স্বামী মানেই আসামি শিবরাম চক্রবর্তী l Swami Manei Asami by Shivram Chakraborty 2024

By raateralo.com

Updated on:

স্বামী মানেই আসামি – শিবরাম চক্রবর্তী

নমস্কার পাঠকবৃন্দ,

আজ আমরা আলোচনা করতে চলেছি বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য মণি, শিবরাম চক্রবর্তী লিখিত “স্বামী মানেই আসামি”। শিবরাম চক্রবর্তী, যিনি হাস্যরসের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁর লেখনীতে আমাদের সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন এক অপূর্ব শৈলীতে। “স্বামী মানেই আসামি” তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় রচনা, যেখানে তিনি বাঙালি সমাজের হাস্যকর কিন্তু গভীর বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন।

এই বইটিতে আমরা দেখতে পাই শিবরাম চক্রবর্তীর স্বকীয় রসিকতা, যার মাধ্যমে তিনি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিভিন্ন মজাদার ও কৌতূহলোদ্দীপক দিকগুলি তুলে ধরেছেন। চলুন, এই লেখনীতে ডুবে যাই এবং শিবরাম চক্রবর্তীর রসিকতার মাধুর্য উপভোগ করি।

তাহলে, শুরু করা যাক এই সাহিত্যিক যাত্রা, যেখানে আমরা হাসির মধ্য দিয়ে জীবনের গভীর সত্যকে আবিষ্কার করবো।

স্বামী মানেই আসামি শিবরাম চক্রবর্তী l Swami Manei Asami by Shivram Chakraborty 2024

বীরেনবাবু ধীরে ধীরে বাড়ি ঢুকলেন—চোরের মতো টিপে টিপে। রাত দশটা বেজে গেছে—একজন স্বামীর দন্ডলাভের পক্ষে এই যথেষ্ট প্রমাণ—বীরেনবাবুর তাই এই চোরের দশা।

আসল চোরের পক্ষে অবশ্যি রাত দশটা কিছুই নয়, আসলে তারা যখন খুশি আসতে পারে, যাতায়াতের ব্যাপারে তারা অনেকটা স্বাধীন এবং আপখেয়ালি। একটা চোরের ‘পরগৃহ প্রবেশের’ বেলায় যে স্বাধীনতা আছে, অতটুকুও তার নিজ গৃহে নেই, এই কথা ভেবে বীরেনের দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল।

বীরেনের বউ সেলাই করছিল, চাইল চোখ তুলে, কিছু বলল না। বীরেন কোটটা খুলে রেখে একটু তৈরি হয়েই বসল সোফাটায়। ঝড় যে আসন্ন, মাথার উপর দিয়ে বইবে এক্ষুনি, আবহাওয়া তত্ত্বে অভ্যস্ত হয়ে সেটা জানার তার বাকি ছিল না।

‘আপিসফেরতা সোজা বাড়ি আসব ভেবেছিলুম।’ বউয়ের গলায় গুমোট।—‘জরুরি কোনো কাজে আটকা পড়ে আসতে দেরি হল বুঝি?’

‘আটকা পড়েছিলাম তা সত্যি, তবে বিশেষ যে কোনো কাজে তা না—’ তানা-নানায় শুরু হয় বীরেনের—‘অনেক দিন পরে হরিপদর সঙ্গে দেখা হল। হরিপদ আমার স্কুলের বন্ধু—তাই তার সঙ্গে গল্প করতে করতে—’

‘বুঝেছি।’ একটা ঝটকা এল নৈঋত কোণ থেকে।—‘তোমার মুখ দেখলেই তা বোঝা যায়। হরিপদ সেখানে জড়িত। আজ হরিপদ, কাল নিরাপদ, পরশু তারাপদ—পদে পদেই ওরা রয়েছে! নাও গেলো এসে, গিলে কৃতার্থ করো।’

বীরেন বউয়ের পিছু পিছু খাবারঘরে যায়। স্ত্রীর কাছে বীর কেউই নয়—বিশেষত খাবারঘরে। বড়ো বড়ো বক্তৃতাবাজও ভাতের গ্রাস মুখে তুলে নীরবে অপর পক্ষের বাক্যবাণ হজম করে—করতে বাধ্য হয়। প্রলয়মূর্তি নটরাজও অন্নপূর্ণার কাছে এসে কীরূপ নম্র হয়ে পড়েন (একেবারে স্পিকটি নট!) তার দৃষ্টান্ত কে না দেখেছে?

