Strir Patra by Rabindranath Tagore 2024 l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রীর পত্র l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “স্ত্রীর পত্র” – এক সাহসী নারীর আত্মজাগরণের গল্প

By raateralo.com

Published on:

Strir Patra by Rabindranath Tagore 2024

Strir Patra by Rabindranath Tagore: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “স্ত্রীর পত্র” (১৯১৪ সালে প্রথম প্রকাশিত) বাংলা সাহিত্যের একটি অনন্যসাধারণ রচনা। এই গল্পে ঠাকুর নারীর আত্মপরিচয়, স্বাধীনতা ও আত্মজাগরণের প্রশ্নগুলি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন। “স্ত্রীর পত্র” গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মৃণাল, এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বধূ, যিনি তাঁর স্বামীকে একটি চিঠি লিখে নিজের জীবনের বাস্তবতা ও দুঃখ-কষ্টের কথা জানান।

মৃণালের চিঠি কেবলমাত্র তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণ নয়, বরং তা এক সামাজিক প্রতিবাদও বটে। এই চিঠিতে মৃণাল তাঁর দাম্পত্য জীবনের যন্ত্রণাগুলি, পারিবারিক অত্যাচার ও সামাজিক নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। গল্পের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজের নারীদের অধিকার ও তাদের সম্মানের জন্য একটি দৃঢ় বক্তব্য রাখেন, যা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

“স্ত্রীর পত্র” একটি এমন সময়ের কথা বলে, যখন নারীরা নিজেদের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে চাইত, নিজেদের মত প্রকাশ করতে চাইত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গল্পটি সেইসব সাহসী নারীদের প্রতি একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য, যারা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন।

Strir Patra by Rabindranath Tagore l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রীর পত্র l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “স্ত্রীর পত্র” – এক সাহসী নারীর আত্মজাগরণের গল্প

স্ত্রীর পত্র (Strir Patra)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শ্রীচরণকমলেষু

আজ পনেরো বছর আমাদের বিবাহ হয়েছে,আজ পর্যন্ত তোমাকে চিঠি লিখি নি। চিরদিন কাছেই

পড়ে আছি — মুখের কথা অনেক শুনেছ, আমিও শুনেছি ;চিঠি লেখবার মতো ফাঁকটুকু পাওয়া যায় নি।

আজ আমি এসেছি তীর্থ করতে শ্রীক্ষেত্রে, তুমি আছ তোমার আপিসের কাজে । শামুকের সঙ্গে

খোলসের যে সম্বন্ধ কলকাতার সঙ্গে তোমার তাই ; সে তোমার দেহ মনের সঙ্গে এটে গিয়েছে ; তাই

তুমি আপিসে ছুটির দরখাস্ত করলে না। বিধাতার তাই অভিপ্রায় ছিল ; তিনি আমার ছুটির দরখাস্ত

মঞ্জুর করেছেন।

আমি তোমাদের মেজোবউ। আজ পনেরো বছরের পরে এই সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে জানতে পেরেছি,

আমার জগৎ এবং জগদীশ্বরের সঙ্গে আমার অন্য সম্বন্ধও আছে তাই আজ সাহস করে এই চিঠিখানি

লিখছি, এ তোমাদের মেজোবউয়ের চিঠি নয়।

তোমাদের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ কপালে যিনি লিখেছিলেন তিনি ছাড়া যখন সেই সম্ভাবনার কথা আর

কেউ জানত না, সেই শিশুবয়সে আমি আর আমার ভাই একসঙ্গেই সান্নিপাতিক জ্বরে পড়ি। আমার

ভাইটি মারা গেল, আমি বেঁচে উঠলুম। পাড়ার সব মেয়েরাই বলতে লাগল ,“মৃণাল মেয়ে কি না, তাই

ও বাঁচল, বেটাছেলে হলে কি আর রক্ষা পেত ?” চুরিবিদ্যাতে যম পাকা, দামি জিনিসের পরেই তার

লোভ।

আমার মরণ নেই। সেই কথাটাই ভালো করে বুঝিয়ে বলবার জন্যে এই চিঠিখানি লিখতে বসেছি।

যেদিন তোমাদের দূরসম্পর্কের মামা তোমার বন্ধু নীরদকে নিয়ে কনে দেখতে এলেন, তখন আমার বয়স বারো। দুর্গম পাড়াগীয়ে আমাদের বাড়ি, সেখানে দিনের বেলা শেয়াল ডাকে । 

স্টেশান থেকে সাত ক্রোশ স্যক্রা গাড়িতে এসে বাকি তিন মাইল কাঁচা রাস্তায় পালকি করে তবে আমাদের

গায়ে গৌঁছনো যায়। সেদিন তোমাদের কী হয়রানি। তার উপরে আমাদের বাঙাল দেশের রান্না — সেই

রান্নার প্রহসন আজও মামা ভোলেন নি।

জিদ ছিল। নইলে এত কষ্ট করে আমাদের সে গাঁয়ে তোমরা যাবে কেন ? বাংলা দেশে পিলে যকৃত

অন্লশূল এবং কনের জন্যে তো কাউকে খোঁজ করতে হয় না — তারা আপনি এসে চেপে ধরে,

কিছুতে ছাড়তে চায় না।

বাবার বুক দুর্দুর্‌ করতে লাগল, মা দুর্গানাম জপ করতে লাগলেন। শহরের দেবতাকে

পাড়ার্ীয়ের পুজারি কী দিয়ে সন্তুষ্ট করবে। মেয়ের রূপের উপর ভরসা, কিন্তু, সেই রূপের গুমর তো

মেয়ের মধ্যে নেই, যে ব্যক্তি দেখতে এসেছে সে তাকে যে-দামই দেবে সেই তার দাম। তাই তো হাজার

রূপে গুণেও মেয়েমানুষের সংকোচ কিছুতে ঘোচে না।

সমস্ত বাড়ির, এমন-কি, সমস্ত পাড়ার এই আতঙ্ক আমার বুকের মধ্যে পাথরের মতো চেপে

বসল। সেদিনকার আকাশের যত আলো এবং জগতের সকল শক্তি যেন বারো বছরের একটি পাড়াগেঁয়ে

করছিল — আমার কোথাও লুকোবার জায়গা ছিল না।

সমস্ত আকাশকে কাঁদিয়ে দিয়ে বাঁশি বাজাতে লাগল — তোমাদের বাড়িতে এসে উঠলুম।

আমার খুঁতগুলি সবিস্তারে খতিয়ে দেখেও গিনির দল সকলে স্বীকার করলেন, মোটের উপর আমি

সুন্দরী বটে। সে কথা শুনে আমার বড়ো জায়ের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল । কিন্তু,আমার রূপের দরকার কী ছিল তাই ভাবি । রূপ-জিনিসটাকে যদি কোনো সেকেলে পন্ডিত গঙ্গামৃত্তিকা দিয়ে গড়তেন, তা হলে ওর

