Rabindranath Tagore story Bodnam: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার সৃষ্টি আমাদের মননশীলতার জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। তাঁর গল্পগুলোতে জীবনের নানা রূপ, মাধুর্য এবং জটিলতা ফুটে উঠেছে। এর মধ্যে একটি বিশেষ গল্প হলো ‘বদনাম’।
‘বদনাম’ গল্পটি সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের জটিলতা এবং সামাজিক মর্যাদার প্রভাবকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখিয়েছেন কিভাবে একজন মানুষের জীবন ও মর্যাদা সমাজের কুসংস্কার ও ভুল বোঝাবুঝির কারণে বদনাম হয়ে যেতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনন্য লেখনশৈলীর মাধ্যমে এই গল্পে ফুটে উঠেছে সামাজিক অন্যায়, অসঙ্গতি এবং মানবিক বোধের সংঘাত। ‘বদনাম’ গল্পটি পাঠকদের এক নতুন ভাবনার জগতে নিয়ে যায়, যেখানে সমাজের প্রচলিত নিয়মকানুন এবং ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ মানসিকতা পরস্পর বিরোধী হিসেবে প্রতিফলিত হয়। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির এই অনন্য রত্নের মধ্যে দিয়ে আমরা সামাজিক সত্য এবং মানবিকতার গভীরতা অন্বেষণ করি।
Rabindranath Tagore story Bodnam l বাংলা ছোটগল্প বদনাম
Table of Contents
বদনাম (bodnam)
প্রথম পরিচ্ছেদ
ক্রিং ক্রিং ক্রিং সাইকেলের আওয়াজ; সদর দরজার কাছে লাফ দিয়ে নেমে পড়লেন ইন্স্পেক্টার বিজয়বাবু। গায়ে ছাঁটা কোর্তা, কোমরে কোমরবন্ধ, হাফ-প্যাণ্টপরা, চলনে কেজো লোকের দাপট। দরজার কড়া নাড়া দিতেই গিন্নি এসে খুলে দিলেন।
ইন্স্পেক্টার ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই ঝংকার দিয়ে উঠলেন–‘এমন করে তো আর পারি নে, রাত্তিরের পর রাত্তির খাবার আগলে রাখি! তুমি কত চোর ডাকাত ধরলে, সাধু সজ্জনও বাদ গেল না, আর ঐ একটা লোক অনিল মিত্তিরের পিছন পিছন তাড়া করে বেড়াচ্ছ, সে থেকে থেকে তোমার সামনে এসে নাকের উপর বুড়ো আঙুল নাড়া দিয়ে কোথায় দৌড় মারে তার ঠিকানা নেই। দেশসুদ্ধ লোক তোমার এই দশা দেখে হেসে খুন, এ যেন সার্কাসের খেলা হচ্ছে।’
ইন্স্পেক্টার বললেন, ‘আমার উপরে ওর নেকনজর আছে কী ভাগ্যিস। ও বেলে খালাস আসামীই বটে, তবু পুলিসে না রিপোর্ট্ করে কোথাও যাবার হুকুম নেই, তাই আমাকে সেদিন চিঠিতে জানিয়ে গেল–‘ইন্স্পেক্টারবাবু, ভয় পাবেন না, সভার কাজ সেরেই আমি ফিরে আসছি।’ কোথায় সভা তার কোনো সন্ধান নেই। পুলিসে ও যেন ভেলকি খেলছে।’
স্ত্রী সৌদামিনী বললে, ‘শোনো তবে আজ রাত্তিরের খবর দিই, শুনলে তোমার তাক লেগে যাবে। লোকটার কী আস্পর্ধা, কী বুকের পাটা! রাত্তির তখন দুটো, আমি তোমার খাবার আগলে বসে আছি, একটু ঝিমুনি এসেছে। হঠাৎ চমকে দেখি সেই তোমাদের অনিল ডাকাত, আমাকে প্রণাম করে বললে, ‘দিদি, আজ ভাইফোঁটার দিন, মনে আছে? ফোঁটা নিতে এসেছি। আমার আপন দিদি এখন চট্টগ্রামে কী সব চক্রান্ত করছে। কিন্তু ফোঁটা আমি চাই, ছাড়ব না, এই বসলুম।’…সত্যি কথা তোমাকে বলব। আমার মনের মধ্যে উছলে উঠল স্নেহ। মনে হল এক রাত্তিরের জন্যে আমি ভাইকে পেয়েছি। সে বললে, ‘দিদি, আজ তিন দিন কোনোমতে আধপেটা খেয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরেছি। আজ তোমার হাতের ফোঁটা তোমার হাতের অন্ন নিয়ে আবার আমি উধাও হব।’ তোমার জন্যে যে ভাত বাড়া ছিল তাই আমি তাকে আদর করে খাওয়ালুম। বললুম, ‘এই বেলা তুমি পালাও, তাঁর আসবার সময় হয়েছে।’ লোকটা বললে, ‘কোনো ভয় নেই, তিনি আমারই সন্ধানে চিতলবেড়ে গেছেন, ফিরতে অন্তত তিনটে বাজবে। আমি রয়ে বসে তোমার পায়ের ধুলো নিয়ে যেতে পারব।’ বলে তোমারই জন্যে সাজা পান টপ করে মুখে নিলে তুলে। তার পরে বললে কিনা–‘ইন্স্পেক্টারবাবু হাভানা চুরুট খেয়ে থাকেন; তারই একটা আমাকে দাও, আমি খেতে খেতে যাব যেখানে আমার সব দলের লোক আছে; তারা আজ সভা করবে।’ তোমার ঐ ডাকাত অনায়াসে, নির্ভয়ে, সেই জায়গাটার নাম আমাকে বলে দিলে।’
