Raater Alo

Prabhatsangit by Rabindranath Tagore 15 l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাতসংগীত l Prabhat Sangeet – Rabindranath tagore

Prabhatsangit by Rabindranath Tagore 15 l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাতসংগীত l Prabhat Sangeet - Rabindranath tagore

Prabhatsangit by Rabindranath Tagore (Prabhat Sangeet – Rabindranath tagore): বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিতে প্রভাতসংগীত (Prabhatsangit) একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। প্রভাতসংগীত বলতে মূলত ভোরের সঙ্গীত বোঝানো হয়, যেখানে প্রভাতের রোমাঞ্চকর অনুভূতি এবং প্রকৃতির জাগরণের মাধ্যমে মানুষের মন ও মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রভাতসংগীতগুলি সেই মোহময়ী প্রভাতের সৌন্দর্যকে তুলে ধরে এবং সেই সময়ের এক নৈসর্গিক অভিজ্ঞতা প্রদান করে।

প্রভাতসংগীতগুলি শুধু সুরেলা এবং কাব্যময় নয়, বরং মানব জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগও গভীরভাবে প্রতিফলিত করে। প্রতিটি গানেই থাকে ভোরের আলো, প্রকৃতির রূপ, আর আত্মার গভীরতম অনুভূতির মেলবন্ধন। এসব গানে প্রভাতের শান্ত সৌন্দর্য, নতুন দিনের সম্ভাবনা, এবং আধ্যাত্মিক জাগরণের এক অপূর্ব মিশ্রণ দেখতে পাই।

আশা করি, আমাদের এই আয়োজন প্রভাতসংগীতের (Prabhatsangit by Rabindranath Tagore) প্রতি আপনার আগ্রহ বাড়াবে এবং রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির প্রতি আপনার ভালোবাসাকে আরও গভীর করবে।

Prabhatsangit by Rabindranath Tagore 15 l রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাতসংগীত

প্রভাত-উৎসব – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (prabhaat-utsab)

হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি!

জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি!

ধরায় আছে যত     মানুষ শত শত

আসিছে প্রাণে মোর,হাসিছে গলাগলি।

এসেছে সখা সখী     বসিয়া চোখাচোখি,

দাঁড়ায়ে মুখোমুখি হাসিছে শিশুগুলি।

এসেছে ভাই বোন   পুলকে ভরা মন,

ডাকিছে, “ভাই ভাই’ আঁখিতে আঁখি তুলি।

সখারা এল ছুটে,    নয়নে তারা ফুটে,

পরানে কথা উঠে– বচন গেল ভুলি।

সখীরা হাতে হাতে ভ্রমিছে সাথে সাথে,

দোলায় চড়ি তারা করিছে দোলাদুলি।

শিশুরে লয়ে কোলে  জননী এল চলে,

বুকেতে চেপে ধরে বলিছে “ঘুমো ঘুমো’।

আনত দু’নয়ানে     চাহিয়া মুখপানে

বাছার চাঁদমুখে খেতেছে শত চুমো।

পুলকে পুরে প্রাণ, শিহরে কলেবর,

প্রেমের ডাক শুনি এসেছে চরাচর–

এসেছে রবি শশী,এসেছে কোটি তারা,

ঘুমের শিয়রেতে জাগিয়া থাকে যারা।

পরান পুরে গেল হরষে হল ভোর

জগতে যারা আছে সবাই প্রাণে মোর।

প্রভাত হল যেই কী জানি হল এ কী!

আকাশপানে চাই কী জানি কারে দেখি!

প্রভাতবায়ু বহে      কী জানি কী যে কহে,

মরমমাঝে মোর কী জানি কী যে হয়!

এসো হে এসো কাছে      সখা হে এসো কাছে–

এসো হে ভাই এসো,বোসো হে প্রাণময়।

পুরব-মেঘমুখে পড়েছে রবিরেখা,

অরুণ-রথ-চূড়া আধেক যায় দেখা।

তরুণ আলো দেখে পাখির কলরব–

মধুর আহা কিবা মধুর মধু সব!

মধুর মধু আলো, মধুর মধু বায়,

মধুর মধু গানে তটিনী বয়ে যায়!

যে দিকে আঁখি চায় সে দিকে চেয়ে থাকে,

যাহারি দেখা পায় তারেই কাছে ডাকে,

নয়ন ডুবে যায় শিশির-আঁখি-ধারে,

হৃদয় ডুবে যায় হরষ-পারাবারে।

আয় রে আয় বায়ু, যা রে যা প্রাণ নিয়ে,

জগৎ-মাঝারেতে দে রে তা প্রসারিয়ে।

ভ্রমিবি বনে বনে, যাইবি দিশে দিশে,

সাগরপারে গিয়ে পুরবে যাবি মিশে।

লইবি পথ হতে পাখির কলতান,

যূথীর মৃদুশ্বাস,      মালতীমৃদুবাস–

অমনি তারি সাথে যা রে যা নিয়ে প্রাণ।

পাখির গীতধার      ফুলের বাসভার

ছড়াবি পথে পথে হরষে হয়ে ভোর,

অমনি তারি সাথে ছড়াবি প্রাণ মোর।

ধরারে ঘিরি ঘিরি কেবলি যাবি বয়ে

ধরার চারি দিকে প্রাণেরে ছড়াইয়ে।

পেয়েছি এত প্রাণ   যতই করি দান

কিছুতে যেন আর ফুরাতে নারি তারে।

আয় রে মেঘ, আয় বারেক নেমে আয়,

কোমল কোলে তুলে আমারে নিয়ে যা রে!

কনক-পাল তুলে   বাতাসে দুলে দুলে

ভাসিতে গেছে সাধ আকাশ-পারাবারে।

আকাশ, এসো এসো, ডাকিছ বুঝি ভাই–

গেছি তো তোরি বুকে, আমি তো হেথা নাই।

প্রভাত-আলো-সাথে ছড়ায় প্রাণ মোর,

আমার প্রাণ দিয়ে ভরিব প্রাণ তোর।

ওঠো হে ওঠো রবি,আমারে তুলে লও,

অরুণতরী তব পুরবে ছেড়ে দাও,

আকাশ-পারাবার বুঝি হে পার হবে–

আমারে লও তবে, আমারে লও তবে।

জগৎ আসে প্রাণে, জগতে যায় প্রাণ

জগতে প্রাণে মিলি গাহিছে একি গান!

কে তুমি মহাজ্ঞানী, কে তুমি মহারাজ,

গরবে হেলা করি হেসো না তুমি আজ।

বারেক চেয়ে দেখো আমার মুখপানে–

উঠেছে মাথা মোর মেঘের মাঝখানে,

আপনি আসি উষা শিয়রে বসি ধীরে

অরুণকর দিয়ে মুকুট দেন শিরে,

নিজের গলা হতে কিরণমালা খুলি

দিতেছে রবি-দেব আমার গলে তুলি!

ধূলির ধূলি আমি রয়েছি ধূলি-‘পরে,

জেনেছি ভাই বলে জগৎ চরাচরে।

Tagore Prabhatsangit collection l প্রভাতসংগীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর l রবীন্দ্রনাথের প্রভাতসংগীত

পুনর্মিলন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (punarmilan)

কিসের হরষ কোলাহল

       শুধাই তোদের, তোরা বল্‌।

আনন্দ-মাঝারে সব উঠিতেছে ভেসে ভেসে

        আনন্দে হতেছে কভু লীন–

চাহিয়া ধরণী-পানে নব আনন্দের গানে

        মনে পড়ে আর-এক দিন।

সে তখন ছেলেবেলা–রজনী প্রভাত হলে,

তাড়াতাড়ি শয্যা ছাড়ি ছুটিয়া যেতেম চলে;