আদর থাকত ; কিন্তু, ওটা যে কেবল বিধাতা নিজের আনন্দে গড়েছেন, তাই তোমাদের ধর্মের সংসারে

ওর দাম নেই। আমার যে রূপ আছে, সে কথা ভুলতে তোমার বেশিদিন লাগে নি। কিন্তু, আমার যে বুদ্ধি

আছে, সেটা তোমাদের পদে পদে স্মরণ করতে হয়েছে। 

এ বুদ্ধিটা আমার এতই স্বাভাবিক যে তোমাদের ঘরকন্নার মধ্যে এতকাল কাটিয়েও আজও সে টিকে আছে। মামার এই বুদ্ধিটার জন্যে বিষম

উদ্বিগ্ন ছিলেন, মেয়েমানুষের পক্ষে এ এক বালাই | যাকে বাধা মেনে চলতে হবে, সে যদি বুদ্ধিকে

মেনে চলতে চায় তবে ঠোকর খেয়ে তার কপাল ভাঙবেই। কিন্তু কী করব বলো। তোমাদের ঘরের

ফেলেছেন, সে আমি এখন ফিরিয়ে দিই কাকে । তোমরা আমাকে মেয়ে-জ্যাঠা বলে দুবেলা গাল

দিয়েছে। কটু কথাই হচ্ছে অক্ষমের সান্ত্বনা ; অতএব সে আমি ক্ষমা করলুম।

আমার একটা জিনিস তোমাদের ঘরকন্নার বাইরে ছিল, সেটা কেউ তোমরা জান নি। আমি লুকিয়ে

কবিতা লিখতুম। সে ছাইপীশ যাই হোক-না, সেখানে তোমাদের অন্দরমহলের পাঁচিল ওঠে নি।

সেইখানে আমার মুক্তি ; সেইখানে আমি আমি । আমার মধ্যে যা-কিছু তোমাদের মেজোবউকে ছাড়িয়ে রয়েছে,

সে তোমরা গছন্দ কর নি, চিনতেও পার নি ; আমি যে কবি, সে এই পনেরো বছরেও তোমাদের কাছে ধরা

পড়ে নি।

তোমাদের ঘরের প্রথম স্মৃতির মধ্যে সব চেয়ে যেটা আমার মনে জাগছে সে তোমাদের

গোয়ালঘর। অন্দরমহলের সিঁড়িতে ওঠবার ঠিক পাশের ঘরেই তোমাদের গোরু থাকে, সামনের

উঠোনটুকু ছাড়া তাদের আর নড়বার জায়গা নেই। সেই উঠোনের কোণে তাদের জাব্না দেবার কাঠের

গামলা। সকালে বেহারার নানা কাজ ; উপবাসী গোরুগুলো ততক্ষণ সেই গামলার ধারগুলো চেটে চেটে

চিবিয়ে চিবিয়ে খাব্লা করে দিত। আমার প্রাণ কীদত। আমি পাড়াগাঁয়ের  মেয়ে – তোমাদের বাড়িতে

যেদিন নতুন এলুম সেদিন সেই দুটি গোরু এবং তিনটি বাছুরই সমস্ত শহরের মধ্যে আমার চিরপরিচিত

আতীয়ের মতো আমার চোখে ঠেকল। যতদিন নূতন বউ ছিলুম নিজে না খেয়ে লুকিয়ে ওদের

খাওয়াতুম ; যখন বড়ো হলুম তখন গোরুর প্রতি আমার প্রকাশ্য মমতা লক্ষ করে আমার ঠাট্টার

সম্পর্কীয়েরা আমার গোত্র সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগবেন।

আমার মেয়েটি জন্ম নিয়েই মারা গেল। আমাকেও সে সঙ্গে যাবার সময় ডাক দিয়েছিল। সে যদি

বেঁচে থাকত তা হলে সেই আমার জীবনে যা-কিছু বড়ো, যা-কিছু সত্য সমস্ত এনে দিত ; তখন

মেজোবউ থেকে একেবারে মা হয়ে বসতুম ৷ মা যে এক-সংসারের মধ্যে থেকেও বিশ্ব-সংসারের।মা

হবার দুঃখটুকু পেলুম কিন্তু মা হবার মুক্তিটুকু পেলুম না ।

মনে অছে, ইংরেজ ভান্তার এসে আমদের অন্দর দেখে আশ্চর্য্য হয়েছিল এবং আতুড়ঘর দেখে

বিরক্ত হয়ে বকাবকি করেছিল। সদরে তোমাদের একটু বাগান আছে। ঘরে সাজসভ্জা আসবাবের

অভাব নেই, আর, অন্দরটা যেন পশমের কাজের উলটো পিঠ ; সেদিকে কোনো লঙ্জা নেই, শ্রী নেই,

সঙ্জা নেই। সেদিকে আলো মিট্মিট্‌ করে জ্বলে ; হাওয়া চোরের মতো প্রবেশ করে ; উঠোনের

আবর্জনা নড়তে চায় না; দেওয়ালের এবং মেজের সমস্ত কলঙ্ক অক্ষয় হয়ে বিরাজ করে। কিন্তু,

ডাক্তার একটা ভুল করেছিল, সে ভেবেছিল, এটা বুঝি আমাদের অহোরাত্র দুঃখ দেয়। ঠিক উলটো

অনাদর জিনিসটা ছাইয়ের মতো, সে ছাই আগুনকে হয়তো ভিতরে ভিতরে জমিয়ে রাখে কিন্তু বাইরে

থেকে তার তাপটাকে বুঝতে দেয় না। আঅসন্মান যখন কমে যায় তখন অনাদরকে তো অন্যা্য বলে

মনে হয় না। সেইজন্যে তার বেদনা নেই। তাই তো মেয়েমানুষ দুঃখ বোধ করতেই লজ্জা পায়। আমি

তাই বলি, মেয়েমানুষকে দুঃখ পেতেই হবে, এইটে যদি তোমাদের ব্যবস্থা হয়, তা হলে যতদূর সম্ভব তাকে

অনাদরে রেখে দেওয়াই ভালো ; আদরে দুঃখে ব্যাথাটা কেবল বেড়ে ওঠে।

যেমন করেই রাখ, দুঃখ যে আছে,এ কথা মনে করবার কথাও কোনোদিন মনে আসে নি।

আতুড়ঘরে মরণ মাথার কাছে এসে দাঁড়াল, মনে ভয়ই হল না । জীবন আমাদের কীই-বা যে মরণকে ভয়

