Rabindranath Tagore’s poems on separation l Heartbreaking Poems by Rabindranath Tagore on Separation l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরহের কবিতা 2024 l রবীন্দ্রনাথের বিরহের কবিতা

By raateralo.com

Updated on:

Rabindranath Tagore's poems on separation

Rabindranath Tagore’s poems on separation 2024: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বিরহের কবিতা আমাদের সকলেরই জানা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবলমাত্র প্রেম প্রকৃতি ইত্যাদি নিয়ে কবিতা লেখেননি তিনি মানুষের মনের বিভিন্ন ধরনের ব্যথা-বেদনা কে তার কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুড়িটি বাছাইকৃত বিরহের কবিতার কথা বর্ণিত হয়েছে।

এই কবিতাগুলি আমাদের মানব জীবনের এক জীবন্ত প্রেক্ষাপট। এই কবিতাগুলি যখন আমরা পড়ি থাকেন আমাদের বাস্তব প্রতিছব্বি আমাদের সামনে ফোটে ওঠে।

Rabindranath Tagore’s poems on separation 2024l রবীন্দ্রনাথের বিরহের কবিতা

Table of Contents


 বিরহ

আমি নিশি – নিশি কত রচিব শয়ন
আকুলনয়ন রে !
কত নিতি – নিতি বনে করিব যতনে
কুসুমচয়ন রে !
কত শারদ যামিনী হইবে বিফল ,
বসন্ত যাবে চলিয়া !
কত উদিবে তপন আশার স্বপন ,
প্রভাতে যাইবে ছলিয়া !
এই যৌবন কত রাখিব বাঁধিয়া ,
মরিব কাঁদিয়া রে !
সেই চরণ পাইলে মরণ মাগিব
সাধিয়া সাধিয়া রে ।
আমি কার পথ চাহি এ জনম বাহি ,
কার দরশন যাচি রে !
যেন আসিবে বলিয়া কে গেছে চলিয়া ,
তাই আমি বসে আছি রে ।
তাই মালাটি গাঁথিয়া পরেছি মাথায়
নীলবাসে তনু ঢাকিয়া ,
তাই বিজন আলয়ে প্রদীপ জ্বালায়ে
একেলা রয়েছি জাগিয়া ।
ওগো তাই কত নিশি চাঁদ ওঠে হাসি ,
তাই কেঁদে যায় প্রভাতে ।
ওগো তাই ফুলবনে মধুসমীরণে
ফুটে ফুল কত শোভাতে !

 ওই       বাঁশিস্বর তার আসে বার বার ,
               সেই   শুধু কেন আসে না !
 এই       হৃদয় - আসন শূন্য যে থাকে ,
               কেঁদে মরে শুধু বাসনা ।
 মিছে     পরশিয়া কায় বায়ু বহে যায় ,
               বহে যমুনার লহরী ,
 কেন      কুহু কুহু পিক কুহরিয়া ওঠে —
                যামিনী যে ওঠে শিহরি ।
 ওগো     যদি নিশিশেষে আসে হেসে হেসে ,
                মোর হাসি আর রবে কি !
 এই       জাগরণে ক্ষীণ বদন মলিন
               আমারে হেরিয়া কবে কী !
 আমি      সারা রজনীর গাঁথা ফুলমালা
               প্রভাতে চরণে ঝরিব ,
 ওগো     আছে সুশীতল যমুনার জল —
               দেখে তারে আমি মরিব ।

(কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)

Tagore’s poetry about separation l রবীন্দ্রনাথের বিরহের কবিতা

বৃদ্ধ কবি

মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে
জীবন হতেছে শেষ,
শিথিল কপোল মলিন নয়ন
তুষার-ধবল কেশ!
পাশেতে আমার নীরবে পড়িয়া
অযতনে বীণাখানি,
বাজাবার বল নাইকো এ হাতে
জড়িমা জড়িত বাণী!
গীতিময়ী মোর সহচরী বীণা!
হইল বিদায় নিতে;
আর কি পারিবি ঢালিবারে তুই
অমৃত আমার চিতে?
তবু একবার আর-একবার
ত্যজিবার আগে প্রাণ,
মরিতে মরিতে গাহিয়া লইব
সাধের সে-সব গান!
দুলিবে আমার সমাধি-উপরে
তরুগণ শাখা তুলি,
বনদেবতারা গাইবে তখন
মরণের গানগুলি!

