Some famous poems of Sukumar Roy 2024 l সুকুমার রায়ের বিখ্যাত কিছু কবিতা 2024: বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিভাবান কবি সুকুমার রায়, যিনি শিশু সাহিত্যিক হিসেবে বিশেষ পরিচিত, তাঁর সৃষ্টির জগতে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর লেখায় মিশে আছে মজার ছলে গুরুগম্ভীর জীবনবোধ ও তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ। সুকুমার রায়ের কবিতাগুলোতে আমরা পাই এক অনন্য রসবোধ এবং শিশুমনকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি সমাজের নানা অসঙ্গতি ও ত্রুটি নিয়ে তীব্র কটাক্ষ।
সুকুমার রায়ের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর অনন্য শব্দচয়ন এবং ছন্দ। তাঁর কবিতাগুলিতে ব্যবহৃত হাস্যরস এবং বিদ্রূপমিশ্রিত মন্তব্যগুলো আমাদের মনের গভীরে স্থান করে নেয়। ছোটদের জন্য লেখা হলেও তাঁর কবিতাগুলো সকল বয়সের পাঠকের কাছেই সমাদৃত।
এই ব্লগে আমরা সুকুমার রায়ের বিখ্যাত কিছু কবিতার সাথে পরিচিত হব। তাঁর রচনাশৈলী, বিষয়বস্তু এবং কবিতার মাধ্যমে ব্যক্ত করা বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করব। সুকুমার রায়ের বিখ্যাত কবিতাগুলোর মধ্যে “আবোল তাবোল”, “হযবরল”, “লেখা” এবং “খিচুড়ি” অন্যতম। আসুন, আমরা ডুব দিই সুকুমার রায়ের মজার এবং মনোগ্রাহী কবিতার জগতে।
Some famous poems of Sukumar Roy 2024 l সুকুমার রায়ের বিখ্যাত কিছু কবিতা 2024
Table of Contents
আড়ি
-সুকুমার রায়
কিসে কিসে ভাব নেই? ভক্ষক ও ভক্ষ্যে—
বাঘে ছাগে মিল হলে আর নেই রক্ষে।
শেয়ালের সাড়া পেলে কুকুরেরা তৈরি,
সাপে আর নেউলে ত চিরকাল বৈরী!
আদা আর কাঁচকলা মেলে কোনোদিন্ সে?
কোকিলের ডাক শুনে কাক জ্বলে হিংসেয়।
তেলে দেওয়া বেগুনের ঝগড়াটা দেখনি?
ছ্যাঁক্ ছ্যাঁক্ রাগ যেন খেতে আসে এখনি।
তার চেয়ে বেশি আড়ি পারি আমি কহিতে—
তোমাদের কারো কারো কেতাবের সহিতে।
আজব খেলা
-সুকুমার রায়
সোনার মেঘে আল্তা ঢেলে সিঁদুর মেখে গায়
সকাল সাঁঝে সূর্যি মামা নিত্যি আসে যায়।
নিত্যি খেলে রঙের খেলা আকাশ ভ’রে ভ’রে
আপন ছবি আপনি মুছে আঁকে নূতন ক’রে।
ভোরের ছবি মিলিয়ে দিল দিনের আল জ্বেলে
সাঁঝের আঁকা রঙিন ছবি রাতের কালি ঢেলে।
আবার আঁকে আবার মোছে দিনের পরে দিন
আপন সাথে আপন খেলা চলে বিরামহীন।
ফুরায় নাকি সোনার খেলা? রঙের নাহি পার?
কেউ কি জানে কাহার সাথে এমন খেলা তার?
সেই খেলা, যে ধরার বুকে আলোর গানে গানে
উঠ্ছে জেগে- সেই কথা কি সুর্যিমামা জানে?
আবোল তাবোল
-সুকুমার রায়
আয়রে ভোলা খেয়াল‐খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।
আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে
নাইকো মানে নাইকো সুর,
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
মন ভেসে যায় কোন সুদূর।…
আয় ক্ষ্যাপা‐মন ঘুচিয়ে বাঁধন
জাগিয়ে নাচন তাধিন্ ধিন্,
আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া
নিয়মহারা হিসাবহীন।
আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল
মাতবি মাতাল রঙ্গেতে—
আয়রে তবে ভুলের ভবে
অসম্ভবের ছন্দেতে॥
বাবুরাম সাপুড়ে
-সুকুমার রায়
বাবুরাম সাপুড়ে,
কোথা যাস্ বাপুরে?
