লালন ফকিরের জনপ্রিয় গান একটি অমূল্য ধর্মীয় ও সাহিত্যিক সম্পদ। তার গানের মধ্যে মানবিকতা, ভালোবাসা, ধর্ম, সামাজিক ন্যায় এবং প্রাকৃতিক সম্পর্কের গভীর বিচারধারা অন্তর্নিহিত।১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর মরমী এ দার্শনিক দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১১৬ বছর। মহাত্মা এই দার্শনিকের মৃত্যুদিনে রাতের আলোর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার জনপ্রিয় গান (Popular Songs by Lalon Fakir) পুনর্মুদ্রণ করা হলো
লালন ফকির ছিলেন একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক। তাঁর গানের মধ্যে সন্ধান পাওয়া যায় এক বিরল মানব দর্শনের।
লালন শাহ, যিনি লালন ফকির বা লালন সাঁই নামেও পরিচিত, তিনি মৃত্যুর ১২৯ বছর পর আজও বেঁচে আছেন তাঁর গানের মাঝে। তাঁর লেখা গানের কোন পাণ্ডুলিপি ছিল না, কিন্তু গ্রাম বাংলায় আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তাঁর রচিত গান ছড়িয়ে পড়ে লোকের মুখে মুখে।
লালন ফকিরকে “বাউল-সম্রাট” বা “বাউল গুরু” হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তাঁর গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি প্রায় দু হাজার গান রচনা করেছিলেন বলে লালন গবেষকরা বলেন।
লালন ফকিরের সঠিক জন্ম ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কোন কোন লালন গবেষক মনে করেন তেরশ’ চুয়াত্তর সালে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার ভাড়ারা গ্রামে লালন জন্মগ্রহণ করেছিলেন সম্ভ্রান্ত এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে। বাবা মাধব কর ও মা পদ্মাবতীর একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি।
কিন্তু এ বিষয়ে দ্বিমতও আছে। কেউ বলেন তাঁর জন্ম ঝিনাইদহে, কেউ বলেন যশোরে।
কথিত আছে শৈশবে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় অল্প বয়সেই তাঁর ওপর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ তাঁর হয়নি।
কোন কোন গবেষকের বিবরণ অনুযায়ী প্রতিবেশী বাউলদাস ও অন্যান্য সঙ্গীদের নিয়ে “পুণ্যস্নান” বা তীর্থভ্রমণ সেরে ঘরে ফেরার পথে লালন বসন্তরোগে গুরুতরভাবে আক্রান্ত হন।
লালন ফকিরের কয়েকটি গান l Popular Songs by Lalon Fakir
Table of Contents
অখণ্ড মণ্ডলাকারং
অখণ্ড মণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং জগৎ চরাচর
গুরু তুমি পতিত পাবন পরম ঈশ্বর।
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব তিনে
ভজে তোমায় নিশিদিনে,
তোমা বিনে বুঝি না অন্যে
যা করো তুমি আমায়।
ভজে যদি না পাই তোমায়
এ দোষ আমি দেবো বা কার,
নয়ন দুটি তোমার উপর
তুমি গুরু পরাৎপর।
আমি লালন একই শিরে
ভাই বন্ধু নাই আমার জোড়ে,
ভুগেছিলাম পক্স জ্বরে
মলম শাহ করলেন উদ্ধার।
অটল অমূল্য নিধি
যে জন পদ্ম হেম
সরোবরে যায়,
অটল অমূল্য নিধি
সে অনায়াসে পায়।
অপরূপ সেই নদীর পানি
জন্মে তাহে মুক্তামণি,
বলবো কি তার গুণ বাখানি
স্পর্শে পরশ হয়।
বিনা হাওয়ায় মৌজা খেলে
ত্রিখণ্ড হয় তৃণ পলে,
তাহে ডুবে রত্ন তোলে
রসিক মহাশায়।
পলক ভ’রে পড়ে চড়া
পলকে হয় তর্ক ধরা,
সে ঘাট বেঁধে মৎস্য ধরা
সামান্যের কাজ নয়।
গুরু যার কান্ডারী হয় রে
অঠাঁই এ ঠাঁই দিতে পারে,
লালন বলে সাধন জোরে
শমন এড়ায়।
অনাদির আদি শ্রীকৃষ্ণনিধি
অনাদির আদি শ্রীকৃষ্ণনিধি
তাঁর কি আছে কভু গোষ্ঠখেলা,
ব্রহ্মরূপে সে অটলে বসে
লীলাকারী তাঁর অংশকলা।
পূর্ণচন্দ্র কৃষ্ণ রসিক সে জন
শক্তিতে উদয় শক্তিতে সৃজন,
মহাভাবে সর্বচিত্ত আকর্ষণ
বৃহদাগমে তাঁরে বিষ্ণু বলা।
সত্যাসত্য স্মরণ বেদ আগমে কয়
সচ্চিদানন্দ রূপে পূর্ণ ব্রহ্ম হয়,
জন্মমৃত্যু যার নাই ভবের পর
সে তো নয় স্বয়ং কভু নন্দলালা।
গুরুকৃপাবলে কোনো ভাগ্যবান
দেখেছে সেরূপ পেয়ে চক্ষুদান,
সেরূপ হেরিয়ে সদা যে অজ্ঞান
লালন বলে সে তো প্রেমের ভোলা।
অনুরাগ নইলে কি সাধন
অনুরাগ নইলে কি সাধন হয়
সে তো মুখের কথা নয়,
বনের পশু হনুমান
রাম বিনে তার নাইরে ধিয়ান,
কইট মনে মুদে নয়ন
অন্যরূপ না ফিরে চায়।
তার সাক্ষী দেখ চাতকেরে
তৃষ্ণায় জীবন যায় মরে,
তবু অন্য বারি খায় না রে
থাকে মেঘের জলের আশায়।
রামদাস মুচির ভক্তিতে
গঙ্গা এল চামকেটোতে,
সে রূপ সাধল কত মহতে
লালন কূলে কূলে বায়।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি: বিবিসি বাংলার জরিপে ১২ নম্বরে বাউল সাধক ফকির লালন শাহ
অন্তরারে ধরো
তোমারি এই বসন-ভূষণ
কার লাগিয়া করো,
দেহটারে ছাইড়া মায়া
অন্তরারে ধরো, ও মন।
ললাটে চাঁদ আঁইকা তুমি
আছো মনের মগনে,
সেজদা দেবার সময় কোথায়
সেই না প্রভুর চরণে,
তাইতো বলি ওরে ও মন
তারে মনে করো।
নিজের কাছে অচেনা তুই
মন রে দিলি পরবাস,
সেই নিরাকার একজনাতে
হইল না তোর বসবাস।
অমৃত মেঘের বারি
অমৃত মেঘের বারি
মুখের কথায় কি মেলে,
চাতক স্বভাব না হলে।
চাতক পাখির এমনি ধারা
তৃষ্ণায় জীবন যায় গো মারা,
অন্য বারি খায় না তারা
মেঘের জল বিনে।
মেঘে কত দেয় গো ফাঁকি
তবুও চাতক মেঘের ভুখি,
ওমনি নিরিখ রাখলে আঁখি
তারে সাধক বলে।
মন হয়েছে পবন গতি
উড়ে বেড়ায় দিবা রাতি,
ফকির লালন বলে গুরুর প্রতি
ও মন রয় না সুহালে।
আগে কপাট মারো
হাওয়া ধরো, অগ্নি স্থির করো
মরার আগেতে মরো,
ম’রে যেন বাঁচিতে পারো
দেখে শমন যাক ফিরে।
বারে-বারে করি মানা
লীলার দেশে আর যেও না,
তেজের ঘর করো তেজিয়ানা
সাধো ঊর্ধচাঁদ ধরে।
জানো না রে মন, পারাহীন দর্পণ
কেমনে হয় রূপ দরশন,
সিরাজ সাঁইয়ের বচন শোন রে লালন
থেকো হুঁশিয়ারে।
আছে ভাবের তালা
আছে ভাবের তালা যে ঘরে,
সেই ঘরে সাঁই বাস করে।
ভাব দিয়ে খোল ভাবের তালা
দেখবি সেই অতলের খেলা,
ঘুচে যাবে মনের ঘোলা
থাক গে সে রূপ নিহারে।
ভাবের ঘরে কী মুরতি
ভাবের লন্ঠন ভাবের বাতি,
ভাবের বিভাগ হয় একরতি
ওমনি সে রূপ যায় স’রে।
ভাব নইলে ভক্তিতে কি হয়
ভেবে বুঝে দেখ মনুরায়,
যার যে ভাব সেই জানতে পায়
লালন কয় বিনয় ক’রে।
আজব আয়নামহল
আজব আয়নামহল মণিগভীরে,
সেথা সতত বিরাজে সাঁইজী মেরে।
তার পূর্ব দিকে রত্ন-বেদী
তার উপরে খেলছে জ্যোতি,
তারে যে দেখে সেই ভাগ্যপতি
সচেতন সে সব খবরে।
জলের ভেতরে শুকনো জমি
আঠার মোকামে তাই কায়েমি,
নিঃশব্দে শব্দের উদ্গামী
সে মোকামের খবর জান গে, যা রে।
মণিপুরের হাটে মনোহারী কল
তেহাটা ত্রিবেণী তাহে বাঁকা নল,
মাকড়শার জালে বন্দী সে জল
লালন বলে সঙ্গী বুঝবে কে রে।
আপন ঘরের
আপন ঘরের খবর নে না,
অনা’সে দেখতে পাবি
কোনখানে তার বারামখানা,
আপন ঘরের খবর নে না।
আমি কমল কোঠা কারে বলি,
কোন মোকাম তার কোথায় গলি
সেখানে পড়ে ফুলি,
মধু খায় সে অলি-জনা
আপন ঘরের খবর নে না।
সূক্ষ্ম জ্ঞান যার ঐক্য মুখ্য,
সাধকেরই উপলক্ষ্য
অপরূপ তারই বৃক্ষ,
দেখলে চোখের পাপ থাকে না
আপন ঘরের খবর নে না।
শুষ্ক নদীর সুখ সরোবর,
তিলে-তিলে হয় গো সাঁতার
লালন কয় কীর্তিকর্মার,
কীর্তিকর্মার কি কারখানা
আপন ঘরের খবর নে না।
আপনার আপনি ফানা
আপনার আপনি ফানা হ’লে
সে ভেদ জানা যাবে,
কোন নামে ডাকিলে পরে
হৃদ-আকাশে উদয় হবে।
আরবীতে বলে আল্লাহ
ফারসীতে কয় খোদাতালা,
গড বলেছেন যীশুর চ্যালা
ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভাবে।
আল্লাহ-হরি ভজন-পূজন
মানুষের সকলই সৃজন,
আচানক অচেনায় যখন
জ্ঞানেন্দ্রিয় না সম্ভবে।
মনের ভাব প্রকাশিতে
ভাষার সৃষ্টি এ জগতে,
অনামক অধরকে চিনতে
ভাষাবাক্য নাহি পাবে।
আপনার আপনি হ’লে ফানা
দেখা দেবেন সাঁই রাব্বানা,
সিরাজ সাঁই কয় লালন কানা
স্বরূপে রূপ দেখ সংক্ষেপে।
আমার এ ঘরখানায়
আমার এ ঘরখানায় কে
বিরাজ করে,
আমি জনম ভ’রে একদিন না
আমি দেখলাম তারে।
নড়ে-চড়ে ঈশান কোণে
দেখতে পাই নে এ নয়নে,
