রাত্রির যাত্রী – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় : এক অনন্য সাহিত্যিক রচনা l Ratrir Jatri by Sasthipada Chattopadhyay 2024

By raateralo.com

Published on:

রাত্রির যাত্রী – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় l Ratrir Jatri by Sasthipada Chattopadhyay 2024

রাত্রির যাত্রী – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় : এক অনন্য সাহিত্যিক রচনা: ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক, যিনি তাঁর অনবদ্য রচনাশৈলীর মাধ্যমে পাঠকদের মন জয় করেছেন। তাঁর লেখা প্রতিটি উপন্যাস, গল্প, ও কবিতা আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি এবং মানবমনের গভীরতাকে ধারণ করে। “রাত্রির যাত্রী” তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস, যা পাঠকদের এক ভিন্ন জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।

“রাত্রির যাত্রী” উপন্যাসে তিনি গভীর রাত্রির নির্জনতা, মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং জীবনের নানা অমোঘ সত্যকে তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসে চট্টোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্রগুলো বাস্তবিক, জীবন্ত এবং পাঠকদের চিন্তার খোরাক যোগায়। তাঁর লেখার শৈলী, বর্ণনা এবং অনুভূতির মেলবন্ধন এতটাই নিখুঁত যে প্রতিটি পাঠক নিজেকে সেই গল্পের অংশ বলে মনে করেন।

চলুন, আমরা ডুব দিই ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের লেখার এই অসাধারণ জগতে, এবং অন্বেষণ করি তাঁর সৃষ্টিশীলতার এক অনন্য দিক।

রাত্রির যাত্রী – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় : এক অনন্য সাহিত্যিক রচনা

বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। এক শীতের রাতে রাজীব আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হল। খেয়েদেয়ে তখন শুতে যাচ্ছি। এমন সময় রাজীব এল। রাজীব আমার পুরনো বন্ধু। ব্যান্ডেলে থাকে। বললাম, “কী ব্যাপার, এমন সময় তুই হঠাৎ?”

রাজীব হেসে বলল, “বলছি বলছি। এখন কী খেতে দিবি তাই বল। দারুণ খিদে পেয়েছে।”

“কী খাবি বল? লুচি আর আলুভাজা খা বরং।”

“ওরে বাবা। লুচি খেলে আমার অম্বল হয়। তুই ভাতের ব্যবস্থা কর।” “তা হলে স্টোভে ভাত বসিয়ে দিই। আর ডিমের ঝোল।”

“অত ঝঞ্ঝাটের দরকার কী? ভাতের মধ্যে ডিম দিয়ে দে। ঘি থাকে তো আরও ভাল। গরম ভাতে ঘি মেখে ডিমসেদ্ধ দিয়ে চমৎকার খাওয়া হবে।” এই বলে জামাপ্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি আর সোয়েটার পরে আমার তক্তাপোশের বিছানায় লেপমুড়ি দিয়ে গা এলিয়ে দিল। তারপর বলল, “তুই তো দেশ-দেশান্তরে ঘুরিস। পাটনায় গেছিস কখনও?” “না। কেন বল তো?”

“একটা অদ্ভুতুড়ে চিঠি এসেছে। আমাকে কালই পাটনা যেতে হবে। তুই যাবি ভাই আমার সঙ্গে? আমি তো কখনও বাইরে বেরোইনি। ছেলেবেলায় মা-বাবার সঙ্গে একবার দেওঘর গিয়েছিলাম।”

বললাম, “যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু আজকাল যা ট্রেনের অবস্থা তাতে বিনা রিজার্ভেশনে ট্রেনে ওঠাই তো মুশকিল।”

“সে ভাবনা তোকে ভাবতে হবে না। আমার ছোট জামাইবাবু রেলের বুকিং ক্লার্ক। পাঞ্জাব মেলের দুটো বার্থের কথা তাকে বলে রেখেছি। এখন তুই যদি যাস তো ভাল হয়। না হলে আমাকে একাই যেতে হবে।”

“কেন, কী ব্যাপার! হঠাৎ পাটনায় যাবি কেন? কী এমন চিঠি এল তোর?”

