সুবোধ ঘোষের গল্প জতুগৃহ: বাঙালি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান গল্পকার সুবোধ ঘোষ তার গল্পের মাধ্যমে পাঠকদের হৃদয় জয় করেছেন। তার রচিত “জতুগৃহ” এমন একটি গল্প যা মানবিক আবেগ, সম্পর্ক এবং জীবন সংগ্রামের গভীরতা তুলে ধরে। এই গল্পে সুবোধ ঘোষের অনন্য বর্ণনাশৈলী এবং চরিত্র চিত্রণ পাঠকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। “জতুগৃহ” কাহিনীতে আমরা দেখতে পাই সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনযাত্রা এবং তাদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন। সুবোধ ঘোষের “জতুগৃহ” কেবল একটি গল্প নয়, এটি বাঙালি জীবনের এক অপরিহার্য প্রতিচ্ছবি। পাঠকরা এই গল্পে যেমন জীবনের গভীরতা খুঁজে পাবেন, তেমনই পাবেন অনুপ্রেরণা এবং চিন্তার খোরাক। ২০২৪ সালে সুবোধ ঘোষের এই কাহিনী পাঠকদের নতুন করে ভাবাবে এবং বাঙালি সাহিত্যে তার অবদানকে আরও একবার স্মরণ করাবে।
সুবোধ ঘোষের গল্প জতুগৃহ 2024 l Jotugriho by Subodh Ghosh
Table of Contents
এত রাত্রে এটা কোন ট্রেন? এই শীতার্ত বাতাস, অন্ধকার আর ধোঁয়া ধোঁয়া বৃষ্টির মধ্যে ট্রেনটা যেন হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ছুটে এসে রাজপুর জংশনের প্লাটফর্মের গায়ে লাগলো।
খুব সম্ভব গঙ্গার ঘাটের দিক থেকে ট্রেনটা এসেছে। এখনো অদূর গঙ্গার বুকে সেই স্টিমারের চিমনি বাঁশির শব্দ শোনা যায়, যে স্টিমারটা একদল যাত্রীকে ঘাটে নামিয়ে দিয়ে একটু হালকা হয়ে আর হাঁপ ছেড়ে আবার ওপারে চলে যাচ্ছে।
প্লাটফর্মের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ট্রেনের এঞ্জিন আস্তে আস্তে হাঁপাতে থাকে। ফাস্ট ক্লাস ওয়েটিংরুমে বয়টা একটু ব্যস্ত হয়ে ওঠে। টেবিল চেয়ার বেঞ্চ আর আয়নাটার ওপর ঝটপট তোয়ালে চালিয়ে একটু পরিচ্ছন্ন করে ফেলে। জমাদার এসে রুমের টুকিটাকি আবর্জনা বড় বড় ঝাড়ুর টান দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যায়।
ঘাটের ট্রেনটা ছোট হলেও এবং যাত্রীর সংখ্যা কম হলেও ফাস্ট ক্লাসের যাত্রী দু-একজন তার মধ্যে পাওয়াই যায়। হয়তো কাটিহারের কোন চিনিকলের মহাজন, অথবা দার্জিলিং-ফেরত কোন চা-বাগানের সাহেব, এই ধরনের কুলিন শ্রেণীর যাত্রীও থাকেন, শুধু সাঁওতাল কুলির দলই নয়।
কিন্তু আজ এখন যাঁরা এই ক্লান্ত ট্রেন থেকে নেমে ব্যস্তভাবে এসে ফাস্ট ক্লাস ওয়েটিংরুমে আশ্রয় নিলেন, তাঁদের সঙ্গে চিনিকল অথবা চা-বাগানের কোন সম্পর্ক নেই।
কুলির মাথায় বাক্স-বেডিং চাপিয়ে প্লাটফর্মের ওপর দিয়ে ওঁড়ো-ওঁড়ো বৃষ্টির মধ্যে তরতর করে হেঁটে ওয়েটিংরুমে প্রথম এসে ঢুকলেন এক বাঙালী মহিলা। গায়ে কাশ্মিরী পশমে তৈরি একটা মেয়েলী আলস্টার, কানে ইহুদী প্যাটানের ছোট ফিরোজার দুল, খোঁপা বিলিতি ধাঁচে ফাঁপানো।
তারপরেই যিনি এসে ঢুকলেন, তাঁরও সঙ্গে কুলি, আর তেমনি বাঙ্গ-বেডিংয়ের বহর। চোখে চশমা, গায়ে শাল, দেশী পরিচ্ছদে ভূষিত এক বাঙালী ভদ্রলোক।
এক ভদ্রলোক আর এক মহিলা, একই ট্রেনের যাত্রী হয়ে এক ওয়েটিংরুমে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এই মাত্র সম্পর্ক, যদি নেহাতই একে সম্পর্ক বলা যায়। ইনি হয়তো ঘন্টা দুয়েক আর উনি ঘণ্টা তিনেক পথপ্রাস্তের এই শিবিরে ট্রেনের প্রতীক্ষায় থাকবেন, তারপর চলে যাবেন যাঁর যাঁর পথে।
কিন্তু আশ্চর্য, ঘরে ঢোকা মাত্র দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথমে চমকে ওঠেন, তারপরেই চিত্রবৎ স্তব্ধ হয়ে থাকেন। দুজনেই যেন অপ্রস্তুত ও লজ্জিত, বিরক্ত ও বিড়ম্বিত, এবং একটু ভীতও হয়েছেন। যেন কাঠগড়া থেকে পলাতক ফেরারী আসামীর মত বহুদিন পরে এবং নতুন করে এক আদালত ঘরের মধ্যে দুজনে এসে পড়েছেন। মাধুরী রায়ের আলস্টারে কুচি কুচি জলের ফোঁটা নিঃশব্দে চিকচিক করে। শতদল দত্তও জলেভেজা চশমার কাচ মুছে নিতে ভুলে যায়।
এটা রাজপুর জংশনের ওয়েটিংরুম, আদালত নয়। জঙ্গ নেই, উকিল নেই, সাক্ষী নেই, সারি সারি সাজানো কতগুলি নিম্পলক লোকচক্ষুও নেই। প্রশ্ন করে লজ্জা দিতে, স্বীকৃতি বা স্বাক্ষর আদায় করতে তৃতীয় কোন ব্যক্তি নেই। তবু এই নিভৃত সান্নিধ্যই দুজনের কাছে বড় বেশি দুঃসহ বলে মনে হয়। সরে পড়তে পারলে ভাল, সরে যাওয়াই উচিত।
শতদল দরজার কাছে এগিয়ে এসে ডাক দেয়—কুলি।
মাধুরীর জিনিসপত্র ছড়িয়ে পড়ে আছে ঐ বেঞ্চের ওপর। শতদলের জিনিসপত্র স্থূপীকৃত হয়ে রয়েছে ঐ টেবিলটার ওপর।
এক্ষুনি জিনিসপত্র আবার কুলির মাথায় চাপিয়ে শতদল দত্তকে চলে যেতে হবে। কিন্তু কোথায়, তা সে জানে না। শুধু অদৃশ্য লজ্জায় অভিভূত এই ওয়েটিংরুম ছেড়ে অন্য কোনখানে, হয়তো ঐ মুসাফিরখানায়, যেখানে এরকম আলো নেই, আসবাবও নেই, কিন্তু অতীতের এক অস্পষ্ট ছায়াকে এত জীবন্ত মূর্তিতে মুখোমুখি দেখে বিব্রত হওয়ার শঙ্কাও সেখানে নেই। শতদলের ডাকে সাড়া দিয়ে কিন্তু কুলিদের কেউ এল না, এল ওয়েটিংরুমের বয়।
—হুজুর!
