Raater Alo

শেষ হয়ে যাওয়া একটি মেয়ের গল্প : মিলে যায় অনেক মেয়ের জীবনের সাথে

শেষ হয়ে যাওয়া একটি মেয়ের গল্প

শেষ হয়ে যাওয়া একটি মেয়ের গল্প

ইন্টার পাশ করার পর বাবা মা এর পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে গেল।ছেলে ভালো চাকরি করে।সারা জীবনের খাওয়া পরা নিয়ে আর কোন চিন্তা নাই। জামাইর ঘর করতে করতেই মেয়েটি লেখাপড়ার শেষ গন্ডি পার হলো।এর মধ্যেই জামাইর ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে দুটি সন্তানের মা হয়ে গেলো।চাকরি করতে চাইলে জামাই কন্ঠে রসের হাড়ি উপুর করে দিয়ে বলে,”কেন শুধু শুধু বাচ্চাদের কষ্ট দিবা!!আমি চাকরি করছি না?”

মেয়েটি সেই রসের হাড়ির রসে সুখের ভেলায় ভাসতে ভাসতে ভালবাসার স্বামীর বুকে মুখ গুজে।আর ভাবে,”কি দরকার চাকরী বাকরীর!!ভালই তো আছি।”

সন্তানরা বড় হতে থাকে,মেয়েটি আরো ব্যাস্ত হতে থাকে।সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায়।নিশ্চিত থাকে, স্বামীর সন্তান স্বামী তো দেখবেই।কোল জুরে তৃতীয় সন্তান আসলো।

আর স্বামীর চেহারা গেল পাল্টে।স্বামী আর স্বামী রইলো না।হয়ে গেল,পুরুষ মানুষ।

এই লোকটিকে মেয়েটি কখনো দেখেনি।চিনে না।কে এই অপরিচিত লোকটি??

সংসারে কে কি খেলো,কি পড়লো কিছুই দেখে না।সারাদিন ঝগড়া লেগে থাকে।কয়েকবার পুরুষটি মেয়েটির গায়ে হাত ও তুলল।মেয়েটি মুরুব্বী টাইপের আত্মীয় স্বজনের কাছে সমস্যা বলে সাহায্য চেয়েছিলো।সবার এক কথা”থাক মা।মানুষ এর চাইতেও খারাপ থাকে।নিচের দিকে তাকা।দেখবি অনেক ভালো আছিস।জামাইর সাথে কোন তর্কে যাবি না মা।কয়দিন আর বাঁচে মানুষ বল।দেখবি এক সময় সব ঠিক হয়ে গেছে।”

মেয়েটি দিন গুনতে থাকে, কবে সব ঠিক হবে?আসবে কি সেই সোনালি দিন গুলো ফিরে।কতবার জিজ্ঞেস করেছে,”তোমার জীবনে কি অন্য কেউ আসছে?আমাকে খুলে বলো।কেন তুমি সংসারের খরচ নিয়ে এমন কর।টাকা তো তুমি ভালই ইনকাম করো।তাহলে??”

কোন ভালো উত্তর পায়নি।পেয়েছে শুধু কটু কথা আর লান্চনা।”আমার টাকা আমি কই খরচ করি,সেটা কেন কৈফিয়ত দিবো কাউকে?”

মেয়েটি তাকিয়ে থাকে।ভাবে,”এই কি সেই প্রানের স্বামী?”

চাকরী করার বাসনা মনে জেগেছিলো।কিন্তু তিনটা বাচ্চার দিকে তাকিয়ে হয়নি।একসময় চুপ হয়ে গেলো মেয়েটি।কারন বাপের বাড়ির লোকজন সংসার ছাড়ার পক্ষে না থাকলেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো।এভাবে সেভাবে ঠেলাগাড়ির মতো চলতে লাগলো সংসার।ভাবে,”স্বামী সুখ হয়তো শেষ,কিন্তু বাচ্চা গুলা বড় হলে হয়তো আরো অনেক ভালো থাকবো।”বিধাতা বোধ হয় তখন মুচকি হেসেছেন।

বড় ছেলেটির মাথায় হঠাৎ করেই গন্ডগোল দেখা দিলো।কি জানি,হয়তো হঠাৎ না।বাবা মা এর অশান্তি দেখতে দেখতেই হয়তো ধীরে ধীরে এমন হয়েছে।যাই হোক না কেন,এটা একটা মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো ঘটনা।নিজের জন্য কোনদিন যা করেনি,ছেলেটির জন্য অনেক কেঁদেছিলো মেয়েটি ঐ পুরুষ মানুষটির পা ধরে।হয়তো তখন একটু অন্তর গলেছিলো,বাবা নামক পদার্থটির।চিকিৎসাও করিয়েছিলো টুকটাক।কিন্তু বেশিদিন ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারেনি।

