বাঙালি সাহিত্যের জগতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর রচনাগুলি পাঠকদের মনের গভীরে এক স্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। “তালনবমী” (তালনবমী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়) এমনই একটি ছোটগল্প যা বিভূতিভূষণের গল্পকার হিসেবে কৃতিত্বকে আরও উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। এই গল্পে তিনি গ্রামবাংলার সরল জীবন ও প্রকৃতির রূপকথার মতো এক গল্পকে চিত্রায়িত করেছেন। “তালনবমী” শুধু একটি গল্প নয়, এটি বাংলা সাহিত্যের একটি মূল্যবান রত্ন, যা পাঠকদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।
তালনবমী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ঝমঝম বর্ষা।
ভাদ্র মাসের দিন। আজ দিন পনরো ধরে বর্ষা নেমেছে, তার আর বিরামও নেই, বিশ্রামও নেই। ক্ষুদিরাম ভট্চাজের বাড়ী দু’দিন হাঁড়ি চড়ে নি।
ক্ষুদিরাম সামান্য আয়ের গৃহস্থ। জমিজমার সামান্য কিছু আয় এবং দু-চার ঘর শিষ্য-যজমানের বাড়ী ঘুরে-ঘুরে কায়ক্লেশে সংসার চলে। এই ভীষণ বর্ষায় গ্রামের কত গৃহস্থের বাড়ীতেই পুত্র-কন্যা অনাহারে আছে,–ক্ষুদিরাম তো সামান্য গৃহস্থ মাত্র ! যজমান-বাড়ী থেকে যে ক’টি ধান এনেছিল তা ফুরিয়ে গিয়েচে।—ভাদ্রের শেষে আউশ ধান চাষীদের ঘরে উঠলে তবে আবার কিছু ধান ঘরে আসবে, ছেলেপুলেরা দুবেলা পেট পুরে খেতে পাবে।
নেপাল ও গোপাল ক্ষুদিরামের দুই ছেলে। নেপালের বয়স বছর বারো, গোপালের দশ। ক’দিন থেকে পেট ভরে না-খেতে পেয়ে ওরা দুই ভায়েই সংসারের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠেছে।
নেপাল বললে, “এই গোপাল, ক্ষিদে পেয়েচে না তোর ?”
গোপাল ছিপ চাঁচতে বললে, “হ, দাদা!”
“মাকে গিয়ে বল– “আমারও পেট চই চই করচে।”
‘মা বকে ; তুমি যাও দাদা!”
“বকুক গে। আমার নাম করে মাকে বলতে পারবি নে ?”
এমন সময় পাড়ার শিব বাড়ুয্যের ছেলে চুনিকে আসতে দেখে নেপাল ডাকলে, “ও চুনি, শুনে যা!”
চুনি ‘বয়সে নেপালের চেয়ে বড়। অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ছেলে, বেশ চেহারা। নেপালের ডাকে সে ওদের উঠোনের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে বললে, “কি ?”
“আয় না ভেতরে।”
“না যাবে না, বেলা যাচ্ছে। আমি জটি পিসিমাদের বাড়ী যাচ্ছি। মা সেখানে রয়েছে কিনা, ডাকতে যাচ্ছি।”
“কেন, তোর মা এখন সেখানে যে?”
“ওদের ডাল ভাঙতে গিয়েছে। তালনবমীর বের্তো আসচে এই মঙ্গলবার; ওদের নাড়ু লোকজন খাবে।”
“সত্যি ?
তা জানিস্ নে বুঝি? আমাদের বাড়ীর সবাইকে নেমন্তন্ন করবে। গাঁয়েও বলবে।”
“আমাদেরও করবে?”
“সবাইকে যখন নেমতন্ন করবে, তোদের কি বাদ দেবে?”
চুনি চলে গেলে নেপাল ছোট ভাইকে বললে, “আজ কি বার রে? তা তুই কি জানিস? আজ শুক্রবার বোধ হয়। মঙ্গলবারে নেমন্তন্ন।”
গোপাল বললে, “কি মজা! না দাদা?”
“চুপ করে থাক,—তোর বুদ্ধি-শুদ্ধি নেই ; তালনবমীর বের্তোয় তালের বড়া করে, তুই জানিস্ ?”