আয় বাবা দেখে যা,
দুটো সাপ রেখে যা!
যে সাপের চোখ্ নেই,
শিং নেই নোখ্ নেই,
ছোটে নাকি হাঁটে না,
কাউকে যে কাটে না,
করে নাকো ফোঁস ফাঁস,
মারে নাকো ঢুঁশ্ ঢাঁশ্,
নেই কোন উৎপাত,
খায় শুধু দুধভাত–
সেই সাপ জ্যাম্ত
গোটা দুই আনত?
তেড়ে মেরে ডাণ্ডা
ক’রে দেই ঠাণ্ডা।
বেজায় খুশি
-সুকুমার রায়
বাহবা বাবুলাল ! গেলে যে হেসে !
বগলে কাতুকুতু কে দিল এসে ?
এদিকে মিটিমিটি দেখ কি চেয়ে ?
হাসি যে ফেটে পড়ে দু’গাল বেয়ে !
হাসে যে রাঙা ঠোঁট দন্ত মেলে
চোখের কোণে কোণে বিজলী খেলে ।
হাসির রসে গ’লে ঝরে যে লালা
কেন এ খি-খি-খি-খি হাসির পালা ?
যে দেখে সেই হাসে হাহাহা হাহা
বাহবা বাবুলাল বাহবা বাহা !
ভালরে ভাল
-সুকুমার রায়
দাদা গো! দেখছি ভেবে অনেক দূর
এই দুনিয়ার সকল ভাল,
আসল ভাল নকল ভাল,
সস্তা ভাল দামীও ভাল,
তুমিও ভাল আমিও ভাল,
হেথায় গানের ছন্দ ভাল,
হেথায় ফুলের গন্ধ ভাল,
মেঘ-মাখানো আকাশ ভাল,
ঢেউ- জাগানো বাতাস ভাল,
গ্রীষ্ম ভাল বর্ষা ভাল,
ময়লা ভাল ফরসা ভাল,
পোলাও ভাল কোর্মা ভাল,
মাছপটোলের দোলমা ভাল,
কাঁচাও ভাল পাকাও ভাল,
সোজাও ভাল বাঁকাও ভাল,
কাঁসিও ভাল ঢাকও ভাল,
টিকিও ভাল টাক্ও ভাল,
ঠেলার গাড়ী ঠেলতে ভাল,
খাস্তা লুচি বেলতে ভাল,
গিট্কিরি গান শুনতে ভাল,
শিমুল তুলো ধুনতে ভাল,
ঠান্ডা জলে নাইতে ভাল।
কিন্তু সবার চাইতে ভাল-
পাঁউরুটি আর ঝোলা গুড়।
ভূতুড়ে খেলা
-সুকুমার রায়
পরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে,
পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছনাতে৷
কচ্ছে খেলা মায়ের কোলে হাত পা নেড়ে উল্লাসে,
আহলাদেতে ধুপধুপিয়ে কচ্ছে কেমন হল্লা সে৷
শুনতে পেলাম ভূতের মায়ের মুচকি হাসি কট্কটে—
দেখছে নেড়ে ঝুন্টি ধ’রে বাচ্চা কেমন চট্পটে৷
উঠছে তাদের হাসির হানা কাষ্ঠ সুরে ডাক ছেড়ে,
খ্যাঁশ্ খ্যাঁশানি শব্দে যেন করাত দিয়ে কাঠ চেরে!
যেমন খুশি মারছে ঘুঁষি, দিচ্ছে কষে কানমলা,
আদর করে আছাড় মেরে শূন্যে ঝোলে চ্যাং দোলা৷
বলছে আবার, ‘আয়রে আমার নোংরামুখো সুঁটকো রে,
দেখনা ফিরে প্যাখনা ধরে হুতোম–হাসি মুখ করে!
ওরে আমার বাঁদর–নাচন আদর–গেলা কোঁত্কা রে!
অন্ধবনের গন্ধ–গোকুল, ওরে আমার হোঁত্কা রে!
