Raater Alo

Mandakinir Prem Kahini Golpo Lila Majumdar l Mandakini’s Love Story – Leela Majumder 2024 l প্রেমের গল্প

Mandakinir Prem Kahini

Mandakinir Prem Kahini: সাহিত্যের জগতে লীলা মজুমদার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর সর্বশেষ রচনা, “মন্দাকিনীর প্রেমকাহিনী,” পাঠকদের নিয়ে যায় আবেগ, উন্মাদনা এবং প্রেমের সূক্ষ্ম নৃত্যের এক গভীর যাত্রায়। ২০২৪ সালে প্রকাশিত এই কাহিনীটি বাংলা সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সাথে চিরন্তন প্রেমের মুগ্ধতা একসূত্রে গেঁথে পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নেয়।

লীলা মজুমদার, তাঁর অনুভূতিপূর্ণ কাহিনী ও চিত্তাকর্ষক চরিত্রগুলির জন্য সুপরিচিত, আবারও মানবিক আবেগের মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরে পাঠকদের মুগ্ধ করেছেন। “মন্দাকিনীর প্রেমকাহিনী” শুধুমাত্র একটি প্রেমের গল্প নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ভ্রমণও বটে, যা প্রতিটি পাঠকের মনে গভীর রেখাপাত করবে।

Mandakinir Prem Kahini Golpo Lila Majumdar l Mandakini’s Love Story – Leela Majumder 2024 l প্রেমের গল্প মন্দাকিনীর প্রেমকাহিনী – লীলা মজুমদার

প্রেমের এমন একটা অবাধ্য ভাব আছে, তার জন্য বিষম আয়োজন করে প্রতীক্ষা করলে তার দর্শন মেলা দায়, কিন্তু যখন তার আগমন কেবলমাত্র অপ্রত্যাশিত নয়, অসুবিধাজনকও বটে, তখন সে ত্রিভুবন জুড়ে বসে।

মন্দাকিনীও এই ধরনের একটা ঘটনায় জড়িত হয়েছিল। যতদিন পুষ্পিত লতার মতন তার জীবনে প্রথম যৌবনের সুরভি লেগে ছিল, এবং মর্মরিত বেণুকুঞ্জে কোকিল-কণ্ঠের মতন তার মনের কোণে কোণে অনাগত বনমালীর বাঁশরী বেজেছিল ততদিন ধরে সে কল্পনানেত্রে তার প্রিয়তমের অতি প্রত্যক্ষ মূর্তি দেখতে পেতা

বেশ দীর্ঘ গৌরবর্ণ দেহখানি, ভ্রমরকৃষ্ণ কোঁকড়া চুল, হরধনুকে হার মানিয়ে দেয় জ্ব-যুগল, অধরোষ্ঠে কোমল কঠিন অপূর্ব সমাবেশ কিবা বঙ্কিম গ্রীবা, বাঁশির মতন নাসিকার ডান পাশে নীচের দিকে ভুবনভুলোনো ছোট একটি কালো কুচকুচে তিল, দাড়ি-গোঁফ কামানো। কণ্ঠস্বরে কখনও বজ্রনির্ঘোষ শোনা যায়, কখনও বা কলনাদিনী স্রোতস্বিনীর কথা মনে পড়ে। পরিধানে কখনও বা সাদা ধুতি চাদর, কখনও বা সুবিন্যস্ত গ্রে-রঙের পাশ্চাত্য বেশ শোভা পায়।

এই আশ্চর্য ব্যক্তি মানসলোকে হয় জ্যোৎস্নানিশীথে বিজন বেণুকুঞ্জে কিম্বা বর্ষা-সন্ধ্যায় বসবার ঘরের স্তিমিত দীপালোকে মন্দাকিনীর কানে কানে কত যে রোমাঞ্চকর মধু বর্ষণ করত তার লেখাজোখা নেই।

প্রেমের এমন একটা অবাধ্য ভাব আছে, তার জন্য বিষম আয়োজন করে প্রতীক্ষা করলে তার দর্শন মেলা দায়, কিন্তু যখন তার আগমন কেবলমাত্র অপ্রত্যাশিত নয়, অসুবিধাজনকও বটে, তখন সে ত্রিভুবন জুড়ে বসে।

মন্দাকিনীও এই ধরনের একটা ঘটনায় জড়িত হয়েছিল। যতদিন পুষ্পিত লতার মতন তার জীবনে প্রথম যৌবনের সুরভি লেগে ছিল, এবং মর্মরিত বেণুকুঞ্জে কোকিল-কণ্ঠের মতন তার মনের কোণে কোণে অনাগত বনমালীর বাঁশরী বেজেছিল ততদিন ধরে সে কল্পনানেত্রে তার প্রিয়তমের অতি প্রত্যক্ষ মূর্তি দেখতে পেতা

বেশ দীর্ঘ গৌরবর্ণ দেহখানি, ভ্রমরকৃষ্ণ কোঁকড়া চুল, হরধনুকে হার মানিয়ে দেয় জ্ব-যুগল, অধরোষ্ঠে কোমল কঠিন অপূর্ব সমাবেশ কিবা বঙ্কিম গ্রীবা, বাঁশির মতন নাসিকার ডান পাশে নীচের দিকে ভুবনভুলোনো ছোট একটি কালো কুচকুচে তিল, দাড়ি-গোঁফ কামানো। কণ্ঠস্বরে কখনও বজ্রনির্ঘোষ শোনা যায়, কখনও বা কলনাদিনী স্রোতস্বিনীর কথা মনে পড়ে। পরিধানে কখনও বা সাদা ধুতি চাদর, কখনও বা সুবিন্যস্ত গ্রে-রঙের পাশ্চাত্য বেশ শোভা পায়।

এই আশ্চর্য ব্যক্তি মানসলোকে হয় জ্যোৎস্নানিশীথে বিজন বেণুকুঞ্জে কিম্বা বর্ষা-সন্ধ্যায় বসবার ঘরের স্তিমিত দীপালোকে মন্দাকিনীর কানে কানে কত যে রোমাঞ্চকর মধু বর্ষণ করত তার লেখাজোখা নেই।

