Bou Chandir Math by Bibhutibhushan Bandopadhyay: বাঙালি সাহিত্যের সমৃদ্ধ ভাণ্ডারে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থান অনন্য। তার রচনাগুলির মধ্যে “বউ-চণ্ডীর মাঠ” একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই কাহিনীটি গ্রামীণ বাংলার জীবন ও সংস্কৃতির একটি সূক্ষ্ম প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার অসামান্য বর্ণনাশৈলীর মাধ্যমে পাঠকদের এমন এক জগতে নিয়ে যান, যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য, মানবিক সম্পর্ক ও জীবন সংগ্রামের চিত্র এক অনবদ্য রূপে ফুটে উঠেছে। “বউ-চণ্ডীর মাঠ” কেবলমাত্র একটি কাহিনী নয়, এটি বাংলার মানুষের হৃদয়ের স্পন্দনকে ছুঁয়ে যাওয়া একটি শিল্পকর্ম। পাঠকদের এই গল্পটি পড়ে যেমন আনন্দ হবে, তেমনই তাদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব বিস্তার করবে।
Bou Chandir Math by Bibhutibhushan Bandopadhyay
Table of Contents
গ্রামের বাঁওড়ের মধ্যে নৌকো ঢুকেই জল-ঝাঁঝির দামে আটকে গেল।
কানুনগো হেমেনবাবু বললেন—বাবলা গাছটার গায়ে কাছি জড়িয়ে বেঁধে নাও…
বাইরের নদীতে ভাটার টান ধরেছে, নাটা-কাঁটার ঝোপের নীচের জল সরে গিয়ে একটু একটু করে কাদা বার হচ্ছে।
হেমেনবাবু বললেন—একটুখানি নেমে দেখবেন না কোথায় পিন ফেলা হয়েছে? যত শিগগির খানাপুরীটা শেষ হয়ে যায়…
এমন সুন্দর বিকালটাতে আর কাজ করতে ইচ্ছা হল না। পিছনের নৌকো থেকে লোকজনেরা নেমে জায়গা ঠিক করে সেখানে তাঁবু ফেলবে। জরিপের বড়ো সাহেবের শিগগির সদর থেকে আসবার কথা আছে, কাজেই যত তাড়াতাড়ি কাজ আরম্ভ হয়, সকলের সেই দিকে ঝোঁক। সাব ডেপুটি নৃপেনবাবু কাজ শেখবার জন্যে এইবার প্রথম খানাপুরীর কাজে এসেছিলেন। বয়স বেশি না, ছোকরা— কিন্তু মাঝনদীতে নৌকো দুললেই তাঁর অত্যন্ত ভয় হচ্ছিল। বোধ হয় ভয়কে ফাঁকি দেবার জন্যেই তিনি এতক্ষণ ছই-এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বার ভান করে শুয়েছিলেন–এবার ডাঙায় নৌকো লাগাতে তিনি ছই-এর ভেতর থেকে বার হয়ে এলেন এবং একটু পরে হেমেনবাবুর সঙ্গে কথায় কথায় কী নিয়ে বেশ একটু তর্ক শুরু করলেন।
নৃপেনবাবুকে বললুম-Tenancy Act-কচকচিতে আর দরকার নেই, তার চেয়ে বরং চলুন নেমে তাঁবুর জায়গা ঠিক করা যাক—কাল সকালেই যাতে কাজ আরম্ভ করা যায়…
