্পে জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব, সম্পর্কের জটিলতা, এবং সময়ের পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন।
এই গল্পে তিনি শৈশবের স্মৃতি, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের পরিবর্তন, এবং সম্পর্কের অনিশ্চয়তা নিয়ে পাঠকদের মনোজগতে এক চমৎকার চিত্র এঁকেছেন। “শিশিরের জল” পাঠকদের মনে একদিকে যেমন নস্টালজিয়া সৃষ্টি করে, তেমনি জীবনের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। সমরেশ মজুমদারের এই রচনা তার সাহিত্যিক দক্ষতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ, যা পাঠকদের মুগ্ধ করে এবং জীবনের গভীর সত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
শিশিরের জল সমরেশ মজুমদার l Shishirer Jol Samaresh Majumder
Table of Contents
দমদম এয়ারপোর্ট থেকে বেরোবার আগে তার পাসপোর্ট দেখে বাঙালি ইমিগ্রেশন অফিসার হেসে বললেন, ‘আপনি অস্ট্রেলিয়ান?’
‘হ্যাঁ। পাসপোর্টই বলছে আমি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক।’
‘বহু দিন পরে এলেন! ভাল থাকুন।’ পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মেরে ভদ্রলোক সেটা ফেরত দিলেন। কাস্টমসেও কোনও অসুবিধে হল না। স্যুটকেস নিয়ে প্রি-পেড ট্যাক্সির টিকিট কেটে সে যখন বাইরে এল, তখন রাতের অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। ড্রাইভার কাগজ দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘পার্ক স্ট্রিটের কোথায় যাবেন স্যর? পার্ক হোটেলে?’
নামটা প্রথম শুনল সে। সিডনিতে বসে ল্যাপটপে কলকাতার ছবি দেখেছিল, বিবরণ পড়েছিল। তাতে জেনেছিল পার্ক ষ্ট্রিট কলকাতার খুব জমজমাট এলাকা, আধুনিক রেস্টুরেন্ট প্রচুর রয়েছে ওখানে। রাতের কলকাতা দেখতে মন্দ লাগছিল না। চোদ্দো বছর বয়সে সে পশ্চিমবাংলা ছেড়ে জব্বলপুরে চলে গিয়েছিল বাবা-মায়ের সঙ্গে। সেখানেই পড়াশোনা, হায়দরাবাদে চাকরি, অষ্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়া। কলকাতায় আসার প্রয়োজন বা সুযোগই হয়নি। কিন্তু বাবা-মায়ের চাপে বাংলা বলতে বা পড়তে অসুবিধে হয় না। ওঁদের অষ্ট্রেলিয়াতে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিল সে। ভালই ছিলেন। কিন্তু দু’বছর আগে বাবা, ছ’মাস পরে মা চলে গেলেন। মায়ের দুটো আক্ষেপ ছিল। প্রথমত, তিনি ছেলের বউকে দেখতে চাইতেন। এ নিয়ে কম তর্কবিতর্ক হয়নি। কিন্তু সে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। কেবলই মনে হত একটি পূর্ণবয়স্কা মহিলা এই সংসারে এলে তাঁর ভাবনার সঙ্গে সঙ্ঘাত ঘটবেই। মা গ্রহণের দিনে ফ্রিজ পরিষ্কার করে ফেলতেন, বৃহস্পতিবার শাঁখ বাজাতেন। বাবা বলতেন, ‘তোমার শাঁখের শব্দ শুনে পুলিশ এল বলে।’ ‘চাঁদে মানুষ হাঁটছে আর তুমি সেকেলে মতে চন্দ্রগ্রহণ মানছ?’ মা হেসেবলত, ‘এই চাঁদ ওই চাঁদ না। এই চাঁদ চন্দ্রদেব।’ এ সব সত্ত্বেও সংসারে শান্তি ছিল।
মায়ের দ্বিতীয় ইচ্ছেটা সুড়সুড়ি দিত তাকেও। রানাঘাট থেকে বিয়ের পর মাকে যখন বাবার কর্মস্থলে যেতে হয়েছিল, তখন তাঁর বয়স ছিল সতেরো। উত্তরবঙ্গের পাহাড় ঘেরা ছোট্ট শহরটিকে তিনি খুব ভালবেসে ফেলেছিলেন। সে সময় বড় জোর হাজার তিনেক লোক বাস করত সেই শহরে। বেশির ভাগই পরস্পরকে চিনতেন। চোদ্দো বছর বয়স পর্যন্ত সেও ছিল ওই ছোট্ট শহরে। পড়ত একমাত্র হাইস্কুলে। ওরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকত, সেখানে মা অনেক গাছ লাগিয়েছিলেন। আম, লিচু, কাঁঠাল, বাতাবি লেবু, সুপারি। ওদের ছেড়ে চলে যাওয়ার দিনে মা অনেকক্ষণ কেঁদেছিলেন। জব্বলপুরে গিয়েও ওদের কথা ভাবতেন। বাবা বলতেন, ‘কাউকে ভোলার সবচেয়ে ভাল উপায় হল তাকে মনে না রাখা। খোঁজখবর নিয়ো না, চিঠি লিখো না, সব ভুলে যাবে।’ বাবার কথাই ঠিক বলে মনে হয়েছিল এক সময়। তাদের তিন জনের কেউ আর ওখানকার গাছগাছালি, মানুষের কথা নিয়ে আলোচনা করত না।
বাবা চলে যাওয়ার পরে এক ছুটির দুপুরে মায়ের পাশে শুয়েছিল সে। হঠাৎ বড় শ্বাস ফেলল মা। সে ফিরে তাকাতে মা বলল, ‘অ্যাদ্দিনে ওই গাছগুলো প্রতি বছর ফল দিচ্ছে কি না কে জানে!’
‘কোন গাছগুলো?’ জিজ্ঞাসা করেই মনে পড়ে গেল, বলল, ‘নিশ্চয় দিচ্ছে।’
‘না রে। অনেক গাছে ফল হয় না। পোকা হয় খুব। আমার আজকাল খুব ইচ্ছে হয়, যদি এক বার ঘুরে আসতে পারতাম!’
