আদায় কাঁচকলায় – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় 2024 l Aday Kachkolay By Sharadindu Bandyopadhyay

By raateralo.com

Updated on:

আদায় কাঁচকলায় l Aday Kachkola By Sharadindu Bandyopadhyay

আদায় কাঁচকলায়: বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ব্যোমকেশ বক্সীর স্রষ্টা হিসেবে সুপরিচিত, তাঁর লেখনীর আরেকটি রূপ আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন “আদায় কাঁচকলায়” গল্পে। এই গল্পটি শুধু পাঠকদের মনোরঞ্জন করে না, বরং আমাদের সমাজের গভীর সত্যগুলিকে হাস্যরসের মাধ্যমে প্রতিফলিত করে। ‘আদায় কাঁচকলায়’ গল্পের মধ্য দিয়ে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সমাজের নানা সমস্যা ও মানুষের অদ্ভুত আচরণকে মজার ছলে তুলে ধরেছেন, যা আমাদেরকে হাসতে হাসতে চিন্তা করতে বাধ্য করে। চলুন, এই ব্লগে আমরা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্মের এই অনন্য দিকটি বিশ্লেষণ করি এবং ‘আদায় কাঁচকলায়’ গল্পের মজাদার দিকগুলি আবিষ্কার করি।

Aday Kachkolay By Sharadindu Bandyopadhyay l বাংলা সাহিত্যের মজার গল্প l আদায় কাঁচকলায়

এতদিন যাহা শহরসুদ্ধ লোকের হাসি-ঠাট্টার বিষয় ছিল, তাহাই হঠাৎ অত্যন্ত ঘোরালো ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আদা বাঁড়ুয্যের কন্যা নেড়ীকে লইয়া কাঁচকলা গাঙ্গুলীর পুত্র বদাই উধাও হইয়াছে। শুধু তাই নয়—

কিন্তু ব্যাপারটা আরও আগে হইতে বলা দরকার।

শহরের এক প্রান্তে নির্জন রাস্তার ধারে ঘেঁষাঘেঁষি দুটি বাড়ি। পঞ্চাশ বছর আগে শহরের পৌরসঙঘ বোধ করি হাত-পা ছড়াইবার মানসে এইদিকে হাত বাড়াইয়াছিল, তারপর কী ভাবিয়া আবার হাত গুটাইয়া লইয়াছে। অনাদৃত পথের পাশে কেবল দুটি বাড়ি একঘরে ভাবে দাঁড়াইয়া আছে। পিছনে এবং সামনে ঘন জঙ্গল।

বাড়ি দুটি করিয়াছিলেন দুই বন্ধু। তাঁহারা বহুকাল গত হইয়াছেন; তাঁহাদের দুই ছেলে এখন বাড়ি দুটিতে বাস করিতেছেন এবং পৈতৃক বন্ধুত্বের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পরস্পর শত্রুতা করিতেছেন। শহরের লোক তাঁহাদের নামকরণ করিয়াছেন—আদা বাঁড়ুয্যে এবং কাঁচকলা গাঙ্গুলী।

কলহের কোনও হেতু ছিল না; একমাত্র গা ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া বাস করাই কলহের কারণ বলিয়া ধরা যাইতে পারে। আদা বাঁড়ুয্যের ছাগল যদি কাঁচকলা গাঙ্গুলীর পালং শাকে মুখ দেয় অমনি শহরে ঢি ঢি পড়িয়া যায়; আবার কাঁচকলা গাঙ্গুলীর একমাত্র বংশধর বদাই যদি বাঁড়ুয্যে-কন্যা নেড়ীকে জানালায় দেখিয়া চক্ষু মিটিমিটি করে, তাহা হইলে এই দুর্বৃত্ততার খবর কাহারও অবিদিত থাকে না। ভাগ্যক্রমে দুইজনেই বিপত্নীক, নহিলে দুই গিন্নীর সঙ্ঘর্ষে পাড়ায় কাক-চিল বসিতে পাইত না।