করতে হবে ? আদরে যতে যাদের প্রাণের বাধন শক্ত করেছে মরতে তাদেরই বাধে । সেদিন যম যদি

আমাকে ধরে টান দিত তা হলে আলগা মাটি থেকে যেমন অতি সহজে ঘাসের চাপড়া উঠে আসে সমস্ত

শিকড়সুদ্ধ আমি তেমনি করে উঠে আসতুম। বাঙালির মেয়ে তো কথায় মরতে যায়। কিন্তু, এমন

মরায় বাহাদুরিটা কী । মরতে লজ্জা হয় ; আমাদের পক্ষে ওটা এতই সহজ।

আমার মেয়েটি তো সন্ধ্যাতারার মতো ক্ষণকালের জন্যে উদয় হয়েই অন্ত গেল। আবার আমার

নিত্যকর্ম এবং গোরুবাছুর নিয়ে পড়লুম। জীবন তেমনি করেই গড়াতে গড়াতে শেষ পর্যন্ত কেটে

যেত ; আজকে তোমাকে এই চিঠি লেখবার দরকারই হত না। কিন্তু, বাতাসে সামান্য একটা বীজ

উড়িয়ে নিয়ে এসে পাকা দালানের মধ্যে অশথগাছের অন্কুর বের করে ; শেষকালে সেইটুকু থেকে

ইটকাঠের বুকের পাঁজর বিদীর্ণ হয়ে যায়। আমার সংসারের পাকা বন্দোবস্তের মাঝখানে ছেটো

একটুখানি জীবনের কণা কোথা থেকে উড়ে এসে পড়ল ; তার পর থেকে ফাটল শুরু হল।

বিধবা মার মৃত্যুর পরে আমার বড়ো জায়ের বোন বিন্দু তার খুড়ততো ভাইদের অত্যাচারে

আমাদের বাড়িতে তার দিদির কাছে এসে যেদিন আশ্রয় নিলে, তোমরা সেদিন ভাবলে, এ আবার

কোথাকার আপদ । আমার পোড়া স্বাভাব, কী করব বলো — দেখলুম, তোমরা সকলেই মনে মনে

বিরক্ত হয়ে উঠেছ, সেইজন্যেই এই নিরাশ্রয় মেয়েটির পাশে আমার সমস্ত মন যেন একেবারে কোমর

বেধে দাঁড়াল। পরের বাড়িতে পরের অনিচ্ছাতে এসে আশ্রয় নেওয়া — সে কতবড়ো অপমান। দায়ে

পড়ে সেও যাকে স্বীকার করতে হল, তাকে কি এক পাশে ঠেলে রাখা যায়।

তার পরে দেখলুম আমার বড়ো জায়ের দশা । তিনি নিতান্ত দরদে পড়ে বোনটিকে নিজের কাছে

এনেছেন। কিন্তু, যখন দেখলেন স্বামীর অনিচ্ছা, তখন এমনি ভাব করতে লাগলেন, যেন এ তাঁর এক

বিষম বালাই , যেন একে দুর করতে পারলেই তিনি বাঁচেন। এই অনাথা বোনটিকে মন খুলে প্রকাশ্যে

স্নেহ দেখালেন, সে সাহস তাঁর হল না। তিনি পতিব্রতা।

তাঁর এই সংকট দেখে আমার মন আরো ব্যথিত হয়ে উঠল। দেখলুম , বড়ো জা সকলকে একটু

বিশেষ করে দেখিয়ে দেখিয়ে বিন্দুর খাওয়াপরার এমনি মোটারকমের ব্যবস্থা করলেন এমং বাড়ির সর্বপ্রকার

দাসীবৃন্তিতে তাকে এমনভাবে নিযুক্ত করলেন যে আমার, কেবল দুঃখ নয়, লঙ্জা বোধ হল। তিনি সকলের

কাছে প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত যে, আমাদের সংসারে ফাঁকি দিয়ে বিন্দুকে ভারি সুবিধাদরে পাওয়া গেছে। ও

কাজ দেয় বিস্তর, অথচ খরচের হিসাবে বেজায় সম্তা।

আমাদের বড়ো জায়ের বাপের বংশে কুল ছাড়া আর বড়ো কিছু ছিল না — রূপও না, টাকাও না।

আমার শশুরের হাতে পায়ে ধরে কেমন করে তোমাদের ঘরে তাঁর বিবাহ হল সে তো সমস্তই জান।

তিনি নিজের বিবাহটাকে এ বংশের প্রতি বিষম একটা অপরাধ বলেই চিরকাল মনে জেনেছেন।

সেইজন্যে সকল বিষয়েই নিজেকে যতদূর সম্ভব সংকুচিত করে তোমাদের ঘরে তিনি অতি অল্প জায়গা

জুড়ে থাকেন।

কিন্তু, তীর এই সাধু দৃষ্টান্তে আমাদের বড়ো মুশকিল হয়েছে। আমি সকল দিকে আপনাকে

অত অসম্ভব খাটো করতে পারি নে। আমি যেটাকে ভালো বলে বুঝি আর-কারো খাতিরে সেটাকে মন্দ

বলে মেনে নেওয়া আমার কর্ম নয় — তুমিও তার অনেক প্রমাণ পেয়েছ ।

মাথাটি খেতে বসলেন ” আমি যেন একটা বিপদ ঘটালুম, এমনি ভাবে তিনি সকলের কাছে নালিশ

করে বেড়ালেন। কিন্তু, আমি নিশ্চয় জানি, তিনি মনে মনে বেঁচে গেলেন। এখন দৌষের বোঝা আমার

উপরেই পড়ল। তিনি বোনকে নিজে যে স্নেহ দেখাতে পারতেন না আমাকে দিয়ে সেই স্নেহটুকু

করিয়ে নিয়ে তীর মনটা হালকা হল। আমার বড়ো জা বিন্দুর বয়স থেকে দু-চারটে অঙ্ক বাদ দিতে চেষ্টা

করতেন। কিন্তু, তার বয়স যে চোদ্দর চেয়ে কম ছিল না, এ কথা লুকিয়ে বললে অন্যায় হত না।

তুমি তো জান, সে দেখতে এতই মন্দ ছিল যে পড়ে গিয়ে সে যদি মাথা ভাঙত তবে ঘরের মেজেটার

জন্যেই লোকে উদ্বিগ্ন হত। কাজেই পিতা-মাতার অভাবে কেউ তাকে বিয়ে দেবার ছিল না, এবং

তাকে বিয়ে করবার মতো মনের জোরই বা কজন লোকের ছিল।

বিন্দু বড়ো ভয়ে ভয়ে আমার কাছে এল। যেন আমার গায়ে তার ছোঁয়াচ লাগলে আমি সইতে

পারব না। বিশ্বসংসারে তার যেন জন্মাবার কোনো শর্ত ছিল না ; তাই সে কেবলই পাশ কাটিয়ে , চোখ