ইন্স্পেক্টারবাবু বললেন, ‘নামটা কী শুনতে পারি কি।’
সদু বললে ‘তুমি এমন প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞেস করলে এর থেকে প্রমাণ হয় তোমার ডাকাত আমাকে চিনেছিল কিন্তু তুমি আজও আমাকে চেনো নি। যা হোক, আমি তাকে তোমার বহু শখের একটি হাভানা চুরুট দিয়েছি। সে জ্বালিয়ে দিব্যি সুস্থ মনে পায়ের ধুলো নিয়ে চুরুট ফুঁকতে ফুঁকতে চলে গেল।’
বিজয় বসে ছিলেন, লাফ দিয়ে উঠে বললেন, ‘বলো সে কোন্ দিকে গেল, কোথায় তাদের সভা হচ্ছে।’
সদু উঠে ঘাড় বেঁকিয়ে বললে, ‘কী! এমন কথা তোমার মুখ দিয়ে বের হল! আমি তোমার স্ত্রী হয়েছি, তাই বলে কি পুলিসের চরের কাজ করব। তোমার ঘরে এসে আমি যদি ধর্ম খুইয়ে বসি, তবে তুমিই বা আমাকে বিশ্বাস করবে কী করে।’
ইন্স্পেক্টার চিনতেন তাঁর স্ত্রীকে ভালো করে। খুব শক্ত মেয়ে, এর জিদ কিছুতেই নরম হবে না। হতাশ হয়ে বসে নিশ্বেস ফেলে বললেন, ‘হায় রে, এমন সুযোগটাও কেটে গেল!’
বসে বসে তাঁর নবাবি ছাঁদের গোঁফ-জোড়াটাতে তা দিতে লাগলেন, আর থেকে থেকে ফুঁসে উঠলেন অধৈর্যে। তাঁর জন্য তৈরি দ্বিতীয় দফার খিচুড়ি তাঁর মুখে রুচল না।
এই গেল এই গল্পের প্রথম পালা।
বাংলা ছোটগল্প বদনাম l Banglashort sroty bodnam
Amazfit GTR 3 Pro
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সদু স্বামীকে বললে, ‘কী গো, তুমি যে নৃত্য জুড়ে দিয়েছ! আজ তোমার মাটিতে পা পড়ছে না। ডিস্ট্রিকট্ পুলিসের সুপারিণ্টেণ্ডের নাগাল পেয়েছ নাকি।’
‘পেয়েছি বৈকি।’
‘কী রকম শুনি।’
‘আমাদের যে চর, নিতাই চক্রবর্তী, সে ওদের ওখানে চরগিরি করে। তার কাছে শোনা গেল আজ মোচকাঠির জঙ্গলে ওদের একটা মস্ত সভা হবে। সেটাকে ঘেরাও করবার বন্দোবস্ত হচ্ছে। ভারী জঙ্গল, আমরা আগে থাকতে লুকিয়ে সার্ভেয়ার পাঠিয়ে তন্ন তন্ন করে সার্ভে করে নিয়েছি। কোথাও আর লুকিয়ে পালাবার ফাঁক থাকবে না।’
‘তোমাদের বুদ্ধির ফাঁকের মধ্য দিয়ে বড়ো বড়ো ফুটোই থাকবে। অনেক বার তো লোক হাসিয়েছ, আর কেন। এবারে ক্ষান্ত দাও।’
‘সে কি কথা সদু। এমন সুযোগ আর পাব না।’
‘আমি তোমাকে বলছি, আমার কথা শোনো–ও মোচকাঠির জঙ্গল ও-সব বাজে কথা। সে তোমাদেরই ঘরের আনাচে কানাচে ঘুরছে। তোমাদের মুখের উপরে তুড়ি মেরে দেবে দৌড়, এ আমি তোমাকে বলে দিলুম।’
‘তা, তুমি যদি লুকিয়ে তাদের ঘরের খবর দাও, তা হলে সবই সম্ভব হবে।’
‘দেখো, অমন চালাকি কোরো না। বোকামি করতে হয় পেট ভরে করো, অনেক বার করেছ, কিন্তু নিজের ঘরের বউকে নিয়ে–‘
কথাটা চাপা পড়ল চোখের উপর আঁচল চাপার সঙ্গে।
‘সদু, আমি দেখেছি যে এই একটা বিষয়ে তোমার ঠাট্টাটুকুও সয় না।’
‘তা সত্যি, পুলিসের ঠাট্টাতেও যে গায়ে দাঁত বসে। এখন কিছু খেয়ে নেবে কি না বলো।’
‘তা নেব, সময় আছে, সব একেবারে পাকাপাকি ঠিকঠাক হয়ে গেছে।’
‘দেখো, আমি সত্যি কথাই বলব। তোমরা যা কানাকানি কর তা যদি জানতে পারতুম তা হলে ওদের কাছে ফাঁস করে দেওয়া কর্তব্য মনে করতুম।’
‘সর্বনাশ, কিছু শুনেছ নাকি তুমি।’
‘তোমাদের সংসারে চোখ কান খুলে রাখতেই হয়, কিছু কানে যায় বৈকি।’
‘কানে যায়, আর তার পরে?’