ওরে আমার বাদলা রোদে জষ্টি মাসের বিষ্টি রে,
ওরে আমার হামান–ছেঁচা যষ্টিমধুর মিষ্টি রে৷
ওরে আমার রান্না হাঁড়ির কান্না হাসির ফোড়নদার,
ওরে আমার জোছনা হাওয়ার স্বপ্নঘোড়ার চড়নদার৷
ওরে আমার গোবরা গণেশ ময়দাঠাসা নাদুস্ রে,
ছিঁচকাঁদুনে ফোক্লা মানিক, ফের যদি তুই কাঁদিস রে—’
এই না ব’লে যেই মেরেছে কাদার চাপটি ফট্ ক’রে,
কোথায় বা কি, ভূতের ফাঁকি মিলিয়ে গেল চট্ ক’রে!
বিচার
-সুকুমার রায়
ইঁদুর দেখে মাম্দো কুকুর বল্লে তেড়ে হেঁকে-
‘বলব কি আর, বড়ই খুশি হলেম তোরে দেখে।
আজকে আমার কাজ কিছু নেই, সময় আছে মেলা,
আয় না খেলি দুইজনাতে মোকদ্দমা খেলা ।
তুই হবি চোর তোর নামেতে করব নালিশ রুজু’-
‘জজ্ কে হবে?’ বল্লে ইঁদুর ,বিষম ভয়ে জুজু,
‘কোথায় উকিল প্যায়দা পুলিশ , বিচার কিসে হবে?’
মাম্দো বলে ‘তাও জানিসনে ? শোন বলে দেই তবে!
আমিই হব উকিল হাকিম , আমিই হব জুরি,
কান ধরে তোর বলব ব্যাটা, ফের করেছিস চুরি?
সটান দেব ফাসির হুকুম অমনি একেবারে-
বুঝবি তখন চোর বাছাধন বিচার বলে কারে।’
বিষম কাণ্ড
-সুকুমার রায়
কর্তা চলেন, গিন্নী চলেন, খোকাও চলেন সাথে,
তড়্বড়িয়ে বুক ফুলিয়ে শুতে যাচ্ছেন রাতে ।
তেড়ে হন্হন্ চলে তিনজন যেন পল্টন চলে,
সিঁড়ি উঠ্তেই, একি কাণ্ড ! এ আবার কি বলে !
ল্যাজ লম্বা, কান গোল্ গোল্, তিড়িং বিড়িং ছোটে,
চোখ্ মিট্মিট্, কুটুস্ কাটুস্- এটি কোন্জন বটে !
হেই ! হুস্ ! হ্যাস্ ! ওরে বাস্রে মতলবখানা কিরে,
করলে তাড়া যায় না তবু, দেখ্ছে আবার ফিরে ।
ভাবছে বুড়ো, করবো গুঁড়ো ছাতার বাড়ি মেরে,
আবার ভাবে ফস্কে গেলে কাম্ড়ে দেবে তেড়ে ।
আরে বাপ্রে ! বস্ল দেখ দুই পায়ে ভর ক’রে,
বুক দুর দুর বুড়ো ভল্লুর, মোমবাতি যায় প’ড়ে ।
ভীষণ ভয়ে দাঁত কপাটি তিন মহাবীর কাঁপে,
গড়িয়ে নামে হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ির ধাপে ধাপে ।
বিষম ভোজ
-সুকুমার রায়
“অবাক কান্ড!” বল্লে পিসী, “এক চাঙাড়ি মেঠাই এল-
এই ছিল সব খাটের তলায়, এক নিমিষে কোথায় গেল?”
সত্যি বটে বললে খুড়ী, “আনলো দু’সের মিঠাই কিনে-
হঠাৎ কোথায় উপসে গেল? ভেল্কিবাজি দুপুর দিনে?”
“দাঁড়াও দেখি” বল্লে দাদা, “কর্ছি আমি এর কিনারা-
কোথায় গেল পটলা ট্যাঁপা – পাচ্ছিনে যে তাদের সাড়া?”