সে উঠে বসে হাসল, ‘কোথায় থাকবে গিয়ে? ওটা তো সরকারি বাড়ি ছিল!’
‘কেন? অনেকেই তো আছে। শেফালিদির বাড়ি গিয়ে থাকব।’
‘ঠিক আছে। যাওয়া যাবে।’
শোনামাত্র মায়ের মুখে অপূর্বসুন্দর হাসি ফুটেছিল। মাকে বলে দুঃখ দিয়ে কী লাভ! বেঁচে থাকলে শেফালি মাসির নব্বইয়ের কাছে বয়স হওয়া উচিত! না থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে কথা মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়নি তার।
তার পর মা চলে গেলেন। ক্রমশ শীতল নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরছিল তাকে। তখন বন্ধুরা চেয়েছিল দেশ থেকে কোনও সুন্দরীকে নির্বাচন করে ওর সঙ্গে জুড়ে দিতে। সিডনির বাঙালি মেয়েরা কুড়ি-বাইশেই বন্ধু পেয়ে যায়। তিরিশের ওপর যাঁরা একা থাকেন তাঁদের বেশির ভাগই বিবাহবিচ্ছিন্না। চট করে নতুন কারও সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে নারাজ তাঁরা। এই ইচ্ছে ওরও হয়নি। কিন্তু মাসখানেক আগে ভোর রাতে মাকে দেখল সে। তার পাশে শুয়ে মা বললেন, ‘আমার আজকাল খুব ইচ্ছে হয় যদি এক বার ঘুরে আসতে পারতাম।’ ঘুম ভেঙে গেলে সে অনেকটা সময় চুপচাপ বসে থেকে স্থির করল, যাবে। গিয়ে মায়ের হাতে যে সব গাছ বড় হচ্ছিল, তাদের দেখে আসবে। দশ দিনের ছুটির জন্যে দরখাস্ত করে প্লেনের টিকিট কাটতে গিয়ে জেনেছিল পশ্চিমবাংলায় একমাত্র কলকাতা শহরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আছে।
পার্ক হোটেলের রিসেপশনিস্ট বাংলা বলেন না। যে লোকটি তার ব্যাগ ঘরে পৌঁছে দিল, সে-ও হিন্দি বলল। সে খুব অস্বস্তিতে পড়ল। পশ্চিমবাংলায় কি এখন কেউ বাংলা বলে না? দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি ছিল, খাওয়ার ইচ্ছেও ছিল না। একঘুমে রাত কাটাল সে। পরদিন সকালে আবার এয়ারপোর্ট, প্লেন ধরা এবং বাগডোগরায় নামা। গন্তব্যের নাম শুনে ট্যাক্সি ড্রাইভার হিন্দিতে বলল, ‘স্যর, রাস্তা খুব খারাপ, ও দিকে গেলে গাড়ির ক্ষতি হবে।’ তিন চার জনের মুখে একই কথা শোনার পর এক জন ভরসা দিল, সে নিয়ে যেতে পারে কিন্তু শেষ দুই মাইল যাবে না, কারণ সেখানে রাস্তা বলে কিছু নেই, শুধু বড় বড় গর্ত। অবাক হয়ে সে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এ রকম অবস্থা কেন? সরকার রাস্তা সারায় না?’
‘সারায়। কিন্তু এক মাসের মধ্যে আগের মতো হয়ে যায়। সব শালা চুরি করে।’
দু’মাইল পথ আর কী এমন বেশি! স্যুটকেসটা সঙ্গে আছে বলে একটু সমস্যা হবে। প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া নিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার তাকে যেখানে নামিয়ে দিয়ে ফিরে গেল তার দু’পাশে ন্যাড়া মাঠ। এতক্ষণ ধরে ঝাঁকুনি খেয়ে খেয়ে সর্বাঙ্গে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল তার। এ রকম কুৎসিত রাস্তা কোনও সভ্য দেশে থাকতে পারে বলে তার ধারণা ছিল না।
চার ধার শুনশান। দুপুর শেষ হতে যাচ্ছে! রাস্তার পাশে একটা লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছ দেখে সে হেসে ফেলল। এত বছর পরেও গাছটা ঠিক আগের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সাইকেল চালিয়ে ওরা এখানে আসত ওই গাছের পাতা হাতে ঘষে গন্ধ শোঁকার জন্যে। টুবলু বলত, ওই গন্ধে সর্দি সেরে যায়। গাছটা আছে, টুবলু এখন কোথায় কে জানে!
স্যুটকেসটা নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। রাস্তা বলে কিছু নেই। বড় বড় গর্তে জল জমে আছে। সেগুলো বাঁচিয়ে ওজন নিয়ে হাঁটা খুব কষ্টকর। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরে সে রাস্তার পাশে একটা ভ্যানরিকশা দেখতে পেল। তার বালক-কিশোর বয়সে এই রকম ভ্যানরিকশা খুব চালু ছিল শহরে। সে রিকশার পাশে এসে চার পাশে তাকিয়েও রিকশাওয়ালাকে দেখতে পেল না। স্যুটকেসটাকে ভ্যানের ওপর রেখে তার হাসি পেল। সিডনি শহরে এই দৃশ্য কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
‘যাবেন কোথায়?’ যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এল লোকটা। বছর তিরিশেক বয়স, পরনে পাজামা আর হাতকাটা গেঞ্জি। লোকটাকে খুব চেনা বলে মনে হল তার। সে উত্তর দিতেই লোকটি বলল, ‘উঠে বসুন। মাঝখানে ধরে বসবেন। এ তো রাস্তা নয়, মরণফাঁদ।’
লোকটি রিকশা চালাল। নৌকোর মতো দুলতে দুলতে যাচ্ছে রিকশা। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই রাস্তা মেরামত হয়নি কত দিন?’