সারি সারি নারিকেল বাগানের এক পাশে,

বাতাস আকুল করে আম্রমুকুলের বাসে।

          পথপাশে দুই ধারে

          বেলফুল ভারে ভারে

ফুটে আছে, শিশুমুখে প্রথম হাসির প্রায়–

          বাগানে পা দিতে দিতে

          গন্ধ আসে আচম্বিতে,

নর্‌গেস্‌ কোথা ফুটে খুঁজে তারে পাওয়া দায়।

মাঝেতে বাঁধানো বেদী, জুঁইগাছ চারি ধারে–

সূর্যোদয় দেখা দিত প্রাচীরের পরপারে।

          নবীন রবির আলো

         সে যে কী লাগিত ভালো

সর্বাঙ্গে সুবর্ণসুধা অজস্র পড়িত ঝরে–

প্রভাত ফুলের মতো ফুটায়ে তুলিত মোরে।

           এখনো সে মনে আছে

           সেই জানালার কাছে

বসে থাকিতাম একা জনহীন দ্বিপ্রহরে।

           অনন্ত আকাশ নীল,

           ডেকে চলে যেত চিল

জানায়ে সুতীব্র তৃষা সুতীক্ষ্ন করুণ স্বরে।

           পুকুর গলির ধারে,

          বাঁধা ঘাট এক পারে–

কত লোক যায় আসে, স্নান করে, তোলে জল–

রাজহাঁস তীরে তীরে

সারাদিন ভেসে ফিরে,

ডানা দুটি ধুয়ে ধুয়ে করিতেছে নিরমল।

পূর্ব ধারে বৃদ্ধ বট

মাথায় নিবিড় জট,

ফেলিয়া প্রকাণ্ড ছায়া দাঁড়ায়ে রহস্যময়।

আঁকড়ি শিকড়-মুঠে

প্রাচীর ফেলেছে টুটে,

খোপেখাপে ঝোপেঝাপে কত-না বিস্ময় ভয়।

বসি শাখে পাখি ডাকে সারাদিন একতান-

চারিদিক স্তব্ধ হেরি কী যেন করিত প্রাণ।

মৃদু তপ্ত সমীরণ গায়ে লাগিত এসে,

সেই সমীরণস্রোতে কত কি আসিত ভেসে

কোন্‌ সমুদ্রের কাছে

মায়াময় রাজ্য আছে,

সেথা হতে উড়ে আসে পাখির ঝাঁকের মতো

কত মায়া, কত পরী, রূপকথা কত শত।

আরেকটি ছোটো ঘর মনে পড়ে নদীকূলে,

সম্মুখে পেয়ারাগাছ ভরে আছে ফলে ফুলে।

বসিয়া ছায়াতে তারি ভুলিয়া শৈশবখেলা,

জাহ্নবীপ্রবাহ-পানে চেয়ে আছি সারাবেলা।

ছায়া কাঁপে, আলো কাঁপে, ঝুরু ঝুরু বহে বায়–

ঝর ঝর মর মর পাতা ঝরে পড়ে যায়।

সাধ যেত যাই ভেসে

কত রাজ্যে কত দেশে,

দুলায়ে দুলায়ে ঢেউ নিয়ে যাবে কত দূর–

কত ছোটো ছোটো গ্রাম

নূতন নূতন নাম,

অভ্রভেদী শুভ্র সৌধ, কত নব রাজপুর।

কত গাছ, কত ছায়া জটিল বটের মূল–

তীরে বালুকার ‘পরে,

ছেলেমেয়ে খেলা করে,

সন্ধ্যায় ভাসায় দীপ, প্রভাতে ভাসায় ফুল।

ভাসিতে ভাসিতে শুধু দেখিতে দেখিতে যাব

কত দেশ, কত মুখ, কত-কী দেখিতে পাব।

কোথা বালকের হাসি,

কোথা রাখালের বাঁশি,

সহসা সুদূর হতে অচেনা পাখির গান।

         কোথাও বা দাঁড় বেয়ে

         মাঝি গেল গান গেয়ে,

কোথাও বা তীরে বসে পথিক ধরিল তান।

শুনিতে শুনিতে যাই আকাশেতে তুলে আঁখি

আকাশেতে ভাসে মেঘ, আকাশেতে ওড়ে পাখি।

হয়তো বরষা কাল– ঝর ঝর বারি ঝরে,

পুলকরোমাঞ্চ ফুটে জাহ্নবীর কলেবরে–

          থেকে  থেকে ঝন্‌ ঝন্‌

          ঘন বাজ-বরিষন,

থেকে থেকে বিজলীর চমকিত চকমকি।

           বহিছে পুরব বায়,

           শীতে শিহরিছে কায়,

গহন জলদে দিবা হয়েছে আঁধারমুখী।

           সেই, সেই ছেলেবেলা

           আনন্দে করেছি খেলা

প্রকৃতি গো, জননী গো, কেবলি তোমারি কোলে।

তার পরে কী যে হল– কোথা যে গেলেম চলে।

হৃদয় নামেতে এক বিশাল অরণ্য আছে,

          দিশে দিশে নাহিকো কিনারা,

          তারি মাঝে হ’নু, পথহারা।

          সে বন আঁধারে ঢাকা

           গাছের জটিল শাখা

           সহস্র স্নেহের বাহু দিয়ে

           আঁধার পালিছে  বুকে নিয়ে।

নাহি রবি, নাহি শশী, নাহি গ্রহ, নাহি তারা,

          কে জানে কোথায় দিগ্‌বিদিক।

          আমি শুধু একেলা পথিক।

          তোমারে গেলেম ফেলে,

          অরণ্যে গেলেম চলে,

          কাটালেম কত শত দিন

          ম্রিয়মাণ সুখশান্তিহীন।

আজিকে একটি পাখি পথ দেখাইয়া  মোরে

         আনিল এ অরণ্য-বাহিরে

         আনন্দের সমুদ্রের তীরে।

         সহসা দেখিনু রবিকর,

         সহসা শুনিনু কত গান।

         সহসা পাইনু পরিমল,

         সহসা খুলিয়া গেল প্রাণ।

দেখিনু ফুটিছে ফুল, দেখিনু উড়িছে পাখি,

         আকাশ পুরেছে কলস্বরে।

জীবনের ঢেউগুলি ওঠে পড়ে চারিদিকে,

         রবিকর নাচে তার ‘পরে।

চারি দিকে বহে বায়ু, চারিদিকে ফুটে আলো,

         চারিদিকে অনন্ত আকাশ

চারিদিক পানে চাই–চারিদিকে প্রাণ ধায়,

        জগতের অসীম বিকাশ।

কেহ এসে বসে কোলে, কেহ ডাকে সখা ব’লে,

       কাছে এসে কেহ করে খেলা।

কেহ হাসে, কেহ গায়, কেহ আসে, কেহ যায়–

       এ কী হেরি আনন্দের মেলা!

যুবক যুবতি হাসে, বালক বালিকা নাচে

       দেখে যে রে জুড়ায় নয়ন।

ও কে হোথা গান গায়, প্রাণ কেড়ে নিয়ে যায়,

        ও কী শুনি অমিয়-বচন।

        তাই আজি শুধাই তোমারে

       কেন এ আনন্দ চারিধারে!

বুঝেছি গো বুঝেছি গো, এতদিন পরে বুঝি

       ফিরে পেলে হারানো সন্তান।

তাই বুঝি দুই হাতে জড়ায়ে লয়েছ বুকে,

        তাই বুঝি গাহিতেছ গান।

ভালোবাসা খুঁজিবারে গেছিনু অরণ্যমাঝে,

        হৃদয়ে হইনু পথহারা,

        বরষিনু অশ্রুবারিধারা।

ভ্রমিলাম দূরে দূরে–কে জানিত বল্‌ দেখি

        হেথা এত ভালোবাসা আছে।

যেদিকেই চেয়ে দেখি সেইদিকে ভালোবাসা

          ভাসিতেছে নয়নের কাছে।

মা আমার,  আজ আমি কত শত দিন পরে

          যখনি রে দাঁড়ানু সম্মুখে,

অমনি চুমিলি মুখ, কিছু নাই অভিমান,

         অমনি লইলি তুলে বুকে।

ছাড়িব না তোর কোল, রব হেথা অবিরাম,

        তোর কাছে শিখিব রে স্নেহ,

সবারে বাসিব ভালো–কেহ না নিরাশ হবে

         মোরে ভালো বাসিবে যে কেহ।

Tagore’s Prabhatsangit l Rabindranath Tagore Prabhatsangit

সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় (srishhti sthiti pralay)

দেশশূন্য, কালশূন্য, জ্যোতিঃশূন্য, মহাশূন্য-‘পরি

           চতুর্মুখ করিছেন ধ্যান,

মহা অন্ধ অন্ধকার সভয়ে রয়েছে দাঁড়াইয়া–

           কবে দেব খুলিবে নয়ান।

অনন্ত হৃদয়-মাঝে আসন্ন জগৎ-চরাচর

           দাঁড়াইয়া স্তম্ভিত নিশ্চল,

অনন্ত হৃদয়ে তাঁর ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান

           ধীরে ধীরে বিকাশিছে দল।

লেগেছে  ভাবের ঘোর,  মহানন্দে পূর্ণ তাঁর প্রাণ

           নিজের হৃদয়পানে চাহি,

নিস্তরঙ্গ রহিয়াছে অনন্ত আনন্দপারাবার

           কূল নাহি, দিগ্‌বিদিক নাহি।

           পুলকে পূর্ণিত তাঁর প্রাণ,

সহসা আনন্দসিন্ধু হৃদয়ে উঠিল উথলিয়া,

           আদিদেব খুলিলা নয়ান;

