শ্রীকান্তের ভ্রমণকাহিনী – শিবরাম চক্রবর্তী: বাংলা সাহিত্যের অনন্য ধ্রুবতারা শিবরাম চক্রবর্তীর সৃষ্টিশীলতার অপরূপ নিদর্শন হলো “শ্রীকান্তের ভ্রমণকাহিনী”। শ্রীকান্ত, একজন সাধারণ বাঙালি যুবক, তার অসাধারণ এবং রোমাঞ্চকর ভ্রমণের কাহিনী নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন এই লেখায়। শিবরামের সহজ, সরল, কিন্তু প্রাঞ্জল ভাষাশৈলী এবং তার চমকপ্রদ কৌতুকরস পাঠককে মুগ্ধ করতে বাধ্য।
শ্রীকান্তের ভ্রমণ শুধু যে ভৌগোলিক পরিভ্রমণ, তা নয়; বরং এটি একটি মানসিক এবং আত্মিক যাত্রাও। ভ্রমণের পথে শ্রীকান্তের নানান বিচিত্র অভিজ্ঞতা, হাস্যরসাত্মক ঘটনা এবং মানবিক সম্পর্কের গভীরতা পাঠকদের আনন্দ দেয় এবং একই সঙ্গে ভাবিয়ে তোলে।
শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর অনন্য কাহিনী বলার দক্ষতায় শ্রীকান্তের ভ্রমণকাহিনীকে করেছেন অনন্যসাধারণ। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই কাহিনীতে, আর পাঠকদেরকে নিয়ে গেছে এক অদ্ভুত, রোমাঞ্চকর যাত্রায়।
চলুন, শ্রীকান্তের সঙ্গে আমরাও বেরিয়ে পড়ি এই অদ্ভুত ভ্রমণে, আর শিবরামের অসাধারণ লেখনীর মাধ্যমে আবিষ্কার করি আমাদের চারপাশের জগৎ এবং আমাদের অন্তরের গভীরতা।
শ্রীকান্তের ভ্রমণকাহিনী – শিবরাম চক্রবর্তী
দেশবিদেশ বেড়াতে তোমরা সকলেই খুব ভালবাস। সব ছেলেই ভালবাসে। কিন্তু আমাদের শ্রীকান্তর। ভ্রমণে আনন্দ নেই, তার কাছে ভ্রমণের মানেই হচ্ছে দেড় মণ।
তার মামা ভারি কৃপণ কোথাও যেতে হলে গোটা বাড়িখানাই সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। কি জানি, বিদেশে কোনো জিনিসের দরকার পড়লে যদি সেটা আবার পয়সা খরচ করে কিনতে হয়! কিন্তু শ্রীকান্তর এদিকে প্রাণ যায় সেই বিরাট লটবহর তাকেই বইতে হয় কি না! সে-সব মালপত্র গাড়িতে তুলতেও শ্রীকান্ত, গাড়ি থেকে নামতেও শ্রীকান্ত, স্টেশনে যে কুলি নামক একজাতীয় জীবের অস্তিত্ব আছে, একথা শ্রীকান্তকে দেখলে মামা একদম ভুলে যান।
কেবল কুলির কাজ করেই কি নিষ্কৃতি আছে? তাকে সারা রাস্তা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় গাড়ির দরজায় পাহারা দিয়ে। কেন না মামার ধারণা, ওইভাবে দরজার মুখে মাথা গলিয়ে খাড়া থাকলে সে কামরার দিকে কেউ আর এগোয়ে না! এবং যে-কামরার দিকে কেউ এগোয় সেদিকে কেবল একজন নয়, সেই স্টেশনের যত ভোলদাস সবাই সেই কামরাটার দিকেই ঝুঁকে পড়ে–তা তার ভেতর জায়গা থাক বা না থাক। কিছু দূরে খালি কামরা থাকলেও সেদিকে তাদের যেন দৃষ্টি যায় না।