যাবার দিন

যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই –
যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।
এই জ্যোতিসমুদ্র মাঝে যে শতদল পদ্ম রাজে
তারি মধু পান করেছি, ধন্য আমি তাই।
যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।

বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে,
অপরূপকে দেখে গেলেম দুটি নয়ন মেলে।
পরশ যাঁরে যায় না করা সকল দেহে দিলেন ধরা,
এইখানে শেষ করেন যদি শেষ করে দিন তাই –
যাবার বেলা এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।।

(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)

Deep separation of the heart l হৃদয়ের গভীর বিরহ

ব্যর্থ

যদি প্রেম দিল না প্রাণে
কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে?
কেন তারার মালা গাঁথা,
কেন ফুলের শয়ন পাতা,
কেন দখিন হাওয়া গোপন কথা জানায় কানে কানে?।

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

কেন আকাশ তবে এমন চাওয়া চায় এ মুখের পানে?
তবে ক্ষণে ক্ষণে কেন
আমার হৃদয় পাগল হেন,
তরী সেই সাগরে ভাসায় যাহার কূল সে নাহি জানে?।

(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)

মেঘদূত

নিমেষে টুটিয়া গেল সে মহাপ্রতাপ।
ঊর্ধ্ব হতে একদিন দেবতার শাপ
পশিল সে সুখরাজ্যে, বিচ্ছেদের শিখা
করিয়া বহন; মিলনের মরীচিকা,
যৌবনের বিশ্বগ্রাসী মত্ত অহমিকা
মুহূর্তে মিলায়ে গেল মায়াকুহেলিকা
খররৌদ্রকরে। ছয় ঋতু সহচরী
ফেলিয়া চামরছত্র, সভাভঙ্গ করি
সহসা তুলিয়া দিল রঙ্গযবনিকা—
সহসা খুলিয়া গেল, যেন চিত্রে লিখা,
আষাঢ়ের অশ্রুপ্লুত সুন্দর ভুবন।
দেখা দিল চারি দিকে পর্বত কানন
নগর নগরী গ্রাম—বিশ্বসভামাঝে
তোমার বিরহবীণা সকরুণ বাজে।

(চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)

শেষের কবিতা

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্য উধাও।
জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয় স্পন্দন
চক্রে পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল
তুলে নিল দ্রুত রথে
দু’সাহসী ভ্রমণের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম।
আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।

কোনদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে
বসন্ত বাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রাণে, বিস্মৃতি প্রাদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয় –
সে আমার প্রেম।
তারে আমি রাখিয়া এলাম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু বিদায়।

তোমায় হয়নি কোন ক্ষতি।
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃত মুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক তাহারি আরতি
হোক তবে সন্ধ্যা বেলা-
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগ বেগে
ভ্রষ্ট্র নাহি হবে তার কোন ফুল নৈবদ্যের থালে।
তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর ত’ষায়
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আজও তুমি নিজে
হয়তো বা করিবে বচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।
হে বন্ধু বিদায়।

মোর লাগি করিয়ো না শোক-
আমার রয়েছে কর্ম রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠা আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সে ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে
সে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু তার
পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম,
ওগো নিরূপম,
হে ঐশ্বর্যবান
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।

বিলাপ

ওগো এত প্রেম – আশা প্রাণের তিয়াষা
কেমনে আছে সে পাসরি !
তবে সেথা কি হাসে না চাঁদিনী যামিনী ,
সেথা কি বাজে না বাঁশরি !
সখী , হেথা সমীরণ লুটে ফুলবন ,
সেথা কি পবন বহে না !
সে যে তার কথা মোরে কহে অনুক্ষণ
মোর কথা তারে কহে না !
যদি আমারে আজি সে ভুলিবে সজনী
আমারে ভুলাল কেন সে !
ওগো এ চির জীবন করিব রোদন
এই ছিল তার মানসে !
যবে কুসুমশয়নে নয়নে নয়নে
কেটেছিল সুখরাতি রে ,
তবে কে জানিত তার বিরহ আমার
হবে জীবনের সাথী রে !


যদি মনে নাহি রাখে , সুখে যদি থাকে ,
তোরা একবার দেখে আয় —
এই নয়নের তৃষা পরানের আশা
চরণের তলে রেখে আয় ।
আর নিয়ে যা রাধার বিরহের ভার ,
কত আর ঢেকে রাখি বল্ ।
আর পারিস যদি তো আনিস হরিয়ে
এক – ফোঁটা তার আঁখিজল ।
না না , এত প্রেম সখী ভুলিতে যে পারে
তারে আর কেহ সেধো না ।
আমি কথা নাহি কব , দুখ লয়ে রব ,
মনে মনে স ‘ ব বেদনা ।
ওগো মিছে , মিছে সখী , মিছে এই প্রেম ,
মিছে পরানের বাসনা ।
ওগো সুখদিন হায় যবে চলে যায়
আর ফিরে আর আসে না ।।

(কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)

 বিরহীর পত্র

হয় কি না হয় দেখা , ফিরি কি না ফিরি ,
দূরে গেলে এই মনে হয় ;
দুজনার মাঝখানে অন্ধকারে ঘিরি
জেগে থাকে সতত সংশয় ।
এত লোক , এত জন , এত পথ গলি ,
এমন বিপুল এ সংসার —
ভয়ে ভয়ে হাতে হাতে বেঁধে বেঁধে চলি ,
ছাড়া পেলে কে আর কাহার ।

 তারায় তারায় সদা থাকে চোখে চোখে
      অন্ধকারে অসীম গগনে ।
 ভয়ে ভয়ে অনিমেষে কম্পিত আলোকে
      বাঁধা থাকে নয়নে নয়নে ।
চৌদিকে অটল স্তব্ধ সুগভীর রাত্রি ,
       তরুহীন মরুময় ব্যোম —
 মুখে মুখে চেয়ে তাই চলে যত যাত্রী
      চলে গ্রহ রবি তারা সোম ।


 নিমেষের অন্তরালে কী আছে কে জানে ,
      নিমেষে অসীম পড়ে ঢাকা —
 অন্ধ কালতুরঙ্গম রাশ নাহি মানে ,
      বেগে ধায় অদৃষ্টের চাকা ।
 কাছে কাছে পাছে পাছে চলিবারে চাই ,
      জেগে জেগে দিতেছি পাহারা ,
 একটু এসেছে ঘুম — চমকি তাকাই
      গেছে চলে কোথায় কাহারা !
 ছাড়িয়ে চলিয়া গেলে কাঁদি তাই একা
      বিরহের সমুদ্রের তীরে ।
 অনন্তের মাঝখানে দু - দন্ডের দেখা
      তাও কেন রাহু এসে ঘিরে !
 মৃত্যু যেন মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে যায় ,
      পাঠায় সে বিরহের চর ।
 সকলেই চলে যাবে , পড়ে রবে হায়
      ধরণীর শূন্য খেলাঘর ।

 গ্রহ তারা ধূমকেতু কত রবি শশী
      শূন্য ঘেরি জগতের ভিড় ,
 তারি মাঝে যদি ভাঙে , যদি যায় খসি
      আমাদের দু - দন্ডের নীড় —
 কোথায় কে হারাইব! কোন্ রাত্রিবেলা
      কে কোথায় হইব অতিথি !
 তখন কি মনে রবে দু - দিনের খেলা ,
      দরশের পরশের স্মৃতি !

 তাই মনে করে কি রে চোখে জল আসে
      একটুকু চোখের আড়ালে !
 প্রাণ যারে প্রাণের অধিক ভালোবাসে
      সেও কি রবে না এক কালে !
 আশা নিয়ে এ কি শুধু খেলাই কেবল —
       সুখ দুঃখ মনের বিকার !
 ভালোবাসা কাঁদে , হাসে , মোছে অশ্রুজল ,
      চায় , পায় , হারায় আবার ।  

(কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)

Rabindranath Tagore’s poems on separation l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরহের কবিতা 2024

প্রার্থনা

তুমি কাছে নাই ব’লে হেরো , সখা , তাই
‘আমি বড়ো’ ‘আমি বড়ো’ করিছে সবাই ।
সকলেই উঁচু হয়ে দাঁড়ায়ে সমুখে
বলিতেছে , ‘ এ জগতে আর কিছু নাই । ‘
নাথ , তুমি একবার এসো হাসিমুখে
এরা সবে ম্লান হয়ে লুকাক লজ্জায় —
সুখদুঃখ টুটে যাক তব মহাসুখে ,
যাক আলো-অন্ধকার তোমার প্রভায় ।
নহিলে ডুবেছি আমি , মরেছি হেথায় ,
নহিলে ঘুচে না আর মর্মের ক্রন্দন —
শুষ্ক ধূলি তুলি শুধু সুধাপিপাসায় ,
প্রেম ব’লে পরিয়াছি মরণবন্ধন ।
কভু পড়ি কভু উঠি , হাসি আর কাঁদি —
খেলাঘর ভেঙে প’ড়ে রচিবে সমাধি ।

(কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)

দায়মোচন

চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙাল,
এ কথা বলিতে চাও বোলো।
এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল –
তার পরে যদি তুমি ভোল
মনে করাব না আমি শপথ তোমার,
আসা যাওয়া দু দিকেই খোলা রবে দ্বার –
যাবার সময় হলে যেয়ো সহজেই,
আবার আসিতে হয় এসো।
সংশয় যদি রয় তাহে ক্ষতি নেই,
তবু ভালোবাস যদি বেসো।।