এড়িয়ে চলত । তার বাপের বাড়িতে তার খুড়ততো ভাইরা তাকে এমন একটু কোণও ছেড়ে দিতে চায়

নি যে-কোন একটা অনাবশ্যক জিনিস পড়ে থাকতে পারে । অনাবশ্যক আবর্জনা ঘরের আশে-পাশে

অনায়াসে স্থান পায়, কেননা মানুষ তাকে ভূলে যায়, কিন্তু অনাবশ্যক মেয়েমানুষ যে একে অনাবশ্যক

আবার তার উপরে তাকে ভোলাও শক্ত, সেইজন্যে আস্তাকুড়েও তার স্থান নেই। অথচ বিন্দুর খুড়তুতো

ভাইরা যে জগতে পরমাবশ্যক পদার্থ তা বলবার জো নেই। কিন্তু, তারা বেশ আছে।

তাই, বিন্দুকে যখন আমার ঘরে ডেকে আনলুম, তার বুকের মধ্যে কীপতে লাগল। তার ভয়

দেখে আমার বড়ো দুঃখ হল । আমার ঘরে যে তার একটুখানি জায়গা আছে, সেই কথাটি আমি অনেক

আদর করে তাকে বুঝিয়ে দিলুম।

কিন্তু, আমার ঘর শুধু তো আমারই ঘর নয়। কাজেই আমার কাজটি সহজ হল না। দু-চারদিন

আমার কাছে থাকলেই তার গায়ে লাল-লাল কী উঠল, হয়তো সে ঘামাচি, নয় তো আর-কিছু হবে।

তোমরা বললে বসন্ত । কেননা, ও যে বিন্দু। তোমাদের পাড়ায় এক আনাড়ি ডাক্তার যসে বললে আর

দুই-একদিন না গেলে ঠিক বলা যায় না । কিন্তু সেঈ দুই-একদিন সবুর সইবে কে। বিন্দু তো তার

আঁতুড়ঘরে ওকে নিয়ে থাকব, আর-কাউকে কিছু করতে হবে না। এই নিয়ে আমার উপরে তোমরা

যখন সকলে মারমুর্তি ধরেছ, এমন-কি, বিন্দুর দিদিও যখন অত্যন্ত বিরক্তির ভান করে পোড়াকপালি

মেয়েটাকে হাসপাতালে পাঠাবার প্রস্তাব করছেন, এমন সময় ওর গায়ে সমস্ত লাল দাগ একদম মিলিয়ে

গেল। তোমারা দেখি তাতে আরো ব্যস্ত হয়ে উঠলে | বললে, নিশ্চয় বসন্ত বসে গিয়েছে। কেননা, ও

যেবিন্দ |

অনাদরে মানুষ হবার একটা মতে গুণ শরীরটাকে তাতে একেবারে অজর অমর করে তোলে।

ব্যামো হতেই চায় না — মরার দের রাস্তাগুলো একেবারেই বন্ধ। রোগ তাই ওকে ঠাট্টা করে গেল,

কিছুই হল না। কিন্তু এটা বেশ বোঝা গেল, পৃতিবীর মধ্যে সব চেয়ে অকিঞ্চিকর মানুষকে আশ্রয়

দেওয়াই সব চেয়ে কঠিন। আশ্রয়ের দরকার তার যত বেশি আশ্রয়ের বাধাও তার তেমনি বিষম |

আমার সম্বন্ধে বিন্দুর ভয় যখন ভাঙল তখন ওকে আর-এক গেরোয় ধরল। আমাকে এমনি

ভালোবাসতে শুরু করলে যে, আমাকে ভয় ধরিয়ে দিল। ভালোবাসার এরকম মূর্তি সংণারে তো

কোনোদিন দেখি নি। বইয়েতে পড়েছি বটে, সেও মেয়ে পুরুষের মধ্যে | আমার যে রূপ ছিল সে কতা

অমার মনে মরবার কোনো কারণ বহুকাল ঘটে নি — এতদিন পরে সেই রূপটা নিয়ে পড়ল এই কু্রী

মেয়েটি । আমার মুখ দেখে তার চোখের আশ আর মিটত না। বলত, “দিদি, তোমার এই মুখখানি

আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় নি” যেদিন আমি নিজের চুল নিজে বাধতুম, সেদিন তার ভারি অভিমান।

আমার চুলের বোঝা দুই হাত দিয়ে নাড়তে-চাড়তে তার ভারি ভালো লাগত | কোথাও নিমন্ত্রনে যাওয়া ছাড়া

আমার সাজগোজের তো দরকার ছিল না । কিন্তু, বিন্দু আমাকে অস্থির করে রোজই কিছু না-কিছু সাজ

করাত । মেয়েটা আমাকে নিয়ে একেবারে পাগল হয়ে উঠল।

তোমাদের অন্দরমহলে কোথাও জমি এক ছটাক নেই। উত্তর দিকের পীঁচিলের গায়ে নর্দমার ধারে

কোনোগতিকে একটা গাবগাছ জন্মেছে। যেদিন দেখতুম সেই গাবের গাছের নুতন পাতাগুলি রাঙা

উকটকে হয়ে উঠেছে, সেইদিন জানতুম, ধরাতলে বসন্ত এসেছে বটে । আমার ঘরকন্নার মধ্যে

অনাদৃত মেয়েটার চিত্ত যেদিন আগা গোড়া এমন রঙিন হয়ে উঠল সেদিন আমি বুঝলুম হৃদয়ের

জগতেও একটা বসন্তের হওয়া আছে — সে কোন্‌ স্বর্গ থেকে আসে, গলির মোড় থেকে আসে না |

বিন্দুর ভালোবাসার দুঃসহ বেগে আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। এক একবার তার উপর রাগ হত, সে কথা স্বীকার করি, কিন্তু তার এই ভালোবাসার ভিতর দিয়ে আমি আপনার একটি স্বরূপ

দেখলুম যা আমি জীবনে আর কোনোদিন দেখি নি। সেই আমার মুক্ত স্বরূপ ।

এদিকে, বিন্দুর মতো মেয়েকে আমি যে এতটা আদরযত্র করছি, এ তোমাদের অত্যন্ত বাড়াবাড়ি

বলে ঠেকল। এর জন্যে খুতখুঁত-খিটখিটের অন্ত ছিল না। যেদিন আমার ঘর থেকে বাজ্বন্ধ চুরি গেল,

সেদিন সেই চুরিতে বিন্দুর যে কোনোরকমের হাত ছিল, এ কথার আভাস দিতে তোমাদের লঙ্জা হল

না। যখন স্বদেশী হাঙ্গামায় সোকের বাড়িতল্লাসি হতে লাগল তখন তোমার অনায়াসে সন্দেহ করে বসলে