পর্দাঘেরা আড়াল দেওয়া বারান্দাটার ঐ কোণেতে
চল্ছে কি সব ফিস্ ফ্সি্ ফিস্ শুনলে দাদা কানটি পেতে।
পটলা ট্যাঁপা ব্যস্ত দুজন ট্প্টপাটপ্ মিঠাই ভোজে,
হঠাৎ দেখে কার দুটো হাত এগিয়ে তাদের কানটি খোঁজে।
কানের উপর প্যাঁচ্ ঘুরাতেই দু চোখ বেয়ে অশ্রু ছোটে,
গিলবে কি ছাই মুখের মিঠাই ,কান বুঝি যায় টানের চোটে।
পটল বাবুর হোম্রা গলা মিল্ল ট্যাঁপার চিকন সুরে
জাগ্ল করুন রাগরাগিণী বিকট তানে আকাশ জুড়ে।
বদ্যি বুড়ো
-সুকুমার রায়
শুন্ছ দাদা! ঐ যে হোথায় বদ্যি বুড়ো থাকে ,
সে নাকি রোজ খাবার সময় হাত দিয়ে ভাত মাখে?
শুন্ছি নাকি খিদেও পায় সারাদিন না খেলে ?
চক্ষু নাকি আপনি বোজে ঘুমটি তেমন পেলে ?
চলতে গেলে ঠ্যাং নাকি তার ভুয়েঁর পরে ঠেকে?
কান দিয়ে সব শোনে নাকি? চোখ দিয়ে সব দেখে?
শোয় নাকি সে মুন্ডুটাকে শিয়র পানে দিয়ে?
হয় না কি হয় সত্যি মিথ্যা চল না দেখি গিয়ে!
বোম্বাগড়ের রাজা
-সুকুমার রায়
কেউ কি জান সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা-
ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা?
রানীর মাথায় অষ্টপ্রহর কেন বালিশ বাঁধা?
পাঁউরুটিতে পেরেক ঠোকে কেন রানীর দাদা?
কেন সেথায় সর্দি হলে ডিগবাজি খায় লোকে?
জোছ্না রাতে সবাই কেন আলতা মাথায় চোখে?
ওস্তাদেরা লেপ মুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে?
টাকের পরে পন্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে।
রাত্রে কেন ট্যাঁক্ঘড়িটা ডুবিয়ে রাখে ঘিয়ে।
কেন রাজার বিছ্না পাতে শিরীষ কাগজ দিয়ে?
সভায় কেন চেঁচায় রাজা “হুক্কা হুয়া” বলে?
মন্ত্রী কেন কলসী বাজায় বসে রাজার কোলে?
সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি?
কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসী?
রাজার খুড়ো নাচেন কেন হুঁকোর মালা পরে?
এমন কেন ঘটছে তা কেউ বলতে পার মোরে?
বুড়ীর বাড়ী
-সুকুমার রায়
গালভরা হাসিমুখে চালভাজা মুড়ি,
ঝুরঝুরে প’ড়ো ঘরে থুর্থুরে বুড়ী৷
কাঁথাভরা ঝুলকালি, মাথাভরা ধুলো,
মিট্মিটে ঘোলা চোখ, পিট খানা কুলো৷
কাঁটা দিয়ে আঁটা ঘর—আঠা দিয়ে সেঁটে,
সূতো দিয়ে বেঁধে রাখে থুতু দিয়ে চেটে৷
ভর দিতে ভয় হয় ঘর বুঝি পড়ে,
খক্ খক্ কাশি দিলে ঠক্ ঠক্ নড়ে৷
ডাকে যদি ফিরিওয়ালা, হাঁকে যদি গাড়ী,
খসে পড়ে কড়িকাঠ ধসে পড়ে বাড়ী৷
বাঁকাচোরা ঘরদোর ফাঁকা ফাঁকা কত,
ঝাঁট দিলে ঝরে প’ড়ে কাঠকুটো যত৷
ছাদগুলো ঝুলে পড়ে বাদ্লায় ভিজে,
একা বুড়ী কাঠি গুঁজে ঠেকা দেয় নিজে৷
মেরামত দিনরাত কেরামত ভারি,
থুর্থুরে বুড়ী তার ঝুর্ঝুরে বাড়ী৷৷
চোর ধরা
-সুকুমার রায়
আরে ছি ছি! রাম রাম! ব’লো নাহে ব’লো না,
চল্ছে যা জুয়াচুরি, নাহি তার তুলনা!
যেই আমি দেই ঘুম টিফিনের আগেতে,
ভয়ানক ক’মে যায় খাবারের ভাগেতে!
রোজ দেখি খেয়ে গেছে, জানিনাকো কারা সে,
কালকে যা হ’য়ে গেল ডাকাতির বাড়া সে!