তার মামা আবার পারতপক্ষে মেল-গাড়িতে যান না, প্যাসেঞ্জার গাড়ি পেলে। যা দু-চার পয়সা বাঁচে। সময়ের আর কি মূল্য আছে বল? দু-ঘন্টা পরে পৌঁছলে যদি দুটো পয়সা বাঁচে, তারই দাম। প্যাসেঞ্জারে গাড়ির সব স্টেশন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়–দু-তিন মিনিট অন্তর স্টেশন–কাজেই একটুখানি বসতে না বসতে অবার গিয়ে দরজায় দাঁড়াতে হয়। রাত্রেও ছাড়ান নেই–কেন না তখন যাতে কামরাতে স্থান বাহুল্য না কমে, সেদিকে প্রখর দৃষ্টি রাখা দরকার। তার মামা আয়েসি লোক, সারারাত দিন গাড়িতেওবাড়ির মতো আরাম চান–তখন যদি অনাহুত কেউ এসে তার জায়গা জুড়ে বসবার জন্য তার ঘুম ভাঙতে চায়, তাহলে যে কি দুর্ঘটনাই ঘটে তা শ্রীকান্ত ভেবে পায় না। কাজেই রিজার্ভ কামরার নোটিশ বোর্ডের মতো তাকে গাড়ির দরজায় লটকে থাকতে হয়।
এই সব নানা কারণে ভ্রমণে শ্রীকান্তের সুখ নেই, শখও নেই। কিন্তু না চাইলেও অনেক জিনিস আপনি আসে। হাম হোক, কে আর চায়? কিন্তু হামেশাই তা হচ্ছে, ফেল হতে আর কোন ছেলের বাসনা, তবু কাউকে না কাউকে ফেল হতেই হয়।
যেমন আজ তাকে যেতে হচ্ছে। ছ্যাকরা গাড়ির ছাদে যা জিনিস ধরে তার চার গুণ চাপানো হয়েছে, গাড়ির মধ্যে শ্রীকান্ত, তার মামা এবং মামী, আর মামাতোবোন টেঁপি। কিন্তু তারই ফাঁকে গাড়ির ফোকরেও মালের কিছু কমতি নেই–জলের কুঁজো, হ্যারিকেন লণ্ঠন, হাতব্যাগ, ছাতা, পানের ডিবে, খাবারের চাঙ্গারি, টুকরো-টুকরো কত কি! কিন্তু এগুলোর জন্য শ্রীকান্তর ভাবনা নেই, কেন না এসব টেপির ভার–পানের ডিবে মামীমা সামলাবেন আর খাবারের চাঙ্গারি মামা। কিন্তু গাড়ি ছাদে বাক্স-তোরঙ্গ, বিছানার লাগেজ আর কাপড়-চোপড়ের বিপুলকায় হেন্ডঅল–ওসব এখন থেকেই যেন শীতের ঘাড়ে চেপে বসেছে।
শিয়ালদহ পৌঁছেই মামা সর্বাগ্রে নামলেন। নেমেই বললেন, ওগো হাতপাখাটা দাও তো! শ্রীকান্ত মোটঘাট সব নামা। ও বাপু কোচম্যান, তুমি একটু ধর, বুঝলে? আমি টিকিটগুলো কেটে আনি।
গাড়ি দাঁড়াতে জনকতক কুলী এসে জুটেছিল, তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মাল নামাতে গেল। মামা টিকিট কাটতে পা বাড়িয়েছিলেন, কিন্তু কুলীদের এই অয়াচিত কর্মস্পৃহা দেখে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন। বাধা দিলে বললেন, কি, তোমারা মাল নামাবে না কি? আবদার তো কম নয়! কেন, আমাদের কি হাত পা নেই?
একজন কুলী শ্রীকান্তর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে বলল, ওই বাচ্চা ছেলে, ওকি সেকবে বাবু?