যে, বিন্দু পুলিসের পোষা মেয়েচর। তার আর কোনো প্রমাণ ছিল না কেবল এই প্রমাণ যে, ও বিন্দু।

তোমাদের বাড়ির দাসীরা কোনোরকম কাজ করতে আপত্তি করত — তাদের কাউকে ওর কাজ

করবার ফরমাশ করলে, ও-মেয়েও একেবারে সংকোচে যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠত। এই সকল কারণেই

ওর জন্যে আমার খরচ বেড়ে গেল। আমি বিশেষ করে একজন আলাদা দাসী রাখলুম। সেটা

তোমাদের ভালো লাগে নি। বিন্দুকে আমি যে-সব কাপড় পরতে দিতুম তা দেখে এত রাগ করেছিলে

যে, আমার হাত-খরচের টাকা বন্ধ করে দিলে। তার পরদিন থেকে ণরমি পাঁচ-সিকে দামের জোড়া

মোটা কোরা কলের ধুতি পরতে আরম্ভ করে দিলুম। আর, মতির মা যখন আমার এটো ভাতের থালা

নিয়ে যেতে এল, তাকে বারণ করে দিলুম | আমি নিজে উঠোনের কলতলায় গিয়ে এটো ভাত বাছুরকে

খাইয়ে বাসন মেজেছি। একদিন হঠাৎ সেই দৃশ্যটি দেখে তুমি খুব খুশি হও নি। আমাকে খুশি না করলে চলে

আর তোমাদের খুশি না করলেই নয় , এই সুবুদ্ধিটা আজ পর্যন্ত আমার ঘটে এল না।

এদিকে তোমাদের রাগও যেমন বেড়ে উঠেছে বিন্দুর বয়সও তেমনি বেড়ে চলেছে। সেই

স্বাভাবিক ব্যাপারে তোমরা অস্বাভাবিক রকমের ব্ব্রিত হয়ে উঠেছিল । একটা কথা মনে করে আমি

আমি আশ্যর্য হই, তোমরা জোর করে কেন বিন্দুকে তোমাদের বাড়ি থেকে বিদায় করে দাও নি। আমি

বেশ বুঝি, তোমরা আমাকে মনে মনে ভয় কর। বিদাতা যে আমাকে বুদ্ধি দিয়েছিলেন, ভিতরে ভিতরে

তার খাতির না করে তোমরা বাঁচ না।

অবশেষে বিন্দুকে নিজের শক্তিতে বিদায় করতে না পেরে তোমরা প্রজাপতি দেবতার শরণাপন্ন

হলে। বিন্দুর বর ঠিক হল। বড়ো জা বললেন, “বাঁচলুম , মা কালী আমাদের বংশের মুখ রক্ষা

করলেন।”

বর কেমন তা জানি নে ;তোমাদের কাছে শুনলুম, সকল বিষয়েই ভালো। বিন্দু আমার পা

জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল ; বললে, “দিদি আমার আবার বিয়ে করা কেন।”

আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে বললুম, “বিন্দু, তুই ভয় মরিস নে — শুনেছি, তোর বর

ভালো?”

বিন্দু বললে, “বর যদি ভালো হয়, আমার কী আছে যে আমাকে তার পছন্দ হবে”

বরপক্ষেরা বিন্দুকে তো দেখতে আসবার নামও করলে না। বড়দিদি তাতে বড়ো নিশ্চিন্ত

হলেন।

কিন্তু, দিনরান্রে বিন্দুর কান্না আর থামতে চায় না। সে তার কী কষ্ট, সে আমি জানি। বিন্দুর

জন্যে আমি সংসার অনেক লড়াই করেছি কিন্তু, ওর বিবাহ বন্ধ হোক এ কথা বলবার সাহস আমার হল

না। কিসের জোরেই বা বলব । আমি যদি মারা যাই তো ওর কী দশা হবে । একে তো মেয়ে, তাতে

কালো মেয়ে — কার ঘরে চলল, ওর কী দশা হবে, সে কথা না ভাবাই ভালো । ভাবতে গেলে প্রাণ

কেপে ওঠে।

বিন্দু বললে, “দিদি, বিয়ের আর পীঁচদিন আছে, এর মধ্যে আমার মরণ হবে না কি?”

হতে পারত তা হলে আমি আরাম বোধ করতুম।

থাকব, আমাকে যা বলবে তাই করব, তোমার পায়ে পড়ি আমাকে এমন করে ফেলে দিয়ো না।”

কিছুকাল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দিদির চোখ দিয়ে জল পড়ছিল, সেদিনও পড়ল । কিন্তু, শুধু

হৃদয় তো নয়, শাম্ব্ও আছে। তিনি বললেন , “জানিস তো, বিন্দি, পতিই হচ্ছে স্ত্রীলোকের গতি মুক্তি

সব। কপালে যদি দুঃখ থাকে তো কেউ খন্ডাতে পারবে না?

আসল কথা হচ্ছে,কোনো দিকে কোনো রাস্তাই নেই — বিন্দুকে বিবাহ করতেই হবে, তার

পরে যা হয় তা হোক।

বাড়িতেই হাওয়া চাই — সেটা তাদের কৌলিক প্রথাআমি বুঝলুম, বিন্দুর বিবাহের জন্য যদি তোমাদের

খরচ করতে হয়, তবে সেটা তোমাদের গৃহদেবতার কিছুতেই সইবে না। কাজেই চুপ করে যেতে হল।

কিন্তু, একটি কথা তোমরা কেউ জান না। দিদিকে জানবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু জানাই নি, কেননা তা হলে

বোধকরি দিদির চোখে সেটা পড়ে থাকবে, কিন্তু সেটা তিনি দেখেও দেখেন নি। দোহাই ধর্মের, সেজন্য

তোমরা তাঁকে ক্ষমা কোরো।

ত্যাগ মরলে

আমি বললুম “না বিন্দি, তোর যেমন দশাই হোক-না কেন, অমি তোকে শেষ পর্যন্ত ত্যাগ

করব না

তিন দিন গেল। তোমাদের তালুকের প্রজা খবার জন্যে তোমাকে যে ভেড়া দিয়েছিল, তাকে

তোমার জঠরাগ্নি থেকে বাঁচিয়ে আমি আমাদের একতলায় কয়লা-রাখবার ঘরের এক পাশে বাস করতে

দিয়েছিলুম। সকালে উঠেই আমি নিজে তাকে দানা খাইয়ে আসতুম ; তোমার চাকরদের প্রতি দুইএকদিন

নির্ভর করে দেখেছি, তাকে খাওয়ানোর চেয়ে তাকে খাওয়ার প্রতিই তাদের বেশি ঝৌক।

সেদিন সকালে সেই ঘরে ঢুকে দেখি, বিন্দু এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে | আমাকে

দেখেই আমার পা জড়িয়ে ধরে লুটিয়ে পড়ে নিঃশব্দে কাদতে লাগল |

বিন্দুর স্বামী পাগল।

“সত্যি বলছিস, বিন্দি?”