বয়কে উত্তর দিতে হবে। শতদল দত্ত আর একবার দরজা পর্যন্ত পায়চারি করে এগিয়ে যায়, বাইরে উকি দিয়ে তাকায়, গুঁড়ো বৃষ্টির একটা ঝাপটা মুখে এসে লাগে। ফিরে এসে আবার টেবিলটার পাশে দাঁড়ান, যেন নিজেরই চিন্তার ভেতর পায়চারি করে উত্তর সন্ধান করছে শতদল ৷
চুপ করে দাঁড়িয়ে কি ভাবতে থাকে শতদল, বোধহয় ততক্ষণে নিজের মনের অবস্থাটার ওপরই রাগ করে একটু শক্ত হয়ে উঠেছে। এভাবে বিচলিত হওয়ার কোন অর্থ নেই। ওয়েটিংরুমের মধ্যে মাত্র একজন যাত্রীকে দেখে এভাবে পালিয়ে যাওয়ার অর্থ, একটা অর্থহীন দুর্বলতার কাছে হার মেনে যাওয়া।
বয় বলে—ফরমাস করুন হুজুর।
বেশ স্বচ্ছন্দভাবে শতদল দত্ত টেবিলের কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে, স্বচ্ছন্দ স্বরে বয়কে নির্দেশ দেয়—চা নিয়ে এস।
আর ওদিকে, কাশ্মিরী পশমের আলস্টার গা থেকে নামিয়ে মাধুরী রায় বেঞ্চের ওপর রাখে। জিনিসপত্রগুলি সরিয়ে একটু জায়গা করে নিয়ে বেঞ্চের ওপরই চুপ করে বসে থাকে।
শতদল দত্ত আর মাধুরী রায়। দুজন ট্রেনযাত্রী মাত্র, রাজপুর জংশনের ওয়েটিংরুমে বসে থাকে ট্রেনের প্রতীক্ষায়। এছাড়া দুজনের মধ্যে আজ আর কোন সম্পর্ক নেই।
শুধু আজ নয়, আজ প্রায় পাঁচ বছর হলো দুজনের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার আগে ছিল, সেও প্রায় একটানা সাত বছর ধরে। সম্পর্কের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল প্রায় বারো বছর অতীতে, যে অতীতে মাধুরী মিত্র নামে দেখতে-বড়-সুন্দর এক অনুঢ়া তরুণী শতদলের মেজবউদির বান্ধবী মাত্র ছিল। আর স্থানটা ছিল ঘাটশিলা, সময়টা ফাল্গুন, মধুক্রমের বীথিকায় যখন সৌরভের উৎসব জাগে। তারই মধ্যে আকস্মিক এক অপরাহের আলোকে শুধু একটি বেড়াতে যাবার ঘটনা, সেই তো মাধুরী মিত্রের সঙ্গে শতদল দত্তের সম্পর্কের আরম্ভ।
এক বছরের পরিচয়ে দুজনে দুজনকে যে খুবই বেশি ভালবেসেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। সে ভালবাসা আইনমত রেজিস্ট্রারিও করা হয়, তার মধ্যেও কোন ভুল ছিল না। কিন্তু বিয়ের পর সাতটি বছর পার হতে না-হতেই মাধুরী দত্ত আর শতদল দত্তের মধ্যে সে ভালবাসার জোর আর রইল না। তাই আবার দুজনেই স্বেচ্ছায় এবং আইনমত আদালতের শরণ নিল, রেজিস্ট্রারি করা সম্পর্ক বাতিল করে দিয়ে দুজনের ছাড়াছড়ি হয়ে গেল।
কে জানে কেমন করে দুজনেই বুঝতে পেরেছিল, ভালবাসার জোর আর নেই। মনের দিক থেকে দুজনে দুজনেরই কাছে যখন পর হয়ে গেল, তখন লোকচক্ষুর সম্মুখে অনৰ্থক আর থিয়েটারের স্বামী-স্ত্রীর মত দাম্পত্যের অভিনয় না করে দুজনেই দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিল। কেউ কাউকে বাধা দিল না।
ফাল্গুনের ঘাটশিলার মধুক্রমের সৌরভে যে প্রেমের আবিভাব, মাত্র সাতটি নতুন ফাল্গুনও তার গায়ে সহ্য হলো না। এতজোর ভালবাসার পর বিয়ে, তবু বিয়ের পর ভালবাসার জোরটুকুই ভেঙে যায় কি করে?
তাও দু’জনেই বাস্তব আর চাক্ষুস প্রমাণ দেখে বুঝেছিল। একদিন এই ঘরে বসে একমনে বই পড়ছিল মধুরী, আর ওঘরে একা একা নিজের হাতে কাপড়চোপড় গুছিয়ে বাক্সে ভরছিল শতদল ৷ এক সপ্তাহের জন্য ভুবনেশ্বরে গিয়ে থাকতে হবে, প্রত্নবিভাগের একটা সার্ভে তদারকের জন্য। শতদলের রওনা হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মধুরী একবার এসে চোখের দেখা দিয়েও যেতে পারলো না। সেদিনই মনে হয়েছিল শতদলের, এই যে পৌষের প্রভাতে জানালা দিয়ে এত আলো ঘরের ভেতরে এসে লুটিয়ে পড়েছে, নিতান্ত অর্থহীন, কোন প্রয়োজন ছিল না।
পৌষের সকালবেলাটাই শুধু অন্যায় করেনি। সেই বছরেই চৈত্রের একটা রবিবারের বিকালবেলাও ভয়ানক এক বিদ্ৰুপ করে দিয়ে চলে গেল। প্রতি রবিবারের মত সাজসজ্জা করে বেড়াতে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে ছিল মাধুরী, এই ঘরে। আর পাশের ঘরে গভীর মনোযোগ দিয়ে চালুক্য স্টাইলের মন্দিরভিত্তির একটা স্কেচ আঁকছিল শতদল ৷ বেড়াতে যাবার কথা একটিবারের জন্যও তার মনে হলো না, কোন সাড়াও দিল না। জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে মাধুরীর শুধু মনে হয়েছিল, অস্তাচলের মেঘে এই ক্ষণিকের রক্তিমা নিতান্ত অর্থহীন, একটা অলক্ষুণে ইঙ্গিত, আর একটু পরেই তো অন্ধকারে সব কালো হয়ে যাবে। এই ছলনার খেলা আর না করে সূর্যটা যদি একটু তাড়াতাড়ি ডুবে যায়, তবেই ভাল।
একে একে এইরকম আরও সব লক্ষণ দেখে দুজনেই বুঝেছিল, ভালবাসা আর নেই। কিংবা, ভালবাসা ছিল না বলেই এইসব লক্ষণগুলি একে একে দেখা দিচ্ছিল। কে জানে কোনটা সত্য! হয়তো চেষ্টা করলে দু’জনেই জানতে পারতো, হয়তো জেনেছিল, হয়তো জানেনি। যাই হোক, জানা-না-জানার ব্যাপারে কেউ কাউকে দোষ দিতে পারে না। হয় দুজনেই জেনেশুনে চুপ করে ছিল, কিংবা দুজনে ইচ্ছে করেই জানতে চেষ্টা করেনি।
এ-ও হতে পারে, দুজনেই নতুন করে আর গোপন করে কোন নতুন জনের ভালবাসায় পড়েছিল। তাই মিথ্যে হয়ে গেল ঘাটশিলার পুরাতন ফাল্গুন। কিংবা সে ফাল্গুন নিজেই সৌরভহীন হয়ে গিয়েছিল, তারই বেদনা দুজনকে দুই দিকে নিয়ে চলে গেল। একজনকে একটি হেমন্তের সন্ধ্যায়, আর একজনকে একটি আষাঢ়ের পূর্ণিমায়। যা-ই হোক না কেন, দুজনের মনে সেজন্য আর কোন ক্ষোভ বা দুঃখ ছিল না। হয় দুজনেই ভুল করেছে, নয় দুজনেই ঠিক করেছে। কেউ কাউকে দোষ দিতে পারে না।