জনশূন্য জ্যোতিঃশূন্য অন্ধতম অন্ধকার-মাঝে

           উচ্ছ্বসি উঠিল বেদগান।

           চারি মুখে বাহিরিল বাণী

           চারিদিকে করিল প্রয়াণ।

           সীমাহারা মহা অন্ধকারে

           সীমাশূন্য ব্যোম-পারাবারে

           প্রাণপূর্ণ ঝটিকার মতো,

           ভাবপূর্ণ, ব্যাকুলতা-সম,

           আশাপূর্ণ অতৃপ্তির প্রায়,

           সঞ্চরিতে লাগিল সে ভাষা।

           দূর দূর যত দূর যায়

           কিছুতেই অন্ত নাহি পায়–

           যুগ যুগ যুগ  যুগান্তর

           ভ্রমিতেছে আজিও সে বাণী,

           আজও সে অন্ত নাহি পায়।

ভাবের আনন্দে ভোর,   গীতিকবি চারি মুখে

           করিতে লাগিলা বেদগান।

আনন্দের আন্দোলনে     ঘন ঘন বহে শ্বাস

           অষ্ট নেত্রে বিস্ফুরিল জ্যোতি ।

জ্যোতির্ময় জটাজাল     কোটিসূর্যপ্রভাসম,

           দিগ্‌বিদিকে পড়িল ছড়ায়ে,

মহান্‌ ললাটে তাঁর       অযুত তড়িৎ-স্ফূর্তি

           অবিরাম লাগিল খেলিতে।

অনন্ত ভাবের দল,       হৃদয়-মাঝারে তাঁর

           হতেছিল আকুল ব্যাকুল–

           মুক্ত হয়ে ছুটিল তাহারা,

           জগতের গঙ্গোত্রীশিখর হতে

           শত শত স্রোতে

           উচ্ছ্বসিল অগ্নিময় বিশ্বের নির্ঝর,

           বাহিরিল অগ্নিময়ী বাণী,

           উচ্ছ্বসিল বাষ্পময় ভাব।

           উত্তরে দক্ষিণে গেল,

           পুরবে পশ্চিমে গেল,

           চারি দিকে ছুটিল তাহারা,

আকাশের মহাক্ষেত্রে    শৈশব-উচ্ছ্বাস-বেগে

           নাচিতে লাগিল মহোল্লাসে।

শব্দশূন্য শূন্যমাঝে       সহসা সহস্র স্বরে

           জয়ধ্বনি উঠিল উথলি,

           হর্ষধ্বনি উঠিল ফুটিয়া,

           স্তব্ধতার পাষাণহৃদয়

           শত ভাগে গেল রে ফাটিয়া।

           শব্দস্রোত ঝরিল চৌদিকে

           এককালে সমস্বরে–

পুরবে উঠিল ধ্বনি,       পশ্চিমে উঠিল ধ্বনি,

           ব্যাপ্ত হল উত্তরে দক্ষিণে।

অসংখ্য ভাবের দল       খেলিতে লাগিল যত

           উঠিল খেলার কোলাহল।

           শূন্যে  শূন্যে মাতিয়া বেড়ায়–

           হেথা ছোটে, হোথা ছুটে যায়।

           কী করিবে আপনা লইয়া

           যেন তাহা ভাবিয়া না পায়,

           আনন্দে ভাঙিয়া যেতে চায়।

           যে প্রাণ অনন্ত যুগ রবে

           সেই প্রাণ পেয়েছে নূতন,

           আনন্দে অনন্ত প্রাণ যেন

           মুহূর্তে করিতে চায় ব্যয় ।

           অবশেষে আকাশ ব্যাপিয়া

           পড়িল প্রেমের আকর্ষণ ।

           এ ধায় উহার পানে

           এ চায় উহার মুখে,

           আগ্রহে ছুটিয়া কাছে আসে।

           বাষ্পে বাষ্পে করে ছুটাছুটি,

           বাষ্পে বাষ্পে করে আলিঙ্গন।

           অগ্নিময় কাতর হৃদয়

           অগ্নিময় হৃদয়ে মিশিছে।

           জ্বলিছে দ্বিগুণ অগ্নিরাশি

           আঁধার হতেছে চুর চুর।

           অগ্নিময় মিলন হইতে

           জন্মিতেছে আগ্নেয় সন্তান,

           অন্ধকার শূন্যমরুমাঝে

           শত শত অগ্নি-পরিবার

           দিশে দিশে করিছে ভ্রমণ।

           নূতন সে প্রাণের উল্লাসে

           নূতন সে প্রাণের উচ্ছ্বাসে

           বিশ্ব যবে হয়েছে উন্মাদ,

           চারি দিকে উঠিছে নিনাদ,

           অনন্ত আকাশে দাঁড়াইয়া

           চারি দিকে চারি হাত দিয়া

           বিষ্ণু আসি মন্ত্র পড়ি দিলা,

           বিষ্ণু আসি কৈলা আশীর্বাদ।

           লইয়া মঙ্গলশঙ্খ করে,

           কাঁপায়ে জগৎ চরাচরে

           বিষ্ণু আসি কৈলা শঙ্খনাদ।

           থেমে এল প্রচণ্ড কল্লোল

           নিবে এল জ্বলন্ত উচ্ছ্বাস,

           গ্রহগণ নিজ অশ্রুজলে

           নিবাইল নিজের হুতাশ।

           জগতের বাঁধিল সমাজ,

           জগতের বাঁধিল সংসার

           বিবাহে বাহুতে বাহু বাঁধি

           জগৎ হইল পরিবার।

বিষ্ণু আসি মহাকাশে,   লেখনী ধরিয়া করে

           মহান্‌ কালের পত্র খুলি

           ধরিয়া ব্রহ্মার ধ্যানগুলি

           একমনে পরম যতনে

           লিখি লিখি যুগ-যুগান্তর

           বাঁধি দিলা ছন্দের বাঁধনে।

           জগতের মহা-বেদব্যাস

           গঠিলা নিখিল উপন্যাস,

           বিশৃঙ্খল বিশ্বগীতি লয়ে

           মহাকাব্য  করিলা রচন।

           জগতের ফুলরাশি লয়ে

           গাঁথি মালা মনের মতন,

           নিজ গলে কৈলা আরোপণ।

জগতের মালাখানি       জগৎ-পতির গলে

           মরি কিবা সেজেছে অতুল

           দেখিবারে হৃদয় আকুল।

           বিশ্বমালা অসীম অক্ষয়,

কত চন্দ্র কত সূর্য       কত গ্রহ কত তারা

           কত বর্ণ কত গীতময়।

           নিজ নিজ পরিবার লয়ে

           ভ্রমে সবে নিজ নিজ পথে,

           বিষ্ণুদেব চক্র হাতে লয়ে,

           চক্রে চক্রে বাঁধিলা জগতে।

           চক্রপথে ভ্রমে গ্রহ তারা,

           চক্রপথে রবি শশী ভ্রমে,

           শাসনের গদা হস্তে লয়ে

           চরাচর রাখিলা নিয়মে।

           দুরন্ত প্রেমের মন্ত্র পড়ি

           বাঁধি দিলা বিবাহবন্ধনে।

           মহাকায় শনিরে ঘেরিয়া

           হাতে হাতে ধরিয়া ধরিয়া

           নাচিতে লাগিল এক তালে

           সুধামুখ চাঁদ শত শত।

           পৃথিবীর সমুদ্রহৃদয়

           চন্দ্রে হেরি উঠে উথলিয়া।

           পৃথিবীর মুখপানে চেয়ে

           চন্দ্র হাসে আনন্দে গলিয়া।

           মিলি যত গ্রহ ভাইবোন

           এক অন্নে হইল পালিত,

           তারা-সহোদর যত ছিল

           এক সাথে হইল মিলিত।

           কত কত শত বর্ষ ধরি

           দূর পথ অতিক্রম করি

           পাঠাইছে বিদেশ হইতে

           তারাগুলি আলোকের দূত

           ক্ষুদ্র ওই দূরদেশবাসী

           পৃথিবীর বারতা লইতে।

           রবি ধায় রবির চৌদিকে

           গ্রহ ধায় রবিরে ঘেরিয়া

           চাঁদ হাসে গ্রহমুখ চেয়ে,

           তারা হাসে তারায় হেরিয়া।

           মহাছন্দ মহা অনুপ্রাস

           চরাচরে বিস্তারিল পাশ।

           পশিয়া মানসসরোবরে

           স্বর্ণপদ্ম করিলা চয়ন,

           বিষ্ণুদেব প্রসন্ন আননে

           পদ্মপানে মেলিল নয়ন।

           ফুটিয়া উঠিল শতদল,

           বাহিরিল কিরণ বিমল,

           মাতিল রে দ্যুলোক ভূলোক

           আকাশে পুরিল পরিমল।

           চরাচরে উঠাইয়া গান

           চরাচরে জাগাইয়া হাসি

           কোমল কমলদল হতে

           উঠিল অতুল রূপরাশি।

           মেলি দুটি নয়ন বিহ্বল

           ত্যজিয়া সে শতদলদল

           ধীর ধীরে জগৎ-মাঝারে

           লক্ষ্মী আসি ফেলিলা চরণ–

           গ্রহে গ্রহে তারায় তারায়

           ফুটিল রে বিচিত্র বরন।

           জগৎ মুখের পানে চায়,

           জগৎ পাগল হয়ে যায়,

           নাচিতে লাগিল চারি দিকে–

           আনন্দের অন্ত নাহি পায়।

           জগতের মুখপানে চেয়ে

           লক্ষ্মী যবে হাসিলেন হাসি

           মেঘেতে ফুটিল ইন্দ্রধনু,

           কাননে ফুটিল ফুলরাশি–

           হাসি লয়ে করে কাড়াকাড়ি

           চন্দ্র সূর্য গ্রহ চারি ভিতে,

           চাহে তাঁর চরণছায়ায়

           যৌবনকুসুম ফুটাইতে।

           জগতের হৃদয়ের আশা

           দশ দিকে আকুল হইয়া

           ফুল হয়ে পরিমল হয়ে

           গান হয়ে উঠিল ফুটিয়া।

           একি হেরি যৌবন-উচ্ছ্বাস,

           একি রে মোহন ইন্দ্রজাল–

           সৌন্দর্যকুসুমে গেল ঢেকে

           জগতের কঠিন কঙ্কাল।

           হাসি হয়ে ভাতিল আকাশে

           তারকার রক্তিম নয়ান,

           জগতের হর্ষকোলাহল

           রাগিণীতে হল অবসান।

           কোমলে কঠিন লুকাইল,

           শক্তিরে ঢাকিল রূপরাশি,

           প্রেমের হৃদয়ে মহা বল

           অশনির মুখে দিল হাসি।

           সকলি হইল মনোহর

           সাজিল জগৎ-চরাচর।

মহাছন্দে বাঁধা হয়ে যুগ যুগ যুগ যুগান্তর

           পড়িল নিয়ম-পাঠশালে

           অসীম জগৎ-চরাচর।

           শ্রান্ত হয়ে এল কলেবর,

           নিদ্রা আসে নয়নে তাহার,

           আকর্ষণ হতেছে শিথিল,

           উত্তাপ হতেছে একাকার।

           জগতের প্রাণ হতে

           উঠিল রে বিলাপসংগীত,

           কাঁদিয়া উঠিল চারি ভিত ।

পুরবে বিলাপ উঠে,      পশ্চিমে বিলাপ উঠে,

           কাঁদিল রে উত্তর দক্ষিণ,

কাঁদে গ্রহ, কাঁদে তারা, শ্রান্তদেহে কাঁদে রবি–

           জগৎ হইল শান্তিহীন।

           চারি দিক হতে উঠিতেছে

           আকুল বিশ্বের কণ্ঠস্বর,

           “জাগো জাগো জাগো মহাদেব,

           কবে মোরা পাব অবসর?

           অলঙ্ঘ্য নিয়মপথে ভ্রমি

           হয়েছে হে শ্রান্ত কলেবর।

           নিয়মের পাঠ সমাপিয়া

           সাধ গেছে খেলা করিবারে,

           একবার ছেড়ে দাও, দেব,

           অনন্ত এ আকাশ-মাঝারে।”

           জগতের আত্মা কহে কাঁদি,

           “আমারে নূতন দেহ দাও–

           প্রতিদিন বাড়িছে হৃদয়,

           প্রতিদিন বাড়িতেছে আশা,

           প্রতিদিন টুটিতেছে দেহ,

           প্রতিদিন ভাঙিতেছে বল।

           গাও দেব মরণসংগীত

           পাব মোরা নূতন জীবন।”

           জগৎ কাঁদিল উচ্চরবে

           জাগিয়া উঠিল মহেশ্বর,

           তিন কাল ত্রিনয়ন মেলি,

           হেরিলেন দিক দিগন্তর।

প্রলয়বিষাণ তুলি      করে ধরিলেন শূলী,

           পদতলে জগৎ চাপিয়া,

জগতের আদি অন্ত     থরথর থরথর

           একবার উঠিল কাঁপিয়া।

           বিষাণেতে পুরিলা নিশ্বাস,

           ছিঁড়িয়া পড়িয়া গেল

           জগতের সমস্ত বাঁধন।

উঠিল রে মহাশূন্যে গরজিয়া তরঙ্গিয়া

ছন্দোমুক্ত জগতের উন্মত্ত আনন্দকোলাহল।

ছিঁড়ে  গেল রবি শশী গ্রহ তারা ধূমকেতু,

           কে কোথায় ছুটে গেল,

           ভেঙে গেল, টুটে গেল,

           চন্দ্রে সূর্যে গুঁড়াইয়া

           চূর্ণ চূর্ণ হয়ে গেল।

           মহা অগ্নি জ্বলিল রে,

           আকাশের অনন্ত হৃদয়

           অগ্নি, অগ্নি, শুধু অগ্নিময়।

           মহা অগ্নি উঠিল জ্বলিয়া

           জগতের মহা চিতানল।

খণ্ড খণ্ড রবি শশী, চূর্ণ চূর্ণ গ্রহ তারা

           বিন্দু বিন্দু আঁধারের মতো

           বরষিছে চারি দিক হতে,

           অনলের তেজোময় গ্রাসে

           নিমেষেতে যেতেছে মিশায়ে।

           সৃজনের আরম্ভসময়ে

           আছিল অনাদি অন্ধকার,

           সৃজনের ধ্বংসযুগান্তরে

           রহিল অসীম হুতাশন।

অনন্ত আকাশগ্রাসী অনলসমুদ্রমাঝে

           মহাদেব মুদি ত্রিনয়ান

           করিতে লাগিলা মহাধ্যান।

সাধ (saadh)