“এত বড়ো মিথ্যা কথা তোমার কাছে বলতে পারি, দিদি? তিনি পাগল। শ্বশুরের যই বিবাহে মত

ছিল না — কিন্তু তিনি আমার শাহুড়িকে যমের মতো ভয় করেন। তিনি বিবাহের পূর্বেই কাশী চলে

গেছেন। শাশুড়ি জেদ করে তাঁর ছেলের বিয়ে দিয়েছেন”

আমি সেই রাশ-করা কয়লার উপরে বসে পড়লুম। মেয়েমানুষকে মেয়েমানুষ দয়া করে না।

বলে,“ওতো মেয়েমানুষ বৈ তো নয়। ছেলে হোক-না পাগল, সে তো পুরুষ বটে?

বিন্দুর স্বামীকে হঠাৎ পাগল বলে বোঝা যায় না, কিন্তু এক-একদিন সে এমন উন্মাদ হয়ে ওঠে যে।

তাকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। বিবাহের রাত্রে সে ভালো ছিল কিন্তু রাত-জাগা প্রভৃতি উৎপাতে

দ্বিতীয় দিন থেকে তার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে উঠল ; বিন্দু দুপগুরবেলায় পিতলের থালায় ভাত

খেতে বসেছিল, হঠাৎ তার স্বামী থালাসুদ্ধ ভাত টেনে উঠানে ফেলে দিল ; হঠাৎ কেমন তার

মনেহয়েছে, বিন্দু স্বয়ং রাণী রাসমণি ; বেহারাটা নিশ্চয় সেনার থালা চুরি করে রাণীকে তার নিজের

থালায় ভাত খেতে দিয়েছে। এই তার রাগ । বিন্দু তো ভয়ে মরে গেল। তৃতীয় রাত্রে শাশুড়ি তাকে যখন

স্বামীর ঘরে শুতে বললে, বিন্দুর প্রাণ শুকিয়ে গেল । শশুড়ি তার প্রচন্ড, রাগলে জ্ঞান থাকে না। সেও

পাগল, কিন্তু পুরো নয় বলেই আরো ভয়ানক । বিন্দুকে ঘরে ঢুকতে হল।। স্বামী সে রাত্রে ঠান্ডা ছিল।

কিন্তু, ভয়ে বিন্দুর শরীর যেন কাঠ হয়ে গেল। স্বামী যখন ঘুমিয়েছে এনেক রাত্রে সে অনেক কৌশলে

পালিয়ে চলে এসেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ লেখবার দরকার নেই।

ঘৃণায় রাগে আমার সকল শরীর জুলতে লাগল। আমি বললুম, “এমন ফাঁকির বিয়ে বিয়েই নয়।

তোমরা বললে, “বিন্দু মিথ্যা কথা বলছে”

আমি বললুম , “ও কখনো মিথ্যা বলে নি?”

তোমরা বললে, “কেমন করে জানলে ।”

আমি বললুম,“আমি নিশ্চয় জানি?”

তোমরা ভয় দেখালে, “বিন্দুর শ্বশুরবাড়ির লোকে পুলিস-কেস করলে মুশকিলে পড়তে হবে”

আমি বললুম,“ফাঁকি দিয়ে পাগল বরের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়েছে এ কথা কি আদালত শুনবে

না”

তোমরা বললে, “তবে কি এই নিয়ে আদালত করতে হবে নাকি | কেন, আমাদের দীয় কিসের 1”

আমি বললুম, “আমি নিজের গয়না বেচে যা করতে পারি করব ৮”

তোমরা বললে, “উকিল বড়ে ছুটবে নাকি ”

এ কথার জবাব নেই | কপালে করাঘাত করতে পারি, তার বেশি আর কী করব |

ওদিকে বিন্দুর শৃশুড়বাড়ি থেকে ওর ভাসুর এসে বাইরে বিষম গোল বাধিয়েছে | সে বলছে, সে

থানায় খবর দেবে |

আমার যে কি জোর আছে জানি নে — কিন্তু কসাইয়ের হাত থেকে যে গরু প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে

আমার আশ্রয় নিয়েছেতাকে পুলিসের তাহায় আবার মন মানতে পারল না | আমি স্পর্ধা করে

বললুম,“তা দিক থানায় খবর 1”

এই বলে মনে করলুম, বিন্দুকে এইবেলা আমার শোবার ঘরে এনে তাকে নিয়ে তালাবদ্ধ করে

বসে থাকি ।খোৌঁজ করে দেখি, বিন্দু নেই | তোমাদের সঙ্গে আমার বাদপ্রতিবাদ যখন চলছিল তখন

বিন্দু আপনি বাইরে গিয়ে তার ভাসুরের কাছে ধরা দিয়েছে । বুঝেছি, এ বাড়িতে যদি সে থাকে তবে

আমাকে সে বিষম বিপদে ফেলবে |

মাঝখানে পালিয়ে এসে বিন্দু আপন দুঃখ আবের বাড়ালে । তার শাশুড়ি তর্ক এই যে। তার ছেলে

তো ওকে খেয়ে ফেলেছিল না । মন্দ স্বামীর দৃষ্টান্ত সংসারে দুর্লভ নয়, তাদের সঙ্গে তুলনা করলে তার

ছেলে যে সোনার চাঁদ |

আমার বড়ো জা বললেন, “ওর পোড়া কপাল, তা নিয়ে দুঃখ করে কী করব | তা পাগল হোক,

ছাগল হোক, স্বামী তো বটে 1”

কুষ্টরোগীকে কোলে করে তার স্ত্রী সেহযার বাড়িতে নিজে পৌছে দিয়েছে সতীসাধীর সেই দৃষ্টান্ত

তোমাদের মনে জাগছিল ; জগতের মধ্যে অধমতম কাপুরুষতার এই গল্পটা প্রচার করে আসতে

তোমাদের পুরুষের মনে আজ পর্যন্ত একটুও সংকোচবোধ হয় নি, সেইজন্যই মানবজন্ম নিয়েও বিন্দুর

ব্যবহারে তোমরা রাগ করতে পেরেছ, তোমাদের মাথা হেটে হয় নি ।

বিন্দুর জন্যে আমার বুক ফেটে গেল কিন্তু তোমাদের জন্যে আমার লজ্জার সীমা ছিল না ।আমি