পাঁচখানা কাট্লেট, লুচি তিন গণ্ডা,
গোটা দুই জিবে গজা, গুটি দুই মণ্ডা,
আরো কত ছিল পাতে আলুভাজা ঘুঙ্নি—
ঘুম থেকে উঠে দেখি পাতাখানা শূন্যি!
তাই আজ ক্ষেপে গেছি—কত আর পার্ব?
এতদিন স’য়ে স’য়ে এইবারে মার্ব৷
খাড়া আছি সারাদিন হুঁশিয়ার পাহারা,
দেখে নেব রোজ রোজ খেয়ে যায় কাহারা৷
রামু হও, দামু হও, ওপাড়ার ঘোষ বোস্—
যেই হও, এইবারে থেমে যাবে ফোঁস্ফোঁস্৷
খাট্বে না জারিজুরি আঁটবে না মার্প্যাঁচ্
যারে পাব ঘাড়ে ধ’রে কেটে দেব ঘ্যাঁচ্ঘ্যাঁচ্৷
এই দেখ ঢাল নিয়ে খাড়া আছি আড়ালে,
এইবারে টের পাবে মুণ্ডুটা বাড়ালে৷
রোজ বলি ‘সাবধান!’ কানে তবু যায় না?
ঠেলাখানা বুঝ্বি তো এইবারে আয় না!
Sukumar Roy’s greatest poems l Sukumar Roy children’s poems
ডানপিটে
-সুকুমার রায়
বাপ্রে কি ডানপিটে ছেলে!-
কোন দিন ফাঁসি যাবে নয় যাবে জেলে।
একটা সে ভুত সেজে আঠা মেখে মুখে,
ঠাঁই ঠাই শিশি ভাঙে শ্লেট দিয়ে ঠুকে।
অন্যটা হামা দিয়ে আলমারি চড়ে,
খাট থেকে রাগ ক’রে দুম্দাম্ পড়ে।
বাপরে কি ডানপিটে ছেলে!-
শিলনোড়া খেতে চায় দুধভাত ফেলে!
একটার দাঁত নেই, জিভ দিয়ে ঘষে,
একমনে মোমবাতি দেশলাই চোষে!
আরজন ঘরময় নীল কালি গুলে,
কপ্ কপ্ মাছি ধরে মুখে দেয় তুলে!
বাপরে কি ডানপিটে ছেলে!-
খুন হ’ত টম্ চাচা ওই রুটি খেলে!
সন্দেহে শুঁকে বুড়ো মুখে নাহি তোলে,
রেগে তাই দুই ভাই ফোঁস্ ফোঁস্ ফোলে!
নেড়াচুল খাড়া হয়ে রাঙা হয় রাগে,
বাপ্ বাপ্ ব’লে চাচা লাফ দিয়ে ভাগে।
গন্ধ বিচার
-সুকুমার রায়
সিংহাসনে বস্ল রাজা বাজল কাঁসর ঘন্টা,
ছট্ফটিয়ে উঠল কেঁপে মন্ত্রীবুড়োর মনটা।
বললে রাজা, ‘মন্ত্রী, তোমার জামায় কেন গন্ধ?’
মন্ত্রী বলে, ‘এসেন্স দিছি- গন্ধ ত নয় মন্দ!’
রাজা বলেন, ‘মন্দ ভালো দেখুক শুঁকে বদ্যি,’
বদ্যি বলে, ‘আমার নাকে বেজায় হল সর্দি।’
রাজা হাঁকেন , ‘বোলাও তবে- রাম নারায়ণ পাত্র।’
পাত্র বলে, ‘নস্যি নিলাম এক্ষনি এইমাত্র-
নস্যি দিয়ে বন্ধ যে নাক, গন্ধ কোথায় ঢুকবে?’