‘মনে নেই। এই যাঃ।’ লোকটি নেমে পড়ল রিকশা থেকে। নেমে খুলে যাওয়া চেন ঠিকঠাক লাগাল। ওর মুখের দিকে ভাল করে তাকাতেই পবনদার কথা মনে পড়ল। প্রায় ওই রকম দেখতে এই লোকটা। পবনদাও সাইকেল রিকশা চালাত। কত বছর আগের কথা। এ পবনদার ছেলে নয় তো?
‘তুমি মানে ক’দিন রিকশা চালাচ্ছ?’
‘বহু দিন।’ লোকটি আবার সিটে উঠে বসল।
ভ্যানরিকশা চলতে শুরু করলে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিছু মনে কোরো না, তোমার নামটা জানতে পারি? এক জনের সঙ্গে তোমার চেহারার খুব মিল আছে তাই।’
‘আমার নাম পবন।’
‘পবন?’ অবাক হয়ে গেল সে।
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, শ্রী পবনকুমার দাস। পিতার নাম মদনকুমার দাস।’
বলে কী লোকটা? পঁচিশ বছর আগে যখন সে এই জায়গা ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তখন পবনদার চেহারা তো এই রকমই ছিল। হ্যাঁ, মনে পড়ছে, পবনদার বাবার নাম ছিল মদন। রাজমিস্ত্রি ছিল। দোতলার ইট গাঁথতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে মরে গিয়েছিল। মদন মিস্ত্রিকে দেখতে ছুটে গিয়েছিল তারা, কারণ তার আগে ওরা কেউ মৃতদেহ দ্যাখেনি। এই পঁচিশ বছরে লোকটির চেহারা একদম পাল্টাল না। দেখে তো তার চেয়ে অনেক কম বয়সী বলে মনে হচ্ছে। সে মাথা নাড়ল।
শেষ পর্যন্ত শহরে ঢুকল ভ্যানরিকশা। পবন জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন পাড়ায় যাবেন?’
তখন চার পাশে তাকাচ্ছিল সে। পঁচিশ বছর আগে যে রকম দেখে গিয়েছিল এই শহরটাকে হুবহু সেই রকমই রয়েছে। ওই যে তরুণ সঙ্ঘ ক্লাবের মাঠ, তার পাশে নেতাজি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। একটুও বদলায়নি। পবন আবার প্রশ্নটা করলে সে বলল, ‘মন্দিরপাড়া।’
প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে পবন জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন বাড়ি?’
‘এই শহরের সবাইকে চেনো?’
‘সবাইকে কি চেনা যায়? তা অনেককেই চিনি।’
নাম মনে আসছিল না। শেফালি মাসির নাম বলবে? তাঁর তো এখন বেঁচে থাকার কথা নয়। তাদের বাড়িওয়ালার নাম ছিল কুঞ্জবিহারী। তাঁরও তো মরে যাওয়ার কথা। তবু তাঁরই নাম বলল সে। পবন মাথা নাড়ল। অর্থাৎ কুঞ্জবিহারীকে ও চেনে। অবাক কাণ্ড! তাদের যাওয়ার দিনে কুঞ্জবিহারী সাদা ধুতি, গেঞ্জি পরে লাঠি হাতে যখন বিদায় জানাতে এসেছিলেন, তখনই একটু ঝুঁকে হাঁটতেন, তাঁকেও চিনল পবন?
যে-বাড়ির সামনে ভ্যানরিকশা দাঁড় করাল পবন, তার দিকে তাকিয়ে খুশিতে মন ভরে গেল তার। এই বাড়িতেই সে চোদ্দো বছর বয়স পর্যন্ত থাকত। ব্যাগ নিয়ে নীচে নেমে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কত দিতে হবে?’
‘রাস্তার হাল তো দেখলেন! একটু বেশি দিন।’
‘কত?’
‘ছয়টা টাকা দিলে ভাল হয়।’
হকচকিয়ে গেল সে অঙ্কটা শুনে। দু’মাইল ওই কদর্য রাস্তায় তাকে নিয়ে আসার জন্যে মাত্র ছ’টা টাকা চাইছে? পঞ্চাশ চাইলেও দিতে দ্বিধা করত না সে। পার্স বের করে দুটো দশ টাকার নোট পবনের হাতে দিয়ে সে বলল, ‘এটা রাখো।’
‘বাবু থাকেন কোথায়?’
‘বিদেশে।’
‘তাই বলুন। অনেক বেশি দিচ্ছেন।’
‘তা হোক।’ বাড়িটার দিকে এগোল সে। বাইরের দরজা বন্ধ। ভুল হয়ে গেল। পবনকে বলা উচিত ছিল কোনও হোটেলে পৌঁছে দিতে। পঁচিশ বছর আগে এই ছোট্ট শহরে কোনও হোটেল ছিল না। কিন্তু এখন নিশ্চয়ই হয়েছে।
‘কাউকে খুঁজছেন?’ পেছন থেকে প্রশ্নটা ভেসে এল।
মুখ ফিরিয়ে মানুষটাকে দেখেই চিনতে পারল সে। কুঞ্জবিহারীবাবু! এখনও বেঁচে আছেন। সে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতেই কুঞ্জবিহারীবাবু বললেন, ‘থাক, থাক।’
‘আপনি কেমন আছেন?’ সে জিজ্ঞাসা করল।
‘ওই আর কী! এখনও আছি। কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না তো!’
‘আমরা আপনার এই বাড়িতে বহু বছর ভাড়া ছিলাম। তার পর জব্বলপুরে চলে যাই।’
‘আমরা মানে? আপনি সুধাময়বাবুর কে হন?’ বৃদ্ধ বললেন, ‘খুব ভাল মানুষ উনি। স্ত্রী আর চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন এই সে-দিন।’
এই সে-দিন? পঁচিশ বছর আগের ঘটনাকে বৃদ্ধ এই সে-দিন বলছেন? সে হেসে বলল, ‘সুধাময়বাবু আমার বাবা।’
বৃদ্ধ হাসলেন, ‘রসিকতা করছেন? আপনার বয়সী ছেলে ওঁর কী করে হবে? তিনি আপনার দাদা হতে পারেন। কেমন আছেন ওঁরা?’