‘আর তার পরে চণ্ডীদাস বলেছেন ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো আকুল করিয়া দিল প্রাণ।’
‘তোমার ঐ ঠাট্টাতেই তুমি জিতে যাও, কোন্টা যে তোমার আসল কথা ধরা যায় না।’
‘তা বুঝবার বুদ্ধিই যদি থাকত তবে এই পুলিস ইন্স্পেক্টরি কাজ তুমি করতে না। এর চেয়ে বড়ো কাজেই সরকার বাহাদুর তোমাকে লাগিয়ে দিতেন বিশ্বহিতৈষীর পদে, বক্তৃতা দিতে দিতে দেশে বিদেশে জাল ফেলতে।’
‘সর্বনাশ, তা হলে সেই যে মেয়েটির গুজব শোনা যাচ্ছে, সে দেখি আমায় আপন ঘরেরই ভিতরকার।’
‘ঐ দেখো, কুকুরটা চেঁচিয়ে মরছে। তাকে খাইয়ে ঠাণ্ডা করে আসি।’
ইন্স্পেক্টারবাবু মহা খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘আমি এক্ষুনি গিয়ে লাগাব ঐ কুকুরটাকে আমার পিস্তলের গুলি।’
সদু তার স্বামীর কাপড় ধরে টেনে বললে, ‘না, কক্ষনো তুমি যেতে পারবে না।’
‘কেন।’
‘তুমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই একেবারে টুঁটি ক্যাঁক্ করে চেপে ধরবে। ও বড়ো বদমাইস কুকুর। ও কেবল আমাকেই চেনে।’
‘একটা খবর পেয়েছি সদু, সেই অনিল লোকটা হরবোলা, ও সব জন্তুরই নকল করতে পারে। রোজ রাত্রি দুটোর সময়ে ওই-যে তোমায় ডাক দিচ্ছে না তাই বা বলি কী করে।’
সদু একেবারে জ্বলে উঠে বললে, ‘অ৻াঁ, শেষকালে আমাকে সন্দেহ! এই রইল তোমার ঘরকন্না পড়ে, আমি চললুম আমার ভগ্নীপতির বাড়িতে।’
এই বলে সে উঠে পড়ল।
‘আরে, কোথায় যাও! ভালো মুশকিল! নিজের ঘরের স্ত্রীকে ঠাট্টা করব না, আমি ঠাট্টার জন্যে পরের ঘরের মেয়ে কোথায় খুঁজে পাই। পেলেই বা শান্তি রক্ষা হবে কী করে।’
ব’লে ওকে জোর করে ধরে বসালেন।
সদু কেবলই চোখ মুছতে লাগল।
‘আহা, কী করছ, কাঁদ কেন, সামান্য একটা ঠাট্টা নিয়ে!’
‘না, তোমার এই ঠাট্টা আমার সইবে না, আমি বলে রাখছি।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা, ব্যস্–রইল, এখন তুমি আরামে নিশ্চিন্ত হয়ে তোমার কুকুরকে খাইয়ে এসো। ও আবার কাটলেট নইলে খায় না, পুডিং না হলে পেট ওর ভরে না। সামান্য কুকুর নিয়ে তুমি অত বাড়াবাড়ি কর কেন আমি বুঝতেই পারি না।’
সদু বললে, ‘তোমরা পুরুষ মানুষ বুঝবে না। পুত্রহীনা মেয়ের বুকে যে স্নেহ জমে থাকে সে যে-কোনো একটা প্রাণীকে পেলে তাকে বুকের কাছে টেনে নেয়। ওকে একদিন না দেখলে আমার মনে কেবলই ভয় হতে থাকে, কে ওকে কোন্ দিক থেকে ধরে নিয়ে গেল। তাই তো আমি ওকে এত যত্নে ঢেকেঢুকে রাখি।’
‘কিন্তু আমি বলে দিচ্ছি সদু, কোনো জানোয়ার এত আদরে বেশি দিন বাঁচতে পারে না।’
‘তা, যতদিন বাঁচে ভালো করেই বাঁচুক।’
বিজয়বাবু বিশ্রাম করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে পুলিসের দলবল জুটল, চলল সবাই আলাদা আলাদা রাস্তায় মোচকাটির দিকে। বহু দূরের পথ, প্রায় রাত পুইয়ে গেল যেতে-আসতে।
পরের দিন বেলা সাতটার সময় মুখ শুকিয়ে ইন্স্পেক্টার বাড়িতে এসে কেদারাটার উপরে ধপাস করে বসে পড়লেন। বললেন, ‘সদু, বড়ো ফাঁকি দিয়েছে! তোমার কথাই সত্যি। পুলিসের লোক ঘেরাও করলে বন, সে বনে জনমানব নেই। হৈ হৈ লাগিয়ে দিলে; চীৎকার করে বলতে লাগলে, ‘কোথায় আছ বের হও, নইলে আমরা গুলি চালাব।’ অনেকগুলো ফাঁকা গুলি চলল, কোনো সাড়া নেই। পুলিসের লোক খুব সাবধানে বনের মধ্যে ঢুকে তল্লাস করলে। তখন ভোর হয়ে এসেছে। রব উঠল, ‘ধর্ সেই নিতাইকে, বদমাইসকে।’ নিতাইয়ের আর টিকি দেখা যায় না। একখানা চিঠি পাওয়া গেল, কেবল এই কটি কথা–‘আসামী নিরাপদ। দিদিকে আমার প্রণাম জানাবেন। অনিল।’ দেখো দেখি কী কাণ্ড, এর মধ্যে আবার তোমার নাম জড়ানো কেন, শেষ কালে’–