কেউ কাউকে দোষ দেয়ওনি। ঘূণা করেছিল, মার্জনা করতে পারেনি, দুজনেই দু’জনকে। কিন্তু মনে মনে। যেদিন এই মনের বিদ্রোহ মনের মধ্যে পুষে রাখা দুঃসহ হয়ে উঠলো, সেদিন সরে গেল দুজনে। কেউ কাউকে অভিযোগ আর অপবাদের আঘাত না দিয়ে ভদ্রভাবে আদালতে আবেদন করে সাত বছরের সম্পর্ক নিঃশেষে চুকিয়ে দিল।
ছাড়াছড়ি হবার পর, বছর দেড়েক যেতে-না-যেতে শতদল শুনেছিল, মাধুরী বিয়ে করেছে অনাদি রায় নামে এক এঞ্জিনিয়ারকে। মাধুরীও খবরের কাগজে পড়েছিল, অধ্যাপক শতদল দত্ত আবার বিয়ে করেছেন, নব জীবন-সঙ্গিনীর নাম সুধাকণা, কলকাতারই একটা সেলাই স্কুলের টিচার।
এই নতুন দুটি বিয়েও নিশ্চয় দেখেশুনে ভালবাসার বিয়ে। যে যাই বলুক, মাধুরী জানে অনাদি রায়কে স্বামীরূপে পেয়ে সে সুখী হয়েছে। বাইরে থেকে না জেনেশুনে যে যতই আজেবাজে মন্তব্য করুক না কেন, শতদলও জানে, সুধাকে পেয়ে সে সুখী হয়েছে।
তাই আজ রাজপুর জংশনের এই ওয়েটিংরুমে, এই শীতার্ত মাঝরাত্রির নিঃশব্দ মুহূর্তগুলির মধ্যে মাধুরী রায় আর শতদল দত্তের সম্পর্ক নিয়ে এসব প্রশ্ন আর গবেষণা নিতান্ত অবাস্তর ও নিম্প্রয়োজন। সে ইতিহাস ভালভাবেই শেষ করে দিয়ে ওরা দুজনে একেবারে ভিন্ন হয়ে গেছে, কোন সম্পর্ক নেই।
অতীতের প্রশ্ন নয়, প্রশ্নটা ছিল বর্তমানের।
এমন করে একটা অযথা সময়ে পথের প্রতীক্ষা-ঘরে সেই দুটি জীবনেরই মুখোমুখি সন্নিধ্য দেখা দেয় কেন, যারা প্রতিদিন মুখোমুখি হবার অধিকার আদালতের সাহায্যে পাঁচ বছর আগেই নিয়মবহির্ভূত করে দিয়েছে? এই আকস্মিক সাক্ষাৎ যেন একটা বিদ্রুপের ষড়যন্ত্র। যেমন অবৈধ তেমনি দুঃসহ। ঘটনাটাকে তাই যেন মন থেকে কেউ ক্ষমা করতে পারে না, অথচ আপত্তি বা প্রতিবাদ করারও কোন যুক্তি নেই। মাধুরী না হয়ে, আর শতদল না হয়ে, যদি অন্য কোন মহিলা যাত্রী ও পুরুষ যাত্রী এভাবে এই প্রতীক্ষা-গৃহে আশ্রয় নিত, এ ধরনের অস্বস্তি নিশ্চয় কারো হতো না। বরং স্বাভাবিকভাবে দু-একটা সাধারণ সৌজন্যের ভাষায় দুজনের পক্ষে আলাপ করাও সম্ভব হতো। কিন্তু মাধুরী রায় আর শতদল দত্ত, পরস্ত্রী আর পরপুরুষ, কোন সম্পর্ক নেই, তবু মনভর সঙ্কোচ আর অস্বস্তি নিয়ে ওয়েটিংরুমের নিস্তব্ধতার মধ্যে অসহায়ভাবে যেন বন্দী হয়ে বসে থাকে।
এই নীরবতার মধ্যে শতদল দত্তের ভারাক্রাস্ত মন কখন যে ডুবে গিয়েছিল, তন্দ্রার মত একটা ক্লাস্তিহরণ আরামে দুই চোখ খুঁজে গিয়েছিল, তা সে বুঝতে পারেনি। চোখ খুলে প্রথমেই বুঝতে পারে এটা ওয়েটিংরুম। একটু দূরে বেঞ্চের ওপর বসে রয়েছে মাধুরী, দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কৌতুহলহীন এবং নিম্পলক একজোড়া চোখের দৃষ্টি।
শতদল কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিল না। তার দু’চোখে একটা লুকিয়ে দেখার কৌতুহল যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু কি এমন দেখবার আছে, আর, নতুন করেই বা দেখবার কি আছে?
আছে। এমন মেঘ রঙের ক্রেপের শাড়ি তো কোন দিন পরেনি মাধুরী, এমন করে এত লঙ্কা আঁচলও মাধুরীকে কখনো লুটিয়ে দিতে দেখেনি শতদল ৷ বেড়াতে যাবার সময় মাধুরীকে অবশ্যই পরতে হতো তাঁতের শাড়ি, ঢাকাই বা অন্য কিছু চলতে গেলে যে শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে ফিসফিস করে অদ্ভুত এক শব্দের সুর শিহরিত হয়। আঁচলে অবশ্যই মাখতে হতো একফোঁট হাসুনাহানার আরক। এইভাবে সুর ও সৌরভ হয়ে শতদলের পাশে চলতে হতো মাধুরীকে, নইলে শতদলের মন ভরতো না। সেই সুর আর সৌরভের কোন অবশেষ আজ আর নেই। মাধুরী বসে আছে এক নতুন শিল্পীর রুচি দিয়ে গড়া মূর্তির মত, নতুন রঙে আর সাজে। এমন করে সস্তপণে অনধিকারীর অবৈধ লোভ নিয়ে এবং লুকিয়ে লুকিয়ে কোন দিন মাধুরীকে দেখেনি শতদল। আজ দেখতে পায় আর বুঝতে পারে, এ মূর্তি সে মূর্তি নয়। একেবারে নতুন, আর বেশ একটু কঠিন, এঞ্জিনিয়ার অনাদি রায়ের স্ত্রী মাধুরী রায়।
অবাস্তর চিস্তা আর অস্বস্তি থেকে মুক্তি পায় শতদল। বেশ স্বচ্ছন্দভাবে এবার নিজের প্রয়োজনের দিকে মন দেয়। ছোট একটা চামড়ার বাক্স খুলে তোয়ালে আর সাবান বের করে। হোল্ড-অল খুলে তার ভেতর থেকে একটা বালিশ আর চাদর বের করে অর্ধশয়ান লম্বা চেয়ারটার ওপর রাখে।
শতদলের দিকে তাকিয়ে দেখার কোন প্রয়োজন ছিল না মধুরীর, সে তাকিয়ে ছিল আয়নায় প্রতিবিম্বিত শতদলের দিকে। ইচ্ছে করে নয়, আয়নাতে শতদলকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল, তাই। এবং ইচ্ছে না থাকলেও লুকিয়ে দেখার এই লোভস্টুকু সামলাতে পারেনি মাধুরী।
আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় মাধুরী, বেশ স্বচ্ছন্দভাবে কাজ করছে শতদল ৷ হাতঘড়িটাকে খুলে নিয়ে একবার দম দিয়ে টেবিলের ওপর রাখে শতদল ৷ মাধুরী বুঝতে পারে, এ ঘড়িটা সেই ঘড়ি নয়। ঘড়ির ব্যান্ডটাও কালো চামড়ার, যে কালো রং কোনদিন পছন্দ করতো না মাধুরী। এবং মাধুরীর রুচির সম্মান রেখে শতদলও কোনদিন কালো ব্যান্ড পরতো না। আরও চোখে পড়ে, আংটিটাও নতুন। বালিশের ঢাকাটার মধ্যেও বৈশিষ্ট্য আছে, রঙিন আর ফুল তোলা। মাধুরীই তো জানে, সাদা প্লেন আর মোলায়েম কাপড়ের ঢাকা ছাড়া এসব রং-চং আর কাজ-করা জিনিস কোনদিন পছন্দ করতো না শতদল ৷ বুঝতে পারে মাধুরী, সেলাই স্কুলের টিচার সুধা ভাল করেই সব বদলে দিয়েছে।