কেন সেকবে না শুনি? ওদের বয়সে আমরা লোহা হজম করেছি। শ্রীকান্ত, সব চটপট নাবিয়ে ফেল, ও ব্যাটাদের ছুঁতে দিসনে। যাও, যাও, একি রুটি সেকা? এখন থেকেই ওকে সব শেকতে হবে। তোমরা সব যাও।
বলে যেভাবে মাছি তাড়ায় সেইভাবে কুলীদের তাড়াবার একটা চেষ্টা করলেন, কিন্তু তারা নড়ল না দেখে বললেন, দেখ বাপু মালে হাত দিও না, পয়সা পাবে না আগেই বলে দিচ্ছি।
এই কথা বলে টিকিট কিনতে চলে গেলেন। শ্রীকান্তের ইচ্ছা হল একবার বলে যে লোহা হজম করা যদিবা সম্ভব হয়, সেই লোহা বহন করা তত সহজ নয়। কিন্তু বলেই বা কি লাভ, সমালোচনা করলে তো লোহার ওজন কমবে না, এই ভেবে সে আস্তে আস্তে বাক্স-পেঁটরা, বাসনের ছালা, বিছানার লাগেজ, সুটকেস, মার জলের কুঁজোটি পর্যন্ত গাড়ি থেকে নামিয়ে প্ল্যাটফর্মের একাংশে স্তূপাকার করতে লাগল।
টিকিট কিনে মামা ছুটতে ছুটতে ফিরলেন–বললেন, গাড়ি ছাড়তে আর দেরি নেই রে মোটে আট মিনিট বাকি। শ্রীকান্ত, এই সামান্য কটা জিনিস প্ল্যাটফর্মে নিতে তোর কবার লাগবে? বার তিনেক, বোধ হয়? বার তিনেক হলে ফি বারে দু মিনিট মোট ছ মিনিট, বাড়তি থাকে আরো দু মিনিট, খুব গাড়ি ধরা যাবে। টেপি, তুই এখানে দাঁড়িয়ে মালপত্রগুলো আগলা, শেষবারে শ্রীকান্তর সঙ্গে আসবি। আমি আর তোর মা এগোলাম। একটা খালি দেখে কামরা দেখতে হবে তো? শ্রীকান্ত, তুই ট্রাঙ্কটা মাথায় নে, তার উপরে ছোট সুটকেসটা চাপিয়ে দিচ্ছি, পারবি তো? বিছানার লাগেজটা বা বগলে নে, আর ডান হাতে বড় সুটকেসটা। বাঁ হাতে লণ্ঠন দুটো ঝুলিয়ে নিস, তাহলেই হবে। দ্বিতীয় বার বাসন-কোসনের থলেটা আর তোর মামীর তোরঙ্গটা নিবি। দৌড়ে যাবি আর দৌড়ে আসবি–নইলে গাড়ি ফেল হয়ে যাবে, বুঝেছিস? আমি এগোই ততক্ষণ।
তিনি তো এগোলেন, কিন্তু কিছুদূর গিয়ে দেখেন শ্রীকান্তর দেখা নাই। তিনি আশা করেছিলেন যে শ্রীকান্ত তার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে, তাকে দেখতে না পেয়ে তিনি ক্ষুণ্ণ হলেন। ফিরে এসে দেখেন, শ্রীকান্ত মালপত্রের বোঝা নিয়ে একেবারে যেন চিত্র পুত্তলিকা!
–কি রে, এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস যে? গাড়ি ফেল করবি না কি?
–কি করব আমি এগোতে পাচ্ছি না যে। বড্ড ভারি হয়েছে মামা। চেঁপিকে বলাম তুই পেছন থেকে ঠেলে ঠেলে দে, আমি চলতে থাকি, তা ও–
–বারে! বাবা আমায় এখানে জিনিস আগলাতে বলল না? আমি ওকে ঠলতে ঠেলতে যাই আর এদিকে সব চুরি হয়ে যাক। তোমার আর কি, জিনিস কমে গেলে তোমাকে তো আর বইতে হবে না।
মামা বললেন, তাই তো, ভারি মুশকিল হল দেখছি।
একটা কুলী এবার সাহসভরে এগিয়ে এসে বলল–খোকাবাবু সেকবে কেননা? সোব ফেলে ভেঙে চুরমার হোবে। আর ইদিকে টিরেনভি ছেড়ে দিবে। তাই তো! ভারি মুশকিল!