‘শেষকালে আবার কী। পুলিসের ঘরের গিন্নি কি আসামীর ঘরের দিদি হতেই পারে না। সংসারের সব সম্বন্ধই কি সরকারী খামের ছাপ-মারা। আমি আর কিছু বলব না। এখন তুমি একটু শোও, একটু ঘুমোও।’
ঘুম ভাঙল তখন বেলা দুপুর। স্নান করে মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বিজয় বসে বসে পান চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘লোকটার চালাকির কথা কী আর তোমাকে বলব। ও দলবল নিয়ে চার দিকে প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে, ও ভোর রাত্তিরে কুম্ভক যোগ করে শূন্যে আসন করে–এটা নাকি অনেকের স্বচক্ষে দেখা। গ্রামের লোকের বিশ্বাস জন্মিয়ে দিয়েছে–ও একজন সিদ্ধপুরুষ, বাবা ভোলানাথের চিহ্নিত। ওর গায়ে হাত দেবে হিন্দুর ঘরে আজ এমন লোক নেই। তারা আপন ঘরের দাওয়ায় ওর জন্য খাবার রেখে দেয়–রীতিমত নৈবেদ্য। সকাল-বেলা উঠে দেখে তার কোনো চিহ্ন নেই। হিন্দু পাহারাওয়ালারা তো ওর কাছে ঘেঁষতেই চায় না। একজন দারোগা সাহস করে হিজলাকান্দির দাঙ্গার পরে ওকে গ্রেপ্তার করেছিল। হপ্তা খানেকের মধ্যে তার স্ত্রী বসন্ত হয়ে মারা গেল। এর পরে আর প্রমাণের অভাব রইল না। সেইজন্য এবারে যখন মোচকাঠিতে ওর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না, পাহারাওয়ালারা ঠিক করলে যে ও যখন খুশি আপনাকে লোপ করে দিতে পারে। ও তার একটি সাক্ষীও রেখে গেছে–একটা জলা জায়গায় পায়ের দাগ দেখা গেল, দু-হাত অন্তর এক-একটি পদক্ষেপ–দেড় হাত লম্বা। হিন্দু পাহারাওয়ালারা সেই পায়ের দাগের উপরে ভক্তিভরে লুটিয়ে পড়ে আর-কি! এই লোককে সম্পূর্ণ মন দিয়ে ধরপাকড় করা শক্ত হয়ে উঠেছে। ভাবছি মুসলমান পাহারাওয়ালা আনাব, কিন্তু দেশের হাওয়ার গুণে মুসলমানকে যদি ছোঁয়াচ লাগে তবে আরও সর্বনাশ হবে। খবরের কাগজওয়ালারা মোচকাঠিতে সংবাদদাতা পাঠাতে শুরু করলে। কোন্ পলাতকের এই লম্বা পা, তা নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা হল। এখন এ লোকটাকে কী করা যায়। এই কিছুদিন বেলে খালাস পেয়েছিল, সেই সুযোগে দেশের হাওয়ায় যেন গাঁজার ধোঁওয়া লাগিয়ে দিলে। এ দিকে পিছনে প্রোপাগাণ্ডা চলছেই, নানা রকম ছায়া নানা জায়গায় দেখা যায়। এক জায়গায় মহাদেবের একগাছি চুল পাওয়া গেছে বলে আমার ভক্ত কনেস্টবল অত্যন্ত গদগদ হয়ে উঠেছে। সেটা যে শণের দড়ি সে কথা বিচার করবার সাহসই হল না। ক’দিনের মধ্যে চারদিকে একেবারে গুজবের ঝড় উঠে গেল। মোচকাঠিতে ঐ পায়ের চিহ্নের উপরে মন্দির বানাবে ব’লে একজন ধনী মাড়োয়ারি ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে বসেছে। একজন ভক্ত পাওয়া গেল, তিনি ছিলেন এক সময়ে ডিস্ট্রিক্ট্ জজ। তাঁর কাছে বসে অনিল-ডাকাত শিবসংহিতার ব্যাখ্যা শুরু করে দিলে–লোকটার পড়াশুনা আছে। এমনি করে ভক্তি ছড়িয়ে যেতে লাগল। এবারকার বেলের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে পর ওর নামে সাক্ষী জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অনিল-ডাকাতকে নিয়ে এই তো আমার এক মস্ত সমস্যা বাধল।
‘সদু, তুমি জান বোধ হয় এ দিকে আর এক সংকট বেধেছে। আমার মামাতো ভাই গিরিশ সে হাতিবাঁধা পরগনায় পুলিসের দারোগাগিরি করে। কর্তব্যের খাতিরে একজন কুলীন ব্রাহ্মণের ছেলের হাতে হাতকড়ি লাগিয়েছিল। সেই অবধি গ্রামের লোকেরা তাকে জাতে ঠেলবার মন্ত্রণা করছে। এ দিকে তার মেয়ের বিয়ের বয়স পেরিয়ে যায়, যে পাত্রই জোটে তাকে ভাঙিয়ে দেয় গ্রামের লোক। পাত্র যদি জোটে তবে পুরুত জোটে না। দূর গ্রাম থেকে পুরুতের সন্ধান পেল, কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল সে কখন দিয়েছে দৌড়। এবারে একটা কিনারা পাওয়া গেছে। বৃন্দাবন থেকে এক বাবাজি এসে হঠাৎ আমার হেড কনেস্টবলের বাড়িতে আড্ডা দিলে, সদ্ব্রাহ্মণ খাইয়ে-দাইয়ে আমরা সবাই মিলে তাঁকে খুশি করাচ্ছি। তাঁকে রাজি করানো গেছে। এখন গ্রামের লোকের হাত থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সদু, তুমিও এ কাজে সাহায্য করো।’