সাবান আর তোয়ালে নিয়ে স্নানের ঘরে চলে গেল শতদল ৷ আয়নার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এবার টেবিলের ওপরে শতদলের যত সংসারসামগ্রীর দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে মাধুরী। এতক্ষণে যেন প্রত্যক্ষভাবে তদন্ত করার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে।
কিন্তু কি এমন বহুমূল্য নিদর্শন দেখার জন্য মাধুরীর দৃষ্টি টেবিলের ওপর স্তুপীকৃত জিনিসপত্রের মধ্যে তল্লাশি করে ফিরছে, তা বোধহয় নিজেই জানে না। অনেকক্ষণ ধরে, দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব কিছুই দেখলো মাধুরী। সবই নতুন, পাঁচ বছর আগের কোন স্মৃতির চিহ্ন নেই। এমন কৌতুহল না হওয়াই উচিত ছিল।
এখন একবার আয়নার দিকে তাকালে দেখতে পেত মাধুরী, তুলির টানের মত অাঁকা তার ভুরুদুটি যেন একটা ঈষার স্পর্শে শিউরে সর্পিল হয়ে উঠেছে। কিন্তু আয়নার দিকে নয়, দৃষ্টি ছিল সোজাসুজি শতদলের জিনিসপত্রগুলির দিকে। তিন-তিনটে বাক্স খোলা পড়ে রয়েছে, ঘড়ি মনিবাগ ও চশমাটা টেবিলের ওপরেই, ছাই রঙের ফ্ল্যানেলের জামাটা ব্রাকেটে ঝুলছে, সোনার বোতামগুলো আলোয় চিকচিক করছে। নিঃসম্পর্কিত এক মহিলার সম্মুখে সব ফেলে রেখে চলে গেছে ভদ্রলোক। চুরি হয়ে যেতে পারে, সে ভয় নেই। ভদ্রলোকের এই বিশ্বাসটা যেমন অস্বাভাবিক তেমনি অস্বাভাবিক মাধুরীর আচরণ। এত সতর্ক-দৃষ্টি দিয়ে শতদলের জিনিসপত্র পাহারা দিতে তো কেউ তাকে বলেনি।
শতদল আবার ঘরে ঢুকতেই মাধুরী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
হোক না দর্পণের প্রতিচ্ছায়া, একটু স্পষ্ট করেই এবার দেখতে পায় মাধুরী, শতদল আগের চেয়ে অনেক রোগ হয়ে গেছে। সেলাই স্কুলের মাস্টারনীর এদিকে বিশেষ কিছু যত্ন নেই বলে মনে হয়। হোক না পাঁচ বছরের অদেখা, আজও দেখে বুঝতে পারে মাধুরী, খুব ক্ষিদে না পেলে শতদলের মুখটা ঠিক এরকম শুকনো দেখাতো না।
মাধুরীর অনুমান মিথ্যে নয়। শতদল একটা টিফিন কেরিয়ার খুলে খাবারের বাটিগুলি বের করে টেবিলের ওপর রাখে। খেতে বসে। হাত তুলতে গিয়েই কি ভেবে হাত নামিয়ে নেয়। ঘরের কোণে রাখা জলের কুঁজোটার দিকে একটা গেলাস হতে নিয়ে এগিয়ে যায়।
দৃশ্যটা মাধুরীর চোখে আঘাতের মত বেজে উঠবে, কল্পনা করতে পারেনি মাধুরী এবং তার জন্য প্রস্তুতও ছিল না। হঠাৎ হয়ে গেল। আয়নার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সোজা শতদলের দিকে হঠাৎ ক্ষুব্ধভাবে তাকায় মাধুরী। মাধুরীর এই চকিত খ্ৰীবাভঙ্গি, মৃদু হুকুটি আর চোখের কুপিত দৃষ্টি কিন্তু এতক্ষণের গম্ভীরতার চেয়ে অনেক বেশি স্বাভাবিক দেখায়।
মাধুরী বলে—ওকি হচ্ছে?
আকস্মিক প্রশ্নে শতদল একটু চমকে উঠেই মাধুরীর দিকে তাকায়।
মাধুরী আবার বলে—একটা মুখের কথা বললে এমন ভয়ানক দোষের কিছু হত না!
শতদলের গম্ভীর মুখ হঠাৎ সুস্মিত হয়ে ওঠে। হেসে হেসে বলে—না, দোষ আর কি?
মাধুরী উঠে দাঁড়ায় এবং এগিয়ে আসে। নিস্তব্ধ ওয়েটিংংরুমের দুঃসহ মুহূর্তগুলির পেষণ থেকে যেন তার আত্মা এতক্ষণে মুক্তি পেয়েছে। শতদলের স্বচ্ছন্দ হাসির শব্দে মাধুরীর ক্লিষ্ট মনের গাম্ভীর্যও ভেঙে গেছে। শতদলের হ৩ থেকে গেলাসটা নিয়ে হাসিমুখে বলে, তুমি বসো।
এটা ওয়েটিংরুম। কর্নওয়ালিশ স্ত্রীটের বাড়ি নয়, আর মাধুরীর জন্মদিনের উৎসবও আজ নয়, যেদিন উৎসবের সোরগোল থেকে শতদলকে এমনই একটি ঘরের নিভৃতে নিয়ে গিয়ে সেই যে জীবনে-প্রথম নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করে খাইয়েছিল মাধুরী।
কুঁজো থেকে জল ঢেলে নিয়ে গেলাসটা টেবিলের ওপর রেখে খাবারগুলো একটা ডিসের মধ্যে সাজিয়ে দিতে থাকে মাধুরী। কাচের গেলাসে আর মাধুরীর হাতের চুড়িতে অসাবধানে সংঘাত লাগে, শব্দ হয়, পাঁচ বছর আগের নিস্তব্ধ অতীত সে নিকণে যেন চমকে জেগে ওঠে। দুই ট্রেনযাত্রী নয়, দেখে মনে হবে, ওরা এই সংসারের দুটি সহজীবনযাত্রী ; আর, সে জীবনযাত্রায় কোন খুঁত আছে বলে মনে হয় না। মাধুরীর হাতের আঙুলগুলি যদিও একটু রোগা হয়ে গেছে, কিন্তু খাবারগুলোকে সেই রকমই আলগোছে যেন চিমটে দিয়ে তোলে, সেই পুরনো অভ্যাস। শতদলের পাশে প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, নিস্তব্ধ ঘরে মাধুরীর ছোট নিঃশ্বাসের শব্দ মাঝে মাঝে বেশ স্পষ্ট করে শোনা যায়। অাঁচলটা কাঁধ থেকে খসে গিয়ে শতদলের একটা হাতের ওপর লুটিয়ে পড়েছে। লক্ষ করে না মাধুরী। এমন বিসদৃশ বা অপার্থিব কিছু নয় যে লক্ষ করতেই হবে।
—সবই দেখছি বাজারের তৈরি খাবার।
মাধুরীর কথার মধ্যে একটা আপত্তির আভাস ছিল, যার অর্থ বুঝতে দেরি হয় না শতদলের। বাজারের তৈরি খাবারের বিরুদ্ধে মাধুরীর মনে যে চিরন্তন বিদ্রোহ আছে, তা শতদলের অজানা নয়। তাই যেন দোষ স্থালনের মত সুরে সঙ্কুচিতভাবে বলে—হাঁ, কাটিহার বাজারে ওগুলি কিনেছিলাম।
মাধুরী—যাচ্ছ কোথায়?