মহকুমা শহর, আকারে ক্ষুদ্র; চারিদিকে জঙ্গল। মাঝে মাঝে চুরি-ডাকাতিও হয়। আদা বাঁড়ুয্যে পৌরসঙেঘর কেরানী। দীর্ঘকাল কেরানীগিরি করিয়া তাঁহার শরীর কৃশ ও মেজাজ রুক্ষ হইয়াছে। উপরন্তু বাড়িতে অবিবাহিতা বয়স্থা কন্যা এবং পাশের বাড়িতে অবিবাহিত শত্ৰুপুত্র। বাঁড়ুয্যের বদ-মেজাজের জন্য তাঁহাকে দোষ দেওয়া যায় না।

কাঁচকলা গাঙ্গুলীর শহরে একটি মনিহারীর দোকান আছে। হৃষ্টপুষ্ট মজবুত চেহারা, গালভরা হাসি। বাঁড়ুয্যে ছাড়া আর কাহারও সহিত তাঁহার বিবাদ নাই। সকলের সঙ্গেই দাদা-ভাই সম্পর্ক।

দুজনেই মধ্যবিত্ত গৃহস্থ, অতি সাধারণ অবস্থা।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুক রচনা l শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় গল্প

আদা বাঁড়ুয্যে সকালবেলা আপিস যান; পথে যাইতে যাইতে হয়তো দেখেন কাঁচকলা গাঙ্গুলীর দোকানের সামনে কয়েকজন ছোকরা উত্তেজিতভাবে জটলা করিতেছে। গাঙ্গুলীর দোকানে প্রত্যহ সকালবেলা খবরের কাগজের আড্ডা বসে; কিন্তু আজ যেন উত্তেজনা কিছু বেশী। নানাপ্রকার জল্পনাকল্পনা চলিতেছে, গাঙ্গুলীও দোকানে থাকিয়া আলোচনায় যোগ দিয়াছেন। একজন ছোকরা বাঁড়ুয্যেকে দেখিতে পাইয়া বলিয়া উঠে—এই যে বাঁড়ুয্যে-দা, খবর শুনেছেন? পেরুমল মারোয়াড়ীর গদিতে কাল রাত্রে ডাকাতি হয়ে গেছে।

বাঁড়ুয্যে স্বভাবসিদ্ধ রুক্ষতার সহিত বলেন—বটে, ডাকাত ধরা পড়েছে?

একজন বলে—ডাকাত কোথায়, পুলিস পৌঁছুবার আগেই পেরুমলের যথাসর্বস্ব নিয়ে কেটে পড়েছে।

বাঁড়ুয্যে বলেন—পুলিসের চোখ থাকলে ডাকাত ধরতে পারত। এ শহরে ডাকাতের মতো চেহারা কার তা সবাই জানে। বলিয়া গাঙ্গুলীর দিকে বক্র কটাক্ষপাত করিয়া চলিতে আরম্ভ করেন।

ছেলেরা হাসিয়া উঠে। গাঙ্গুলী দোকান হইতে গলা বাড়াইয়া বলেন—তোমাদের বাড়ি থেকে যদি কখনো ঘটি-বাটি চুরি যায়, কে চুরি করেছে বলতে হবে না। ছিচকে চোরের মতো চেহারা শহরে একটাই আছে।

বাঁড়ুয্যে শুনিতে পাইলেও কানে তোলেন না, হন্ হন্ করিয়া আপিসের দিকে চলিয়া যান।

এইভাবে চলিতেছে। কলহের কটুকাটব্য কখনও বা থানা পর্যন্ত পৌঁছয়। থানার দারোগা উভয়ের পরিচিত, সহাস্য সহানুভূতির সহিত নালিশ চাপা দেন।

কিন্তু হঠাৎ পরিস্থিতি ঘোরালো হইয়া দাঁড়াইয়াছে। উপর্যুপরি দুইটি ঘটনা ঘটিয়া শহরসুদ্ধ লোককে সচকিত করিয়া তুলিয়াছে।

প্রত্যহ সন্ধ্যায় পোস্ট আপিসের ঠেলাগাড়ি চিঠিপত্র লইয়া স্টেশনে যায়। স্টেশন ও ডাকঘরের মাঝে মাইলখানেক রাস্তার ব্যবধান; তাহার মধ্যে খানিকটা রাস্তা জঙ্গলের ভিতর দিয়া গিয়াছে। সেদিন ঠেলাগাড়ি যথাসময়ে স্টেশনে যাইতেছিল, সঙ্গে ছিল তিনজন পিওন। জঙ্গলের মধ্যে দিয়া যাইবার সময় হঠাৎ একটা মুখোশ-পরা ডাকাত দমাদ্দম বোমা ফাটাইতে ফাটাইতে তাহাদের আক্রমণ করিল; তাই দেখিয়া পিওন তিনজন ঠেলাগাড়ি ফেলিয়া থানার অভিমুখে ধাবিত হইল।