চৈত্র মাস যায় যায়। গ্রাম্য নদীটির দু-পাড় ভরে সবুজ সবুজ লতানো গাছে নীল-পাপড়ি বন-অপরাজিতা ফুল ফুটে আছে। বাঁশঝাড় কোথাও জলের ধারে নত হয়ে পড়েছে, তলায় আকন্দ ঘেঁটুফুলের বনফুলের ডালি মাথায় নিয়ে ঝিরঝিরে বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। দু-ধারের রোদ-পোড়া কটা ঘাসওয়ালা মাঠের মাঝে মাঝে পত্র-বিরল বাবলা গাছে গাঙশালিকের ঝাঁক কিচ কিচ কচ্ছে—নদীর বাঁ-পাড়ের গায়ে গর্তের মধ্যে তাদের বাসা। মাকাল-লতার ঝোপের তলায় জলের ধারে কোথাও উঁচু উঁচু বনমুলোর ঝাড়, তাদের কুচো কুচো হলদে ফুল থেকে জায়ফলের মতো একটা ঘন গন্ধ উঠছে।…
বেলা আর একটু পড়লে আমরা সেই বাঁওড়ের ধারের মাঠে তাঁবুর জায়গা কোথায় ঠিক হবে দেখতে গেলুম। নদীর ধার থেকে গ্রাম একটু দূর হলেও গ্রামের মেয়েরা নদীতেই জল নিতে আসে। আমাদের যেখানে নৌকোখানা বাঁধা হয়েছিল, তার বাঁ-ধারে খানিকটা দূরে মাটিতে ধাপ-কাটা কাঁচা ঘাট। গ্রামের একজন বৃদ্ধ বোধ হয় নদীতে গ্রীষ্মের দিনের বৈকালে স্নান করতে আসছিলেন, তাঁকে আমরা জিজ্ঞাসা করলুম-রসুলপুর কোন গাঁ-খানার নাম মশাই? সামনের এটা, না ওই পাশে?
তিনি বললেন—আজ্ঞে না, এটা হল কুমুরে, পাশের ওটা আমডাঙা-রসুলপুর হল এ গাঁ-গুলোর পেছনে, কোশ দুই তফাত—আপনারা?
আমাদের পরিচয় শুনে বৃদ্ধ বললেন—এই মাঠটাতেই আপনারা তাঁবু ফেলবেন? আপনাদের জরিপের কাজ শেষ হতেও তো পাঁচ-ছয় মাস…
আমরা বললুম—তা তো হবেই, বরং তার বেশি…
বৃদ্ধ বললেন—এখানটা একটা ঠাকুরের স্থান, গাঁয়ের মেয়েরা পুজো দিতে আসে, বরং আর একটু সরে গিয়ে নদীর মুখের দিকে তাঁবু ফেলুন, নইলে মেয়েদের একটু অসুবিধে…
বৃদ্ধের নাম ভুবন চক্রবর্তী। জরিপ আরম্ভ হয়ে গেলে নিজের দরকারে চক্রবর্তী মশায় দলিলপত্র বগলে অনেকবার তাঁবুতে যাতায়াত শুরু করে দিলেন, সকলের সঙ্গে তাঁর বেশ মেশামেশি ও আলাপ পরিচয় হয়ে গেল। তাঁর পৈতৃক জমা-জমি অনেকে নাকি ফাঁকি দিয়ে দখল করেছে, আমাদের সাহায্যে এবার যদি সেগুলোর একটা গতি হয়—এইসব ধরনের কথা তিনি আমাদের প্রায়ই শোনাতেন।
আমি সেখানে বেশিদিন ছিলুম না। খানাপুরীর কাজ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে, আমি সেদিনই জেলায় ফিরব—জোয়ারের অপেক্ষায় নৌকো ছাড়তে দেরি হতে লাগল। চক্রবর্তী মশায়ও সেদিন উপস্থিত ছিলেন। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলুম, এটাকে বউ-চণ্ডীর মাঠ বলে কেন চক্কত্তি মশাই? আপনাদের কী কোনো…
নৃপেনবাবুও বললেন—ভালো কথা, বলুন তো চক্রবর্তী মশাই, বউ-চণ্ডী আবার কী কথা—শুনিনি তো কখনো!