হাতের কাছে যার ভবের হাট-বাজার
ধরতে গেলে হাতে পাই নে তারে।
সবে বলে প্রাণপাখি
শুনে চুপে-চুপে থাকি,
জল কি হুতাশন, মাটি কি পবন
কেউ বলে না একটা নির্ণয় করে।
আপন ঘরের খবর হয় না
বাঞ্ছা করি পরকে চেনা,
লালন বলে পর পথে পরমেশ্বর
সে কেমন রূপ আমি কি কব রে।
আমার ঘরের চাবি
আমার ঘরের চাবি
পরের হাতে রে,
আমার ঘরের চাবি।
আমি কেমনে খুলিয়ে সে ধন
দেখবো চোখেতে রে,
আমার ঘরের চাবি।
আপন ঘরে বোঝাই সোনা
পরে করে লেনা দেনা,
আমি হলাম জন্ম-কানা
না পাই দেখিতে রে।
এই মানুষের আছে রে মন
তারে বলে মানুষ রতন,
ফকির লালন বলে পেয়ে সে ধন
পারলাম না চিনতে রে।
আমার মনচোরারে
আমার মনচোরারে কোথা পাই,
কোথা যাই মন আর কিসে বুঝাই।
নিষ্কলঙ্কে ছিলাম ঘরে,
কি বা রূপ নয়নে হেরে
এখন প্রাণে তো আমার ধৈর্য নাই,
ও সে চাঁদ বটে কি মানুষ
গৌর দেখে হলাম বেহুঁশ,
থেকে থেকে ঐ রূপ মনে পড়ে তাই।
রূপের কালে আমায় দংশিলে,
উঠিল বিষ ব্রহ্মমূলে
এখন কেমনে সে বিষ নামাই,
সে বিষ গাঁঠরি করা
না যায় হরা,
কি করিবে কবিরাজ গোঁসাই।
মন জেনে ধন দিতে যে পারে,
কে আছে এই ভাব-নগরে
কার কাছে এই প্রাণ জুড়াই,
যদি গুরু দয়াময়
এই অনল নিভায়,
লালন বলে, কেবল সেই তার উপায়।
আমার হয় না রে
আমার হয় না রে সে
মনের মত মন,
আমি জানবো কি সে
রাগের কারণ।
পড়ে রিপু ইন্দ্রিয় ভোলে
মন বেড়ায় রে ডালে আলে,
দুই মনে এক মন হইলে
এড়াই শমন।
রসিক ভক্ত যারা
মনে মনে মিশালো তারা,
এবার শাসন করে তিনটি ধারা
পেল রতন।
কিসে হবে নাগিনী বশ
সাধব কবে অমৃত-রস,
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয়
বিষে বিনাশ হ’লি লালন।
আমারে কি রাখবেন গুরু
আমারে কি রাখবেন গুরু চরণদাসী,
ইতরপনা কার্য আমার ঘটে অহর্নিশি।
জঠর যন্ত্রণা পেয়ে
এসেছিলাম করাল দিয়ে,
সে সকল গিয়েছি ভুলে ভবেতে আসি।
চিনলাম না সে গুরু কি ধন
জানলাম না তার সেবা সাধন,
ঘুরতে বুঝি হলো রে মন আবার চৌরাশি।
গুরুরূপ যার বাঁধা হৃদয়
শমন বলে তার কিসের ভয়,
লালন বলে মন তুই আমায় করিলি দোষী।
আমায় চরণ ছাড়া কোরো না
আমায় চরণ ছাড়া
কোরো না হে দয়াল হরি,
পাপ করি পামরা বটে
দোহায় দিই তোমারি।
অনিত্য সুখে সর্ব ঠাঁই,
তাই দিয়ে জীব ভোলাও গো সাঁই,
তবে কেন চরণ দিতে
করো হে চাতুরি।
চরণের ঐ যোগ্য মন নয়,
তথাপি মন রাঙা চরণ চায়,
দয়াল চাঁদের দয়া হ’লে
যেত অসুখ সারি।
ক্ষম অধীন দাসের অপরাধ
শীতল চরণ দাও হে দীননাথ,
লালন বলে ঘুরাইও না
হে মায়াচারী।
আমায় পার করো ভবের ঘাটে
এসো দয়াল,
আমায় পার করো ভবের ঘাটে,
দেখে ভবনদীর তুফান
ভয়ে প্রাণ কেঁপে ওঠে।
সাধনার বল যাদের ছিলো
তারাই কূল-কিনারা পেলো,
আমার দিন কাজেই গেলো
কি জানি হয় ললাটে।
পাপ পুণ্য যতই করি
ভরসা কেবল তোমারি,
তুমি যার হও কাণ্ডারী
ভবভয় তার যায় ছুটে।
পুরাণে শুনেছি খবর
পতিতপাবন নাম তোর,
লালন বলে আমি পামর
তাইতে দোহাই দিই বটে।
আমি অপার হয়ে
আমি অপার হয়ে বসে আছি,
ওহে দয়াময়।
পারে, লয়ে যাও আমায়,
পারে, লয়ে যাও আমায়।
আমি একা রইলাম ঘাটে,
ভানু সে বসিল পাটে,
আমি তোমা বিনে ঘোর-সংকটে,
না দেখি উপায়।
লয়ে যাও আমায়,
পারে, লয়ে যাও আমায়।
নাই আমার ভজন-সাধন,
চিরদিন কুপথে গমন।
আমি নাম শুনেছি পতিত-পাবন,
তাইতে দেই দোহাই।
লয়ে যাও আমায়,
পারে, লয়ে যাও আমায়।
অগতির না দিলে গতি,
ওই নামে রবে অখ্যাতি,
ফকির লালন কয় অকুলের পতি,
কে বলবে তোমায়।
লয়ে যাও আমায়,
পারে, লয়ে যাও আমায়।
আমি আর কি বসবো
আমি আর কি বসবো
এমন সাধুর সাধবাজারে,
না জানি কোন সময়
কোন দশা ঘটে আমারে।
সাধুর বাজার কি আনন্দময়
অমাবস্যায় পূর্ণচন্দ্র-উদয়,
আছে ভক্তি-নয়ন যার, সে চাঁদ দৃষ্ট তার
ভববন্ধন জ্বালা যায় গো দূরে।
দেবের দুর্লভ পদ সে
সাধুনাম তাঁর শাস্ত্রে ভাসে,
মা গঙ্গাজননী পতিতপাবনী
সাধুর চরণ সেও বাঞ্ছা করে।
আমি দাসের দাস তাঁর দাসযোগ্য নই
কোন ভাগ্যে এলাম এই সাধসভায়,
ফকির লালন বলে মোর ভক্তিহীন অন্তর
এবার বুঝি প’লাম কদাচারে।
আমি ওই চরণের দাসের যোগ্য নই
আমি ওই চরণের দাসের যোগ্য নই,
নইলে মোর দশা কি এমন হয়।
তুমি নিজগুণে পদার বিন্দু দেন যদি সাঁই দীনবন্ধু,
তবেই তরি ভবসিন্ধু নইলে না দেখি উপায়।
ভাব জানি নে, প্রেম জানি নে, দাসী হতে চাই চরণে,
ভাব দিয়ে ভাব নিলে ‘পরে সেই সে রাঙাচরণ পাই।
অহল্যা পাষাণী ছিল, চরণধূলায় মানবী হইল,
ফকির লালন পথে পড়ে রইল, যা করেন সাঁই দয়াময়।
আমি কাঙাল দয়াল গুরু
তোমার নামের সুধা পান করিয়া
মত্ত থাকি সর্বদাই,
আমি কাঙাল দয়াল গুরু আমার
মন তো কাঙাল নয়।
শুনেছি হে তুমি নাকি
বড়ো দয়াময়,
তোমার কৃপা না হইলে কারো
চলবার শক্তি নাই,
একটা পাথরের ভিতরে ক্রিয়া পোকা
আহার যোগায় সর্বদাই।
যে যা মনে বাঞ্ছা করে
দয়াল গুরু কৃপা করে,
ভক্তি যার থাকে
হবে রে ফল, নয় রে বিফল
গুরু গোসাঁই-র কৃপা হয়।
গেল বেলা, জপ হরিনামের মালা
হবেরে ফল নয়রে বিফল
গুরু গোসাঁই-র কৃপা হয়।
লালন বলে এসে দুনিয়ায়,
দুখে-দুখে জনম গেল, দয়াল
করি কি উপায়,
আজ দুখ-নিবারণ করবে যে জন
শরণ লও গুরুর রাঙা পায়।
আমি কী দোষ দিব
আমি কী দোষ দিব কারে রে,
আপন মনের দোষে আমি
পড়লেম রে ফেরে।
সুবুদ্ধি-সুস্বভাব গেল
কাকের স্বভাব মনে হলো,
ত্যেজিয়া অমৃত ফল
মাকাল ফলে মন মজিল রে।
যে আশায় এ ভবে আসা
ভাঙিল রে আশার বাসা,
ঘটিল রে কি দুর্দশা
ঠাকুর গড়িতে বানর হলো রে।
গুরুবস্তু চিনলি নে মন
অসময়ে কি করবি তখন,
বিনয় করে বলছে লালন
আমার যজ্ঞের ঘৃত কুত্তায় খেল রে।
আমি দেখিলাম এ সংসার
আমি দেখিলাম এ সংসার ভোজবাজী প্রকার
দেখিতে দেখিতে অমনি কে বা কোথা যায়,
মিছে এ ঘরবাড়ি মিছে ধন-টাকাকড়ি
মিছে দৌড়াদৌড়ি করি কার মায়ায়।
কীর্তিকর্মার কীর্তি কে বুঝতে পারে
সে বা জীবকে কোথায় লয়ে যায় ধ’রে,
এ কথা আর শুধাব কারে
নিগুঢ়তত্ত্ব অর্থ কে বলবে আমায়।
যে করে এই লীলে তারে চিনলাম না
আমি-আমি বলি ভবে, আমি কোনজনা,
মরি এ কি আজব কারখানা
গুনে পড়ে কিছু ঠাহর নাহি পাই।
ভয় ঘোচে না আমার দিবারজনী
কার সাথে কোন দেশে যাবো না জানি,
সিরাজ সাঁই কয় বিষম কারগুণই
পাগল হয় রে লালন যথায় বুঝতে চায়।
আমি যদি গৌর চাঁদকে পাই
আমি যদি গৌর চাঁদকে পাই,
গেল-গেল এ চার কুল
তাতে ক্ষতি নাই।
কি ছার কূলের গৌরব করি
অকূলের কূল গৌর হরি,
এ ভব তরঙ্গে তরী
গৌর গোঁসাই।
জন্মিলে মরিতে হবে
কুল কি কা’র সঙ্গে যাবে,
মিছে কেবল দুই দিন ভবে
কুলেরই বড়াই।
ছিলাম কূলের কূলবালা
স্কন্ধে লয়ে আছলা ঝোলা,
লালন বলে গৌর বালা
আর কারে ডরাই।
আর আমারে মারিস নে মা
আর আমারে মারিস নে মা,
বলি মা তোর চরণ ধ’রে
ননী চুরি আর করবো না।
ননীর জন্যে আজ আমারে
মারলি মাগো বেঁধে ধ’রে,
দয়া নাই মা তোর অন্তরে
স্বল্পেতে গেলো জানা।
পরে মারে পরের ছেলে
কেঁদে যেয়ে মাকে বলে,
সেই মা জননী নিঠুর হলে
এখন কে বোঝে শিশুর বেদনা।
ছেড়ে দে মা হাতের বাঁধন
যাই যেদিকে যায় দুই নয়ন,
পরের মাকে ডাকবো এখন
তোর গৃহে আর থাকবো না।
যে না বোঝে ছেলের বেদন
সেই ছেলের মা’র বৃথা জীবন,
বিনয় করে বলছে লালন
কাঁদছে সে ক’রে করুণা।
আর কত কাল রইবি রঙ্গে
আর কত কাল রইবি রঙ্গে
বাড়িতেছে বেলা, ধর এই বেলা,
যদি বাঁচতে চাও তরঙ্গে।
নিকটে বিকটে বেশেতে শমন
দাঁড়াইয়া আছে হরিতে জীবন,
মানিবে না কারে, কেশে ধরে তোরে
লয়ে যাবে সে জন আপন সঙ্গে।
দারাসূত-আদি যত প্রিয়জনে
বক্ষমাঝে যাদের রাখতে সর্বক্ষণে,
আমার-আমার বলো বারেবার
তখন হেরিবে না কেহ অপাঙ্গে।
অতএব শোন থাকিতে জীবন
করো অন্বেষণ পতিতপাবন,
সিরাজ সাঁই কয়, শোন রে লালন
বাঁচো এখন পাপ আতঙ্কে।
আর কত দিন জানি
আর কত দিন জানি,
এ অবলার প্রাণই,
এ জ্বলনে জ্বলিবে
ওহে দয়েশ্বর চিরদিনই,
দুঃখেরই অনলে প্রাণ
জ্বলিছে আমার চিরদিনই।
দাসী ম’লে ক্ষতি নাই
যাই হে, মরে যাই,
তোমার দয়াল নামের দোষ
রবে রে গোঁসাই,