পুলিস আসিয়া দেখিল, বোমারু ডাকাত একটি ব্যাগ কাটিয়া রেজেস্ট্রি ইন্সিওরের খামগুলি লইয়া গিয়াছে। একজন পিওন দূর হইতে ডাকাতকে দেখিয়াছিল, মুখ দেখিতে না পাইলেও চেহারাটা তাহার চেনা-চেনা মনে হইয়াছিল। অনেকটা যেন কাঁচকলা গাঙ্গুলীর মতো।

রাত্রি আন্দাজ আটটার সময় দারোগা সদলবলে গাঙ্গুলীর বাড়িতে হানা দিলেন। গাঙ্গুলী সরকারী মেলব্যাগ লুঠ করিয়াছেন, একথা পুরাপুরি বিশ্বাস না করিলেও একটা কিছু করা দরকার। কিন্তু সেখানে উপস্থিত হইয়া দারোগা যে ব্যাপার দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার চক্ষু কপালে উঠিয়া গেল। গাঙ্গুলীর দরজার সম্মুখে বাঁড়ুয্যে এবং গাঙ্গুলীতে তুমুল ঝগড়া বাধিয়া গিয়াছে। উভয়ে পরস্পরকে যে ভাষায় সম্বোধন করিতেছেন, তাহা ভদ্রসমাজে অপ্রচলিত। দুজনের হাতেই লাঠি। লাঠালাঠি বাধিতে আর দেরি নাই।

দারোগাকে দেখিয়া বাঁড়ুয্যে ছুটিয়া আসিয়া তাঁহার হাত ধরিলেন। বলিলেন—দারোগাবাবু, এসেছেনধরুন ব্যাটাকে। কড়াক্কড় করে বেঁধে নিয়ে যান।

হতভম্ব দারোগা বলিলেন—কি হয়েছে?

বাঁড়ুয্যে বলিলেন—আমার সর্বনাশ করেছে হতভাগা। বাপ-ব্যাটায় সড় করে আমার মেয়েকে কুলত্যাগিনী করেছে। আমার জাত মেরেছে।

গাঙ্গুলী বলিলেন—মিছে কথা—মিছে কথা। আমার ছেলে একটা পঞ্চান্নর গাড়িতে বর্ধমান গেছে মামার বাড়িতে। কোন্ শালা বলে— ইত্যাদি।

বাঁড়ুয্যে বলিলেন—দারোগাবাবু, এই দেখুন চিঠি। আমার মেয়ে কি লিখে রেখে গেছে। দেখুন।

দারোগা চিঠি পড়িলেন। তাহাতে লেখা ছিল—

বাবা, গাঙ্গুলী মশাইয়ের ছেলের সঙ্গে তুমি তো আমার বিয়ে দেবে না, তাই আমি ওর সঙ্গে পালিয়ে চললুম। প্রণাম নিও।
ইতি—নেড়ী।

দারোগা মাথা নাড়িয়া বলিলেন—আপনার মেয়ে নাবালিকা নয়। সে যদি নিজের ইচ্ছেয় কারুর সঙ্গে পালিয়ে থাকে, আমরা কিছু করতে পারি না। আপনি কখন জানতে পারলেন?

বাঁড়ুয্যে বলিলেন—ছটার সময় আপিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি, এই চিঠি রয়েছে, মেয়ে নেই। ঐ নচ্ছার গাঙ্গুলীটা ঘরের মধ্যে লুকিয়ে বসেছিল, দোর ঠেলাঠেলি করে বার করলুম। এতবড় বেহায়া, বলে তোমার মেয়ের খবর আমি জানি না, আমার ছেলে মামার বাড়ি গেছে। চোর-ডাকাত—বোম্বেটে।

দারোগা জিজ্ঞাসা করিলেন—সেই ছটা থেকে আপনারা ঝগড়া করছেন?