“এই দেখ।” বলে উঠে গিয়ে হ্যাঙারে ঝোলানো ওর জামার পকেট থেকে একটা চিঠি এনে আমাকে দেখাল। “অন ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট সার্ভিস’ ছাপ দেওয়া একটা খাম। আমি সেটা হাতে নিয়ে তার ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে পড়লাম। তারপর বেশ খুশির সঙ্গেই বললাম, “এ তো রেডিয়ো অফিস থেকে এসেছে। তুই রেডিয়োতে ভজন গাইবি বলে আবেদন করেছিলি, তাই ওরা তোকে ভয়েস টেস্টের জন্য ডেকেছে। কাল বাদে পরশু তোর টেস্ট। তার মানে কাল রাত্রে পাঞ্জাব মেলে যেতে পারলে পরশু ভোরে নামা। তারপর দুপুর দুটোয় পরীক্ষা দিয়ে সন্ধের সময় ট্রেনে চাপলে সকাল হলেই হাওড়ায়। মাত্র দু’-তিনদিনের মামলা।”

“হ্যাঁ। মামলাটা দু’-তিনদিনের। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, আমি কলকাতা সেন্টার থাকতে পাটনায় ভয়েস টেস্ট দিতে যাব কেন? আর তার চেয়েও বড় কথা, রেডিয়োয় গান গাইবার জন্য আমি কোনও সময়েই কোনও আবেদন করিনি।”

“তবে তো কথাই নেই। চিঠিটা ছিঁড়ে কুচিয়ে ফেলে দিয়ে দু’দিন এখানে বিশ্রাম নিয়ে গল্পেরই বই পড়। সিনেমা দেখ। এইসব কর।”

“তাই করতাম। কিন্তু এইবার দ্যাখ। এই চিঠিটা পড়।” বলে আর একটা চিঠি আমার হাতে দিয়ে রাজীব আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইল।

সে চিঠিটা এইরকম: “ভাই রাজীব, আমি অভিজিৎ, তোকে এই চিঠি লিখছি। তোর হয়তো আমার কথা মনে নেই। কিন্তু আমি তোকে ভুলিনি এখনও। স্কুলে লাস্ট বেঞ্চে বসে তুই গুনগুন করে গান গাইতিস, আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। একদিন এই গান গাওয়া নিয়ে চঞ্চলবাবু স্যার তোকে কী মার মেরেছিলেন মনে আছে তো? যাই হোক, আমি এখানে দরিয়াপুরে একটা পুরনো বাড়ি কিনেছি। এলাকাটা মুসলমানপ্রধান।

সেটা কোনও ব্যাপার নয়। তোর বকলমে আমি এখানকার রেডিয়ো সেন্টারে একটা আবেদনপত্র পেশ করেছি। তুই আয়। আমার জানাশোনা লোক আছে। তোর হয়ে যাবে। এখানে দু’-চারটে কল পাওয়ার পর কলকাতা সেন্টারে তোর একটা ট্রান্সফারের ব্যবস্থা আমি করে দেব। শুনলুম এখনও বিয়ে করিসনি তুই। গর্দভ কোথাকার! যদি পারিস তো জহরটাকেও সঙ্গে আনিস। ওটাও তো তোর মতো। টো টো করে চারদিকে শুধু ঘুরে বেড়ায়।”

চিঠিটা পড়ে আমি যারপরনাই অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, “কী আশ্চর্য! এ তো আমারও নাম লিখেছে দেখছি। কিন্তু তুই আমি তো এক স্কুলে পড়তাম না। তবে এক কোচিং-এ পড়েছি। অভিজিৎ কে? ও নামে কাউকে কখনও চিনতাম বলেও তো মনে পড়ছে না।”

“আমারও কিছু মনে পড়ছে না। কে অভিজিৎ? অথচ চিঠিটা এমনভাবে লেখা, যেন সে আমাদের দু’জনেরই অত্যন্ত পরিচিত।”

“কেউ আমাদের ব্ল্যাকমেল করছে না তো?”