কুলী করলে তো নগদ লোকসান, এদিকে জিনিস ফেলে ভাঙলেও ক্ষতি, গাড়িরও সময় নেই কিন্তু ভাববার আর সময় কই? কাজেই বাধ্য হয়ে মামাকে দুটো কুলী রাখতে হল। আধঘণ্টা আগে বেরুলে এই অপব্যয়টা হত না। শ্রীকান্তই পাঁচ-ছবারে কম কম করে গাড়িতে মালগুলো তুলতে পারত। থাকগে, আর উপয় কি?
অতঃপর একটা দেখবার মতো দৃশ্য হল। দুটো কুলী আগে আগে, তাদের মাথায় দুটো বড় বড় তোরঙ্গ। একজনের বগলে বিছানার ল্যাগেজ, আরেক জনের বগলে বাসনের থলে। মামী নিয়েছেন জলের কুঁজো আর চেঁপি নিয়েছে পানের বাট। মামার এক হাতে একটা ছোট হাতব্যাগ, অন্য হাতে তালপাখা– তারই ভারে মামা কাতর; এতই ঘেমে উঠেছেন যে, ওরই ফাঁকে তালপাখার হাওয়া খেতে হচ্ছে তাকে।
সব শেষে বলেছে শ্রীকান্ত–একেবারে কুঁজো হয়ে। বাড়তি ট্রাঙ্কটা তারই ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। শোভাযাত্রাটা দেখবার মতো।
গাড়িতে উঠেই মামা লম্বা বিছানা পেতে ফেললেন। এতক্ষণ গুরুতর পরিশ্রম গেছে, সেজন্য যথেষ্ট বিশ্রাম দরকার। চলতি গড়ির ফাঁকা হাওয়া গায়ে লাগতেই তিনি আরামে চক্ষু বুজে বললেন, আঃ, এতক্ষণে দেহটা জুড়োল। গোটা গাড়িটা ভর্তি, কিন্তু এ কামরাটা খুব খালি পাওয়া গেছে; কারু চোখে পড়েনি বোধ হয়।
বিচিত্র লটবহরে ওই ছোট কামরার প্রায় সমস্তটাই ভরে গেছল, তারই একধারে, বসে শ্রীকান্ত তার পীড়িত ঘাড়ে শুশ্রূষা করছিল। তার অবস্থাটা বুঝে মামী বললেন, বড্ড লেগেছে না কি রে?
অপ্রতিভ হয়ে শ্রীকান্ত ঘাড়ে হাত বুলানো বন্ধ করল–না, মামীমা।
মামা বললেন, ওয়েট লিফটিং একটা ভালো একসারসাইজ। এতে ওর ঘাড় শক্ত হবে। সেটা দরকার। এর পরে ওর বৌ-এর বোঝ রয়েছে না?
বৌ-এর না বইয়ের–কিসের বোঝা বললেন মামা, বোঝা গেল না সঠিক।
মামী বললেন, তোমার যেমন। যাচ্ছি তো কদিনের জন্য বিয়ের নেমন্তন্নে। এত মালপত্র নিয়ে বেরুনো কেন? কী কাজে লাগবে এসব?