বন্ধু, তোমার পথ সম্মুখে জানি,
পশ্চাতে আমি আছি বাঁধা।
অশ্রুনয়নে বৃথা শিরে কর হানি
যাত্রায় নাহি দিব বাধা।
আমি তব জীবনের লক্ষ্য তো নহি,
ভুলিতে ভুলিতে যাবে হে চিরবিরহী,
তোমার যা দান তাহা রহিবে নবীন
আমার স্মৃতির আঁখিজলে –
আমার যা দান সেও জেনো চিরদিন
রবে তব বিস্মৃতিতলে।।

দূরে চলে যেতে যেতে দ্বিধা করি মনে
যদি কভু চেয়ে দেখ ফিরে,
হয়তো দেখিবে আমি শূন্য শয়নে –
নয়ন সিক্ত আঁখিনীরে।
মার্জনা কর যদি পাব তবে বল,
করুণা করিলে নাহি ঘোচে আঁখিজল –
সত্য যা দিয়েছিলে থাক্ মোর তাই,
দিবে লাজ তার বেশি দিলে।
দুঃখ বাঁচাতে যদি কোনোমতে চাই
দুঃখের মূল্য না মিলে।।

দুর্বল ম্লান করে নিজ অধিকার
বরমাল্যের অপমানে।
যে পারে সহজে নিতে যোগ্য সে তার,
চেয়ে নিতে সে কভু না জানে।
প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি,
সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি –
যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন,
যা পাই নি বড়ো সেই নয়।
চিত্ত ভরিয়া রবে ক্ষণিক মিলন
চিরবিচ্ছেদ করি জয়।।

(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)

Rabindranath Tagore’s poems on separation l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরহের কবিতা 2024

তোমারে পাছে সহজে বুঝি

তোমারে পাছে সহজে বুঝি
তাই কি এত লীলার ছল,
বাহিরে যবে হাসির ছটা
ভিতরে থাকে আঁখির জল।
বুঝি গো আমি বুঝি গো তব
ছলনা,
যে কথা তুমি বলিতে চাও
সে কথা তুমি বল না।

তোমারে পাছে সহজে ধরি
কিছুরই তব কিনারা নাই–
দশের দলে টানি গো পাছে
বিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।
বুঝি গো আমি বুঝি গো তব
ছলনা,
যে পথে তুমি চলিতে চাও
সে পথে তুমি চল না।

সবার চেয়ে অধিক চাহ
তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও–
হেলার ভরে খেলার মতো
ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও।
বুঝেছি আমি বুঝেছি তব
ছলনা,
সবার যাহে তৃপ্তি হল
তোমার তাহে হল না।

(উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)

ছল

তোমারে পাছে সহজে বুঝি তাই কি এত লীলার ছল –
বাহিরে যবে হাসির ছটা ভিতরে থাকে আঁখির জল।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা –
যে কথা তুমি বলিতে চাও সে কথা তুমি বল না।।

তোমারে পাছে সহজে ধরি কিছুরই তব কিনারা নাই –
দশের দলে টানি গো পাছে কিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।
বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব ছলনা –
যে পথে তুমি চলিতে চাও সে পথে তুমি চল না।।

সবার চেয়ে অধিক চাহ, তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও –
হেলার ভরে খেলার মতো ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও?
বুঝেছি আমি, বুজেছি তব ছলনা –
সবার যাহে তৃপ্তি হল তোমার তাহে হল না।।

(কাব্যগ্রন্থঃ সঞ্চয়িতা)

Rabindranath Tagore’s poems on separation l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরহের কবিতা 2024

গিয়াছে যে দিন, সে দিন হৃদয়

গিয়াছে যে দিন, সে দিন হৃদয়
রূপের মোহনে আছিল মাতি,
প্রাণের স্বপন আছিল যখন
প্রেম প্রেম শুধু দিবস রাতি!
শান্ত আশা এ হৃদয়ে আমার
এখন ফুটিতে পারে,
সুবিমলতর দিবস আমার
এখন উঠিতে পারে।
বালক কালের প্রেমের স্বপন–
মধুর যেমন উজল যেমন
তেমন কিছুই আসিবে না,
তেমন কিছুই আসিবে না!
সে দেবীপ্রতিমা নারিব ভুলিতে
প্রথম প্রণয় আঁকিল যাহা,
স্মৃতি-মরু মোর উজল করিয়া
এখনো হৃদয়ে বিরাজে তাহা!
সে প্রতিমা সেই পরিমল সম
পলকে যা লয় পায়,
প্রভাতকালের স্বপন যেমন
পলকে মিশায়ে যায়।
অলস প্রবাহ জীবনে আমার
সে কিরণ কভু ভাসিবে না আর
সে কিরণ কভু ভাসিবে না,
সে কিরণ কভু ভাসিবে না!