“তাতে লাভ? আমরা তো টাকার থলি নিয়ে সেখানে যাচ্ছি না। আমাদের ব্ল্যাকমেল করে কী করবে?”

“আমি বলি কি সাড়াশব্দ না করে চেপে যা ব্যাপারটা।”

“দেখ ভাই, গান আমি অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি। কাজেই গাইতে পারব না। তানপুরা টানপুরা কিছুই আর নেই। তবুও বিশ্বাস কর, এই আমন্ত্রণে আমার রক্তে দোলা লেগেছে। দেখিই না একবার পরীক্ষাটা দিয়ে। যদি উতরে যাই? অবশ্য অভিজিতের ব্যাপারটা খুবই রহস্যময়। তবু ওর সঙ্গে দেখা করি। হয়তো কখনও না কখনও পরিচয় ছিল। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, ও আমার ঠিকানা জানল কী করে? ব্যান্ডেলে আমরা নতুন গেছি বাড়ি তৈরি করে। এ ঠিকানা তো ওর জানবার কথা নয়।”

“আমি তবুও বলছি, ও আশা ছাড়। বরং কোথাও বেড়াতে যেতে চাস তো চল ঘুরে আসি দু-চারদিন।”

“তা হলে আমাকে একাই যেতে হচ্ছে।”

“আঃ হা। তুই ভুল বুঝছিস আমাকে। আমি কি সেই কথাই বলছি? শুধু তাই নয়, তুই ভেবে দেখ, রেডিয়ো একটা সরকারি সংস্থা। অ্যাপ্লিকেশনে তোর নিজের সই নেই। অন্যে তোর হয়ে সই করেছে। অথচ তুই ওই জাল আবেদনপত্রের ডাকে পরীক্ষা দিতে যাবি। এটা  কি একটা দু’–নম্বরি ব্যাপার নয়? ধরা পড়লে কিন্তু কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।” “হয় হবে। তবু যাব। এবং দেখব অভিজিৎটা কে?” “চল তবে।”

“আমি মুখে ওকে বারণ করলেও কৌতূহল আমারও বড় কম ছিল না! সে রাতটা দু’বন্ধুতে গল্পগুজবে কাটিয়ে পরদিন সকালে রিজার্ভেশনের জন্য গেলাম। টিকিটের অবশ্য অসুবিধে হল না। ওর ছোট জামাইবাবুর সৌজন্যে ফাইভ আপে দুটো বাৰ্থ পেয়ে গেলাম। সঙ্গে টাকাকড়িও নিলাম বেশি করে। ঠিক হল পাটনার কাজ শেষ হলে রাজগির কিংবা বেনারসে গিয়ে কাটিয়ে আসব কয়েকটা দিন। এখন অঘ্রানের শেষ। এই কনকনে শীতে বিহার ইউ. পি.র দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে বেড়াতে মন্দ লাগবে না!

সে কী দারুণ আনন্দ! পরদিন রাতের গাড়িতে পাটনা কোচের থ্রি-টায়ারে শুয়ে হোটেলের কষা মাংস আর তন্দুরি রুটি খেতে খেতে মনে হল, যেন বদ্ধ খাঁচা থেকে মুক্ত হওয়া পাখির মতো ডানা মেলে উড়ছি। প্রচণ্ড শীতের দাপটটাকে ঢাকতে সারা গায়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে ট্রেনের দোলায় দুলতে দুলতে কখনও জেগে, কখনও ঘুমিয়ে এক অপূর্ব নিশিযাপন করতে লাগলাম।