কী বলবে সে? বাবা-মায়ের মৃত্যুসংবাদ দিলে কুঞ্জবিহারী যে বিশ্বাস করবেন না, তা বোঝাই যাচ্ছে। সে মাথা নাড়ল, যার অর্থ ভাল।
‘আপনাকে বোধ হয় এক বার ওঁদের কাছে আসতে দেখেছি। ঠিক মনে পড়ছে না। ওঁরা চলে যাওয়ার পর আর এই বাড়ি ভাড়া দিইনি। মনের মতো ভাড়াটে পাওয়া খুব মুশকিল। তা আপনি কি কোনও কাজে এখানে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ, একটু প্রয়োজন ছিল।’
‘অ। উঠেছেন কোথায়?’
‘কোথাও না। একটা ভাল হোটেলের খোঁজ পেলে…!’
‘আর ভাল হোটেল। একটা ধর্মশালা ছাড়া এখানে কোনও হোটেল নেই। এক কাজ করুন। বাড়িটা প্রতি সপ্তাহে পরিষ্কার কর া হয়। এখানেই থাকতে পারেন। কত দিন থাকবেন?’ কুঞ্জবিহারীবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
‘দিন সাতেক।’
‘কোনও সমস্যা হবে না। আপনি সুধাময়বাবুর ভাই, এটুকু তো করতেই হবে। খাওয়ার চিন্তা করবেন না। দু’বেলা আমার কাজের লোক টিফিন কেরিয়ারে করে আপনার খাবার পৌঁছে দেবে।’ তালা খুলে দিলেন কুঞ্জবিহারীবাবু।
ভদ্রলোক বিদায় নিলে সে বাড়িটাকে ঘুরে ঘুরে দেখল। একটুও বদলে যায়নি। যে ঘরে সে থাকত, তার দেওয়ালে ভারতের ম্যাপ এঁকেছিল বলে মায়ের কাছে খুব ধমক খেয়েছিল। সেই ম্যাপটা এখনও স্পষ্ট রয়েছে দেওয়ালে। কিন্তু কুঞ্জবিহারীবাবু তাকে সুধাময়বাবুর ভাই ভাবছেন কেন? পঁচিশ বছর পরে তার চেহারা তো চোদ্দো বছরের থাকতে পারে না। অথচ ভদ্রলোক একই রকম রয়েছেন। ওঁর শরীর দেখলে মনেই হবে না পঁচিশ বছর বয়স বেড়েছে।
তাজ্জব ব্যাপার!
ভেতরের দরজা খুলে বাগানে ঢুকে তার চোখ ছোট হয়ে গেল। মায়ের হাতে লাগানো গাছগুলো পঁচিশ বছরে ডালপালা ছড়িয়ে পরিপূর্ণ হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু এ কী দেখছে সে! গাছগুলো রয়েছে। শৈশব থেকে বালক হয়েছে মাত্র। পোকায় ধরলে বা গাছ ক্ষয়াটে হয়ে গেলে যেমন চেহারা হওয়া উচিত, এরা সে রকম নয়। বেশ তরতাজা কিন্তু এখনও কচি, আদৌ বড় হয়নি। ফলটল ধরার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আম, কাঁঠাল, বাতাবি লেবু, সুপারি গাছগুলোর ছোট্ট শরীরে হাত বোলালো সে। হঠাৎ মনে হল সে যেন মায়ের স্পর্শ পাচ্ছে ওদের ছুঁয়ে। আমি বড় হয়ে প্রৌঢ় হতে চললাম, তোরা কেন একটুখানি মাথা তুললি?
তবু সেই রাতে কুঞ্জবিহারীবাবুর পাঠানো খাবার খেয়ে কিশোরকালের বিছানায় শুতেই চমৎকার ঘুম হল। এই ঘরে এসি মেশিন কোনও কালেই ছিল না, এখনও নেই। অথচ গত পনেরো বছরে অষ্ট্রেলিয়ায় সামান্য গরম পড়লে এসি না চালালে ঘুমোতে পারত না সে। রাতে লক্ষ করেনি, ঘুম ভাঙার পর সকালে করল, মাথার ওপর যে ফ্যান ঘুরছে, সেটা আগের মতো ডিসি কারেন্টেই চলছে। পঁচিশ বছর আগে এই শহরে ডিসি কারেন্টই পাওয়া যেত। আশ্চর্য ব্যাপার। এখন পৃথিবীর কোথায় কোথায় এই কারেন্ট ব্যবহার করা হয়, তা নেট না খুললে জানা যাবে না।
সকালে কুঞ্জবিহারীবাবু ফ্ল্যাক্সে চা পাঠিয়ে দিলেন, সঙ্গে সুজির গোল বিস্কুট। আঃ ফাইন! সে খুব খুশি হল। এই বিস্কুট ছেলেবেলায় খেত সে। পরে কত দামি দামি বিস্কুট খেয়েছে কিন্তু আজ মনে হল এর স্বাদ আলাদা। এই বিস্কুট অষ্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায় না।
শার্ট, ফুলপ্যান্ট না পরে আজ বারমুডা আর টি-শার্ট পরল সে। ও দেশে ছুটির দিনে এই পোশাকেই বাজার করতে যেতে ওরা অভ্যস্ত। পায়ে একজোড়া কেডস গলিয়ে নিয়ে দরজায় তালা দিয়ে যখন সে রাস্তায় নামল, তখন ঘড়িতে ন’টা। আজ বেশ মিষ্টি রোদ চার পাশে। একটু হাঁটতেই খেলার মাঠ। পাশেই নেতাজি সঙ্ঘ ক্লাবের ঘর। সেখানে বড় বড় হরফে পোস্টার সাঁটা। আগামী রবিবার বিকেল চার ঘটিকায় পি ডি কাপ ফাইনালে নেতাজি সঙ্ঘ বনাম বিবেকানন্দ ক্লাবের ফুটবল ম্যাচ।
তার বেশ মজা লাগল। এই দুটো ফুটবল ক্লাব তার ছেলেবেলাতেও প্রায়ই ফাইনালে খেলত। পঁচিশ বছর ধরে বোধ হয় খেলে যাচ্ছে।
দু’মিনিট হাঁটতেই অন্তুদের বাড়িটা দেখতে পেল সে। অন্তু তার সঙ্গে পড়ত। খুব বন্ধুত্ব ছিল ওর সঙ্গে। যাওয়ার দিন অন্তু তার হাত ধরে অনেক কেঁদেছিল। কিন্তু ওদের বাড়িতে সে চেষ্টা করত না যেতে। অন্তুর বোন চন্দ্রকলা যেন তাকে সহ্য করতে পারত না। দেখা হলেই ট্যারা বাঁকা কথা বলত। পিঠোপিঠি ভাইবোন, এক ক্লাস নীচে পড়ত। এক বার তাকে একলা পেয়ে বলেছিল, ‘এই যে, আমার দিকে ও রকম করে তাকাও কেন? আবার তাকালে চোখ গেলে দেব।’ সে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘আশ্চর্য! তোমার দিকে তাকাতে যাব কেন?’