অরুণময়ী তরুণী উষা

        জাগায়ে দিল গান।

পুরব মেঘে কনকমুখী

বারেক শুধু মারিল উঁকি,

অমনি যেন জগৎ ছেয়ে

        বিকশি উঠে প্রাণ।

কাহার হাসি বহিয়া এনে

        করিলি সুধা দান।

ফুলেরা সব চাহিয়া আছে

আকাশ-পানে মগন-মনা,

মুখেতে মৃদু বিমল হাসি

নয়নে দুটি শিশির-কণা।

আকাশ-পারে কে যেন বসে,

তাহারে যেন দেখিতে পায়,

বাতাসে দুলে বাহুটি তুলে

মায়ের কোলে ঝাঁপিতে যায়।

কী যেন দেখে, কী যেন শোনে,

কে যেন ডাকে, কে যেন গায়

ফুলের সুখ, ফুলের হাসি

দেখিবি তোরা আয় রে আয়।

আ মরি মরি অমনি যদি

ফুলের মতো চাহিতে পারি।

বিমল প্রাণে বিমল সুখে

বিমল প্রাতে বিমল মুখে

ফুলের মতো অমনি যদি

বিমল হাসি হাসিতে পারি।

দুলিছে, মরি, হরষ-স্রোতে,

অসীম স্নেহে আকাশ হতে

কে যেন তারে খেতেছে চুমো,

কোলেতে তারি পড়িছে লুটে।

কে যেন তারি নামটি ধ’রে

ডাকিছে তারে সোহাগ করে

শুনিতে পেয়ে ঘুমের ঘোরে

মুখটি ফুটে হাসিটি ফোটে,

শিশুর প্রাণে সুখের মতো

সুবাসটুকু জাগিয়া ওঠে।

আকাশ পানে চাহিয়া থাকে,

না জানি তাহে কী সুখ পায়।

বলিতে যেন শেখে নি কিছু

কী যেন তবু বলিতে চায়।

আঁধার কোণে থাকিস তোরা,

জানিস কি রে কত সে সুখ,

আকাশ-পানে চাহিলে পরে

আকাশ-পানে তুলিলে মুখ।

সুদূর দূর, সুনীল নীল,

সুদূরে পাখি উড়িয়া যায়।

সুনীল দূরে ফুটিছে তারা,

সুদূর হতে আসিছে বায়।

প্রভাত-করে করি রে স্নান

        ঘুমাই ফুলবাসে,

পাখির গান লাগে রে যেন

দেহের চারি পাশে।

বাতাস যেন প্রাণের সখা,

প্রবাসে ছিল, নতুন দেখা,

ছুটিয়া আসে বুকের কাছে

        বারতা শুধাইতে।

চাহিয়া আছে আমার মুখে,

কিরণময় আমারি সুখে

আকাশ যেন আমারি তরে

        রয়েছে বুক পেতে।

মনেতে করি আমারি যেন

        আকাশ-ভরা প্রাণ,

আমারি প্রাণ হাসিতে ছেয়ে

জাগিছে উষা তরুণ মেয়ে,

করুণ আঁখি করিছে প্রাণে

        অরুণ- সুধা দান।

আমারি বুকে প্রভাতবেলা

ফুলেরা মিলি করিছে খেলা,

হেলিছে কত, দুলিছে কত,

        পুলকে ভরা মন,

আমারি তোরা বালিকা মেয়ে

        আমারি স্নেহধন।

আমারি মুখে চাহিয়া তোর

        আঁখিটি ফুটিফুটি।

আমারি বুকে আলয় পেয়ে

        হাসিয়া কুটিকুটি।

কেন রে বাছা, কেন রে হেন

        আকুল কিলিবিলি,

কী কথা যেন জানাতে চাস

        সবাই মিলি মিলি।

হেথায় আমি রহিব বসে

        আজি সকালবেলা

নীরব হয়ে দেখিব  চেয়ে

        ভাইবোনের খেলা।

বুকের কাছে পড়িবি ঢলে

        চাহিবি ফিরে ফিরে,

পরশি দেহে  কোমলদল

স্নেহেতে চোখে আসিবে জল,

শিশির-সম তোদের ‘পরে

        ঝরিবে ধীরে ধীরে।

হৃদয় মোর আকাশ-মাঝে

তারার মতো উঠিতে চায়,

আপন সুখে ফুলের মতো

আকাশ-পানে ফুটিতে চায়।

নিবিড় রাতে আকাশে উঠে

চারি দিকে সে চাহিতে চায়,

তারার মাঝে হারায়ে গিয়ে

আপন মনে গাহিতে চায়।

মেঘের মতো হারায়ে দিশা

আকাশ-মাঝে ভাসিতে চায়–

কোথায় যাবে কিনারা নাই,

দিবসনিশি চলেছে তাই

বাতাস এসে লাগিছে গায়ে

জোছনা এসে পড়িছে পায়ে,

উড়িয়া কাছে গাহিছে পাখি,

মুদিয়া যেন এসেছে আঁখি,

আকাশ-মাঝে মাথাটি থুয়ে

আরামে যেন ভাসিয়া যায়,

হৃদয় মোর মেঘের মতো

আকাশ-মাঝে ভাসিতে চায়।

ধরার পানে মেলিয়া আঁখি

উষার মতো হাসিতে চায়।

জগৎ-মাঝে ফেলিতে পা

চরণ যেন উঠিছে না,

শরমে যেন হাসিছে মৃদু হাস,

হাসিটি যেন নামিল ভুঁয়ে,

জাগায়ে দিল ফুলেরে ছুঁয়ে,

মালতীবধূ হাসিয়া তারে

        করিল পরিহাস।

মেঘেতে হাসি জড়ায়ে যায়,

বাতাসে হাসি- গড়ায়ে যায়,

উষার হাসি–ফুলের হাসি

কানন-মাঝে ছড়ায়ে যায়।

হৃদয় মোর আকাশে উঠে

উষার মতো হাসিতে চায়।

শরতে প্রকৃতি (shrate prakriti)

কই গো প্রকৃতি রানী, দেখি দেখি মুখখানি,

কেন গো বিষাদছায়া রয়েছে অধর ছুঁয়ে

          মুখানি মলিন কেন গো?

এই যে মুহূর্ত আগে হাসিতে ছিলে গো দেখি

পলক না পালটিতে সহসা নেহারি এ কি–

          মরমে বিলীন যেন গো!

কেন তনুখানি ঢাকা শুভ্র কুহেলিকা বাসে

মৃদু বিষাদের ভারে সুধীরে মুদিয়া আসে

          নয়ন-নলিন হেন গো?

ওই দেখো চেয়ে দেখো– একবার চেয়ে দেখো–

চাঁদের অধর দুটি হাসিতে ভাসিয়া যায়!

নিশীথের প্রাণে গিয়া সে হাসি মিশিয়া যায়।

সে হাসির কোলে বসি কানন-গোলাপগুলি

আধো আধো কথা কহে সোহাগেতে দুলি দুলি!

সে হাসির পায়ে পড়ি নদীর লহরীগণ

যার যত কথা আছে বলিতে আকুল মন।

সে হাসির শিশুদুটি লতিকামণ্ডপে গিয়া

আঁধারে ভাবিয়া সারা বাহিরিবে কোথা দিয়া!

সে-হাসি অলসে ঢলি দিগন্তে পড়িয়া নুয়ে,

মেঘের অধরপ্রান্ত একটু রয়েছে ছুঁয়ে।

          বলো তুমি কেন তবে

          এমন মলিন রবে?

বিষাদ-স্বপন দেখে হাসির কোলেতে শুয়ে।

          ঘোমটাটি খোলো খোলো

          মুখখানি তোলো তোলো

চাঁদের মুখের পানে চাও একবার!

বলো দেখি কারে হেরি এত হাসি তার!

নিলাজ বসন্ত যবে কুসুমে কুসুমময়

মাতিয়া নিজের রূপে হাসিয়া আকুল হয়,

          মলয় মরমে মরি,

          ফিরে হাহাকার করি–

বনের হৃদয় হতে সৌরভ-উচ্ছ্বাস বয়!

তারে হেরি হয় না সে এমন হরষে ভোর;

কী চোখে দেখেছে চাঁদ ওই মুখখানি তোর!

          তুই তবু কেন কেন

          দারুণ বিরাগে যেন

চাস নে চাঁদের হাসি চাঁদের আদর!

          নাই তোর ফুলবাস,

          নাইক প্রেমের হাস,

পাপিয়া আড়ালে বসি শুনায় না প্রেমগান!

          কী দুখেতে উদাসিনী

          যৌবনেতে সন্ন্যাসিনী!

কাহার ধেয়ানে মগ্ন শুভ্র বস্ত্র পরিধান?

এক-কালে ছিল তোর কুসুমিত মধুমাস–

হৃদয়ে ফুটিত তোর অজস্র ফুলের রাশ;

          যৌবন-উচ্ছ্বাসে ভোর

          প্রাণের সুরভি তোর

পথিক সমীরে সব দিলি তুই বিলাইয়া!

          শেষে গ্রীষ্মতাপে জ্বলি

          শুকাইল ফুল-কলি,

সর্বস্ব যাহারে দিলি সেও গেল পলাইয়া!

চেতনা পাইয়া শেষে হইয়া সর্বস্ব-হারা

সারাটি বরষা তুই কাঁদিয়া হইলি সারা!

এত দিন পরে বুঝি শুকাইল অশ্রুধারা!

আজ বুঝি মনে মনে করিলি দারুণ পণ

যোগিনী হইবি তুই পাষাণে বাঁধিবি মন!

বসন্তের ছেলেখেলা ভালো নাহি লাগে আর–

চপল চঞ্চল হাসি ফুলময় অলংকার!

এখন যে হাসি হাসো আজি বিরাগের দিন,

শুভ্র শান্ত সুবিমল বাসনা-লালসাহীন।

          এত যে করিলি পণ

          তবুও তো ক্ষণে ক্ষণ

সে দিনের স্মৃতিছায়া হৃদয়ে বেড়ায় ভাসি।

          প্রশান্ত মুখের ‘পরে

          কুহেলিকা ছায়া পড়ে–

ভাবনার মেঘ উঠে সহসা আলোক নাশি–

          মুহূর্তে কিসের লাগি

          আবার উঠিস জাগি

আবার অধরে ফুটে সেই সে পুরানো হাসি!

ঘুমায়ে পড়িস যবে বিহ্বল রজনীশেষে,

অতি মৃদু পা টিপিয়া উষা আসে হেসে হেসে,

অতিশয় সাবধানে দুইটি আঙুল দিয়া

কুয়াশা-ঘোমটা তোর দেয় ধীরে সরাইয়া!

অমনি তরুণ রবি পাশে আসি মৃদুগতি

মুদিত নয়ন তোর চুমে ধীরে ধীরে অতি!

          শিহরিয়া কাঁপি উঠি

          মেলিস নয়ন দুটি,

রাঙা হয়ে ওঠে তোর কপোল-কুসুমদল

শরমে আকুল ঝরে শিশির-নয়নজল!

সুদূর আলয় হতে তাড়াতাড়ি খেলা ভুলি

মাঝে মাঝে ছুটে আসে দুদণ্ডের মেঘগুলি।

চমকি দাঁড়ায়ে থাকে, ওই মুখপানে চায়,

কাঁদিয়া কাঁদিয়া শেষে কাঁদিয়া মরিয়া যায়!

কিসের বিরাগ এত, কী তপে আছিস ভোর!

          এত করে সেধে সেধে

          এত করে কেঁদে কেঁদে

যোগিনী, কিছুতে তবু ভাঙিবে না পণ তোর?

যোগিনী, কিছুতে কি রে ফিরিবে না মন তোর?

আহ্বানসংগীত (ahbaansangeet)