মন্দাকিনীর প্রেমকাহিনী – লীলা মজুমদার l মন্দাকিনীর প্রেমকাহিনী

অবশেষে একদিন মন্দাকিনীর ঈষৎ কম্পমান বাঁ হাতখানা ধীরে ধীরে নিজের করকমলে তুলে নিয়ে, নীল মখমলের ছোট বাক্স খুলে নক্ষত্রোজ্জ্বল এক হীরের আংটি পরিয়ে দিল এবং মন্দাকিনীর রক্তিম অধরে…এর বেশি কল্পনা করবার ক্ষমতা মন্দাকিনীর ছিল না। তাছাড়া এতেই তার এমন শিহরণ লেগে যেত যে, সেরাত্রে চোখে ঘুম আর আসত না। বলা বাহুল্য, এই সকল রোমাঞ্চকর ঘটনাবলীর মধ্যে মন্দাকিনীর পরনে থাকত সুযোগ্য নীল শাড়ি, সোনালী তার আঁচল।

দুঃখের বিষয় এমন সুপ্রকাশ যার রূপ, সে ব্যক্তি চিরকাল মন্দাকিনীর আগ্রহাধীর নয়নযুগলকে ফাঁকি দিয়ে যেতে লাগল। কত যে বর্ষা-সন্ধ্যা, কত যে জ্যোৎস্নাময় নিশীথ বিফল হয়ে যেতে লাগল তার কোন হিসাব নেই। শেষ পর্যন্ত মন্দাকিনী তার দুর্লভ আদর্শটিকে ধরা ছোঁয়ার গোচর করবার দুরাশায় তাকে অনেকটা খর্ব করেও এনেছিল।

তার অমন সুঠাম দেহের দৈর্ঘ্য থেকে দু-চার ইঞ্চি হেঁটে দিয়ে, তার ওই উজ্জ্বল গৌর কান্তিতে একটুখানি শ্যামলের ছোপ ধরিয়ে, তার দাড়িকে শেষ পর্যন্ত না-মঞ্জুর করে, (কারণ কে না জানে যে ভক্তির রাজ্যে যাই হোক, প্রেমের রাজ্যে দাড়ি অচল) তার গোঁফ সম্বন্ধে একটু উদার হয়ে, তাকে প্রায় সাধারণত্বের কোটায় এনে ফেলেছিল।

তবু তার দিশা পাওয়া যায় নি। একটি সুকোমল নারীহৃদয়ে তার জন্য এত সম্ভার রক্ষিত আছে, তবু যদি সে নরাধম অনুপস্থিত থাকে তবে সে কোন রকম সহানুভূতিরও অযোগ্য একথা। জেনে অবশেষে একদা নির্দয়ভাবে স্বহস্তে তাকে প্রিয়তমের সিংহাসন থেকে বিদায় দিল। এমন কি মনে-মনে তাকে আহাম্মক আখ্যা দিতেও কুণ্ঠাবোধ করলে না। তবু মাঝে মাঝে নির্জন নিশীথে তার মনে সংশয়ের দোলা লাগত, আর ওই শূন্য সিংহাসনখানা অন্ধকারে হাহাকার করত।

সময় কিন্তু লঘুপদে চলে যেতে লাগল আর মন্দাকিনীর যৌবন থেকে একটু একটু করে মধু চুরি করে নিতে লাগল। মন্দাকিনী এতদিন অলস ছিল না, ধীরে ধীরে অনেক বিদ্যাকে অনেক ললিতকলাকে আয়ত্ত করে ফেলেছিল।

তার কাঁচা-রূপের সাজ আভরণে আস্তে আস্তে অভিজ্ঞ সুরুচির পরিচয় পাওয়া গেল। সে রূপসীও নয়, কুরূপাও নয়। দুইয়ের মাঝামাঝি এমনটি, যার মাধুর্য দেখামাত্র চোখে পড়ে না, কিন্তু মন দিয়ে খুঁজলে সুপ্রকাশ হয়ে পড়ে।

যত দিন যেতে লাগল তার কথায়, ভঙ্গিতে, সজ্জায়, এমন কি কবরী রচনাতেও একটা তীব্রতা প্রকাশ পেল, যার মাধুর্য মধুরের চেয়ে তিক্ত বেশি রৌদ্রবর্ণ বহুমূল্য সুরা যেমন বেশিদিন রেখে দিলে তিতিয়ে যায়। আর নিয়ত তার কানে বাজতে লাগল কালের রথের চাকার ধ্বনি।

জীবনটাকে যখন শূন্য বোধ হবার আশঙ্কা হল, মন্দাকিনীরও সুবুদ্ধি হল। হৃদয়ের সমস্ত অপ্রার্থিত প্রেমরাশি একজন অনাগত মানুষের চরণ থেকে অপসারিত করে সে সহজে আয়ত্ত বস্তুর উপর ন্যস্ত করল। বস্তুর পোষমানা ভাবটা তাকে নিগূঢ়ভাবে আকর্ষণ করতে লাগল। যে সকল বস্তুকে কামনা করলে, এবং যে-ভাবে কামনা করলে অন্তঃকরণ স্কুল ও বৈষয়িক হয়ে যায়, তারা সেভাবে মন্দাকিনীকে লুব্ধ করল না। সে ভালবাসল প্রাচীন ও আধুনিক চিত্র, পুঁথি, বাসন, সূচিকর্ম, নকশা-দেওয়া হাতে-বোনা পর্দা, মিনে-করা চৌকি—এমন আরও কত কী!

Mandakinir Prem Kahini l Mandakini’s Love Story – Leela Majumder

সৌন্দর্যের এমন একটা মোহিনী শক্তি আছে যে, যে তাকে অর্থ দিয়ে কেনে তাকেও সে নক্ষত্রলোকে নিয়ে যায়। যা কিছু সুন্দর, সৌন্দর্যই তার সার্থকতা। তার আর কোনও গুণের প্রয়োজন নেই। সে নয়নানন্দ। তার কাছে আর কিছু প্রত্যাশা করলে তার প্রাণময় পরিপূর্ণ রূপরাশি অর্থহীন বিলাসে পরিণত হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে।

যে কেউ সৌন্দর্য উপভোগ করতে জানে না। কিন্তু মন্দাকিনী জানত। তাই তার বারবার হতাশ হয়ে যাওয়া হৃদয় মরুভূমি না হয়ে গিয়ে নিত্য নূতন রসের উৎসের সন্ধান পেল।

সৌন্দর্যের উপাসকের যে অনাবিল অবসর ও অজস্র অর্থের প্রয়োজন, যে দুষ্ট-শনি মন্দাকিনীর পিছু নিয়েছিল, সে একদিন সে সকল হরণ করে নিল। মন্দাকিনী সৌন্দর্যের উপাসনা তখনকার মতন বন্ধ করে দিয়ে, সৌন্দর্যের সামগ্রীগুলোকে এবাড়ি-ওবাড়ি বাক্সবন্দী করে কেমন করে যেন এক মাস্টারী যোগাড় করে দার্জিলিং চলে গেল।