তো পাড়ােঁয়ে মেয়ে, তার উপরে তোমাদের ঘরে পড়েছি, ভগবান কোন্‌ ফাক দিয়ে আমার মধ্যে

এমন বুদ্ধি দিলেন | তোমাদের এই-সব ধর্মের কথা আমি যে কিছুতেই সইতে পারলুম না ।

আমি নিশ্চয় জানতুম, মরে গেলেও বিন্দু আমাদের ঘরে আর আসবে না, কিন্তু আমি যে তাকে বিয়ের আগের

দিন আশা দিয়েছিলুম যে, তাকে শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করব না। আমার ছোটো ভাই শরৎ কলকাতায় কলেজে

পড়ছিল ; তোমরা জানই তো যতরকমের ভলন্টিয়ারি করা, প্রেগের পাড়ার ইদুর মারা, দামোদরের বন্যায়

ছোটো, এতেই তার এত উৎসাহ যে উপরি উপরি দুবার সে এফ, এ পরীক্ষায় ফেল করেও কিছুমাত্র দমে যায়

নি। তাকে আমি ডেকে বললুম, “বিন্দুর খবর যাতে আমি পাই তোকে সেই বন্দোবস্ত করে দিতে হবে, শরৎ।

বিন্দু আমাকে চিঠি লিখতে সাহস করবে না, লিখলেও আমি পাব না”

এরকম কাজের চেয়ে যদি তাকে বলতুম, বিন্দুকে ডাকাতি করে আনতে কিম্বা তার পাগল

স্বামীর মাথা ভেঙে দিতে তা হলে বেশি খুশি হত।

শরতের সঙ্গে আলোচনা করছি এমন সময় তুমি ঘরে এসে বললে, “আবার কী হাঙ্গামা

বাধিয়েছ”

আমি বললুম, “সেই যা-সব গোড়ায় বাধিয়েছিলুম, তোমাদের ঘরে এসেছিলুম –কিন্তু সেতো

তোমাদেরই কীর্তি”

তুমি জিজ্ঞাসা করলে, “বিন্দুকে আবার এনে কোথাও লুকিয়ে রেখেছি ?”

আকি বললুম, “বিন্দু যদি আসত তা হলে নিশ্চয় ষনে লুকিয়ে রাখতুম। কিন্তু সে আসবে না,

তোমাদের ভয় নেই 1”

শরৎকে আমার কাছে দেখে তোমার সন্দেহ আরো বেড়ে উঠল। আমি জানতুম, শরৎ

আমাদের বাড়ি যাতায়াত করে, এ তোমরা কিছুতেই পছন্দ করতে না। তোমাদের ভয় ছিল, ওর পরে

ফেলবে। সেইজন্যে আমি ওকে ভাইফোঁটা পর্যস্ত লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিতুম, ঘরে ভাকতুম না।

তোমার কাছে শুনলুম, বিন্দু আবার পালিয়েছে, তাই তোমাদের বাড়িতে তার ভাসুর খৌজ

করতে এসেছে। শুনে আমার বুকের মধ্যে শেল বিধল। হতভাগিনীর যে কী অসহ্য কষ্ট তা বুঝলুম

অথচ কিছুই করবার রাস্তা নেই ।

শরৎ খবর নিতে ছুটল। সন্ধ্যার সময় ফিরে এসে আমাকে বললে, বিন্দু তার খুড়ততো

ভাইদের বাড়ি গিয়েছিল, কিন্তু তারা তুমুল রাগ করে তখনই আবার তাকে শ্বশুরবাড়ি গৌঁছে দিয়ে

গেছে। এর জন্যে তাদের খেসারত এবং গাড়িভাড়া দন্ড যা ঘটেছে, তার বাঁজ এখনো তাদের মন থেকে

মরে নি।

তোমাদের খুড়িমা শ্রীক্ষেত্রে তীর্থ করতে যাবেন বলে তোমাদের বাড়িতে এসে উঠেছেন। আমি

তোমাদের বললুম, “আমিও যাব”

আমার হঠাৎ এমন ধর্মে মন হয়েছে দেখে তোমরা এত খুশি হয়ে উঠলে যে, কিছুমাত্র আপত্তি

করলে না। এ কথা ও মনে ছিল যে, এখন যদি কলকাতায় থাকি তবে আবার কোন্‌ দিন বিন্দুকে নিয়ে

ফ্যাসাদ বাধিয়ে বসব । আমাকে নিয়ে বিষম ল্যাঠা।

বুধবার আমাদের যাবার দিন, রবিবারে সমস্ত ঠিক হল । আমি শরৎকে ডেকে বললুম,“যেমন করে

হোক, বিন্দুকে বুধবারে পুরী যাবার গাড়িতে তোকে তুলে দিতে হবে ”

শরতের মুখ প্রফুল্ল হয়ে উঠল ; সে বললে, “ভয় নেই, দিদি, আমি তাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে

পুরী পর্যন্ত চলে যাব। — ফাঁকি দিয়ে জগন্নাথ দেখা হয়ে যাবে।”

সেইদিন সন্ধ্যার সময় শরৎ আবার এল তার মুখ দেখেই আমার বুক দমে গেল। আমি

বললুম,“কী, শরৎ ? সুবিধা হল না বুঝি ?”

সে বললে, না?”

সে বললে,“এরে দরকার নেই। কাল রান্তিরে সে কাপড়ে আগুন ধরিয়ে আঅহত্যা করে মরেছে।

বাড়ির যে ভাইপোটার সঙ্গে ভাব করে নিয়েছিলুম, তার কাছে খবর পেলুম, তোমার নামে সে একটা

চিঠি রেখে গিয়েছিল, কিন্তু সে চিঠি ওরা নষ্ট করেছে”

যাক, শান্তি হল।

দেশসুদ্ধ লোক চটে উঠল। বলতে লাগল, “মেয়েদের কাপড়ে আগুন লাগিয়ে মরা একটা ফ্যাশান

হয়েছে”

তোমরা বললে, “এ-সমস্ত নাটক করা ” তা হবে। কিন্তু নাটকের তামাশাটা কেবল বাঙালি

মেয়েদের উপর দিয়েই হয় কেন, আর বাঙালি বীরপুরুষদের কৌচার উপর দিয়ে হয় নাকেন, সেটা

ভেবে দেখা উচিত।

বিন্দিটার এমনি পোড়া কপাল বটে ! যতদিন বেচে ছিলে রূপে গুণে কোনো যশ পায় নি — মরবার

বেলাও যে একটু ভেবে চিন্তে এমন একটা নতুন ধরনে মরবে যাতে দেশের পুরুষেরা খুশি হয়ে

হাততালি দেবে তাও তার ঘটে এল না। মরেও লোকদের চটিয়ে দিলে !