থালা-বাটির ঝনৎকার তুলে দেয় বীরেনের বউ—‘আচ্ছা, ফি-দিনই কি এমনি এক-একটা আপদ—হয় ইশকুলের নয় কলেজের নয়তো আপিসের—তোমার বাড়ি ফেরার পথের সামনে পড়ে হোঁচট খায়? আশ্চর্য!’

বীরেনও বিস্মিত হয়—বউয়ের বলার ধরনে। তিলমাত্র জিনিসকে কী করে যে ও তাল মাত্রায় এনে ফেলে তা সামলাতে বীরেন দিশে পায় না—তার কানে তালা লাগে—ভাবলে অবাক হতে হয়।

‘প্রত্যেক দিন নয়।’ প্রতিবাদ ছলে সেবলতে যায়—‘কোনো কোনো দিন। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে পথে দেখা হলে কী করব? দেখতে পাইনি ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে আসব? তুমি তাই বল?’

বীরেনের বউ কিছু বলে না, ভাতের থালা ধরে দেয়। বীরেনকে হাত-মুখের ব্যাপারে বিব্রত করে। তারপরে বলে—‘মনে করো আমিও যদি প্রত্যেক দিন এমনি বেরিয়ে যেতুম আর ফিরতুম অনেক রাত করে? আমারও কি বন্ধুবান্ধব নেই? তুমি তাহলে কী বলতে আমায় শুনি?’

বীরেন গ্রাসটা কোঁত করে গিলে এক ঢোঁক জল খেয়ে নেয়—‘কিচ্ছু না। যাও না কেন বেড়াতে? আমি তো তাই বলি। চুপচাপ বাড়িতে এমনি মনমরা হয়ে বসে না থেকে সই-টইদের বাড়ি গেলে কি সিনেমা দেখে এলে—মন্দ কী?’

‘যাবার মতো কোনো চুলো আছে নাকি আমার? থাকলে আর একথা তুমি আমায় বলতে না।’ ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টির আমেজ দেখা দেয় এবার।

বীরেন অস্থির হয়ে ওঠে—‘ওই তো! মেয়েদের ধরনই ওই! একটুতেই কান্না!’ বীরেন বউয়ের বায়না সইতে পারে, রান্না সইতেও রাজি, কিন্তু কান্না ওর অসহ্য। গর্জনে সেকাহিল নয়, কিন্তু বর্ষণে কাতর।

বীরেনের বউ উদগত অশ্রু দমন করে অন্য ভূমিকা নেয়—‘তা ছাড়া যাব যে সিনেমায় তার সময় কই আমার? সেই সকাল থেকে এই এতটা রাত অবধি তো তোমাদের দাস্যবৃত্তিই করছি! আমি সিনেমায় গেলে গুষ্টির পিন্ডি কে রাঁধবে শুনি? ছেলে-মেয়েদের ইজের ফ্রক—এ সবই-বা সেলাই করবে কে? তারপর ঘরদোর ঝাড়া মোছা—’

‘আমি বলি কী, এর কিছু কিছু বাদ দিলে বোধ হয় ভালো হয়। বড্ড যেন বেশি বেশি করা হচ্ছে। তাই না কি?’ বীরেন বাধা দিয়ে জানায়—‘এই যেমন ধরো, ঘরদোর ঝাড়ামোছার কাজ! এটার যেন একটু বাড়াবাড়ি করা হয় আমার ধারণা। এই সেদিন আমি দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম হয়তো তুমি দেখতে পাওনি, তুমি ঝুল-ঝাড়া ঝাড়নটা দিয়ে মায় দরজা আমার আগাপাশতলা ঝেড়ে দিলে! তাতে আপাদমস্তকে আমার অনেক আবর্জনা সাফ হয়ে গেল তা সত্যি, কিন্তু মানুষ পরিষ্কার করার রীতি বোধ হয় ও নয়।’