আমাদের প্রশ্নের উত্তরে চক্রবর্তী মশায়ের মুখে একটা অদ্ভুত গল্প শুনলুম। তিনি বলতে লাগলেন—শুনুন তবে, এটা সেকালের গল্প। ছেলেবেলায় আমার ঠাকুরমার কাছ থেকে শোনা। এ অঞ্চলের অনেক প্রাচীন লোকে এ গল্প জানে।
সেকালে এ গ্রামে একঘর সম্পন্ন গৃহস্থ বাস করতেন। এখন আর তাদের কেউ নেই, তবে আমি যে সময়ের কথা বলছি সে-সময় তাঁদের বড়ো শরিক পতিতপাবন চৌধুরী মহাশয়ের খুব নামডাক ছিল।
এই পতিতপাবন চৌধুরী মহাশয় যখন তৃতীয় পক্ষের বিয়ে করে বউ ঘরে আনলেন, তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে গিয়েছে। এমন যে বিশেষ বয়স তা নয়, বিশেষত ভোগের শরীর—পঞ্চাশ বছর বয়স হলেও চৌধুরী মশায়কে বয়সের তুলনায় অনেক ছোটো দেখাত। বউ দেখে বাড়ির সকলেই খুব সন্তুষ্ট হল। তৃতীয় পক্ষের বউ বলে চৌধুরীমশায় একটু ডাগর মেয়ে দেখেই বিয়ে করেছিলেন, নতুন বউয়ের বয়স ছিল প্রায় সতেরোর কাছাকাছি। বউয়ের মুখের গড়নটি বড়ো সুন্দর, মুখের ছাঁচ যেন হরতনের টেক্কাটির মতো। চোখদুটি বেশ ডাগর, ভাসা ভাসা মুখে চোখে ভারি একটা শান্ত ভাব। নতুন বউয়ের কাজকর্ম আর ধীর শান্তভাব দেখে পাড়ার লোকে বললে, এরকম বউ এ গাঁয়ে আর আসেনি। সে মাটির দিকে চোখ রেখে ছাড়া কথা বলে না, অল্প-বয়সের খুড়-শাশুড়িদলের সামনেও ঘোমটা দেয়; সকলে বললে, যেমন লক্ষ্মীর মতো রূপ তেমনই গুণ।
মাস দুই-তিন পরে কিন্তু একটা বড়ো বিপদ ঘটল। সকলে দেখলে বউটির আর সব ভালো বটে, একটা কিন্তু বড়ো দোষ। সে কিছুতেই স্বামীর ঘেঁষ নিতে চায় না, প্রাণপণে এড়িয়ে চলতে চায়। প্রথম প্রথম সকলে ভেবেছিল, নতুন বিয়ে হয়েছে, ছেলেমানুষ, বোধহয় সেইজন্যই এ রকম করে! ক্রমে কিন্তু দেখা গেল স্বামী কেন, যেকোনো পুরুষমানুষ দেখলেই সে কেমন ভয়ে কাঁপে। বাড়িতে যেদিন যজ্ঞি কী কোনো বড়ো কাজকর্মে বাইরের লোকের ভিড় হয়, সেদিন সে ঘর থেকে আর বারই হয় না। স্বামীর ঘরে কিছুতেই তো যেতে রাজি হয় না,
মাসে দু-দিন কী একদিন সকলে আদর করে গায়ে হাত বুলিয়ে পাঠাতে যায়, সে জনেজনের পায়ে পড়ে, এর-ওর কাছে কাকুতিমিনতি করে, কিছুতেই বুঝ মানে না। পুরুষমানুষের গলার স্বর শুনলেই কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে পড়ে।
অনেক করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সকলে তাকে একদিন স্বামীর ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে দোরে শিকল বন্ধ করে দিল। চৌধুরীমশায় অনেক রাত্রে ঘরে ঢুকে দেখেন, তাঁর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী ঘরের এককোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে। এর পর আর কিছুতেই কোনো দিন সে স্বামীর ঘরে যেতে চাইত না, বাড়িসুদ্ধ লোকের হাতেপায়ে পড়ে বেড়াতে লাগল; সকলকে বলে—আমার বড় ভয় করে, আমায় ওরকম করে আর পাঠিও না…তোমাদের পায়ে পড়ি।…