ক্ষান্ত করিয়াছ তুমি আপনারে

ক্ষান্ত করিয়াছ তুমি আপনারে, তাই হেরো আজি
তোমার সর্বাঙ্গ ঘেরি পুলকিছে শ্যাম শস্পরাজি
প্রস্ফুটিত পুষ্পজালে; বনস্পতি শত বরষার
আনন্দবর্ষণকাব্য লিখিতেছে পত্রপুঞ্জে তার
বল্কলে শৈবালে জটে; সুদুর্গম তোমার শিখর
নির্ভয় বিহঙ্গ যত কলোল্লাসে করিছে মুখর।
আসি নরনারীদল তোমার বিপুল বক্ষপটে
নিঃশঙ্ক কুটিরগুলি বাঁধিয়াছে নির্ঝরিণীতটে।
যেদিন উঠিয়াছিলে অগ্নিতেজে স্পর্ধিতে আকাশ,
কম্পমান ভূমণ্ডলে, চন্দ্রসূর্য করিবারে গ্রাস —
সেদিন হে গিরি, তব এক সঙ্গী আছিল প্রলয়;
যখনি থেমেছ তুমি, বলিয়াছ “আর নয় নয়’,
চারি দিক হতে এল তোমা’পরে আনন্দনিশ্বাস,
তোমার সমাপ্তি ঘেরি বিস্তারিল বিশ্বের বিশ্বাস।

(উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)

Rabindranath Tagore’s poems on separation l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরহের কবিতা 2024

কোথায়

হায় কোথা যাবে !
অনন্ত অজানা দেশ , নিতান্ত যে একা তুমি ,
পথ কোথা পাবে !
হায় , কোথা যাবে !

কঠিন বিপুল এ জগৎ ,

খুঁজে নেয় যে যাহার পথ ।

স্নেহের পুতলি তুমি সহসা অসীমে গিয়ে
কার মুখে চাবে ।
হায় , কোথা যাবে !

মোরা কেহ সাথে রহিব না ,

মোরা কেহ কথা কহিব না ।

নিমেষ যেমনি যাবে , আমাদের ভালোবাসা
আর নাহি পাবে ।
হায় , কোথা যাবে !

মোরা বসে কাঁদিব হেথায় , শূন্যে চেয়ে ডাকিব তোমায় ;

মহা সে বিজন মাঝে হয়তো বিলাপধ্বনি
মাঝে মাঝে শুনিবারে পাবে ,
হায় , কোথা যাবে !

দেখো , এই ফুটিয়াছে ফুল , বসন্তেরে করিছে আকুল ,

পুরানো সুখের স্মৃতি বাতাস আনিছে নিতি
কত স্নেহভাবে ,
হায় , কোথা যাবে !
খেলাধূলা পড়ে না কি মনে ,
কত কথা স্নেহের স্মরণে ।
সুখে দুখে শত ফেরে সে – কথা জড়িত যে রে ,
সেও কি ফুরাবে !
হায় , কোথা যাবে !

চিরদিন তরে হবে পর , এ – ঘর রবে না তব ঘর ।

যারা ওই কোলে যেত , তারাও পরের মতো ,
বারেক ফিরেও নাহি চাবে ।
হায় , কোথা যাবে !

হায় , কোথা যাবে !

যাবে যদি , যাও যাও , অশ্রু তব মুছে যাও ,
এইখানে দুঃখ রেখে যাও ।
যে বিশ্রাম চেয়েছিলে , তাই যেন সেথা মিলে —
আরামে ঘুমাও ।
যাবে যদি , যাও ।

(কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)

আরো একবার যদি পারি

আরো একবার যদি পারি
খুঁজে দেব সে আসনখানি
যার কোলে রয়েছে বিছানো
বিদেশের আদরের বাণী।

অতীতের পালানো স্বপন
আবার করিবে সেথা ভিড়,
অস্ফুট গুঞ্জনস্বরে
আরবার রচি দিবে নীড়।

সুখস্মৃতি ডেকে ডেকে এনে
জাগরণ করিবে মধুর,
যে বাঁশি নীরব হয়ে গেছে
ফিরায়ে আনিবে তার সুর।