বউকে এবার নিরুত্তর হতে হয়—তার বধূ-জীবনে বোধ হয় এই প্রথম এবং জীবনের এই প্রথম সুযোগে বীরেনও আরও কিছু বলে নেয়—‘তা ছাড়া সেলায়ের কাজ বলছ, তার জন্য বাজারের দর্জি আছে—তাদের অন্ন মারা কেন? আর পিন্ডি রাঁধার কথা যা বললে, কথাটা নেহাত মিথ্যে বলনি। আমার মনে হয় ঠিকে ঝিকে আরও গোটা কয়েক টাকা বেশি দিলে সেরেঁধে দিয়ে যাবে এবং এর চেয়ে বেশি খারাপ সেরাঁধতে পারবে বলে আমি আশা করিনে।’

‘তা তো বলবেই। তা তো বলবেই তুমি।’ বউয়ের চোখের বিদ্যুৎ এবার বর্ষা হয়ে নামল। ‘আমি যা করি সব খারাপ, সমস্ত অকাজ। আমার রান্না মুখে তোলা যায় না। আমি কিছু না করলেই তোমার ভালো হয়। ঘরদোর গোল্লায় যাক, কী হবে ঝেড়ে-মুছে, বেশ, তবে আর আমি কিচ্ছুটি করব না।’ ঝমাঝম বর্ষা!

বর্শাবিদ্ধ হয়ে বীরেনকে এবার চুপ করতে হয়। রোরুদ্যমানাকে কে রুধবে? বউ বলেই চলে—‘কেন যে তুমি আর সবার স্বামীর মতো নও আমি তাই ভাবি! আর সব স্বামীরা নিজের ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখলে খুশি হয়, বাড়িতে থাকতে ভালোবাসে, নিজের বউ ছেলে-মেয়ের সঙ্গে গল্প করতে চায় মিশতে চায়—তুমি তাদের মতো নও। পাশের বাড়ির নিবারণবাবুকে দ্যাখো তো? কেমন চমৎকার লোক! সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরবেন, কেবল আপিসটুকুই যা বাইরে, নইলে বাড়িতেই সারাক্ষণ। আর কীরকম বউয়ের বাধ্য!—সর্বদা কাছে কাছে রয়েছেন! নিবারণবাবুর মতো হতে কেন যে তুমি পার না, কোথায় যে তোমার আটকায়—’

বীরেনের গলায় আটকাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি জল খেয়ে বাধাকে তলায় পাঠিয়ে, অন্নগ্রাসমুক্ত হয়ে চট করে সেউঠে পড়ল। নিবারণবাবুর প্রসঙ্গ ওঠার প্রায় সময় হয়েছে সেটের পেয়েছিল, সে-ঢেউ একবার উঠলে শ্রীমতীকে নিবারণ করা অসম্ভব সেজানত। কথার চেয়ে দৃষ্টান্ত তীক্ষ্ণ। কথার খোঁচা তবু সওয়া যায়, কিন্তু দৃষ্টান্তের খোঁচা অসহ্য। তার সূচিমুখ থেকে বঁাচতে হলে কান হাতে করে দৃষ্টির বাইরে যেতে হয়। বীরেন হাত-মুখ ধুয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দার দিকে পালিয়ে গেল। যতক্ষণ-না বউ ঠাণ্ডা হয়, সেনাহয় এই ঠাণ্ডাতেই কাটাবে।

খোলা বারান্দাটার ওধারেই নিবারণদের বাড়ি। একেবারে কোণঘেঁষা—কানঘেঁষা! বারান্দার গায়ে হেলান দিয়ে যে একটুকরো আকাশের দেখা মেলে সেই দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল বীরেন। তারাদের পানে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে লাগল সে—মেয়েদের মন পাওয়া দায়। তার বউয়ের কথাই ধরা যাক-না! অতি তুচ্ছ কারণে, এমন অকারণে সেউত্তাল হয়ে ওঠে যে, ভাবতেই পারা যায় না। হয়তো সব দোষটাই বউয়ের নয়, তার নিজেরও কিছু আছে। বাস্তবিক, ভেবে দেখলে, দিনের পর দিন একঘেয়ে খালি ঘরকন্না চালিয়ে কতটা আমোদ পেতে পারে মানুষ? মেয়ে হলেও মানুষ তো! পুরুষের তবু একটা পা বাড়ির বাইরে থাকে, এই একঘেয়েমির অরণ্য থেকে তবু তার বেরোবার পথ আছে, সারাদিনের কোনো-না-কোনো সময়ে সেমুক্তির স্বাদ পায়। এক বারও অন্তত ঘরোয়া বানপ্রস্থ থেকে বেরিয়ে বাইরের জনারণ্যে সেনিজেকে হারাতে পারে। প্রতিদিনই সিনেমা, রেস্তরাঁ, প্রিয়সঙ্গ—অতটা না হোক তবু রাস্তায় বেরোলে অনেক নতুন মুখ চোখে পড়ে তো। নতুন মুখ আর অচেনা মুখ যত! সব মুখই কিছু অসুন্দর নয়। ফিরে দেখবার মতো কেউ কেউ থাকেই বই কী তার মধ্যে—ফিরে দেখা আর নাও যদি হয়! শুধুই মুখ দেখা—পাকা দেখায় নাই-বা পাকল, তাই কি কম?