‘এম্মা! আবার মিথ্যে কথা। সবাই বলে আমার দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না, ইনি বলছেন তাকাব কেন? মিথ্যেবাদী!’
ব্যাপারটা অন্তুকে বলেনি সে, কিন্তু চন্দ্রকলাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে ওদের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করেছিল। এখন মনে পড়ছে, সত্যি সুন্দরী ছিল চন্দ্রকলা। কিন্তু বড্ড মুখরা। এত দিনে সে নিশ্চয়ই ছেলেমেয়ের মা হয়ে চুটিয়ে সংসার করছে। দেখলে চিনতেও পারবে না। অন্তুও নিশ্চয়ই এখানে নেই। কোনও বড় শহরে চাকরি করাই স্বাভাবিক। তবে ওর বাবা-মায়ের কাছে খবরটা পাওয়া যেতে পারে। সে এগিয়ে গিয়ে বন্ধ দরজায় কড়া নাড়ল।
আধ মিনিট পরে দরজা খুলল যে তাকে দেখে সে অবাক। কপাল থেকে একগাছি চুল সরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে চাই?’
সে হাসল। এ নিশ্চয়ই চন্দ্রকলার মেয়ে। অবিকল এক রকম দেখতে হয়েছে। তবে এই পঁচিশ বছরে চন্দ্রকলার মুখের পুরোটা ঠিক স্মরণে নেই।
‘কিছু বলবেন, না ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবেন?’
‘তো… তোমার মামা বাড়িতে আছে?’
‘আমার মাম া কেনএই বাড়িতে থাকবে? কে আপনি?’
‘অন্তু, অন্তুর কথা বলছি!’
‘অ। অন্তু আমার মামা, এ কথা আপনাকে কে বলল।’ তার পর ঘুরে চিৎকার করল, ‘এই দাদা, তোকে কে ডাকছে দ্যাখ।’ চোখের আড়ালে চলে গেল মেয়েটা। এ কী! মেয়েটা অন্তুকে দাদা বলল কেন? ওরা এখান থেকে চলে যাওয়ার পরে অন্তুর আবার কোনও বোন হয়েছিল নাকি? অসম্ভব। অন্তুর পঁচিশ বছরের ছোট বোন থাকতেই পারে না। আরও অতীতে এ সব হত বলে মায়ের কাছে শুনেছে সে।
‘কাকে চাইছেন?’
গলা শুনে মুখ ফেরাতেই তার চোখ স্থির হয়ে গেল। অন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেই হাফপ্যান্ট আর হাফ-শার্ট পরা অন্তু, যে তার হাত ধরে যাওয়ার দিন কেঁদেছিল, সে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘অন্তু, তুমি অন্তু?’ সে জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ। আপনি কে?’
‘আমি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি—!’ নিজের নাম বলল সে।
কপালে ভাঁজ পড়ল অন্তুর। তাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখল। পনেরো বছরের ছেলে চল্লিশের মানুষকে যে ভাবে দেখে।
‘আমাকে চিনতে পারছিস না?’ আবেগে ‘তুই’-তে নেমে এল সে, ‘আমরা খুব বন্ধু ছিলাম। পঁচিশ বছর আগে জব্বলপুরে চলে গিয়েছিলাম বাবা-মায়ের সঙ্গে। তুই খুব কেঁদেছিলি। মনে পড়ছে?’
‘ধ্যাৎ! সেটা পঁচিশ বছর আগে হবে কেন? তখন তো আমি জন্মাইনি। এই তো সেদিনের কথা। এই ক’দিনে এত বড় চেহার া হবেকী করে?’
‘হয়ে গেছে। বিশ্বাস কর। এখানে আসার আগে জানতাম না যে এত বদলে গেছে আমার চেহারা।’
‘আমি বিশ্বাস করি না।’
এই সময় এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। চিনতে অসুবিধে হল না তার। এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতেই ভদ্রলোক, ‘এ কী করছেন’ বলে সরে দাঁড়ালেন।
অন্তু বলল, ‘বাবা! আমার বন্ধু যে জব্বলপুরে চলে গিয়েছে…!’
‘হ্যাঁ। সুধাময়ের ছেলে।’
‘উনি নিজেকে তাই বলে দাবি করছেন। বলছেন ওঁর চেহার া যেপাল্টে গিয়েছে তা নাকি জানতেন না।’
‘বিশ্বাস করুন মেসোমশাই, আপনারা সবাই আগের মতো কী করে আছেন, তাই ভেবে পাচ্ছি না।’
‘পাচ্ছেন না? আপনি কি পাগল?’
‘আমাকে আপনি বলবেন না, প্লিজ।’
‘কিন্তু আপনার কথা অসংলগ্ন, অন্তুর বন্ধু বলে দাবি করছেন অথচ নিজের চেহার া দেখছেননা। বেশ, আপনি কী প্রমাণ দিতে পারেন?’