ওরে তুই জগৎ-ফুলের কীট,

জগৎ যে তোর শুকায়ে আসিল,

মাটিতে পড়িল খসে–

সারা দিন রাত গুমরি গুমরি

কেবলি আছিস বসে।

মড়কের কণা,নিজ হাতে তুই

রচিলি নিজের কারা,

আপনার জালে জড়ায়ে পড়িয়া

আপনি হইলি হারা।

অবশেষে কারে অভিশাপ দিস

হাহুতাশ করে সারা,

কোণে বসে শুধু ফেলিস নিশাস,

ঢালিস বিষের ধারা।

জগৎ যে তোর মুদিয়া আসিল,

ফুটিতে নারিল আর,

প্রভাত হইলে প্রাণের মাঝারে

ঝরে না শিশিরধার।

ফেলিস নিশাস, মরুর বাতাস

জ্বলিস জ্বালাস কত,

আপন জগতে আপনি আছিস

একটি রোগের মতো।

হৃদয়ের ভার বহিতে পার না,

আছ মাথা নত করে–

ফুটিবে না ফুল, ফলিবে না ফল,

শুকায়ে পড়িবে মরে।

রোদন,রোদন, কেবলি রোদন,

কেবলি বিষাদশ্বাস–

লুকায়ে, শুকায়ে, শরীর গুটায়ে

কেবলি কোটরে বাস।

নাই কোনো কাজ–মাঝে মাঝে চাস

মলিন আপনা-পানে,

আপনার স্নেহে কাতর বচন

কহিস আপন কানে।

দিবস রজনী মরীচিকাসুরা

কেবলি করিস পান।

বাড়িতেছে তৃষা,  বিকারের তৃষা–

ছট্‌ফট্‌ করে প্রাণ।

“দাও দাও’  ব’লে সকলি যে চাস,

জঠর জ্বলিছে ভুখে–

মুঠি মুঠি ধুলা তুলিয়া লইয়া

কেবলি পুরিস মুখে।

নিজের নিশাসে কুয়াশা ঘনায়ে,

ঢেকেছে নিজের কায়া,

পথ আঁধারিয়া পড়েছে সমুখে

নিজের দেহের ছায়া।

ছায়ার মাঝারে দেখিতে না পাও,

শব্দ শুনিলে ডর’–

বাহু প্রসারিয়া চলিতে চলিতে,

নিজেরে আঁকড়ি ধর’।

চারি দিকে শুধু ক্ষুধা ছড়াইছে

যে দিকে পড়িছে দিঠ

বিষেতে ভরিলি জগৎ, রে তুই

কীটের অধম কীট।

আজিকে বারেক ভ্রমরের মতো

বাহির হইয়া আয়,

এমন প্রভাতে এমন কুসুম

কেন রে শুকায়ে যায়।

বাহিরে আসিয়া উপরে বসিয়া

কেবলি গাহিবি গান,

তবে সে কুসুম কহিবে রে কথা,

তবে সে খুলিবে প্রাণ।

আকাশে হাসিবে তরুণ তপন,

কাননে ছুটিবে বায়,

চারিদিকে তোর প্রাণের লহরী

উথলি উথলি যায়।

বায়ুর হিল্লোলে ধরিবে পল্লব

মরমর মৃদু তান,

চারিদিক হতে কিসের উল্লাসে

পাখিতে গাহিবে গান।

নদীতে উঠিবে শত শত ঢেউ,

গাবে তারা কল কল,

আকাশে আকাশে উথলিবে শুধু

হরষের কোলাহল।

কোথাও বা হাসি কোথাও বা খেলা

কোথাও বা সুখগান–

মাঝে বসে তুই বিভোর হইয়া,

আকুল পরানে নয়ন মুদিয়া

অচেতন সুখে চেতনা হারায়ে

করিবি রে মধুপান।

ভুলে যাবি ওরে আপনারে তুই

ভুলে যাবি তোর গান।

মোহ ছুটিবে রে নয়নেতে তোর,

যে দিকে চাহিবি হয়ে যাবে ভোর,

যাহারে হেরিবি তাহারে হেরিয়া

মজিয়া রহিবে প্রাণ।

ঘুমের ঘোরেতে গাহিবে পাখি

এখনো যে পাখি জাগে নি,

ভোরের আকাশ ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া

উঠিবে বিভাসরাগিণী।

জগৎ-অতীত আকাশ হইতে

বাজিয়া উঠিবে বাঁশি,

প্রাণের বাসনা আকুল হইয়া

কোথায় যাইবে ভাসি।

উদাসিনী আশা গৃহ তেয়াগিয়া

অসীম পথের পথিক হইয়া,

সুদূর হইতে সুদূরে উঠিয়া

আকুল হইয়া চায়,

যেমন বিভোর চকোরের গান

ভেদিয়া ভেদিয়া সুদূর বিমান

চাঁদের মরণে মরিতে গিয়া

মেঘেতে হারায়ে যায়।

মুদিত নয়ান, পরান বিভল,

স্তব্ধ হইয়া শুনিবি কেবল,

জগতেরে সদা ডুবায়ে দিতেছে

জগৎ-অতীত গান–

তাই শুনি যেন জাগিতে চাহিছে

ঘুমেতে-মগন প্রাণ।

জগৎ বাহিরে যমুনাপুলিনে

কে যেন বাজায় বাঁশি,

স্বপন-সমান পশিতেছে কানে

ভেদিয়া নিশীথরাশি–

এ গান শুনিনি,এ আলো দেখিনি,

এ মধু করিনি পান,

এমন বাতাস পরান পুরিয়া

করে নি রে সুধা দান,

এমন প্রভাত-কিরণ-মাঝারে

কখনো করি নি স্নান,

বিফলে জগতে লভিনু জনম,

বিফলে কাটিল প্রাণ।

দেখ্‌ রে সবাই চলেছে বাহিরে

সবাই চলিয়া যায়,

পথিকেরা সবে হাতে হাতে ধরি

শোন্‌ রে কী গান গায়।

জগৎ ব্যাপিয়া শোন্‌ রে সবাই

ডাকিতেছে, আয়,আয়–

কেহ বা আগেতে কেহ বা পিছায়ে,

কেহ ডাক শুনে ধায়।

অসীম আকাশে স্বাধীন পরানে

প্রাণের আবেগে ছোটে,

এ শোভা দেখিলে জড়ের শরীরে

পরান নাচিয়া ওঠে।

তুই শুধু ওরে ভিতরে বসিয়া

গুমরি মরিতে চাস!

তুই শুধু ওরে করিস রোদন,

ফেলিস দুখের শ্বাস!

ভূমিতে পড়িয়া আঁধারে বসিয়া

আপনা লইয়া রত,

আপনারে সদা কোলেতে তুলিয়া

সোহাগ করিস কত!

আর কতদিন কাটিবে এমন,

সময় যে চলে যায়।

ওই শোন্‌ ওই ডাকিছে সবাই,

বাহির হইয়া আয়!

অনন্ত জীবন (ananta jeeban)

অধিক করি না আশা, কিসের বিষাদ,

জনমেছি দু দিনের তরে–

যাহা মনে আসে তাই আপনার মনে

গান গাই আনন্দের ভরে।

এ আমার গানগুলি দু দণ্ডের গান

রবে না রবে না চিরদিন–

পুরব-আকাশ হতে উঠিবে উচ্ছ্বাস,

পশ্চিমেতে হইবে বিলীন।

তোরা-ফুল, তোরা পাখি, তোরা খোলা প্রাণ,

জগতের আনন্দ যে তোরা,

জগতের বিষাদ-পাসরা।

পৃথিবীতে উঠিয়াছে আনন্দলহরী

তোরা তার একেকটি ঢেউ,

কখন উঠিলি আর কখন মিলালি

জানিতেও পারিল না কেউ।

নাই তোর নাই রে ভাবনা,

এ জগতে কিছুই মরে না।

নদীস্রোতে কোটি কোটি মৃত্তিকার কণা

ভেসে আসে, সাগরে মিশায়–

জান না কোথায় তারা যায়!

একেকটি কণা লয়ে গোপনে সাগর

রচিছে বিশাল মহাদেশ,

না জানি কবে তা হবে শেষ!

মুহূর্তেই ভেসে যায় আমাদের গান,

জান না তো কোথায় তা যায়!

আকাশের সাগরসীমায়!

আকাশ-সমুদ্র তলে গোপনে গোপনে

গীতরাজ্য হতেছে সৃজন,

যত গান উঠিতেছে ধরার আকাশে

সেইখানে করিছে গমন।

আকাশ পুরিয়া যাবে শেষ,

উঠিবে গানের মহাদেশ।

নাই তোর নাই রে ভাবনা

এ জগতে কিছুই মরে না।

কাল দেখেছিনু পথে হরষে  খেলিতেছিল

দুটি ভাই গলাগলি করি

দেখেছিনু জানালায় নীরবে দাঁড়ায়েছিল

দুটি সখা হাতে হাতে ধরি

দেখেছিনু কচি মেয়ে মায়ের বাহুতে শুয়ে

ঘুমায়ে করিছে স্তনপান,

ঘুমন্ত মুখের ‘পরে বরষিছে স্নেহধারা

স্নেহমাখা নত দু’নয়ান

দেখেছিনু রাজপথে চলেছে বালক এক

বৃদ্ধ জনকের হাত ধরি–

কত কী যে দেখেছিনু, হয়তো সে-সব ছবি

আজ আমি গিয়েছি পাসরি।

তা বলে নাহি কি তাহা মনে?

ছবিগুলি মেশেনি জীবনে?

স্মৃতির কণিকা তারা স্মরণের তলে পশি

রচিতেছে জীবন আমার–

কোথা যে কে মিশাইল, কেবা গেল কার পাশে

চিনিতে পারি নে তাহা আর।

হয়তো অনেকদিন দেখেছিনু ছবি এক

দুটি প্রাণী বাহুর বাঁধনে

তাই আজ ছুটাছুটি এসেছি প্রভাতে উঠি

সখারে বাঁধিতে আলিঙ্গনে।

হয়তো অনেক দিন শুনেছিনু, পাখি এক

আনন্দে গাহিছে প্রাণ খুলি,

সহসা রে তাই আজ প্রভাতের মুখ দেখি

প্রাণ মন উঠিছে উথুলি।

সকলি মিশেছে আসি হেথা,

জীবনে কিছু না যায় ফেলা

এই যে যা-কিছু চেয়ে দেখি

এ নহে কেবলি ছেলেখেলা।

এই জগতের মাঝে একটি সাগর আছে

নিস্তব্ধ তাহার জলরাশি,

চারিদিক হতে সেথা অবিরাম অবিশ্রাম

জীবনের স্রোত মিশে আসি।

    সূর্য হতে ঝরে ধারা, চন্দ্র হতে ঝরে ধারা,

কোটি কোটি তারা হতে ঝরে,

জগতের যত হাসি যত গান যত প্রাণ

ভেসে আসে সেই স্রোতোভরে–

মেশে আসি সেই সিন্ধু-‘পরে।

পৃথ্বী হতে মহাস্রোত ছুটিতেছে অবিরাম

সেই মহাসাগর-উদ্দেশে,

আমরা মাটির কণা জলস্রোত ঘোলা করি

অবিশ্রাম চলিয়াছি ভেসে–

সাগরে পড়িব অবশেষে।

জগতের মাঝখানে সেই সাগরের তলে

রচিত হতেছে পলে পলে

অনন্ত-জীবন মহাদেশ,

কে জানে হবে কি তাহা শেষ!

তাই বলি, প্রাণ ওরে, গান গা পাখির মতো,

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ শোক ভুলি–

তুই যাবি,  গান যাবে, একসাথে ভেসে যাবে

তুই আর তোর গানগুলি।

মিশিবি সে সিন্ধুজলে অনন্তসাগরতলে,

একসাথে শুয়ে রবি প্রাণ,

তুই আর তোর এই গান।

প্রতিধ্বনি (pratidwani)

অয়ি প্রতিধ্বনি,

      বুঝি আমি তোরে ভালোবাসি,

      বুঝি আর কারেও বাসি না।

আমারে করিলি তুই আকুল ব্যাকুল,

      তোর লাগি কাঁদে মোর বীণা।

তোর মুখে পাখিদের শুনিয়া সংগীত,

      নির্ঝরের শুনিয়া ঝর্ঝর,

গভীর রহস্যময় অরণ্যের গান,

      বালকের মধুমাখা স্বর,

তোর মুখে জগতের সংগীত শুনিয়া,

      তোরে আমি ভালোবাসিয়াছি;

তবু কেন তোরে আমি দেখিতে না পাই,

      বিশ্বময় তোরে খুঁজিয়াছি।

চিরকাল-চিরকাল-তুই কি রে চিরকাল

           সেই দূরে রবি,

আধো সুরে গাবি শুধু গীতের আভাস,

           তুই চিরকবি।

দেখা তুই দিবি না কি?  নাহয় না দিলি

      একটি কি পুরাবি না আশ?