শতদল—কলকাতায়।
মাধুরী—তুমি এখন কলকাতাতেই…।
শতদল—হাঁ। ..তুমি?
এ কথাগুলি না উঠলেই বোধহয় ভাল ছিল। হাত কাঁপে, কাজের স্বাচ্ছদ্য হারায় মাধুরী। শতদলের প্রশ্নে যেন নিজের পরিচয়টা হঠাৎ মনে পড়ে গেছে মাধুরীর। কুষ্ঠিতভাবে একটু তফাতে সরে গিয়ে মৃদু স্বরে মাধবী উত্তর দেয়—রাজগীর। এই পর্যন্ত এসেই প্রসঙ্গ ফুরিয়ে যায়। আর প্রশ্ন করে জানবার মত কিছু নেই। একজন কলকাতা, আর একজন রাজগীর।
দুজন দুই ট্রেনযাত্রী মাত্ৰ! এক ট্রেন নয়, এক লাইনের ট্রেনও নয়। তবু মনের ভুলে দুজনে যেন বড় কাছাকাছি হয়ে গিয়েছিল। যা নিতান্ত অশোভন ও অসঙ্গত, তাই দিয়ে দুজনে যেন কিছুক্ষণের মত শোভন ও সঙ্গত হয়ে উঠেছিল।
হয়তো কোন প্রসঙ্গ পায় না বলেই শতদল বলে—তোমাকে তাহলে বোধহয় পাটনার ট্রেন ধরতে হবে?
–হাঁ। তুমি খেয়ে নাও।
এক নিঃশ্বাসে যেন জোর করে কোনমতে কথাগুলি উচ্চারণ করেই মাধুরী সরে যায়। সত্যিই তো, পাটনার ট্রেনেই তাকে চলে যেতে হবে, চিরকালের মত। এখানে বসে থাকবার জন্য সে আসেনি। নিজের হাতঘড়িটার দিকে সন্ত্রস্তভাবে তাকায় মাধুরী ; তারপর আবার আগের মতই বেঞ্চটার ওপর গিয়ে বসে থাকে।
খাবারগুলো শতদলের সম্মুখে সাজানো। কাচের গেলাসের গায়ে বিদ্যুতের বাতিটার আলো ঝলকায়, জলটাকে তরল আগুনের মত মনে হয়। আবার বোধহয় অপ্রস্তুত ও লজ্জিত হয়েছে শতদল ৷ কিন্তু বড় শ্লেষ, বড় জ্বালা আছে এ লজ্জায়। সব জেনেশুনেও হঠাৎ লোভের ভুলে এক প্রহেলিকার মায়াকে কেন সত্য বলে বিশ্বাস করেছিল শতদল?
ছটফট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় শতদল, চাদরটা গায়ে জড়িয়ে লম্বা চেয়ারের ওপর শুয়ে পড়ে, সিগারেট ধরায়।
খাবার খেতে পারল না শতদল ৷ কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আজ নিজের মনের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার জন্য কোন চেষ্টা করে না শতদল ৷
ওয়েটিংরুম আবার ওয়েটিংরুম হয়ে ওঠে। দুই সম্পর্কহীন অনায়ীয়, ভিন্ন ভিন্ন ট্রেনের দুই যাত্রী প্রতীক্ষার মুহূর্ত গুনছে। কিন্তু ট্রেনও আসে না, তৃতীয় কোন যাত্রীও এ ঘরে প্রবেশ করে না। আসে বয়, হাতে একটি ট্রে, তার ওপর চায়ের সরঞ্জাম সাজানো। একটি টি-পট, একটি দুধের জার, একটি চিনির পাত্র, কিন্তু পেয়ালা দুটি।
টেবিলের ওপর ট্রে-সমেত চায়ের সরঞ্জাম রেখে বয় চলে যায়। তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি তুলে চায়ের পাত্রের দিকে একবার তাকায় শতদল, কিন্তু পরমুহূর্তে যেন একটা বাধা পেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
ট্রের ওপর দুটি চায়ের পেয়ালা। কি ভয়ানক বিৰূপ। কোন বুদ্ধিতে বয়টা দুটি চায়ের পেয়ালা দিয়ে গেল কে জানে? সেরকম কোন নির্দেশ তো বয়কে দেয়নি শতদল ৷
চা খাওয়াও আর সম্ভব হলো না।
সোজাসুজি তাকিয়ে না দেখুক, মাধুরী যেন মনের চোখ দিয়ে স্পষ্ট করেই দেখতে পাচ্ছে, খাবার স্পর্শ করছে না শতদল, চা-ও বোধহয় খাবে না। বয়টা এক নম্বরের মুর্খ, চা-টা যদি ঢেলে দিয়ে যেত, তবে ভদ্রলোক বোধহয় এরকম কুষ্ঠিত হয়ে বসে থাকতেন না। কিন্তু এত কুষ্ঠাই বা কেন? এ তো আর মধুপুর নয়, সেজমামার বাসাও নয়, আর সেই বড়দিনের ছুটির দিনটাও নয়।
বড়দিনের ছুটিতে মধুপুরে সেজমামার ওখানে বেড়াতে গিয়েছিল শতদল আর মাধুরী। প্রথম দিনেই দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল, অনেকটা এইরকমই নিঃশব্দ প্রতিবাদের মত। চা না খেয়ে সারা সকালটা বাগানের একটা ঝাউয়ের নিচে চেয়ার টেনে বসে রইল শতদল। প্রতিবাদের কারণ, বাড়িতে এত লোক থাকতে আর সবার উপরে মাধুরী থাকতেও শতদলকে চা দিয়ে গেল বাড়ির চাকর। রহস্যটা যখন ধরা পড়লো, বাড়িসুদ্ধ লোক তখন লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি বকুনি খেল মাধুরী। মামীমা বকলেন, সেজমামা বকলেন, এমনকি স্বল্পভাষী বড়দাও বললেন—যখন জানিস যে, তুই নিজের হাতে চা না এনে দিলে শতদল অসন্তুষ্ট হয়, তখন…। কিন্তু এটা ওয়েটিংরুম, সেজমামার বাসা নয়। অভিমানী স্বামীর মত এমন মুখ ঘুরিয়ে এভাবে পড়ে থাকা আজ আর শতদলকে একটুও মানায় না।
কিন্তু কি আশ্চর্য, এই বিসদৃশ অভিমানের আবেদন ওয়েটিংরুমের অন্তর যেন স্পর্শ করেছে। রঙ্গমঞ্চের একটি নাটকাঙ্কের দৃশ্যের মত কৃত্রিম হয়েও ঘটনাটা সত্যি সত্যি মান-অভিমানের দাবি নিয়ে যেন প্রাণময় হয়ে ওঠে। মধুরীকে এখানে ধমক দিয়ে কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেবার কেউ নেই, তবু নিজের মনের গভীরে কান পেতে শুনতে পায়, কেউ যেন তাকে কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
—খাবার খাচ্ছ না কেন?