‘যা চাইবেন।’
‘তার মানে?’
‘আমরা ওয়ান থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত একসঙ্গে পড়তাম। আমাদের অনেক কথা আছে যা তৃতীয় ব্যক্তি জানে না। জিজ্ঞাসা করুন।’
অন্তুর বাবা অন্তুর দিকে তাকালেন।
অন্তু চোখ বন্ধ করে ভাবল। তার পর জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার বাংলার মোটা খাতা কে চুরি করেছিল?’
শ্যামল। কিছুতেই স্বীকার করেনি। ও যখন বাড়িতে ছিল না, তখন আমরা ওর বাড়িতে গিয়ে পড়ার টেবিল খুঁজে ওটা পেয়ে যাই। তখন কী কান্না ওর।’ সে বলল।
অন্তুর বাবা বললেন, ‘এই ঘটনার কথা সবাই জানে। অন্য কিছু জিজ্ঞাসা কর!’
‘চলে যাওয়ার মাসখানেক আগে নদীর চরে দাঁড়িয়ে আমি খুব বকেছিলাম। কেন?’
‘মেসোমশাইয়ের সামনে বলব?’ সে জিজ্ঞাসা করল।
অন্তুর বাবা মাথা নাড়লেন, ‘বলুন।’
‘আমি বাবার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলাম নদীর চরে। কেমন খেতে লাগবে বলতেই তুই খুব রেগে গিয়েছিলি। বলেছিলি সিগারেট খেলে টি বি হয়।’ সে হেসে বলতেই অন্তুর বাবা গম্ভীর হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। অন্তুর মুখে হাসি ফুটল। বলল, ‘ঠিক, ঠিক।’
ইতিমধ্যে চন্দ্রকলা ফিরে এসে দাঁড়িয়েছে ভেতরের দরজায়, পাশে তার মা। তাঁর দিকে চোখ যেতেই সে জিজ্ঞাসা করল, ‘মাসিমা, আমাকে চিনতে পারছেন?’
অন্তুর মা বললেন, ‘খুব চেনা চেনা লাগছে!’
‘আমি সেই।’ তার পর দ্রুত কথাটা বানাল, ‘একটা ওষুধ খেতাম স্বাস্থ্য ভাল হবে বলে, তার ফলে এই অবস্থা হয়ে গেছে।’
অন্তুর বাবা বললেন, ‘তাই বলো। এ রকম হয়। কোনও কোনও ওষুধের সাইড এফেক্ট শরীরকে বদলে দেয়। তুমি তা হলে সুধাময়বাবুর ছেলে। তোমার বাবা কেমন আছেন?’
‘ভাল।’
‘তা ওঁরা আসেননি?’
‘না। আমি একাই চলে এলাম।’
‘জব্বলপুর থেকে একা এসেছ? অবশ্য তোমার চেহারা দেখে কেউ তো বয়স আন্দাজ করতে পারবে না। ঠিক আছে, তোমরা কথা বলো…!’ অন্তুর বাবা ভেতরে চলে গেলেন। পেছনে ওর মা-ও।
সে তাকাল অন্তুর দিকে, ‘কী রে, বিশ্বাস হচ্ছে?’
অন্তু হাসল, ‘পৃথিবীর নবম আশ্চর্য! এই জানিস, অরুণদা মারা গেছে?’
‘অরুণদা মানে? আমাদের স্কুলের ক্রিকেট প্লেয়ার?’
‘হ্যাঁ। আম পাড়তে গাছে উঠেছিল, পড়ে গিয়ে স্পট ডেড।’
‘ইস্। খুব ভাল খেলত রে, বলত, দেখিস এক দিন ইণ্ডিয়া খেলব।’
এই সময় অন্তুর মা একটা প্লেটে চারটে গোকুলপিঠে সাজিয়ে নিয়ে এলেন। সঙ্গে চামচ। বললেন, ‘খেয়ে দ্যাখো, কেমন হয়েছে!’
‘আরে, গোকুলপিঠে? উঃ, কত দিন খাইনি।’
‘কেন? জব্বলপুরে তোমার মা করেন না?’
‘না। মা একদম সময় পায় না।’ চামচে তুলে মুখে দিল সে, ‘বাঃ, দারুণ।’
অন্তুর মা হেসে ভেতরে চলে গেলেন।
অন্তু চন্দ্রকলার দিকে তাকাল, ‘তুই কিছু বলছিস না কেন?’
‘কী বলব বুঝতে পারছি না।’ চন্দ্রকলা বলল, ‘তবে শরীর বদলে গেলেও একটা ব্যাপার ঠিকই আছে!’
সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী?’
‘ড্যাব ড্যাব করে তাকানো।’
‘তখন বললে ফ্যাল ফ্যাল করে…।’
‘বেশ করেছি। আমার যা ইচ্ছে হবে তাই বলব।’ চন্দ্রকলা এক ঝটকায় নিজেকে ভেতরে নিয়ে গেল।
একটু পরে ওরা রাস্তায় হাঁটছিল। অন্তু বলল, ‘এখন আর তোমাকে অচেনা বলে মনে হচ্ছে না। তুমি ডাক্তারকে বলোনি কেন ওই ওষুধের রিঅ্যাকশন কাটিয়ে এমন কোনও ওষুধ দিতে, যাতে আগের চেহারায় ফিরে যাবে।’
‘বলেছি। ডাক্তার বলেছেন তেমন কোনও ওষুধ নেই। তাই মা বলল এখানে আসতে। তোদের সবাইকে দেখলে, কথা বললে যদি কাজ হয়। কিন্তু অন্তু, তুই আমাকে ‘তুমি তুমি’ করে যাচ্ছিস কেন?’
অন্তু হাসল কিন্তু সে কথা বলার আগেই ও-পাশ থেকে এক জন বলে উঠলেন, ‘কে যায়? আমার ছাত্র নাকি?’