দার্জিলিংয়ে গুছিয়ে বসলে পর চারিদিকে চেয়ে মন্দাকিনী দেখল হিমালয়ের কোলে কোলে রডোডেনড্রন গাছের সারি, কিন্তু তার একটিরও উদ্ধত শাখার রাঙা পুষ্পস্তবকের নাগাল পাওয়া যায় না। পাহাড়ের কানা ধরে ধরে একটির পর একটি ঝাউ গাছের শ্রেণী, কিন্তু তাদের দীর্ঘ শীর্ণ ছায়াগুলি অগম্য রাজ্যে নিচের উপত্যকায় সাদা মেঘ জমেছে, সেখানে পৌঁছনো অসম্ভব।

এক দিক রোদে স্নান করছে, সেদিকে চাইলে মন গলে জল হয়ে যায় অন্য দিক কুয়াশাচ্ছন্ন, সেদিকে চাইলে মন জমে বরফ হয়ে যায়। কিন্তু এ সৌন্দর্য নৈর্ব্যক্তিক, একে মন্দাকিনীর সেই জয়পুরী চৌকির মতন কোলের কাছে টেনে নেওয়া যায় না। বরং একে বেশিক্ষণ দেখলে মনে একটা নিষ্কাম বৌদ্ধভাব জন্মায়।

ঠিক এই সময়, যখন জগৎটা মন্দাকিনীর কাছে অকিঞ্চিৎকর হয়ে আসছিল তখন সে এক ম্লান গোধূলির আলোতে ডাক্তার চ্যাটার্জির খুদে বাড়িখানা আবিষ্কার করল।

পাহাড়ের গায়ে একটুখানি অপরিসর জমির উপর, সত্যি কথা বলতে কি, খানিকটা শূন্যমার্গে, লোহা ও ইটকাঠের উপর ধৃত হয়ে অতি বিপজ্জনক ভাবে, কায়ক্লেশে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে প্রবল সাক্ষ্য দিয়ে কোনও গতিকে বাড়িটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্দাকিনীর হৃদয়ে তার মায়াজাল বিস্তার করল।

এক মুহূর্তে তার চোখে পৃথিবীর রঙ বদলে গেল। তার যে মন দূর বনান্তরালে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পদাঙ্গুলির অগ্রভাগে নির্ভর করে দুই পক্ষ বিস্তার করে বিহঙ্গের মতন উড়ে যাচ্ছিল, সে আবার। পাখা বন্ধ করে কুলায়ে ফিরে এল।

চর্মচক্ষে মন্দাকিনী দেখল বহুবর্ষের বৃষ্টিধারায় রঙ-ওঠা, কাঁচেমোড়া, বিবর্ণ সবুজ পর্দা ঘেরা ছোট দোতলা বাড়ি ভাঙা কাঁচের অন্তরালে দৃশ্যমান ধূলিমলিন মনোমোহিনী কাঠের সিঁড়ি। পশ্চিমদিকের ঝাউগাছ তাদের আলম্বিত ছায়াগুলিকে দেওয়ালের উপর ফেলেছে। সামনের শানবাঁধানো জমির ধারে ধারে ক্রিস্যান্থিমাম গাছ, জেরেনিয়াম গাছ, আর তাদের পদপ্রান্তে প্রিমরোজ ও ভায়োলেটা কোথাও একটি ফুল ফোটেনি এবং কখনও ফুটবে কিনা সন্দেহ। জনমানুষের সাড়া নেই।

এই শূন্য বাড়িখানা মন্দাকিনীর হৃদয়কে এক নিমেষে গ্রাস করল। সে তার মাস্টারনীসুলভ গাম্ভীর্য ভুলে গিয়ে গেট খুলে অনধিকার প্রবেশ করল এবং অমার্জনীয় ভাবে পায়ের আঙুলের। উপর দাঁড়িয়ে হেঁড়া পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতর দেখল গদি-মোড়া প্রাচীন ও সুশ্রী আসবাবে ধুলো জমেছে।

তারপর ওই বাড়ি তাকে যাদু করল। অনেকদিন পর সে তার মিনে-করা বাসন ইত্যাদির দুঃখ ভুলে গেল। সমস্ত দিনের কর্মব্যস্ততা অসহ্য মনে হত বিকেলবেলা ওই রঙ-ধোওয়া বাড়ির কাছে সে নিজেকে খুঁজে পেত।

দিনের পর সপ্তাহ ও সপ্তাহের পর মাস এই ভাবে গড়িয়ে গেল। মন্দাকিনী মনে মনে বাড়িখানাকে মেজে-ঘষে ফেলল, পুরনো সবুজ পর্দাগুলি ধোপার বাড়ি পাঠিয়ে নতুন ঘোর গোলাপী রঙের পর্দা লাগাল। প্রাচীন আসবাবের ধুলো মুছল, বাগানটির সংস্কার করে অনেক যত্নে সেখানে ফুল ফোঁটালা এমন কি কালো চীনেমাটির চ্যাপটা ফুলদানিতে ফুল সাজাল।

হঠাৎ একদিন মন্দাকিনী মনে মনে একটা বেহিসাবী কাজ করে ফেলল। মনগড়া অপরূপ এক দাঁড়-করানো বিজলী বাতি কিনে ফেলল, কোথায় তাকে মানাবে ভেবে মনে বড় অশান্তি অনুভব করল। মনস্থির করবার জন্য বিকেলবেলা সেখানে গিয়ে গেট খুলে ঢুকেই পটের পুতুলের মতো থমকে দাঁড়ালা

আধ-ময়লা ছাইরঙের পেন্টালুন, গলা-খোলা নীল রঙের শার্ট আর কালো পশমের গেঞ্জি গায়ে একজন লোক ঝাঁঝরি হাতে মরা ফুলগাছে জল দিচ্ছে। তার মুখের ডানপাশে প্রাচীন পাইপ এবং দেখামাত্র বোঝা যায় যে তিনদিন ক্ষৌরকর্ম হয়নি। রান্নাঘরের খোলা জানলা দিয়ে অশুদ্ধ তেলের গন্ধ ভেসে আসছে।

