প্রেম—একটি অনন্ত অনুভূতি, যা মানুষের হৃদয়কে গভীরভাবে নাড়া দেয়। বাংলা সাহিত্য সেই অনুভূতির এক অসাধারণ প্রতিফলন। বিখ্যাত বাংলা প্রেমের কবিতা যুগে যুগে আমাদের ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশের মতো কিংবদন্তি কবিরা তাঁদের কবিতায় প্রেমের নানা রূপ—আনন্দ, বেদনা, অপেক্ষা ও বিরহ—সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।
এই ব্লগে আমরা আপনাকে নিয়ে যাব বাংলা সাহিত্যের সেই প্রেমময় জগতে, যেখানে শব্দের মাঝে লুকিয়ে আছে অনুভূতির গভীরতা। এখানে পাবেন বিখ্যাত বাংলা প্রেমের কবিতার এমন কিছু মনোমুগ্ধকর লাইন, যা হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় এবং প্রেমের মানে নতুন করে ভাবতে শেখায়।
আপনার প্রিয় কবির প্রেমের কবিতার ছোঁয়া খুঁজতে চলুন আমাদের সঙ্গে। কবিতার সেই জগতে ডুব দিন, যেখানে প্রেমই প্রধান সুর, এবং আবেগই একমাত্র ভাষা। বিখ্যাত বাংলা প্রেমের কবিতাগুলোর আলোচনায় আপনার ভালোবাসার জগৎ আরও সমৃদ্ধ হোক।
চিরন্তন প্রেমের ছোঁয়া: বিখ্যাত বাংলা প্রেমের কবিতা ২০২৫
Table of Contents
সুপ্তোত্থিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ঘুমের দেশে ভাঙিল ঘুম, উঠিল কলস্বর ।
গাছের শাখে জাগিল পাখি, কুসুমে মধুকর ।
অশ্বশালে জাগিল ঘোড়া, হস্তীশালে হাতি ।
মল্লশালে মল্ল জাগি ফুলায় পুন ছাতি ।
জাগিল পথে প্রহরীদল, দুয়ারে জাগে দ্বারী,
আকাশে চেয়ে নিরখে বেলা জাগিয়া নরনারী ।
উঠিল জাগি রাজাধিরাজ, জাগিল রানীমাতা ।
কচলি আঁখি কুমার-সাথে জাগিল রাজভ্রাতা ।
নিভৃত ঘরে ধূপের বাস, রতন-দীপ জ্বালা,
জাগিয়া উঠি শয্যাতলে শুধালো রাজবালা—
‘কে পরালে মালা ! ‘
খসিয়া-পড়া আঁচলখানি বক্ষে তুলে নিল ।
আপন-পানে নেহারি চেয়ে শরমে শিহরিল ।
ত্রস্ত হয়ে চকিত চোখে চাহিল চারি দিকে—
বিজন গৃহ, রতন-দীপ জ্বলিছে অনিমিখে ।
গলার মালা খুলিয়া লয়ে ধরিয়া দুটি করে
সোনার সূতে যতনে গাঁথা লিখনখানি পড়ে।
পড়িল নাম, পড়িল ধাম, পড়িল লিপি তার,
কোলের ‘পরে বিছায়ে দিয়ে পড়িল শতবার ।
শয়নশেষে রহিল বসে, ভাবিল রাজবালা—
‘আপন ঘরে ঘুমায়ে ছিনু নিতান্ত নিরালা,
‘কে পরালে মালা !’
নূতন-জাগা কুঞ্জবনে কুহরি উঠে পিক,
বসন্তের চুম্বনেতে বিবশ দশ দিক ।
বাতাস ঘরে প্রবেশ করে ব্যাকুল উচ্ছাসে,
নবীনফুলমঞ্জরীর গন্ধ লয়ে আসে ।
জাগিয়া উঠে বৈতালিক গাহিছে জয়গান,
প্রাসাদদ্বারে ললিত স্বরে বাঁশিতে উঠে তান ।
শীতলছায়া নদীর পথে কলসে লয়ে বারি—
কাঁকন বাজে, নূপুর বাজে, চলিছে পুরনারী ।
কাননপথে মর্মরিয়া কাঁপিছে গাছপালা,
আধেক মুদে নয়ন দুটি ভাবিছে রাজবালা—
‘কে পরালে মালা !’