মামা বললেন, যাকে রাখে সেই রাখে, কথাটা জান তো? সব জিনিসই কাজে লাগে, কাজের সময় তখন পাওয়া না গেলেই মুশকিল।
মামী বললেন, মদনপুরে গাড়ি তো দাঁড়ায় মোটে এক মিনিট। বোধ হয় এক মিনিটও দাঁড়ায় না। তার মধ্যে কি এই লটবহর নিয়ে নামা যাবে? দেখো, তখন কী ফ্যাসাদে পড়। বাক্স পেঁটরা সব গাড়িতেই থেকে যাবে দেখছি।
মামা বললেন, কি জানো গিন্নী, ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বয়। কিছু ভেব না তুমি।
মামার কথায় শ্রীকান্ত হৃৎকম্প হল, কেন না মদনপুর স্টেশন যেখানে এক মিনিট মাত্র গাড়ি থামে কিংবা তাও থামে না, সেখানে ভগবানের জায়গায় নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই সে কল্পনা করতে পারল না। এই বিরাট এবং বিচিত্র লাটবহর তাকেই গাড়ি থেকে নামাতে হবে। তাহলেই তো সে গেছে, ত তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না শ্রীকান্তর সারা শরীর রি রি করে কাঁটা দিয়ে উঠল।
দমদমে গাড়ি দাঁড়াতেই জনকতক কৃষ্ণকায় ফিরিঙ্গী যুবক এসে সেই কামরায় উঠল। মামার এবং মালপত্রের বহর দেখে তারা একে বারে হতভম্ব। অবশেষে, তাদের একজন ভাঙা বাংলায় মামাকে বলল, টোমরা ও গাড়িতে কেন বাবু? এটা সাহেবডের জন্যে–দরজায় নোটিস দেখ নাই For Europeasn only টোমাদের নামিটে হবে।
সবেমাত্র আয়েস করছেন, নামার কথায় মামার কথা গরম হয়ে উঠল। তিনি বললেন, কোনো নামটে হইব? আমরাও তোমাদের মটই খাঁটি ইউরোপীয়ান আছি। চাহিয়া ডেখ টোমাডের ও আমাড়ের গায়ের রঙ একপ্রকার।
–অল রাইট। ডেখি তোমরা নামিবে কি না? বলে তারা নেমে গেল এবং পরবর্তী স্টেশনে একজন রেল-কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে এল।
কর্মচারীটিও এসে নামতে অনুরোধ করলেন।
মামা বললেন, সমস্ত গাড়ি ভর্তি, কেবল একটা খালি, কোথাও জায়গা না পেয়ে বাধ্য হয়ে আমরা এই কামরায় উঠেছি। অন্য কোথাও বা উঁচু ক্লাসে আমাদে জায়গা করে দিন, এখুনি আমরা নেমে যাচ্ছি।
আচ্ছা দেখছি জায়গা বলে কর্মচারীটি নেমে গেলেন, ফিরিঙ্গীরা গাড়িতে রইল! শ্রীকান্তর ভয় হল পাছে কর্মচারীটি অন্য কোথাও জায়গা খুঁজে পান তাহলে তো এখুনি তাকে ভগবানের অবতার হয়ে আবার লটবহর বওয়া-বওয়ি করতে হবে।
কিন্তু কর্মচারীটি আর ফিরলেন না, গাড়িও ছেড়ে দিল। কেবল ফিরিঙ্গীরা নিজেদের মধ্যে গজরাতে লাগল। মামা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করলেন না। কিন্তু মামী বললেন, কাজ নেই বাপু, পরের স্টেশনে চল অন্য আকরায় যাই।
-হ্যাঁ, কোথায় খালি রয়েছে না কি?
–না থাকে, পরের গাড়িতে যাব না হয়।
–পাগল!
-–সবই তো পরের গাড়ি মামীমা, কোনটা আমাদের নিজেদের গাড়ি? বলল শ্রীকান্ত। আবার ওঠা-নামার ঝক্যি বওয়ার দায় এড়াতে বলতে হল তাকে!
–যদি পুলিসে ধরে নিয়ে যায়। সাহেবদের গাড়ি যে! মামীমা কন।
–হ্যাঁ, ধরলেই হল! তুমি চুপ করে থাক, ব্যাটারা বাংলা বোঝে তুমি ঘাবড়ে গেছ জানলে আরো লাফাবে।
অগত্যা মামী চুপ করলেন।
খানিক বাদেই ব্যারাকপুরে এল। গাড়ি দাঁড়াতেই ফিরিঙ্গীগুলো একজন সাহেব কর্মচারীকে ডেকে আনল। তিনি এসে বললেন, বাবু টোমাডের নামিটে হইবে–যাহাদের সাহেবি ড্রেস, এ কেবল টাহাদিগের জন্য!