গোপাল সেটা জানতো না! কিন্তু দাদার মুখে শুনে খুব খুশী হয়ে উঠলো ; সত্যিই, তা যদি হয়, তবে সে সুখাদ্য খাবার সম্ভাবনা বহুদূরবর্তী নয়, ঘনিয়ে এসেচে কাছে। আজ কি বার সে জানে না, সামনের মঙ্গলবারে। নিশ্চয় তার আর বেশি দেরি নেই।
দাদার সঙ্গে বাড়ী যাবার পথে পড়ে জটি পিসিমার বাড়ী। নেপাল বললে, “তুই দাঁড়া, ওদের বাড়ী ঢুকে দেখে আসি। ওদের বাড়ী তালের দরকার হবে, যদি তাল কেনে।”
এ গ্রামের মধ্যে তালের গাছ নেই। মাঠে প্রকাণ্ড তালদীঘি, নেপাল সেখান থেকে ভাল কুড়িয়ে এনে গাঁয়ে বিক্রি করে।
জটি পিসিমা সামনেই দাঁড়িয়ে। তিনি গ্রামের নটবর মুখুজ্যের স্ত্রী, ভালো নাম হরিমতী ; গ্রামসুদ্ধু ছেলে-মেয়ে তাঁকে ডাকে জটি পিসীমা।
পিসীমা বললেন, “কি রে ?”
“তাল নেবে পিসীমা?”
“হাঁ, নেব বই কি। আমাদের তো দরকার হবে মঙ্গলবার।”
ঠিক এই সময় দাদার পিছু পিছু গোপালও এসে দাঁড়িয়েছে। জটি পিসীমা বললেন, “পেছনে কে রে? গোপাল? তা সন্ধ্যেবেলা দুই ভায়ে গিয়েছিলি কোথায় ?”
নেপাল সলজ্জমুখে বললে, “মাছ ধরতে।”
“পেলি?”
“ওই দুটো পুঁটি আর একটা ছোট বেলে…তাহ’লে যাই পিসীমা ?”
“আচ্ছা, এসোগে বাবা, সন্ধ্যে হয়ে গেল? অন্ধকারে চলাফেরা করা ভালো নয় বর্ষাকালে।”
জটি পিসিমা তাল সম্বন্ধে আর কোনো আগ্রহ দেখালেন না বা তালনবমীর ব্রত উপলক্ষে তাদের নিমন্ত্রণ করার উল্লেখও করলেন না,যদিও দু’জনেরই আশা ছিল হয়তো জটি পিসীমা তাদের দেখলেই নিমন্ত্রণ করবেন এখন। দরজার কাছে গিয়ে নেপাল আবার পেছন ফিরে জিগ্যেস করলে, “তাল নেবেন তা হ’লে ?”
“তাল? তা দিয়ে যেও বাবা। ক’টা করে পয়সায় ?”
“দুটো করে দিচ্ছি পিসীমা। তা নেবেন আপনি, তিনটে করেই নেবেন।”
“বেশ কালো হেড়ে তাল তো? আমাদের তালের পিঠে হবে তালনবমীর দিন–ভালো তাল চাই।”
“মিশকালো তাল পাবেন। দেখে নেবেন আপনি।”
গোপাল বাইরে এসেই দাদাকে বললে, “কবে তাল দিবি দাদা?”
“কাল।”
“তুই ওদের কাছে পয়সা নিস্ নে দাদা।”
নেপাল আশ্চর্য হয়ে বললে, “কেন রে?”
“তা’হলে আমাদের নেমন্তন্ন করবে, দেখিস এখন।”
“দূর! তা হয় না। আমি কষ্ট করে তাল কুড়বো—আর পয়সা নেবো না?”
রাত্রে বষ্টি নামে। হু হু বাদলার হাওয়া সেই সঙ্গে। পূবদিকের জানলার কপাট দড়িবাঁধা ; হাওয়ায় দড়ি ছিঁড়ে সারারাত খট খট শব্দ করে ঝড়বষ্টির দিনে। গোপালের ঘুম হয় না, তার যেন ভয় ভয় করে। সে শুয়ে শুয়ে ভাবচে—দাদা তাল যদি বিক্রি করে, তবে ওরা আর নেমন্তন্ন করবে না। তা কখনো করে?
খুব ভোরবেলা উঠে গোপাল দেখলে বাড়ীর সবাই ঘুমিয়ে। কেউই তখন ওঠে নি। রাত্রের বৃষ্টি থেমে গিয়েচে,—সামান্য একটু টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। গোপাল একছুটে চলে গেল গ্রামের পাশে সেই তালদীঘির ধারে। মাঠে এক হাঁটু জল আর কাদা। গ্রামের উত্তরপাড়ার গণেশ কাওরা লাঙল ঘাড়ে এই এত সকালে মাঠে যাচ্ছে। ওকে দেখে বললে, “কি খোকা ঠাকুর, যাচ্ছ কনে এত ভোরে ?”