বারেক মালা গলায় পরে, বারেক লহে খুলি—
দুইটি করে চাপিয়া ধরে বুকের কাছে তুলি ।
শয়ন -‘পরে মেলায়ে দিয়ে তৃষিত চেয়ে রয়,
এমনি করে পাইবে যেন অধিক পরিচয় ।
জগতে আজ কত-না ধ্বনি উঠিছে কত ছলে—
একটি আছে গোপন কথা, সে কেহ নাহি বলে ।
বাতাস শুধু কানের কাছে বহিয়া যায় হূহু,
কোকিল শুধু অবিশ্রাম ডাকছে কুহু কুহু ।
নিভৃত ঘরে পরান মন একান্ত উতালা,
শয়নশেষে নীরবে বসে ভাবিছে রাজবালা—
‘কে পরালে মালা !’
কেমন বীর-মুরতি তার মাধুরী দিয়ে মিশা—
দীপ্তিভরা নয়ন-মাঝে তৃপ্তিহীন তৃষা ।
স্বপ্নে তারে দেখেছে যেন এমনি মনে লয়—
ভুলিয়া গেছে রয়েছে শুধু অসীম বিস্ময় ।
পার্শ্বে যেন বসিয়াছিল, ধরিয়াছিল কর,
এখনো তার পরশে যেন সরস কলেবর ।
চমকি মুখ দু হাতে ঢাকে, শরমে টুটে মন,
লজ্জাহীন প্রদীপ কেন নিভে নি সেইক্ষণ !
কন্ঠ হতে ফেলিল হার যেন বিজুলিজ্বালা,
শয়ন-‘পরে লুটায়ে প’ড়ে ভাবিল রাজবালা—
‘কে পরালে মালা !’
এমনি ধীরে একটি করে কাটিছে দিন রাতি ।
বসন্ত সে বিদায় নিল লইয়া যূথীজাতি ।
সঘন মেঘে বরষা আসে, বরষে ঝরঝর্,
কাননে ফুটে নবমালতী কদম্বকেশর ।
স্বচ্ছহাসি শরৎ আসে পূর্ণিমামালিকা,
সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা ।
আসিল শীত সঙ্গে লয়ে দীর্ঘ দুখনিশা,
শিশির-ঝরা কুন্দফুলে হাসিয়া কাঁদে দিশা ।
ফাগুন-মাস আবার এল বহিয়া ফুলডালা,
জানালা-পাশে একেলা বসে ভাবিছে রাজবালা—
‘কে পরালে মালা !’
লাজময়ী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাছে তার যাই যদি কত যেন পায় নিধি
তবু হরষের হাসি ফুটে ফুটে, ফুটে না।
কখন বা মৃদু হেসে আদর করিতে এসে
সহসা সরমে বাধে, মন উঠে উঠে না।
অভিমানে যাই দূরে, কথা তার নাহি ফুরে,
চরণ বারণ-তরে উঠে উঠে, উঠে না।
কাতর নিশ্বাস ফেলি আকুল নয়ন মেলি
চেয়ে থাকে, লাজবাঁধ তবু টুটে টুটে না।
যখন ঘুমায়ে থাকি মুখপানে মেলি আঁখি
চাহি দেখে, দেখি দেখি সাধ যেন মিটে না।
সহসা উঠিলে জাগি, তখন কিসের লাগি
মরমেতে ম’রে গিয়ে কথা যেন ফুটে না!
লাজময়ি তোর চেয়ে দেখি নি লাজুক মেয়ে
প্রেমবরিষার স্রোতে লাজ তবু ছুটে না!
কর্ণফুলী – কাজী নজরুল ইসলাম
ওগো ও কর্ণফুলী,
উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি।
যে লোনা জলের সিন্ধু-সিকতে নিতি তব আনাগোনা,
আমার অশ্রু লাগিবে না সখী তার চেয়ে বেশি লোনা!