তার বউও তো ইচ্ছে করলে বেরোতে পারে! এধার-ওধার ঘুরেটুরে আসতে পারে এক-আধটু। তার দিকে তো কোনোই বাধা নেই। লাইব্রেরি থেকে বই আনিয়ে পড়তে পারে, কত নাচ-গানের জলসা হয়, সিনেমায় কত ভালো ছবি আসে—গিয়ে দেখতে পারে তো! একলাই বা কাউকে সঙ্গে নিয়ে—কে আপত্তি করছে? তা না, কেবল সেলাই আর সেলাই! কে বলেছে তাকে এত এত সেলাই করতে আর দিনরাত কেবল ঘরদোরের ঝুল ঝাড়তে—শুনি?

অবশ্যি, তার বউ যে আরও অনেক বউয়ের মতো নয় এজন্যে সেমনে মনে খুশিই। তার বউ যে ঘরকন্না নিয়ে জড়িয়ে থেকে সুখী থাকে সেটা একপক্ষে ভালোই। কোনো কোনো মেয়ে যেমন প্রজাপতির মতো খালি উড়ছেই, দিন-রাতই কেবল ফুর্তি—স্বামীর দিকেও নজর নেই, গেরস্থালির দিকেও না, কেবল তাঁর কষ্টার্জিত টাকা উড়িয়েই খালাস—তার বউ তেমন নয়। হ্যাঁ, এর জন্য তার বউকে ধন্য বলতে হয়—বীরেন নিজের মনে মনে বলে। সেনিজেও কম ধন্য নয় একথাও সেমানতে বাধ্য হয়।

এতদূর ভেবে এতক্ষণে বীরেনের বিবেক টনটন করতে থাকে। দূরের তারকালোকের দিকে তাকিয়ে একটু আগেই নিজের গৃহকে সেতাড়নালোক জ্ঞান করেছে, কিন্তু এখন দেখল, না তা নয়, অতটা নয়। দূরবিন না লাগিয়েও অদূরে যাকে দেখা যায় সেনিছক তাড়কারাক্ষুসি না, বরং ধ্রুবতারার সগোত্রীয়েরই তাকে হয়তো বলা চলে।

না, এরপর থেকে সেবউয়ের কথামতো চলবে। আর তার অবাধ্য হবে না। আপিসের ফেরত সোজা বাড়ি এসে তার সান্ধ্যকৃত্য! তারপর আর বাড়ির বার নয়। বউয়ের রূপসুধা, কথামৃত, শ্রীহস্ত-লাঞ্ছিত খাদ্যাখাদ্য ইত্যাদির পানাহার শেষে লক্ষ্মীছেলের মতো শুতে যাওয়া, তারপরে ঘুম থেকে উঠে বাজার সেরে নেয়ে-খেয়েই ফের আপিস! এবার থেকে এই হল তার নিত্যক্রিয়া। এবং নৃত্যক্রীড়া।

বউয়ের খাতিরে বন্ধুবান্ধব সব সেবর্জন করবে। রাস্তায় তাদের কারও সঙ্গে দেখা হলে প্রথমেই পাওনাদারের মতো না দেখার ভান দেখাবে, তাতেও যদি তারা না মানে, ঘাড়ে পড়ে জমাতে আসে, সেচোখ তুলে না চেয়ে ব্রীড়াবনত মুখে সরে পড়ার চেষ্টা করবে। যদি তবু কেউ তাড়া করে—তাকে উপদেশ দেবে, যাও, নিজের বউয়ের কাছে যাও। আমাকে বখিয়ো না। …সত্যি, বউয়ের চেয়ে আপনার আর কে আছে? কার কে আছে?