কাছে হতে একবার শুনিবারে চাই

      তোর গীতোচ্ছ্বাস।

অরণ্যের পর্বতের সমুদ্রের গান,

      ঝটিকার বজ্রগীতস্বর,

দিবসের প্রদোষের রজনীর গীত,

     চেতনার নিদ্রার মর্মর,

বসন্তের বরষার শরতের গান,

     জীবনের মরণের স্বর,

আলোকের পদধ্বনি মহা অন্ধকারে

     ব্যাপ্ত করি বিশ্বচরাচর,

পৃথিবীর চন্দ্রমার গ্রহ-তপনের,

    কোটি কোটি তারার সংগীত,

তোর কাছে জগতের কোন্‌ মাঝখানে

     না জানি রে হতেছে মিলিত।

সেইখানে একবার বসাইবি মোরে

      সেই মহা-আঁধার নিশায়,

শুনিব রে আঁখি মুদি বিশ্বের সংগীত

      তোর মুখে কেমন শুনায়।

জোছনায় ফুলবনে একাকী বসিয়া থাকি,

       আঁখি দিয়া অশ্রুবারি ঝরে–

বল্‌ মোরে বল্‌ অয়ি মোহিনী ছলনা,

       সে কি তোরি তরে?

বিরামের গান গেয়ে সায়াহ্নের বায়

        কোথা বহে যায়–

তারি সাথে কেন মোর প্রাণ হু হু করে,

        সে কি তোরি তরে?

বাতাসে সৌরভ ভাসে, আঁধারে কত-না তারা,

        আকাশে অসীম নীরবতা–

তখন প্রাণের মাঝে কত কথা ভেসে যায়,

       সে কি তোরি কথা?

ফুলের সৌরভগুলি আকাশে খেলাতে এসে

       বাতাসেতে হয় পথহারা,

       চারিদিকে ঘুরে হয় সারা,

       মার কোলে ফিরে যেতে চায়,

       ফুলে ফুলে খুঁজিয়া বেড়ায়,

তেমনি প্রাণের মাঝে অশরীরী আশাগুলি

       ভ্রমে কেন হেথায় হোথায়–

       সেকি কি তোরে চায়?

আঁখি যেন কার তরে পথ-পানে চেয়ে আছে

         দিন গনি গনি,

মাঝে মাঝে কারো মুখে সহসা দেখে সে যেন

         অতুল রূপের প্রতিধ্বনি,

         কাছে গেলে মিলাইয়া যায়

         নিরাশের হাসিটির প্রায়–

সৌন্দর্যে মরীচিকা এ কাহার মায়া,

        এ কি তোরি ছায়া!

জগতের গানগুলি দূর-দূরান্তর হতে

       দলে দলে তোর কাছে যায়,

যেন তারা বহ্নি হেরি পতঙ্গের মতো

       পদতলে মরিবারে চায়!

জগতের মৃত গানগুলি

       তোর কাছে পেয়ে নব প্রাণ,

সংগীতের পরলোক হতে

       গান যেন দেহমুক্ত গান।

তাই তার নব কণ্ঠধ্বনি

       প্রভাতের স্বপনের প্রায়,

কুসুমের সৌরভের সাথে

       এমন সহজে মিশে যায়।

আমি ভাবিতেছি বসে        গানগুলি তোরে

       না জানি কেমনে খুঁজে পায়–

       না জানি কোথায় খুঁজে পায়।

       না জানি কী গুহার মাঝারে

       অস্ফুট মেঘের উপবনে,

       স্মৃতি ও আশায় বিজড়িত

       আলোক-ছায়ার সিংহাসনে,

ছায়াময়ী মূর্তিখানি     আপনে আপনি মিশি

       আপনি বিস্মিত আপনায়,

       কার পানে শূন্যপানে চায়!

সায়াহ্নে প্রশান্ত রবি          স্বর্ণময় মেঘমাঝে

          পশ্চিমের সমুদ্রসীমায়

প্রভাতের জন্মভূমি          শৈশব পুরব-পানে

          যেমন আকুল নেত্রে চায়

পুরবের শূন্যপটে,  প্রভাতের স্মৃতিগুলি

          এখনো দেখিতে যেন পায়,

তেমনি সে ছায়াময়ী          কোথা যেন চেয়ে আছে

         কোথা হতে আসিতেছে গান–

এলানো কুন্তলজালে         সন্ধ্যার তারকাণ্ডলি

          গান শুনে মুদিছে নয়ান।

          বিচিত্র সৌন্দর্য জগতের

          হেথা আসি হইতেছে লয়।

সংগীত, সৌরভ, শোভা      জগতে যা-কিছু আছে

          সবি হেথা প্রতিধ্বনিময় ।

          প্রতিধ্বনি, তব নিকেতন,

         তোমার সে সৌন্দর্য অতুল,

          প্রাণে জাগে ছায়ার মতন–

          ভাষা হয় আকুল ব্যাকুল।

আমরণ চিরদিন     কেবলি খুঁজিব তোরে

          কখনো কি পাব না সন্ধান?

কেবলি কি রবি দূরে,        অতি দূর হতে

         শুনিব রে ওই আধো গান?

এই বিশ্বজগতের    মাঝখানে দাঁড়াইয়া

          বাজাইবি সৌন্দর্যের বাঁশি,

অনন্ত জীবনপথে    খুঁজিয়া চলিব তোরে,

          প্রাণমন হইবে উদাসী।

তপনেরে ঘিরি ঘিরি         যেমন ঘুরিছে ধরা,

          ঘুরিব কি তোর চারি দিকে?

অনন্ত প্রাণের পথে           বরষিবি গীতধারা,

          চেয়ে আমি রব অনিমিখে।

তোরি মোহময় গান          শুনিতেছি অবিরত,

          তোরি রূপ কল্পনায় লিখা–

করিস নে প্রবঞ্চনা সত্য করে বল্‌ দেখি

          তুই তো নহিস মরীচিকা?

কত বার আর্ত স্বরে শুধায়েছি প্রাণপণে,

         অয়ি তুমি কোথায়-কোথায়–

অমনি সুদূর হতে   কেন তুমি বলিয়াছ

         “কে জানে কোথায়’?

আশাময়ী, ও কী কথা       তুমি কি আপনহারা–

          আপনি জান না আপনায়?

স্রোত (srot)

জগৎ-স্রোতে ভেসে চলো, যে যেথা আছ ভাই!

চলেছে যেথা রবি শশী চল্‌ রে সেথা যাই।

কোথায় চলে কে জানে তা, কোথায় যাবে শেষে,

জগৎ-স্রোত বহে গিয়ে কোন্‌ সাগরে মেশে।

অনাদি কাল চলে স্রোত অসীম আকাশেতে,

উঠেছে মহা কলরব অসীমে যেতে যেতে।

উঠিছে ঢেউ, পড়ে ঢেউ, গনিবে কেবা কত!

ভাসিছে শত গ্রহ তারা, ডুবিছে শত শত।

ঢেউয়ের ‘পরে খেলা করে আলোকে আঁধারেতে,

জলের কোলে লুকাচুরি জীবনে মরণেতে–।

শতেক কোটি গ্রহ তারা যে স্রোতে তৃণপ্রায়

সে স্রোত-মাঝে অবহেলে ঢালিয়া দিব কায়,

অসীম কাল ভেসে যাব অসীম আকাশেতে,

জগৎ- কলকলরব শুনিব কান  পেতে।

দেখিব ঢেউ–উঠে ঢেউ, দেখিব মিশে যায়,

জীবন-মাঝে উঠে ঢেউ মরণ-গান গায়।

দেখিব চেয়ে চারি দিকে, দেখিব তুলে মুখ–

কত-না আশা, কত হাসি, কত-না সুখ দুখ,

বিরাগ দ্বেষ ভালোবাসা, কত-না হায়-হায়–

তপন ভাসে, তারা ভাসে, তা’রাও ভেসে যায়।

কত-না যায়, কত চায়, কত-না কাঁদে হাসে–

আমি তো শুধু ভেসে যাব, দেখিব চারি পাশে।

অবোধ ওরে, কেন মিছে করিস “আমি আমি’।

উজানে যেতে পারিবি কি সাগরপথগামী?

জগৎ-পানে যাবি নে রে, আপনা-পানে যাবি–

সে যে রে মহামরুভূমি, কী জানি কী যে পাবি।

মাথায় করে আপনারে, সুখ-দুখের বোঝা,

ভাসিতে চাস প্রতিকূলে– সে তো রে নহে সোজা ।

অবশ দেহ, ক্ষীণ বল, সঘনে বহে শ্বাস,

লইয়া তোর সুখ-দুখ এখনি পাবি নাশ।

জগৎ হয়ে রব আমি, একেলা রহিব না।

মরিয়া যাব একা হলে একটি জলকণা।

আমার নাহি সুখ দুখ, পরের পানে চাই–

যাহার পানে চেয়ে দেখি তাহাই হয়ে যাই।

তপন ভাসে, তারা ভাসে, আমিও যাই ভেসে–

তাদের গানে আমার গান, যেতেছি এক দেশে।

প্রভাত সাথে গাহি গান, সাঁঝের সাথে গাই,

তারার সাথে উঠি আমি–তারার সাথে যাই।

ফুলের সাথে ফুটি আমি, লতার সাথে নাচি,

বায়ুর সাথে ঘুরি শুধু ফুলের কাছাকাছি।

মায়ের প্রাণে স্নেহ হয়ে শিশুর পানে ধাই,

দুখীর সাথে কাঁদি আমি সুখীর সাথে গাই।

সবার সাথে আছি আমি, আমার সাথে নাই,

জগৎ-স্রোতে দিবানিশি ভাসিয়া চলে যাই।

সমাপন (samaapan)

 আজ আমি কথা কহিব না।

        আর আমি গান গাহিব না।

হেরো আজি ভোরবেলা এসেছে রে মেলা লোক,

        ঘিরে আছে চারি দিকে

        চেয়ে আছে অনিমিখে,

হেরে মোর হাসিমুখ ভুলে গেছে দুখশোক।

        আজ আমি গান গাহিব না।

সকাতরে গান গেয়ে পথপানে চেয়ে চেয়ে

        এদের ডেকেছি দিবানিশি।

ভেবেছিনু মিছে আশা, বোঝে না আমার ভাষা,

        বিলাপ মিলায় দিশি দিশি।

কাছে এরা আসিত না, কোলে বসে হাসিত না,

        ধরিতে চকিতে হত লীন।

মরমে বাজিত ব্যথা–সাধিলে না কহে কথা–

        সাধিতে শিখি নি এতদিন।

দিত দেখা মাঝে মাঝে, দূরে যেন বাঁশি বাজে,

        আভাস শুনিনু যেন হায়–।

মেঘে কভু পড়ে রেখা, ফুলে কভু দেয় দেখা,

        প্রাণে কভু বহে চলে যায়।

        আজ তারা এসেছে রে কাছে

        এর চেয়ে শোভা কিবা আছে।

কেহ নাহি করে ডর, কেহ নাহি ভাবে পর,

        সবাই আমাকে ভালোবাসে

        আগ্রহে ঘিরিছে চারি পাশে।

        এসেছিস তোরা যত জনা,

        তোদের কাহিনী আজি শোনা।

যার যত কথা আছে খুলে বল্‌ মোর কাছে,

        আজ আমি কথা কহিব না ।

আয় তুই কাছে আয়, তোরে মোর প্রাণ চায়,

        তোর কাছে শুধু বসে রই।

        দেখি শুধু, কথা নাহি কই।

ললিত পরশে তোর পরানে  লাগিছে ঘোর,

        চোখে তোর বাজে বেণুবীণা–

        তুই মোরে গান শুনাবি না?

