জনপ্রিয় বাংলা প্রেমের কবিতা: হৃদয়ের ছোঁয়া l Popular Bengali Love Poems: Touching the Heart 2024

By raateralo.com

Updated on:

জনপ্রিয় বাংলা প্রেমের কবিতা , Popular Bengali Love Poems

জনপ্রিয় বাংলা প্রেমের কবিতা: হৃদয়ের ছোঁয়া: বাংলা সাহিত্য সবসময় প্রেমের সুধাময় সৌন্দর্যে ভরপুর। প্রেমের কবিতা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মূল্যবান রত্ন, যা যুগে যুগে পাঠকদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। বাংলা ভাষার মহান কবিদের হাতে রচিত প্রেমের কবিতাগুলি প্রেম, বেদনা, আনন্দ, আর আবেগের এক অসামান্য সংমিশ্রণ।

এই ব্লগে আমরা সেইসব জনপ্রিয় বাংলা প্রেমের কবিতার প্রতি একঝলক নজর দেব, যা প্রেমের আবেগকে অসামান্য ভাবে প্রকাশ করেছে। রবি ঠাকুরের “শেষের কবিতা” থেকে শুরু করে কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী প্রেম, প্রেমের কবিতা সবসময়ই প্রেমিক হৃদয়ের একান্ত আপন সঙ্গী। চলুন, প্রেমের এই মধুময় যাত্রায় আমরা সবাই একসাথে পা বাড়াই এবং হারিয়ে যাই বাংলা প্রেমের কবিতার সুধাময় জগতে।

জনপ্রিয় বাংলা প্রেমের কবিতা: হৃদয়ের ছোঁয়া

Table of Contents

পিছু-ডাক (Pichu Dak) – কাজী নজরুল ইসলাম

সখি! নতুন ঘরে গিয়ে আমায় প’ড়বে কি আর মনে?

               সেথা তোমার নতুন পূজা নতুন আয়োজনে!

                         প্রথম দেখা তোমায় আমায়

                         যে গৃহ-ছায় যে আঙিনায়,

                         যেথায় প্রতি ধূলিকণায়,

                                             লতাপাতার সনে

               নিত্য চেনার বিত্ত রাজে চিত্ত-আরাধনে,

               শূন্য সে ঘর শূন্য এখন কাঁদছে নিরজনে।।

সেথা তুমি যখন ভুল্‌তে আমায়, আস্‌ত অনেক কেহ,

তখন আমার হ’য়ে অভিমানে কাঁদত যে ঐ গেহ।

                         যেদিক পানে চাইতে সেথা

                         বাজ্‌তে আমার স্মৃতির ব্যথা,

                         সে গ্লানি আজ ভুলবে হেথা

                                             নতুন আলাপনে।

               আমিই শুধু হারিয়ে গেলেম হারিয়ে-যাওয়ার বনে।।

আমার এত দিনের দূর ছিল না সত্যিকারের দুর,

ওগো আমার সুদুর ক’রত নিকট ঐ পুরাতন পুর।

                         এখন তোমার নতুন বাঁধন

                         নতুন হাসি, নতুন কাঁদন,

                         নতুন সাধন, গানের মাতন

                                             নতুন আবাহনে।

               আমারই সুর হারিয়ে গেল সুদুর পুরাতন।।

সখি! আমার আশাই দুরাশা আজ, তোমার বিধির বর,

আজ মোর সমাধির বুকে তোমার উঠবে বাসর-ঘর!

                         শূণ্য ভ’রে শুনতে পেনু

                         ধেনু-চরা বনের বেণু-

                         হারিয়ে গেনু হারিয়ে গেনু

                                             অন–দিগঙ্গনে।

               বিদায় সখি, খেলা-শেষ এই বেলা-শেষের খনে!

               এখন তুমি নতুন মানুষ নতুন গৃহকোণে।।

কর্ণফুলী – কাজী নজরুল ইসলাম

ওগো ও কর্ণফুলী,

উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি।

যে লোনা জলের সিন্ধু-সিকতে নিতি তব আনাগোনা,

আমার অশ্রু লাগিবে না সখী তার চেয়ে বেশি লোনা!

তুমি শুধু জল করো টলমল ; নাই তব প্রয়োজন

আমার দু-ফোঁটা অশ্রুজলের এ গোপন আবেদন।

যুগ যুগ ধরি বাড়াইয়া বাহু তব দু-ধারের তীর

ধরিতে চাহিয়া পারেনি ধরিতে, তব জল-মঞ্জীর

বাজাইয়া তুমি ওগো গর্বিতা চলিয়াছ নিজ পথে!