আমায় দাও হে দুঃখ যদি
তবু তোমার সাধি,
তোমা ভিন্ন দোহাই
আর দিব কার, চিরদিনই।
ও মেঘ হইয়ে উদয়
লুকালে কোথায়,
পিপাসীর প্রাণ
যায় পিপাসায়।
আমার কি দোষেরই ফলে
এই দশা ঘটাইলে,
চাও হে নাথ ফিরে এখন
চাও হে একবার, চিরদিনই।
আমি উড়ি হাওয়ার সাথ
ধরি তোমার হাত,
তুমি না করাইলে
কে করাবে হে নাথ।
আমার ক্ষমো অপরাধ
দাও হে ওই শীতল পদ,
লালন বলে প্রাণে
সহে না আমার, চিরদিনই।
আর কি হবে মানব জনম
হেলায় হেলায় দিন বয়ে যায়
আর ঘিরে নিলো কালে,
আর কি হবে মানব জনম
আমি বসব সাধু মিলে।
কত শত লক্ষ যোনি
ভ্রমণ করেছো জানি,
মানব কূলে মন রে তুমি
এসে কি করিলে।
মানব জনমের আশায়
কত দেব-দেবতায় বঞ্চিত হয়,
হেন জনম দীন-দয়াময়
দিয়েছ কোন ফলে।
ভুলো না রে মন বাসনা
সমঝে করো বেচা কেনা,
লালন বলে কূল পাবে না
এবার ঠকে গেলে।
আরশিনগর
বাড়ির কাছে আরশিনগর,
সেথা পড়শি বসত করে,
একঘর পড়শি বসত করে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
বাড়ির কাছে আরশিনগর,
সেথা পড়শি বসত করে,
একঘর পড়শি বসত করে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
গেরাম বেড়ে অগাধ পানি,
নাই কিনারা, নাই তরণী পারে,
বাঞ্ছা করি দেখব তারে,
দয়াল, কেমনে সেথায় যাই রে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
কি বলব পড়শির কথা,
হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মাথা নাইরে,
ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর,
ও সে ক্ষণেক ভাসে নীড়ে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
পড়শি যদি আমায় ছুঁত,
যম-যাতনা সকল যেত দূরে,
সে আর লালন একখানে রয়,
তবু, লক্ষ যোজন ফাঁক রে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
আল্লাহ্, কে বোঝে
আল্লাহ্, কে বোঝে তোমার
অপার লীলে,
তুমি আপনি আল্লাহ্,
ডাকো আল্লাহ্ ব’লে।
নিরাকারে তুমি নূরী
ছিলে ডিম্ব অবতারী,
সাকারে সৃজন করলে ত্রিভুবন
সে আকারে চমৎকার ভাব দেখালে।
নিরাকার নিগুম ধ্বনি,
তাও তো সত্য সবাই জানি,
তুমি আগমের ফুল নিগমে রসুল
সে যে আদমের ধড়েতে’ জান হইলে।
আত্মতত্ত্ব জানে যারা
সাঁইর নিগূঢ় লীলা দেখছে তারা,
তুমি নীরে নিরঞ্জন অকৈতব যে জন
ফকির লালন খুঁজে বেড়ায় বনে-জঙ্গলে।
আল্লাহ্ বলো মন রে
আল্লাহ্ বলো মন রে পাখি।
ভবে কেউ কারো নয় দুঃখের দুখী।।
ভুলো না রে ভব ভ্রান্ত কাজে
আখেরে এসব কান্ড মিছে।
মন রে আসতে একা যেতে একা
এ ভব পিরিতের ফল আছে কি।।
হওয়া বন্ধ হলে সুবাদ কিছুই নাই
বাড়ির বাহির করেন সবাই।
মন তোর কেবা আপন পর কে তখন
দেখে শুনে খেদে ঝরে আঁখি।।
গোরের কিনারে যখন লয়ে যায়
কাঁদিয়ে সবাই প্রাণ ত্যাজতে চায়।
ফকির লালন বলে,
কারো গোরে কেউ না যায়
থাকতে হয় একাকী ।।
আয় কে যাবি ওপারে
আয় কে যাবি ওপারে,
দয়াল চাঁদ মোর দিচ্ছে খেয়া
অপার সাগরে।
যে দিলো তাঁর নামের দোহাই
তারে দয়া করিলেন সাঁই,
এমন দয়াল আর দেখি নাই
এই ভব মাঝারে।
পার করে সে জগৎ-বেড়ি
নেয় না কারোর পয়সাকড়ি,
সেরে সুরে মনের দেড়ি
ভার দেনা রে, তারে।
ঐ চরণে দিয়ে রে ভার
কত পাপী হইল পার,
সিরাজ সাঁই কয়, লালন তোমার
মনের বিকার যায় না রে।
আশা পূর্ণ হলো না
আশা পূর্ণ হলো না
আমার মনের বাসনা,
ভজন-সাধন করবো ব’লে
বাঁধি রিপু ছয়জনা।
বিধাতা সংসারের রাজা
আমায় করে রাখলেন প্রজা,
কর না দিলে দেয় গো সাজা
কারো দোহাই মনে না।
বাঞ্ছা করি যুগল পদে
সাধ মিটাবো ওই পদ সেধে,
বিধি বৈমুখ হল তাতে
দিলো সংসার যাতনা।
পড়ে গেলাম বিধির বামে
আমার ভুল হলো যে মূল সাধনে,
ফকির লালন বলে শেষ নিদানে
মুর্শিদ ফেলে যেও না।
ইতরপনা
মন তুই করলি একি ইতরপনা,
দুগ্ধেতে যেমন রে তোর মিশিলো চোনা।
শুদ্ধরাগে থাকতে যদি
হাতে পেতে অটলনিধি,
বলি মন তাই নিরবধি বাগ মানে না,
মন তুই করলি একি ইতরপনা।
কি বৈদিকে ঘিরলো হৃদয়,
হইলো না সুরাগের উদয়
নয়ন থাকিতে সদাই হলি রে কানা,
মন তুই করলি একি ইতরপনা।
পাপের ধন তোর খেলো সর্পে
জ্ঞানচক্ষু নাই দেখবি কবে,
ফকির লালন বলে হিসাব কালে
যাবে রে জানা,
মন তুই করলি একি ইতরপনা।
এ গোকুলে শ্যামের প্রেমে
এ গোকুলে শ্যামের প্রেমে
কে বা না মজেছে সখী,
কারো কথা কেউ বলে না
আমি একা হই কলঙ্কী।
অনেকে তো প্রেম করে
এমন দশা ঘটে কারে,
গঞ্জনা দেয় ঘরে পরে
শ্যামের পদে দিয়ে আঁখি।
তলে তলে তলগোঁজা খায়
লোকের কাছে সতী কওলায়,
এমন সৎ অনেক পাওয়া যায়
সদর যে হয় সেই পাতকী।
অনুরাগী রসিক হলে
সেকি ডরায় কুল নাশিলে,
লালন বেড়ায় ফুচকি খেলে
ঘোমটা দিয়ে চায় আড়চোখী।
এই দেশেতে এই সুখ হলো
এই দেশেতে এই সুখ হলো
আবার কোথা যাই না জানি,
পেয়েছি এক ভাঙা তরী
জনম গেল সেঁচতে পানি।
আমি বা কার, কে বা আমার
প্রাপ্ত বস্তু ঠিক নাই তার,
বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার
উদয় হয় না দিনমণি।
আর কি রে এই পাপীর ভাগ্যে
দয়াল চান্দের দয়া হবে,
কতদিন এই হালে যাবে
বহিতে পাপের তরণী।
কার দোষ দেবো এ ভুবনে
হীন হয়েছি ভজন-বিনে,
লালন শাহ কয়, কতদিনে
পাব সাঁই-র চরণ দুখানি।
এই বেলা তোর ঘরের খবর
এই বেলা তোর ঘরের খবর
জেনে নে রে মন,
ঘরের কে বা ঘুমায়, কে বা জাগে
কে কারে দেখায় স্বপন।
শব্দের ঘরে কে বারাম দেয়
নি:শব্দে কে আছে সদাই,
যেদিন হবে মহাপ্রলয়
কে কারে করবে দমন।
দেহের গুরু হয় কে বা
শিষ্য হয়ে কে দেয় সেবা,
যেদিন তাহা জানতে পাবা
কুলের ঘোর যাবে তখন।
যে ঘরামি ঘর বেঁধেছে
কোনখানে সে বসে আছে,
সিরাজ সাঁই কয় তাই না বুঝে
দিন তো বয়ে যায় লালন।
এই মানুষে সেই মানুষ আছে
এই মানুষে সেই মানুষ আছে,
কত মুনি-ঋষি যোগী-তপস্বী
তারে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়
ধরতে গেলে কে হাতে পায়,
আলেক মানুষ আছে সদাই
আলে বসে।
অচিন দলে বসতি যার
দ্বিদল পদ্মে বারাম তার,
দল নিরূপণ হবে যাহার
সে রূপ দেখবে অনাসে।
আমার হলো বিভ্রান্ত মন
আমি বাইরে খুঁজি ঘরেরই ধন,
সিরাজ সাঁই কয়, ঘুরবি লালন
আত্মতত্ত্ব না বুঝে।
এক ফুলে চার রঙ
এক ফুলে চার রঙ ধরেছে,
সে ফুলে ভাব নগরে
কি শোভা করেছে।
মূল ছাড়া সেই ফুলের লতা
ডাল ছাড়া তার আছে পাতা,
এ বড় অকৈতব কথা
কে শুনাবে কই কার কাছে।
কারণবারির মধ্যে সে ফুল
ভেসে বেড়ায় এ-কূল ও-কূল,
শ্বেতবরণ এক ভ্রমর ব্যাকুল
সেই ফুলের মধুর আশে।
ডুবে দেখ মন দিল-দরিয়ায়
যে ফুলে নবির জন্ম হয়,
সে ফুল তো সামান্য ফুল নয়
লালন কয় তার নাই মূল দেশে।
এক ফুলের মর্ম
এক ফুলের মর্ম জানতে হয়,
যে ফুলে অটল বিহারে
শুনতে লাগে বিষম ভয়।
ফুলে মধু প্রফুল্লতা
ফলে তার অমৃত সুধা,
এমন ফুল দুনিয়ায় পয়দা
জানিলে দুর্গতি যায়।
চিরদিন সেই যে ফুল
দীন-দুনিয়ার মকবুল,
যাতে পয়দা দীনের রসুল
সে ফুল তো সামান্য নয়।
জন্মপথে ফুলের ধ্বজা
ফুল ছাড়া নাই গুরুপূজা,
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয়,
এ ভেদ বোঝা
লালন ভেঁড়োর কার্য নয়।
একবার জগন্নাথে দেখ যেয়ে
একবার জগন্নাথে দেখ যেয়ে
ও জাত কেমনে রাখবি বাঁচিয়ে,
চণ্ডালে রাঁধিছে অন্ন
ব্রাহ্মণেই তা চায় খেয়ে।
জোলা ছিল কুবীর দাস,
তার পুরানি বারোমাস
ওঠে যে উথলিয়ে,
সেই পুরানি গায় যে ধ্বনি
সে আসে দর্শন পেয়ে।
ধন্য প্রভু জগন্নাথ,
চায় না রে জাত-অজাত
ভক্তের অধীনেই থাকে,
যতসব জাতবিচারী দুরাচারী
তারাই যায় সব দূর হয়ে।
জাত না গেলে পাই না হরি
কি ছার জাতের গৌরব করি,
ছুঁস না বলিয়ে,
লালন কয় জাত হাতে পেলে
পোড়াতাম আগুন দিয়ে।
এমন সৌভাগ্য আমার
এমন সৌভাগ্য আমার কবে গো হবে,
দয়াল চাঁদ আসিয়া মোরে পার করিবে।
সাধন-ভজন আমাতে নাই
আমি কেমনে সেই পারে যাই,
কূলে বসে দিচ্ছি দোহাই অপার ভেবে।
পতিতপাবন নামটি তোমার
তাই শুনে বল হয় গো আমার,
আবার ভাবি এ পাপীর ভার সে কি নেবে।
গুরুপদে ভক্তিহীন
আমি হয়ে রইলাম চিরদিন,