রাজা বলেন, ‘কোটাল তবে এগিয়ে এস শুক্বে।’
কোটাল বলে, ‘পান খেয়েছি মশলা তাহে কর্পূর,
গন্ধে তারি মুন্ড আমার এক্কেবারে ভরপুর।’
রাজা বলেন, ‘আসুক তবে শের পালোয়ান ভীমসিং,’
ভীম বলে, ‘আজ কচ্ছে আমার সমস্ত গা ঝিম্ ঝিম্
রাত্রে আমার বোখার হল, বলছি হুজুর ঠিক বাৎ’-
ব’লেই শুল রাজসভাতে চক্ষু বুজে চিৎপাত।
রাজার শালা চন্দ্রকেতু তারেই ধ’রে শেষটা
বল্ল রাজা, ‘তুমিই না হয় কর না ভাই চেষ্টা।’
চন্দ্র বলেন, ‘মারতে চাও ত ডাকাও নাকো জল্লাদ,
গন্ধ শুকে মর্তে হবে এ আবার কি আহ্লাদ?’
ছিল হাজির বৃদ্ধ নাজির বয়সটি তার নব্বই,
ভাব্ল মনে, ‘ভয় কেন আর একদিন তো মরবই-‘
সাহস করে বল্লে বুড়ো, ‘মিথ্যে সবাই বকছিস,
শুঁকতে পারি হুকুম পেলে এবং পেলে বক্শিস।’
রাজা বলেন, ‘হাজার টাকা ইনাম পাবে সদ্য,’
তাই না শুনে উৎসাহতে উঠ্ল বুড়ো মদ্দ।
জামার পরে নাক ঠেকিয়ে- শুক্ল কত গন্ধ,
রইল অটল, দেখ্ল লোকে বিস্ময়ে বাক্ বন্ধ।
রাজ্য হল জয় জয়কার বাজ্ল কাঁসর ঢক্কা,
বাপ্রে কি তেজ বুড়োর হাড়ে, পায় না সে যে অক্কা!
Sukumar Roy’s renowned poems l Popular poems of Sukumar Roy
হাত গণনা
-সুকুমার রায়
ও পাড়ার নন্দগোঁসাই, আমাদের নন্দ খুড়ো,
স্বভাবেতে সরল সোজা অমায়িক শান্ত বুড়ো৷
ছিল না তাঁর অসুখবিসুখ, ছিল সে যে মনের সুখে,
দেখা যেত সদাই তারে হুঁকো হাতে হাস্যমুখে৷
হঠাৎ কি তার খেয়াল হল, চল্ল সে তার হাত দেখাতে
ফিরে এল শুকনো সরু, ঠকাঠক্ কাঁপছে দাঁতে!
শুধালে সে কয় না কথা, আকাশেতে রয় সে চেয়ে,
মাঝে মাঝে শিউরে ওঠে, পড়ে জল চক্ষু বেয়ে৷
শুনে লোকে দৌড়ে এল, ছুটে এলেন বদ্যিমশাই,
সবাই বলে, ‘কাঁদছ কেন ? কি হয়েছে নন্দগোঁসাই?’
খুড়ো বলে, ‘বলব কি আর, হাতে আমার পষ্ট লেখা
আমার ঘাড়ে আছেন শনি, ফাঁড়ায় ভরা আয়ুর রেখা৷
এতদিন যায়নি জানা ফিরছি কত গ্রহের ফেরে—
হঠাৎ আমার প্রাণটা গেলে তখন আমায় রাখবে কে রে?
ষাটটা বছর পার হয়েছি বাপদাদাদের পুণ্যফলে—
ওরা তোদের নন্দ খুড়ো এবার বুঝি পটোল তোলে৷
কবে যে কি ঘটবে বিপদ কিছু হায় যায় না বলা—’
এই ব’লে সে উঠল কেঁদে ছেড়ে ভীষণ উচ্চ গলা৷
দেখে এলাম আজ সকালে গিয়ে ওদের পাড়ার মুখো,
বুড়ো আছে নেই কো হাসি, হাতে তার নেই কো হুঁকো৷
হিতে-বিপরীত
-সুকুমার রায়
ওরে ছাগল, বল্ত আগে
সুড় সুড়িটা কেমন লাগে?
কই গেল তোর জারিজুরি
লম্ফঝম্ফ বাহাদুরি।
নিত্যি যে তুই আসতি তেড়ে
শিং নেড়ে আর দাড়ি নেড়ে,
ওরে ছাগল করবি রে কি?
গুঁতোবি তো আয়না দেখি।
হাঁ হাঁ হাঁ, এ কেমন কথা ?
এমন ধারা অভদ্রতা!
শান্ত যারা ইতরপ্রাণী,
তাদের পরে চোখরাঙানি!