‘ওমা, করব না তো কী! ও তো আমার কর্তব্য। আহা, তোমাদের গিরিশের মেয়ে, আমাদের মিনু। সে তো কোনো অপরাধ করে নি। তার বিয়ে তো হওয়াই চাই। আনো তোমার বৃন্দাবনবাসীকে, আমি জানি ঐ-সব স্বামীজিদের কী করে আদর যত্ন করতে হয়।’
এলেন বৃন্দাবনবাসী। বুকে লুটিয়ে পড়ছে সাদা দাড়ি, নারদ মুনির মতো। সদু ভক্তিতে গদগদ হয়ে পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল, পাড়ার লোক তার প্রণামের ঘটা দেখে হেসে বাঁচে না। প্রবীণা প্রতিবেশিনী মুচকে হেসে বললেন, ‘সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি তোমার এত ভক্তি হঠাৎ জেগে উঠল কী করে।’
সদু হেসে বললে, ‘দরকার পড়লেই ভক্তি উথলে ওঠে। বাবাঠাকুরেরা পায়ের ধুলো নিয়ে গলে যান। মিনুর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমার ভক্তিটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।’
ঘন ঘন শাঁখ বেজে উঠল, উলুর সঙ্গে বর আসার শব্দ এল চার দিক থেকে। কনেকে একটি চেলী-জড়ানো পুঁটুলির মতো করে এয়োর দল নিয়ে এল ছাঁদনাতলায়। নির্বিঘ্নে কাজ সমাধা হল। বর কনে বাবাজিকে প্রণাম করে অন্দরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল, তখন বাবাজি আশীর্বাদ শেষ করে বিজয়বাবুকে আর সভার সবাইকে বললেন, ‘মশায়, আমার খবরটা এবারে দিয়ে যাই। পুরুতের কাজ আমার পেশা নয়। আমার যা পেশা সে আপনার সমস্ত দারোগা-কনেস্টবলদের ভালো করেই জানা আছে। এখন আপনাদের পুরুতের দক্ষিণা দেবার সময় এসেছে। সে পর্যন্ত আমার আর সবুর সইবে না। অতএব আপনারা বিদায় করবার আগেই আমি বিদায় নিলেম।’
এই ব’লে সন্ন্যাসী সকলের সামনে দাড়ি গোঁফ টেনে ফেলে তিন লাফে চণ্ডীমণ্ডপের পাঁচিল ডিঙিয়ে উধাও।
সভার লোকেরা হাঁ করে চেয়ে রইল। বিজয়বাবুর মুখে কথা নেই।
বিয়ের ভোজ শেষ হয়ে গেছে, পাড়াপড়শী গেছে যে যার ঘরে। বরবধূ বাসর ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। সদু স্বামীকে বললে, ‘তুমি ভাবছ কী, যেমন করে হোক কাজ তো উদ্ধার হয়ে গেছে। সন্ন্যাসী উধাও হয়ে গিয়ে তোমাদেরই তো কাজ হালকা করে দিয়ে গেল। এখন বাসিবিয়ের আয়োজন করতে হবে, চোর-ডাকাতের পিছনে সময় নষ্ট কোরো না। কিন্তু সেই মেয়েটির কোনো খোঁজ পেলে কি।’
‘দুঃখের কথা বলব কী, এখন একটি মেয়ের জায়গায় রোজ আমার থানার সামনে পঁচিশটি মেয়ের আমদানি হচ্ছে চাল কলা নৈবেদ্য নিয়ে। এখন কোন্টি যে কে খোঁজ করা শক্ত হয়ে উঠল।’
‘সে কী, তোমার দরজায় এত মেয়ের আমদানি তো ভালো নয়। ওখানে তুমি কি বাবাজি সেজে বসেছ নাকি।’
‘না, লোকটার চালাকির কথা শোনো একবার, অবাক হবে। একদিন হঠাৎ কিষণলাল এসে খবর দিলে আফিসের সামনের রাস্তায় একটি পাথর বেরিয়েছে। তার গায়ে পাড়ার মেয়েরা এসে সিঁদুর লাগাচ্ছে, চন্দন মাখাচ্ছে; কেউ চাইতে এসেছে সন্তান, কেউ স্বামীসৌভাগ্য, কেউ আমারই সর্বনাশ। এই ভিড় পরিষ্কার করতে গেলেই খবরের কাগজে মহা হাঁউমাউ করে উঠবে যে এইবার হিন্দুর ধর্ম গেল। আমার হিন্দু পাহারাওয়ালারাও তাকে পাঁচ সিকা করে প্রণামী দেয়। ব্যাবসা খুব জমে উঠল। টাকাগুলো কে আদায় করছে অবশেষে সেটার দিকে চোখ পড়ল। একদিন দেখা গেল–না আছে পাথরটা, না আছে টাকার থালা। আর সেই পাগলা গোছের লোকটা সেও তার সাজ বদলে কোথায় যে গা-ঢাকা দিল সে সম্বন্ধে নানা