ফকির লালন বলে কী করিতে এলাম ভবে।
এসো হে অপারের কান্ডারী
এসো হে অপারের কান্ডারী,
পড়েছি অকূল পাথারে
দাও আমায় চরণতরী।
প্রাপ্ত পথ ভুলে হে এবার
ভবরোগে ভুগবো কত আর,
তুমি নিজগুণে শ্রীচরণ দাও
তবেই কূল পেতে পারি।
ছিলাম কোথায় এলাম হেথায়
আবার আমি যাই যেন কোথায়,
তুমি মনোরথের সারথি হয়ে
স্বদেশে নাও মনেরই।
পতিতপাবন নাম তোমার গো সাঁই
পাপী-তাপী তাইতে দেয় দোহাই,
ফকির লালন বলে তোমা বিনে
ভরসা কারে করি।
এসো হে প্রভু নিরঞ্জন
এসো হে প্রভু নিরঞ্জন,
এ ভব তরঙ্গ দেখে
আতঙ্কেতে যায় জীবন।
তুমি ভক্তি, তুমি মুক্তি
অনাদির আদ্যশক্তি,
দাও হে আমার ভক্তির শক্তি
যাতে তৃপ্ত হয় ভবজীবন।
ধ্যানযোগে তোমারে দেখি
তুমি সখা আমি সখী,
মম হৃদয় মন্দিরে থাকি
দাও ঐ রূপ দরশন।
ত্রিগুণে সৃজিলেন সংসার
লীলা দেখে কয় লালন তার,
সিদরাতুল মুনতাহায়
যেন গোলামেরই হয় আসন।
ও দয়াল গুরু গো
ও দয়াল গুরু গো,
মনের দুখ আর বলা গেল না,
ও দুখ বলতে গেলে, না যায় বলা
মন-তলায় জল মানে না।
দশে ইন্দ্রিয় রিপু ছয়জনা,
ছয়জনা ছয় মতে চলে গুরু
নিষেধ মানে না,
তাঁরা সদাই চলে কুপথে মন
সুপথে আর চলে না।
এক ঘরেতে বসত করি মন,
আপনারে পর ভাবিয়া
কাটাইলাম জনম,
এসে এই বিদেশে পরবাসে
আপনারে চিনলাম না।
এখন আমি কার ছায়ায় দাঁড়াই,
তুমি বিনে ও গুরু গো
আর তো কেহ নাই,
এসে দয়া ক’রে মনমোহন কে
দাও যদি চরণ খানা।
কই হল মোর মাছ ধরা
কই হল মোর মাছ ধরা,
চিরদিন ধাপ ঠেলিয়ে
হলাম আমি বল সারা।
একে যাই ধেপো বিলি
তাতে হল ঠেলা জালি,
ওঠে শামুকের ভারা।
শুভ যোগ না পেলে
সে মাছ বলে,
হয় না কভু ক্ষার ছাড়া।
কেউ বলা-কওয়া করে
মাছ ধরতে যাই প্রেম সাগরে,
যে নদীর হয় তিন ধারা।
আমি মরতে গেলাম সেই নদীতে
খাটল না খ্যাপলা-ক্ষরা।
যেজন ডুবারু ভাল
মাছের ক্ষার সেই চিনিল,
তাদের সিদ্ধি হল যাত্রা।
আমি লালন ধাপ ঠেলা পাট
সার হল মোর লাল পড়া।
কবে সাধুর চরণধূলি
কবে সাধুর চরণধূলি মোর লাগবে গায়
আমি বসে আছি আশাসিন্ধুর তীরে সদাই।
চাতক যেমন মেঘের জল বিনে
অহর্নিশি চেয়ে থাকে মেঘ-ধেয়ানে,
ও তার তৃষ্ণায় মৃত্যু গতি জীবনে
হলো সেই দশা আমার।
ভজন-সাধন আমাতে নাই
কেবল মহৎ নামের দিই গো দোহাই,
তোমার নামের মহিমা জানাও গো সাঁই
পাপীর হও সদয়।
শুনেছি সাধুর করুণা
সাধুর চরণ পরশিলে লোহা হয় সোনা,
বুঝি, আমার ভাগ্যে তাও হইল না
ফকির লালন কেঁদে কয়।
কবে হবে সজল বরষা
কবে হবে সজল বরষা
আমি চেয়ে আছি সেই ভরসা,
আমার এই আধলা দশা
ঘুচবে কতদিন পরে।
এবার যদি না পাই চরণ
আবার কি পড়ি ফেরে,
আমায় রাখিলেন সাঁই কূপজল করে
আন্দেলা পুকুরে।
নদীর জল কূপজল হয়
বিল কিংবা বাওড়ে রয়,
সাধ্য কি সে গঙ্গাতে যায়
গঙ্গা না এলে পরে,
দয়াল জীবের তেমনি ভজন বৃথা
তোমার দয়া নাই যারে।
যন্তর পড়িয়ে অন্তর
রয় যদি কেউ লক্ষ বছর,
যন্ত্র কভু বাজতে না পারে
দয়াল যন্ত্রী বিহনে,
আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী
সুবোল ধরাও আমারে।
পতিতপাবন নামটি
শাস্ত্রে শুনেছি খাঁটি,
পতিত না তরাও যদি
কে ডাকবে ঐ নাম ধরে,
ফকির লালন বলে তরাও গো সাঁই
এই ভব-কারাগারে।
করি কেমনে সহজ শুদ্ধ
প্রেম সাধিতে ফাঁপরে উঠে
কামনদীর তুফান।
প্রেম-রত্নধন পাবার আশে
ত্রিবেণীর ঘাট বাঁধলাম কষে,
কামনদীর এক ধাক্কা এসে
কেটে যায় বাঁধন।
বলবো কি সে প্রেমের কথা
কাম হয়েছে প্রেমের লতা,
কাম ছাড়া প্রেম যথাতথা
নয় সে আগমন।
পরম গুরু প্রেমপ্রকৃতি
কাম গুরু হয় নিজ পতি,
কাম ছাড়া প্রেম পায় কি গতি
ভেবে কয় লালন।
করি মানা কাম ছাড়ে না
করি মানা, কাম ছাড়ে না মদনে
আমি প্রেম-রসিকা হব কেমনে।
এই দেহেতে মদন রাজা করে যে কাচারি
কর আদায় করে নিয়ে যায় হুজুরি,
মদন তো দুষ্ট ভারি, তারে দাও তহশিলদারি
করে সে মুনশীগিরি গোপনে।
চোর দিয়ে চোর ধরাধরি এ কী কারখানা
আমি তাই জিজ্ঞাসিলে তুমি বলো না,
সাধু থাকে চেতন ঘরে, চোর সব পালায় ডরে
নইলে চোর নিয়ে যাবে কোনখানে।
অধীন লালন বিনয় করে সিরাজ সাঁইজীর পায়
স্বামী মারিলে লাথি নালিশ জানাব কোথায়,
তুমি মোর প্রাণপতি, কি দিয়ে রাখবো রতি
কেমনে হব সতী চরণে।
কলিতে পয়দা হয়েছে
জিকির ছেড়ে হলাম ফকির
ওরে কোপনি করলাম সার
আবার বাবার পেটে মায়ের জন্ম
দুধ খাবি তুই কার ?
বাবা কি শুনাইলি আব্বা
কলিতে পয়দা হয়েছে ।
দিল দরিয়ার মাঝেরে ভাই
একটা সর্প রয়েছে,
আবার সর্পের মাথায়
একটা ব্যাঙে নৃত্য করতেছে।
দিল দরিয়ার মাঝে একটা
ও ভাই ডিম্ব রয়েছে ,
সেই ডিমের ভিতর ছয়টা ছানা
বসত করতেছে।
সকালবেলা লও সম্বন্ধ
দুপুরবেলায় বিয়ে,
আবার সাঁঝের বেলায়
বউটা এলো ছেলে কোলে নিয়ে।
সাগরে জল নাই
বাজারে মারে ঢেউ,
বাবার যখন হয় নাই বিয়ে
ছেলের কোলে বউ।
কানার হাট বাজার
বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা
আর এক কানা মন আমার,
এসব দেখি কানার হাট বাজার।
এক কানা কয় আর এক কানারে
চল এবার ভবপারে,
নিজে কানা পথ চেনে না
পরকে ডাকে বারংবার।
পণ্ডিত কানা অহংকারে
মাতবর কানা চোগলখোরে,
সাধু কানা অন বিচারে
আন্দাজে এক খুঁটি গাড়ে,
চেনে না সীমানা কার।
কানায় কানায় উলামিলা
বোবাতে খায় রসগোল্লা,
তেমনি লালন মদনা কানা
ঘুমের ঘোরে দেয় বাহার।
কারে দিব দোষ
কারে দিব দোষ, নাহি পরের দোষ
মনের দোষে আমি পড়লাম রে ফেরে,
আমার মন যদি বুঝিত, লোভের দেশ ছাড়িত
লয়ে যেত আমায় বিরজা পারে।
মনের গুণে কেহ হইল মহাজন
ব্যাপার ক’রে পেল অমূল্য রতন,
আমারে ডুবালি, ওরে অবোধ মন
এখন পারের সম্বল কিছুই না পেলাম করে।
একদিন ভাবলে না অবোধ মনুরায়
ভেবেছ কি দিন এমনি বুঝি যায়,
অন্তিম কালের কালে কি না জানি হয়
সকল জানা যাবে যেদিন শমনে ধরে।
কামে চিত্ত-হত মন রে আমার
সুধা ত্যেজে গরল খায় সে বেশুমার,
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয়, লালন রে তোমার
ভগ্নদশা বুঝি ঘটলো আখেরে।
কাল কাটালি কালের বশে
কাল কাটালি কালের বশে
এ যে যৌবন কাল কামে চিত্ত কাল
কোন কালে তোর হবে দিশে।।
যৌবনকালের কালে রঙে দিলি মন
দিনে দিন হারা হলি পিতৃ ধন।
গেল রবির জোর আঁখি হলো ঘোর
কোনদিন ঘিরবে মহাকাল এসে।।
যদের সঙ্গে রঙে মেতে র’লি চিরকাল
কালাকালে তারাই হলো কাল।
জান না কার কি গুণপনা
ধনীর ধন গেল সব রিপুর বশে।।
বাদী ভেধী বিবাদী সদাই
সাধন সিদ্ধি করিতে না দেয়।
নাটের গুরু হয় লালস মহাশয়
ডুরি দাও রে লালন লোভ লালসে।।
কি করি কোন পথে যাই
কি করি কোন পথে যাই
মনে কিছু ঠিক পড়ে না,
দোটানাতে ভাবছি বসে
ঐ ভাবনা।
কেউ বলে মক্কায় গিয়ে
হজ করিলে যাবে গুনাহ,
কেউ বলিছে মানুষ ভজে
মানুষ হ’না।
কেউ বলে পড়লে কালাম
পায় সে আরাম বেহেস্তখানা,
কেউ বলে এ সুখের ঠাঁই
স্থায়ী রয় না।
কেউ বলে মুরশিদের ঠাঁই
খুঁজিলে পাই আদি ঠিকানা,
না বুঝে লালন ভেড়ে
হয় দোটানা।
কি সন্ধানে যাই সেখানে
কি সন্ধানে যাই সেখানে
মনের মানুষ যেখানে,
আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি
দিবা রাতি নাই সেখানে।
যেতে পথে কাম নদীতে
পাড়ি দিতে ত্রিবিনে,
কতো ধনীর ভারা যাচ্ছে মারা
পরে নদীর তোড় তুফানে।
রসিক যারা চতুর তারা
তারাই নদীর ধারা চেনে,
উজান তরী যাচ্ছে বেয়ে
তারাই স্বরূপ সাধন জানে।
লালন বলে ম’লাম জ্বলে
দিবানিশি জলে-স্থলে,
আমি মণিহারা ফণীর মতো
হারা হইলাম পিতৃধনে।
কৃষ্ণ প্রেমে পোড়া দেহ
কৃষ্ণ প্রেমে পোড়া দেহ,
কি দিয়ে জুড়াই বলো সখী?
কে বুঝবে অন্তরের জ্বালা,
কে মোছাবে আঁখি?
যে দেশেতে আছে আমার বন্ধু চাঁদ-কালা,
সে দেশেতে যাব নিয়ে, ফুলের মালা,
নগর গাঁয়ে ঘুরব আমি, যোগিনী বেশ ধরি।
তোমরা যদি দেখে থাক, খবর দিও তারে,
নইলে আমি প্রাণ ত্যাজিব যমুনারই নীড়ে।
কালা আমায় করে গেল, অসহায় একাকী।
কালাচাঁদ কে হারাইয়ে, হলাম যোগিনী,
কত দিবা নিশি গেল, কেমনে জুড়াই আঁখি?
লালন বলে যুগল চরণ, আমার ভাগ্যে হবে কি?
