Raater Alo

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প – শুভদৃষ্টি 2024 l Rabindranath Tagore’s story – Shubhadristi l শুভদৃষ্টি (Shubhadrishti)

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প - শুভদৃষ্টি 2024 l Rabindranath Tagore's story - Shubhadristi

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প – শুভদৃষ্টি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঙালি সাহিত্য ও সংস্কৃতির অমর কবি, তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে আমাদের সমাজের গভীর সত্যগুলোকে তুলে ধরেছেন। তাঁর গল্প “শুভদৃষ্টি” তেমনই একটি রচনা, যা মানবিক সম্পর্কের জটিলতা ও সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে নির্মিত। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, বিবাহের আড়ম্বর এবং এর সাথে জড়িত ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলোর একটি সংবেদনশীল চিত্র অঙ্কন করেছেন।

“শুভদৃষ্টি” গল্পটি মূলত একটি বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্রপাত এবং এর সাথে জড়িত সামাজিক ও ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের উপর আলোকপাত করে। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন কিভাবে সামাজিক নিয়ম ও প্রথা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলে এবং তাদের জীবনকে নাড়া দেয়। গল্পের প্রতিটি চরিত্র, তাদের অনুভূতি ও সম্পর্কের জটিলতা পাঠককে সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা নিয়ে নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে।

“শুভদৃষ্টি” গল্পটি রবীন্দ্রনাথের অনন্য প্রতিভার আরেকটি মাইলফলক, যা আমাদের সমাজের আয়না হিসেবে কাজ করে এবং আমাদের ভেতরের মানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই গল্পের মাধ্যমে আমরা তাঁর গভীর দর্শন ও মানবতাবোধের পরিচয় পাই, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প – শুভদৃষ্টি l Rabindranath Tagore’s story – Shubhadristi

শুভদৃষ্টি

কান্তিচন্দ্রের বয়স অল্প, তথাপি প্রীবিয়ােগের পর দ্বিতীয় স্ত্রীর অনুসন্ধান ক্ষান্ত থাকিয়া পশুপক্ষী-শিকারেই মনােনিবেশ করিয়াছেন। দীর্ঘ কৃশ কঠিন লঘু, শরীর, তীক্ষ দৃষ্টি, অব্যর্থ লক্ষ্য, সাজসজ্জায় পশ্চিমদেশীর মতাে; সঙ্গে সঙ্গে কুস্তিগির হীরা সিং ছক্কনলাল, এবং গাইয়ে বাজিয়ে খাঁসাহেব, মিঞাসাহেব অনেক ফিরিয়া থাকে; অকর্মণ্য অনুচর-পরিচরেরও অভাব নাই।

দুইচারিজন শিকারী বন্ধুবান্ধব লইয়া অঘ্রানের মাঝামাঝি কান্তিচন্দ্র নৈদিঘির বিলের ধারে শিকার করিতে গিয়াছেন। নদীতে দুইটি বড়াে বেটে তাঁহাদের বাস, আরও গােটা-তিনচার নৌকায় চাকরবাকরের দল গ্রামের ঘাট ঘিরিয়া বসিয়া আছে। গ্রামবধদের জল তােলা, স্নান করা প্রায় বন্ধ। সমস্ত দিন বন্দকের আওয়াজে জলঞ্চল কম্পমান, সন্ধ্যাবেলায় ওস্তাদি গলার তানকর্তবে পল্লির নিদ্ৰাতন্দ্রা তিরােহিত।

একদিন সকালে কান্তিচন্দ্র বােটে বসিয়া বন্দকের চোঙ সযত্নে ঘহতে পরিষ্কার করিতেছেন, এমন সময় অনতিদরে হাঁসের ডাক শনিয়া চাহিয়া দেখিলেন, একটি বালিকা দই-হাতে দুইটি তরুণ হাঁস বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া ঘাটে আনিয়াছে। নদীটি ছােটো, প্রায় শ্রোতহীন, নানাজাতীয় শৈবালে ভরা। বালিকা হাঁস দুইটিকে জলে ছাড়িয়া দিয়া, একেবারে আয়ত্তের বাহিরে না যায় এইভাবে, অস্তসতর্ক স্নেহে তাহাদের আগলাইবার চেষ্টা করিতেছে। এটকু বুঝা গেল, অন্য দিন সে তাহার হাঁস জলে ছাড়িয়া দিয়া চলিয়া যাইত, কিন্তু সম্প্রতি শিকারীর ভয়ে নিশ্চিন্তচিত্তে রাখিয়া যাইতে পারিতেছে না।