ওরা তাকাল। সুশীল স্যর চোখের ওপর হাত রেখে তাদের দেখতে চেষ্টা করছেন। সে এগিয়ে গেল, ‘হ্যাঁ স্যর, আমরা যখন ক্লাস ফোরে পড়তাম, তখন আপনি রিটায়ার করেছিলেন। আপনার কি দেখতে অসুবিধা হচ্ছে স্যর?’
‘হ্যাঁ বাবা। দশ ভাগ পাই, নব্বই ভাগ ঝাপসা। মিউনিসিপ্যালিটিতে গিয়েছিলাম এখন বাড়ি ফিরছি। যাওয়ার সময় তেমন অসুবিধে হয়নি, কিন্তু এখন যেন আরও ঝাপসা লাগছে। আমাকে একটু এগিয়ে দেবে বাবা?’ সুশীল স্যর বললেন।
সে অন্তুর দিকে তাকাল, ‘চল স্যরকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’
‘কিন্তু মা যে বলল মাংস কিনে আনতে। এর পরে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।’
‘ও। ঠিক আছে, তুই যা, আমি স্যরকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’
‘তাড়াতাড়ি না ফিরলে মা কিন্তু রাগ করবে।’
‘ঠিক আছে।’ সে এগিয়ে গিয়ে সুশীল স্যরের হাত ধরল, ‘চলুন স্যর।’
‘চলো। এ বার বোধ হয় পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাব।’
‘ডাক্তার কী বলছেন?’
‘কী বলবে? ওষুধে কাজ হল না। মাদ্রাজে গিয়ে অপারেশন করাতে বলছে। অনেক খরচ। সারা জীবন মাস্টারি করে যা পেয়েছি তা খরচ করে ফেললে বাকি জীবন কী দিয়ে চলবে? তা ছাড়া মেয়েটার জন্যেও কিছু রেখে যেতে পারব না।’ সুশীল মাস্টার বললেন।
হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবল, চোখ অপারেশন করতে কী এমন টাকা লাগে! পাঁচ হাজার অষ্ট্রেলিয়ান ডলার? কোনও সমস্যাই নয়। তখনই তার খেয়াল হল, সুশীল স্যরের শরীরের বয়স তো একশো হওয়া উচিত। একশো বছর বয়সে কেউ এ ভাবে হাঁটতে পারে? সেই মানুষ তো দৃষ্টি হারিয়ে ফেলবেনই। সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে সতর্ক করল। ওই পঁচিশ বছরের ব্যবধানটা তার এখন ভুলে যাওয়া উচিত। সুশীল স্যর ছয়-সাত বছর আগে অবসর নিলে এখন একাত্তর-বাহাত্তরের বেশি হয়নি।
সুশীল স্যরের বাড়িটা তার চেনা। টিনের ছাদ, এক তলা বাড়ির ভেতরে উঠোন। সে বলল, ‘আমরা এসে গেছি স্যর।’
‘অনেক ধন্যবাদ বাবা, খুব উপকার করলে। ওই টিনের দরজার কাছে গেলেই হবে।’
উঠোনে ঢোকার টিনের দরজা খুলতেই ভেতর থেকে মেয়েদের গলা ভেসে এল, ‘কে? কে এল?’
সুশীল স্যর বললেন, ‘আমি রে পাখি। আমার এক ছাত্র নিয়ে এল।’
‘এত বার বললাম আপনি যাবেন না, আমি যাব, শুনলেন না। সেই তো অন্যের সাহায্য নিতে হল।’ বলতে বলতে যিনি ভেতরের ঘর থেকে উঠোনে নেমে এলেন তাঁর বয়স মধ্যতিরিশের বেশি নয়। ছিপছিপে, লম্বা, অত্যন্ত সুশ্রী। তাকে দেখল মেয়েটি। তার পর এগিয়ে এসে সুশীল স্যরের হাত ধরে বলল, ‘চলুন।’
‘এ আমার ছাত্র। এত দূরে আমার জন্যে এল। আমার মেয়ে পাখিকে কি তুমি আগে দেখেছ?’
‘না স্যর।’
‘ও এখানকার জুনিয়ার গার্লস স্কুলে পড়ায়।’
সুশীল স্যরকে বারান্দায় চেয়ারে বসিয়ে পাখি বলল, ‘আপনি বসুন।’
সে মাথা নাড়ল, ‘না। থাক।’
‘সে কী! এতটা পথ বাবার জন্যে এসে কিছু না খেয়ে চলে যাবেন নাকি? চা না শরবত, কী খাবেন?’ পাখি জিজ্ঞাসা করল।
‘শরবতই দে ওকে। নিশ্চয়ই তেষ্টা পেয়েছে।’
‘আচ্ছা, তুমি তখন কী বললে? যখন ক্লাস ফোরে পড়তে তখন আমি রিটায়ার করেছিলাম? তা হলে তো তোমার এখন ষোলো বছর বয়স। পাখি আপনি বলছে কেন?’
ভেতর থেকে পাখির গলা ভেসে এল, ‘ভুল শুনেছেন বাবা। উনি নিশ্চয়ই আপনার অনেক পুরনো ছাত্র।’
‘তাই? কোন ব্যাচ?’
‘প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে গেল।’ সত্যি কথাটাই বলল সে।
‘ও। তা কী করছ এখন?’
‘চাকরি করছি।’
‘এখানেই?’
‘না স্যর। আমরা জব্বলপুরে চলে গিয়েছিলাম। হায়দরাবাদে পড়াশোনা করে এখন অষ্ট্রেলিয়াতে আছি।’
‘ওরে ব্বাবা। আমার ছাত্ররা কোথায় না কোথায় ছড়িয়ে গিয়েছে। বিয়েথা নিশ্চয়ই করেছ, ছেলেমেয়ে ক’টি?’
সে হাসল, ‘না স্যর, বিয়েটা করা হয়নি।’
‘সে কী? কেন?’