কে তোমার আর যাবে সাথে
কোথায় রবে এ ভয় বন্ধু
পড়বে যেদিন কালের হাতে,
কে তোমার আর যাবে সাথে।
নিকাশের দায় ক’রে খাড়া
মারবে রে ও দোষের গোড়া,
সোজা করবে ব্যাঁকা-ত্যাড়া
জোর জবর খাটবে না তাতে।
যে আশাতে ভবে আসা
হলো না তার রতিমাসা,
ঘটালি মন কী দুর্দশা
কু-রসে কু-সঙ্গে মেতে।
যারে ধ’রে পাবি নিস্তার
তারে সদাই ভাবলি রে পর,
সিরাজ সাঁই কয় লালন তোমার
ছাড়ো ভবের কুটুম্বিতে।
কে তোমারে এ বেশ-ভূষণ
কে তোমারে এ বেশ-ভূষণ
পরাইলো বলো শুনি,
জিন্দা দেহে মরার বসন
খিলকা তাজ আর ডোর কোপিনী।
জিন্দা মরার পোশাক পরা
আপন সুরত আপনি সারা,
ভবলোককে ধ্বংস করা
দেখি অসম্ভব করণী।
যে মরণের আগে মরে
শমনে ছোঁবে না তারে,
শুনেছি সাধুর দ্বারে
তাই বুঝি করেছে ধ্বনি।
সেজেছ সাজ ভালই তরো
ম’রে যদি ডুবতে পারো,
লালন বলে যদি ফেরো
দুকূল হবে অপমানি।
কে বানাইলো এমন রঙমহলখানা
কে বানাইলো এমন রঙমহলখানা
হাওয়া দমে দেখ তারে আসল বেনা।
বিনা তেলে জ্বলছে বাতি
দেখতে যেমন মুক্তা মোতি,
ঝলক দেয় তার চতুর্ভিতি, মধ্যেখানা।
তিল পরিমাণ জায়গা সে যে
হদ্দরূপ তাহার মাঝে,
কালায় শোনে, আঁধলায় দেখে ল্যাংড়ার নাচনা।
যে বানাইলো এ রঙমহল
না জানি তার রূপটি কেমন,
সিরাজ সাঁই কয়, নাই রে লালন, তার তুলনা।
কেন জিজ্ঞাসিলে খোদার কথা
আছেন কোথায় স্বর্গপুরে
কেউ নাহি সন্ধান জানে,
কেন জিজ্ঞাসিলে খোদার কথা
দেখায় আসমানে?
পৃথিবী গোলাকার শুনি
অহর্নিশি ঘোরে আপনি,
তাইতে হয় দিন-রজনী,
জ্ঞানী-গুণী তাই মানে।
আর একদিকে নিশি হলে
অন্যদিকে দিবা বলে,
আকাশতো দেখে সকলে
খোদা দেখে কয়জনে?
আপন ঘরে কে কথা কয়
না জেনে আসমানে তাকায়,
লালন বলে কে বা কোথায়
বুঝিবে বিশ্বজ্ঞানে।
কেন মরলি রে মন
কেন মরলি রে মন ঝাঁপ দিয়ে
তোর বাবার পুকুরে,
দেখি কামে চিত্ত
পাগলপ্রায় তোরে।
কেন রে মন এমন হলি
যাতে জন্ম তাতেই ম’লি,
ঘুরতে হবে লক্ষ গলি
হাতে-পায়ে বেড়ি সার করে।
দীপের আলো দেখে যেমন
উড়ে পড়ে পতঙ্গগণ,
অবশেষে হারায় জীবন
মন আমার তাই করলি আরে।
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয়
শক্তিরূপে ত্রিজগতময়,
লালন ফকির বুদ্ধি হারায়
আত্মতত্ত্ব না সেরে।
কোথায় রইলে হে দয়াল
কোথায় রইলে হে
দয়াল কাণ্ডারী,
এ ভবতরঙ্গে আমায়
চরণে ঠাঁই দাও তরী।
যতই করি অপরাধ
তথাপি হে তুমি নাথ,
তুমি মারিলে মরি নিতান্তই
বাঁচালে বাঁচতে পারি।
পাপীকে করিতে তারণ
নাম ধরেছ পতিতপাবন,
আমি ওই ভরসায় আছি যেমন
চাতকে মেঘ নিহারি।
সকলকেই নিলে পারে
আমারে না চাইলে ফিরে,
ফকির লালন বলে এ সংসারে
আমি কি এতই ভারী।
কোন কলে নানাবিধ
কোন কলে নানাবিধ
আওয়াজ উদয়,
কোন কলে নানান ছবি
নাচ করে সদাই।
কলমা পড়ি কল চিনিনে
যে কলে ঐ কলমা চলে,
উপর-উপর বেড়াই ঘুরে
গভীরে ডুবিল না হৃদয়।
কলের পাখি কলের ধুঁয়া
কলের মোহর গিরে দেওয়া,
কল ছুটিলে যাবে হাওয়া
কে রবে কোথায়।
আপন দেহের কল না ঢুঁড়ে
বিভোর হলে কলমা পড়ে,
ফকির লালন বলে মুর্শিদ ছেড়ে
কে পাবে খোদায়।
কোন সাধনে তাঁরে পাই
জীবনের জীবন সাঁই,
আমি কোন সাধনে তাঁরে পাই।
শাক্ত শৈব বৈরাগ্য ভাব
তাতে যদি হয় চরণ লাভ,
তবে দয়াময় সদাসর্বদাই
প্রীতিভক্তি ব’লে পুষিলেন তাই।
সাধিলে সিদ্ধির ঘরে
আবার শুনি পাইনে তারে
সযোগ্য ব্যক্তি পেলো সে মুক্তি
আবার শুনি ঠকে যাবে রে ভাই।
গেলো না রে মনের ভ্রান্ত
পেলাম না সে ভাবের অন্ত,
বলে মূঢ় লালন, ভবে এসে মন
কি করিতে যেন কি করে যাই।
কোন সুখে সাঁই করেন খেলা
কোন সুখে সাঁই করেন খেলা এই ভবে,
আপনি বাজায় আপনি বাজে
আপনি মজে সেই রবে।
নাম শুনি লা-শরীকালা
সবার শরিক সেই একেলা,
আপনি তরঙ্গ, আপনি ভেলা
আপনি খাবি খায় ডুবে।
ত্রিজগতে যে রাই রাঙা
তার দেখি ঘরখানি ভাঙা,
হায়, কি মজা, আজবরঙা
দেখায় ধনী কোন ভাবে।
আপনি চোর হয়, আপন বাড়ি
আপনি পরে আপন বেড়ি,
লালন বলে, এই নাচারি
কেমনে থাকি চুপেচাপে।
ক্ষ্যাপা রে কেন
ক্ষ্যাপা রে,
কেন খুজিস মনের মানুষ
ব’লে সর্বদাই,
ক্ষ্যাপা রে,
তোর নিজ-আত্মা যে রূপ আছে
দেখ সে রূপে দীন-দয়াময়।
বলবো কি তার আজব খেলা
আপনি গুরু আপনি চেলা,
ক্ষ্যাপা রে,
বনের উদ্ভু বনের পন্ডিত
আত্মতত্ত্বের প্রবর্তক নয়।
পরম-আত্মা কে রূপ ধরে
জিহ্বা তাকে হরণ করে,
ক্ষ্যাপা রে,
লালন বলে যাই রে নিদ্রে
সে যে অভেদ ব্রহ্ম নয়।
ক্ষ্যাপা রে তুই
ক্ষ্যাপা রে তুই, না জেনে তোর
আপন খবর যাবি কোথায়?
আপন ঘরে না খুঁজে তুই
বাহিরে খুঁজলে পড়বি ধাঁধায়।
আমি সত্য না হ’লে
গুরু সত্য হয় কোন কালে,
আমি যেরূপ দেখ না সেরূপ
দীন দয়াময়।
আত্মারূপে সেই অধর
সঙ্গে অংশ কলা তার,
ভেদ না জেনে বনে-বনে
ফিরিলে কি হয়।
আপনার আপনি না চিনে
ঘুরবি কত এ ভুবনে,
লালন বলে, অন্তিম কালে
নাই রে উপায়।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়,
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি
ধরতে পারলে মন বেড়ি
দিতাম পাখির পায়।
আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা,
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না মহল তায়।
কপালের ফের নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার,
খাঁচা ভেঙে পাখি আমার
কোনখানে পালায়।
মন তুই রইলি খাঁচার আসে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশের,
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।
খালি ভাঁড়
খালি ভাঁড় থাকবে রে পড়ে,
দিনে-দিনে কর্পূর তোর
যাবে রে উড়ে।
মন যদি গোলমরিচ হত
তবে কি আর কর্পূর যেত,
তিলক আদি না থাকিত
সুসঙ্গ ছেড়ে।
অমূল্য কর্পূর যাহা
ঢাকা দেওয়া আছে তাহা,
কেমনে প্রবেশে হাওয়া
কর্পূরের ভাঁড়ে।
সে ধন রাখিবার কারণ
নিলে না গুরুর স্মরণ,
লালন বলে বেড়াই এখন
আগাড় ভাগাড়ে।
খুঁজি তারে
খুঁজি তারে আসমান জমি
আমারে চিনি না আমি,
কি বিষম ভ্রমের ভ্রমি
আমি কোনজন সে কোনজনা,
কি কথা কয় রে দেখা দেয় না।
নড়ে চড়ে হাতের কাছে
খুঁজলে জনম ভর মেলে না,
কি কথা কয় রে দেখা দেয় না
কি কথা কয় রে দেখা দেয় না।
হাতের কাছের হয় না খবর
কি দেখতে যাও দিল্লি শহর,
সিরাজ সাঁই কয়, লালন রে তোর
সদাই মনের ঘোর গেল না।
গুণে পড়ে সারলি দফা
গুণে পড়ে সারলি দফা
করলি রফা গোলেমালে,
বুঝলি নে মন কোথা সে ধন
ভাজলি বেগুন পরের তেলে।
করলি বহু পড়াশোনা
কাজের বেলায় ঝলসে কানা,
কথায় তো চিড়ে ভেজে না
জল কিংবা দুধ না দিলে।
আর কি হবে এমন জনম
লুটবি মজা মনের মতন,
বাবার হোটেল ভাঙবে যখন
খাবি তখন কার বা শালে।
হায় রে মজা তিলে খাজা
খেয়ে দেখলি নে মন কেমন মজা,
লালন কয় বেজাতের রাজা
হয়ে রইলাম কালে কালে।
গুরু দোহাই তোমার
গুরু দোহাই তোমার
মনকে আমার নাও না সুপথে,
তোমার দয়া বিনে তোমায় সাধবো কি মতে।
তুমি যারে হও গো সদয়
সে তোমারে সাধনে পায়,
বিবাদী তার স্ববশে রয় তোমার কৃপাতে।
যন্তরেতে যন্ত্রী যেমন
যেমত বাজায় বাজে তেমন,
তেমনি যন্ত্র আমারি মন, বোল তোমার হাতে।
জগাই মাধাই দস্যু ছিল
তারে গুরুর কৃপা হল,
অধীন লালন দোহাই দিল সেই আশাতে।
গুরু বিনে কী ধন আছে
গুরু বিনে কী ধন আছে
কী ধন খুজিস, ক্ষ্যাপা, কার কাছে।
বিষয়-ধনের ভরসা নাই
ধন বলিতে গুরু-গোঁসাই,
যে ধনের দিয়ে দোহাই
ভব-তুফান যাবে বেঁচে।
পুত্র-পরিবার বড়ো ধন
ভুলেছ এই ভবের ভূষণ,
মায়ায় ভুলে অবোধ মন
গুরুধনকে ভাবলে মিছে।
কি ধনের কি গুণপনা
অন্তিম কালে যাবে জানা,
গুরুধন এখন চিনলে না
নিদানে পস্তাবি পিছে।
গুরুধন মূল্যধন রে
ও মনে বুঝলি না রে,
সিরাজ সাঁই কয়, লালন তোরে
নিতান্ত পেঁচোয় পেয়েছে।
গুরুকে ভজনা করো মন
গুরুকে ভজনা করো মন,
ভ্রান্ত হয়ো না,
সদাই থেকো সচেতনে
অচেতনে ঘুম যেওনা।
ব্যাধে যখন পাখি ধরতে যায়
নয়ন তার ঊর্দ্ধ পানে রয়,
এক নিরিখে চেয়ে থাকে
পলক না ফিরায়,
নড়লে আঁখি উড়বে পাখি
নয়নে পলক মেরো না।
ছিদ্র-কুম্ভে জল আনিতে যায়
তাতে জল কি মতে রয়,
আসা-যাওয়ায় দেরী হলে
পিপাসায় প্রাণ যায়,
ও তোর, আসা-যাওয়ায় দিন ফুরালো
গুরু-মতি ঠিক হলো না।
নারিকেলে জলের সঞ্চার
আ চায় কি বাহার,
রসে-পরিপূর্ণ দেখতে চমৎকার
গোপনে আছে গোপিকা ভজন যার,
সেই রসিকজনে মর্মসার
লালন বলে, মনের ভুলে,
দেহের খবর নিলে না।।
গুরুচরণ অমূল্য ধন
গুরুচরণ অমূল্য ধন
বাঁধো ভক্তি রসে,
মানব জনম সফল হবে
গুরুর উপদেশে।
হিংসা-নিন্দা-তমঃ ছাড়ো
মরার আগেতে মরো,
তবে যাবে ভবপারে
ঘুচবে মনের দিশে।
ষোলোকলা পূর্ণরতি
হতে হবে ভাবপ্রকৃতি,
গুরু দেবেন পূর্ণরতি
হৃদকমলে বসে।
পারাপারের খবর জানো
মহর গুরুকে মানো,
লালন কয় ভাবছো কেন
পড়ে মায়াফাঁসে।
গুরুপদে ডুবে থাক রে
গুরুপদে ডুবে থাক রে
আমার মন,
গুরু পদে না ডুবিলে
হবে না ভজনসাধন।
গুরু-শিষ্যর এমনি ধারা
চাঁদের কোলে থাকে তারা,
আয়নাতে লাগাইলে পারা
দেখে তারা ত্রিভুবন।
শিষ্য যদি হয় কায়েমি
কর্ণে দেয় তার মন্ত্রখানি,
এই নামে হয় চক্ষুদানী
নইলে অন্ধ দুই নয়ন।
ঐ দেখা যায় আনকা লহর
অচিন মানুষ অচিন শহর,
সিরাজ সাঁই কয় লালন রে তোর
জনম গেল অকারণ।
গুরু কূলে যেতে হলে
গুরু কূলে যেতে হলে
লোক কূল ছাড়তে হয়,
কোন কূলেতে যাবি মনরাই?