বাতায়নে রবে বাহু মেলি
বসন্তের সৌরভের পথে,
মহানিঃশব্দের পদধ্বনি
শোনা যাবে নিশীথজগতে।

বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে
যে প্রেয়সী পেতেছে আসন
চিরদিন রাখিবে বাঁধিয়া
কানে কানে তাহারি ভাষণ।

ভাষা যার জানা ছিল নাকো,
আঁখি যার কয়েছিল কথা,
জাগায়ে রাখিবে চিরদিন
সকরুণ তাহারি বারতা।

(শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ)

Rabindranath Tagore’s poems on separation l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরহের কবিতা 2024

অসম্ভব

পূর্ণ হয়েছে বিচ্ছেদ , যবে ভাবিনু মনে ,
একা একা কোথা চলিতেছিলাম নিষ্কারণে ।
শ্রাবণের মেঘ কালো হয়ে নামে বনের শিরে ,
খর বিদ্যুৎ রাতের বক্ষ দিতেছে চিরে ,
দূর হতে শুনি বারুণী নদীর তরল রব —
মন শুধু বলে , অসম্ভব এ অসম্ভব ।

এমনি রাত্রে কতবার , মোর বাহুতে মাথা ,
শুনেছিল সে যে কবির ছন্দে কাজরি-গাথা ।
রিমিঝিমি ঘন বর্ষণে বন রোমাঞ্চিত ,
দেহে আর মনে এক হয়ে গেছে যে-বাঞ্ছিত
এল সেই রাতি বহি শ্রাবণের সে-বৈভব —
মন শুধু বলে , অসম্ভব এ অসম্ভব ।

দূরে চলে যাই নিবিড় রাতের অন্ধকারে ,
আকাশের সুর বাজিছে শিরায় বৃষ্টিধারে ।
যূথীবন হতে বাতাসেতে আসে সুধার স্বাদ ,
বেণীবাঁধনের মালায় পেতেম যে-সংবাদ
এই তো জেগেছে নবমালতীর সে সৌরভ —
মন শুধু বলে , অসম্ভব এ অসম্ভব ।

ভাবনার ভুলে কোথা চলে যাই অন্যমনে
পথসংকেত কত জানায়েছে যে-বাতায়নে ।
শুনিতে পেলেম সেতারে বাজিছে সুরের দান
অশ্রুজলের আভাসে জড়িত আমারি গান ।
কবিরে ত্যজিয়া রেখেছ কবির এ গৌরব —
মন শুধু বলে , অসম্ভব এ অসম্ভব ।

অচলা বুড়ি

অচলবুড়ি, মুখখানি তার হাসির রসে ভরা
স্নেহের রসে পরিপক্ক অতিমধুর জরা।
ফুলো ফুলো দুই চোখে তার, দুই গালে আর ঠোঁটে
উছলে-পড়া হৃদয় যেন ঢেউ খেলিয়ে ওঠে।
পরিপুষ্ট অঙ্গটি তার, হাতের গড়ন মোটা,
কপালে দুই ভুরুর মাঝে উল্‌কি-আঁকা ফোঁটা।
গাড়ি-চাপা কুকুর একটা মরতেছিল পথে,
সেবা ক’রে বাঁচিয়ে তারে তুলল কোনোমতে।
খোঁড়া কুকুর সেই ছিল তার নিত্যসহচর;
আধপাগলি ঝি ছিল এক, বাড়ি বালেশ্বর।
দাদাঠাকুর বলত, ‘বুড়ি, জমল কত টাকা,
সঙ্গে ওটা যাবে না তো, বাক্সে রইল ঢাকা,
ব্রাহ্মণে দান করতে না চাও নাহয় দাও-না-ধার,
জানোই তো এই অসময়ে টাকার কী দরকার।’
বুড়ি হেসে বলে, ‘ঠাকুর, দরকার তো আছেই,
সেইজন্যে ধার না দিয়ে রাখি টাকা কাছেই।’

সাঁৎরাপাড়ার কায়েতবাড়ির বিধবা এক মেয়ে,
এককালে সে সুখে ছিল বাপের আদর পেয়ে।
বাপ মরেছে, স্বামী গেছে, ভাইরা না দেয় ঠাঁই–
দিন চালাবে এমনতরো উপায় কিছু নাই।
শেষকালে সে ক্ষুধার দায়ে, দৈন্যদশার লাজে
চলে গেল হাঁসপাতালে রোগীসেবার কাজে।
এর পিছনে বুড়ি ছিল, আর ছিল লোক তার
কংসারি শীল বেনের ছেলে মুকুন্দ মোক্তার।
গ্রামের লোকে ছি-ছি করে, জাতে ঠেলল তাকে,
একলা কেবল অচল বুড়ি আদর করে ডাকে।
সে বলে, ‘তুই বেশ করেছিস যা বলুক-না যেবা,
ভিক্ষা মাগার চেয়ে ভালো দুঃখী দেহের সেবা।’