‘এমনি। কোনও কারণ নেই।’
‘আমার এই মেয়েটা কত চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না বিয়ে করতে। সমানে বলে গেল, ও বিয়ে করলে আমায় কে দেখবে?’ সুশীল স্যরকে বিষণ্ণ দেখাল।
এক গ্লাস লেবুর শরবত ট্রেতে করে নিয়ে এল পাখি, ‘নিন। বাবা সেই একই কথা বলে যাচ্ছেন। প্রত্যেক মানুষের নিজের ইচ্ছে বলে একটা কথা আছে, তাই না?’
‘ঠিকই।’ শরবতে চুমুক দিল সে, বেশ ভাল।
‘আচ্ছা, অষ্ট্রেলিয়ায় চোখ অপারেশন করতে কী রকম খরচ হয়?’ সুশীল স্যর আচমকা জিজ্ঞাসা করলেন।
‘ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি খরচটা দিয়ে দেয়। আমি খোঁজ নিতে পারি।’
পাখি বলল, ‘বাবা, ভারতবর্ষের চেয়ে অনেক বেশি খরচ হবে। যেতে আসতেও তো অনেক ভাড়া।’
‘মাদ্রাজে আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছেন। চেষ্টা করব?’ সে জিজ্ঞাসা করল।
‘একটু দেখুন না। বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না খরচের ভয়ে।’ পাখি বলল, ‘আপনি যদি করে দিতে পারেন, তা হলে উনি আবার দেখতে পাবেন।’
পাখি তাকে টিনের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনার নামটা জিজ্ঞাসা করা হয়নি।’
সে হাসল, ‘আমি তো জেনে গেলাম। আমিই যোগাযোগ করব।’
দুপুরের খাওয়া হল চমৎকার। মাংসটা দারুণ। অনেক দিন পরে মাটিতে আসন পেতে বসে চেটেপুটে খেল সে। খাওয়ার পরে বাইরের ঘরে একা বসেছিল সে, চন্দ্রকলা প্লেটে লবঙ্গ নিয়ে এল। একটা লবঙ্গ তুলে সে বলল, ‘ধন্যবাদ।’
চন্দ্রকলা মুখ নামাল, ‘আমার অন্যায় হয়ে গেছে। আমি আর বলব না।’
‘কী?’
‘ওই ড্যাবড্যাব করে তাকানোর কথা।’
‘যদি তাকাই?’ হাসল সে।
‘তবু বলব না।’ দৌড়ে ভেতরে চলে গেল চন্দ্রকলা।
সেই রাতে বিছানায় শুয়েও ঘুম আসছিল না তার। যখন সে এখানে থাকত, তখন অনেক সমস্যার কথা তার জানা ছিল না। অন্তুর বাবা আর কয়েক বছর পর অবসর নেবেন। তখনও যদি অন্তু চাকরি না পায় তা হলে বিপদ হবে। চন্দ্রকলারও বিয়ে দিতে হবে। সে ইচ্ছে করলে অন্তুকে সিডনিতে নিয়ে গিয়ে ভাল কলেজে ভর্তি করে দিতে পারে। চার বছরের মধ্যেই চাকরি পেয়ে যাবে। সে চাইলে এখনই সুশীল স্যরকে ম্যাড্রাসে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করাতে পারে। সঙ্গে কার্ড আছে, টাকার অভাব হবে না। আর ওই টাকা খরচ করলে তার কোনও অসুবিধে হবে না। পাখি…! মুখটা মনে পড়তেই কী রকম একটা ভাল লাগা তৈরি হল বুকে। মা যদি বেঁচে থাকত তা হলে এখানে এসে পাখির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিত। মা পাখিকে দেখে খুশি হতেন। তার পরেই তার মনে হল, এই পাখির বয়স এখন কত? পঁচিশ বছর আগে পঁয়ত্রিশ হলে এখন ওর ষাট হয়ে যাওয়া উচিত। ধীরে ধীরে সে ধাতস্থ হল। এখন সে কিছুই করতে পারে না। পঁচিশটা বছর তাকে যেমন অনেক দিয়েছে তেমনি কেড়ে নিয়েছে প্রচুর।
দ্বিতীয় রাতে তার আর ঘুম আসছিল না।
‘আপনি এখনও দাঁড়িয়ে আছেন বাবু?’
চমকে পাশে তাকাল সে। এক জন প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে। মাইকে কী সব ঘোষণা হচ্ছে।
‘আপনাকে তো বলা হয়েছে যেখানে যেতে চেয়েছেন সেখানে কোনও ট্যাক্সি যাবে না! যাওয়ার রাস্তা না থাকলে কী করে যাবে বলুন।’ প্রৌঢ় বলল।
‘এক জন ড্রাইভার আমাকে দু’মাইল আগে…।’
‘কী যে বলেন। কোনও ড্রাইভার ও-দিকে একশো গজও যেতে পারবে না। যদি চান তা হলে এখানকার হোটেলে পৌঁছে দিতে পারি। ভাল হোটেল আছে।’
এ বার স্পষ্ট শুনতে পেল সে। কলকাতাগামী বিমান যাত্রার জন্যে তৈরি। যাত্রীদের শেষ বার জানানো হচ্ছে। সিকিয়োরিটি চেকিং করে বিমানে ওঠার সুযোগ এর পরে আজ আর পাওয়া যাবে না।
সে দৌড়াল। কাউন্টারে গিয়ে টিকিট দেখিয়ে বলল, ‘একটা বোর্ডিং কার্ড প্লিজ।’
‘বন্ধ হয়ে গিয়েছে। লাস্ট কল হয়ে গেছে।’
‘প্লিজ। আমাকে আজ কলকাতায় ফিরে যেতে হবে।’
অনেক অনুরোধ করার পর লোকটি টিকিট নিয়ে বলল, ‘আপনার তো ফেরার টিকিট ওপেন আছে।’
‘আমি আজই ফিরতে চাই।’
বোর্ডিং কার্ড বের করে ওর হাতে দিয়ে লোকটা বলল, ‘লাগেজ হাতে নিয়ে দৌড়ান। যাত্রা শুভ হোক।’