শেষ রাত্রে ট্রেন পাটনা জংশনে এল। আমরা কনকনে শীতের মধ্যে ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মের ওভারব্রিজ পার হয়ে ওপারে গেলাম। তারপর গেটে টিকিট জমা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর ওয়েটিংরুমে গিয়ে দাঁড়ালাম। চারদিকে লোকজন। কোথাও পা রাখার জায়গা নেই। এই দারুণ শীতে কাঁথা কম্বল মুড়ি দিয়ে মেঝেতেই শুয়ে আছে সব।

আমরা অযথা এদিক-সেদিক পায়চারি করতে লাগলাম। বসবার জায়গা না পেয়ে স্টেশনের বাইরে এসে স্টেশনের কাছে একটা চায়ের দোকানে চায়ের অর্ডার দিলাম। বাইরে তারা-ঝলমলে শেষরাতের আকাশ। আলোকমালায় সজ্জিত পাটনা শহর। সত্যি বলতে কি সেই প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে এই নতুন পরিবেশে এইরকম একটি মুহূর্তে গাঢ় দুধের তৈরি গরম চা ভাঁড়ে করে খেতে যে কী আরাম পেয়েছিলাম, তা বলে বোঝাতে পারব না। আমরা যখন চা খাচ্ছি তখন হর্ন বাজিয়ে একটা সাইকেল রিকশা এসে আমাদের সামনে

Ratrir Jatri by Sasthipada Chattopadhyay l ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় উপন্যাস

দাঁড়াল, “আইয়ে বাবু রাজেন্দ্রনগর?”

আমরা বললাম, “রাজেন্দ্রনগর নয়। দরিয়াপুর।” “চলিয়ে।”

চা খাওয়া শেষ করে দাম মিটিয়ে বললাম, “যাব। কিন্তু এত অন্ধকারে নয়। ভোরবেলা যাব।”

“এখন গেলে কি হোবে? সামান্য দুটো টাকার লোভে আপনাদের অন্য কোথাউ লিয়ে গিয়ে কি খুন করিয়ে ফেলব?”

“না না। তা বলছি না। মানে নতুন আসছি তো! এখন গেলে ঠিকানা খুঁজে বাড়ি চিনতে অসুবিধে হবে।”

“কুছু ওসুবিধা হোবে না আপনাদের। অভিজিৎবাবুর কাছে যাঁরা আসেন তাঁদের কোনও ওসুবিধা হামি করে না।”

আমরা দু’জনেই চমকে উঠলাম। বললাম, “তুমি কী করে জানলে আমরা অভিজিৎবাবুর কাছে যাচ্ছি?”

“উনি হামাকে বোলে রেখেছিলেন দু’জন বাঙালি ছোকরা হামার বাড়িতে আসবে। তাদের কোনও ওসুবিধা যাতে না হয় সেইভাবে এখানে লিয়ে আসতে।”

“কিন্তু আমরা যে এই গাড়িতেই আসব তোমার অভিজিৎবাবু তা জানলেন কী করে?”

“অভিজিৎবাবুর কাছে যাঁরা আসেন তাঁরা রাতের গাড়িতেই আসেন বাবু।”

“অ। তা আমরাই যে সেই লোক তুমি জানলে কী করে?”

“হামি যখন রাজেন্দ্রনগর বোললাম আপনারা তখন দরিয়াপুর বোললেন। তাতেই বুঝলাম, আপনারা তারাই।”

আমরা দু’জনে পরস্পরের দিকে একবার তাকিয়ে চোখে চোখে সম্মতি জানিয়ে রিকশায় উঠে বসলাম।

আলোকোজ্জ্বল পাটনা শহরের বুকে রাত্রির যাত্রী আমরা প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে রিকশায় চলেছি। রিকশা সমানে ভেঁপু বাজিয়ে দ্রুতগতিতে এ-পথ সে-পথ করে দরিয়াপুরের দিকে এগিয়ে চলল। এইভাবে অনেকটা পথ যাওয়ার পর বড় রাস্তা ছেড়ে বস্তি অঞ্চলের গলিতে ঢুকল রিকশা। এতক্ষণ তবু পথেঘাটে দু’-একজন মানুষ বা কোনও না কোনও যানবাহন নজরে পড়ছিল। দোকানপাট বন্ধ থাকলেও রোড লাইটে পথঘাট উজ্জ্বল ছিল । এখন এই গলির নরকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। এ-গলি সে-গলি করে কোথায় যে নিয়ে চলল সে, তা কে জানে? তারপর একটা বাড়ির সামনে এসে অনবরত ভেঁপু বাজাতে লাগল।

আমরা বললান, “এই বাড়ি নাকি?”