বাঁড়ুয্যে বলিলেন—সেই ছটা থেকে; এখনও জল দিইনি মুখে। আমার গায়ে যদি জোর থাকত, ঘাড় ধরে শালাকে থানায় নিয়ে যেতুম।

দারোগা চিন্তা করিলেন। রাস্তায় ডাকাতি হইয়াছে সাতটার সময়। এদিকে আদা ও কাঁচকলার ঝগড়া বাধিয়াছে ছটার সময়। সুতরাং পিওনটা ভুল করিয়াছে সন্দেহ নাই। তবু

দারোগা বলিলেন—গাঙ্গুলী মশাই, আপনার বাড়ি আমরা খানাতল্লাশ করব।

গাঙ্গুলী বলিলেন—আসতে আজ্ঞা হোক। আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখুন, ওর মেয়ের গন্ধ যদি আমার বাড়িতে পান, আমি বেগের গাঙ্গুলী নই।

দারোগা ও তাঁহার সাঙ্গোপাঙ্গ গাঙ্গুলীর বাড়ি তল্লাশ করিল। দারোগা অবশ্য বাঁড়ুয্যেকন্যাকে। খুঁজিতেছিলেন না; কিন্তু তিনি যাহা খুঁজিতেছিলেন, তাহাও পাওয়া গেল না। চোরাই ইন্সিওর চিঠিগুলির চিহ্নমাত্র গাঙ্গুলীর বাড়িতে নাই। প্রস্থানকালে দারোগা বলিলেন—গাঙ্গুলী মশাই, কিছু মনে করবেন না, আপনার উপর অন্য কারণে সন্দেহ হয়েছিল। শত্তুরের সাক্ষীতে আপনি বেঁচে গেলেন।

গাঙ্গুলী ও বাঁড়ুয্যে যুগপৎ হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

.

গভীর রাত্রে বাঁড়ুয্যের দরজায় টোকা পড়িল।

বাঁড়ুয্যে দ্বার খুলিয়া বলিলেন—এস ভাই—এস।

আদা বাঁড়ুয্যে কাঁচকলা গাঙ্গুলীর হাত ধরিয়া ঘরের মধ্যে তক্তপোশে বসাইলেন। তক্তপোশের উপর অনেকগুলি ইন্সিওর খাম খোলা অবস্থায় পড়িয়াছিল। বাঁড়ুয্যে বলিলেন—কুড়িয়ে বাড়িয়ে দেড় হাজার টাকা হল। তাই বা মন্দ কি?

গাঙ্গুলী বলিলেন-হ্যাঁ ওই টাকায় বদাই কলকাতায় মনিহারীর দোকান খুলতে পারবে।

উভয়ে মধুর হাস্য করিলেন। বাঁড়ুয্যে বলিলেন—তারপর—কোনও গণ্ডগোল হয়নি তো?

গাঙ্গুলী বলিলেন—কিচ্ছু না। দুটো পটকা ছুঁড়তেই পিওন ব্যাটারা মাল ফেলে পালাল।

কিন্তু পুলিস গন্ধ পেয়েছিল।

হুঁ। ভাগ্যিস অ্যালিবাই তৈরি করা গেছল! কিন্তু এবার উঠি। খামগুলো পুড়িয়ে ফেলো বেহাই।

সে আর বলতে–বাঁড়ুয্যে অন্যমনস্কভাবে একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন—বিয়েটা দেখতে পেলুম না এই শুধু দুঃখু।

গাঙ্গুলী ঘড়ি দেখিয়া বলিলেন—পৌনে বারোটায় লগ্ন। তার মানে এতক্ষণ সম্প্রদান হয়ে গেছে। তা দুঃখ কি বেহাই, কালই নাহয় বর্ধমানে গিয়ে মেয়ে-জামাই দেখে এস। আমার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা তো তুমি জানোই।

বাঁড়ুয্যের মুখ আবার প্রফুল্ল হইল। তিনি উঠিয়া গাঙ্গুলীকে আলিঙ্গন করিলেন, বলিলেন—বেহাই, আমি মেয়ের বাপ, আজ তো আমারই খাওয়াবার কথা। তোমার জন্যে ভাল মিষ্টি এনে রেখেছি। চল, খাবে চল।

১২ ভাদ্র ১৩৬০

raateralo.com

Leave a Comment