দিদি ঘরের মধ্যে লুকিয়ে কীদলেন। কিন্তু সে কান্নার মধ্যে এমটা সান্তনা ছিল। যাই হোক-না

কেন, তবু রক্ষা হয়েছে, মরেছে বৈ তো না ! বেঁচে থাকলে কী না হতে পারত।

আমি তীর্থে এসেছি। বিন্দুর আর আসবার দরকার হল না। কিন্তু আমার দরকার ছিল।

দুঃখ বলতে লোকে যা বোঝে তোমাদের সংসারে তা আমার ছিল না। তোমাদের ঘরে খাওয়া-

পরা অসচ্ছল নয় ;তোমার দাদার চরিত্র যেমন হোক, তোমার চরিত্রে এমন কোনো দোষ নেই যাতে

বিধাতাকে মন্দ বলতে পারি। যদি বা তোমার স্বাভাব তোমার দাদার মতোই হত তা হলে হয়তো মোটের

উপর আমার এমনি ভাবেই দিন চলে যেত এবং আমার সতীসাধী বড়ো জায়ের মতো পতিদেবতাকে

দোষ না দিয়ে বিশ্বদেবতাকেই আমি দোষ দেবার চেষ্টা করতুম | অতএব তোমাদের নামে আমি কোনো

নালিশ উত্থাপন করতে চাই নে — আমার এ চিঠি সেজন্যে নয়।

কিন্তু আমি আর তোমাদের সেই সাতাশ নম্বর মাখন বড়ালের গলিতে ফিরব না। আমি বিন্দুকে

দেখেছি সংসারের মাঝখানে মেয়েমানুষের পরিচয়টা যে কী তা আমি পেয়েছি। আর আমার দরকার

নেই।

তার পরে এও দেখেছি, ও মেয়ে বটে তবু ভগবান ওকে ত্যাগ করেন নি। ওর উপরে

তোমাদের যত জোরই থাক্‌-না কেন, সে জোরের অন্ত আছে। ও আপনার হতভাগ্য মানবজন্মের চেয়ে

বড়ো। তোমরাই যে আপন ইচ্ছামত আটন দস্তুর দিয়ে ওর জীবনটাকে চিরকাল পায়ের তলায় চেপে

রেখে দেবে, তোমাদের পা এত লম্বা নয়। মৃত্যু তোমাদের চেয়ে বড়ো । সেই মৃত্যুর মধ্যে সে মহান –

– সেখনে বিন্দু কেবল বাঙালি ঘরের মেয়ে নয়, কেবল খড়ততো ভায়ের বোন নয়, কেবল অপরিচিত

পাগল স্বামীর প্রবঞ্চিত স্ত্রী নয়। সেখানে সে অনন্ত।

সেই মৃত্যুর বাশি এই বালিকার ভাঙা হৃদয়ের ভিতর দিয়ে আমার জীবনের যমুনাপারে যেদিন

বাজল সেদিন প্রথমটা আমার বুকের মধ্যে যেন বাণ বিধল। বিধাতাকে জিজ্ঞাসা করলুম, জগতের মধ্যে

যা-কিছু সব চেয়ে তুচ্ছ তাই সব চেয়ে কঠিন কেন ? এই গলির মধ্যকার চারি-দিকে-প্রাচীর-তোলা

নিরানন্দের অতি সামান্য বুদ্বুদটা এমন ভয়ংকর বাধা কেন। তোমার বিশবজগৎ তার ছয় খতুর

সুধাপাত্র হাতে করে যেমন করেই ডাক দিক-না, এক মুহুর্তের জন্যে কেন আমি এই অন্দরমহলটার

ঠইটুকু মাত্র চৌকাঠ পেরতে পারি নে। তোমার এমন ভুবনে আমার এমন জীবন নিয়ে কেন এ অতি

তুচ্ছ ইটকাঠের আড়ালটার মধ্যেই আমাকে তিলে তিলে মরতেই হবে। কত তুচ্ছ আমার এই

প্রতিদিনের জীবনযাত্রা, কত তুচ্ছ এর সমস্ত বাঁধা নিয়ম, বাঁধা অভ্যাস, বাঁধী বুলি, এর সমস্ত বাঁধা

মার — কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই দীনতার নাগপাশ বন্ধনেরই হবে জিত — আর হার হল তোমার নিজের

সৃষ্টি এ আনন্দলোকের ?

কিন্তু মৃত্যুর বাশি বাজাতে লাগল — কোথায় রে রাজমিস্ত্রির গড়া দেয়াল, কোথায় রে তোমাদের

ঘোরা আইন দিয়ে গড়া কাঁটার বেড়া ; কেন্‌ দুঃখে কোন্‌ অপমানে মানুষকে বন্দী করে রেখে দিতে

পারে ! এ তো মৃত্যুর হাতে জীবনের জয়পতাকা উড়ছে ! ওরে মেজোবউ, ভয় নেই তোর ! তোর

মেজবউয়ের খোলস ছিন্ন হতে এক নিমেষও লাগে না।

তোমাদের গলিকে আর আমি ভয় করি নে । আমার সন্মুখে আজ নীল সমুদ্র, আমার মাথার উপরে

আধাটের মেঘপুঞ্জ।

তোমাদের অভ্যাসের অন্ধকারে আমাকে ঢেকে রেখে দিয়েছিলে । ক্ষণকালের জন্য বিন্দু এসে

সেই আবরণের ছিত্র দিয়ে আমাকে দেখে নিয়েছিল । সেই মেয়েটাই তার আপনার মৃত্যু দিয়ে

আবরণখানা আগাগোড়া ছিন্ন করে দিয়ে গেল। আজ বাইরে এসে দেখি, আমার গৌরব রাখবার আর

জায়গা নেই। আমার এই আনাদূত রূপ যার চোখে ভালো লেগেছে, সেই সুন্দর সমস্ত আকাশ দিয়ে

আমাকে চেয়ে দেখছেন । এইবার মরেছে মেজোবউ।

না। মীরাবাঈ ও তো আমারই মতো মেয়েমানুষ ছিল– তার শিকল ও তো কম ভারী ছিল না তাকে

তো বাঁচবার জন্যে মরতে হয় নি। মীরাবাঈ তার গানে বলেছিল,ছাড়ুক বাপ, ছাড়ুকমা, ছাড়ুক যে

যেখানে আছে, মীরা কিন্তু লেগেই রইল, প্রভূ– তাতে তার যা হবার তা হোক। এই লেগে থাকাই তো

বেচে থাকা । আমিও বাঁচব। আমি বাঁচলুম।

তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন  —  

মৃণাল।

raateralo.com

Leave a Comment