ঠান্ডা মেজাজ কয় না কিছু,
লাগতে গেছে তারই পিছু?
শিক্ষা তোদের এম্নিতর
ছি-ছি-ছি! লজ্জা বড়।
ছাগল ভাবে সামনে একি!
একটুখানি গুতিয়ে দেখি।
গুতোর চোটে ধড়াধ্বড়
হুড়মুড়িয়ে ধুলোয় পড়।
তবে রে পাজি লক্ষ্মীছাড়া,
আমার পরেই বিদ্যেঝড়া,
পাত্রাপাত্র নাই কিরে হুঁশ্
দে দমাদম্ ধুপুস্ ধাপুস্।
Famous poems of Sukumar Roy l Sukumar Roy poetry collection
হুঁকোমুখো হ্যাংলা
-সুকুমার রায়
হুঁকোমুখো হ্যাংলা বাড়ি তার বাংলা
মুখে তার হাসি নাই দেখেছ?
নাই তার মানে কি? কেউ তাহা জানে কি?
কেউ কভু তার কাছে থেকেছ?
শ্যামাদাস মামা তার আফিঙের থানাদার,
আর তার কেহ নাই এ-ছাড়া –
তাই বুঝি একা সে মুখখানা ফ্যাকাশে,
ব’সে আছে কাঁদ’-কাঁদ’ বেচারা?
থপ্ থপ্ পায়ে সে নাচত যে আয়েসে,
গালভরা ছিল তার ফুর্তি,
গাইতো সে সারা দিন ‘সারে গামা টিমটিম্’
আহ্লাদে গদ-গদ মূর্তি।
এই তো সে দুপ’রে বসে ওই উপরে,
খাচ্ছিল কাঁচকলা চটকে –
এর মাঝে হল কি? মামা তার মোলো কি?
অথবা কি ঠ্যাং গেল মটকে?
হুঁকোমুখো হেঁকে কয়, ‘আরে দূর, তা তো নয়,
দেখছ না কিরকম চিন্তা?
মাছি মারা ফন্দি এ যত ভাবি মন দিয়ে –
ভেবে ভেবে কেটে যায় দিনটা।
বসে যদি ডাইনে, লেখে মোর আইনে –
এই ল্যাজে মাছি মারি ত্রস্ত;
বামে যদি বসে তাও, নহি আমি পিছপাও,
এই ল্যাজে আছে তার অস্ত্র।
যদি দেখি কোনো পাজি বসে ঠিক মাঝামাঝি
কি যে করি ভেবে নাহি পাই রে –
ভেবে দ্যাখ একি দায় কোন্ ল্যাজে মারি তায়
দুটি বৈ ল্যাজ মোর নাই রে।’
আরো পড়ুন: প্রেমেন্দ্র মিত্র ভৌতিক গল্প – নিশাচর
হুলোর গান
-সুকুমার রায়
বিদ্ঘুটে রাত্তিরে ঘুট্ঘুটে ফাঁকা,
গাছপালা মিশ্মিশে মখ্মলে ঢাকা!
জট্বাঁধা ঝুল কালো বটগাছতলে,
ধক্ধক্ জোনাকির চক্মকি জ্বলে।
চুপচাপ চারিদিকে ঝোপ ঝাড়গুলো,
আয় ভাই গান গাই আয় ভাই হুলো।
গীত গাই কানে কানে চীৎকার ক’রে,
কোন্ গানে মন ভেজে শোন্ বলি তোরে।
পূবদিকে মাঝরাতে ছোপ্ দিয়ে রাঙা
রাতকানা চাঁদ ওঠে আধখানা ভাঙা।
চট্ ক’রে মনে পড়ে মট্কার কাছে
মালপোয়া আধখানা কাল থেকে আছে।
দুড়্ দুড়্ ছুটে যাই, দূর থেকে দেখি
প্রাণপণে ঠোঁট চাটে কানকাটা নেকী!