জেগেছে নূতন প্রাণ, বেজেছে নূতন গান,

        ওই দেখ পোহায়েছে রাতি।

আমারে বুকেতে নে রে, কাছে আয়,আমি যে রে

        নিখিলের খেলাবার সাথী।

চারি দিকে সৌরভ, চারি দিকে গীতরব,

        চারি দিকে সুখ আর হাসি,

চারি দিকে শিশুগুলি মুখে আধো আধো বুলি,

        চারি দিকে স্নেহপ্রেমরাশি!

আমারে ঘিরেছে কারা, সুখেতে করেছে সারা,

        জগতে হয়েছে হারা প্রাণের বাসনা।

        আর আমি কথা কহিব না–

        আর আমি গান গাহিব না।

নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ (nirjharer swapnabhanga)

আজি এ প্রভাতে   প্রভাতবিহগ

কী গান গাইল রে!

অতি দূর দূর        আকাশ হইতে

ভাসিয়া আইল রে!

না জানি কেমনে    পশিল হেথায়

পথহারা তার একটি তান,

আঁধার গুহায় ভ্রমিয়া ভ্রমিয়া

গভীর গুহায় নামিয়া নামিয়া

আকুল হইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া

ছুঁয়েছে আমার প্রাণ।

আজি এ প্রভাতে   সহসা কেন রে

পথহারা রবিকর

আলয় না পেয়ে     পড়েছে আসিয়ে

আমার প্রাণের ‘পর!

বহুদিন পরে         একটি কিরণ

গুহায় দিয়েছে দেখা,

পড়েছে আমার      আঁধার সলিলে

একটি কনকরেখা।

প্রাণের আবেগ রাখিতে নারি

থর থর করি কাঁপিছে বারি,

টলমল জল করে থল থল,

কল কল করি ধরেছে তান।

আজি এ প্রভাতে   কী জানি কেন রে

জাগিয়া উঠেছে প্রাণ।

জাগিয়া দেখিনু, চারিদিকে মোর

পাষাণে রচিত কারাগার ঘোর,

বুকের উপরে       আঁধার বসিয়া

করিছে নিজের ধ্যান।

না জানি কেন রে   এতদিন পরে

জাগিয়া উঠেছে প্রাণ।

জাগিয়া দেখিনু আমি আঁধারে রয়েছি আঁধা,

আপনারি মাঝে আমি আপনি রয়েছি বাঁধা।

রয়েছি মগন হয়ে আপনারি কলস্বরে,

ফিরে আসে প্রতিধ্বনি নিজেরি শ্রবণ-‘পরে।

দূর দূর দূর হতে ভেদিয়া আঁধার কারা

মাঝে মাঝে দেখা দেয় একটি সন্ধ্যার তারা।

তারি মুখ দেখে দেখে       আঁধার হাঁসিতে শেখে,

তারি মুখ চেয়ে চেয়ে করে নিশি অবসান।

শিহরি উঠে রে বারি,দোলে রে দোলে রে প্রাণ,

প্রাণের মাঝারে ভাসি        দোলে রে দোলে রে হাসি,

দোলে রে প্রাণের ‘পরে আশার স্বপন মম,

দোলে রে তারার ছায়া সুখের আভাস-সম।

মাঝে মাঝে একদিন আকাশেতে নাই আলো,

পড়িয়া মেঘের ছায়া কালো জল হয় কালো।

আঁধার   সলিল ‘পরে     ঝর ঝর বারি ঝরে

ঝর ঝর ঝর ঝর,দিবানিশি অবিরল–

বরষার দুখ-কথা,বরষার আঁখিজল।

শুয়ে শুয়ে আনমনে দিবানিশি তাই শুনি

একটি একটি ক’রে দিবানিশি তাই গুনি,

তারি সাথে মিলাইয়া কল কল গান গাই–

ঝর ঝর কল কল–দিন নাই, রাত নাই।

এমনি নিজেরে লয়ে রয়েছি নিজের কাছে,

আঁধার সলিল ‘পরে আঁধার জাগিয়া আছে।

এমনি নিজের কাছে খুলেছি নিজের প্রাণ,

এমনি পরের কাছে শুনেছি নিজের গান।

আজি এ প্রভাতে রবির কর

কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর,

কেমনে পশিল গুহার আঁধারে

প্রভাত-পাখির গান।

না জানি কেন রে         এতদিন পরে

জাগিয়া উঠিল প্রাণ।

জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,

ওরে        উথলি উঠেছে বারি,

ওরে       প্রাণের বাসনা  প্রাণের আবেগ

রুধিয়া রাখিতে নারি।

থর থর করি কাঁপিছে ভূধর,

শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,

ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল

গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।

হেথায় হোথায় পাগলের প্রায়

ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়,

বাহিরিতে চায়,         দেখিতে না পায়

   কোথায় কারার দ্বার।

প্রভাতেরে যেন লইতে কাড়িয়া

আকাশেরে যেন ফেলিতে ছিঁড়িয়া

উঠে শূন্যপানে–পড়ে আছাড়িয়া

করে শেষে হাহাকার।

প্রাণের উল্লাসে ছুটিতে চায়

ভূধরের হিয়া টুটিতে চায়,

আলিঙ্গন তরে ঊর্ধ্বে বাহু তুলি

আকাশের পানে উঠিতে চায়।

প্রভাতকিরণে পাগল হইয়া

জগৎ-মাঝারে লুটিতে চায়।

কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন,

চারিদিকে তার বাঁধন কেন?

ভাঙ্‌ রে হৃদয় ভাঙ্‌ রে বাঁধন,

সাধ্‌ রে আজিকে প্রাণের সাধন,

লহরীর পরে লহরী তুলিয়া

আঘাতের পর আঘাত কর্‌।

মাতিয়া যখন উঠিছে পরান,

কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ!

উথলি যখন উঠিছে বাসনা,

জগতে তখন কিসের ডর!

সহসা আজি এ জগতের মুখ

নূতন করিয়া দেখিনু কেন?

একটি পাখির আধখানি তান

জগতের গান গাহিল যেন!

জগৎ দেখিতে হইব বাহির,

আজিকে করেছি মনে,

দেখিব না আর নিজেরি স্বপন

বসিয়া গুহার কোণে।

আমি       ঢালিব করুণাধারা,

আমি       ভাঙিব পাষাণকারা,

আমি       জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া

আকুল পাগল-পারা;

কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,

রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,

রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া,

দিব রে পরান ঢালি।

শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,

ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব

হেসে খলখল গেয়ে কলকল

তালে  তালে দিব তালি।

তটিনী হইয়া যাইব বহিয়া–

যাইব বহিয়া–যাইব বহিয়া–

হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া

গাহিয়া গাহিয়া গান,

যত দেব প্রাণ       বহে যাবে প্রাণ

ফুরাবে না আর প্রাণ।

এত কথা আছে     এত গান আছে

এত প্রাণ আছে মোর,

এত সুখ আছে      এত সাধ আছে

প্রাণ হয়ে আছে ভোর।

এত সুখ কোথা     এত রূপ কোথা

এত খেলা কোথা আছে!

যৌবনের বেগে      বহিয়া যাইব

কে জানে কাহার কাছে!

অগাধ বাসনা        অসীম আশা

জগৎ দেখিতে চাই!

জাগিয়াছে সাধ      চরাচরময়

প্লাবিয়া বহিয়া যাই।

যত প্রাণ আছে ঢালিতে পারি,

যত কাল আছে বহিতে পারি,

যত দেশ আছে ডুবাতে পারি,

তবে আর কিবা চাই!    

পরানের সাধ তাই।

কী জানি কী হল আজি জাগিয়া উঠিল প্রাণ,

দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান–

“পাষাণ-বাঁধন টুটি, ভিজায়ে কঠিন ধরা,

বনেরে শ্যামল করি, ফুলেরে ফুটায়ে ত্বরা

সারাপ্রাণ ঢালি দিয়া,

জুড়ায়ে জগৎ-হিয়া–

আমার প্রাণের মাঝে কে আসিবি আয় তোরা!’

আমি যাব, আমি যাব, কোথায় সে, কোন্‌ দেশ–

জগতে ঢালিব প্রাণ,

গাহিব করুণাগান,

উদ্‌বেগ-অধীর হিয়া

সুদূর সমুদ্রে গিয়া

সে প্রাণ মিশাব আর সে গান করিব শেষ।

ওরে, চারিদিকে মোর

এ কী কারাগার ঘোর!

ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ কারা, আঘাতে আঘাত কর্‌!

  ওরে,আজ কী গান গেয়েছে পাখি,

এয়েছে রবির কর!

অনন্ত মরণ (ananta maran)

কোটি কোটি  ছোটো ছোটো মরণেরে লয়ে

        বসুন্ধরা ছুটিছে আকাশে,

        হাসে খেলে মৃত্যু চারিপাশে।

        এ ধরণী মরণের পথ,

        এ জগৎ মৃত্যুর জগৎ।

যতটুকু বর্তমান, তারেই কি বল’ প্রাণ?

         সে তো শুধু, পলক, নিমেষ।

অতীতের মৃত ভার পৃষ্ঠেতে রয়েছে তার,

        না জানি কোথায় তার শেষ।

যত বর্ষ বেঁচে আছি তত বর্ষ মরে গেছি,

        মরিতেছি প্রতি পলে পলে,

জীবন্ত মরণ মোরা মরণের ঘরে থাকি

        জানি নে মরণ কারে বলে।

একমুঠা মরণেরে জীবন বলে কি তবে,

        মরণের সমষ্টি কেবল?

একটি নিমেষ তুচ্ছ শত মরণের গুচ্ছ,

       নাম নিয়ে এত কোলাহল।

মরণ বাড়িবে যত জীবন বাড়িবে তত,

      পলে পলে উঠিব আকাশে

      নক্ষত্রের কিরণনিবাসে।

মরণ বাড়িবে যত   কোথায় কোথায় যাব,

       বাড়িবে প্রাণের অধিকার–

বিশাল প্রাণের মাঝে  কত গ্রহ কত তারা

       হেথা হোথা করিবে বিহার ।

উঠিবে জীবন মোর কত-না আকাশ ছেয়ে,

        ঢাকিয়া ফেলিবে রবি শশী–

যুগ-যুগান্তর যাবে, নব নব রাজ্য পাবে

        নব নব তারায় প্রবেশি।

কবে রে আসিবে সেই দিন

উঠিব সে আকাশের পথে,

আমার মরণ-ডোর দিয়ে

বেঁধে দেব জগতে জগতে।

আমাদের মরণের জালে

জগৎ ফেলিব আবরিয়া,

এ অনন্ত  আকাশসাগরে

দশ দিক রহিব ঘেরিয়া।

জয় হোক জয় হোক মরণের জয় হোক–

          আমাদের অনন্ত মরণ,

          মরণের হবে না মরণ।

এ ধরায় মোরা সবে শতাব্দীর ক্ষুদ্র শিশু

           লইলাম তোমার শরণ,

এসো তুমি এসো কাছে, স্নেহ-কোলে লও তুমি,

          পিয়াও তোমার মাতৃস্তন,

          আমাদের করো হে পালন।

আনন্দে পুরেছে প্রাণ, হেরিতেছি এ জগতে

          মরণের অনন্ত উৎসব।

কার নিমন্ত্রণে মোরা মহাযজ্ঞে এসেছি রে,

          উঠেছে বিপুল কলরব।

যে ডাকিছে ভালোবেসে, তারে চিনিস নে শিশু?

          তার কাছে কেন তোর ডর?