বড় কোমল ও মৃদু অনুনয়ের সুর ছিল মধুরীর কথায়।
শতদল শান্তভাবে উত্তর দেয়—না, এত রাত্রে এসব আর খাব না।
—তবে শুধু চা খাও।
–হাঁ, চা অবশ্য খেতে পারি। ..তুমি খাবে না?
মাধুরীর মুখে হাসির ছায়া পড়ে। —আমার কি চা খাবার কথা ছিল?
শতদল লজ্জিতভাবে হাসে—তা অবশ্য ছিল না। কিন্তু বয়টা যখন ভুল করে দুটাে পেয়ালা দিয়েই গেছে, তখন…।
—তখন এক পেয়ালা চা আমার খাওয়াই উচিত, এই তো?
মাধুরীর কথার মধ্যে কোন সঙ্কোচ বা জড়তা ছিল না। হেসে হেসে কথাগুলি বলতে পারে মাধুরী।
শতদল বলে—আমি তো তাই মনে করি। বয়টার আর কি দোষ বলো?
মাধুরী—না, বয়কে আর দোষ দিয়ে লাভ কি?
দুজনেই ক্ষণিকের মত গম্ভীর হয়। সত্যিই তো বয়কে দোষ দিয়ে লাভ নেই। মাধুরীর কথাগুলির মধ্যে কেমন একটা আক্ষেপের সুর যেন মিশে আছে। বোধহয় বলতে চায় মাধুরী, বয়টার দোষ হবে কেন, দোষ অদৃষ্টের, নইলে আজ পাঁচ বছর পরে এমন একটা বিশ্রী রাত্রিতে একটা ওয়েটিংরুমের চক্রান্তে পড়ে কেন এভাবে অপ্রস্তুত হতে হবে?
হয় আর চুপ করে বসে থাকার শক্তি ছিল না, নয় ইচ্ছে করে এই ওয়েটিংরুমের চক্রান্তে আত্মসমর্পণ করতে চায় মাধুরী ৷ উঠে দাঁড়ায়, টেবিলের কাছে এগিয়ে আসে, চা তৈরি করে। সেই হাতে, সেই নিপুণতা দিয়ে, স্বচ্ছন্দে ও সাগ্রহে।
শতদলও ওঠে, একটা চেয়ার তুলে নিয়ে এসে টেবিলের কাছে নিজের চেয়ারের পাশে রাখে। মাধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে—বসো।
মাধুরী আপত্তি করে না। আপত্তি করার মত জেদগুলিকে আর মনের মধ্যে খুঁজে পায় না। রাজপুর জংশনের ওয়েটিংরুম দুই অনাস্ত্রীয় নরনারীর মনের ভুলে ধীরে ধীরে দম্পতির নিভৃত নীড়ের মত আবেগময় হয়ে উঠেছে, বুঝতে পারলেও কেউ আর ঘটনাটাকে বাধা দিতে চায় না। শতদলের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে মাধুরী।
চায়ে চুমুক দিয়ে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে শতদল। শুধু চায়ের আস্বাদ পেয়ে নিশ্চয় নয়, চায়ের সঙ্গে মাধুরীর হাতের স্পর্শমিশেছে, তৃষ্ণা মিটে যাবারই কথা।
শতদল হাসিমুখে বলে—তোমার গম্ভীর ভাব দেখে সত্যিই এতক্ষণ বড় অস্বস্তি হচ্ছিল।
মাধুরীও হাসে–তোমার তো অস্বস্তি হচ্ছিল, কিন্তু আমার যা হচ্ছিল তা আমি জানি।
শতদল—ভয় করছিল বুঝি?
মাধুরী মাথা হেট করে—হাঁ।
শতদল—ছি, ভয় করবার কি আছে?
হাসতে হাসতে আলাপটা শুরু হয়েও শেষ দিকে কথাগুলি কেমন একটা করুণতার ভারে বিনমিত হয়ে যায়। মাধুরীর কথাগুলি বেদনাময় স্বীকৃতির মত, শতদলের কথায় আশ্বাসের নিবিড়তা। সে অতীত অতীত হয়েই গেছে, আজ আর ভয় করবার কি আছে?
মানুষ মরে যাবার পর যেমন তার কথা মমতা দিয়ে বিচার করা সহজ হয়ে ওঠে, আর ভুলগুলি ভুলে গিয়ে গুণগুলিকে বড় করে ভাবতে ইচ্ছে করে, শতদল আর মাধুরী বোধহয় তেমনি করেই আজ তাদের মৃত অতীতকে মমতা দিয়ে বিচার করতে পারছে। অতীতের সেই ভয়, ঘৃণা ও সংশয়ের ইতিহাস যেন নিজেরই জ্বালায় ভস্ম হয়ে সংসারের বাতাসে হারিয়ে গেছে। আজ শুধু মনে হয়, সেই অতীত যেন সাত বছরের একটি রাত্রির আকাশ, তার মধ্যে ফুটে উঠেছিল ছোট বড় কত তারা, কত মধুর ও স্নিগ্ধ তার আভা। সে আকাশ একেবারে হারিয়ে গেছে, ভাবতে কষ্ট হয়, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না, ফিরে পেতে ইচ্ছা করে বৈকি!
শতদলের মুখের দিকে তাকিয়ে মাধুরী বলে,তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছ।
শতদল—নিজে কি হয়েছ?
চায়ের পেয়ালাটা হাতে ধরে রেখেছিল মাধুরী। সেই দিকে তাকিয়ে শতদল অনুযোগের সুরে বলে—আঙুলগুলোর এ দশা হয়েছে কেন?
মাধুরী—কি হয়েছে?
শতদল—কি বিশ্রী রকমের সরু সরু হয়ে গেছে।
মাধুরী লজ্জিতভাবে হাসে, আঁচলের আড়ালে হাতটা লুকিয়ে ফেলতে চায়। কিন্তু শতদল যেন একটু দুঃসহ লোভের ভুলে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে মাধুরীর হাতটা টেনে নিয়ে দুহাত দিয়ে চেপে ধরে। মাধুরী আপত্তি করে না।
এ বড় অদ্ভুত ৷ সাত বছরের যে জীবন-কুঞ্জ একেবারে বাতিল হয়ে গেছে, আজ এতদিন পরে দেখা যায়, বাতিল হয়ে গেছে তার কাঁটাগুলি, বাতিল হয়নি তার ছায়া।
একটা অজানা সত্য যেন আজ হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলেছে শতদল, মাধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে—তোমার মুখটি কিন্তু সেই রকমই আছে মাধুরী, একটুও বদলায়নি।
বদলে গেছে সব, শুধু সেই মুখটি বদলায়নি। বাতিল হয়ে গেছে সব, শুধু সেই ভালবাসার মুখটি বাতিল হয়ে যায়নি। এও কি সস্তব? হয় চোখের ছলনা, নয় কল্পনার বিভ্রম।
সব ছলনা ও বিভ্রমকে মিথ্যে করে দিয়ে মাধুরীর সারা মুখে নিবিড় এক লজ্জার ছায়া রক্তাভ হয়ে ওঠে। প্রথম ভালবাসার সম্ভাষণে চঞ্চলিতচিত অনুঢ়া মেয়ের মুখের মত নয়, বাসরকক্ষে প্রথম পরিচিত ব্ৰীড়ানতা বধুর মুখের মত নয়, দীর্ঘ আদর্শনের পর স্বামীর সম্মুখে সমাদরধন্য নারীর মুখের মতই!