দুই কূল ঠিক রয় না গাঙে,
এক কূল গড়ে এক কূল ভাঙে,
তেমনি যেন সাধুর সঙ্গে
বেদ বিধির পদ দূরে রয়।
রোজা পূজা বেদের আচার
মন যদি চায় কর এবার,
নির্বোধের কাজ বেদ বেদান্তর
মায়াবাদীর কার্য নয়।
ভেবে বুঝে এক কূল ধর
দোটানায় কেন ঘুরে মর,
সিরাজ সাঁই কয় লালন তোর
ভূ ফুরাবে কোন সময়।
গেঁড়ে তুই গাঙের কূলে
গেঁড়ে তুই গাঙের কূলে
হাপুর-হুপুর ডুব পাড়িলে,
এবার মজা যাবে বোঝা
কার্তিকের উলানির কালে।
কুতবি যখন কফের জ্বালায়
তাবিজ-তাগা বাঁধবি গলায়,
তাতে কি রোগ হবে ভালায়
মস্তকের জল শুষ্ক হলে।
বাইচালা দেয় ঘড়ি ঘড়ি
ডুব পারিস কেন তাড়াতাড়ি,
প্রবল হবে কফের নাড়ি
যাতে হানি জীবনমূলে।
শান্ত হরে ও মনভোলা
ক্ষান্ত দে রে ঝাঁপই খেলা,
লালন কয় গেল বেলা
দেখলি নারে চক্ষু মেলে।
গোপনে রয়েছে খোদা
গোপনে রয়েছে খোদা, তারে চেনো নি
কাম গোপন, প্রেম গোপন,
মুর্শিদ লীলা নিত্য গোপন
দেহেতে তোর মক্কা গোপন,
তাও হইল জানাজানি।
আদমে আহাদ গোপন
মিমে দেখ তার নূর গোপন,
নামাজে হয় মারফত গোপন
তাও কি আবার জানো নি।
আছে আরশ-কুরসি লহুকালাম গোপন
তাই বলে ফকির লালন,
উপরে আল্লাহ গোপন
গুরু হইল নিশানি।
গৌরের ভাব রাখিতে
ওই গৌরের ভাব রাখিতে
সামান্যে কি পারবি তোরা,
কুলশীলে ইস্তফা দিয়ে
হতে হবে জ্যান্ত মরা।
থেকে-থেকে গোরার হৃদয়
কত না ভাব হয় গো উদয়,
ভাব জেনে ভাব নিতে সদাই
জানবি কঠিন কেমন ধারা।
পুরুষ-নারীর ভাব থাকিতে
পারবি কিসে ভাব রাখিতে,
আপনার আপনি হয় ভুলিতে
যেজন গৌর রূপ নিহারা।
গৃহে ছিলি ভালোই ছিলি
কেন গৌরহাটায় মরতে এলি,
লালন বলে কি আর বলি
দুকূল যেন হোস নে হারা।
চরণ পাই যেন
চরণ পাই যেন অন্তিমকালে,
দূরে ফেলো না অধম বলে।
সাধনে পাব চরণ তোমার
গুরু সেই ক্ষমতা নাই গো আমার,
দয়াল নাম শুনিয়ে আশায়
চেয়ে আছি অধীন কাঙ্গালে।
জগাই-মাধাই দস্যু ছিল
তোমায় কাধা ফেলে গায়ে মারিল,
তাহে প্রভুর দয়া হলো
দয়া করো সেই হালে আমায়।
ভারত-পুরাণে শুনি
তোমার পতিতপাবন নামের ধ্বনি,
ফকির লালন বলে সত্য জানি
দয়াল আমারে চরণ দিলে।
চাতক বাঁচে কেমনে
চাতক বাঁচে কেমনে,
মেঘের বরিষণ বিনে।
তুমি হে নব-জলধর
চাতকিনী ম’লো এবার,
ঐ নামের ফল-সুফল এবার
রেখো ভুবনে।
তুমি দাতার শিরোমণি,
আমি চাতক অভাগিনী,
তোমা ভিন্ন আর না জানি
রেখো চরণে।
চাতক ম’লে যাবে জানা,
ঐ নামের গৌরব রবে না,
জল দিয়ে কর সান্তনা
অবোধ লালনে।
চাঁদ ধরা ফাঁদ জান না
চাঁদ ধরা ফাঁদ জান না রে মন
লেহাজ নাই তোমার নাচানাচি সার,
একবার লাফ দিয়ে ধরতে চাও গগন।
সামান্যে রসের মর্ম পাবে কে
কেবল প্রেমরসের রসিক সে,
সে প্রেম কেমন, কর নিরূপণ
প্রেমের সন্ধি জেনে থাক চেতন।
ভক্তিপাত্র আগে করো নির্ণয়
মুক্তিদাতা এসে তাতে বারাম দেয়,
নইলে হবে না প্রেম উপাসনা
মিছে জল সেচিয়ে হবে মরণ।
মুক্তিদাতা আছে নয়নের অজান
ভক্তিপাত্র সিঁড়ি দেখো বর্তমান,
মুখে গুরু গুরু বলো, সিঁড়ি ধরে চলো
সিঁড়ি ছাড়লে ফাঁকে পড়বি লালন।
চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে
চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে
আমরা ভেবে করব কি?
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম
তাদের তোমরা বলবে কি?
ছয় মাসের এক কন্যা ছিল
নয় মাসে তার গর্ভ হল গো,
আবার এগারো মাসে তিনটি সন্তান
কোনটি করবে ফকিরি।
ঘর আছে তার দুয়ার নাই
হায় হায়, লোক আছে তার বাক্য নাই গো,
আবার কে বা তাহার আহার যোগায়
কে দেয় সন্ধ্যাবাতি।
লালন ফকির ভেবে বলে
ছেলে মোর মাকে চুলে গো,
আবার এই তিন কথার অর্থ নইলে
তার হবে না ফকিরি।
চিরদিন জল সেঁচিয়ে
চিরদিন জল সেঁচিয়ে
জল মানে না এ ভাঙ্গা নায়,
এক মালা জল ছেঁচতে গেলে
তিন মালা যোগায় সে তলায়।
ছুতোর বেটার কারসাজিতে
জনমতরীর ছাদ আঁটা নাই,
তরীর আশেপাশের কাষ্ঠ সরল
মেঝের কাঠ গড়েছে তলায়।
আগা নায়ে মোর মন রয়
ব’সে-ব’সে চোকম খেলায়,
আমার দশা তলা-ফাঁসা
জল সেঁচা সার গুদড়ী-গলায়।
মহাজনের অমূল্য ধন
মেরে নিল ডাকনী জোলায়,
লালন বলে মোর কপালে
কি হবে নিকাশের বেলায়।
চিরদিন পুষলাম
চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি
ভেদ-পরিচয় দেয় না আমায়,
আমার ঐ খেদে ঝরে আঁখি
চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি।
বুলি বলে শুনতে পাই
রূপ কেমন দেখি না ভাই,
আমি বিষম ঘোর দেখি।
চেনাল পেলে চিনে নিতাম
আমার যেত মনের ধুকধুকি।
পোষা পাখি চিনলাম না
এ লজ্জা তো যাবে না,
আমি উপায় কি করি!
কোন দিন জানি যাবে উড়ে
ধুলো দিয়ে দুই চোখে।
নয় দরজা খাঁচাতে
যায় আসে পাখি কোন পথে
চোখে দিয়ে রে ভেল্কি,
সিরাজ সাঁই কয় বয় লালন বয়
ফাঁদ পেতে ঐ সিঁদমুখী।
চেয়ে দেখ না রে মন
চার চাঁদ দিচ্ছে ঝলক মণিকোঠার ঘরে,
চেয়ে দেখ না রে মন দিব্য নজরে।
চাঁদে চাঁদ ঢাকা দেওয়া
চাঁদে দেয় চাঁদের খ্যাওয়া, দেয় রে,
জমিনেতে ফলছে মেওয়া, চাঁদের সুধা ঝরে।
হ’লে রে চাঁদের সাধন
অধর চাঁদ হয় দরশন, হয় রে,
চাঁদেতে চাঁদের সরণ রেখেছে ঘিরে।
নয়ন-চাঁদ প্রসন্ন যার
সকল চাঁদ দৃষ্টি দেয় তার, দেয় রে,
ফকির লালন বলে বিপদ আমার, গুরু চাঁদ ভুলে।
জল বিনে চাতকে মরলো
ওরে বিধি, হায় রে বিধি
তোর মনে কি ইহাই ছিল,
সমুদ্রকিনারে ব’সে
জল বিনে চাতকে মরলো।
চাতক থাকে মেঘের আশে
মেঘ বারিষে অন্য দেশে,
বলো চাতক বাঁচে কিসে
ওষ্ঠাগত প্রাণ আকুল।
নবঘন বিনে বারি
খায় না চাতক অন্য বারি,
চাতকের প্রতিজ্ঞা ভারী
যায় যদি প্রাণ, সেও তো ভালো।
লালন বলে ওরে রে মন
কই হলো মোর ভজন-সাধন,
বিনে সিরাজ সাঁইজীর চরণ
তাইতে জীবন বৃথা গেল।
জাত গেল
জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা,
সত্য কাজে কেউ নয় রাজী
সবই দেখি তা-না-না-না।
আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে,
কি জাত হবে যাবার কালে
সে কথা ভেবে বলো না।
ব্রাহ্মণ-চন্ডাল-চামার-মুচি
একি জলেই সব হয় গো শুচি,
দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তো কাউকে ছাড়বে না।
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়,
লালন বলে জাত কারে কয়
সে ঘোরও তো গেল না।
জানিতে হয় ভাবাবেশে
অমাবস্যায় পূর্ণিমা সে
পূর্ণিমাতে অমাবস্যে,
সে কথা কি কবার কথা
জানিতে হয় ভাবাবেশে।
অমাবস্যায় পূর্ণিমার যোগ
অসম্ভব সম্ভব সম্ভোগ,
জানলে খণ্ডে এ ভবরোগ
গতি হয় অখণ্ড দেশে।
রবি-শশী রয় বিমুখা
মাস-অন্তে হয় একদিন দেখা,
সেই যোগের যোগ লেখাজোখা
সাধন-সিদ্ধি হয় অনাসে।
দিবাকর-নিশাকর সদাই
উভয় অঙ্গে উভয় লুকায়,
ইশারাতে কয় সিরাজ সাঁই
লালন তোর হইল না দিশে।
ডুবে দেখ দেখি মন
আকাশ-পাতাল খুঁজিস যারে
এই দেহে সে রয়,
ডুবে দেখ দেখি মন
কি রূপ লীলাময়।
লাম আলেফ লুকায় যেমন
মানুষের সাঁই আছে তেমন,
তা নইলে কি সব নূরীতন
আদম তনে সেজদা জানায়।
আাহাদে আহম্মদ হলো
মানুষে সাঁই জন্ম নিলো,
লালন মহা ফেরে প’লো
সিরাজ সাঁইজির অন্ত না পাওয়ায়।
তাল তমালের বনেতে
তাল তমালের বনেতে
আগুন লাগে মনেতে
বন্ধু আমার বুনো হাওয়া
সুখ হলো না প্রাণেতে ।
শহর নগর বন্দরে
ঘুরি আমি ঘুরি রে,
ভাব লাগেনা মনেতে
অভাবে দিন গেল রে ।
সকাল দুপুর সন্ধ্যা গেল,
সূর্য্য ঢেকে আধারে
নদী পাহাড় সাগরে
খুঁজি আমি কাহারে।
এখন কোন গল্প নাই
গল্পে কোন কথা নাই.