অদ্ভুত গুজব শোনা যেতে লাগল। মুশকিল এই–হিন্দুধর্মের পাহারাওয়ালারা হাংগার-স্ট্রাইকের ভয় দেখাতে থাকে। এই নিয়ে যদি শান্তিভঙ্গ হয় তা হলে আবার সকলের কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে প্রাণ বেরিয়ে যাবে। এখন কোন্ দিক সামলাই! আর এক উৎপাত ঘটেছে, একদিন ছেদীলাল এসে পড়ল পুলিসের থানার দরজায় দড়াম করে। হাঁউমাউ করে বললে যে, ভোলানাথের একশিঙওয়ালা ভৃঙ্গীবাবা ষাঁড়ের মতো গর্জাতে গর্জাতে তাকে এসে তাড়া করেছিল। সে তো কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে সন্ন্যাসী হয়ে। গাছতলায় বসে বসে গাঁজা খাচ্ছে। এখন লোক পাওয়া শক্ত হয়েছে। আর ওর সঙ্গে আমরা পেরে উঠি নে, কেননা মেয়েরা ওর সহায়। ও তাদের সব বশ করে নিয়েছে।’
সদু হেসে বললে,’ওর গল্প যতই শুনি আমারই তো মন টলমল করে ওঠে।’
‘দেখো, সর্বনাশ কোরো না যেন।’
‘না, তোমার ভয় নেই, আমার এত সৌভাগ্য নয়। মেয়েদের চাতুরী দিয়ে ঘরকন্না চালাতে হয়, সেটা দেশের সেবায় লাগালে ঐ স্ত্রীবুদ্ধি ষোলো-আনা কাজে লাগতে পারে। পুরুষরা বোকা, তারা আমাদের বলে সরলা, অখলা–এই নামের আড়ালেই আমরা সাধ্বীপনা করে থাকি আর ঐ খোকার বাবারা মুগ্ধ হয়ে যায়। আমরা অবলা অখলা, কুকুরের গলার শিকলের মতো এই খ্যাতি আমরা গলায় পরে থাকি, আর তোমরা আমাদের পিছন পিছন টেনে নিয়ে বেড়াও। তার চেয়ে সত্যি কথা বলো-না কেন–সুযোগ পেলে তোমরাও ঠকাতে জান, সুযোগ পেলে আমরাও ঠকাতে জানি। আমরা এত বোকা নই যে শুধু ঠকবই আর ঠকাব না। বুড়িগুলো বলে থাকে ‘সদু বড়ো লক্ষ্মী,’ অর্থাৎ রাঁধতে বাড়তে ঘর নিকোতে সদুর ক্লান্তি নেই। এইটুকু বেড়ার মধ্যে আমাদের সুনাম। দেশের লোক না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে আর যাঁরা মানুষের মতো মানুষ তাঁদের হাতে হাতকড়ি পড়ছে, আমরা রেঁধে বেড়ে বাসন মেজে করছি সতীসাধ্বীগিরি! আমরা অলক্ষ্মী হয়ে যদি কাজের মতন একটা-কিছু করতে পারি তা হলে আমাদের রক্ষা, এই আমি তোমাকে বলে রাখলুম। আমাদের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দেখো তো দেখবে–হয়তো আছে কোথাও কিছু কলঙ্কের চিহ্ন,’ কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গেই আছে জ্বলন্ত আগুনের দাগা। নিছক আরামের খেলার দাগ নয়। মেরেছি, কিন্তু মরেছি তার অনেক আগে। সংসারে মেয়েরা দুঃখের কারবার করতেই এসেছে। সেই দুঃখ কেবল আমি ঘরকন্নার কাজে ফুঁকে দিতে পারব না। আমি চাই সেই দুঃখের আগুনে জ্বালিয়ে দেব দেশের যত জমানো আঁস্তাকুড়। লোকে বলবে না সতী, বলবে না সাধ্বী। বলবে দজ্জাল মেয়ে। এই কলঙ্কের-তিলক-আঁকা ছাপ পড়বে তোমার সদুর কপালে, আর তুমি যদি মানুষের মতো মানুষ হও তবে তার গুমোর বুঝতে পারবে।’
‘তোমার মুখে ও রকম কথা আমি ঢের শুনেছি, তার পরে দেখেছি সংসার যেমন চলে তেমনি চলছে। মাঝে মাঝে মন খোলসা করা দরকার, তাই শুনি আর হাভানা চুরুট টানি।’
‘যাই হোক-না কেন, আমি জানি আমি যাই করি শেষ পর্যন্ত তুমি আমাকে ক্ষমা করবেই আর সেই ক্ষমাই যথার্থ পুরুষ মানুষের লক্ষণ, যেন শ্রীকৃষ্ণর বুকে ভৃগুর পায়ের চিহ্ন। তোমার সেই ক্ষমার কাছেই তো আমি হার মেনে আছি। মিথ্যা স্তব করব না–পুলিসের কাজে তোমার খবরদারির শেষ নেই, কিন্তু আমাকে তুমি চোখ বুজে বিশ্বাস করে এসেছ, যদিও সব সময়ে সেই বিশ্বাসের যোগ্যতা আমার ছিল না। আমি এই জন্যই তোমাকে ভক্তি করি, আমার ভক্তি শাস্ত্রমতে গড়া নয়।’
‘সদু আর কেন, পেট ভরে যা বলবার সে তো বলে গেলে, এখন তোমার ঐ কুকুরটাকে খাওয়াতে যাও, বড্ড চেঁচাচ্ছে–ও আমাকে ঘুমোতে দেবে না। আমি ভাবছি আমাকে এবারে ছুটির দরখাস্ত দিতে হবে।’