জমিদারের মায়ের শ্রাদ্ধ, বেগার খাটার ডাক–
রাই ডোম্‌নির ছেলে বললে, কাজের যে নেই ফাঁক,
পারবে না আজ যেতে। শুনে কোতলপুরের রাজা
বললে, ওকে যে ক’রে হোক দিতেই হবে সাজা।
মিশনরির স্কুলে প’ড়ে, কম্পোজিটরের
কাজ শিখে সে শহরেতে আয় করেছে ঢের–
তাই হবে কি ছোটোলোকের ঘাড়-বাঁকানো চাল।
সাক্ষ্য দিল হরিশ মৈত্র, দিল মাখনলাল–
ডাকলুঠের এক মোকদ্দমায় মিথ্যে জড়িয়ে ফেলে
গোষ্ঠকে তো চালান দিল সাত বছরের জেলে।
ছেলের নামের অপমানে আপন পাড়া ছাড়ি
ডোম্‌নি গেল ভিন গাঁয়েতে পাততে নতুন বাড়ি।
প্রতি মাসে অচলবুড়ি দামোদরের পারে
মাসকাবারের জিনিস নিয়ে দেখে আসত তারে।
যখন তাকে খোঁটা দিল গ্রামের শম্ভু পিসে
‘রাই ডোম্‌নির ‘পরে তোমার এত দরদ কিসে’
বুড়ি বললে, ‘যারা ওকে দিল দুঃখরাশি
তাদের পাপের বোঝা আমি হালকা করে আসি।’

পাতানো এক নাতনি বুড়ির একজ্বরি জ্বরে
ভুগতেছিল স্বরূপগঞ্জে আপন শ্বশুরঘরে।
মেয়েটাকে বাঁচিয়ে তুলল দিন রাত্রি জেগে,
ফিরে এসে আপনি পড়ল রোগের ধাক্কা লেগে।
দিন ফুরলো, দেব্‌তা শেষে ডেকে নিল তাকে,
এক আঘাতে মারল যেন সকল পল্লীটাকে।
অবাক হল দাদাঠাকুর, অবাক স্বরূপকাকা,
ডোম্‌নিকে সব দিয়ে গেছে বুড়ির জমা টাকা।
জিনিসপত্র আর যা ছিল দিল পাগল ঝিকে,
সঁপে দিল তারই হাতে খোঁড়া কুকুরটিকে।
ঠাকুর বললে মাথা নেড়ে, ‘অপাত্রে এই দান।
পরলোকের হারালো পথ, ইহলোকের মান।’

অক্ষমতা

এ যেন রে অভিশপ্ত প্রেতের পিপাসা —
সলিল রয়েছে প’ড়ে, শুধু দেহ নাই।
এ কেবল হৃদয়ের দুর্বল দুরাশা
সাধের বস্তুর মাঝে করে চাই – চাই।
দুটি চরণেতে বেঁধে ফুলের শৃঙ্খল
কেবল পথের পানে চেয়ে বসে থাকা!
মানবজীবন যেন সকলি নিষ্ফল —
বিশ্ব যেন চিত্রপট, আমি যেন আঁকা!
চিরদিন বুভুক্ষিত প্রাণহুতাশন
আমারে করিছে ছাই প্রতি পলে পলে,
মহত্ত্বের আশা শুধু ভারের মতন
আমারে ডুবায়ে দেয় জড়ত্বের তলে।
কোথা সংসারের কাজে জাগ্রত হৃদয়!
কোথা রে সাহস মোর অস্থিমজ্জাময়!

Rabindranath Tagore’s poems on separation l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরহের কবিতা 2024

পুরাতন ভৃত্য

ভূতের মতন চেহারা যেমন, নির্বোধ অতি ঘোর—
যা‐কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, “কেষ্টা বেটাই চোর।”
উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত, শুনেও শোনে না কানে।
যত পায় বেত না পায় বেতন, তবু না চেতন মানে।
বড়ো প্রয়োজন, ডাকি প্রাণপণ চীৎকার করি “কেষ্টা”—
যত করি তাড়া নাহি পাই সাড়া, খুঁজে ফিরি সারা দেশটা।
তিনখানা দিলে একখানা রাখে, বাকি কোথা নাহি জানে;
একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে তিনখানা করে আনে।
যেখানে সেখানে দিবসে দুপুরে নিদ্রাটি আছে সাধা;
মহাকলরবে গালি দেই যবে “পাজি হতভাগা গাধা”—
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে হাসে, দেখে জ্বলে যায় পিত্ত।
তবু মায়া তার ত্যাগ করা ভার— বড়ো পুরাতন ভৃত্য।