দিনমানে সূর্য নাই
রাতে কোন চন্দ্র নাই ।
না হইল না কথা বলা
কি পরিব গলেতে,
গল্প করি কাহারে
কবে পাব তাহারে।
তিন পাগলের হলো মেলা
তিন পাগলের হলো মেলা নদে এসে,
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।
একটা পাগলামি করে,
জাত দেয় সে অজাতেরে, দৌড়ে গিয়ে,
আবার হরি বলে, পড়ছে ঢলে,
ধূলার মাঝে ।
একটা নারকেলের মালা,
তাতে জল তোলা-ফেলা করঙ্গ সে,
পাগলের সঙ্গে যাবি, পাগল হবি,
বুঝবি শেষে ।
পাগলের নামটি এমন,
বলিতে অধীন লালন হয় তরাসে,
ও সে অদ্বৈ নিতে চৈতে পাগল
নাম ধরে সে ।
তোমার ঘরে বসত করে
তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জান না,
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা, মন জান না
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।
এক জনায় ছবি আঁকে এক মনে, ও রে মন
আরেক জনায় বসে বসে রঙ মাখে,
ও আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে
কোন জনা,কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।
এক জনে সুর তোলে এক তারে, ও মন
আরেক জন মন্দিরাতে তাল তোলে,
ও আবার বেসুরা সুর ধরে দেখো
কোন জনা, কোন জনা
তোমর ঘরে বসত করে কয় জনা।
রস খাইয়া হইয়া মাতাল, ঐ দেখো
হাত ফসকে যায় ঘোড়ার লাগাম,
সেই লাগাম খানা ধরে দেখো
কোন জনা, কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা।
তোমার মতো দয়াল বন্ধু
তোমার মতো দয়াল বন্ধু
আর পাব না,
দেখা দিয়ে ওগো রাসুল
ছেড়ে যেও না।
তুমি তো খোদারই দোস্ত
অপারের কান্ডারী সত্য,
তুমি বিনে পারের লক্ষ্য
আর তো দেখি না।
আমরা সব মদিনাবাসী
ছিলাম যেমন বনবাসী গো,
তোমা হতে জ্ঞান পেয়েছি
আছি সান্ত্বনা।
আসমানি এক আইন দিয়ে
আমাদের সব আনলেন রাহে গো,
এখন মোদের ফাঁকি দিয়ে
ছেড়ে যেও না।
তুমি বিনে এরূপ শাসন
কে করিবে দীনের কারণ গো,
লালন বলে আর তো এমন
বাতি জ্বলবে না।
দিবানিশি ডাকো মন তারে
গুরুর নাম সুধা-সিন্ধু
পান কর তাহাতে বিন্ধু,
সখা হবে দীনবন্ধু
তৃষ্ণা-ক্ষুধা রবে না রে,
দিবানিশি ডাকো মন তারে
যারে ভাবলে পাপীর পাপ হরে।
প্রহলাদ হৃদয় ক’রে
অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করে,
কৃষ্ণ নরসিংহ রূপ ধারণ ক’রে
হিরণ্যকশব মারে।
ভাবলি না সে]তোর ভাবনা
মহাজনের ধন ষোলআনা,
লালন বলে মন রসনা
একদিন তাও ভাবলি না রে।
দিনে দিনে
দিনে দিনে হলো আমার দিন আখেরি,
আমি কোথায় ছিলাম কোথায় এলাম
তাইতো সদাই ভেবে মরি।
বসত করি দিবা রাতে
ষোলজন বোম্বেটের সাথে,
দেয় না যেতে সরল পথে আমায়
পদে পদে করে দাগাদারি।
বাল্যকাল খেলায় গেলো
যৌবনে কলঙ্ক হলো,
বৃদ্ধকাল সামনে এলো
মহাকাল হলো অধিকারী।
যে আশাতে ভবে আশা
তাতে হলো ভগ্নদশা,
লালন বলে হয় কী দশা
উজাইতে ভেটেনে প’ল তরী।
দিল দরিয়ার মাঝে
দিল দরিয়ার মাঝে রে ভাই
আছে মজার কারখানা,
সেথা ডুবলে ‘পরে রতন পাবে
ভাসলে ‘পরে পাবে না।
দেহের মাঝে বাড়ি আছে
সেই বাড়িতে চোর ঢুকেছে,
আবার ছয়জনাতে সিঁধ কাটিছে
চুরি করে একজনা।
দেহের মাঝে নদী আছে
আর সেই নদীতে নৌকা চলছে,
সেথা ছয়জনাতে গুন টানিছে
হাল ধরেছে একজনা।
দেহের মাঝে বাগান আছে
সেই বাগানে ফুল ফুটেছে,
ফুলের সৌরভে জগত মেতেছে
লালনের মন মাতলো না।
দীনবন্ধু কৃপাসিন্ধু
দীনবন্ধু কৃপাসিন্ধু
কোনদিন পদার বিন্দু দেবে,
আর কি আমার সাধুদরশন হবে।
সাধুর বাগান কি আনন্দময়,
কেমন নামে ভাসছে এ পাপ-হৃদয়
সাধুর দরশনে-পরশনে
মনের ময়লা ধুয়ে যাবে।
সাধুগুরুর কি মহিমা
বেদে দিতে নাই রে সীমা,
সাধু গুরুর কৃপা হলে
পশুর জনম কেটে যাবে।
সাধুগুরুর সঙ্গ নিলে
কু-স্বভাব মোর যাবে চলে,
লালন সাঁই কয় সিরাজ সাঁইরে
আমার সেই দিন কবে হবে।
দীনের ভাব
দীনের ভাব যেই দিন উদয় হবে,
সেই দিন মন তোর ঘোর অন্ধকার
ঘুচে যাবে।
মণিহারা ফণী যেমন
তেমতি ভাব রাগের করণ,
অরুণবসন ধারণ
বিভূতি ভূষণ লবে।
হাদিসে লিখেছে প্রমাণ
আপনারে আপনি গেয়ে জান,
কোথা হতে, কী রূপে সে
কহিছে জবান।
না করলি মন সে সব দিশে
তরিকার মঞ্জিলে বসে,
তিনেতে তিন আছে মিশে
ভাবুক হ’লে জানতে পাবে।
ভাবশুন্য হৃদয়মাঝার
মুখে পড়ো কালাম আল্লার,
তাই কি মন তুই পাবি নিস্তার
ভেবেছো এবার।
অঙ্গে ধারণ করো বেহাল
হৃদে জ্বালো প্রেমের মশাল,
দুই নয়ন হইবে উজ্জ্বল
মুর্শিদ বস্তু দেখতে পাবে।
একের যুতে তিনের লক্ষণ
তিনের ঘরে আছে সে ধন,
তিনের মর্ম সাজিলে হয়
স্বরূপ দরশন।
সাঁই সিরাজের হক্কের বচন
ভেবে বলে ফকির লালন,
কথায় কি তোর হয় আচরণ
রাজি হও মন দীনের ভাবে।
ধন্য ধন্য বলি তারে
ধন্য ধন্য বলি তারে
বেঁধেছে এমন ঘর শূন্যের উপর পোস্তা ক’রে,
ধন্য ধন্য বলি তারে।
সবে মাত্র একটি খুঁটি
খুঁটির গোড়ায় নাইকো মাটি,
কিসে ঘর রবে খাঁটি
ঝড়-তুফান এলে পরে।
মূলাধার কুঠুরি নয়টা
তার উপরে চিলেকোঠা,
তাহে এক পাগলা বেটা
বসে একা একেশ্বরে।
উপর নিচে সারি সারি
সাড়ে-নয় দরজা তারি,
লালন কয় যেতে পারি
কোন দরজা খুলে ঘরে,
ধন্য ধন্য বলি তারে।
ধর রে অধরচাঁদেরে
ধর রে অধরচাঁদেরে
অধরে অধর দিয়ে।
ক্ষীরোদ মৈথুনের ধরা
ধরো রে রসিক নাগরা,
যে রসেতে অধর ধরা,
থাকো সচৈতন্য হয়ে।
অরসিকের ভোলে ভুলে
ডুবিস নে কু-নদীর জলে,
কারণবারির মধ্যস্থলে
ফুটেছে ফুল অচিন দলে,
চাঁদ-চকোরা তাহে খেলে
প্রেমবাণে প্রকাশিয়ে।
নিত্য ভেবে নিত্যে থেক,
লীলার বশে যেও না,
সেই দেশেতে মহাপ্রলয়
মায়েতে পুত্র ধরে খায়,
ভেবে বুঝে দেখ মনুরায়
সে দেশে তোর কাজ কি যেয়ে।
পঞ্চবাণের ছিলা কেটে
প্রেম যাচো স্বরূপের হাটে,
সিরাজ সাঁই বলে রে লালন
বৈদিক বাণে করিস নে রণ,
বাণ হারায়ে পড়বি তখন
রণ-খোলাতে হুবড়ি খেয়ে।
ধরো চোর হাওয়ার ঘরে
সেকি সামান্য চোরা
ধরবি কোনা কানচিতে,
ধরো চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে।
পাতালে চোরের বহর
দেখায় আসমানের নহর,
তিন তারে হচ্ছে খবর
শুভাশুভ যোগমতে।
কে বা চোর, কে বা সেনা
কে করে ঠিক ঠিকানা,
হাওয়ায় তার লেনাদেনা
হাওয়াই মূলাধার তাতে।
চোর ধরে রাখবি যদি
হৃদগারদ কর গে খাঁটি,
লালন কয় খুঁটিনাটি
থাকতে কি চোর দেয় ছুঁতে।
নবী না চিনলে
নবী না চিনলে সে কি
খোদার ভেদ পায়,
চিনিতে বলেছেন খোদে
সেই দয়াময়।
যে নবী পারের কান্ডার
জিন্দা সে চার যুগের উপর,
হায়াতুল মুরছালিন নাম তার
সেই জন্য কয়।
কোন নবী হলেন ওফাত
কোন নবী হন বান্দার হায়াত,
নিহাজ করে জানলে নেহাত
যাবে রে সংশয়।
যে নবী আজ সঙ্গে তোরও
চিনে মন তার দাওন ধরো,
লালন বলে পারের কারও
সাধ যদি রয়।
না বুঝে মজো না পিরীতে
না বুঝে মজো না পিরীতে,
জেনে শুনে কর গা পিরীত
শেষ ভালো আছে যাতে।
সাধুর কাছে জান গে চেনা
লোহায় যেমন স্পর্শে সোনা, সেইমতে,
ভবের পিরীত ভূতের কীর্তন
ক্ষণেক বিচ্ছেদ, ক্ষণেক মিলন,
অবশেষে বিপাকে মরণ তেমাথা পথে।
এক পিরীতের দ্বিভাব চলন
কেউ স্বর্গে, কেউ নরকে গমন
বিনয় ক’রে বলছে লালন এই জগতে।।
নিগুম বিচারে সত্য
নিগুম বিচারে সত্য
গেল তাই জানা,
মায়েরে ভজিলে হয় তার
বাবার ঠিকানা।
নিগুম খবর নাহি জেনে
কে বা সে মায়েরে চেনে,
যার উপরে দুনিয়ার ভার
দিলেন রাব্বানা।
পুরুষ পারবর্তীগার
অঙ্গে ছিল প্রকৃতি তার,
প্রকৃতি প্রকৃত সংসার
সৃষ্টির সব গেল জানা।
ডিম্বর ভিতর কে বা ছিল
বাহির হয়ে কারে দেখিল,
লালন বলে ভেদ যে পেল
তার ঘুচলো দিনকানা,
মায়েরে ভজিলে হয় তার
বাবার ঠিকানা।
নিগূঢ় প্রেম কথাটি
নিগূঢ় প্রেম কথাটি তাই আজ আমি
শুধাই কার কাছে,
যে প্রেমেতে আল্লাহ নবী মেরাজ করেছে।
মেরাজ হয় সে ভাবের ভুবন
গুপ্ত-ব্যক্ত আলাপ হয় রে দুইজন,
কে পুরুষ-আকার, কে প্রকৃতি তার
শাস্ত্রে প্রমাণ কি রেখেছে।
কোন প্রেমের প্রেমিকা ফাতেমা
করেন সাঁই কে পতি ভজনা,
কোন প্রেমের দায় ফাতেমাকে সাঁই
মা বোল বলেছে।
কোন প্রেমে গুরু হয় ভবতরী
কোন প্রেমে শিষ্য হয় কাণ্ডারী,