মামা বললেন, তা একথা আগে বলনি সাহেব? আমাডোরো সাহেব পোশাক আছে। আমাদের সময় দাও, আমরা এখুনি সাহেব বনে যাচ্ছি। ওগো ট্রাঙ্কের চাবিটা দাও তো–
অগত্যা সাহেব কর্মচারীটি চলে গেল। মামার সত্যিই কিছু সাহেবি শোপাক ছিল না, একটা চাল মারলেন মাত্র। এদিকে গাড়িও ব্যারাকপুর ছাড়ল।
অতঃপর ফিরিঙ্গীরা আর কোনো উপায় না দেখে এদের তাড়াবার ভার নিজেদের হাতে নিল। পরস্পর পরামর্শ করে এমন চেঁচামেচি শুরু করে দিল মামী দস্তুরমতো ঘাবড়ে গেলেন। মামারও যে একটু ভয় না হল এমন নয়। মামী বললেন, হ্যাঁ গা, কামড়ে দেবে না তো?
মামা খানিকক্ষণ নিঃশব্দে মাথা নেড়ে বললেন–কি জানি!
কামড়াবার কথা শুনে কেঁপি একেবারে বাবার বিরাট পরিধির পেছনে এসে আশ্রয় নিল!
মামা বললেন, ভালো ফন্দি মাথায় এসেছ। শ্রীকান্ত তুই কুকুর ডাকতে পারিস?
–না, না, বেড়াল ডাকতে হবে না। মাঝে মাঝে তুই কুকুরের মতো ডাক দিখি! শ্রীকান্ত ডাকল–ঘেউ ঘেউ।
–আরো একটু জোরে।
-–ঘেউ ঘেউ ঘেউউ।
সহসা কুকুরের ডাক শুনে ফিরিঙ্গীরা সব চুপ। শ্রীকান্ত আবার ডাকল–ঘেউ ঘেউ ঘেউ–
একজন জিজ্ঞাসা করল, ওরোকম ডাকছে কোনো সে? তার কি হোয়েছে?
মামা গম্ভীরভাবে বললেন, ও কিছু নয় সাহেব। দশ-বারো দিন হল ওকে একটা পাগলা কুকুরে কামড়িয়েছে। Bitten by a mad dog বুঝলে?
ফিরিঙ্গীরা যেন লাফিয়ে উঠল–অ্যাঁ? হাইড্রোফোবিয়া! একথা আগে বলল নাই কেন? ওটো কামড়াইটে পারে?
মামা বললেন–না না, কামড়াইবে না। সে ভয় নাই।
বলতে বলতে নৈহাটি এসে পড়ল। ফিরিঙ্গীরা আর এক মুহূর্তে বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ হুড়মুড় করে সেই কামরা থেকে পিটটান দিল।
যাক, বাঁচা গেল বলে যেই মাত্র না স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন অমনি আরেকজন ফিরিঙ্গী যুবক এসে সেই কামরায় উঠল। সে কোনো উচ্চবাচ্য করে এককোণে গিয়ে বসল, মামাদের দিকে তাকালও না। মামা বললেন, দাঁড়াও। তোমাকেও ভাগাচ্ছি পরের স্টেশনে। শ্রীকান্ত, গাড়ি ছাড়লেই–বুঝেছিস?
যুবকটি ডিটেকটিভ নভেল বের করে পড়তে শুরু করে দিয়েছিল, হঠাৎ কুকুরের ডাক শুনে চমকে উঠে মামাক জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপার কি? কি হয়েছে ওর?
সাহেবের মুখে পরিষ্কার বাংলা শুনে মামা বাংলাতেই জবাব দিলেও কিছু না, জলাতঙ্ক–যাকে তোমরা হাউড্রেফোলিয়া বল!
ছোকরা আবার বইয়ে মন দিল। তার নিশ্চিন্ত নির্বিকার ভাব দেখে মামার পিত্তি জ্বেলে গেল। তবু তিনি বললেন, তোমাকে সাবধান করা আমার কর্তব্য। কি জান, যদি কামড়ে দেয়, বলা তো যায় না। তখন তোমাকেও ঐ রোগে–
যুবকটি মৃদু হেসে বলল–আহা, না না! যে কুকুর ডাকে সে কি আর কামড়ায়?