বোঝাতে বোঝাতে বাড়ির লোক হয়রান হয়ে গেল।
দিনকতক গেল, একদিন তাকে সকলে মিলে জোর করে স্বামীর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বার থেকে দোর বন্ধ করে দিলে। তারা ঠিক করলে এইরকম দিতে দিতে ক্রমে লজ্জা ভাঙবে—নইলে কতদিন আর এ ন্যাকামি ভালো লাগে?…ভোরে উঠে সকলে দেখলে ঘরের মধ্যে বউ নেই, বাড়ির কোথাও নেই। নিকটেই বাপেরবাড়ির গাঁ, সেখানে পালিয়ে গিয়েছে ভেবে লোক পাঠানো গেল। লোক ফিরে এল, সে সেখানে যায়নি। তখন সকলে বললে—পুকুরে ডুবে মরেছে; পুকুরে জাল ফেলা হয়, কোনো সন্ধান মেলে না। বউয়ের কচি মুখের ও নিরীহ চোখের ভাব মনে হয়ে লোকের মনে অন্য কোনো সন্দেহ জাগবার অবকাশ পেল না। কত দিকে কত সন্ধান করে যখন কোন খোঁজই মিলল না, চৌধুরীমশায় মানসিক শোক নিবারণ করবার জন্যে চতুর্থ পক্ষের স্ত্রী ঘরে আনলেন।
অজ পাড়া-গাঁ, নতুন কিছু একটা বড়ো ঘটে না, অনেকদিন এটা নিয়ে নাড়াচাড়া চলল, তারপর ক্রমে সেটা কেটে গিয়ে গ্রাম ঠান্ডা হল। এই মাঠের পুবধারে গ্রামের মধ্যেই চৌধুরীদের বাড়ি ছিল। তখন এইখান দিয়েই নদীর স্রোত বইতমজে বাঁওড় হয়ে গিয়েছে তো সেদিন, আমরা ছেলেবেলাতেও ধান বোঝাই নৌকো চলাচল হতে দেখেছি। ক্রমে চৌধুরীদের সব মরে–হেজে গেল, শেষপর্যন্ত বংশে একজন কে ছিল, উঠে গিয়ে অন্য কোথাও বাস করলে। এসব অনেক বছর আগেকার কথা, সত্তর-আশি বছর খুব হবে। সেই থেকে কিন্তু আজ পর্যন্ত এইসব মাঠে বড়ো এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে শোনা যায়।
এই ফাল্গুন-চৈত্র মাসে যখন খুব গরম পড়ে, তখন রাখালেরা গোরু চরাতে এসে দূর থেকে কতদিন দেখেছে, মাঠের ধারে বনের মধ্যে নিভৃত দুপুরে বাঁশবনের ছায়ায় কে যেন শুয়ে আছে, কাছে গেলে কেউ কখনো দেখতে পায়নি।…কতদিন সন্ধ্যার সময় তারা গোরুর দল নিয়ে গ্রামের মধ্যে যেতে যেতে শুনেছে, অন্ধকার ঝোপের মধ্যে যেন একটা চাপা কান্নার রব উঠছে।…সমুখ জ্যোৎস্নারাত্রে অনেকে নদীর ঘাট থেকে ফেরবার পথে ছাতিমগাছের নীচু ডালের তলা দিয়ে যেতে যেতে দেখেছে, দূর মাঠে সন্ধ্যার আবছায়া জ্যোৎস্নার মধ্যে দিয়ে সাদা কাপড় পরে কে যেন ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছে—তার সমস্ত গায়ের সাদা কাপড়ে জ্যোৎস্না পড়ে চিকচিক করতে থাকে।…মাঠে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, তখন ফুলেভরা নাগকেশর গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখলে মনে হয়, কে খানিকটা আগে এখানে দাঁড়িয়ে ডাল নীচু করে ফুল পেড়ে নিয়ে গিয়েছে…তার ছোটে ছোটো পায়ের দাগ, ঝোপ যেখানে বড়ো ঘন সেদিকেই চলে গিয়েছে।…