“হ্যাঁ। এই বাড়ি। ইয়ে মকান অভিজিৎবাবুকা।

আমরা তখন দরজায় কড়া নেড়ে ডাকতে লাগলাম, “অভিজিৎ। অভিজিৎ।” দু-একবার ডাকার পরই ভেতর থেকে সাড়া পাওয়া গেল।

“হ্যাঁ। এক মিনিট দাঁড়া।”

আমরা দরজা খোলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এমন সময় হঠাৎ খেয়াল হল, রিকশাটা নেই। তাই তো! গেল কোথায়? ভাড়াও তো দেওয়া হয়নি। চেয়ে দেখলাম রিকশাটা গলির বাঁকে হারিয়ে যাচ্ছে।

এমন সময় দরজা খুলে গেল। কেউ একজন হাসিমুখে বলল, “ভেতরে আয়।”

ভুল হচ্ছে হয়তো। অভিজিৎকে না চেনার কারণও আছে অবশ্য। ওর সারা গায়ে কম্বল মুড়ি দেওয়া ছিল । মাথায় ছিল মাঙ্কি ক্যাপ। শুধু ওর চোখ দুটি বোঝা যাচ্ছিল।

আমরা অভিজিৎকে চিনতে পারলাম না। বুঝলাম কোথাও একটা

যাই হোক, অভিজিতের পেছন পেছন আমরা ঘরে ঢুকে সোফায় বসলাম। ঘরের দেওয়ালে অনেক আঁকা ছবি টাঙানো আছে। অভিজিৎ হেসে বলল, “ওগুলো আমারই আঁকা।”

আমি বললাম, “তোমার চিঠি পেয়েই আমরা চলে এসেছি। কারণ রেডিয়ো প্রোগ্রামের তারিখ আজই। অথচ আশ্চর্য দেখো, তোমার কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি এখনও চিনতে অসুবিধে হচ্ছে তোমাকে।”

“চা না কফি?”

রাজীব বলল, “এই তো চা খেয়ে এলাম। তবে যা দারুণ ঠাণ্ডা, তাতে এবার একটু কফি  হলে মন্দ হয় না।”

অভিজিৎ উঠে গেল। তারপর আমাদের দু’জনের জন্য দু’ কাপ কফি নিয়ে চলে এল সঙ্গে ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুট। আশ্চর্য! কফিও কি আমাদের জন্য তৈরি ছিল? অভিজিৎ বলল, “খুব অবাক হয়ে যাচ্ছিস না? মুখটা ঠিক মনে করতে পারছিস না। ভাবছিস কে না কে নকশা করছে হয়তো।”

আমি বললাম, “ঠিক তাই।”

অভিজিৎ বলল, “আজকে এই ট্রেনে এসেই ভাল করেছিস তোরা। না হলে পরে এলে দেখা হত না। হঠাৎ একটা দরকারি কাজ পড়ে যাওয়ায় একটু পরেই আমাকে দানাপুর চলে যেতে হবে। সেজন্য অবশ্য তোদের থাকার কোনও অসুবিধে হবে না। আমি চাবি দিয়ে যাব। তোরা বাইরে যাওয়ার সময় মেন গেটে তালা দিয়ে চলে যাস। অনেক হোটেল আছে এখানে। যেখানে হোক খেয়ে নিয়ে ঠিক দুটোর সময় রেডিয়ো স্টেশনে চলে যাবি। তবে ভাই একটা কথা। আমার ওপর রাগ করে কাজ মিটে গেলে চলে যাস না যেন। আমি সন্ধের সময় ফিরব। তারপর তিন বন্ধুতে রান্না-খাওয়া করে হইহল্লায় কাটিয়ে দেব সারাটি রাত।”

রাজীব কফি খেতে খেতে বলল, “তা তো বুঝলাম। কিন্তু ভাই একটা কথা। এখানকার অ্যাপ্লিকেশনে যে সিগনেচার করা আছে তার সঙ্গে তো আমার সই মিলবে না। এতে কোনও অসুবিধে হবে না তো?”