সদু হেসে বললে, ‘তুমি ইন্স্পেক্টরি ছেড়ে দিয়ে গাছতলায় বাবাজি সেজে বোসো, তোমার আয় যাবে বেড়ে, আমিও তার কিছু বখরা পাব।’
‘সব তাতেই তুমি যেমন নিশ্চিন্ত হয়ে থাক, আমার ভালো লাগে না।’
‘ও আমার স্বভাব, তোমার খুনী ডাকাতদের জন্য আমি চিন্তা করতে পারব না। একা তোমার চিন্তাতেই আমার দিন চলে গেল। সমস্ত দেশের লোকের হাসিতে যোগ না দিয়ে আমি করব কী। তোমার এই পুলিসের থানায় স্বদেশীদের নিয়ে অনেক চোখের জল বয়ে গেছে, এত দিনে লোকেরা একটু হেসে বাঁচছে। এই জন্যই অনিলবাবুকে সবাই দু হাত তুলে আশীর্বাদ করছে, তুমি ছাড়া। আমি দুশ্চিন্তার ভাণ করব কী করে বলো দেখি।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প বদনাম l Bangla chotogolpo Bodnam
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
‘দেখো, সদু, এবারে আমি তোমার শরণাপন্ন।’
সদু বললে, ‘কবে তুমি আমার শরণাপন্ন নও, শুনি। এই জন্য তো তোমাকে সবাই স্ত্রৈণ বলে। দু জাতের স্ত্রৈণ আছে। এক দল পুরুষ স্ত্রীর জোরের কাছে হার না মেনে থাকতে পারে না, তারা কাপুরুষ। আর এক দল আছে তারা সত্যিকার পুরুষ, তাই স্ত্রীর কাছে অসংশয়ে হার মেনেই নেয়। তারা অবিশ্বাস করতে জানেই না, কেননা তারা বড়ো। এই দেখো-না আমার কত বড়ো সুবিধে–তোমাকে যখন খুশি যেমন খুশি ঠকাতে পারি, তুমি চোখ বুজে সব নাও।’
‘সদু, কী পষ্ট তোমার কথাগুলি গো!’
‘সে তোমারই গুণে কর্তা, সে তোমারই গুণে।’
‘এবারে কাজের কথাটা শুনে নাও– ও-সব আলোচনা পরে হবে। এবারে একটা সরকারী কাজে তোমার সাহায্য চাই। নইলে আমার আর মান থাকে না। পুলিসের লোকরা নিশ্চয়ই জেনেছে এই কাছাকাছি কোথায় এক জায়গায় একজন মেয়ে আছে। সেই এখানকার খবর কেমন করে পায় আর ওকে সাবধানে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়। সে আচ্ছা জাঁহাবাজ মেয়ে। ওরা বলছে সে এই পাড়ারই কোনো বিধবা মেয়ে। যেমন করে হোক তার সন্ধান নিয়ে তার সঙ্গে তোমাকে ভাব করতে হবে।’
সদু বললে, ‘শেষকালে আমাকেও তোমাদের চরের কাজে লাগাবে! আচ্ছা, তাই হবে, মেয়েকে দিয়ে মেয়ে ধরার কাজে লাগা যাবে, নইলে তোমার মুখ রক্ষা হবে না। আমি এই ভার নিলুম। দুদিনের মধ্যে সমস্ত রহস্য ভেদ হয়ে যাবে।’
‘পরশু হল শিবরাত্রি, খবর পেয়েছি অনিল-ডাকাত সিদ্ধেশ্বরী তলার মন্দিরে জপতপ করে রাত কাটাবে। তার মনে তো ভয়-ডর কোথাও নেই। এ দিকে ও ভারি ধার্মিক কিনা, ও মেয়েটা থাকবে তার কিরকম তান্ত্রিক মতের স্ত্রী হয়ে।’
‘তোমরা পুলিসের লোক আড়ালে আড়ালে থেকো, আমি ধরে দেব। কিন্তু রাত্রি একটার আগে যেয়ো না। তাড়াহুড়ো করলে সব ফসকে যাবে।’
অমাবস্যার রাত, একটা বেজেছে। পায়ের-জুতো-খোলা দুটো একটা লোক অন্ধকারে নিঃশব্দে এ দিকে ও দিকে বেড়াচ্ছে। বিজয়বাবু মন্দিরের দরজার কাছে। একজন চুপিচুপি তাঁকে ইশারা করে ডাকলে, আস্তে আস্তে বললে, ‘সেই ঠাকরুনটি আজ মন্দিরের মধ্যে এসেছেন তাতে সন্দেহমাত্র নেই। তিনি বিখ্যাত কোনো যোগিনী ভৈরবী। দিনের বেলা কারো চোখেই পড়েন না। রাত্রি একটার পর শুনেছি নটরাজের সঙ্গে তাঁর নৃত্য। একটা লোক দৈবাৎ দেখেছিল, সে পাগল হয়ে বেড়াচ্ছে চারি দিকে। হুজুর, আমরা মন্দিরে গিয়ে ঐ ঠাকরুনের গায়ে হাত দিতে পারব না। এমন-কি চোখে দেখতেও পারব না–এ বলে রাখছি। আমরা ব্যারাকে ফিরে যাব ঠিক করেছি। আপনি একলা যা পারেন করবেন।’
একে একে তারা সবাই চলে গেল। নিঃশব্দ–বিজয়বাবু যত বড়ো একেলে লোক হোন-না কেন, তাঁর যে ভয় করছিল না এ কথা বলা যায় না। তাঁর বুক দুর্দুর্ করছে তখন। দরজার কাছ থেকে মেয়েলি গলায় গুন্ গুন্ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং!