মেয়েটির সৌন্দর্য নিরতিশয় নবীন, যেন বিশ্বকর্মা তাহাকে সদ্য নির্মাণ করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছেন। বয়স ঠিক করা শক্ত। শরীরটি বিকশিত কিন্তু মুখটি এমন কাঁচা যে, সংসার কোথাও যেন তাহাকে লেশমাত্র স্পর্শ করে নাই। সে যে যৌবনে পা ফেলিয়াছে, এখনও নিজের কাছে সে খবরটি তাহার পপীছে নাই।

কান্তিচন্দ্র ক্ষণকালের জন্য বন্দকে সাফ করায় ঢিল দিলেন। তাঁহার চমক লাগিয়া গেল। এমন জায়গায় এমন মুখ দেখিবেন বলিয়া কখনও আশা করেন নাই। অথচ, রাজার অন্তঃপুরের চেয়ে এই জায়গাতেই এই মুখখানি মানাইয়াছিল। সােনার ফুলদানির চেয়ে গাছেই ফলকে সাজে। সেদিন শরতের শিশিরে এবং প্রভাতের রৌদ্রে। নদীতীরের বিকশিত কাশবনটি ঝলমল করিতেছিল, তাহারই মধ্যে সেই সরল নবীন মুখখানি কান্তিচন্দ্রের মুখ চক্ষে আশ্বিনের আসন্ন আগমনীর একটি আনন্দবি আকিয়া দিল। মন্দাকিনীতীরে তরুণ পার্বতী কখনও কখনও এমন হংসশিশু, বকে লইয়া আসিতেন, কালিদাস সে কথা লিখিতে ভুলিয়াছেন।

এমন সময় হঠাৎ মেয়েটি ভীতত হইয়া কাঁদোকাঁদো মুখে আড়াতাড়ি হল দটিকে বুকে তুলিয়া লইয়া অব্যক্ত আতরে ঘাট ত্যাগ করিয়া চলি। কাচিন্দ্র কারণসখানে বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, তাহার একটি রসিক পারিণকৌতুক করিয়া বালিকাকে ভয় দেখাইবার জন্য হাঁসের দিকে ফাকা বন্দকে লক্ষ্য করিয়েছে। কাতি পশ্চাৎ হইতে কক কাভিন্ন লইয়া হঠাৎ তাহার গালে সঙ্গে প্রকাণ্ড একটি চপেটাঘাত করিলেন, অকস্মাৎ রসভঙ্গ হইয়া লােকটা সেইখানে ধপ করিয়া বসিয়া পড়িল। কাতি পুনরায় কামরায় আসিয়া বন্দক সাফ করিতে লাগিলেন।

সেইদিন বেলা প্রহর-তিনেকের সময় গ্রামপথের ঘনচ্ছায়ার মধ্য দিয়া শিকারীর দল শস্যক্ষেত্রের দিকে চলিয়াছিল। তাহাদের মধ্যে একজন বন্দুকের আওয়াজ করিয়া দিল। কিছু দূরে বাঁশঝাড়ের উপর হইতে কী-একটা পাখি আহত হইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে ভিতরের দিকে পড়িয়া গেল। | কৌতহলী কান্তিচন্দ্র পাখির সন্ধানে ঝােপঝাড় ভেদ করিয়া ভিতরে গিয়া দেখিলেন, একটি সচ্ছল গহস্পঘর, প্রাঙ্গণে সারি সারি ধানের গােলা। পরিচ্ছন্ন বহৎ গােয়ালঘরে কুলগাছতলায় বসিয়া সকালবেলাকার সেই মেয়েটি একটি আহত দুঘ, বুকের কাছে তুলিয়া উচ্ছসিত হইয়া কাঁদিতেছে এবং গামলার জলে অঞ্চল ভিজাইয়া পাখির চঞ্চপটের মধ্যে জল নিংড়াইয়া দিতেছে। পােষ বিড়ালটা তাহার কোলের উপরই পা তুলিয়া উমখে ঘুঘটির প্রতি উৎসুক দৃষ্টিপাত করিতেছে; বালিকা মধ্যে মধ্যে তাহার নাসিকাগ্রভাগে তর্জনী-আঘাত করিয়া লৰ জন্তুর অতিরিক্ত আগ্রহ দমন করিয়া দিতেছে।