না জেনে লালন, প্রেমের উদ্দীপন
ও প্রেম করেছে মিছে।
নিতাই কাউরে ছেড়ে যাবে না
আগে ধরো, চরণ ছেড়ো না গো,
দয়াল নিতাই কাউরে ছেড়ে যাবে না।
হরিনাম-তরণী লয়ে
ফিরছে নিতাই নেয়ে-হয়ে,
এমন দয়াল কাছে পেয়ে
ও তার শরণ কেন নিলে না।
দৃঢ়বিশ্বাস করো রে মন
ধর গো নিতাই চাঁদের চরণ,
ও তুই পার হবি, পার হবি তুফান
অপারে কেউ থাকবে না।
কলির জীবে হয়ে সদয়
পারে যেতে ডাকছে নিতাই,
ফকির লালন বলে মন চলো যাই
ভবে আর এমন দয়াল মিলবে না।
পাখি কখন জানি উড়ে যায়
পাখি কখন জানি উড়ে যায়
একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়।
খাঁচার আড়া প’লো ধ্বসে
পাখি আর দাঁড়াবে কিসে,
আমি ঐ ভাবনা ভাবছি ব’সে
চমক-জ্বরা বইছে গায়।
ভেবে অন্ত নাহি দেখি
কার বা খাঁচায় কে বা পাখি,
পাখি আমারই আঙ্গিনায় থাকি
পাখি আমারে মজা’তে চায়।
আগে যদি যেত জানা
জংলা কভু পোষ মানে না,
আমি তবে উহার প্রেম করতাম না
ওরে, লালন ফকির কেঁদে কয়।
পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না
খাজার নামে পাগল হইয়া,
ঘুরি আমি আজমীর গিয়া রে।
এত ক’রে ডাকলাম তারে,
তবু দেখা পাইলাম না,
পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না।
মুর্শিদ আছে দেশে দেশে
এই জগতে কত বেশে রে,
ধরতে পারলে পাবি রে তুই
বেহেশতেরি নাজরানা,
পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না।
তুই পাগল, তোর মনও পাগল
পাগল, পাগল, করিস না
পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না।
পাপ পুণ্যের কথা আমি
পাপ পুণ্যের কথা আমি
কারে বা শুধাই,
এই দেশে যা পাপ গণ্য
অন্য দেশে পুণ্য তাই।
তিব্বত-নিয়ম অনুসারে
এক নারী বহু পতি ধরে,
এই দেশে তা হ’লে ‘পরে
ব্যভিচারী দণ্ড হয়।
শূকর-গরু দুইটি পশু
খাইতে বলেছেন যীশু,
শুনে কেন মুসলমান-হিন্দু
পিছেতে হটায়।
দেশ-সমস্যা অনুসারে
ভিন্ন বিধান হ’তেই পারে,
সূক্ষ্মজ্ঞানে বিচার করলে
পাপ-পুণ্যের আর নাই বালাই।
পাপ করিলে ভবে আসি
পুণ্য হ’লে স্বর্গবাসী,
লালন বলে নামে উর্বশী
নিত্য-নিত্য প্রমাণ পাই।
পাপীর ভাগ্যে এমন দিন
পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে,
দেখ দেখ মনরাই, হয়েছে উদয়
কী আনন্দময় এই সাধবাজারে।
যথা রে সাধুর বাজার
তথা সাঁইর বারাম নিরন্তর,
এনে সাধ-সভায়, তবে মন আমায়
আবার যেন ফ্যারে ফেলাস না রে।
সাধুগুরুর কি মহিমা
দেবে দিতে নাই রে সীমা,
হেন পদে যার, নিষ্ঠা না হয় তার
না জানি কপালে কী আছে রে।
সাধুর বাতাসের মন
বনের কাষ্ঠ হয় রে চন্দন,
লালন বলে মন, খোঁজ কি আর ধন
সাধুর সঙ্গে রঙ্গে দেশ করবে।
পারে কে যাবি তোরা
পারে কে যাবি তোরা আয় না জুটে,
নিতাইচাঁদ হয়েছে নেয়ে ভবের ঘাটে।
হরি নামের তরী আর
রাধা নামের বাদাম তাঁর,
পারে যেতে ভয় কি রে আর নায়ে উঠে।
নিতাই বড় দয়াময়
পারের কড়ি নাহি লয়,
এমন দয়াল মিলবে কি আর এই ললাটে।
ভাগ্যবান যেই ছিল
সেই তরীতে পার হলো,
লালন ঘোর তুফানে প’লো ভক্তি চটে।
লালন ফকিরের বিখ্যাত কিছু গান l Popular Lalon Geeti
পারে কে যাবি নবীর
পারে কে যাবি
নবীর নৌকাতে আয়,
রুপকাষ্ঠের নৌকাখানি
নাই ডুবার ভয়।
বে-সরা নেয়ে যারা,
তুফানে যাবে মারা
এক ধাক্কায়,
কি করবে সে বদর মাঝি
থাকবে কোথায়।
নবী না মানিল যারা,
মুয়াহেদ কাফের তারা
এই দুনিয়ায়,
ভজনে তার নাই মজুরী
দলিলে সব লেখা রয়।
যেই মুরশিদ সেই তো রাসুল,
ইহাতে নাই কোন ভুল
খোদাও সে হয়,
লালন কয় না এমন কথা
কোরানে কয়।
লালনগীতি l লোকসঙ্গীত l Popular Songs by Lalon Fakir
প্রেম করা কি কথারই কথা
ও সে প্রেম করা কি
কথারই কথা,
প্রেমে মজে হরির
হলো গলায় কাঁটা।
একদিন রাধে মান করিয়ে
ছিলেন ধ্বনি শ্যামতে দিয়ে,
মানের দায়ে শ্যাম যোগী হয়ে
মুড়ালে মাথা।
আর এক প্রেমে ম’জে ভোলা
শ্মশানেতে করে খেলা,
গলে শক্তি হাড়ের মালা
দেখিতে পাগল অবস্থা।
রূপ-সনাতন উজীর ছিল
প্রেমে মজে ফকির হলো,
লালন বলে এমনি জেনো
প্রেমের ক্ষমতা।
প্রেম জানো না
প্রেম জানো না
প্রেমের হাটের বুলবুলা,
কথায় দেখি ব্রহ্ম-আলাপ
মনে গলদ ষোলোকলা।
বেশ করে বোষ্টমগিরি
রস নাহি তার গুমর ভারি,
হরি নামের ঢু-ঢু তারি
তিনগাছি জপের মালা।
খাঁদা-বাঁদা ভূত-চালানি
সেইটে বটে গণ্য জানি,
সাধুর হাটে ঘুসঘুসানি
কী বলিতে কী বলা।
তার মন মেতেছে মদনরসে
সদাই থাকে সেই আবেশে,
লালন বলে সকল মিছে
লব-লবানি প্রেমতালা।
প্রেম-প্রেম-প্রেম ব’লে
প্রেম-প্রেম-প্রেম ব’লে করো
কোর্টকাচারি,
সেই প্রেমের বাড়ি কোথায়
বলো বিহারী।
প্রেমের উৎপত্তি কিসে
শুন্য কি ভাণ্ড মাঝে,
কোন প্রেমে ঘুরি ফিরি
অহর্নিশি।
কোন প্রেমে মাতাপিতা
খণ্ড করে জীবাত্মা,
না জেনে সেই প্রেমের কথা
গোলমাল ক’রি।
কোন প্রেমে মা কালী
পদতলে মহেশ্বর ব’লি,
লালন বলে ধন্য দেবী
জয় জয় হরি।
ফকিরি করবি ক্ষ্যাপা
ফকিরি করবি ক্ষ্যাপা কোন্ রাগে,
আছে হিন্দু – মুসলমান দুই ভাগে।
বেহেস্তের আশায় মমিনগণ
হিন্দুরা দেয় স্বর্গেতে মন,
বেহেস্ত-স্বর্গ ফাটক সমান
কার বা তা ভাল লাগে।
ফকিরি সাধন করে
খোলসা রয় হুজুরে,
চল কী সে অটল মুকাম
নিহাজ করে জান আগে।
অটল প্রাপ্তি কিসে হয়
মুরশিদের ঠাঁই জানিতে হয়,
সিরাজ সাই তাই লালনকে কয়
ভুগিস্ নে ভবের ভোগে।
বল রে নিমাই
বল রে নিমাই বল আমারে,
রাধা বলে আজগুবি আবার
কাঁদলি কেন ঘুমের ঘোরে।
সেই যে রাধার কি মহিমা
বেদাদিতে নাই রে সীমা,
ধ্যানে যারে পায় না ব্রহ্মা
তুই কি রূপে জানলি তারে।
রাধে তোমার কি হয় নিমাই
সত্য করে বলো আমায়,
এমন বালকের সময়
এ বোল কে শেখালো তোরে।
তুমি শিশু ছেলে আমার
মা হয়ে ভেদ পাইনে তোমার,
লালন কয় শচীর কুমার
জগৎ ফেললো চমৎকারে।
বলাই দাদার দয়া নাই প্রাণে
গোষ্ঠে আর যাব না মাগো
দাদা বলাইয়ের সনে,
বলাই দাদার দয়া নাই প্রাণে।
বড় বড় রাখাল যারা
বনে বসে থাকে তারা,
আমায় ক’রে জ্যান্তে মরা
ধেনু ফিরানে।
বনে গিয়ে রাখাল সবাই
বলে এসো খেলি কানাই,
হারিলে স্কন্ধে বলাই
চড়ে তখনে।
ক্ষুধাতে প্রাণ আকুল হয় মা
ধেনু রাখার বল থাকে না,
আমার বলাই দাদা বোল বোঝে না
কথা কয় হেনে।
আজকের মতো তোরাই যা রে
আজ আমি যাবো না বনে,
খেলবো খেলা আপন মনে
ফকির লালন তাই ভণে।
People also ask
লালন ফকির বিখ্যাত ছিলেন কেন?
তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক ফকির সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। তিনি অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। লালনকে বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তার গান উনিশ শতকে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
লালন ফকির কত দিন বেঁচে ছিলেন?
তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং ধর্ম, জাত, কূল, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদে তিনি বিশ্বাস করতেন না। কুমারখালির ছেউড়িয়ায় নিজের আখড়ায় ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর, বাংলা ১২৯৭ সালের পয়লা কার্তিক ১১৬ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন মহাত্মা ফকির লালন শাহ।
লালন শাহ এর গুরু কে ছিলেন?
বাউল সম্রাট লালন তার নিকট বাউলধর্মে দীক্ষিত হন এবং জীবদ্দশায় লালন তার বহু গানে সিরাজ সাঁইয়ের কথা উল্লেখ করেন। লালনের গুরু হিসেবেই পরবর্তীতে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে সিরাজ সাইয়ের সমাধি অবস্থিত।
লালন ফকিরের পুরো নাম কি?
লালন ফকিরের আসল নাম নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কিছু গবেষক মনে করেন, তাঁর প্রকৃত নাম ফকির লালন শাহ। তবে, অন্যান্য গবেষকরা দাবি করেন যে লালন শাহ তাঁর গুরু সিরাজ সাঁই কর্তৃক প্রদত্ত একটি উপাধি। অন্য কিছু গবেষক দাবি করেন যে লালন তাঁর মায়ের দেওয়া ডাকনাম।