প্রণয়কুঞ্জ নয়, বাসরকক্ষ নয়, দম্পতির গৃহনিভৃত নয়, রাজপুর জংশনের ওয়েটিংরুম। তবু শতদল আর মাধুরী, দুই ট্রেনযাত্রী বসে থাকে পাশাপাশি, যেন এইভাবে তারা চিরকালের সংসারে সহযাত্রী হয়ে আছে, কোনদিন বিচ্ছিন্ন হয়নি।
চা খাওয়া শেষ হয়। মাধুরী জিজ্ঞাসা করে—কাকাবাবু এখন কোথায় আছেন?
শতদল—তিনি দেরাদুনে বাড়ি করেছেন, এখন সেখানেই আছেন।
মাধুরী—পুটি?
শতদল—পুটির বিয়ে হয়ে গেছে, সেই রমেশের সঙ্গে। দিল্লির সেক্রেটারিয়েটে ভালই একটা চাকরি পেয়েছে রমেশ।
মাধুরীর হাতটা বড় শক্ত করে ধরেছিল শতদল ৷ যেন পাঁচ বছর অতীতের এক পলাতক মায়াকে অনেক সন্ধানের পর এতদিনে কাছে পেয়েছে। দুহাত দিয়ে ধরে রেখেছে তার এক হাত, যেন আবার হারিয়ে না যায়।
—তুমি বিশ্বাস কর মাধুরী?
—কি?
—তোমাকে আমি ভুলিনি, ভুলতে পারা যায় না।
—বিশ্বাস না করার কি আছে, চোখেই দেখতে পাচ্ছি।
–কিন্তু তুমি?
—কি?
—তুমি ভুলতে পেরেছ আমাকে?
দুচোখ বন্ধ করে মাধুরী, যেন চারদিকের বাস্তব সংসারের লোকচক্ষুগুলিকে অন্ধ করে দিয়ে উত্তর দেবার জন্য প্রস্তুত হয়। মাথাটা শতদলের বুকের কাছে একটু ঝুঁকে পড়ে, দুচোখের কোণে ছোট ছোট মুক্তা-কণিকার মত দুটি সজলতার বিন্দু জেগে ওঠে।
দুহাতে জড়িয়ে মাধুরীর মাথাটা বুকের উপর টেনে নেয় শতদল—বলতেই হবে মাধুরী, আমি না শুনে ছাড়বো না।
হঠাৎ ছটফট করে ওঠে মাধুরী, যেন মাধুরীকে একটা আগুনের জ্বালা হঠাৎ দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে। শতদলের হাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। বাইরে শীতার্ত রাত্রির স্তব্ধতা চমকে দিয়ে প্রবল শব্দে লোহার ঘণ্টা বাজছিল ঝনঝন করে। ঘরের ভেতর আয়নাটাও কাঁপছিল। যেন দুটি জীবনের এই দুঃসাহসের ব্যভিচার সইতে না পেরে ওয়েটিংরুমটাই আর্তনাদ করে উঠেছে। ধুলিয়ান আপ প্যাসেঞ্জার এসে পড়েছে, ছুটোছুটির সাড়া পড়ে গেছে প্লাটফর্মের ওপর।
–এই ট্রেনেই তো ওর আসবার কথা!
উদভ্রান্তের মত কথাগুলি বলতে বলতে দরজার দিকে ছুটে যায় মাধুরী।
তৃতীয় যাত্রী এসে ওয়েটিংরুমে প্রবেশ করে। মাধুরীকে দেখতে পেয়েই তার সারা মুখ আনন্দে দীপ্ত হয়ে ওঠে, যেন এই অমাবৃত রাত্রির পথে এতক্ষণ পরে পান্থশালার আলোক দেখতে পেয়েছে মাধুরী রায়ের স্বামী অনাদি রায়।
মাধুরীর মুখও পুলকিত হয়ে উঠেছে দেখা যায়, কিন্তু তখনো যেন একটু বিষন্নতর স্পর্শ লেগে ছিল, ক্লান্ত প্রদীপের আলোকে যেমন একটু ধোঁয়ার ভাব থাকে।
অনাদি রায় কিন্তু তাতেই বিচলিত হয়ে ওঠেন। মাধুরীর কাছে এগিয়ে এসে ব্যস্তভাবে প্রশ্ন করেন—শরীরটরীর ভাল বোধ করছে তো?
—হাঁ, ভালই আছি।
—অনেকক্ষণ ধরে একা একা বসে থাকতে হয়েছে, না?
—হাঁ।
—কি করবো বলো? ট্রেনগুলো যে রকম বেটাইমে চলছে, নইলে দুঘন্টা আগেই পৌঁছে যেতাম।
অনাদি রায় উৎসাহের সঙ্গে একটা বেডিং খুলতে আরম্ভ করেন। মাধুরী আপত্তি করে—থাক, ওসব খোলামেলা করে লাভ নেই।
—তুমি একটু শুয়ে নাও মাধুরী, রেস্ট পেলে শরীর ভাল বোধ করবে।
—থাক, আর কতক্ষণই বা।
অনাদি রায় কিন্তু নিরুৎসাহিত হলেন না। বাক্স খুলে একটা মিজাপুরী আলোয়ান বের করলেন। দুভাঁজ করে নিজের হাতেই আলোয়ানটা মাধুরীর গায়ে পরিপাটি করে জড়িয়ে দিলেন।
এতক্ষণ চেয়ারের ওপর স্থির হয়ে বসে দেখছিল শতদল। একটা প্রহসনের দৃশ্য, নির্মম ও অশোভন। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকা আর সম্ভব হলো না। একবার ব্যস্ত হয়ে উঠে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে। ফিরে এসে জিনিসপত্রগুলি একবার অকারণ টানাটানি করে। যেন একটা শাস্তির কারাগারে বন্দী হয়ে শতদলের অন্তরাত্মা ছটফট করছে। যেন একটু সুস্থির হবার মত ঠাঁই, অথবা পালিয়ে যাবার পথ খুঁজছে শতদল ৷
দৃশ্যটা সত্যি সহ্য হল না। মিজাপুরী আলোয়ান যেন মাধুরীর পথশ্ৰমক্লান্ত আত্মাকে শত অনুরাগে জড়িয়ে ধরে রয়েছে। অনাদি রায় নামে এই সজ্জন, কী গরবে গরীয়ান হয়ে বসে আছেন হাসিমুখে। আর ঐ মাধুরী, যেন পৌরাণিক কিংবদন্তীর এক নারী, স্বয়ংবরার অভিনয় মাত্র করে, কিন্তু বরমাল্য দান করে তারই গলায়, যে তাকে লুঠ করে রথে তুলে নিয়ে চলে যেতে পারে। এক ভগ্নবাহু প্রতিদ্বন্দ্বীর মত সকল পরাভবের দীনতা নিয়ে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে শতদল। সহ্য করতে কষ্ট হয়।
চলে গেলেই তো হয়, কেন বসে বসে এত জ্বালা সহ্য করে শতদল?
যেতে পারে না একটি লোভের জন্য। মাধুরীর কাছ থেকে সেই প্রশ্নের উত্তরটা শুনে যাবার লোভ। মাধুরী তাকে ভুলতে পারেনি, মাত্র এইটুকু সত্য মাধুরীর মুখ থেকে শুনে যেতে পারলেই জয়ীর আনন্দ নিয়ে চলে যেতে পারবে শতদল ৷
কিন্তু ইহজীবনে এই উত্তর শুনে যাবার কোন সুযোগ আর হবে কি?