পল্লির নিন্তব্ধ মধ্যাহ্নে একটি গৃহস্থপ্রাঙ্গণের সচ্ছল শান্তির মধ্যে এই করণছবি এক মহতেই কান্তিচন্দ্রের হদয়ের মধ্যে আঁকা হইয়া গেল। বিরলপল্লব গাছটির ছায়া ও রৌদ্র বালিকার ক্রোড়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছে; অদরে আহারপরিতৃপ্ত পরিপুষ্ট গাভী আলস্যে মাটিতে বসিয়া শন্স ও পচ্ছ -আন্দোলনে পিঠের মাছি তাড়াইতেছে; মাঝে মাঝে বাঁশের ঝাড়ে ফিস ফিস কথার মতাে নতন উত্তরবাতাসে খস খস শব্দ উঠিতেছে। সেদিন প্রভাতে নদীতীরে বনের মধ্যে যাহাকে বনশ্রীর মতাে দেখিতে হইয়াছিল, আজ মধ্যাহ্নে নিস্তব্ধ পােঠপ্রাঙ্গণচ্ছায়ায় তাহাকে নেইবিগলিত গহলক্ষীটির মতাে দেখিতে হইল।

কান্তিচন্দ্র বন্দুকহতে হঠাৎ এই ব্যথিত বালিকার সম্মুখে আসিয়া অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া পড়িলেন। মনে হইল, ‘যেন বমালস চোর ধরা পড়িলাম। পাখিটি যে আমার গুলিতে আহত হয় নাই কোনােপ্রকারে এই কৈফিয়ত দিতে ইচ্ছা হইল। কেমন করিয়া কথাটা পাড়িবেন ভাবিতেছেন, এমন সময়ে কুটির হইতে কে ডাকিল, “সুধা।” বালিকা যেন চমকিত হইয়া উঠিল। আবার ডাক পড়িল, “সুধা।” তখন সে-তাড়াতাড়ি পাখিটি সইয়া কুটিমুখে চলিয়া গেল। কাতিচন্দ ভাবিলেন, নামটি উপতে বটে। সাধা!

কান্তি তখন দলের লােকের হাতে বন্দক রাখিয়া সদর পথ দিয়া সেই কুটিরের দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, একটি প্রৌঢ়বয়স্ক মণ্ডিতমখ শান্তমতি ব্ৰাহরণ দাওয়ায় বসিয়া হরিভক্তিৰিলাস পাঠ করিতেছেন। ভক্তিমণ্ডিত তাঁহার মুখের গভীর ক্ষিপ্ত প্রশান্ত ভাবের সহিত কান্তিচন্দ্র সেই বালিকার দয়া মনে সাদশ অনুভব করিলেন। | কাতি তাঁহাকে নমস্কার করিয়া কহিলেন, “শ পাইয়াছে ঠাকুর, এক ঘটি জল পাইতে পারি কি।”

রাহুশি তাড়াতড়ি তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া বাইলেন এবং ভিতর হইতে পিতলের রেকাবিতে কয়েকটি বাতাসা ও কাসার ঘটিতে জল লইয়া স্বহস্তে অতিথির সম্মুখে রাখিলেন।

কান্তি জল, খাইলে পর ব্রাহণ তাঁহার পরিচয় লইলেন। কান্তি পৰি দিয়া কহিলেন, “ঠাকুর, আপনার যদি কোনাে উপকার করিতে পারি তাে কৃতার্থ হই।”

নবীন বাড়ুজ্জে কহিলেন, “বাবা, আমার আর কী উপকার করিবে। তবে সুধা বলিয়া আমার একটি কন্যা আছে, তাহার বয়স হইতে চলিল, তাহাকে একটি সৎপাত্রে দান করিতে পারিলেই সংসারের ঋণ হইতে মুক্তিলাভ করি। কাছে কোথাও ভালাে ছেলে দেখি না, দুরে সন্ধান করিবার মতাে সামর্থও নাই; ঘরে গােপীনাথের বিগ্রহ আছে, তাঁহাকে ফেলিয়া কোথাও যাই নাই।”

কান্তি কহিলেন, “আপনি নৌকায় আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলে পাত্র সম্বন্ধে আলােচনা করিব।”

এ দিকে কান্তির প্রেরিত চরগণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা সুধার কথা যাহাকেই জিজ্ঞাসা করিল সকলেই একবাক্যে কহিল, এমন লক্ষীস্বভাবা কন্যা আর হয় না।

পরদিন নবীন বােটে উপস্থিত হইলে কান্তি তাঁহাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন এবং জানাইলেন, তিনিই ব্রহ্মণের কন্যাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছুক আছেন। ব্রহ্মণ এই অভাবনীয় সৌভাগ্যে রুদ্ধকণ্ঠে কিছুক্ষণ কথাই কহিতে পারিলেন না। মনে করিলেন, কিছু-একটা ভ্রম হইয়াছে। কহিলেন, “আমার কন্যাকে তুমি বিবাহ করিবে?”