“না না। কোনও অসুবিধে হবে না। ওখানে গিয়ে ঝাজির খোঁজ করবি। ঝাজি সব জানে। তাকে বলবি আমি পাঠিয়েছি তোকে। আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে না।”

আমাদের কফি খাওয়া যখন শেষ হল তখন একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। অভিজিৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কিছু মনে করিস না ভাই, আমি চলি। আর আমার থাকার উপায় নেই। আমি ওদিক দিয়ে দরজায় শিকল এঁটে চলে যাচ্ছি। তোরা বাইরের দরজায় তালা দিয়ে যাস। এই নে তালাচাবি।”

আমরা হাত পেতে তালাচাবি নিলাম।

“একটা দিন একটু মানিয়ে নে। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে আমাকে যেতে হচ্ছে।” বলে ভেতরে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল অভিজিৎ।

আমরা দু’জনে চুপচাপ বসে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর বাইরে বেরিয়ে দেখলাম জল কল খাটা পায়খানা সবকিছুরই ব্যবস্থা আছে। আমরা দাঁত মেজে মুখহাত ধুয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে মেন গেটে তালা দিয়ে বাইরে এলাম। সবে সকাল ছ’টা। ভয়েস টেস্ট দুপুর দুটোয়। যার আতিথ্যে এলাম সে-ই যখন নেই তখন মিছিমিছি এখানে বসে থেকে সময় নষ্ট করে লাভ কী? তার চেয়ে পাটনা শহরটা একটু ঘুরে বেড়িয়ে দেখে নিই।

পাটনা তো আমাদের কাছে পাটনা নয়। পাটলিপুত্র। মগধের রাজধানী। সেই চোখ নিয়ে দেখতে হবে। দু’ টাকা ঘণ্টা হিসাবে একটা রিকশা ভাড়া করে গোটা শহরটা আমরা প্রদক্ষিণ করতে লাগলাম। অনেক ঘোরাঘুরির পর মহেন্দ্রনগরে এসে আমরা রিকশা ছাড়লাম। এখানে এসে অনেকক্ষণ ধরে দোতলার বারান্দায় বসে গঙ্গার সৌন্দর্য দেখলাম। তারপর একটা হোটেলে খেয়ে ঠিক দুটোর সময় এসে হাজির হলাম পাটনা বেতার কেন্দ্রে।

আমরা অফিসঘরে গিয়ে কাগজ জমা দিতেই ওখানকার ইনচার্জ একবার তাকিয়ে দেখলেন আমাদের দিকে! তারপর হেসে বললেন, “কে পাঠিয়েছে আপনাদের, অভিজিৎবাবু?”

আশ্চর্য তো! লোকটা জানল কী করে! বললাম, “হ্যাঁ, অভিজিৎবাবু আমাদের পাঠিয়েছেন। তবে আপনাদের চিঠি পেয়েই আমরা এসেছি। আপনি কি ঝাজি?”

“জি হ্যাঁ। কোথা থেকে আসছেন আপনারা?”

“এখন অভিজিৎবাবুর বাড়ি থেকে আসছি।”

“হুঁ। তা বলুন, আমি কী করতে পারি আপনাদের জন্য?”

“কী আর করবেন? আমার বন্ধু রাজীব পাটনা বেতার কেন্দ্র থেকে গান গাইবে। ওর ভয়েসটা টেস্ট করে ছেড়ে দিন।”

“আপনারা কলকাতায় কোথায় থাকেন?”