জীবন যাহারে বলে মরণ তাহারি নাম,

       মরণ তো নহে তোর পর।

       আয়, তারে অলিঙ্গন কর্‌–

       আয় তার হাতখানি ধর্‌।

মহাস্বপ্ন (mahaaswapna)

পূর্ণ করি মহাকাল পূর্ণ করি অনন্ত গগন,

নিদ্রামগ্ন মহাদেব দেখিছেন মহান্‌ স্বপন্‌।

          বিশাল জগৎ এই

          প্রকাণ্ড স্বপন সেই,

হৃদয়সমুদ্রে তাঁর উঠিতেছে বিম্বের মতন।

উঠিতেছে চন্দ্র সূর্য, উঠিতেছে আলোক আঁধার,

উঠিতেছে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের জ্যোতি-পরিবার।

উঠিতেছে, ছুটিতেছে গ্রহ উপগ্রহ দলে দলে,

উঠিতেছে ডুবিতেছে রাত্রি দিন, আকাশের তলে ।

একা বসি মহাসিন্ধু চিরদিন গাইতেছে গান,

ছুটিয়া সহস্র নদী পদতলে মিলাইছে প্রাণ।

তটিনীর কলরব, লক্ষ নির্ঝরের ঝর ঝর,

সিন্ধুর গম্ভীর গীত, মেঘের গম্ভীর কণ্ঠস্বর,

ঝটিকা করিছে হা হা আশ্রয়-আলয় তার ছাড়ি

বাজায়ে অরণ্যবীণা ভীমবল শত বাহু নাড়ি,

রুদ্র রাগ আলাপিয়া গড়ায়ে পড়িছে হিমরাশ

পর্বতদৈত্যের যেন ঘনীভূত ঘোর অট্টহাস,

ধীরে ধীরে মহারণ্য নাড়িতেছে জটাময় মাথা–

ঝর ঝর মর মর উঠিতেছে সুগম্ভীর গাথা।

চেতনার কোলাহলে দিবস পুরিছে দশ দিশি,

ঝিল্লিরবে একমন্ত্র জপিতেছে তাপসিনী নিশি,

সমস্ত একত্রে মিলি ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া চারি ভিত

উঠাইছে মহা-হৃদে মহা এক স্বপনসংগীত।

স্বপনের রাজ্য এই স্বপন-রাজ্যের জীবগণ

দেহ ধরিতেছে কত মুহুর্মুহু নূতন নূতন।

ফুল হয়ে যায় ফল, ফুল ফল বীজ হয় শেষে,

নব নব বৃক্ষ হয়ে বেঁচে থাকে কানন-প্রদেশে।

বাষ্প হয়, মেঘ হয়, বিন্দু বিন্দু বৃষ্টিবারিধারা

নির্ঝর তটিনী হয়, ভাঙি ফেলে শিলাময় কারা।

নিদাঘ মরিয়া যায়, বরষা শ্মশানে আসি তার

নিবায় জলন্ত চিতা বরষিয়া অশ্রুবারিধার।

বরষা হইয়া বৃদ্ধ শ্বেতকেশ শীত হয়ে যায়,

যযাতির মতো পুন বসন্তযৌবন ফিরে পায়।

এক শুধু পুরাতন, আর সব নূতন নূতন

এক পুরাতন হৃদে উঠতেছে নূতন স্বপন।

অপূর্ণ স্বপনসৃষ্ট মানুষেরা অভাবের দাস,

জাগ্রত পূর্ণতা-তরে পাইতেছে কত না প্রয়াস।

চেতনা ছিঁড়িতে চাহে আধো-অচেতন আবরণ–

দিনরাত্রি এই আশা, এই তার একমাত্র পণ।

পূর্ণ আত্মা জাগিবেন, কভু কি আসিবে হেন দিন?

অপূর্ণ জগৎ-স্বপ্ন ধীরে ধীরে হইবে বিলীন?

চন্দ্র-সূর্য-তারকার অন্ধকার স্বপ্নময়ী ছায়া

জ্যোতির্ময় সে হৃদয়ে ধীরে ধীরে মিলাইবে কায়া।

পৃথিবী ভাঙিয়া যাবে, একে একে গ্রহতারাগণ

ভেঙে ভেঙে মিলে যাবে একেকটি বিস্বের মতন।

চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ চেয়ে জ্যোতির্ময় মহান্‌ বৃহৎ

জীব-আত্মা মিলাইবে একেকটি জলবিম্ববৎ।

কভু কি আসিবে, দেব, সেই মহাস্বপ্ন-ভাঙা দিন

সত্যের সমুদ্র-মাঝে আধো সত্য হয়ে যাবে লীন?

আধেক প্রলয়জলে ডুবে আছে তোমার হৃদয়–

বলো, দেব, কবে হেন প্রলয়ের হইবে প্রলয়।

চেয়ে থাকা (cheye thaakaa)

মনেতে সাধ  যে দিকে চাই

      কেবলি চেয়ে রব।

দেখিব শুধু, দেখিব শুধু,

       কথাটি নাহি কব।

পরানে শুধু জাগিবে প্রেম,

       নয়নে লাগে ঘোর,

জগতে যেন ডুবিয়া রব

       হইয়া রব ভোর।

তটিনী যায়, বহিয়া যায়,

       কে জানে কোথা যায়;

তীরেতে বসে রহিব চেয়ে,

       সারাটি দিন যায়।

সুদূর জলে ডুবিছে রবি

       সোনার লেখা লিখি,

সাঁঝের আলো জলেতে শুয়ে

        করিছে ঝিকিমিকি।

সুধীর স্রোতে তরণীগুলি

        যেতেছে সারি সারি,

বহিয়া যায়, ভাসিয়া যায়

        কত-না নরনারী।

না জানি তারা কোথায় থাকে

       যেতেছে কোন্‌ দেশে,

সুদূর তীরে কোথায় গিয়ে

        থামিবে অবশেষে।

কত কী আশা গড়িছে বসে

        তাদের মনখানি,

কত কী সুখ কত কী দুখ

        কিছুই নাহি জানি।

দেখিব পাখি আকাশে ওড়ে,

        সুদূরে উড়ে যায়,

মিশায়ে যায় কিরণমাঝে,

        আঁধাররেখাপ্রায়!

তাহারি সাথে সারাটি দিন

        উড়িবে মোর প্রাণ,

নীরবে বসি তাহারি সাথে

        গাহিব তারি গান।

তাহারি মতো মেঘের মাঝে

        বাঁধিতে চাহি বাসা,

তাহারি মতো চাঁদের কোলে

        গড়িতে চাহি আশা!

তাহারি মতো আকাশে উঠে,

        ধরার পানে চেয়ে,

ধরায় যারে এসেছি ফেলে

        ডাকিব গান গেয়ে।

তাহারি মতো, তাহারি সাথে

        উষার দ্বারে গিয়ে,

ঘুমের ঘোর ভাঙায়ে দিব

        উষারে জাগাইয়ে।

পথের ধারে বসিয়া রব

        বিজন তরুছায়,

সমুখ দিয়ে পথিক যত

        কত-না আসে যায়

ধুলায় বসে আপন-মনে

        ছেলেরা খেলা করে,

মুখেতে হাসি সখারা মিলে

        যেতেছে ফিরে ঘরে।

পথের ধারে ঘরের দ্বারে

        বালিকা এক মেয়ে,

ছোটো ভায়েরে পাড়ায় ঘুম

        কত কী গান গেয়ে।

তাহার পানে চাহিয়া থাকি

        দিবস যায় চলে

স্নেহেতে ভরা করুণ আঁখি–

        হৃদয় যায় গলে ,

এতটুকু সে পরানটিতে

        এতটা সুধারাশি!

কাছেতে তাই দাঁড়ায়ে তারে

        দেখিতে ভালোবাসি।

কোথা বা শিশু কাঁদিছে, পথে

        মায়েরে ডাকি ডাকি

আকুল হয়ে পথিক-মুখে

        চাইছে থাকি থাকি।

কাতর স্বর শুনিতে পেয়ে

        জননী ছুটে আসে

মায়ের বুক জড়ায়ে শিশু

        কাঁদিতে গিয়ে হাসে।

অবাক হয়ে তাহাই দেখি

        নিমেষ ভুলে গিয়ে,

দুইটি ফোঁটা বাহিরে জল

        দুইটি আঁখি দিয়ে।

যায় রে সাধ জগৎ-পানে

        কেবলি চেয়ে রই

অবাক হয়ে, আপনা ভুলে,

        কথাটি নাহি কই।

স্নেহ উপহার (sneha upahaar)

শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু।

বাব্‌লা।

আয় রে বাছা কোলে বসে চা’ মোর মুখ-পানে,

হাসিখুশি প্রাণখানি তোর প্রভাত ডেকে আনে।

আমায় দেখে আসিস ছুটে, আমায় বাসিস ভালো,

কোথা হতে পড়লি প্রাণে তুই রে উষার আলো!

দেখ্‌ রে প্রাণে স্নেহের মতো সাদা সাদা জুঁই ফুটেছে।

দেখ্‌ রে, আমার গানের সাথে ফুলের গন্ধ জড়িয়ে গেছে।

গেথেছি রে গানের মালা, ভোরের বেলা বনে এসে

মনে বড়ো সাধ হয়েছে পরাব তোর এলোকেশে!

গানের সাথে ফুলের সাথে মুখখানি মানাবে ভালো,

আয় রে তবে আয় রে মেয়ে দেখ্‌ রে চেয়ে রাত পোহালো!

কচিমুখটি ঘিরে দেব ললিতরাগিণী দিয়ে,

বাপের কাছে মায়ের কাছে দেখিয়া আসবি ছুটে গিয়ে!

চাঁদনি রাতে বেড়াই ছাতে মুখখানি তোর মনে পড়ে,

তোর কথাটাই কিলিবিলি মনের মধ্যে নড়েচড়ে!

হাসি হাসি মুখখানি তোর ভেসে ভেসে বেড়ায় কাছে,

হাসি যেন এগিয়ে এল, মুখটি যেন পিছিয়ে আছে!

কচি প্রাণের আনন্দ তোর ভাঙা বুকে দে ছড়িয়ে,

ছোটো দুটি হাত দিয়ে তোর গলাটি মোর ধর জড়িয়ে!

বিজন প্রাণের দ্বারে বসে করবি রে তুই ছেলেখেলা,

চুপ করে তাই বসে বসে দেখব আমি সন্ধেবেলা।

কোথায় আছিস, সাড়া দে রে, বুকের কাছে আয় রে তবে,

তোর মুখেতে গানগুলি মোর কেমন শোনায় শুনতে হবে!

আমি যেন দাঁড়িয়ে আছি একটা বাবলা গাছের মতো

বড়ো বড়ো কাঁটার ভয়ে তফাত থাকে লতা যত।

সকাল হলে মনের সুখে ডালে ডালে ডাকে পাখি,

আমার  কাঁটা-ডালে কেউ ডাকে না চুপ করে তাই দাঁড়িয়ে থাকি!

নেই বা লতা এল কাছে, নেই বা পাখি বসল শাখে,

যদি আমার বুকের কাছে বাবলা ফুলটি ফুটে থাকে!

বাতাসেতে দুলে দুলে ছড়িয়ে দেয় রে মিষ্টি হাসি,

কাঁটা-জন্ম ভুলে গিয়ে তাই দেখে হরষে ভাসি!

দূর কর ছাই, ঝোঁকের মাথায় বলে ফেললেম কত কী যে?

কথাগুলো ঠেকছে যেন চোখের জলে ভিজে ভিজে!

           রবি কাকা।

Exit mobile version