কান্তি কহিলেন, “আপনার যদি সম্মতি থাকে, আমি প্রস্তুত আছি।”

নবীন আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “সুধাকে?”—উত্তরে শনিলেন, “হাঁ।”

নবীন শিরভাবে কহিলেন, “তা দেখাশােনা-“

কান্তি, যেন দেখেন নাই, ভাণ করিয়া কহিলেন, “সেই একেবারে শুভদৃষ্টির সময়।”

নবীন গদগদকণ্ঠে কহিলেন, “আমার সধা বড়ো সুশীলা মেয়ে, রাধাবাড়া বরকন্নার কাজে অদ্বিতীয়। তুমি যেমন না দেখিয়াই তাহাকে বিবাহ করিতে প্রত্যুত হইয়াছ তেমনি আশীর্বাদ করি, আমার সখা পতিব্রতা সতীলক্ষী হইয়া চিরকাল তােমার মঙ্গল করুক। কখনও মহতের জন্য তােমার পরিতাপের কারণ না ঘটুক।”

কান্তি আর বিলম্ব করিতে চাহিলেন না, মাঘ মাসেই বিবাহ স্থির হইয়া গেল।

পাড়ার মজুমদারদের পােন কোঠাবাড়িতে বিবাহের খান নিদিষ্ট হইয়াছে। বর হাতি চড়িয়া মশাল লাইয়া বাজনা বাজাইয়া যথাসময়ে আসিয়া উপস্থিত।

শুভদষ্টির সময় বর কন্যার মুখের দিকে চাহিলেন। নতশির টোপর-পরা চন্দনচর্চিত সুধাকে ভালাে করিয়া যেন দেখিতে পাইলেন না। উদকেলিত হদয়ের আনন্দে চোখে যেন ধাঁধা লাগিল।

বাসরঘরে পাড়ার সরকারি ঠানদিদি যখন বরকে দিয়া জোর করিয়া মেয়ের ঘােমটা খােলাইয়া দিলেন তখন কাতি হঠাৎ চমকিয়া উঠিলেন।

আরো পড়ুন: রুদ্র গোস্বামীর সেরা কবিতা

এ তাে সেই মেয়ে নয়। হঠাৎ বুকের কাছ হইতে একটা কালাে বস্ত্র উঠিয়া তাহার মস্তকে যেন আঘাত করিল, মুহুর্তে বাসরঘরের সব প্রাণ যেন অন্ধকার হইয়া গেল এবং সেই অন্ধকারবনে নববধুর মুখখানিয়ে যেন কালিমালিপ্ত করিয়া দিল।

কান্তি দ্বিতীয়বার বিবাহ করিবেন না বলিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন; সেই প্রতিজ্ঞা কি এমনি একটা অদ্ভুত পরিহাসে অদৃষ্ট তুড়ি দিয়া ভাঙিয়া দিল। কত ভালাে ভালাে বিবাহের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিয়াছেন, কত আত্মীয়বন্ধুবান্ধবদের সানুনয় অনুরােধ অবহেলা করিয়াছেন; উচ্চকুটবিতার আকর্ষণ, অর্থের প্রলােভন, রপখ্যাতির মােহ, সমস্ত কাটাইয়া অবশেষে কোন এক অজ্ঞাত পল্লিগ্রামে বিলের ধারে এক অজ্ঞাত দরিদ্রের ঘরে এতবড়াে বিড়ম্বনা, লােকের কাছে মুখ দেখাইবেন কী করিয়া॥

শ্বশুরের উপরে প্রথমটা রাগ হইল। ‘প্রতারক এক মেয়ে দেখাইয়া আর-এক মেয়ের সহিত আমার বিবাহ দিল। কিন্তু ভাবিয়া দেখিলেন, নবীন তাে তাঁহাকে বিবাহের পূর্বে কন্যা দেখাইতে চান নাই এমন নয়, তিনি নিজেই দেখিতে অসম্মত হইয়াছিলেন। বুদ্ধির দোষে যে এতবড়ো ঠকাটা ঠকিয়াছেন সে লজ্জার কথাটা কাহারও কাছে প্রকাশ না করাই শ্রেয়ঃ বিবেচনা করিলেন।