বিজয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে লাগল। ভাবলেন কী করা যায়। এক সময়ে সাহসে ভর করে দিলেন দরজায় ধাক্কা। ভাঙা দরজা খুলে গেল। ভিতরে একটি মাটির প্রদীপ মিট্মিট্ করে জ্বলছে, দেখলেন শিবলিঙ্গের সামনে তাঁর স্ত্রী জোড়হাত করে বসে, আর অনিল এক পাশে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। নিজের স্ত্রীকে দেখে সাহস হল মনে, বললেন–‘সদু, অবশেষে তোমার এই কাজ!’
‘হ্যাঁ, আমিই সেই মেয়ে যাকে তোমরা এতদিন খুঁজে বেড়াচ্ছ। নিজের পরিচয় দেব বলেই আজ এসেছি এখানে। তুমি তো জান আমাদের দেশে দৈবাৎ দুই একজন সত্যিকার পুরুষ দেখা যায়। তোমাদের একমাত্র চেষ্টা এঁদের একেবারে নির্জীব করে দিতে। আমরা দেশের মেয়েরা যদি এই-সব সুসন্তানদের আপন প্রাণ দিয়ে রক্ষা না করি তবে আমাদের নারীধর্মকে ধিক্। তোমার অগোচরে নানা কৌশলে এতদিন এই কাজ করে এসেছি। যাঁর কোনো হুকুম কখনও ঠেলতে পারি নি, সকলের চেয়ে কঠিন আজকের এই হুকুম–এও আমাকে মানতে হবে। এই আমার দেবতাকে আজ তোমার হাতেই ছেড়ে দিয়ে আমি সরে দাঁড়াব। জানি আমার চেয়ে বড়ো রক্ষক তাঁর মাথার উপরে আছেন। দু দিন পরেই সমাজের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ কী রকম নিন্দায় ভরে উঠবে তা আমি জানি। এই লাঞ্ছনা আমি মাথায় করে নেব। কখনো মনে কোরো না চাতুরী করে তোমার স্ত্রীকে বাঁচিয়ে এই মানুষকে আলাদা নালিশে জড়াতে পারবে। আমি চিরদিন তাঁর পিছন পিছন থেকে শাস্তির শেষ পালা পর্যন্ত যাব। তুমি সুখে থেকো। তোমার ভয় নেই, ইচ্ছা করলেই তুমি নূতন সঙ্গিনী পাবে। আর যা কর আমাকে দয়া কোরো না। আমার চেয়ে অনেক বড়ো যাঁরা তাঁদের তুমি তা কর নি। সেই নিষ্ঠুরতার অংশ নিয়ে মাথা উঁচু করেই আমি তোমার কাছ থেকে বিদায় নেব। প্রাণপণে তোমার সেবা করেছি ভালোবেসে, প্রাণপণে তোমাকে বঞ্চনা করেছি কর্তব্যবোধে, এই তোমাকে জানিয়ে গেলুম। এর পরে হয়তো আর সময় পাব না।’
সদুর কথায় বাধা দিয়ে অনিল বলে উঠল, ‘বিজয়বাবু, আজ আমি ধরা দেব বলেই স্থির করে এসেছিলুম। আমার আর কোনো ভাবনা নেই। আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে। আপনি সদুর কথায় ভড়কাবেন না। ও একটি অসাধারণ মেয়ে, জন্মেছে আমাদের দেশে, একেবারে খাপছাড়া সমাজে। খুব ভালো করেই চিনেছি আমি ওকে, চিনি বলেই আপনাকে বলছি ও নিষ্কলঙ্ক। যে কঠিন কর্তব্য আমরা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়েছি সেখানে ভালোবাসার কোনো ফাঁক নেই, আছে কেবল আপনাকে জলাঞ্জলি দেওয়া। বিশ্বসংসারের লোক সদু সম্বন্ধে কিচ্ছু জানবে না, আপনার কোনো ভয় নেই। ওকে নিয়ে আপনি মন্দিরের সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে বাড়ি ফিরুন। আর আমি অন্য দিক থেকে পুলিসের হাতে এখুনি ধরা দিচ্ছি। এই সঙ্গে একটি কথা আপনাদের জানিয়ে রাখি, আমাকে আপনারা বাঁধতে পারবেন না। রবিঠাকুরের একটা গান আমার কণ্ঠস্থ–
‘আমারে বাঁধবি তোরা সেই বাঁধন কি তোদের আছে!’
হঠাৎ গেয়ে উঠল বিদেশী গলায়, মন্দিরের ভিত থর থর করে কেঁপে উঠল গলার জোরে। অবাক হয়ে গেলেন ইন্স্পেক্টারবাবু।
‘এই গান অনেক বার গেয়েছি, আবার গাইব, তার পরে চলব আফগানিস্থানের রাস্তা দিয়ে, যেমন করে হোক পথ করে নেব। আপনাদের সঙ্গে এই আমার কথা রইল। আর পনেরো দিন পরে খবরের কাগজে বড়ো বড়ো অক্ষরে বের হবে, অনিল বিপ্লবী পলাতক। আজ প্রণাম হই।’
হঠাৎ বিজয়ের হাত কেঁপে উঠল, টর্চ্টা মাটিতে পড়ে গেল হাত থেকে। মুখের উপরে দুই হাত চেপে বসে পড়লেন। প্রদীপটাও দমকা বাতাসে শেষ হয়ে গেছে আগেই।
Perfect Sound, Anytime: BQYA 2.4 GHz Lavalier Mic with Plug & Play for USB Devices
আরো পড়ুন: প্রেমেন্দ্র মিত্র ভৌতিক গল্প – নিশাচর