এইরূপ সমাধানে পৌঁছে, অনুতাপ-বিদগ্ধ বীরেন বউয়ের কাছে মার্জনা-ভিক্ষা করে আরও মার্জিত হবার আশায় যখন বারান্দা ত্যাগ করতে যাচ্ছে সেই সময়ে অপ্রত্যাশিতরূপে আরেক সমস্যা দেখা দিল! আরেক দাম্পত্য সমস্যা।

পাশের নিবারণবাবুর ঘর থেকে শ্রীমতী নিবারণীর কলকন্ঠ কানে এল। তিনিও স্বামীকে শায়েস্তা করতে লেগেছেন।

‘বলিহারি যাই তোমায় (বলছিলেন নিবারণের বউ) কী করে যে দিনের পর দিন এমনি করে বাড়ি কামড়ে পড়ে থাকতে পার তাই আমি অবাক হয়ে ভাবি! এমন ঘরকুনো মানুষ আমি জন্মে দেখিনি! কেন, সন্ধ্যের পরে একটু বেড়ালে, হাওয়া খেতে বেরোলে কী হয়? বন্ধুবান্ধব পাঁচজনের সঙ্গে মিশলে, আড্ডা দিলে, এখানে-ওখানে গল্পগুজব করলে খানিক—তাও কি তোমার ভালো লাগে না? কেবল আপিস আর ঘর, ঘর আর আপিস! আপিস থেকে ফিরে নির্জীব হয়ে শুয়ে পড়লে! এমন করলে বাতে ধরবে যে!—’

‘কেয়াবাত!’ বারান্দার অন্ধকারের মধ্যে বীরেনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।—‘বেচারা নিবারণেরও দেখছি সেই দশা। তারও স্বস্তি নেই। যদিও তার অপরাধ আমার ঠিক উলটো বলেই যেন বোধ হচ্ছে।’

নিবারণ কী সদুত্তর দেয় জানবার জন্য, পরের কথায় আড়ি পাতা অন্যায়—এবং আড়ি পাততে গিয়ে অধঃপতন লাভ আরও অন্যায়—তা জেনেও, বারান্দা থেকে অনেকখানি সেঝুঁকল। কিন্তু এত ঝুঁকি নিয়েও কোনো লাভ হল না। প্রত্যুত্তরে নিবারণ আমতা আমতা করে কী যে বলল কিচ্ছু বোঝা গেল না।

সঙ্গে সঙ্গে ওর বউয়ের গর্জন তেড়ে এল।—‘বউয়ের এত আঁচল-ধরা হওয়া কি ভালো? এরকম ন্যাওটা মানুষ মোটেই আমি ভালোবাসিনে। আমার দু-চক্ষের বিষ! সারাটা সন্ধ্যে বাড়িতে বসে থেকে আমার প্রত্যেক কাজে বাগড়া না দিয়ে একটু বেড়িয়ে-চেড়িয়ে এলে কি হয় না? তাতে কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। একটু পুরুষ মানুষের মতো নাহয় হলেই! পাশের বাড়ির বীরেনবাবুকে দ্যাখো দিকি। ওরকম কি তুমি হতে পার না? না কি, ওরকম না হবার জন্যে কেউ তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়ে পায়ে ধরে সেধেছে?…’

এই পর্যন্ত শুনেই বীরেনের মাথা ঘুরতে লাগল। বারান্দা থেকে পা টিপে টিপে ঘরের মধ্যে ফিরল সে, কিন্তু বউয়ের কাছে মার্জনা-লাভের সংকল্প নিয়ে নয়। সেসাধু ইচ্ছা তার উড়ে গেছে তখন। কী লাভ? মেয়েদের রহস্য তার সামান্য বুদ্ধির বাইরে। তবে এটুকু সেবুঝেচে যে, মেয়েদের কাছে মার্জনা নেই; কখনোই না, কোনো ক্ষেত্রেই নয়। আছে সম্মার্জনা, সর্বদা এবং সর্বত্র; এবং এই বোঝাই তার যথেষ্ট। সেই বোঝা আরও বাড়িয়ে আর কী লাভ হবে তার?

raateralo.com

Leave a Comment