Mandakini’s Love Story – Leela Majumder l প্রেমের গল্প

সেই ব্যক্তি মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে, হাত থেকে ঝাঁঝরি নামিয়ে অবাক হয়ে দেখল গেটের উপর হাত রেখে বছর ত্রিশ বয়সের একজন শ্যামবর্ণ মহিলা বেতসলতার মত কাঁপছে। তাকে বিপন্ন মনে করে কাছে যেতেই সে একটু অপ্রতিভ স্বরে বলল, ‘আমি রোজ আসি।’ ডাক্তার চ্যাটার্জি বললেন, বাড়ি আর বাগানের অবস্থা থেকে তার পরিচয় পেয়েছি। ‘ তাইতে মন্দাকিনীর একটু রাগ হল এবং রোষকষায়িত নেত্রে ঝাঁঝরিখানা নিয়ে যে গাছে ডাক্তার চ্যাটার্জি একবার জল দিয়েছেন তাতে আবার জল দিতে লাগল আর ডাক্তার চ্যাটার্জি পাইপটা আবার মুখে দিয়ে প্রসন্নচিত্তে মস্ত এক গাছ-ছাঁটা কাঁচি তুলে নিলেন।

এমনি করে মন্দাকিনীর মন আর মন্দাকিনীর মনোবার মাঝে এক অন্তরাল রচনা হল। ডাক্তার চ্যাটার্জির মধ্যে নয়নলোভন কোনও গুণ প্রকাশ পেল না যা বিন্দুমাত্র চিত্তাকর্ষণ করো এমন কি চিত্তাকর্ষণ করবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা পর্যন্ত দেখা গেল না।

কোন সুদূর মহানগরীর ছায়াময় খ্যাতি তাঁর নামের সঙ্গে জড়িত ছিল তাঁর বিষয় অদম্য কৌতূহল ছাড়া মন্দাকিনীর মনের কোন ভাবান্তর ঘটল না। যৌবনে তার স্বপ্নে-দেখা সেই পুরাতন। প্রিয়তমের ইতিবৃত্ত মন্দাকিনীর জানা ছিল না। সে ধনী কি নির্ধন, কোন কাজকর্ম করে কি ঘরে। বসে থাকে, এই সকল অতি তুচ্ছ তথ্য জানবার প্রয়োজনই তার মনে আসে নি সে দ্বিধাবিহীন চিত্তে দর্শনমাত্রেই তার গলায় বরমাল্য দিয়েছিল। কিন্তু ডাক্তার চ্যাটার্জি সম্বন্ধে তার জিজ্ঞাসার অন্ত ছিল না।

এক মাস কাল সময়, অশেষ ধৈর্য ধারণ এবং সমস্ত ছোট বাগানখানার আমূল সংসারের পর মন্দাকিনী জানল তাঁর বয়স চল্লিশ বছর, অবিবাহিত, ধর্ম-বিরোধী, কিন্তু ভগবানের অস্তিত্ব সম্বন্ধে একটু একটু সন্দেহ আছে, দৈর্ঘ্য ৫ফুট ১১ ইঞ্চি, ওজনের কথা প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক।

স্ত্রীজনসুলভ নানান চাতুরী অবলম্বন করে মন্দাকিনী তাঁকে দিয়ে নতুন গোলাপী পর্দা কেনাল, দরজা-জানালায় সবুজ সাদা রঙ লাগাল, গেটের পাশে চেরী গাছের কলম বসাল।

এমনি করে মন্দাকিনীর স্বপ্ন ফুলের মতন ফুটতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলা মন্দাকিনী আবিষ্কার করল ইডেনে সর্প প্রবেশ করেছে।

কে একজন অতি তরুণী, তনুদেহে সবুজ জজের্টের শাড়ি অপরূপ করে জড়িয়ে, কালো কোঁকড়া চুলগুলিকে মাথার উপরে অভিনব রুচিতে চূড়ো করে বেঁধে ডাক্তার চ্যাটার্জির স্কন্ধ অবলম্বন করে অতি-রক্তিম ঠোঁট দুখানিকে ঈষৎ আলগা করে হিমালয় দেখছে। আর তার সর্বাঙ্গ থেকে মাধুরী ঝরে পড়ছে।

এইটুকু মাত্র। কিন্তু মন্দাকিনীর হৃদয় বিকল হল। ত্বরিত পদে সেখান থেকে সে ফিরে গেল। তার মানসচক্ষের সম্মুখে ওই মেয়েটি তার সবুজ জর্জেটের আঁচলখানা মেলে দিয়ে এমন একটা শ্যামল অন্তরাল সৃষ্টি করল যাকে ভেদ করে মন্দাকিনীর লুব্ধ চোখ আর সেই ছোট বাড়ি কি তার মালিককে দেখতে পেল না।

মন্দাকিনীর হৃদয়ে জীবনে এই প্রথম ঈর্ষা জন্ম নিল এবং তার সবুজ চোখের কাছে সমগ্র জগৎখানা বিষময় হয়ে উঠল। যেখানে কোন দাবি নেই সেখানে নৈরাশ্যের জ্বালা সব থেকে তীব্র, কারণ তার কোনও প্রতিকার হয় না।

মন্দাকিনী নিজেকে শত শত গঞ্জনা দিল। তার কোন অনুযোগের কারণ নেই। ডাক্তার চ্যাটার্জির বাড়িতে তাঁর যে কোনও অতিথি আসুক না কেন, মন্দাকিনীর তাতে কি? কিন্তু তবুও দার্জিলিংয়ের হিমকুজঝটিকা একেবারে হৃদয়ে গিয়ে প্রবেশ করল তার ব্যথিত দৃষ্টি হিমালয়ের পুঞ্জিত রূপরাশির মধ্যে কোনও দিন কোন কোমলতা খুঁজে পায় নি, আজও পেল না।

এক সপ্তাহ কাল উত্তরবিহীন আত্মজিজ্ঞাসার পর মন্দাকিনী আবার ডাক্তার চ্যাটার্জির সমীপে উপস্থিত হল। আর তার কোন আশঙ্কা নেই, মন তার বর্ম পরেছে। নৈরাশ্যের গভীরতম অতলে যে ডুব দিয়েছে সে আবার চোখে আলোর রেখা দেখতে পায়। সে ঔদাসীন্যের চন্দ্রলোক, শীতল সুন্দর।

প্রেমের গল্প l মন্দাকিনীর প্রেমকাহিনী

মন্দাকিনী তাই সাহসে বুক বেঁধে, দৃষ্টিতে ত্যাগের মহিমা নিয়ে ডাক্তার চ্যাটার্জির সমীপে উপস্থিত হল।

দেখল দরজা-জানালা খোলা হয় নি, ফুলগাছে জল দেওয়া হয় নি। উদাসী মনের উপর উদ্বেগের কালো ছায়া নেমে এল। যাকে ত্যাগ করা যায় তার মঙ্গল কামনা করাতে কোন বাধা নেই।

কম্পিত পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে উপরে গিয়ে মন্দাকিনী দেখল শোবার ঘরের পর্দা উঠানো, জানালা বন্ধ, শার্সিতে ধুলো এবং টেবিলে বই, ড্রেসিংটেবিলে বই, আরামকেদারায় বই, আরামকেদারার নিচে বই, পাশে বই, পিছনে বই, মোড়াতে বই, জলচৌকিতে বই এবং মেঝের গালিচাতে রাশি রাশি দিশী ও বিলেতী বই। স্প্রিংযুক্ত লোহার খাটে বাদামী রঙের কম্বলে ঢাকা রোগপাণ্ডুর মুখে ডাক্তার চ্যাটার্জিকেও দেখা গেল।

আবেগের আতিশয্যে মন্দাকিনীর বাক্যরোধ হল। ডাক্তার চ্যাটার্জি হাত থেকে রিলিজিও মেডিচিখানা নামিয়ে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।

মন্দাকিনী নির্বাক রইল তার অভিজ্ঞতামতে মনে যার অভিমান নেই, তার মনে স্নেহপ্রেমের লেশমাত্রও নেই। মন্দাকিনী তাই হতাশ হল। কিন্তু তার উৎকর্ণ মন মুহূর্তের মধ্যে নৈরাশ্যের চেয়ে ঘরের অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়ল সে আয়নার সামনে গিয়ে প্রথমে নিজের কেশ-বেশ সংস্কারের পরে রুমাল দিয়ে ওই আয়না সংস্কারে মনোনিবেশ করল।

শান্তকণ্ঠে ডাক্তার চ্যাটার্জি বললেন, আমার ভাগ্নী এসেছিল, তোমায় দেখাতে পারলাম না মন্দাকিনী এর উত্তরে কি বলবে ভেবে পেল না। ভাবল, হয়তো মন্দাকিনীর মনোভাব সম্বন্ধে ডাক্তার চ্যাটার্জির কোন কৌতূহল নেই।

হঠাৎ রুমালের আঘাতে ছোট একটা জিনিস মাটিতে পড়ল। মন্দাকিনী অপ্রতিভ হয়ে তুলে নিয়ে দেখল একটি নক্ষত্রোজ্জ্বল হীরাবসানো মেয়েদের আংটি।

চোখ তুলতেই ডাক্তার চ্যাটার্জির ঈষৎ ক্লান্ত চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। ডাক্তার চ্যাটার্জি স্নিগ্ধস্বরে বললেন, আমার মায়ের বিয়ের আংটিা মনে করেছি তোমার হাতে মানাবো বলে পরিয়ে দেবার বিন্দুমাত্র উদ্যোগ না করে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।

মন্দাকিনী শেষ পর্যন্ত আংটিটা নিজেই পরল। আর দুটি মুক্তোর মতন দুই বিন্দু অশ্রু আস্তে আস্তে গাল বেয়ে গড়িয়ে গেল।

ডাক্তার চ্যাটার্জির নিকোটিন-রঞ্জিত ডান হাতখানি মন্দাকিনীর ক্ষীণ মণিবন্ধে নিবদ্ধ হল, আর সেই সঙ্গে মন্দাকিনী অনুভব করল তার হৃদয়ের সকল রুদ্ধ বাতায়নগুলি একে একে খুলে গিয়ে সূর্যালোক আর দক্ষিণ-বাতাস যুগপৎ সেখানে প্রবেশ করল।

অবশেষে একদিন মন্দাকিনীর ঈষৎ কম্পমান বাঁ হাতখানা ধীরে ধীরে নিজের করকমলে তুলে নিয়ে, নীল মখমলের ছোট বাক্স খুলে নক্ষত্রোজ্জ্বল এক হীরের আংটি পরিয়ে দিল এবং মন্দাকিনীর রক্তিম অধরে…এর বেশি কল্পনা করবার ক্ষমতা মন্দাকিনীর ছিল না। তাছাড়া এতেই তার এমন শিহরণ লেগে যেত যে, সেরাত্রে চোখে ঘুম আর আসত না। বলা বাহুল্য, এই সকল রোমাঞ্চকর ঘটনাবলীর মধ্যে মন্দাকিনীর পরনে থাকত সুযোগ্য নীল শাড়ি, সোনালী তার আঁচল।

দুঃখের বিষয় এমন সুপ্রকাশ যার রূপ, সে ব্যক্তি চিরকাল মন্দাকিনীর আগ্রহাধীর নয়নযুগলকে ফাঁকি দিয়ে যেতে লাগল। কত যে বর্ষা-সন্ধ্যা, কত যে জ্যোৎস্নাময় নিশীথ বিফল হয়ে যেতে লাগল তার কোন হিসাব নেই। শেষ পর্যন্ত মন্দাকিনী তার দুর্লভ আদর্শটিকে ধরা ছোঁয়ার গোচর করবার দুরাশায় তাকে অনেকটা খর্ব করেও এনেছিল।

তার অমন সুঠাম দেহের দৈর্ঘ্য থেকে দু-চার ইঞ্চি হেঁটে দিয়ে, তার ওই উজ্জ্বল গৌর কান্তিতে একটুখানি শ্যামলের ছোপ ধরিয়ে, তার দাড়িকে শেষ পর্যন্ত না-মঞ্জুর করে, (কারণ কে না জানে যে ভক্তির রাজ্যে যাই হোক, প্রেমের রাজ্যে দাড়ি অচল) তার গোঁফ সম্বন্ধে একটু উদার হয়ে, তাকে প্রায় সাধারণত্বের কোটায় এনে ফেলেছিল।

তবু তার দিশা পাওয়া যায় নি। একটি সুকোমল নারীহৃদয়ে তার জন্য এত সম্ভার রক্ষিত আছে, তবু যদি সে নরাধম অনুপস্থিত থাকে তবে সে কোন রকম সহানুভূতিরও অযোগ্য একথা। জেনে অবশেষে একদা নির্দয়ভাবে স্বহস্তে তাকে প্রিয়তমের সিংহাসন থেকে বিদায় দিল। এমন কি মনে-মনে তাকে আহাম্মক আখ্যা দিতেও কুণ্ঠাবোধ করলে না। তবু মাঝে মাঝে নির্জন নিশীথে তার মনে সংশয়ের দোলা লাগত, আর ওই শূন্য সিংহাসনখানা অন্ধকারে হাহাকার করত।

সময় কিন্তু লঘুপদে চলে যেতে লাগল আর মন্দাকিনীর যৌবন থেকে একটু একটু করে মধু চুরি করে নিতে লাগল। মন্দাকিনী এতদিন অলস ছিল না, ধীরে ধীরে অনেক বিদ্যাকে অনেক ললিতকলাকে আয়ত্ত করে ফেলেছিল।

তার কাঁচা-রূপের সাজ আভরণে আস্তে আস্তে অভিজ্ঞ সুরুচির পরিচয় পাওয়া গেল। সে রূপসীও নয়, কুরূপাও নয়। দুইয়ের মাঝামাঝি এমনটি, যার মাধুর্য দেখামাত্র চোখে পড়ে না, কিন্তু মন দিয়ে খুঁজলে সুপ্রকাশ হয়ে পড়ে।

যত দিন যেতে লাগল তার কথায়, ভঙ্গিতে, সজ্জায়, এমন কি কবরী রচনাতেও একটা তীব্রতা প্রকাশ পেল, যার মাধুর্য মধুরের চেয়ে তিক্ত বেশি রৌদ্রবর্ণ বহুমূল্য সুরা যেমন বেশিদিন রেখে দিলে তিতিয়ে যায়। আর নিয়ত তার কানে বাজতে লাগল কালের রথের চাকার ধ্বনি।

জীবনটাকে যখন শূন্য বোধ হবার আশঙ্কা হল, মন্দাকিনীরও সুবুদ্ধি হল। হৃদয়ের সমস্ত অপ্রার্থিত প্রেমরাশি একজন অনাগত মানুষের চরণ থেকে অপসারিত করে সে সহজে আয়ত্ত বস্তুর উপর ন্যস্ত করল। বস্তুর পোষমানা ভাবটা তাকে নিগূঢ়ভাবে আকর্ষণ করতে লাগল। যে সকল বস্তুকে কামনা করলে, এবং যে-ভাবে কামনা করলে অন্তঃকরণ স্কুল ও বৈষয়িক হয়ে যায়, তারা সেভাবে মন্দাকিনীকে লুব্ধ করল না। সে ভালবাসল প্রাচীন ও আধুনিক চিত্র, পুঁথি, বাসন, সূচিকর্ম, নকশা-দেওয়া হাতে-বোনা পর্দা, মিনে-করা চৌকি—এমন আরও কত কী!

সৌন্দর্যের এমন একটা মোহিনী শক্তি আছে যে, যে তাকে অর্থ দিয়ে কেনে তাকেও সে নক্ষত্রলোকে নিয়ে যায়। যা কিছু সুন্দর, সৌন্দর্যই তার সার্থকতা। তার আর কোনও গুণের প্রয়োজন নেই। সে নয়নানন্দ। তার কাছে আর কিছু প্রত্যাশা করলে তার প্রাণময় পরিপূর্ণ রূপরাশি অর্থহীন বিলাসে পরিণত হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে।

যে কেউ সৌন্দর্য উপভোগ করতে জানে না। কিন্তু মন্দাকিনী জানত। তাই তার বারবার হতাশ হয়ে যাওয়া হৃদয় মরুভূমি না হয়ে গিয়ে নিত্য নূতন রসের উৎসের সন্ধান পেল।

সৌন্দর্যের উপাসকের যে অনাবিল অবসর ও অজস্র অর্থের প্রয়োজন, যে দুষ্ট-শনি মন্দাকিনীর পিছু নিয়েছিল, সে একদিন সে সকল হরণ করে নিল। মন্দাকিনী সৌন্দর্যের উপাসনা তখনকার মতন বন্ধ করে দিয়ে, সৌন্দর্যের সামগ্রীগুলোকে এবাড়ি-ওবাড়ি বাক্সবন্দী করে কেমন করে যেন এক মাস্টারী যোগাড় করে দার্জিলিং চলে গেল।

দার্জিলিংয়ে গুছিয়ে বসলে পর চারিদিকে চেয়ে মন্দাকিনী দেখল হিমালয়ের কোলে কোলে রডোডেনড্রন গাছের সারি, কিন্তু তার একটিরও উদ্ধত শাখার রাঙা পুষ্পস্তবকের নাগাল পাওয়া যায় না। পাহাড়ের কানা ধরে ধরে একটির পর একটি ঝাউ গাছের শ্রেণী, কিন্তু তাদের দীর্ঘ শীর্ণ ছায়াগুলি অগম্য রাজ্যে নিচের উপত্যকায় সাদা মেঘ জমেছে, সেখানে পৌঁছনো অসম্ভব।

এক দিক রোদে স্নান করছে, সেদিকে চাইলে মন গলে জল হয়ে যায় অন্য দিক কুয়াশাচ্ছন্ন, সেদিকে চাইলে মন জমে বরফ হয়ে যায়। কিন্তু এ সৌন্দর্য নৈর্ব্যক্তিক, একে মন্দাকিনীর সেই জয়পুরী চৌকির মতন কোলের কাছে টেনে নেওয়া যায় না। বরং একে বেশিক্ষণ দেখলে মনে একটা নিষ্কাম বৌদ্ধভাব জন্মায়।

ঠিক এই সময়, যখন জগৎটা মন্দাকিনীর কাছে অকিঞ্চিৎকর হয়ে আসছিল তখন সে এক ম্লান গোধূলির আলোতে ডাক্তার চ্যাটার্জির খুদে বাড়িখানা আবিষ্কার করল।

পাহাড়ের গায়ে একটুখানি অপরিসর জমির উপর, সত্যি কথা বলতে কি, খানিকটা শূন্যমার্গে, লোহা ও ইটকাঠের উপর ধৃত হয়ে অতি বিপজ্জনক ভাবে, কায়ক্লেশে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে প্রবল সাক্ষ্য দিয়ে কোনও গতিকে বাড়িটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মন্দাকিনীর হৃদয়ে তার মায়াজাল বিস্তার করল।

এক মুহূর্তে তার চোখে পৃথিবীর রঙ বদলে গেল। তার যে মন দূর বনান্তরালে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পদাঙ্গুলির অগ্রভাগে নির্ভর করে দুই পক্ষ বিস্তার করে বিহঙ্গের মতন উড়ে যাচ্ছিল, সে আবার। পাখা বন্ধ করে কুলায়ে ফিরে এল।

চর্মচক্ষে মন্দাকিনী দেখল বহুবর্ষের বৃষ্টিধারায় রঙ-ওঠা, কাঁচেমোড়া, বিবর্ণ সবুজ পর্দা ঘেরা ছোট দোতলা বাড়ি ভাঙা কাঁচের অন্তরালে দৃশ্যমান ধূলিমলিন মনোমোহিনী কাঠের সিঁড়ি। পশ্চিমদিকের ঝাউগাছ তাদের আলম্বিত ছায়াগুলিকে দেওয়ালের উপর ফেলেছে। সামনের শানবাঁধানো জমির ধারে ধারে ক্রিস্যান্থিমাম গাছ, জেরেনিয়াম গাছ, আর তাদের পদপ্রান্তে প্রিমরোজ ও ভায়োলেটা কোথাও একটি ফুল ফোটেনি এবং কখনও ফুটবে কিনা সন্দেহ। জনমানুষের সাড়া নেই।

এই শূন্য বাড়িখানা মন্দাকিনীর হৃদয়কে এক নিমেষে গ্রাস করল। সে তার মাস্টারনীসুলভ গাম্ভীর্য ভুলে গিয়ে গেট খুলে অনধিকার প্রবেশ করল এবং অমার্জনীয় ভাবে পায়ের আঙুলের। উপর দাঁড়িয়ে হেঁড়া পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতর দেখল গদি-মোড়া প্রাচীন ও সুশ্রী আসবাবে ধুলো জমেছে।

তারপর ওই বাড়ি তাকে যাদু করল। অনেকদিন পর সে তার মিনে-করা বাসন ইত্যাদির দুঃখ ভুলে গেল। সমস্ত দিনের কর্মব্যস্ততা অসহ্য মনে হত বিকেলবেলা ওই রঙ-ধোওয়া বাড়ির কাছে সে নিজেকে খুঁজে পেত।

দিনের পর সপ্তাহ ও সপ্তাহের পর মাস এই ভাবে গড়িয়ে গেল। মন্দাকিনী মনে মনে বাড়িখানাকে মেজে-ঘষে ফেলল, পুরনো সবুজ পর্দাগুলি ধোপার বাড়ি পাঠিয়ে নতুন ঘোর গোলাপী রঙের পর্দা লাগাল। প্রাচীন আসবাবের ধুলো মুছল, বাগানটির সংস্কার করে অনেক যত্নে সেখানে ফুল ফোঁটালা এমন কি কালো চীনেমাটির চ্যাপটা ফুলদানিতে ফুল সাজাল।

হঠাৎ একদিন মন্দাকিনী মনে মনে একটা বেহিসাবী কাজ করে ফেলল। মনগড়া অপরূপ এক দাঁড়-করানো বিজলী বাতি কিনে ফেলল, কোথায় তাকে মানাবে ভেবে মনে বড় অশান্তি অনুভব করল। মনস্থির করবার জন্য বিকেলবেলা সেখানে গিয়ে গেট খুলে ঢুকেই পটের পুতুলের মতো থমকে দাঁড়ালা

আধ-ময়লা ছাইরঙের পেন্টালুন, গলা-খোলা নীল রঙের শার্ট আর কালো পশমের গেঞ্জি গায়ে একজন লোক ঝাঁঝরি হাতে মরা ফুলগাছে জল দিচ্ছে। তার মুখের ডানপাশে প্রাচীন পাইপ এবং দেখামাত্র বোঝা যায় যে তিনদিন ক্ষৌরকর্ম হয়নি। রান্নাঘরের খোলা জানলা দিয়ে অশুদ্ধ তেলের গন্ধ ভেসে আসছে।

সেই ব্যক্তি মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে, হাত থেকে ঝাঁঝরি নামিয়ে অবাক হয়ে দেখল গেটের উপর হাত রেখে বছর ত্রিশ বয়সের একজন শ্যামবর্ণ মহিলা বেতসলতার মত কাঁপছে। তাকে বিপন্ন মনে করে কাছে যেতেই সে একটু অপ্রতিভ স্বরে বলল, ‘আমি রোজ আসি।’ ডাক্তার চ্যাটার্জি বললেন, বাড়ি আর বাগানের অবস্থা থেকে তার পরিচয় পেয়েছি। ‘ তাইতে মন্দাকিনীর একটু রাগ হল এবং রোষকষায়িত নেত্রে ঝাঁঝরিখানা নিয়ে যে গাছে ডাক্তার চ্যাটার্জি একবার জল দিয়েছেন তাতে আবার জল দিতে লাগল আর ডাক্তার চ্যাটার্জি পাইপটা আবার মুখে দিয়ে প্রসন্নচিত্তে মস্ত এক গাছ-ছাঁটা কাঁচি তুলে নিলেন।

এমনি করে মন্দাকিনীর মন আর মন্দাকিনীর মনোবার মাঝে এক অন্তরাল রচনা হল। ডাক্তার চ্যাটার্জির মধ্যে নয়নলোভন কোনও গুণ প্রকাশ পেল না যা বিন্দুমাত্র চিত্তাকর্ষণ করো এমন কি চিত্তাকর্ষণ করবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা পর্যন্ত দেখা গেল না।

কোন সুদূর মহানগরীর ছায়াময় খ্যাতি তাঁর নামের সঙ্গে জড়িত ছিল তাঁর বিষয় অদম্য কৌতূহল ছাড়া মন্দাকিনীর মনের কোন ভাবান্তর ঘটল না। যৌবনে তার স্বপ্নে-দেখা সেই পুরাতন। প্রিয়তমের ইতিবৃত্ত মন্দাকিনীর জানা ছিল না। সে ধনী কি নির্ধন, কোন কাজকর্ম করে কি ঘরে। বসে থাকে, এই সকল অতি তুচ্ছ তথ্য জানবার প্রয়োজনই তার মনে আসে নি সে দ্বিধাবিহীন চিত্তে দর্শনমাত্রেই তার গলায় বরমাল্য দিয়েছিল। কিন্তু ডাক্তার চ্যাটার্জি সম্বন্ধে তার জিজ্ঞাসার অন্ত ছিল না।

এক মাস কাল সময়, অশেষ ধৈর্য ধারণ এবং সমস্ত ছোট বাগানখানার আমূল সংসারের পর মন্দাকিনী জানল তাঁর বয়স চল্লিশ বছর, অবিবাহিত, ধর্ম-বিরোধী, কিন্তু ভগবানের অস্তিত্ব সম্বন্ধে একটু একটু সন্দেহ আছে, দৈর্ঘ্য ৫ফুট ১১ ইঞ্চি, ওজনের কথা প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক।স্ত্রীজনসুলভ নানান চাতুরী অবলম্বন করে মন্দাকিনী তাঁকে দিয়ে নতুন গোলাপী পর্দা কেনাল, দরজা-জানালায় সবুজ সাদা রঙ লাগাল, গেটের পাশে চেরী গাছের কলম বসাল।

এমনি করে মন্দাকিনীর স্বপ্ন ফুলের মতন ফুটতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলা মন্দাকিনী আবিষ্কার করল ইডেনে সর্প প্রবেশ করেছে।

কে একজন অতি তরুণী, তনুদেহে সবুজ জজের্টের শাড়ি অপরূপ করে জড়িয়ে, কালো কোঁকড়া চুলগুলিকে মাথার উপরে অভিনব রুচিতে চূড়ো করে বেঁধে ডাক্তার চ্যাটার্জির স্কন্ধ অবলম্বন করে অতি-রক্তিম ঠোঁট দুখানিকে ঈষৎ আলগা করে হিমালয় দেখছে। আর তার সর্বাঙ্গ থেকে মাধুরী ঝরে পড়ছে।

এইটুকু মাত্র। কিন্তু মন্দাকিনীর হৃদয় বিকল হল। ত্বরিত পদে সেখান থেকে সে ফিরে গেল। তার মানসচক্ষের সম্মুখে ওই মেয়েটি তার সবুজ জর্জেটের আঁচলখানা মেলে দিয়ে এমন একটা শ্যামল অন্তরাল সৃষ্টি করল যাকে ভেদ করে মন্দাকিনীর লুব্ধ চোখ আর সেই ছোট বাড়ি কি তার মালিককে দেখতে পেল না।

মন্দাকিনীর হৃদয়ে জীবনে এই প্রথম ঈর্ষা জন্ম নিল এবং তার সবুজ চোখের কাছে সমগ্র জগৎখানা বিষময় হয়ে উঠল। যেখানে কোন দাবি নেই সেখানে নৈরাশ্যের জ্বালা সব থেকে তীব্র, কারণ তার কোনও প্রতিকার হয় না।

মন্দাকিনী নিজেকে শত শত গঞ্জনা দিল। তার কোন অনুযোগের কারণ নেই। ডাক্তার চ্যাটার্জির বাড়িতে তাঁর যে কোনও অতিথি আসুক না কেন, মন্দাকিনীর তাতে কি? কিন্তু তবুও দার্জিলিংয়ের হিমকুজঝটিকা একেবারে হৃদয়ে গিয়ে প্রবেশ করল তার ব্যথিত দৃষ্টি হিমালয়ের পুঞ্জিত রূপরাশির মধ্যে কোনও দিন কোন কোমলতা খুঁজে পায় নি, আজও পেল না।

এক সপ্তাহ কাল উত্তরবিহীন আত্মজিজ্ঞাসার পর মন্দাকিনী আবার ডাক্তার চ্যাটার্জির সমীপে উপস্থিত হল। আর তার কোন আশঙ্কা নেই, মন তার বর্ম পরেছে। নৈরাশ্যের গভীরতম অতলে যে ডুব দিয়েছে সে আবার চোখে আলোর রেখা দেখতে পায়। সে ঔদাসীন্যের চন্দ্রলোক, শীতল সুন্দর।

মন্দাকিনী তাই সাহসে বুক বেঁধে, দৃষ্টিতে ত্যাগের মহিমা নিয়ে ডাক্তার চ্যাটার্জির সমীপে উপস্থিত হল।

দেখল দরজা-জানালা খোলা হয় নি, ফুলগাছে জল দেওয়া হয় নি। উদাসী মনের উপর উদ্বেগের কালো ছায়া নেমে এল। যাকে ত্যাগ করা যায় তার মঙ্গল কামনা করাতে কোন বাধা নেই।

কম্পিত পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে উপরে গিয়ে মন্দাকিনী দেখল শোবার ঘরের পর্দা উঠানো, জানালা বন্ধ, শার্সিতে ধুলো এবং টেবিলে বই, ড্রেসিংটেবিলে বই, আরামকেদারায় বই, আরামকেদারার নিচে বই, পাশে বই, পিছনে বই, মোড়াতে বই, জলচৌকিতে বই এবং মেঝের গালিচাতে রাশি রাশি দিশী ও বিলেতী বই। স্প্রিংযুক্ত লোহার খাটে বাদামী রঙের কম্বলে ঢাকা রোগপাণ্ডুর মুখে ডাক্তার চ্যাটার্জিকেও দেখা গেল।

আবেগের আতিশয্যে মন্দাকিনীর বাক্যরোধ হল। ডাক্তার চ্যাটার্জি হাত থেকে রিলিজিও মেডিচিখানা নামিয়ে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।

মন্দাকিনী নির্বাক রইল তার অভিজ্ঞতামতে মনে যার অভিমান নেই, তার মনে স্নেহপ্রেমের লেশমাত্রও নেই। মন্দাকিনী তাই হতাশ হল। কিন্তু তার উৎকর্ণ মন মুহূর্তের মধ্যে নৈরাশ্যের চেয়ে ঘরের অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়ল সে আয়নার সামনে গিয়ে প্রথমে নিজের কেশ-বেশ সংস্কারের পরে রুমাল দিয়ে ওই আয়না সংস্কারে মনোনিবেশ করল।

শান্তকণ্ঠে ডাক্তার চ্যাটার্জি বললেন, আমার ভাগ্নী এসেছিল, তোমায় দেখাতে পারলাম না মন্দাকিনী এর উত্তরে কি বলবে ভেবে পেল না। ভাবল, হয়তো মন্দাকিনীর মনোভাব সম্বন্ধে ডাক্তার চ্যাটার্জির কোন কৌতূহল নেই।

হঠাৎ রুমালের আঘাতে ছোট একটা জিনিস মাটিতে পড়ল। মন্দাকিনী অপ্রতিভ হয়ে তুলে নিয়ে দেখল একটি নক্ষত্রোজ্জ্বল হীরাবসানো মেয়েদের আংটি।

চোখ তুলতেই ডাক্তার চ্যাটার্জির ঈষৎ ক্লান্ত চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। ডাক্তার চ্যাটার্জি স্নিগ্ধস্বরে বললেন, আমার মায়ের বিয়ের আংটিা মনে করেছি তোমার হাতে মানাবো বলে পরিয়ে দেবার বিন্দুমাত্র উদ্যোগ না করে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।

মন্দাকিনী শেষ পর্যন্ত আংটিটা নিজেই পরল। আর দুটি মুক্তোর মতন দুই বিন্দু অশ্রু আস্তে আস্তে গাল বেয়ে গড়িয়ে গেল।

ডাক্তার চ্যাটার্জির নিকোটিন-রঞ্জিত ডান হাতখানি মন্দাকিনীর ক্ষীণ মণিবন্ধে নিবদ্ধ হল, আর সেই সঙ্গে মন্দাকিনী অনুভব করল তার হৃদয়ের সকল রুদ্ধ বাতায়নগুলি একে একে খুলে গিয়ে সূর্যালোক আর দক্ষিণ-বাতাস যুগপৎ সেখানে প্রবেশ করল।

আরো পড়ুন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প – “ত্যাগ”

Exit mobile version