অগত্যা মামা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন এবং শ্রীকান্তও ডাক ছেড়ে দিল। তাকে কুকুর বলাতে সে মনে মনে এমনই চটেছিল যে, তার ইচ্ছা করছিল এখুনি গিয়ে ফিরিঙ্গীটাকে কামড়ে দেয়।
কাঁচড়াপাড়ায় গাড়ি থামাতেই যুবকটি মুখ বাড়িরে বাইরে দেখছিল। তার পরিচিত বন্ধুদের দেখতে পেয়ে ডাকাডাকি শুরু করতেই সে পুরাতন দল এসে উপস্থিত। তারা তাকে ঐ কামরায় দেখে ভারী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি নিরাপদে আছ তো? ওখানে যে মারাত্মক হাইড্রোফেবিয়া!
–সে আমি সারিয়ে দিয়েছি।
–সারিয়ে দিয়েছ কি রকম?
তখন মামার চাল যুবকটি বন্ধুদের কাছে ফাঁস করে দিল–সে কামরায় ঢুকেই ছেলেটিকে জল খেতে দেখেছিল, জলাতঙ্ক রোগে যা কখনো সম্ভব নয়। তখন শ্রীকান্তর ভারি রাগ হল তার মামার উপর, জলাতঙ্ক রোগে জল খেতে নেই একথা কেন তাকে তিনি আগে বলেননি। তাইতো তাকে এমন অপদস্থ হতে হল! কুকুর না হবার অপমান সইতে হল এমন!
এইবার ফিরিঙ্গরী আবার সে কামরায় জাঁকিয়ে বসল এবং স্পষ্ট ভাষায় মামাকে জানাল যে একবার তাঁকে নামতেই হবে এবং এর পরের স্টেশনেই।
অসহায়ভাবে মামী বললেন, ওগো, কি হবে তাহলে?
মামা বললেন–কিছু ভেব না গিন্নী ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য।
ভগবানের নাম শুনে শ্রীকান্তর নিজেকে মনে পড়ল এবং ঘাড়ের ব্যথাটা এতক্ষণে কতটা মরেছে জানবার জন্য সে একবার ঘাড়টাকে খেলিয়ে নিল।
পরের স্টেশন আসতেই মামা বললেন, এখানে তো হয় না, পরের জংশনে না হয় বদলানো যাবে। এখানে তো মিনিট খানেক যাত্রী গাড়ি থামে এত মালপত্তর আমাদের!
-–না, টা হইবে না, এইখানেই টোমাকে নামটে হইবে।
তখন তারা সবাই মিলে মামার বাক্স, তেরঙ্গ, বিছানা, সুটকেস-এ হাত লাগাল।
–ডেখি, টুমি কেমন না নাম। এই বলে একজন বাসনের থলেটা নামিয়ে দিয়ে বলল–Here You are আর এই নাও টোমার জলে পিচার!
কুঁজোর জাত যাওয়ায় মীমাসা হায় হায় করতে লাগলেন। ততক্ষণে দুজন মিলে ধরাধরি করে ভারি ট্রাঙ্কটা নামিয়ে ফেলেছে। মামা তখন বাঙ্কের উপরে আরো ভারি হোন্ডঅলটা ওদের দেখিয়ে দিলেন। একজন গিয়ে সেটা নামাল মামা বললেন, বেঞ্জির তলায় ঐ তোরঙ্গটা–ওই যে!
একজন সেটা নামিয়ে বলল এই নাও, টোমার টুরঙ্গ।
মামা সংশোধন করে দিলেন–তুরঙ্গ নয় তোরঙ্গ। সর্বশেষে বুদ্ধিশেষে বুদ্ধিমান যুবকটি ছোট হাতব্যাগটা মামাকে এগিয়ে বলল, গুডবাই, মিষ্টার!
মামা এতক্ষণ পুলকিত হয়ে ওদের কার্য্যকলাপ পর্যনবেক্ষণ করেছিলেন। এই বাক্স বললেন, ইহাই মদনপুর–এইখানেই আমরা নামতাম। এতএব গুডবাই মিস্টারস এবং থ্যাঙ্কস!