মাঠের ধারে এই ছাতিমগাছের তলায় উলো-চণ্ডীতলা। চৈত্র সংক্রান্তিতে গ্রামবধূরা পিঠে, কাঁচা দুধ আর নতুন আখের গুড় নিয়ে বউ-চণ্ডীর পূজো দিতে আসে। বউ-চণ্ডী সকলের মঙ্গল করেন, অসুখ হলে সারিয়ে দেন, নতুন প্রসূতির স্তনে দুধ শুকিয়ে গেলে, ওঁর কাছে পুজো দিলে আবার দুধ হয়। কচি ছেলের সর্দি সারে, ছেলে বিদেশে থাকবার সময় চিঠি আসতে দেরি হলে পুজো মানত করবার পরই শিগগির সুসংবাদ আসে। মেয়েদের বিপদে-আপদে তিনিই সকলকে বিপদ আপদ থেকে উদ্ধার করে থাকেন।…
চক্রবর্তী মহাশয়ের গল্প শেষ হল। তারপর আরও নানা কথাবার্তার পর তিনি ও আর সকলে উঠে চলে গেলেন।
বেলা বেশ পড়ে এসেছে। সন্ধ্যার বাতাসে ছাতিম বনে সুর সুর শব্দ হচ্ছে। গ্রামের মাঠটা অনেকদ্দূর পর্যন্ত উঁচু-নীচু ঢিবি আর ঘেঁটুফুলের বনে একেবারে ভরা। বাঁ-দিকে দূরে একটা পুরোনো ইটের পাঁজার খানিকটা ঘন জিউলি গাছের সারির মধ্যে দিয়ে চোখে পড়ে।
নৌকোর গলুই-এ বসে আসন্ন সন্ধ্যায় আশি বছর আগেকার পলাতকা গ্রাম্যবধূর ইতিহাসটা ভাবতে লাগলুম। মাঠের মাঝে উঁচু ঢিবির ওপরকার ঘেঁটুফুলের ঘন বনের দিকে চেয়ে মনে হল যে—সারা দিনমান সে হয়তো ওর মধ্যে লুকিয়ে বসে
থাকে, কেবল গভীর রাত্রে লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে আসে, মাঠের মধ্যেও বটগাছের তলায় চুপ করে বসে আকাশের তারার দিকে চায়।…পাশের ঝোপের ফুটন্ত বন-অপরাজিতা ফুলের রং-এর সঙ্গে রং মিলিয়ে নদী বয়ে যায়…ছাতিম বনের পাখিরা ঘুমের ঘোরে গান গেয়ে ওঠে—ওপার থেকে হু-হু করে হাওয়া বয়…সে ভয়ে ভয়ে মাঝে মাঝে পুব দিকে চেয়ে দেখে ভোরের আলো ফোটবার দেরি কত!…
সন্ধ্যা হয়ে গেল। বনের ওপর নবমীর চাঁদ উঠল। একটু পরেই জোয়ার পেয়ে আমাদেরঃনৌকো ছাড়া হল। জলের ধারের আঁধারভরা নিভৃত ঝোপের মধ্যে থেকে সত্যিই যেন একটা চাপাঃকান্নার রব পাওয়া যাচ্ছিল—সেটা হয়তো কোনো রাতজাগা বনের পাখির, কী কোনো পতঙ্গের ডাক।
বাঁওড়ের মুখ পার হয়ে যখন আমরা বাইরের নদীতে এসে পড়েছি, তখন পিছন ফিরে চেয়ে দেখি নির্জন গ্রামের মাঠে সাদা কুয়াশায় ঘোমটা দেওয়া ঝাপসা জ্যোৎস্নারাত্রি অল্পে অল্পে লুকিয়ে চোরের মতো আত্মপ্রকাশ করছে, অনেককাল আগেকার সেই লজ্জা-কুণ্ঠিতা ভীরু পল্লিবধূটির মতো!…