তুমি শুধু জল করো টলমল ; নাই তব প্রয়োজন
আমার দু-ফোঁটা অশ্রুজলের এ গোপন আবেদন।
যুগ যুগ ধরি বাড়াইয়া বাহু তব দু-ধারের তীর
ধরিতে চাহিয়া পারেনি ধরিতে, তব জল-মঞ্জীর
বাজাইয়া তুমি ওগো গর্বিতা চলিয়াছ নিজ পথে!
কূলের মানুষ ভেসে গেল কত তব এ অকূল স্রোতে!
তব কূলে যারা নিতি রচে নীড় তারাই পেল না কূল,
দিশা কি তাহার পাবে এ অতিথি দুদিনের বুলবুল?
– বুঝি প্রিয় সব বুঝি,
তবু তব চরে চখা কেঁদে মরে চখিরে তাহার খুঁজি!
* * *
তুমি কি পদ্মা, হারানো গোমতী, ভোলে যাওয়া ভাগিরথী –
তুমি কি আমার বুকের তলার প্রেয়সী অশ্রুমতী?
দেশে দেশে ঘুরে পেয়েছি কি দেখা মিলনের মোহানায়,
স্থলের অশ্রু নিশেষ হইয়া যথায় ফুরায়ে যায়?
ওরে পার্বতী উদাসিনী, বল এ গৃহ-হারারে বল,
এই স্রোত তোর কোন পাহাড়ের হাড়-গলা আঁখি-জল?
বজ্র যাহারে বিঁধিতে পারেনি, উড়াতে পারেনি ঝড়,
ভূমিকম্পে যে টলেনি, করেনি মহাকালেরে যে ডর,
সেই পাহাড়ের পাষাণের তলে ছিল এত অভিমান?
এত কাঁদে তবু শুকায় না তার চোখের জলের বান?
তুই নারী, তুই বুঝিবি না নদী পাষাণ নরের ক্লেশ,
নারী কাঁদে – তার সে-আঁখিজলের একদিন শেষ।
পাষাণ ফাটিয়া যদি কোনোদিন জলের উৎস বহে,
সে জলের ধারা শাশ্বত হয়ে রহে রে চির-বিরহে!
নারীর অশ্রু নয়নের শুধু ; পুরুষের আঁখি-জল
বাহিরায় গলে অন্তর হতে অন্তরতম তল!
আকাশের মতো তোমাদের চোখে সহসা বাদল নেমে
রৌদ্রের তাত ফুটে ওঠে সখী নিমেষে সে মেঘ থেমে!
সারা গিরি হল শিরী-মুখ হায়, পাহাড় গলিল প্রেমে,
গলিল না শিরী! সেই বেদনা কি নদী হয়ে এলে নেমে?
ওই গিরি-শিরে মজনুন কি গো আজিও দিওয়ানা হয়ে
লায়লির লাগি নিশিদিন জাগি ফিরিতেছে রোয়ে রোয়ে?
পাহাড়ের বুক বেয়ে সেই জল বহিতেছ তুমি কি গো? –
দুষ্মন্তের খোঁজ-আসা তুমি শকুন্তলার মৃগ?
মহাশ্বেতা কি বসিয়াছে সেথা পুণ্ডরীকের ধ্যানে? –
তুমি কি চলেছ তাহারই সে প্রেম নিরুদ্দেশের পানে? –
যুগে যুগে আমি হারায়ে প্রিয়ারে ধরণির কূলে কূলে
কাঁদিয়াছি যত, সে অশ্রু কি গো তোমাতে উঠেছে দুলে?
* * *
– ওগো চির উদাসিনী!
তুমি শোনো শুধু তোমারই নিজের বক্ষের রিনিরিনি।
তব টানে ভেসে আসিল যে লয়ে ভাঙা ‘সাম্পান’ তরি,
চাহনি তাহার মুখ-পানে তুমি কখনও করুণা করি।
জোয়ারে সিন্ধু ঠেলে দেয় ফেলে তবু নিতি ভাটি-টানে
ফিরে ফিরে যাও মলিন বয়ানে সেই সিন্ধুরই পানে!
বন্ধু, হৃদয় এমনই অবুঝ কারও সে অধীন নয়!