“আজ্ঞে ঠিক কলকাতায় নয়। আমি থাকি হাওড়ায়। আর আমার এই বন্ধুটি থাকেন ব্যান্ডেলে।”

ঝা’জি বললেন, “কিন্তু যে চিঠি আপনারা এনেছেন সেই চিঠির ওপর ভরসা করে কি আমি আপনার বন্ধুর ভয়েস টেস্ট করতে পারি?”

‘কেন পারেন না? এ তো আপনাদেরই দেওয়া চিঠি।”

“স্বীকার করলাম। কিন্তু এতে রাজীববাবুর নাম কোথায়? এ তো অন্য নাম দেখছি।”

“তার মানে? আমরা দু’জনেই চিঠিটার ওপর ঝুঁকে পড়ে দেখলাম তাতে পরিষ্কার লেখা আছে আমার নাম। বললাম—কী ব্যাপার! আমার নাম কেন? আমি তো গানই গাইতে পারি না। তা ছাড়া আমি কোনও আবেদনও করিনি।”

“আবেদন তো উনিও করেননি। ওঁর হয়ে অভিজিৎবাবু করেছিলেন।”

“সে যেই করুক। এই চিঠি যখন হাতে পেয়েছিলাম আমরা, তখনও কিন্তু রাজীবের নামই লেখা ছিল এতে।”

“তা হলে কি বলতে চান আমি কোনও কারসাজি করেছি এতে?”

“না না সে কী কথা।” বলে বললাম, “আচ্ছা খামটা একবার দেখি?”

“ঝা’জি আমাদের খাম দিলে তাতেও আমার নাম এবং বাড়ির ঠিকানা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কী আশ্চর্য! এই ঠিকানায় চিঠি এলে সে চিঠি তো আমি পেতাম। ব্যান্ডেলে বসে রাজীব পাবে কেন? এই শীতেও আমাদের কপালে ঘাম দেখা দিল।

ঝা’জি কঠিন গলায় বললেন, “গভর্নমেন্টকে চিট করতে আসার জন্য আমি আপনাদের দু’জনকেই পুলিশে দেব।”

আমরা সভয়ে বললাম, “ঝা’জি, প্লিজ। আপনি বিশ্বাস করুন, আমরা জোচ্চোর নই। আসলে আমরা বোকা বনে গেছি। কেউ আমাদের বিপদে ফেলবে বলে এই টোপ ফেলে এ কাজ করেছে।”

ঝা’জি হেসে বললেন, “যাক, আপনাদের অবস্থা দেখে খুব হাসি পাচ্ছে আমার। তবু আপনাদের জন্য মায়াও হচ্ছে। ঠিক আছে। রাজীববাবু, আপনি এক কাজ করুন, ব্যাক ডেটে একটা অ্যাপ্লিকেশন করুন। তারপর দেখছি আপনার ভয়েসটা টেস্ট করে আপনার জন্য কিছু করতে পারি কিনা।”

রাজীব তাই করল।

ঝা’জি ওকে নিয়ে গেলেন স্টুডিয়োর ভেতরে। তারপর প্রায় আধঘণ্টাটাক বাদে যখন ফিরে এলেন তখন রাজীবের মুখ বেশ প্রসন্ন।

ঝা’জি বললেন, “আপনার অ্যাপ্লিকেশন ফর্মে আপনি অভিজিৎবাবুর ঠিকানাটাই দিয়েছেন তো?”