অনাদি রায় ঘড়ি দেখলেন, বোধহয় ট্রেনের টাইম হয়ে এসেছে। মাধুরী তার আলস্টার জড়ালো গায়ে। কুলিও পৌঁছে গেল, পাটনার ট্রেন আসছে।
স্বামীর পাশে দাঁড়িয়েছিল মাধুরী। কুলিরা চটপট জিনিসপত্রগুলি মাথায় চাপিয়ে দাঁড়ালো। রাজপুর জংশনের ওয়েটিংরুমকে শূন্য করে দিয়ে ওরা এখনই চলে যাবে। শতদলের মনে হয়, মাধুরী যেন যাবার আগে এক জতুগৃহের গায়ে আগুনের জ্বালা লাগিয়ে দিয়ে সরে পড়ছে।
সাত বছরের আকাশ কি নিতান্ত মিথ্যা? তাকে কি ভুলতে পারা যায়? ছিন্ন করে দিলেই কি ভিন্ন করা যায়? এ প্রশ্নের উত্তর আর দিয়ে যাবে না মাধুরী, উত্তর দেবার আর কোন সুযোগও নেই।
কোন দিকে না তাকিয়ে শুধু স্বামীর সঙ্গে হাসতে হাসতে এই ঘরের দুয়ার পর হয়ে চলে গেলেই ভাল ছিল, কিন্তু ঠিক সেভাবে চলে যেতে পারলো না মাধুরী। কুলিরা চলে গেল, অনাদি রায় এগিয়ে গেলেন, কিন্তু দরজার কাছ পর্যন্ত এসে মধুরী যেন চরম অন্তধনের আগে এই জতুগৃহের জন্যই একটা অলীক মমতার টানে একবার থমকে দাঁড়ায়। মুখ ফিরিয়ে শতদলের দিকে তাকায়। হাসিমুখে বিদায় চায়—যাই।
শতদল হাসতে চেষ্টা করেও হাসতে পারে না। অনেকগুলি অভিমান আর দাবি একসঙ্গে এলোমেলোভাবে তার কথায় ফুটে উঠতে চাইছে। কিন্তু এত কথা বলার সময় আর কই? শুধু সেই একটি প্রশ্নের উত্তর শুনে চরম জানা জেনে নিতে চায় শতদল ৷
—যাচ্ছ, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর তো দিয়ে গেলে না মাধুরী?
হাসি মুছে যায়, মাধুরী বিস্মিতভাবে তাকিয়ে প্রশ্ন করে—কিসের প্রশ্ন?
শতদল বলে—সত্যি ভুলে গেছ?
উত্তর দেয় না মাধুরী। ভুলেই গেছে বোধহয়। সাত বছরের ইতিহাস ভুলতে পারেনি যে মাধুরী, সাত মিনিট আগের কথা সে কি ভুলে গেল? এরই মধ্যে বিশ্বসংসারের নিয়মগুলি কি এমনই উল্টে গেল যে, সব ভুলে যেতে হবে। বুঝতে পারে না শতদল ৷
মাধুরী বলে—যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
শতদলের সব কৌতুহলের লোভ যেন একটা রূঢ় আঘাতে ভেঙে যায়। এতক্ষণে মনে পড়ে, মাধুরীর যে একটি পরম গন্তব্য আছে, আর দেরি করতে পারে না। সাত বছর দেরি করিয়ে দিয়েছে শতদল, এখন আর এক মুহূর্তও মাধুরীকে দেরি করিয়ে দেবার কোন অধিকার নেই।
শতদল বিমৰ্ষভাবে বলে—বুঝেছি, তুমি উত্তর দেবে না।
মাধুরী শান্তভাবে বলে—উত্তর দেওয়া উচিত নয়।
শতদল—কেন?
মাধুরী—বড় অন্যায় প্রশ্ন।
—বুঝেছি! ছটফট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় শতদল। তার অন্তরাত্মা যেন কিসের মোহে অবুঝ হয়ে আছে, যার জন্যে বার বার শুধু বুঝতে হচ্ছে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শতদল এক নিঃশ্বাসে এবং একটু রূঢ়ভাবে বলে—যাও, কিন্তু এরকম একটা তামাসা করে যাবার কোন দরকার ছিল না।
বড় তিক্ত শতদলের কথাগুলি। মুহূর্তের মধ্যে মাধুরীর মুখটাও কঠিন হয়ে ওঠে, ভ্রু কুঞ্চিত হয়। চুপ করে কি যেন ভেবে নেয়। কিন্তু পরমুহূর্তে আগের মতই আবার হাস্যময় হয়ে ওঠে। বোধহয় সেই অলীক মমতার টানে এই জতুগৃহকে যাবার আগে জ্বলিয়ে দিয়ে নয়, একটু বুঝিয়ে দিয়ে আর হাসিয়ে দিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয় মাধুরী।
হাতঘড়ির দিকে একবার চকিতে তাকিয়ে নিয়ে মাধুরী বলে—একবার সুধাকে নিয়ে রাজগীরে বেড়াতে এস।
শতদল অপ্রস্তুতভাবে তাকায়—তারপর?
—তারপর তোমরা দুজনে যেদিন বিদায় নেবে, আমি এসে ট্রেনে তুলে দিয়ে যাব।
—কেন?
—আমাকে একটা তামাসা দেখাবার সুযোগ তোমরাও পাবে, এইমাত্র।
—তাতে তোমার লাভ? মাধুরী হেসে ফেলে—লাভ কিছু নয়, তোমার মতই হয়তো এই রকম মিছিমিছি রাগ করে কতগুলি বাজে কথা বলবো।
মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত, নিম্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে শতদল, তারপরেই বলে ওঠে—বুঝলাম।
কথাটা বেশ জোরে উচ্চারণ করে, এবং সঙ্গে সঙ্গে হেসেও ফেলে শতদল ৷ বাজে কথার অভিমান আর দাবীগুলি যেন নিজের স্বরূপ চিনতে পেরে অট্টহাস্য করে উঠেছে। এতক্ষণে সত্যিই বুঝতে পেরেছে শতদল ৷
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখতে থাকে এবং দরজার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারে শতদল, মাধুরী চলে গেল।
জতুগৃহে আর আগুনের স্ফুলিঙ্গ লাগলো না, লাগলো উচ্চহাসির প্রতিধ্বনি। রাজপুর জংশনের যেন সুপ্তি ভেঙে গেল। আর একটি আগন্তুক ট্রেনের সঙ্কেতধ্বনিও বাজে। কলকাতার ট্রেনও এসে পড়েছে। এদিকের প্লাটফর্মে নয়, উল্টো দিকে। কুলির মাথায় জিনিসপত্র চাপিয়ে শতদল দত্তও ব্যস্তভাবে চলে যায়।
দুদিকের ট্রেন দুদিকে চলে যাবে। রাজপুর জংশনের শেষ রাত্রি ক্ষণিক কলরবের পর নীরব হয়ে যাবে। এরই মধ্যে এক প্রতীক্ষাগৃহের নিভৃতে দুই ট্রেনযাত্রীর সম্পর্কের ইতিহাস নিয়ে কি যে পরীক্ষা হয়ে গেল, তার সাক্ষ্য আর কিছু থাকবে না।
কিন্তু এখনও আছে, যদিও দেখে কিছু বোঝা যায় না।
ওয়েটিংরুমের টেবিলের ওপর একটি ট্রে, তার ওপর পাশাপাশি দুটি শূন্য চায়ের পেয়ালা।
কোথা থেকে কারা দুজন এসে, আর পাশাপাশি বসে তাদের তৃষ্ণ মিটিয়ে চলে গেছে। রাজপুর জংশন আবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে বয় এসে তুলে নিয়ে যাবে, ধুয়ে মুছে সাজিয়ে রেখে যাবে, একটা পেয়াল কাবার্ডের এইদিকে, আর একটা হয়তো একেবারে ঐ দিকে।