যারে চায় শুধু তাহারেই চায়– নাহি মনে লাজ ভয়।
বারে বারে যায় তারই দরজায়, বারে বারে ফিরে আসে!
যে আগুনে পুড়ে মরে পতঙ্গ – ঘোরে সে তাহারই পাশে!
* * *
–ওগো ও কর্ণফুলী!
তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কান-ফুল খুলি?
তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে,
‘সাম্পান’-নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে?
আনমনা তার খুলে গেল খোঁপা, কান-ফুল গেল খুলি,
সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হলে কি কর্ণফুলী ?
যে গিরি গলিয়া তুমি বও নদী, সেথা কি আজিও রহি
কাঁদিছে বন্দী চিত্রকূটের যক্ষ চির-বিরহী?
তব এত জল একি তারই সেই মেঘদূত-গলা বাণী?
তুমি কি গো তার প্রিয়-বিরহের বিধুর স্মরণখানি?
ওই পাহাড়ে কি শরীরে স্মরিয়া ফারেসের ফরহাদ,
আজিও পাথর কাটিয়া করিছে জিন্দেগি বরবাদ?
তব জলে আমি ডুবে মরি যদি, নহে তব অপরাধ,
তোমার সলিলে মরিব ডুবিয়া, আমারই সে চির-সাধ!
আপনার জ্বালা মিটাতে এসেছি তোমার শীতল তলে,
তোমারে বেদনা হানিতে আসিনি আমার চোখের জলে!
অপরাধ শুধু হৃদয়ের সখী, অপরাধ কারও নয়!
ডুবিতে যে আসে ডুবে সে একাই, তটিনী তেমনই বয়!
* * *
সারিয়া এসেছি আমার জীবনে কূলে ছিল যত কাজ,
এসেছি তোমার শীতল নিতলে জুড়াইতে তাই আজ!
ডাকনিকো তুমি, আপনার ডাকে আপনি এসেছি আমি
যে বুকের ডাক শুনেছি শয়নে স্বপনে দিবস-যামি।
হয়তো আমারে লয়ে অন্যের আজও প্রয়োজন আছে,
মোর প্রয়োজন ফুরাইয়া গেছে চিরতরে মোর কাছে!
– সে কবে বাঁচিতে চায়,
জীবনের সব প্রয়োজন যার জীবনে ফুরায়ে যায়!
জীবন ভরিয়া মিটায়েছি শুধু অপরের প্রয়োজন,
সবার খোরাক জোগায়ে নেহারি উপবাসী মোরই মন!
আপনার পানে ফিরে দেখি আজ – চলিয়া গেছে সময়,
যা হারাবার তা হারাইয়া গেছে, তাহা ফিরিবার নয়!
হারায়েছি সব, বাকি আছি আমি, শুধু সেইটুকু লয়ে
বাঁচিতে পারিনা, যত চলি পথে তত উঠি বোঝা হয়ে!
বহিতে পারি না আর এই বোঝা, নামানু সে ভার হেথা;
তোমার জলের লিখনে লিখিনু আমার গোপন ব্যথা!
ভয় নাই প্রিয়, নিমেষে মুছিয়া যাইবে এ জল-লেখা,
তুমি জল – হেথা দাগ কেটে কভু থাকে না কিছুরই রেখা!
আমার ব্যথায় শুকায়ে যাবে না তব জল কাল হতে,
ঘূর্ণাবর্ত জাগিবে না তব অগাধ গভীর স্রোতে।
হয়তো ঈষৎ উঠিবে দুলিয়া, তারপর উদাসিনী,
বহিয়া চলিবে তব পথে তুমি বাজাইয়া কিঙ্কিণি!
শুধু লীলাভরে তেমনই হয়তো ভাঙিয়া চলিবে কূল,
তুমি রবে, শুধু রবে নাকো আর এ গানের বুলবুল!
তুষার-হৃদয় অকরুণা ওগো, বুঝিয়াছি আমি আজি –
দেওলিয়া হয়ে কেন তব তীরে কাঁদে ‘সাম্পান’-মাঝি!