রাজীব বলল, “হ্যাঁ।”

“ঠিক করেছেন। কেননা ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে এসে পাটনায় অডিশন দেওয়া বা প্রোগ্রাম পাওয়া যায় না। তবে আপনার কেসটা আলাদা। আপনি ফর্মের পেছনে আপনার ব্যান্ডেলের ঠিকানাটা লিখে দিন। পাশ করলে বা প্রোগ্রাম পেলে চিঠি দেব। মনে হচ্ছে আপনার হয়ে যাবে। আপনার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব। তবু আমি তো ফাইনাল অথরিটি নই। ইতিমধ্যে বাড়ি ফিরে গিয়ে বেশ পুরোদমে সঙ্গীতচর্চা চালিয়ে যান। যদি পাশ করে যান তা হলে খুব শিগগিরই গাইতে আসতে হবে।”

আমরা বললাম, “প্রোগ্রাম পেলে কতদিন বাদে পাওয়া যাবে।”

“তা মাসতিনেকের মধ্যে।”

আমরা নমস্কার জানিয়ে উঠতেই ঝা’জি বললেন, “কোথায় যাবেন এখন?” “এখন আর যাব কোথায়? অভিজিতের ওখানেই যাব।”

ঝা’জি বললেন, “আপনারা দেখছি রীতিমতো সম্মোহিত হয়েছেন। আচ্ছা, আপনাদের কি একবারের জন্যও মনে হল না যে, এই নামে আপনাদের কোনও বন্ধু নেই।”

অমাবস্যার মতো অন্ধকার হয়ে গেল আমাদের মুখ। ঝা’জি এ-কথা জানলেন কী করে? সত্যিই তো, এ নামে তো আমাদের কোনও বন্ধু নেই। আমরা কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “কী ব্যাপার বলুন তো?”

“তার আগে বলুন আপনারা এসেছেন কখন? কোন গাড়িতে?”

“পাঞ্জাব মেলে। ভোরবেলায়।”

“ওর বাড়িতে গিয়েছিলেন?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“খুব বরাতজোর যে, ভোরবেলা গেছেন। না হলে রাত্রে গিয়ে ওর সঙ্গে সারারাত থাকলে পাগল হয়ে যেতেন।”

“সে কী!”

আরে মশাই, অভিজিৎ বলে কেউ ওখানে থাকে না । তবে একসময় থাকত। আমার বিশেষ বন্ধুলোক ছিল। আজ থেকে প্রায় সাত-আট বছর আগে ওই বাড়িটা কেনার পরই ও এক বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকের হাতে খুন হয়। আসলে যে বাড়িটা ও কিনেছিল সেটা ছিল মুসলমানদের বাড়ি। ভাল করে কাগজপত্র খতিয়ে না দেখে কেনার ফলে অন্য এক শরিক এসে ওকে খুন করে। তারপর থেকে প্রায়ই দেখা যায় ছ’মাস এক বছর অন্তর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বেছে বেছে বাঙালি ছেলেমেয়েদের এইভাবে উড়ো চিঠি দিয়ে ও এখানে ডেকে আনছে।

এবং ওর অলৌকিকত্বর নিদর্শন হিসেবে প্রতিবারই দেখা যাচ্ছে পরীক্ষার্থী তার কাগজ জমা দেওয়ার পর কাগজে হয় অন্য নাম-ঠিকানা ফুটে উঠেছে, নয়তো কাগজ একদম সাদা হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে আমরা তিতিবিরক্ত হয়ে গেছি ভাই। এমনিতে অভিজিৎ খুবই ভাল ছেলে ছিল । গানবাজনা করত। ছবি আঁকত। তা যাক, আপনারা যেন ভুলেও ও বাড়িতে রাত কাটাতে যাবেন না। সোজা স্টেশনে গিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান।”

আমরা কালবিলম্ব না করে স্টেশনে চলে এলাম, এবং বেশি টাকা দিয়ে সিক্স ডাউনের পাটনা কোচে দুটো স্লিপার বার্থ রিজার্ভ করে সে রাতেই পালিয়ে এলাম। ঝাজি অবশ্য কথা রেখেছিলেন। কিছুদিন পরেই ভদ্রতা করে সরকারিভাবে চিঠি দিয়ে রাজীবকে পাটনা বেতার কেন্দ্রের ভয়েস টেস্টে উত্তীর্ণ হতে না পারার কথাটা জানিয়ে দিয়েছিলেন।

raateralo.com

Leave a Comment