ধৈর্য্য থাকবে কি করে!!তাহলে যে নিজের সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে।ছেলেটির ট্রিটমেন্ট মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেলো।মানসিক রুগি হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো।আর মেঝো ছেলেটি লেখাপড়া ছেড়ে দিলো।

বাকি থাকলো মেয়েটি।ও তো মেয়ে।কি আর হবে ওর জীবন।মা এর মতোই হবে হয়তো।আর সংসারটা যার সেই মেয়েটি আরো নিস্তেজ হয়ে গেলো।একসময় তার শরীরেও বাসা বাঁধলো কঠিন অসুখ।চিকিৎসা করাবে কে?

সেই পুরুষ মানুষটি বলেছে,বাপের বাড়ি গিয়ে ট্রিটমেন্ট করাতে।তার এতো টাকা নাই।

মেয়েটি অবশ্য বাবার বাড়ি থেকেই টাকা পয়সা জোগারের ব্যাবস্থা করছিলো।কারন তাকে বাঁচতে হবে ছেলে মেয়েদের জন্য।সে ছাড়া যে আর কেউ নেই বাচ্চাগুলার। মানসিক রুগি ছেলেটিকে খাওয়ানো।মেঝ ছেলেটিকে লেখাপড়ায় আবার উৎসাহী করে তোলা।একমাত্র মেয়েটিকে ভবিষ্যতের ভালো একটা রাস্তা ধরিয়ে দেয়া।কতো কাজ!!তাই তাকে বাঁচতে হবে। কিন্তু বিধাতার বুঝি অন্যরকম পরিকল্পনা মেয়েটিকে নিয়ে।

হঠাৎ করেই শুনলাম সে আর এই দুনিয়ায় নেই।শেষ হয়ে গেল একটা জীবন।

কাকে দোষ দিব আমরা??তার স্বামীকে??তার বাপের বাড়ীর লোকজনকে নাকি মেয়েটির নিয়তিকে??শারীরিক,মানুষিক নির্যাতন সহ্য করে যে মেয়েটি আজকে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলো,সে ও তো একসময় কোন এক বাবার রাজকন্যা ছিলো।বাবার হাত ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটতে শিখেছিলো।কোন এক মায়ের চোখের মনি ছিলো।মা মেয়েটিকে সাথে নিয়ে লেখাপড়া,ঘর গুছানো,রান্নাবান্না সব শিখিয়েছিল হাতে ধরে।স্বামীর বাড়ির উপযোগী করে গড়ে তুলেছিলো।মেয়েটিকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিলো তার পরিবারের।না, ইনকাম করে খাওয়াবে এমন স্বপ্ন না।বাবা মা এর আদরের মেয়েটি স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকবে এমন স্বপ্ন। চোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর ঘর করতে এসেছিলো মেয়েটি।হাতে গোনা কয়েকটি বছর বাদে বাকি জীবনটা তার গেলো সংগ্রাম করতে করতে।

কেন…কেন আমরা মেয়েরা এতো কষ্ট সহ্য করবো!!সৃষ্টিকর্তা কি বলেছেন,আমাদের এইরকম ভাবে মুখ বুঝে অত্যচার সহ্য করতে??একটু বুদ্ধি খরচ করে কি আমরা চলতে পারি না??স্বামী যতক্ষন স্বামী থাকে,আমরা ততোক্ষন বউ থাকবো।স্বামী যখন অচেনা মানুষে পরিনিত হবে,আমরা তখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবো।একটা মেয়ে স্বামী, সংসার,সন্তান সামলাতে সামলাতে ভুলেই যায় তার ও একটা নিজস্বতা আছে।সে ও একটা মানুষ।তার ও অনেক কিছু ইচ্ছা করে।

যে লোকটি তার বউ এর সাথে অন্যায় করে, তাকেও সৃষ্টিকর্তা বিবেক বুদ্ধি দিয়েছেন।তারপর ও তাকে কেন যেন দোষ দেয়া যায় না।কারন সে হয়তো পরিবার থেকে এই শিক্ষাটা পায়নি।মেয়েরা মায়ের জাতি।সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের এমন কিছু গুন দিয়েছেন,যা পুরুষ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না।মেয়েদের শরীরে সৃষ্টকর্তার হুকুমে নতুন মানুষ জন্ম নেয়।মেয়েদের অসীম ধৈর্য্য।যা পুরুষের মধ্যে কমই লক্ষ্য করা যায়।এরকম জাতিকে তো সবার শ্রদ্ধা করা উচিৎ।ভালবাসা উচিৎ।

আসুন সবাই আজকে থেকেই নিজ নিজ পরিবারে কাজ শুরু করে দেই।মা রা ছেলে সন্তানদের বুঝাই মেয়েদের শ্রদ্ধা করার বিষয়টা। বোনের সাথে,বউ এর সাথে কিভাবে আচরন করতে হবে তা পরিবার থেকেই শিক্ষা নিক একটা ছেলে সন্তান।তাহলে পরবর্তী জীবনে তার জীবনটাও সুখের সাগরে ভাসবে।যেসব পুরুষ গুলো এমন তারা আসলে জানেই না পরিবার কি…সংসার কি…সন্তান কি….সর্বোপরি বউ কি এবং তার সংসারে বউ এর ভূমিকা কতখানি।

আসলে সেই পুরুষ মানুষটি হয়তো পরিবার থেকেই কিছু শিখে আসেনি।জানবে কোথা থেকে।আর যে মায়ের কাছ থেকে শিখবে সেও হয়তো শেখায়নি কিংবা সেই মা নিজেই হয়তো অত্যাচারিত ছিলো।একটা মায়ের সন্তানকে মানুষ করতে গেলে তার নিজের ও তো মন মানসিকতা ঠিক থাকা লাগবে।

এখন সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর।মেয়েরা আমরা পরে পরে অত্যাচারিত না হয়ে যে যার যার জায়গায় থেকে ঘুরে দাঁড়াবো।সন্তান মানুষ করতে হলে এটা অবশ্যই দরকার।চাকরি করতে পারলে করবো।না করতে পারলে নিজস্ব একটা জগৎ তৈরী করে নিবো।যেখানে আমার অবাধ বিচরন থাকবে।যেখানে আমাদের মাইন্ড ফ্রেশের প্রয়োজনীয় উপকরন থাকবে।অত্যাচারী স্বামীকে কঠিন হাতে দমন করবো।নিজের ব্যক্তিত্ব নিজে বজায় রাখবো।মনকে নিয়ন্ত্রন করবো আমরা।

কথায় তো আছেই,মন ভালো থাকলে শরীর ও ভালো থাকে।কেন শুধু শুধু চোখের পানিকে এতো সস্তা করে ফেলবো!!কেন সৃষ্টিকর্তার দেয়া এত বড় নেয়ামত আমাদের শরীরটাকে আমরা কষ্ট দিবো!!

প্রতিটা মেয়েকে ঘুরে দাঁড়াতে জানতে হবে।বিপদে মুখ থুবরে পরে না থেকে বা কষ্টকে নিয়তির পরিহাস ভেবে মেনে নিয়ে বসে না থেকে যার যার অবস্থান থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়াবো।তবেই না আমাদের হাতে একটা সুস্থ মন মানসিকতার প্রজন্ম জন্ম নিবে।ছোট্ট ছোট্ট কুঁড়ি গুলোকে প্রস্ফুটিত করার দায়িত্ব তো আমাদের মেয়েদের উপরই ন্যস্ত করা হয়েছে।কেন আমরা মা হয়ে সন্তানকে বিপথে ঠেলে দিব স্বামী নামক অত্যাচারী লোকটির অত্যাচারের বলি করে নিজেকে!!??সন্তান তো আমাদেরও।আমাদের শরীরের রক্ত মাংস দিয়েই তো আমাদের কোমলমতি সন্তানের জন্ম।আমরা তাদের যা শিক্ষা দিব তাই তো তারা শিখবে।

পরিশেষে শুধু বলবো,মায়ের জাতি আমরা।মমতার রসে যেমন টইটুম্বুর।সময় মতো রুদ্র মূর্তি ধরতেও আমাদের জুরি মেলা ভার।তবে কেন আমরা ঘরে বাইরে অত্যাচারিত হবো।একটু বুদ্ধি খরচ করে নিজেকে ভালো রাখার কৌশল আমাদেরই খুঁজে নিতে হবে।মোট কথা আমাদের মন… আমাদের শরীর… ভাল রাখার দায়িত্ত্ব ও আমাদের।

গল্পটি লিখেছেন: সালমা তালুকদার

Exit mobile version