ছল – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমারে পাছে সহজে বুঝি তাই কি এত লীলার ছল –
বাহিরে যবে হাসির ছটা ভিতরে থাকে আঁখির জল।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা –
যে কথা তুমি বলিতে চাও সে কথা তুমি বল না।।
তোমারে পাছে সহজে ধরি কিছুরই তব কিনারা নাই –
দশের দলে টানি গো পাছে কিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা –
যে পথে তুমি চলিতে চাও সে পথে তুমি চল না।।
সবার চেয়ে অধিক চাহ, তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও –
হেলার ভরে খেলার মতো ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও?
বুঝেছি আমি, বুজেছি তব ছলনা –
সবার যাহে তৃপ্তি হল তোমার তাহে হল না।।
অচেনা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Achena poem by Rabindranath)
তোমারে আমি কখনো চিনি নাকো,
লুকানো নহ, তবু লুকানো থাকো।
ছবির মতো ভাবনা পরশিয়া
একটু আছ মনেরে হরষিয়া।
অনেক দিন দিয়েছ তুমি দেখা,
বসেছ পাশে, তবুও আমি একা।
আমার কাছে রহিলে বিদেশিনী,
লইলে শধু নয়ন মম জিনি।
বেদনা কিছু আছে বা তব মনে,
সে ব্যথা ঢাকে তোমারে আবরণে।
শূন্য-পানে চাহিয়া থাকো তুমি,
নিশ্বসিয়া উঠে কাননভূমি।
মৌন তব কী কথা বলে বুঝি,
অর্থ তারি বেড়াই মনে খুঁজি।
চলিয়া যাও তখন মনে বাজে—
চিনি না আমি, তোমারে চিনি না যে।
তুমি – জীবনানন্দ দাশ
নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারিদিকে উজ্জ্বল আকাশ;
বাতাসে নীলাভ হ’য়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস;
কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে— গঙ্গাফড়িং সে-ও ঘুমে;
আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে প’ড়ে আছো তুমি।
‘মাটির অনেক নিচে চ’লে গেছো? কিংবা দূর আকাশের পারে
তুমি আজ? কোন্ কথা ভাবছো আঁধারে?
ওই যে ওখানে পায়রা একা ডাকে জামিরের বনে:
মনে হয় তুমি যেন ওই পাখি— তুমি ছাড়া সময়ের এ-উদ্ভাবনে
আমার এমন কাছে— আশ্বিনের এত বড়ো অকূল আকাশে
আর কাকে পাবো এই সহজ গভীর অনায়াসে—’
বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে
প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে— প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে।
আমাকে তুমি – জীবনানন্দ দাশ
আমাকে
তুমি দেখিয়েছিলে একদিন:
মস্ত বড়ো ময়দান— দেবদারু পামের নিবিড় মাথা— মাইলের পর মাইল;
দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস
দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হ’য়ে হারিয়ে যায়;
জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;
জানালায়-জানালায় অনেকক্ষণ ধ’রে কথা বলে:
পৃথিবীকে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয়।
তারপর
দূরে
অনেক দূরে
খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মতো ধান ভানে— গান গায়— গান গায়
এই দুপুরের বাতাস।
এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হ’য়ে যায় যেন।
বিকেলে নরম মুহূর্ত;
নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, হরিণের ছায়ার আসা-যাওয়া;
একটা ধবল চিতল-হরিণীর ছায়া
আতার ধূসর ক্ষীরে-গড়া মূর্তির মতো
নদীর জলে
সমস্ত বিকেলবেলা ধ’রে
স্থির।
মাঝে-মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ,
আগুনের— ঘিয়ের ঘ্রাণ;
বিকেলে
অসম্ভব বিষণ্ণতা।
ঝাউ হরিতকী শাল, নিভন্ত সূর্যে
পিয়াশাল পিয়াল আমলকী দেবদারু—
বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ, জীবনের ফেনা;
শাদা শাদাছিট কালো পায়রার ওড়াউড়ি জ্যোৎস্নায়— ছায়ায়,
রাত্রি;
নক্ষত্র ও নক্ষত্রের
অতীত নিস্তব্ধতা।
মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার
এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো।