Dolonchapa By Kazi Nazrul Islam 2024l দোলনচাঁপা – কাজী নজরুল ইসলাম

By raateralo.com

Published on:

Dolonchapa By Kazi Nazrul Islam 2024l দোলনচাঁপা - কাজী নজরুল ইসলাম

Dolonchapa By Kazi Nazrul Islam 2024l দোলনচাঁপা – কাজী নজরুল ইসলাম: বাংলা সাহিত্যের জগতে কাজী নজরুল ইসলাম এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত আছেন। তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি যেমন প্রেম, বিরহ, বিপ্লবের কথা বলেছেন, তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরও অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন। ‘দোলনচাঁপা’ এমনই একটি কবিতা, যেখানে তিনি প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ও জীবনের সুন্দর দিকগুলোর কথা তুলে ধরেছেন। দোলনচাঁপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নজরুল এই কবিতায় যে আবেগ ও ভালবাসার ছোঁয়া দিয়েছেন, তা পাঠকদের মনে চিরকালীন সঞ্চার সৃষ্টি করবে।

Dolonchapa By Kazi Nazrul Islam 2024l দোলনচাঁপা – কাজী নজরুল ইসলাম

অবেলার ডাক

অনেক ক’রে বাসতে ভালো পারিনি মা তখন যারে,
আজ অবেলায় তারেই মনে পড়ছে কেন বারে বারে।।

আজ মনে হয় রোজ রাতে সে ঘুম পাড়াত নয়ন চুমে,
চুমুর পরে চুম দিয়ে ফের হান্‌তে আঘাত ভোরের ঘুমে।
           ভাব্‌তুম তখন এ কোন্‌ বালাই!
           কর্‌ত এ প্রাণ পালাই পালাই।
আজ সে কথা মনে হ’য়ে ভাসি অঝোর নয়ন-ঝরে।
অভাগিনীর সে গরব আজ ধূলায় লুটায় ব্যথার ভারে।।

তর”ণ তাহার ভরাট বুকের উপ্‌চে-পড়া আদর সোহাগ
হেলায় দু’পায় দ’লেছি মা, আজ কেন হায় তার অনুরাগ?
           এই চরণ সে বক্ষে চেপে
           চুমেছে, আর দু’চোখ ছেপে
জল ঝ’রেছে, তখনো মা কইনি কথা অহঙ্কারে,
এম্‌নি দার”ণ হতাদরে ক’রেছি মা, বিদায় তারে।।

দেখেওছিলাম বুক-ভরা তার অনাদরের আঘাত-কাঁটা,
দ্বার হ’তে সে গেছে দ্বারে খেয়ে সবার লাথি-ঝাটা।
           ভেবেছিলাম আমার কাছে
           তার দরদের শানি- আছে,
আমিও গো মা ফিরিয়ে দিলাম চিন্‌তে নেরে দেবতারে।
ভিক্ষুবেশে এসেছিল রাজাধিরাজ দাসীর দ্বারে।।

পথ ভুলে সে এসেছিল সে মোর সাধের রাজ-ভিখারী,
মাগো আমি ভিখারিনী, আমি কি তাঁয় চিন্‌তে পারি?
           তাই মাগো তাঁর পূজার ডালা
           নিইনি, নিইনি মণির মালা,
দেব্‌তা আমার নিজে আমায় পূজল ষোড়শ-উপচারে।
পূজারীকে চিন্‌লাম না মা পূজা-ধূমের অন্ধকারে।।

আমায় চাওয়াই শেষ চাওয়া তার মাগো আমি তা কি জানি?
ধরায় শুধু রইল ধরা রাজ-অতিথির বিদায়-বাণী।
           ওরে আমার ভালোবাসা!
           কোথায় বেঁধেছিলি বাসা
যখন আমার রাজা এসে দাঁড়িয়েছিল এই দুয়ারে?
নিঃশ্বসিয়া উঠছে ধরা, ‘নেই রে সে নেই, খুঁজিস কারে!’

সে যে পথের চির-পথিক, তার কি সহে ঘরের মায়া?
দূর হ’তে মা দূরন-রে ডাকে তাকে পথের ছায়া।
           মাঠের পারে বনের মাঝে
           চপল তাহার নূপুর বাজে,
ফুলের সাথে ফুটে বেড়ায়, মেঘের সাথে যায় পাহাড়ে,
ধরা দিয়েও দেয় না ধরা জানি না সে চায় কাহারে?

মাগো আমায় শক্তি কোথায় পথ-পাগলে ধ’রে রাখার?
তার তরে নয় ভালোবাসা সন্ধ্যা-প্রদীপ ঘরে ডাকার।
           তাই মা আমার বুকের কবাট
           খুলতে নারল তার করাঘাত,
এ মন তখন কেমন যেন বাসত ভালো আর কাহারে,
আমিই দূরে ঠেলে দিলাম অভিমানী ঘর-হারারে।।

সোহাগে সে ধ’রতে যেত নিবিড় ক’রে বক্ষে চেপে,
হতভাগী পারিয়ে যেতাম ভয়ে এ বুক উঠ্‌ত কেঁপে।
           রাজ ভিখারীর আঁখির কালো,
           দূরে থেকেই লাগ্‌ত ভালো,
আসলে কাছে ক্ষুধিত তার দীঘল চাওয়া অশ্র”-ভারে।
ব্যথায় কেমন মুষড়ে যেতাম, সুর হারাতাম মনে তরে।।

আজ কেন মা তারই মতন আমারো এই বুকের ক্ষুধা
চায় শুধু সেই হেলায় হারা আদর-সোহাগ পরশ-সুধা,
           আজ মনে হয় তাঁর সে বুকে
           এ মুখ চেপে নিবিড় সুখে
গভীর দুখের কাঁদন কেঁদে শেষ ক’রে দিই এ আমারে!
যায় না কি মা আমার কাঁদন তাঁহার দেশের কানন-পারে?

আজ বুঝেছি এ-জনমের আমার নিখিল শানি–আরাম
চুরি ক’রে পালিয়ে গেছে চোরের রাজা সেই প্রাণারাম।
           হে বসনে-র রাজা আমার!
           নাও এসে মোর হার-মানা-হারা!
আজ যে আমার বুক ফেটে যায় আর্তনাদের হাহাকারে,
দেখে যাও আজ সেই পাষাণী কেমন ক’রে কাঁদতে পারে!

তোমার কথাই সত্য হ’ল পাষাণ ফেটেও রক্ত বহে,
দাবাললের দার”ণ দাহ তুষার-গিরি আজকে দহে।
           জাগল বুকে ভীষণ জোয়ার,
           ভাঙল আগল ভাঙল দুয়ার
মূকের বুকে দেব্‌তা এলেন মুখর মুখে ভীম পাথারে।
বুক ফেটেছে মুখ ফুটেছে-মাগো মানা ক’র্‌ছ কারে?

স্বর্গ আমার গেছে পুড়ে তারই চ’লে যাওয়ার সাথে,
এখন আমার একার বাসার দোসরহীন এই দুঃখ-রাতে।
           ঘুম ভাঙাতে আস্‌বে না সে
           ভোর না হ’তেই শিয়র-পাশে,
আস্‌বে না আর গভীর রাতে চুম-চুরির অভিসারে,
কাঁদাবে ফিরে তাঁহার সাথী ঝড়ের রাতি বনের পারে।

আজ পেলে তাঁয় হুম্‌ড়ি খেয়ে প’ড়তুম মাগো যুগল পদে,
বুকে ধ’রে পদ-কোকনদ স্নান করাতাম আঁখির হ্রদে।
           ব’সতে দিতাম আধেক আঁচল,
           সজল চোখের চোখ-ভরা জল-
ভেজা কাজল মুছতাম তার চোখে মুখে অধর-ধারে,
আকুল কেশে পা মুছাতাম বেঁধে বাহুর কারাগারে।

দেখ্‌তে মাগো তখন তোমার রাক্ষুসী এই সর্বনাশী,
মুখ থুয়ে তাঁর উদার বুকে ব’লত,‘ আমি ভালোবাসি!’
           ব’ল্‌তে গিয়ে সুখ-শরমে
           লাল হ’য়ে গাল উঠত ঘেমে,
বুক হ’তে মুখ আস্‌ত নেমে লুটিয়ে যখন কোল-কিনারে,
দেখ্‌তুম মাগো তখন কেমন মান ক’রে সে থাক্‌তে পারে!

এম্‌নি এখন কতই আমা ভালোবাসার তৃষ্ণা জাগে
তাঁর ওপর মা অভিমানে, ব্যাথায়, রাগে, অনুরাগে।
           চোখের জলের ঋণী ক’রে,
           সে গেছে কোন্‌ দ্বীপান-রে?
সে বুঝি মা সাত সমুদ্দুর তের নদীর সুদূরপারে?
ঝড়ের হাওয়া সেও বুঝি মা সে দূর-দেশে যেতে নারে?

তারে আমি ভালোবাসি সে যদি তা পায় মা খবর,
চৌচির হ’য়ে প’ড়বে ফেটে আনন্দে মা তাহার কবর।
           চীৎকারে তার উঠবে কেঁপে
           ধরার সাগর অশ্র” ছেপে,
উঠবে ক্ষেপে অগ্নি-গিরি সেই পাগলের হুহুঙ্কারে,
ভূধর সাগর আকাশ বাতাস ঘুর্ণি নেচে ঘিরবে তারে।

ছি, মা! তুমি ডুকরে কেন উঠছ কেঁদে অমন ক’রে?
তার চেয়ে মা তারই কোনো শোনা-কথা শুনাও মোরে!
           শুনতে শুনতে তোমার কোলে
           ঘুমিয়ে পড়ি। – ও কে খোলে
দুয়ার ওমা? ঝড় বুঝি মা তারই মতো ধাক্কা মারে?
ঝোড়ো হওয়া! ঝোড়ো হাওয়া! বন্ধু তোমার সাগর পারে!

সে কি হেথায় আসতে পারে আমি যেথায় আছি বেঁচে,
যে দেশে নেই আমার ছায়া এবার সে সেই দেশে গেছে!
           তবু কেন থাকি’ থাকি’,
           ইচ্ছা করে তারেই ডাকি!
যে কথা মোর রইল বাকী হায় যে কথা শুনাই কারে?
মাগো আমার প্রাণের কাঁদন আছড়ে মরে বুকের দ্বারে!

যাই তবে মা! দেকা হ’লে আমার কথা ব’লো তারে-
রাজার পূজা-সে কি কভু ভিখারিনী ঠেলতে পারে?
           মাগো আমি জানি জানি,
           আসবে আবার অভিমানী
খুঁজতে আমায় গভীর রাতে এই আমাদের কুটীর-দ্বারে,
ব’লো তখন খুঁজতে তারেই হারিয়ে গেছি অন্ধকারে!

বাংলা কবিতা দোলনচাঁপা l দোলনচাঁপা কাজী নজরুল ইসলাম

পূজারিণী

এত দিনে অবেলায়-
প্রিয়তম!
ধূলি-অন্ধ ঘূর্ণি সম
দিবাযামী
যবে আমি
নেচে ফিরি র”ধিরাক্ত মরণ-খেলায়-
এ দিনে অ-বেলায়
জানিলাম, আমি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি।
পূজারিণী!
ঐ কন্ঠ, ও-কপোত- কাঁদানো রাগিণী,
ঐ আখি, ঐ মুখ,
ঐ ভুর”, ললাট, চিবুক,
ঐ তব অপরূপ রূপ,
ঐ তব দোলো-দোলো গতি-নৃত্য দুষ্ট দুল রাজহংসী জিনি’-
চিনি সব চিনি।

তাই আমি এতদিনে
জীবনের আশাহত ক্লান- শুষ্ক বিদগ্ধ পুলিনে
মূর্ছাতুর সারা প্রাণ ভ’রে
ডাকি শুকু ডাকি তোমা’
প্রিয়তমা!
ইষ্ট মম জপ-মালা ঐ তব সব চেয়ে মিষ্ট নাম ধ’রে!
তারি সাথে কাঁদি আমি-
ছিন্ন-কন্ঠে কাঁদি আমি, চিনি তোমা’, চিনি চিনি চিনি,
বিজয়িনী নহ তুমি-নহ ভিখারিনী,
তুমি দেবী চির-শুদ্ধ তাপস-কুমারী, তুমি মম চির-পূজারিণী!
যুগে যুগে এ পাষাণে বাসিয়াছ ভালো,
আপনারে দাহ করি, মোর বুকে জ্বালায়েছ আলো,
বারে বারে করিয়াছ তব পূজা-ঋণী।
চিনি প্রিয়া চিনি তোমা’ জন্মে জন্মে চিনি চিনি চিনি!
চিনি তোমা’ বারে বারে জীবনের অস–ঘাটে, মরণ-বেলায়,
তারপর চেনা-শেষে
তুমি-হারা পরদেশে
ফেলে যাও একা শুণ্য বিদায়-ভেলায়!

দিনানে-র প্রানে- বসি’ আঁখি-নীরে তিনি’
আপনার মনে আনি তারি দূর-দূরানে-র স্মৃতি-
মনে পড়ে-বসনে-র শেষ-আশা-ম্লান মৌন মোর আগমনী সেই নিশি,
যেদিন আমার আঁখি ধন্য হ’ল তব আখি-চাওয়া সনে মিশি।
তখনো সরল সুখী আমি- ফোটেনি যৌবন মম,
উন্মুখ বেদনা-মুখী আসি আমি ঊষা-সম
আধ-ঘুমে আধ-জেগে তখনো কৈশোর,
জীবনের ফোটো-ফোটো রাঙা নিশি-ভোর,
বাধা বন্ধ-হারা
অহেতুক নেচে-চলা ঘূর্ণিবায়ু-পারা
দুরন- গানের বেগ অফুরন- হাসি
নিয়ে এনু পথ-ভোলা আমি অতি দূর পরবাসী।
সাথে তারি
এনেছিনু গৃহ-হারা বেদনার আঁখি-ভরা বারি।
এসে রাতে-ভোরে জেগে গেয়েছিনু জাগরণী সুর-
ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছিলে তুমি কাছে এসেছিলে,
মুখ-পানে চেয়ে মোর সকর”ণ হাসি হেসেছিলে,-
হাসি হেরে কেঁদেছিনু-‘তুমি কার পোষাপাখী কান-ার বিধুর?’
চোখে তব সে কী চাওয়া! মনে হ’ল যেন
তুমি মোর ঐ কন্ঠ ঐ সুর-
বিরহের কান্না-ভারাতুর
বনানী-দুলানো,
দখিনা সমীরে ডাকা কুসুম-ফোটানো বন-হরিণী-ভুলানো
আদি জন্মদিন হ’তে চেন তুমি চেন!
তারপর-অনাদরে বিদায়ের অভিমান-রাঙা
অশ্র”-ভাঙা-ভাঙা
ব্যথা-গীত গেয়েছিনু সেই আধ-রাতে,
বুঝি নাই আমি সেই গান-গাওয়া ছলে
কারে পেতে চেয়েছিনু চিরশূন্য মম হিয়া-তলে-
শুধু জানি, কাঁচা-ঘুমে জাগা তব রাগ-অর”ণ-আঁখি-ছায়া
লেগেছিল মম আঁখি-পাতে।
আরো দেখেছিনু, ঐ আঁখির পলকে
বিস্ময়-পুলক-দীপ্তি ঝলকে ঝলকে
ঝ’লেছিল, গ’লেছিল গাঢ় ঘন বেদানার মায়া,-
কর”ণায় কেঁপে কেঁপে উঠেছিল বিরহিণী
অন্ধকার-নিশীথিনী-কায়া।

তৃষাতুর চোখে মোর বড় যেন লেগেছিল ভালো
পূজারিণী! আঁখি-দীপ-জ্বালা তব সেই সিগ্ধ সকর”ণ আলো।

তারপর-গান গাওয়া শেষে
নাম ধ’রে কাছে বুঝি ডেকেছিনু হেসে।
অমনি কী গ’র্জে-উঠা র”দ্ধ অভিমানে
(কেন কে সে জানে)
দুলি’ উঠেছিল তব ভুর”-বাঁধা সি’র আঁখি-তরী,
ফুলে উঠেছিল জল, ব্যথা-উৎস-মুখে তাহা ঝরঝর
প’ড়েছিল ঝরি’!
একটু আদরে এত অভিমানে ফুলে-ওঠা, এত আঁখি-জল,
কোথা পেলি ওরে কা’র অনাদৃতা ওরে মোর ভিখারিনী
বল্‌ মোরে বল্‌ ।
এই ভাঙা বুকে
ঐ কান্না-রাঙা মুখ থুয়ে লাজ-সুখে
বল্‌ মোরে বল্‌-
মোরে হেরি’ কেন এত অভিমান?
মোর ডাকে কেন এত উথলায় চোখে তব জল?
অ-চেনা অ-জানা আমি পথের পথিক
মোরে হেরে জলে পুরে ওঠে কেন এত ঐ বালিকার আঁখি অনিমিখ?
মোর পানে চেয়ে সবে হাসে,
বাঁধা-নীড় পুড়ে যায় অভিশপ্ত তপ্ত মোর শ্বাসে;
মণি ভেবে কত জনে তুলে পরে গলে,
মণি যবে ফণী হয়ে বিষ-দগ্ধ-মুখে
দংশে তার বুকে,
অমনি সে দলে পদতলে!
বিশ্ব যারে করে ভয় ঘৃণা অবহেলা,
ভিখরিণী! তারে নিয়ে এ কি তব অকর”ণ খেলা?
তারে নিয়ে এ কি গূঢ় অভিমান? কোন্‌ অধিকারে
নাম ধ’রে ডাকটুকু তা’ও হানে বেদনা তোমারে?
কেউ ভালোবাসে নাই? কেই তোমা’ করেনি আদর?
জন্ম-ভিখারিনী তুমি? তাই এত চোখে জল, অভিমানী কর”ণা-কাতর!
নহে তা’ও নহে-
বুকে থেকে রিক্ত-কন্ঠে কোন্‌ রিক্ত অভিমানী কহে-
‘নহে তা’ও নহে।’
দেখিয়াছি শতজন আসে এই ঘরে,
কতজন না চাহিতে এসে বুকে করে,
তবু তব চোখে-মুখে এ অতৃপ্তি, এ কী স্নেহ-ক্ষুধা
মোরে হেলে উছলায় কেন তব বুক-ছাপা এত প্রীতি সুধা?
সে রহস্য রাণী!
কেহ নাহি জানে-
তুমি নাহি জান-
আমি নাহি জানি।
চেনে তা প্রেম, জানে শুধু প্রাণ-
কোথা হ’তে আসে এত অকারণে প্রাণে প্রাণে বেদনার টান!

নাহি বুঝিয়াও আমি সেদিন বুঝিনু তাই, হে অপরিচিতা!
চির-পরিচিতা তুমি, জন্ম জন্ম ধ’রে অনাদৃতা সীতা!
কানন-কাঁদানো তুমি তাপস-বালিকা
অনন- কুমারী সতী, তব দেব-পূজার থালিকা
ভাঙিয়াছি যুগে যুগে, ছিঁড়িয়াছি মালা
খেলা-ছলে; চিন-মৌনা শাপভ্রষ্টা ওগো দেববালা!
নীরবে স’য়েছ সবি-
সহজিয়া! সহজে জেনেছ তুমি, তুমি মোর জয়লক্ষ্মী, আমি তব কবি।
তারপর-নিশি শেষে পাশে ব’সে শুনেছিনু তব গীত-সুর
লাজে-আধ-বাধ-বাধ শঙ্কিত বিধুর;
সুর শুনে হ’ল মনে- ক্ষণে ক্ষণে
মনে-পড়ে-পড়ে না হারা কন্ঠ যেন
কেঁদে কেঁদে সাধে, ‘ওগো চেন মোরে জন্মে জন্মে চেন।’
মথুরায় গিয়ে শ্যাম, রাধিকার ভুলেছিল যবে,
মনে লাগে- এই সুর গীত-রবে কেঁদেছিল রাধা,
অবহেলা-বেঁধা-বুক নিয়ে এ যেন রে অতি-অন-রালে ললিতার কাঁদা
বন-মাঝে একাকিনী দময়ন-ী ঘুরে ঘুরে ঝুরে,
ফেলে-যাওয়া নাথে তার ডেকেছিল ক্লান–কন্ঠে এই গীত-সুরে।
কানে- প’ড়ে মনে
বনলতা সনে
বিষাদিনী শকুন-লা কেঁদেছিল এই সুরে বনে সঙ্গোপনে।
হেম-গিরি-শিরে
হারা-সতী উমা হ’য়ে ফিরে
ডেকেছিল ভোলানাথে এমনি সে চেনা কন্ঠে হায়,
কেঁদেছিল চির-সতী পতি প্রিয়া প্রিয়ে তার পেতে পুনরায়!-
চিনিলাম বুঝিলাম সবি-
যৌবন সে জাগিল না, লাগিল না মর্মে তাই গাঢ় হ’য়ে তব মুখ-ছবি।

তবু তব চেনা কন্ঠ মম কন্ঠ -সুর
রেখে আমি চ’লে গেনু কবে কোন্‌ পল্লী-পথে দূরে!–
দু’দিন না যেতে যেতে এ কি সেই পুণ্য গোমতীর কূলে
প্রথম উঠিল কাঁদি’ অপরূপ ব্যথা-গন্ধ নাভি-পদ্ম-মুলে!

খুঁজে ফিরি কোথা হ’তে এই ব্যাথা-ভারাতুর মদ-গন্ধ আসে-
আকাশ বাতাস ধরা কেঁপে কেঁপে ওঠে শুধু মোর তপ্ত ঘন দীর্ঘশ্বাসে।
কেঁদে ওঠে লতা-পাতা,
ফুল পাখি নদীজল
মেঘ বায়ু কাঁদে সবি অবিরল,
কাঁদে বুকে উগ্রসুখে যৌবন-জ্বালায়-জাগা অতৃপ্ত বিধাতা!
পোড়া প্রাণ জানিল না কারে চাই,
চীৎকারিয়া ফেরে তাই-‘কোথা যাই,
কোথা গেলে ভালোবাসাবাসি পাই?
হু-হু ক’রে ওঠে প্রাণ, মন করে উদাস-উদাস,
মনে হয়-এ নিখিল যৌবন-আতুর কোনো প্রেমিকের ব্যথিত হুতাশ!
চোখ পুরে’ লাল নীল কত রাঙা, আবছায়া ভাসে, আসে-আসে-
কার বক্ষ টুটে
মম প্রাণ-পুটে
কোথা হ’তে কেন এই মৃগ-মদ-গন্ধ-ব্যথা আসে?
মন-মৃগ ছুটে ফেরে; দিগন-র দুলি’ ওঠে মোর ক্ষিপ্ত হাহাকার-ত্রাসে!
কস’রী হরিণ-সম
আমারি নাভির গন্ধ খুঁজে ফেলে গন্ধ-অন্ধ মন-মৃগ মম!
আপনারই ভালোবাসা
আপনি পিইয়া চাহে মিটাইতে আপনার আশা!
অনন- অগস-্য-তৃষাকুল বিশ্ব-মাগা যৌবন আমার
এক সিন্ধু শুষি’ বিন্দু-সম, মাগে সিন্ধু আর!
ভগবান! ভগবান! এ কি তৃষ্ণা অনন- অপার!
কোথা তৃপ্তি? তৃপ্তি কোথা? কোথা মোর তৃষ্ণা-হরা প্রেম-সিন্ধু
অনাদি পাথার!
মোর চেয়ে স্বে”ছাচারী দুরন- দুর্বার!
কোথা গেলে তারে পাই,
যার লাগি’ এত বড় বিশ্বে মোর নাই শানি- নাই!
ভাবি আর চলি শুধু, শুধু পথ চলি,
পথে কত পথ-বালা যায়,
তারি পাছে হায় অন্ধ-বেগে ধায়
ভালোবাসা-ক্ষুধাতুর মন,
পিছু ফিরে কেহ যদি চায়, ‘ভিক্ষা লহ’ ব’লে কেহ আসে দ্বার-পাশে।
প্রাণ আরো কেঁদে ওঠে তাতে,
গুমরিয়া ওঠে কাঙালের লজ্জাহীন গুর” বেদনাতে!
প্রলয়-পয়োধি-নীরে গর্জে-ওঠা হুহুঙ্কার-সম
বেদনা ও অভিমানে ফুলে’ ফুলে’ দুলে’ ওঠে ধূ-ধূ
ক্ষোভ-ক্ষিপ্ত প্রাণ-শিখা মম!
পথ-বালা আসে ভিক্ষা-হাতে,
লাথি মেরে চুর্ণ করি গর্ব তার ভিক্ষা-পাত্র সাথে।
কেঁদে তারা ফিরে যায়, ভয়ে কেহ নাহি আসে কাছে;
‘অনাথপিন্ডদ’-সম
মহাভিক্ষু প্রাণ মম
প্রেম-বুদ্ধ লাগি’ হায় দ্বারে দ্বারে মহাভিক্ষা যাচে,
“ভিক্ষা দাও, পুরবাসি!
বুদ্ধ লাগি’ ভিক্ষা মাগি, দ্বার হ’তে প্রভু ফিরে যায় উপবাসী!’’
কত এল কত গেল ফিরে,-
কেহ ভয়ে কেহ-বা বিস্ময়ে!
ভাঙা-বুকে কেহ,
কেহ অশ্র”-নীরে-
কত এল কত গেল ফিরে!
আমি যাচি পূর্ণ সমর্পণ,
বুঝিতে পারে না তাহা গৃহ-সুখী পুরনারীগণ।
তারা আসে হেসে;
শেষে হাসি-শেষে
কেঁদে তারা ফিরে যায়
আপনার গৃহ স্নেহ”ছায়ে।
বলে তারা, “হে পথিক! বল বল তব প্রাণ কোন্‌ ধন মাগে?
সুরে তব এত কান্না, বুকে তব কা’র লাগি এত ক্ষুধা জাগে?
কি যে চাই বুঝে না ক’ কেহ,
কেহ আনে প্রাণ মম কেহ- বা যৌবন ধন,
কেহ রূপ দেহ।
গর্বিতা ধনিকা আসে মদমত্তা আপনার ধনে
আমারে বাঁধিতে চাহে রূপ-ফাঁদে যৌবনের বনে।….
সর্ব ব্যর্থ, ফিরে চলে নিরাশায় প্রাণ
পথে পথে গেয়ে গেয়ে গান-
“কোথা মোর ভিখারিনী পূজারিণী কই?
যে বলিবে-‘ভালোবেসে সন্ন্যাসিনী আমি
ওগো মোর স্বামি!
রিক্তা আমি, আমি তব গরবিনী,বিজয়িনী নই!”
মর” মাঝে ছুটে ফিরি বৃথা,
হু হু ক’রে জ্ব’লে ওঠে তৃষা-
তারি মাঝে তৃষ্ণা-দগ্ধ প্রাণ
ক্ষণেকের তরে কবে হারাইল দিশা।
দূরে কার দেখা গেল হাতছানি যেন-
ডেকে ডেকে সে-ও কাঁদে-
‘আমি নাথ তব ভিখারিনী,
আমি তোমা’ চিনি,
তুমি মোরে চেন।’
বুঝিনু না, ডাকিনীর ডাক এ যে,
এ যে মিথ্যা মায়া,
জল নহে, এ যে খল, এ যে ছল মরীচিকা ছাষা!
‘ভিক্ষা দাও’ ব’লে আমি এনু তার দ্বারে,
কোথা ভিখারিনী? ওগো এ যে মিথ্যা মায়াবিনী,
ঘরে ডেকে মারে।
এ যে ক্রূর নিষাদের ফাঁদ,
এ যে ছলে জিনে নিতে চাহে ভিখারীর ঝুলির প্রসাদ।
হ’ল না সে জয়ী,
আপনার জালে প’ড়ে আপনি মরিল মিথ্যাময়ী।
কাঁটা-বেঁধা রক্ত মাথা প্রাণ নিয়ে এনু তব পুরে,
জানি নাই ব্যথাহত আমার ব্যথায়
তখনো তোমার প্রাণ পুড়ে।
তবু কেন কতবার মনে যেন হ’ত,
তব স্নিগ্ধ মদিন পরশ মুছে নিতে পারে মোর
সব জ্বালা সব দগ্ধ ক্ষত।
মনে হ’ত প্রাণে তব প্রাণে যেন কাঁদে অহরহ-
‘হে পথিক! ঐ কাঁটা মোরে দাও, কোথা তব ব্যথা বাজে
কহ মোরে কহ!
নীরব গোপন তুমি মৌন তাপসিনী,
তাই তব চির-মৌন ভাষা
শুনিয়াও শুনি নাই, বুঝিয়াও বুঝি নাই ঐ ক্ষুদ্র চাপা-বুকে
কাঁদে কত ভালোবাসা আশা!
এরি মাঝে কোথা হ’তে ভেসে এল মুক্তধারা মা আমার
সে ঝড়ের রাতে,
কোলে তুলে নিল মোরে, শত শত চুমা দিল সিক্ত আঁখি-পাতে।
কোথা গেল পথ-
কোথা গেল রথ-
ডুবে গেল সব শোক-জ্বালা,
জননীর ভালোবাসা এ ভাঙা দেউলে যেন দুলাইল দেয়ালীর আলা!
গত কথা গত জন্ম হেন
হারা-মায়ে পেয়ে আমি ভুলে গেনু যেন।
গৃহহারা গৃহ পেনু, অতি শান- সুখে
কত জন্ম পরে আমি প্রাণ ভ’রে ঘুমাইনু মুখ থুয়ে জননীর বুকে।
শেষ হ’ল পথ-গান গাওয়া,
ডেকে ডেকে ফিরে গেল হা-হা স্বরে পথসাথী তুফানের হাওয়া।
আবার আবার বুঝি ভুলিলাম পথ-
বুঝি কোন্‌ বিজয়িনী-দ্বার প্রানে- আসি’ বাধা পেল পার্থ-পথ-রথ।
ভুলে গেনু কারে মোর পথে পথ খোঁজা,-
ভুলে গেনু প্রাণ মোর নিত্যকাল ধ’রে অভিসারী
মাগে কোন্‌ পূজা,
ভুলে গেনু যত ব্যথা শোক,-
নব সুখ-অশ্র”ধারে গ’লে গেল হিয়া, ভিজে গেল অশ্র”হীন চোখ।
যেন কোন্‌ রূপ-কমলেতে মোর ডুবে গেল আঁখি,
সুরভিতে মেতে উঠে বুক,
উলসিয়া বিলসিয়া উথলিল প্রাণে
এ কী ব্যগ্র উগ্র ব্যথা-সুখ।
বাঁচিয়া নূতন ক’রে মরিল আবার
সীধু-লোভী বাণ-বেঁধা পাখী।….
…. ভেসে গেল রক্তে মোর মন্দিরের বেদী-
জাগিল না পাষাণ-প্রতিমা,
অপমানে দাবানল-সম তেজে
র”খিয়া উঠিল এইবার যত মোর ব্যথা-অর”নিমা।
হুঙ্কারিয়া ছুটিলাম বিদ্রোহের রক্ত-অশ্বে চড়ি’
বেদনার আদি-হেতু স্রষ্টা পানে মেঘ অভ্রভেদী,
ধূমধ্বজ প্রলয়ের ধূমকেতু-ধুমে
হিংসা হোমশিখা জ্বালি’ সৃজিলাম বিভীষিকা স্নেহ-মরা শুষ্ক মর”ভূমে।
…. এ কি মায়া! তার মাঝে মাঝে
মনে হ’ত কতদূরে হ’তে, প্রিয় মোর নাম ধ’রে যেন তব বীণা বাজে!
সে সুদূর গোপন পথের পানে চেয়ে
হিংসা-রক্ত-আঁখি মোর অশ্র”রাঙা বেদনার রসে যেত ছেয়ে।
সেই সুর সেই ডাক স্মরি’ স্মরি’
ভুলিলাম অতীতের জ্বালা,
বুঝিলাম তুমি সত্য-তুমি আছে,
অনাদৃতা তুমি মোর, তুমি মোরে মনে প্রাণে যাচ’,
একা তুমি বনবালা
মোর তরে গাঁথিতেছ মালা
আপনার মনে
লাজে সঙ্গোপনে।
জন্ম জন্ম ধ’রে চাওয়া তুমি মোর সেই ভিখারিনী।
অন-রের অগ্নি-সিন্ধু ফুল হ’য়ে হেসে উঠে কহে- ‘চিনি, চিনি।
বেঁচে ওঠ্‌ মরা প্রাণ! ডাকে তোরে দূর হ’তে সেই-
যার তরে এত বড় বিশ্বে তোর সুখ-শানি- নেই!’
তারি মাঝে
কাহার ক্রন্দন-ধ্বনি বাজে?
কে যেন রে পিছু ডেকে চীৎকারিয়া কয়-
‘বন্ধু এ যে অবেলায়! হতভাগ্য, এ যে অসময়!
শুনিনু না মানা, মানিনু না বাধা,
প্রাণে শুধু ভেসে আসে জন্মন-র হ’তে যেন বিরহিণী ললিতার কাঁদা!
ছুটে এনু তব পাশে
উর্ধ্বশ্বাসে,
মৃত্যু-পথ অগ্নি-রথ কোথা প’ড়ে কাঁদে, রক্ত-কেতু গেল উড়ে পুড়ে,
তোমার গোপান পূজা বিশ্বের আরাম নিয়া এলো বুক জুড়ে।

তারপর যা বলিব হারায়েছি আজ তার ভাষা;
আজ মোর প্রাণ নাই, অশ্র” নাই, নাই শক্তি আশা।
যা বলিব আজ ইহা গান নহে, ইহা শুধু রক্ত-ঝরা প্রাণ-রাঙা
অশ্র”-ভাঙা ভাষা।
ভাবিতেছ, লজ্জাহীন ভিখারীর প্রাণ-
সে-ও চাহে দেওয়ার সম্মান!
সত্য প্রিয়া, সত্য ইহা, আমিও তা স্মরি’
আজ শুধু হেসে হেসে মরি!
তবু শুধু এইটুকু জেনে রাখো প্রিয়তমা, দ্বার হ’তে দ্বারান-রে
ব্যর্থ হ’য়ে ফিরে
এসেছিনু তব পাশে, জীবনের শেষ চাওয়া চেয়েছিনু তোমা’,
প্রাণের সকল আশা সব প্রেম ভালোবাসা দিয়া
তোমারে পূজিয়াছিনু, ওগো মোর বে-দরদী পূজারিণী প্রিয়া!
ভেবেছিনু, বিশ্ব যারে পারে নাই তুমি নেবে তার ভার হেসে,
বিশ্ব-বিদ্রোহীরে তুমি করিবে শাসন
অবহেলে শুধু ভালোবাসে।
ভেবেছিনু, দুর্বিনীত দুর্জয়ীরে জয়ের গরবে
তব প্রাণে উদ্ভাসিবে অপরূপ জ্যোতি, তারপর একদিন
তুমি মোর এ বাহুতে মহাশক্তি সঞ্চারিয়া
বিদ্রোহীর জয়লক্ষ্মী হবে।
ছিল আশা, ছিল শক্তি, বিশ্বটারে টেনে
ছিঁড়ে তব রাঙা পদতলে ছিন্ন রাঙা পদ্মসম পূজা দেব এনে!
কিন’ হায়! কোথা সেই তুমি? কোথা সেই প্রাণ?
কোথা সেই নাড়ী-ছেঁড়া প্রাণে প্রাণে টান?
এ-তুমি আজ সে-তুমি তো নহ;
আজ হেরি-তুমিও ছলনাময়ী,
তুমিও হইতে চাও মিথ্যা দিয়া জয়ী!
কিছু মোরে দিতে চাও, অন্য তরে রাখ কিছু বাকী,-
দুর্ভাগিনী! দেখে হেসে মরি! কারে তুমি দিতে চাও ফাঁকি?
মোর বুকে জাগিছেন অহরহ সত্য ভগবান,
তাঁর দৃষ্টি বড় তীক্ষ্ন, এ দৃষ্টি যাহারে দেখে,
তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজে দেখে তার প্রাণ!
লোভে আজ তব পূজা কলুষিত, প্রিয়া,
আজ তারে ভুলাইতে চাহ,
যারে তুমি পূজেছিলে পূর্ণ মন-প্রাণ সমর্পিয়া।
তাই আজি ভাবি, কার দোষে-
অকলঙ্ক তব হৃদি-পুরে
জ্বলিল এ মরণের আলো কবে প’শে?
তবু ভাবি, এ কি সত্য? তুমিও ছলনাময়ী?
যদি তাই হয়, তবে মায়াবিনী অয়ি!
ওরে দুষ্ট, তাই সত্য হোক।
জ্বালো তবে ভালো ক’রে জ্বালো মিথ্যালোক।
আমি তুমি সুর্য চন্দ্র গ্রহ তারা
সব মিথ্যা হোক;
জ্বালো ওরে মিথ্যাময়ী, জ্বালো তবে ভালো ক’রে
জ্বালো মিথ্যালোক।
তব মুখপানে চেয়ে আজ
বাজ-সম বাজে মর্মে লাজ;
তব অনাদর অবহেলা স্মরি’ স্মরি’
তারি সাথে স্মরি’ মোর নির্লজ্জতা
আমি আজ প্রাণে প্রাণে মরি।
মনে হয়-ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি, ‘মা বসুধা দ্বিধা হও!
ঘৃণাহত মাটিমাখা ছেলেরে তোমার
এ নির্লজ্জ মুখ-দেখা আলো হ’তে অন্ধকারে টেনে লও!
তবু বারে বারে আসি আশা-পথ বাহি’,
কিন’ হায়, যখনই ও-মুখ পানে চাহি-
মনে হয়,-হায়,হায়, কোথা সেই পূজারিণী,
কোথা সেই রিক্ত সন্ন্যাসিনী?
এ যে সেই চির-পরিচিত অবহেলা,
এ যে সেই চির-ভাবহীন মুখ!
পূর্ণা নয়, এ যে সেই প্রাণ নিয়ে ফাঁকি-
অপমানে ফেটে যায় বুক!
প্রাণ নিয়া এ কি নিদার”ণ খেলা খেলে এরা হায়!
রক্ত-ঝরা রাঙা বুক দ’লে অলক্তক পরে এরা পায়!
এর দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্বজন-প্রীতি!
ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্পণ,
পূজা হেরি’ ইহাদের ভীর” বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি।
নারী নাহি হ’তে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো!
ইহাদের অতিলোভী মন
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়,
যাচে বহু জন।..
যে-পূজা পূজিনি আমি স্রষ্টা ভগবানে,
যারে দিনু সেই পূজা সে-ই আজি প্রতারণা হানে।
বুঝিয়াছি, শেষবার ঘিরে আসে সাথী মোর মৃত্যু-ঘন আঁখি,
রিক্ত প্রাণ তিক্ত সুখে হুঙ্কারিয়া উঠে তাই,
কার তরে ওরে মন, আর কেন পথে পথে কাঁদি?
জ্বলে’ ওঠ্‌ এইবার মহাকাল ভৈরবের নেত্রজ্বালা সম ধ্বক্‌-ধ্বক্‌,
হাহাকার-করতালি বাজা! জ্বালা তোর বিদ্রোহের রক্তশিখা অনন- পাবক।
আন্‌ তোর বহ্নি-রথ, বাজা তোর সর্বনাশী তূরী!
হান্‌ তোর পরশু-ত্রিশুল! ধ্বংস কর্‌ এই মিথ্যাপুরী।
রক্ত-সুধা-বিষ আন্‌ মরণের ধর টিপে টুটি!
এ মিথ্যা জগৎ তোর অভিশপ্ত জগদ্দল চাপে হোক্‌ কুটি-কুটি!
কন্ঠে আজ এত বিষ, এত জ্বালা,
তবু, বালা,
থেকে থেকে মনে পড়ে-
যতদিন বাসিনি তোমারে ভালো,
যতদিন দেখিনি তোমার বুক-ঢাকা রাগ-রাঙা আলো,
তুমি ততদিনই
যেচেছিলে প্রেম মোর, ততদিনই ছিলে ভিখারিনী।
ততদিনই এতটুকু অনাদরে বিদ্রোহের তিক্ত অভিমানে
তব চোখে উছলাতো জল, ব্যথা দিত তব কাঁচা প্রাণে;
একটু আদর-কণা একটুকু সোহাগের লাগি’
কত নিশি-দিন তুমি মনে কর, মোর পাশে রহিয়াছ জাগি’,
আমি চেয়ে দেখি নাই; তারই প্রতিশোধ
নিলে বুঝি এতদিনে! মিথ্যা দিয়ে মোরে জিনে
অপমান ফাঁকি দিয়ে করিতেছ মোর শ্বাস-রোধ!
আজ আমি মরণের বুক থেকে কাঁদি-
অকর”ণা! প্রাণ নিয়ে এ কি মিথ্যা অকর”ণ খেলা!
এত ভালোবেসে শেষে এত অবহেলা
কেমনে হানিতে পার, নারী!
এ আঘাত পুর”ষের,
হানিতে এ নির্মম আঘাত, জানিতাম মোরা শুধু পুর”ষেরা পারি।
ভাবিতাম, দাগহীন অকলঙ্ক কুমারীর দান,
একটি নিমেষ মাঝে চিরতরে আপনারে রিক্ত করি’ দিয়া
মন-প্রাণ লভে অবসান।
ভুল, তাহা ভুল
বায়ু শুধু ফোটায় কলিকা, অলি এসে হ’রে নেয় ফুল!
বায়ু বলী, তার তরে প্রেম নহে প্রিয়া!
অলি শুধু জানে ভালো কেমনে দলিতে হয় ফুল-কলি-হিয়া!
পথিক-দখিনা-বায়ু আমি চলিলাম বসনে-র শেষে
মৃত্যুহীন চিররাত্রি নাহি-জানা দেশে!
বিদায়ের বেলা মোর ক্ষণে ক্ষণে ওঠে বুকে আনন্দাশ্র” ভরি’
কত সুখী আমি আজ সেই কথা স্মরি’!
আমি না বাসিতে ভালো তুমি আগে বেসেছিলে ভালো,
কুমারী-বুকের তব সব স্নিগ্ধ রাগ-রাঙা আলো
প্রথম পড়িয়াছিল মোর বুকে-মুখে-
ভুখারীর ভাঙা বুকে পুলকের রাঙা বান ডেকে যায় আজ সেই সুখে!
সেই প্রীতি, সেই রাঙা সুখ-স্মৃতি স্মরি’
মনে হয় এ জীবন এ জনম ধন্য হ’ল- আমি আজ তৃপ্ত হ’য়ে মরি!
না-চাহিতে বেসেছিলে ভালো মোরে তুমি-শুধু তুমি,
সেই সুখে মৃত্যু-কৃষ্ণ অধর ভরিয়া
আজ আমি শতবার ক’রে তব প্রিয় নাম চুমি’।
মোরে মনে প’ড়ে-
একদা নিশীথে যদি প্রিয়
ঘুশায়ে কাহারও বুকে অকারণে বুক ব্যথা করে,
মনে ক’রো, মরিয়াছে, গিয়াছে আপদ!
আর কভু আসিবে না
উগ্র সুখে কেহ তব চুমিতে ও-পদ-কোকনদ!
মরিয়াছে-অশান- অতৃপ্ত চির-স্বার্থপর লোভী,-
অমর হইয়া আছে-র’বে চিরদিন
তব প্রেমে মৃত্যুঞ্জয়ী
ব্যথা-বিষে নীলকণ্ঠ কবি!

কবি নজরুলের দোলনচাঁপা l কাজী নজরুলের বিখ্যাত কবিতা

পিছু-ডাক

সখি!  নতুন ঘরে গিয়ে আমায় প’ড়বে কি আর মনে?
  সেথা তোমার নতুন পূজা নতুন আযোজনে!
   প্রথম দেখা তোমায় আমায়
   যে গৃহ-ছায় যে আঙিনায়,
   যেথায় প্রতি ধূলিকণায়,
      লতাপাতার সনে
  নিত্য চেনার বিত্ত রাজে চিত্ত-আরাধনে,
  শূন্য সে ঘর শূন্য এখন কাঁদছে নিরজনে।।

সেথা  তুমি যখন ভুল্‌তে আমায়, আস্‌ত অনেক কেহ,
তখন  আমার হ’য়ে অভিমানে কাঁদত যে ঐ গেহ।
   যেদিক পানে চাইতে সেথা
   বাজ্‌তে আমার স্মৃতির ব্যথা,
   সে গ্লানি আজ ভুলবে হেথা
     নতুন আলাপনে।
  আমিই শুধু হারিয়ে গেলেম হারিয়ে-যাওয়ার বনে।।

আমার  এত দিনের দূর ছিল না সত্যিকারের দুর,
ওগো  আমার সুদুর ক’রত নিকট ঐ পুরাতন পুর।
   এখন তোমার নতুন বাঁধন
   নতুন হাসি, নতুন কাঁদন,
   নতুন সাধন, গানের মাতন
     নতুন আবাহনে।
  আমারই সুর হারিয়ে গেল সুদুর পুরাতন।।

সখি!  আমার আশাই দুরাশা আজ, তোমার বিধির বর,
আজ  মোর সমাধির বুকে তোমার উঠবে বাসর-ঘর!
   শূণ্য ভ’রে শুনতে পেনু
   ধেনু-চরা বনের বেণু-
   হারিয়ে গেনু হারিয়ে গেনু
     অন–দিগঙ্গনে।
  বিদায় সখি, খেলা-শেষ এই বেলা-শেষের খনে!
  এখন তুমি নতুন মানুষ নতুন গৃহকোণে।।

পথহারা

বেলা শেষে উদাস পথিক ভাবে,
সে যেন কোন অনেক দূরে যাবে –
         উদাস পথিক ভাবে।

‘ঘরে এস’ সন্ধ্যা সবায় ডাকে,
‘নয় তোরে নয়’ বলে একা তাকে;
পথের পথিক পথেই বসে থাকে,
জানে না সে কে তাহারে চাবে।
         উদাস পথিক ভাবে।

বনের ছায়া গভীর ভালোবেসে
আঁধার মাথায় দিগবধূদের কেশে,
ডাকতে বুঝি শ্যামল মেঘের দেশে
শৈলমূলে শৈলবালা নাবে –
         উদাস পথিক ভাবে।

বাতি আনি রাতি আনার প্রীতি,
বধূর বুকে গোপন সুখের ভীতি,
বিজন ঘরে এখন সে গায় গীতি,
একলা থাকার গানখানি সে গাবে –
         উদাস পথিক ভাবে।

হঠাত্‍ তাহার পথের রেখা হারায়
গহন বাঁধায় আঁধার-বাঁধা কারায়,
পথ-চাওয়া তার কাঁদে তারায় তারায়
আর কি পূবের পথের দেখা পাবে
         উদাস পথিক ভাবে।

পউষ

পউষ এলো গো!
    পউষ এলো অশ্র”-পাথার হিম পারাবার পারায়ে
ঐ যে এলো গো-
    কুজঝটিকার ঘোম্‌টা-পরা দিগন-রে দাঁড়ায়ে।।
সে এলো আর পাতায় পাতায় হায়
বিদায়-ব্যথা যায় গো কেঁদে যায়,
অস্ত-বধূ (আ-হা) মলিন চোখে চায়
    পথ-চাওয়া দীপ সন্ধ্যা-তারায় হারায়ে।।

পউষ এলো গো-
    এক বছরের শ্রানি- পথের, কালের আয়ু-ক্ষয়,
    পাকা ধানের বিদায়-ঋতু, নতুন আসার ভয়।
পউষ এলো গো! পউষ এলো-
শুক্‌নো নিশাস্‌, কাঁদন-ভারাতুর
বিদায়-ক্ষণের (আ-হা) ভাঙা গলার সুর-
‘ ওঠে পথিক! যাবে অনেক দূর
কালো চোখের কর”ণ চাওয়া ছাড়ায়ে।।’

কবি-রানি

তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমায় ভালোবাসার ছবি।।
    আপন জেনে হাত বাড়ালো-
    আকাশ বাতাস প্রভাত-আলো,
    বিদায়-বেলার সন্ধ্যা-তারা
      পুবের অরুণ রবি,-
তুমি ভালোবাস ব’লে ভালোবাসে সবি?

আমার আমি লুকিয়েছিল তোমার ভালোবাসায়,
    তুমিই আমার মাঝে আসি’
    অসিতে মোর বাজাও বাঁশি,
    আমার পূজার যা আয়োজন
      তোমার প্রাণের হবি।
আমার বাণী জয়মাল্য, রাণি! তোমার সবি।।

তুমি আমায় ভালোবাস তাই তো আমি কবি।
আমার এ রূপ-সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।।

আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে

আজ     সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–
মোর     মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
                আজ     সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।

    আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে –
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে।
                        আসল হাসি, আসল কাঁদন
                        মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।
            ঐ         রিক্ত বুকের দুখ আসে –
            আজ       সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

                        আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ
                        সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
                        ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে!
                        ঐ     ধূমকেতু আর উল্কাতে
                        চায়     সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,

আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে
                        আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
              আজ     হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
                        মদন মারে খুন-মাখা তূণ
                        পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
                        ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
               গো     দিগ বালিকার পীতবাসে;

আজ     রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
                আজ     সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
                আজ     কপট কোপের তূণ ধরি,
                ঐ       আসল যত সুন্দরী,
    কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন,
            কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে!
তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে
            ঐ    তাদের কথা শোনাই তাদের
                    আমার চোখে জল আসে
            আজ   সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!

            আজ     আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
                      আসল নিকট, আসল সুদূর
                      আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
                      পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে!
             ঐ      আসল আশিন শিউলি শিথিল
                      হাসল শিশির দুবঘাসে
            আজ     সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!

            আজ     জাগল সাগর, হাসল মরু
                      কাঁপল ভূধর, কানন তরু
                      বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
                      ভৈরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।

মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে।
                আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
                আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!

কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা l দোলনচাঁপা কবিতা

অভিশাপ

যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে-
                      বুঝবে সেদিন বুঝবে!
                  ছবি আমার বুকে বেঁধে
                  পাগল হ’লে কেঁদে কেঁদে
                  ফিরবে মর” কানন গিরি,
                  সাগর আকাশ বাতাস চিরি’
                  যেদিন আমায় খুঁজবে-
                      বুঝবে সেদিন বুঝবে!

স্বপন ভেঙে নিশুত্‌ রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে,
কাহার যেন চেনা-ছোঁওয়ায় উঠবে ও-বুকে ছমকে,-
                      জাগবে হঠাৎ চমকে!
                  ভাববে বুঝি আমিই এসে 
                  ব’সনু বুকের কোলটি ঘেঁষে,
                  ধরতে গিয়ে দেখবে যখন
                  শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!
                  বেদ্‌নাতে চোখ বুঁজবে-
                      বুঝবে সেদিন বুজবে।

গাইতে ব’সে কন্ঠ ছিঁড়ে আস্‌বে যখন কান্না,
ব’লবে সবাই-“ সেই য পথিক তার শেখানো গান না?’’
                      আস্‌বে ভেঙে কান্না!
                  প’ড়বে মনে আমার সোহাগ,
                  কন্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ!
                  প’ড়বে মনে অনেক ফাঁকি
                  অশ্র”-হারা কঠিন আঁখি
                  ঘন ঘন মুছবে-
                      বুঝ্‌বে সেদিন বুঝবে!

আবার যেদিন শিউলি ফুটে ভ’রবে তোমার অঙ্গন,
তুলতে সে ফুল গাঁথতে মালা কাঁপবে তোমার কঙ্কণ-
                      কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন!
                  শিউলি ঢাকা মোর সমাধি
                  প’ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি’!
                  বুকের মালা ক’রবে জ্বালা
                  চোখের জলে সেদিন বালা
                  মুখের হাসি ঘুচবে-
                      বুঝবে সেদিন বুঝবে!

আসবে আবার আশিন-হাওয়া, শিশির-ছেঁচা রাত্রি,
থাকবে সবাই – থাকবে না এই মরণ-পথের যাত্রী!
                      আসবে শিশির-রাত্রি!
                  থাকবে পাশে বন্ধু স্বজন,
                  থাকবে রাতে বাহুর বাঁধন,
                  বঁধুর বুকের পরশনে
                  আমার পরশ আনবে মনে-
                  বিষিয়ে ও-বুক উঠবে-
                      বুঝবে সেদিন বুঝবে!

আসবে আবার শীতের রাতি, আসবে না ক আ সে-
তোমার সুখে প’ড়ত বাধা থাকলে যে-জন পার্শ্বে,
                      আসবে না ক’ আর সে!
                  প’ড়বে মনে, মোর বাহুতে
                  মাথা থুয়ে যে-দিন শুতে,
                  মুখ ফিরিয়ে থাকতে ঘৃণায়!
                  সেই স্মৃতি তো ঐ বিছানায়
                  কাঁটা হ’য়ে ফুটবে-
                      বুঝবে সেদিন বুঝবে!

আবার গাঙে আসবে জোয়ার, দুলবে তরী রঙ্গে,
সেই তরীতে হয়ত কেহ থাকবে তোমার সঙ্গে-
                      দুলবে তরী রঙ্গে,
                  প’ড়বে মনে সে কোন্‌ রাতে
                  এক তরীতে ছিলেম সাথে,
                  এমনি গাঙ ছিল জোয়ার,
                  নদীর দু’ধার এমনি আঁধার
                  তেম্‌নি তরী ছুটবে-
                      বুঝবে সেদিন বুঝবে!

তোমার সখার আসবে যেদিন এমনি কারা-বন্ধ,
আমার মতন কেঁদে কেঁদে হয়ত হবে অন্ধ-
                      সখার কারা-বন্ধ!
                  বন্ধু তোমার হান্‌বে হেলা
                  ভাঙবে তোমার সুখের মেলা;
                  দীর্ঘ বেলা কাটবে না আর,
                  বইতে প্রাণের শান- এ ভার
                  মরণ-সনে বুঝ্‌বে-
                      বুঝবে সেদিন বুঝ্‌বে!

ফুট্‌বে আবার দোলন চাঁপা চৈতী-রাতের চাঁদনী,
আকাশ-ছাওয়া তারায় তারায় বাজবে আমার কাঁদ্‌নী-
                      চৈতী-রাতের চাঁদ্‌নী।
                  ঋতুর পরে ফির্‌বে ঋতু,
                  সেদিন-হে মোর সোহাগ-ভীতু!
                  চাইবে কেঁদে নীল নভো গা’য়,
                  আমার মতন চোখ ভ’রে চায়
                  যে-তারা তা’য় খুঁজবে-
                      বুঝ্‌বে সেদিন বুঝ্‌বে!

আস্‌বে ঝড়, নাচবে তুফান, টুটবে সকল বন্ধন,
কাঁপবে কুটীর সেদিন ত্রাসে, জাগবে বুকে ক্রন্দন-
                      টুটবে যবে বন্ধন!
                  পড়বে মনে, নেই সে সাথে
                  বাঁধবে বুকে দুঃখ-রাতে-
                  আপনি গালে যাচবে চুমা,
                  চাইবে আদর, মাগ্‌বে ছোঁওয়া,
                  আপনি যেচে চুমবে-
                      বুঝবে সেদিন বুঝবে।

আমার বুকের যে কাঁটা-ঘা তোমায় ব্যথা হান্‌ত,
সেই আঘাতই যাচবে আবার হয়ত হ’য়ে শ্রান–
                      আসবে তখন পান’।
                  হয়ত তখন আমার কোলে
                  সোহাগ-লোভে প’ড়বে ঢ’লে,
                  আপনি সেদিন সেধে কেঁদে
                  চাপ্‌বে বুকে বাহু বেঁধে,
                  চরণ চুমে পূজবে-
                      বুঝবে সেদিন বুঝবে!

সে যে চাতকই জানে

সে যে           চাতকই জানে তার মেঘ এত কি,
যাচে             ঘন ঘন বরিষণ কেন কেতকী!
চাঁদে             চকোরই চেনে আর চেনে কুমুদী,
জানে            প্রাণ কেন প্রিয়ে প্রিয়-তম চুমু দি!

ব্যথা-গরব

তোমার কাছে নাই অজানা কোথায় আমার ব্যথা বাজে।
ওগো প্রিয়! তবু এত ছল করা কি তোমার সাজে?

কেন তোমার অনাদরে বক্ষ আমার ডুকরে ওঠে,
চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ে, কলজে ছিঁড়ে রক্ত ছোটে,
        এ অভিমান এ ব্যথা মোর
        জানি, জানো, হে মনোচোর,
        তবু কেন এমন কঠোর
              বুঝতে আমি পারি না যে!
              অন্‌হেলা না পুলক-লাজে॥

যখন ভাবি আমার আদর কতই তোমায় হানে বেদন
বুকের ভিতর আছড়ে পড়ে অসহায়ের হুতাশ রোদন।
        যতই আমায় সইতে নারো
        আঁকড়ে ততই ধরি আরো;
        মারো প্রিয় আরো মারো
               তোমার আঘাত-চিহ্ন রাজে
               যেন আমার বুকের মাঝে॥

মনে পড়ে সেদিন তুমি ঘুমিয়ে ছিলে অঘোর ঘুমে
এ দীন কাঙাল এসেছিল তোমার পায়ের আঙুল চুমে।
        আমার অশ্রু-আঘাত লেগে
        চমকে তুমি উঠলে জেগে
        চরণ-আঘাত করলে রেগে
              সেই পরশের সান্ত্বনা যে
              আজো আমার মর্মে রাজে॥
এমনি তোমার পদ্মপায়ের আঘাত-সোহাগ দিয়ো দিয়ো
এই ব্যথিত বুকে আমার, ওগো নিঠুর পরান-প্রিয়!
      সেই পদ-চিন বক্ষে রেখে
      ভগবানে কইব ডেকে–
      'ছাই ভৃগুপদ, যাও হে দেখে
               কি কৌস্তুভ এ হিয়ায় রাজে!'
               মরবে হরি হিংসা-লাজে॥

বিষ্ণুজয়ী ভালোবাসার গর্বে এ বুক উঠবে দুলে,
সর্বহারার হাহাকার আর কাঁদবে নাকো চিত্ত-কূলে।
      এই যে তোমার অবহেলা
      তাই নিয়ে মোর কাটবে বেলা,
      হেলাফেলার বসবে মেলা,
              একলা আমার বুকের মাঝে,
              সুখে দুখে সকল কাজে॥

উপেক্ষিত

কান্না-হাসির খেলার মোহে অনেক আমার কাটল বেলা,
কখন তুমি ডাক দেবে মা, কখন আমি ভাঙব খেলা?
      অজানাকে আনতে জিনে
      জগৎটাকে ফেলনু চিনে,
      চাই যারে মা তায় দেখিনে
                ফিরে এনু তাই একেলা
পরাজয়ের লজ্জা নিয়ে বক্ষে বিঁধে অবহেলা॥

আজকে বড় শ্রান্ত আমি আশায় আশায় মিথ্যা ঘুরে,
ও মা এখন বুকে ধরো মরণ আসে ঐ অদূরে!
     সৃষ্টিটাকে পায়ের তলে
     এসেছি মা হেলায় সলে,
     হৃদয় শুধু জিনতে বলে
                খেয়ে এনু পায়ের ঠেলা
আর সহে না মাগো এখন আমায় নিয়ে হেলাফেলা॥

বিশ্বজয়ের গর্ব আমার জয় করেছে ঐ পরাজয়,
ছিন্ন-আশা নেতিয়ে পড়ে, ও মা এসে দাও বরাভয়!
     চারদিকে মা প্রবঞ্চনা
     ভালোবাসার গিল্টিসোনা,
     আজ মণি কাল ধূলি-কণা,
                 জুয়ার হাট এই প্রেমের মেলা!
খুইয়েছি সব সাধের খেলায়, বুক ভেঙেছে হেলার ঢেলা!
এখন তুমি নাও মা কোলে, নয় অকূলে ভাসাই ভেলা॥

চপল সাথী

প্রিয়!      সামলে ফেলে চলো এবার চপল তোমার চরণ!
তোমার   ঐ চলাতে জড়িয়ে গেছে আমার জীবন-মরণে॥
কোথায়   দূরে নূপুর বাজে তোমার পায়ে,
হেথায়    রোদন আমার ওঠে উথলায়ে,
তোমার   উদাসীন ঐ বিষম চলার ঘায়ে
আজ      কাঁপে আমার সকল শরম-ভরম।
এখন     ঐ দ্বিধাহীন চরণ করো মোর বুকে সম্বরণ।
তোমার   ঐ চলাতে জড়িয়ে গেছে আমার জীবন-মরণে॥

তুমি       চলার ঝোঁকে দেখছো না হায় পড়ছে চরণ কোথায়,
                  ওগো     চপল পরান-প্রিয়!
হেরো    এবার তোমার পা পড়েছে আমার বুকের ব্যথায়
                  এখন    ধীরে চরণ নিয়ো।
তোমার  ঐ যে দোলন দোদুল-দোলা-চলায়,
আজ     পথ-পাগলের পথের নেশা ভোলায়,
এবার    থামাও সে দোল আমার বুকের তলায়,
আর      সরিয়ো না মোর ব্যথায়-বাজা চরণ।
আমার   ব্যথায় রেঙে হোক ও-চরণ নিখিল-মনোহরণে॥
ঐ        অধীর চরণ চলার নেশায় হলে বিপথগামী
                আমি    বাঁচব কি আর প্রিয়?
তোমার   বিপথ সে যে আমার তরে মৃত্যু-আঘাত, স্বামি!
               এখন    ধীরে চরণ নিয়ো।

ওগো    জানি জানি শুধু চলার সুখে
তুমি     পা ফেলেছ আমার ব্যথার বুকে,
ঐ        চলাই তোমার আমার গভীর দুখে,
শেষে    প্রেম হয়ে সে করল অবতরণ।
আজ     একা তোমার নয় ও-চরণ আমার নিখিল শরণ!
তোমার  ঐ চলাতে জড়িয়ে গেছে আমার জীবন-মরণ!
প্রিয়      সামলে ফেলো চলো এবার চপল তোমার চরণে॥

শেষ প্রার্থনা

আজ  চোখের জলে প্রার্থনা মোর শেষ বরষের শেষে
যেন  এমনি কাটে আস্‌ছ-জনম তোমায় ভালোবেসে।
          এমনি আদর, এমনি হেলা
          মান-অভিমান এমনি খেলা,
          এমনি ব্যথার বিদায়-বেলা
                      এমনি চুমু হেসে,
যেন  খণ্ডমিলন পূর্ণ করে নতুন জীবন এসে!
এবার ব্যর্থ আমার আশা যেন সকল প্রেমে মেশে!
আজ  চোখের জলে প্রার্থনা মোর শেষ বরষের শেষে॥

যেন  আর না কাঁদায় দ্বন্দ্ব-বিরোধ, হে মোর জীবন-স্বামী!
এবার এক হয়ে যাক প্রেমে তোমার তুমি আমার আমি!
          আপন সুখকে বড় করে
          যে-দুখ পেলেম জীবন ভরে,
          এবার তোমার চরণ ধরে
                   নয়ন-জলে ভেসে

যেন  পূর্ণ করে তোমায় জিনে সব-হারানোর দেশে,
মোর  মরণ-জয়ের বরণ-মালা পরাই তোমার কেশে।
আজ  চোখের জলে প্রার্থনা মোর শেষ-বিদায়ের শেষে॥

আশা

আমি  শ্রান্ত হয়ে আসব যখন পড়ব দোরে টলে,
আমার লুটিয়ে-পড়া দেহ তখন ধরবে কি ঐ কোলে?
          বাড়িয়ে বাহু আসবে ছুটে?
          ধরবে চেপে পরান-পুটে?
          বুকে রেখে চুমবে কি মুখ
              নয়ন-জলে গলে?
আমি  শ্রান্ত হয়ে আসব যখন পড়ব দোরে টলে!

তুমি  এতদিন যা দুখ দিয়েছ হেনে অবহেলা,
তা   ভুলবে না কি যুগের পরে ঘরে-ফেরার বেলা?
          বলো বলো জীবন-স্বামী,
          সেদিনও কি ফিরব আমি?
          অন্তকালেও ঠাঁই পাব না
              ঐ চরণের তলে?
আমি  শ্রান্ত হয়ে আসব যখন পড়ব দোরে টলে!

সমর্পণ

প্রিয়!
        এবার আমায় সঁপে দিলাম তোমার চরণ-তলে।
        তুমি শুধু মুখ তুলে চাও, বলুক যে যা বলে॥
               তোমার আঁখি কাজল-কালো
                     অকারণে লাগল ভালো
                            লাগল ভালো,
               পথিক আমার পথ ভুলাল
                         সেই নয়নের জলে।
          আজকে বনের পথ হারালেম ঘরের পথের ছলে।
          তুমি শুধু মুখ তুলে চাও, বলুক যে যা বলে॥

আজ    দিগ্‌বালিকার আঁখি-পাতা অনেক দূরের কানন-ছায়ে
                        কাঁপচে অভিমানে,
         একলা-আমার পথ দেখাত ঐ বালিকাই চপল পায়ে
                       দিক হতে দিক-পানে!
             মুঠার মানিক ঠেলে পায়ে
                   এলেম তোমার কুটির ছায়ে
                           চরণ-ছায়ে,
             ক্লান্তি আমার দাও মুছায়ে
                           দীপ-ঢাকা অঞ্চলে।
আপন মালা পরাও বালা পরাও আমার গলে!
এবার আমায় সঁপে দিলাম তোমার চরণ-তলে॥

বেলাশেষে

 ধরণী দিয়াছে তার
          গাঢ় বেদনার
রাঙা মাটি-রাঙা ম্লান ধূসর আঁচলখানি
          দিগন্তের কোলে কোলে টানি।
পাখি উড়ে যায় যেন কোন মেঘ-লোক হতে
সন্ধ্যা-দীপ-জ্বালা গৃহ-পানে ঘর-ডাকা পথে।
         আকাশের অস্ত-বাতায়নে
অনন্ত দিনের কোন্ বিরহিণী কনে
        জ্বালাইয়া কনক-প্রদীপখানি
উদয়-পথের পানে যায় তার অশ্রু-চোখ হানি?
‘আসি’-বলে চলে যাওয়া বুঝি তার প্রিয়তম আশে,
অস্ত-দেশ হয়ে ওঠে মেঘ-বাষ্প-ভারাতুর তারি দীর্ঘশ্বাসে।
        আদিম কালের ঐ বিষাদিনী বালিকার পথ-চাওয়া চোখে–
         পথ-পানে-চাওয়া-ছলে দ্বারে-আনা সন্ধ্যা-দীপালোকে
                     মাতা বসুধার মমতার ছায়া পড়ে।
        করুণার কাঁদন ঘনায় নত-আঁখি স্তব্ধ দিগন্তরে।

কাঙালিনী ধরা-মা’র অনাদি কালের কত অনন্ত বেদনা
হেমন্তের এমনি সন্ধ্যায় যুগ যুগ ধরি বুঝি হারায় চেতনা।
        উপুড় হইয়া সেই স্তূপীকৃত বেদনার ভার
        মুখ গুঁজে পড়ে থাকে; ব্যথা-গন্ধ তার
        গুমরিয়া গুমরিয়া কেঁদে কেঁদে যায়
        এমনি নীরবে শান্ত এমনি সন্ধ্যায়।...
ক্রমে নিশীথিনী আসে ছড়াইয়া ধূলায়-মলিন এলোচুল,
সন্ধ্যা-তারা নিবে যায়, হারা হয় দিবসের কূল।...

          তারি মাঝে কেন যেন অকারণে হায়
আমার দুচোখ পুরে বেদনার ম্লানিমা ঘনায়।
          বুকে বাজে হাহাকার-করতালি,
কে বিরহী কেঁদে যায় ‘খালি, সব খালি!
ঐ নভ, এই ধরা, এই সন্ধ্যালোক,
নিখিলের করুণা যা-কিছু, তোর তরে তাহাদের অশ্রুহীন চোখ!'
                মনে পড়ে-তাই শুনে মনে পড়ে মম
      কত না মন্দিরে গিয়া পথের সে লাথি-খাওয়া ভিখারির সম
                      প্রসাদ মাগিনু আমি–
       'দ্বার খোলো, পূজারী দুয়ারে তব আগত যে স্বামী!'
      খুলিল দুয়ার, দেউলের বুকে দেখিনু দেবতা,
      পূজা দিনু রক্ত-অশ্রু, দেবতার মুখে নাই কথা।

                     হায় হায় এ যে সেই অশ্রুহীন-চোখ,
       কেঁদে ফিরি, ওগো এ কি প্রেমহীন অনাদর-হানস দেবলোক!
                     ওরে মূঢ়! দেবতা কোথায়?
       পাষাণ-প্রতিমা এরা, অশ্রু দেখে নিষ্পলক অকরুণ মায়াহীন
                                       চোখে শুধু চায়।
       এরাই দেবতা, যাচি প্রেম ইহাদেরই কাছে,
       অগ্নি-গিরি এসে যেন মরুভূর কাছে হায় জল-ধারা যাচে।   
আমার সে চারি পাশে ঘরে ঘরে কত পূজা কত আয়োজন,
তাই দেখে কাঁদে আর ফিরে ফিরে চায় মোর ভালোবাসা-ক্ষুধাতুর মন,
                  অপমানে পুন ফিরে আসে,
ভয় হয়, ব্যাকুলতা দেখি মোর কি জানি কখন কে হাসে।
                 দেবতার হাসি আছে, অশ্রু নাই;
ওরে মোর যুগ-যুগ-অনাদৃত হিয়া, আয় ফিরে যাই।...
এই সাঁঝে মনে হয়, শূন্য চেয়ে আরো এক মহাশূন্য রাজে
দেবতার-পায়ে-ঠেলা এই শূন্য মম হিয়া-মাঝে।
                আমার এ ক্লিষ্ট ভালোবাসা,
                তাই বুঝি হেন সর্বনাশা।
প্রেয়সীর কণ্ঠে কভু এই ভুজ এই বাহু জড়াবে না আর,
উপেক্ষিত আমার এ ভালোবাসা মালা নয়, খর তরবার।

দোলনচাঁপা বাংলা সাহিত্য l দোলনচাঁপা কবিতা রচনা

দোদুল দুল

[আরবি ‘মোতাকারিব্’ ছন্দ]

     দোদুল দুল্
     দোদুল দুল্!
     বেণীর বাঁধ
     আলগ্-ছাঁদ,
     আলগ্-ছাঁদ
     খোঁপার ফুল,
     কানের দুল
     খোঁপার ফুল
     দোদুল দুল্
     দোদুল দুল!

                   অলক-ছায়
                   কপোল-ছায়,
                   পরশ চায়
                   অলস চুল
                   বিনুন্-বিন্
                   কেশের উল
                   দোদুল দুল্
                   দোদুল দুল!

     অসম্বৃত্
     কাঁখের ভিত
     অসম্বৃত্
     পিঠের চুল,
     লোহিত পীত
     নোলক দুল
     দোদুল দুল্
     দোদুল দুল!

                   সোহাগ্-ঘায়
                   দোলন্-গায়
                   কাঁপন খায়
                   আপন পায়,
                   পায়ের নখ
                   মাথার চুল
                   দোদুল দুল্
                   দোদুল দুল!
                   পরাগ-ফাগ
                   ছড়ায় আজ
                   শিরাজ-বাগ
                   ইরান-গুল,
                   দোলন্-দোল
                   দে বুলবুল,
                   দোদুল দুল্
                   দোদুল দুল!

     কাঁকন চায়
     নাচন্ ফিন্
     রিমিক ঝিম
     ঝিমিক ঝিম!
     আঁচল-বীণ
     চাবির রিং
     বুলায় নিদ
     ঢুলায় ঢুল্ৰ
     দোদুল দুল্
     দোদুল দুল!

                    নিশাস-রেশ
                    কাঁপায় বেশ
                    মোতির হার
                    হিয়ার দেশ,
                    কাঁপায় শেষ
                    প্রাণের কূল
                    দোদুল দুল্
                    দোদুল দুল!
                    বুকের কোল
                    আদর ঘায়
                    দোলায় দোল্
                    দোলায় দোল্
                    শরম-লোল
                    মরম-মূল
                    দোদুল দুল্
                    দোদুল দুল!

     কলস্-কাঁখ
     পুকুর যায়,
     আঁচল চায়
     চুমায় ধুল,
     দখিন্ হাত
     ঝুলন্ ঝুল্
     দোদুল দুল্
     দোদুল দুল!
     কাঁকাল ক্ষীণ
     মরাল গ্রীব
     ভুলায় জড়্-
     ভুলায় জীব,
     গমন-দোল্
     অতুল তুল্
     দোদুল দুল্
     দোদুল দুল!

                  হাসির ভাস,
                  ব্যথার শ্বাস,
                  চপল চোখ,
                  আঁখির লাস,
                  নয়ন-নীর
                  অধর-ফুল
                  রাতুল তুল
                  রাতুল তুল
                  দোদুল দুল্
                  দোদুল দুল!
                  মৃণাল-হাত
                  নয়ন-পাত
                  গালের টোল,
                  চিবুক দোল
                  সকল কাজ
                  করায় ভুল
                  প্রিয়ার মোর
                  কোথায় তুল?
                  কোথায় তুল
                  কোথায় তুল?
                  স্বরূপ তার
                  অতুল তুল,
                  রাতুল তুল,
                  কোথায় তুল
                  দোদুল দুল্
                  দোদুল দুল!

সাধের ভিখারিনী

তুমি  মলিন বাসে থাকো যখন, সবার চেয়ে মানায়!
তুমি  আমার তরে ভিখারিনী, সেই কথা সে জানায়!
          জানি, প্রিয়ে, জানি জানি,
          তুমি হতে রাজার রানি,
          খাটত দাসী, বাজত বাঁশি
              তোমার বালাখানায়।
তুমি   সাধ করে আজ ভিখারিনী, সেই কথা সে জানায়ি॥

দেবি!  তুমি সতী অন্নপূর্ণা, নিখিল তোমার ঋণী,
শুধু     ভিখারিকে ভালোবেসে সাজলে ভিখারিনী।
          সব ত্যাজি মোর হলে সাথী,
          আমার আশায় জাগচ রাতি,
          তোমার পূজা বাজে আমার
              হিয়ার কানায় কানায়!
তুমি   সাধ করে মোর ভিখারিনী, সেই কথা সে জানায়॥

মুখরা

আমার      কাঁচা মনে রঙ ধরেচে আজ,
        ক্ষমা করো মা গো আমার আর কি সাজে লাজ?
আমার      কাঁচা মনে রঙ ধরেচে আজ॥

         আমার ভুবন উঠচে রেঙে
         তার পরশের সোহাগ লেগে,
         ঘুমিয়ে ছিনু দেখনু জেগে মা,
আমায়     জড়িয়ে বুকে দাঁড়িয়ে আছেন নিখিল হৃদয়-রাজ!
             ক্ষমা করো মা গো আমার আর কি সাজে লাজ?

 আমায়    দিনের আলোয় নিলেন বুকে আপনি লজ্জাহারী!
             মা গো, আমি আর কি মিথ্যা লজ্জা করে পারি?
আমায়     দিনের আলোয় নিলেন বুকে আপনি লজ্জাহারী!
                 জগৎ যারে পায় না সেধে
                 সেই সে যখন সাধছে কেঁদে
                আমার চরণ বক্ষে বেঁধে মা,
আমি      বাঁধব না চুল, এই ভালো মোর ভিখারিনীর সাজ।
            ক্ষমা করো মা গো আমার আর কি সাজে লাজ?

আমার     কিসের সজ্জা, কিসের লজ্জা, কিসের পরানপণ?
মা গো     বক্ষে আমার বিশ্বলোকের চির-চাওয়া ধন,
আমার     কিসের সজ্জা, কিসের লজ্জা, কিসের পরানপণ?


               বিশ্ব-ভুবন যার পদছায়
               সেই এসে হায় মোর পদ চায়,
আমার     সুখ-আবেগে বুক ফেটে যায় মা,
আজ       লাজ ভুলেছি, সাজ ভুলেছি, ভুলেছি সব কাজ।
             ক্ষমা করো মা গো আমার আর কি সাজে লাজ?

আশান্বিতা

আবার কখন আসবে ফিরে সেই আশাতে জাগব রাত,
হয়তো সে কোন নিশুত রাতে ডাকবে এসে অকস্মাৎ!
     সেই আশাতে জাগব রাত।
     যতই কেন বেড়াও ঘুরে
     মরণ-বনের গহন জুড়ে
                       দূর সুদূরে,
কাঁদলে আমি আসবে ছুটে, রইতে দূরে নারবে নাথ,
                     সেই আশাতে জাগব রাত।

কপট! তোমার শপথ-পাহাড় বিন্ধ্যসম হোক না সে,
ঝড়ের মুখে খড়ের মতন উড়বে তা মোর নিশ্বাসে!
                     একটি ছোট্ট নিশ্বাসে!
         রাত্রি জেগে কাঁদছি আমি
         শুনবে যখন, হে মোর স্বামি,
                        সুদূরগামী!
আগল ভেঙে আসবে পাগল, চুমবে সজল নয়ন-পাত,
                  সেই আশাতে জাগব রাত।

জানি সখা, আমার চোখের একটি বিন্দু অশ্রুজল,
নিববে তাতেই তোমার বুকের অগ্নি-সিন্ধু নীল গরল,
                     আমার চোখের অশ্রুজল!
         তোমার আদর-সোহাগিনী
         তাই তো কাঁদায় নিশিদিনই
                         এ অধীনী,
ভুলবে জানি তোমার রানি গরবিনীর সব আঘাত!
                  সেই আশাতে জাগব রাত।

আসবে আবার পদ্মানদী, দুলবে তরী ঢেউ-দোলায়,
তেমনি করে দুলব আমি তোমার বুকের পরকোলায়।
          দুলবে তরী ঢেউ-দোলায়।
         পাগ্‌লি নদী উঠবে খেপে,
         তোমায় তখন ধরব চেপে
                       বক্ষ ব্যেপে,
মরণ-ভয়কে ভয় কি তখন, জড়িয়ে কণ্ঠ থাকবে হাত!
                সেই আশাতে জাগব রাত।

পোড়া চোখের জল ফুরায় না, কেমন করে আসবে ঘুম?
মনে পড়ে শুধু তোমার পাতাল-গভীর মাতাল চুপ,
          কেমন করে আসবে ঘুম?
         আজ যে আমার নিশীথ জুড়ে
         একলা থাকার কান্না ঝুরে
                     হতাশ সুরে,
পুবের হাওয়ায় সে সুর, আসবে পছিম হাওয়ার সাথ!
               সেই আশাতে জাগব রাত।

বিজলি-শিখার প্রদীপ জ্বেলে ভাদর রাতের বাদল মেঘ,
দিগ্বিদিকে খুঁজছে তোমায় ডাকছে কেঁদে বজ্র-বেগ–
          দিগ্বিদিকে খুঁজছে মেঘ!
          তোমার আশায় ঐ আশা-দীপ
          জ্বালিয়েছে আজ দিক ভরে নীপ,
                    হে রাজ-পথিক,
আজ না আসো, এসো যেদিন দীপ নিবাবে ঝন্‌ঝবাত!
                  সেই আশাতে জাগব রাত।

পুবের চাতক

সকাল-সাঁঝে চেয়ে থাকি পুব-গগনের পানে
          কেন যে তা তার আঁখি আর আমার আঁখিই জানে।
নদীপারের দেশে থাকি           এমনি তারও আঁখি-পাখি
          দিগ্‌বালিকার পুব-কপোলে চাওয়ার পাখা হানে।
          চাওয়ায় চাওয়ায় চুমোচুমি রোজ মোদের ওইখানে।
  
          মোদের চোখের চুমুর মিলন ভোরের তারার পুবে,
          সেই মিলনের ভরাট পুলক অস্তঘাটে ডুবে।
হারা সে চোখ নতুন করে          ভোরের আলোয় উঠে ভরে
          নিশি-জাগা আঁখির লালি লাগে ঊষার প্রাণে।
          দূরের দেখা দুইটি চাওয়ায় করুণ রেখা টানে।
  
          উদয়ঘাটে হাসে যখন পোড়ারমুখি শশী
          শশীর মুখে চেয়ে ভাবি শশী তো নয় দোষী।
তার চোখে ওই কাজল-রাগই          রুচির চাঁদে করলে দাগি
          কলঙ্কী চাঁদ কাজল-আঁখির সজল চাওয়ার বাণে।
          দোষী শশীর কলঙ্ক তার আঁখির স্মৃতি আনে।
  
          পুবের দেশের চাতক আমি চাই নাকো আন্ পানে,
          তাই তো সে-ও তার চাহনি পুব গগনেই হানে।
সে থাকে মোর উদয়-দেশে          তাই সে দেশে ভালোবেসে
          তাকাই না গো পিছন পানের অস্তমরূদ্যানে,
          পাছে তাহার বাজে ব্যথা কোমল অভিমানে।
  
          যেদিন আমি বিদায় নেব শেষের খেয়া বেয়ে
          জানি না তার আঁখি সেদিন থাকবে কোথায় চেয়ে।
তাই তো এমন মিটিয়ে ক্ষুধা          চোখ ভরে পিই চোখের সুধা
          দূরের বেদন ভুলায় মোর ওই চাউনি-তরঙ গানে।
          এবার এ চোখ হারিয়ে গেলাম পুবের পরিস্থানে।

Best selling smartwatches in India 

 The smartwatch market in India has witnessed a significant surge in popularity, offering a wide range of options for tech enthusiasts and fitness lovers alike. With advanced features like heart rate monitoring, GPS tracking, and seamless smartphone integration, these wearables have become an essential part of our daily lives. In this blog, we’ll explore the best selling smartwatches in India, helping you make an informed decision to find the perfect match for your lifestyle and needs. Whether you’re a fitness enthusiast, a tech geek, or someone looking to stay connected on the go, we’ve got you covered with the top choices that are winning hearts across the nation.

Fire-Boltt Newly Launched Ninja Call Pro Max 2.01” Display Smart Watch, Bluetooth Calling, 120+ Sports Modes, Health Suite, Voice Assistance

Fire-Boltt Phoenix Smart Watch with Bluetooth Calling 1.3″,120+ Sports Modes, 240 * 240 PX High Res with SpO2, Heart Rate Monitoring & IP67 Rating (Gold Pink)

Fastrack FS1 Pro Smartwatch|1.96″ Super AMOLED Arched Display with High Resolution of 410X502|Singlesync BT Calling|Nitrofast Charging|110+ Sports Modes|200+ Watchfaces

NoiseFit Halo 1.43″ AMOLED Display, Bluetooth Calling Round Dial Smart Watch, Premium Metallic Build, Always on Display, Smart Gesture Control, 100 Sports Modes (Fiery Orange)

Fire-Boltt Newly Launched Ninja Call Pro Max 2.01” Display Smart Watch, Bluetooth Calling, 120+ Sports Modes, Health Suite, Voice Assistance

Noise Pulse 2 Max 1.85″ Display, Bluetooth Calling Smart Watch, 10 Days Battery, 550 NITS Brightness, Smart DND, 100 Sports Modes, Smartwatch for Men and Women (Deep Wine)

Titan Smart 3 Premium Smart Watch|1.96″ Super AMOLED Display with 410×502 Pixel Resolution|SingleSync BT Calling|NitroFast Charging|110+ Sports Modes|200+ Watchfaces|Upto 7 Days Battery (Black)

CrossBeats Nexus 2.01” Super AMOLED Display Smart Watch with ChatGPT-Powered| Dynamic Island| 5.3 Bluetooth Calling Smartwatch| Always on| in-app GPS| 60 Hz Refresh Rate | AI Health Tracker -(Black)

raateralo.com

Leave a Comment