“তাল কুড়ুতে দীঘির পাড়ে।”
“বড্ড সাপের ভয় খোকাঠাকুর! বর্ষাকালে ওখানে যেও না একা-একা।”
গোপাল ভয়ে ভয়ে দীঘির তালপুকুরের তালের বনে ঢুকে তাল খুঁজতে লাগলো। বড় আর কালো কুচকুচে একটা মাত্র তাল প্রায় জলের ধারে পড়ে ; সেটা কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসবার পথে আরও গোটা-তিনেক ছোট তাল পাওয়া গেল। ছেলেমানুষ, এত তাল বয়ে আনার সাধ্য নেই, দুটি মাত্র তাল নিয়ে সোজা একেবারে জটি পিসীমার বাড়ী হাজির।
জটি পিসীমা সবেমাত্র সদর দোর খুলে দোরগোড়ায় জলের ধারা দিচ্ছেন, ওকে এত সকালে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “কিরে খোকা?”
গোপাল একগাল হেসে বললে, “তোমার জন্যে তাল এনিচি পিসীমা!”
জটি পিসীমা আর কিছু না বলে তাল দুটো হাতে করে নিয়ে বাড়ীর ভেতরে চলে গেলেন।
গোপাল একবার ভাবলে, তালনবমী কবে জিগ্যেস করে; কিন্তু সাহসে কুলোয় না তার। সারাদিন গোপালের মন খেলাধুলোর ফাঁকে কেবলই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। ঘন বর্ষার দুপুরে, মুখ উঁচু করে দেখে –নারকোল গাছের মাথা থেকে পাতা বেয়ে জল ঝরে পড়চে, বাঁশ ঝাড় নুয়ে পড়চে বাদলার হাওয়ায়, বকুলতলার ডোবায় কট্কটে ব্যাঙের দল থেকে থেকে ডাকছে।
গোপাল জিগ্যেস করলে, “ব্যাঙগুলে আজকাল তেমন ডাকে না কেন মা?”
গোপালের মা বলেন, “নতুন জলে ডাকে, এখন পুরোনো জলে তত আমোদ নেই ওদের।”
“আজ কি বার, মা?”
“সোমবার। কেন রে? বারের খোঁজে তোর কি দরকার ?”
“মঙ্গলবারে তালনবমী, না মা?”
“তা হয়তো হবে। কি জানি বাপ! নিজের হাঁড়িতে চাল জোটে না, তালনবমীর খোঁজে কি দরকার আমার?”
সারাদিন কেটে গেল। নেপাল বিকেলের দিকে জিগ্যেস করলে, “জটি পিসীমার বাড়ীতে তাল দিইছিলি আজ সকালে ? কোথায় পেলি তুই? আমি তাল দিতে গেলে পিসী বললেন, ‘তাল, গোপাল তাল দিয়ে গেছে, পয়সা নেয় নি।’—কেন দিতে গেলি তুই ? একটা পয়সা হ’লে দুজনে মুড়ি কিনে খেতাম!”
“ওরা নেমতন্ন করবে, দেখিস দাদা, কাল তো তালনবমী!”
“সে এমনিই নেমন্তন্ন করবে, পয়সা নিলেও করবে। এই একটা বোকা!”
“আচ্ছা দাদা, কাল তো মঙ্গলবার না?”
“হুঁ”।
রাত্রে উত্তেজনায় গোপালের ঘুম হয় না। বাড়ীর পাশের বড় বকুল গাছটায় জোনাকির ঝাঁক জ্বলচে ; জানালা দিয়ে সেদিকে চেয়ে চেয়ে সে ভাবে—কাল সকালটা হ’লে হয়। কতক্ষণে যে রাত পোহাবে!..
জটি পিসীমা আদর করে ওকে বললেন খাওয়ানোর সময়, “খোকা, কাঁকুড়ের ডালনা আর নিবি? মুগের ডাল বেশি করে মেখে নে।” জটি পিসীমার বড় মেয়ে লাবণ্য-দি একখানা থালায় গরম-গরম তিল-পিটুলি ভাজা এনে ওর সামনে ধরে হেসে বললে, “খোকা, ক’খানা নিবি তিল-পিটুলি ?” বলেই লাবণ্য-দি থালাখানা উপুড় করে তার পাতে ঢেলে দিলে। তার পর জটি পিসীমা আনলেন পায়েস আর তালের বড়া। হেসে বললেন, “খোকা যাই তাল কুড়িয়ে দিয়েছিল, তাই পায়েস হ’ল!….খা, খা-খুব খা — আজ যে তালনবমী রে!”…কত কি চমৎকার ধরনের রাধা তরকারির গন্ধ বাতাসে! খেজুর গুড়ের পায়েসের সুগন্ধ-বাতাসে! গোপালের মন খুশি ও আনন্দে ভরে উঠলো। সে বসে বসে খাচ্ছে, কেবলই খাচ্ছে!……সবারই খাওয়া শেষ, ও তবুও খেয়েই যাচ্ছে….. লাবণ্য-দি হেসে হেসে বলছে, “আর নিবি তিল-পিটুলি?”
“ও গোপাল?”
হঠাৎ গোপাল চোখ মেলে চেয়ে দেখলে—জানলার পাশে বর্ষার জলে ভেজা ঝোঁপঝাড়, তাদের সেই আতা গাছটা…সে শুয়ে আছে তাদের বাড়ীতে। মার হাতের মৃদু ঠেলায় ঘুম ভেঙেচে, মা পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, “ওঠ, ওঠ, বেলা হয়েচে কত! মেঘ করে আছে। তাই বোঝা যাচ্ছে না।”
বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে সে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল। “আজ কি বার মা…?”
“মঙ্গলবার।”
তাও তো বটে! আজই তো তালনবমী! ঘুমের মধ্যে ওসব কি হিজিবিজি স্বপ্ন সে দেখছিল!
বেলা আরও বাড়লো, ঘন মেঘাচ্ছন্ন বর্ষার দিনে যদিও বোঝা গেল না বেলা কতটা হয়েছে। গোপাল দরজার সামনে একটা কাঠের গুড়ির ওপর ঠায় বসে রইলো। বৃষ্টি নেই একটুও, মেঘ-জমকালো আকাশ। বাদলের সজল হাওয়ায় গা সিরসির করে। গোপাল আশায় আশায় বসে রইলো বটে, কিন্তু কই, পিসীমাদের বাড়ী থেকে কেউ তো নেমন্তন করতে এলো না!
অনেক বেলায় তাদের পাড়ার জগবন্ধু চক্কোত্তি তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে সামনের পথ দিয়ে কোথায় যেন চলেছেন। তাদের পেছনে রাখাল রায় ও তার ছেলে সানু ; তার পেছনে কালীবর বাঁড়ুয্যের বড় ছেলে পাঁচু, আর ও-পাড়ার হরেন …
গোপাল ভাব্লে এরা যায় কোথায় ?
এ-দলটি চলে যাবার কিছু পরে বড়ো নবীন ভট্চাজ ও তার ছোট ভাই দীনু সঙ্গে একপাল ছেলেমেয়ে নিয়ে চলেছে।
দীনু ভটচাজের ছেলে কুড়োরাম ওকে দেখে বললে, “এখানে বসে কেন রে? যাবিনে?”
গোপাল বললে, “কোথায় যাচ্ছিস তোরা ?”
“জটি পিসীমাদের বাড়ী তালনবমীর নেমন্তন্ন খেতে। করে নি তোদের? ওরা বেছে বেছে বলেছে কি না, সবাইকে তো বলেনি……”
গোপাল হঠাৎ রাগে, অভিমানে যেন দিশাহারা হয়ে গেল। রেগে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “কেন করবে না আমাদের নেমন্তন্ন ? আমরা এর পরে যাবো……”
রাগ করবার মত কি কথা সে বলেচে বুঝতে না পেরে কুড়োরাম অবাক হয়ে বললে, “বারে! তা অত রাগ করিস কেন? কি হয়েছে?”
ওরা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে গোপালের চোখে জল এসে পড়লো—বোধ হয় সংসারের অবিচার দেখেই। পথ চেয়ে সে বসে আছে কদিন থেকে! কিন্তু তার কেবল পথ চাওয়াই সার হল? তার সজল ঝাপ্সা দৃষ্টির সামনে পাড়ার হার, হিতেন, দেবেন, গুট্কে তাদের বাপ-কাকাদের সঙ্গে একে একে তার বাড়ীর সামনে দিয়ে জটি পিসীমাদের বাড়ীর দিকে চলে গেল…