গালফোলা মুখে তার মালপোয়া ঠাসা,
ধুক ক’রে নিভে গেল বুকভরা আশা।
মন বলে আর কেন সংসারে থাকি,
বিল্কুল্ সব দেখি ভেল্কির ফাঁকি।
সব যেন বিচ্ছিরি সব যেন খালি,
গিন্নীর মুখ যেন চিম্নির কালি।
মন–ভাঙা দুখ্ মোর কন্ঠেতে পুরে
গান গাই আয় ভাই প্রাণফাটা সুরে।
সুকুমার রায়ের বিখ্যাত কিছু কবিতা l Sukumar Roy famous poems
সঙ্গীহারা
– সুকুমার রায়
সবাই নাচে ফূর্তি করে সবাই করে গান,
একলা বসে হাঁড়িচাঁচার মুখটি কেন ম্লান ?
দেখ্ছ নাকি আমার সাথে সবাই করে আড়ি-
তাইত আমার মেজাজ খ্যাপা মুখটি এমন হাঁড়ি ।
তাও কি হয় ! ঐ যে মাঠে শালিখ পাখি ডাকে
তার কাছে কৈ যাওনিকো ভাই শুধাওনিতো তাকে !
শালিখ পাখি বেজায় ঠ্যাঁটা চেঁচায় মিছিমিছি,
হল্লা শুনে হাড় জ্বলে যায় কেবল কিচিমিচি ।
মিষ্টি সুরে দোয়েল পাখি জুড়িয়ে দিল প্রাণ
তার কাছে কৈ বস্লে নাতো শুনলে না তার গান ।
দোয়েল পাখির ঘ্যান্ঘ্যানানি আর কি লাগে ভালো ?
যেমন রূপে তেমন গুণে তেমনি আবার কালো ।
রূপ যদি চাও যাও না কেন মাছরাঙার কাছে,
অমন খাসা রঙের বাহার আর কি কারো আছে ?
মাছরাঙা ? তারেও কি আর পাখির মধ্যে ধরি
রকম সকম সঙের মতন, দেমাক দেখে মরি ।
পায়রা ঘুঘু কোকিল চড়াই চন্দনা টুনটুনি
কারে তোমার পছন্দ হয়, সেই কথাটি শুনি !
এই গুলো সব ছ্যাবলা পাখি নেহাৎ ছোট জাত-
দেখলে আমি তফাৎ হাটি অমনি পঁচিশ হাত ।
এতক্ষণে বুঝতে পারি ব্যাপারখানা কি যে-
সবার তুমি খুঁৎ পেয়েছ নিখুঁৎ কেবল নিজে !
মনের মতন সঙ্গী তোমার কপালে নাই লেখা
তাইতে তোমায় কেউ পোঁছে না তাইতে থাক একা ।
Sukumar Roy humorous poems l Sukumar Roy classic poems
জীবনের হিসেব
বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে,
মাঝিরে কন, ”বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?”
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে হাসে।
বাবু বলেন, ”সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।”
খানিক বাদে কহেন বাবু, ”বলতো দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় থেকে নেবে?
বলতো কেন লবণ পোরা সাগর ভরা পানি?”
মাঝি সে কয়, ”আরে মশাই অত কি আর জানি?”
বাবু বলেন, ”এই বয়সে জানিসনেও তা কি
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!”
আবার ভেবে কহেন বাবু, ” বলতো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বলতো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলে, ”আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?”
বাবু বলেন, ”বলব কি আর বলব তোরে কি তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।”
খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে!
মাঝিরে কন, ” একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, ”সাঁতার জানো?”- মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, ”মশাই, এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!”
পাকাপাকি
– সুকুমার রায়
আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাগুনে,
কাঁচা ইট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে।
রোদে জলে টিকে রঙ পাকা কই তাহারে।
ফলারটি পাকা হয় লুচি দই আহারে।
হাত পাকে লিখে লিখে, চুল পাকে বয়সে,
জ্যাঠামিতে পাকা ছেলে বেশি কথা কয় সে।
লোকে কয় কাঁঠাল সে পাকে নাকি কিলিয়ে?
বুদ্ধি পাকিয়ে তোলে লেখাপড়া গিলিয়ে!
কান পাকে ফোড়া পাকে, পেকে করে টন্টন্-
কথা যার পাকা নয়, কাজে তার ঠন্ঠন্
রাঁধুনী বসিয়া পাকে পাক দেয় হাঁড়িতে,
সজোরে পাকালে চোখ ছেলে কাঁদে বাড়িতে।
পাকায়ে পাকায়ে দড়ি টান হয়ে থাকে সে।
দুহাতে পাকালে গোফঁ তবু নাহি পাকে সে।