ঘরের কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি বলে, “আর পারি নাকো,
রহিল তোমার এ ঘর‐দুয়ার, কেষ্টারে লয়ে থাকো।
না মানে শাসন বসন বাসন অশন আসন যত
কোথায় কী গেল, শুধু টাকাগুলো যেতেছে জলের মতো।
গেলে সে বাজার সারা দিনে আর দেখা পাওয়া তার ভার—
করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি ভৃত্য মেলে না আর!”
শুনে মহা রেগে ছুটে যাই বেগে, আনি তার টিকি ধরে;
বলি তারে, “পাজি, বেরো তুই আজই, দূর করে দিনু তোরে।”
ধীরে চলে যায়, ভাবি গেল দায়; পরদিনে উঠে দেখি,
হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি—
প্রসন্ন মুখ, নাহি কোনো দুখ, অতি অকাতর চিত্ত!
ছাড়ালে না ছাড়ে, কী করিব তারে— মোর পুরাতন ভৃত্য!

সে বছরে ফাঁকা পেনু কিছু টাকা করিয়া দালালগিরি।
করিলাম মন শ্রীবৃন্দাবন বারেক আসিব ফিরি।
পরিবার তায় সাথে যেতে চায়, বুঝায়ে বলিনু তারে—
পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য, নহিলে খরচ বাড়ে।
লয়ে রশারশি করি কষাকষি পোঁটলাপুঁটলি বাঁধি
বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে গৃহিণী কহিল কাঁদি,
“পরদেশে গিয়ে কেষ্টারে নিয়ে কষ্ট অনেক পাবে।”
আমি কহিলাম, “আরে রাম রাম! নিবারণ সাথে যাবে।”
রেলগাড়ি ধায়; হেরিলাম হায় নামিয়া বর্ধমানে—
কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত, তামাক সাজিয়া আনে!
স্পর্ধা তাহার হেনমতে আর কত বা সহিব নিত্য!
যত তারে দুষি তবু হনু খুশি হেরি পুরাতন ভৃত্য!

নামিনু শ্রীধামে— দক্ষিণে বামে পিছনে সমুখে যত
লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্রাণটা করিল কণ্ঠাগত।
জন‐ছয়‐সাতে মিলি এক‐সাথে পরমবন্ধুভাবে
করিলাম বাসা; মনে হল আশা, আরামে দিবস যাবে।
কোথা ব্রজবালা কোথা বনমালা, কোথা বনমালী হরি!
কোথা হা হন্ত, চিরবসন্ত! আমি বসন্তে মরি।
বন্ধু যে যত স্বপ্নের মতো বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ;
আমি একা ঘরে ব্যাধি‐খরশরে ভরিল সকল অঙ্গ।
ডাকি নিশিদিন সকরুণ ক্ষীণ, “কেষ্ট আয় রে কাছে।
এত দিনে শেষে আসিয়া বিদেষে প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে।”
হেরি তার মুখ ভরে ওঠে বুক, সে যেন পরম বিত্ত—
নিশিদিন ধরে দাঁড়ায়ে শিয়রে মোর পুরতন ভৃত্য।

মুখে দেয় জল, শুধায় কুশল, শিরে দেয় মোর হাত;
দাঁড়ায়ে নিঝুম, চোখে নাই ঘুম, মুখে নাই তার ভাত।
বলে বার বার, “কর্তা, তোমার কোনো ভয় নাই, শুন—
যাবে দেশে ফিরে, মাঠাকুরানীরে দেখিতে পাইবে পুন।”
লভিয়া আরাম আমি উঠিলাম; তাহারে ধরিল জ্বরে;
নিল সে আমার কালব্যাধিভার আপনার দেহ‐’পরে।
হয়ে জ্ঞানহীন কাটিল দু দিন, বন্ধ হইল নাড়ী;
এতবার তারে গেনু ছাড়াবারে, এতদিনে গেল ছাড়ি।
বহুদিন পরে আপনার ঘরে ফিরিনু সারিয়া তীর্থ;
আজ সাথে নেই চিরসাথি সেই মোর পুরাতন ভৃত্য।

Rabindranath Tagore’s poems on separation l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরহের কবিতা 2024
Also Read: Love Quotes By Rabindranath Tagore To Dedicate To Your Beloved

raateralo.com

Leave a Comment