ঔষধ যেন গিলিলেন কিন্তু মুখের তারটা বিগড়াইয়া গেল। বাসরঘরের ঠাট্টা অমােদ কিছুই তাহার কাছে রচিল না। নিজের এবং সর্বসাধারণের প্রতি রাগে তাঁহার সর্বাঙ্গ জলিতে লাগিল।

এমন সময় হঠাৎ তাঁহার পার্শ্ববর্তিনী বধু অব্যক্ত ভীত স্বরে চমকিয়া উঠিল। সহসা তাহার কোলের কাছ দিয়া একটা খরগােসের বাচ্ছা ছুটিয়া গেল। পরক্ষণেই সেদিনকার সেই মেয়েটি শশকশিশুর অনুসরণ-পূর্বক তাহাকে ধরিয়া গালের কাছে রাখিয়া একান্ত স্নেহে আদর করিতে লাগিল। “ঐ রে, পাগলি আসিয়াছে” বলিয়া সকলে তাহাকে চলিয়া যাইতে ইঙ্গিত করিল। সে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করিয়া ঠিক বরকন্যার সম্মুখে বসিয়া শিশুর মতো কৌতহলে কী হইতেছে দেখিতে লাগিল। বাড়ির কোনাে দাসী তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া লইবার চেষ্টা করিলে বর ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “আহা, থাক-না, বসুক।”

মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন “তােমার নাম কী।”

সে উত্তর না দিয়া দলিতে লাগিল।

ঘরসুদ্ধে রমণী হাসিয়া উঠিল।

কান্তি আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তােমার হাঁসদটি কতবড়ো হইল।”

অসংকোচে মেয়েটি নীরবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। হতবুদ্ধি কান্তি সাহসপুর্বক আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তােমার সেই ঘঘ, আরাম হইয়াছে তাে?” কোনাে ফল পাইলেন না। মেয়েরা এমনভাবে হাসিতে লাগিল যেন বর ভারি ঠকিয়াছেন।

অবশেষে প্রশ্ন করিয়া খবর পাইলেন, মেয়েটি কালা এবং বােবা, পাড়ার যত পশুপক্ষীর প্রিয়সগিনী। সেদিন সে যে সুধা ডাক শুনিয়া উঠিয়া ঘরে গিয়াছিল সে তাঁহার অনুমানমাত্র, তাহার আর-কোনাে কারণ ছিল।

কান্তি তখন মনে মনে চমকিয়া উঠিলেন। যাহা হইতে বঞ্চিত হইয়া পৃথিবীতে তাঁহার কোনাে সুখ ছিল না, শুভদৈবক্রমে তাহার নিকট হইতে পরিত্রাণ পাইয়া নিজেকে ধন্য জ্ঞান করিলেন। মনে করিলেন, যদি এই মেয়েটির বাপের কাছে যাইতাম এবং সে ব্যক্তি আমার প্রার্থনা-অনুসারে কনাটিকে কোনােমতে আমার হাতে সমর্পণ করিয়া নিতি লাভের চেষ্টা করিত! শুভদৃষ্টি যতক্ষণ আয়ত্তচু্যত এই মেয়েটির মোহ তাঁহায় মনটিকে আলোঁঞ্চত করতেছিল ততক্ষণ নিজের বধটে সবন্ধে একেবারে অন্ধ হইয়াছিলেন। নিকটেই আর কোথাও কিছু সাত্বনার কারণ ছিল কি না তাহা অনুসন্ধান করিয়া দেখিবার প্রবত্তিও ছিল না।

যেই শুনিলেন মেয়েটি বোবা ও কালা অমনি সমস্ত জগতের উপল্প হইতে একটা কালো পদা ছিন্ন হইয়া পড়িয়া গেল। দরের আশা দরে হইয়া নিকটের জিনিসগুলি প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিল। সগভীর পরিত্রাণের নিশ্বাস ফেলিয়া কান্তি লজাবনত বধরে মাখের দিকে কোনো-এক সষোগে চাহিয়া দেখিলেন। এতক্ষণে যথাথ শুভদৃষ্টি হইল। চম চক্ষর অন্তরালবতী মনোনেত্রের উপর হইতে সমস্ত বাধা খসিয়া পড়িল। হাদয় হইতে এবং প্রদীপ হইতে সমস্ত আলোক বিচ্ছুরিত হইয়া একটিমাত্র কোমল সকুমার মখের উপরে প্রতিফলিত হইল ; কান্তি দেখিলেন, একটি স্নিগ্ধ শ্রী, একটি শান্ত লাবণ্যে মুখখানি মণ্ডিত। বঝিলেন, নবীনের আশীবাদ সাথক হইবে।

Exit mobile version