কূলের মানুষ ভেসে গেল কত তব এ অকূল স্রোতে!

তব কূলে যারা নিতি রচে নীড় তারাই পেল না কূল,

দিশা কি তাহার পাবে এ অতিথি দুদিনের বুলবুল?

– বুঝি প্রিয় সব বুঝি,

তবু তব চরে চখা কেঁদে মরে চখিরে তাহার খুঁজি!

* * *

তুমি কি পদ্মা, হারানো গোমতী, ভোলে যাওয়া ভাগিরথী –

তুমি কি আমার বুকের তলার প্রেয়সী অশ্রুমতী?

দেশে দেশে ঘুরে পেয়েছি কি দেখা মিলনের মোহানায়,

স্থলের অশ্রু নিশেষ হইয়া যথায় ফুরায়ে যায়?

ওরে পার্বতী উদাসিনী, বল এ গৃহ-হারারে বল,

এই স্রোত তোর কোন পাহাড়ের হাড়-গলা আঁখি-জল?

বজ্র যাহারে বিঁধিতে পারেনি, উড়াতে পারেনি ঝড়,

ভূমিকম্পে যে টলেনি, করেনি মহাকালেরে যে ডর,

সেই পাহাড়ের পাষাণের তলে ছিল এত অভিমান?

এত কাঁদে তবু শুকায় না তার চোখের জলের বান?

তুই নারী, তুই বুঝিবি না নদী পাষাণ নরের ক্লেশ,

নারী কাঁদে – তার সে-আঁখিজলের একদিন শেষ।

পাষাণ ফাটিয়া যদি কোনোদিন জলের উৎস বহে,

সে জলের ধারা শাশ্বত হয়ে রহে রে চির-বিরহে!

নারীর অশ্রু নয়নের শুধু ; পুরুষের আঁখি-জল

বাহিরায় গলে অন্তর হতে অন্তরতম তল!

আকাশের মতো তোমাদের চোখে সহসা বাদল নেমে

রৌদ্রের তাত ফুটে ওঠে সখী নিমেষে সে মেঘ থেমে!

সারা গিরি হল শিরী-মুখ হায়, পাহাড় গলিল প্রেমে,

গলিল না শিরী! সেই বেদনা কি নদী হয়ে এলে নেমে?

ওই গিরি-শিরে মজনুন কি গো আজিও দিওয়ানা হয়ে

লায়লির লাগি নিশিদিন জাগি ফিরিতেছে রোয়ে রোয়ে?

পাহাড়ের বুক বেয়ে সেই জল বহিতেছ তুমি কি গো? –

দুষ্মন্তের খোঁজ-আসা তুমি শকুন্তলার মৃগ?

মহাশ্বেতা কি বসিয়াছে সেথা পুণ্ডরীকের ধ্যানে? –

তুমি কি চলেছ তাহারই সে প্রেম নিরুদ্দেশের পানে? –

যুগে যুগে আমি হারায়ে প্রিয়ারে ধরণির কূলে কূলে

কাঁদিয়াছি যত, সে অশ্রু কি গো তোমাতে উঠেছে দুলে?

* * *

– ওগো চির উদাসিনী!

তুমি শোনো শুধু তোমারই নিজের বক্ষের রিনিরিনি।

তব টানে ভেসে আসিল যে লয়ে ভাঙা ‘সাম্পান’ তরি,

চাহনি তাহার মুখ-পানে তুমি কখনও করুণা করি।

জোয়ারে সিন্ধু ঠেলে দেয় ফেলে তবু নিতি ভাটি-টানে

ফিরে ফিরে যাও মলিন বয়ানে সেই সিন্ধুরই পানে!

বন্ধু, হৃদয় এমনই অবুঝ কারও সে অধীন নয়!

যারে চায় শুধু তাহারেই চায়– নাহি মনে লাজ ভয়।

বারে বারে যায় তারই দরজায়, বারে বারে ফিরে আসে!

যে আগুনে পুড়ে মরে পতঙ্গ – ঘোরে সে তাহারই পাশে!

* * *

–ওগো ও কর্ণফুলী!

তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কান-ফুল খুলি?

তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে,

‘সাম্পান’-নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে?

আনমনা তার খুলে গেল খোঁপা, কান-ফুল গেল খুলি,

সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হলে কি কর্ণফুলী ?

যে গিরি গলিয়া তুমি বও নদী, সেথা কি আজিও রহি

কাঁদিছে বন্দী চিত্রকূটের যক্ষ চির-বিরহী?

তব এত জল একি তারই সেই মেঘদূত-গলা বাণী?

তুমি কি গো তার প্রিয়-বিরহের বিধুর স্মরণখানি?

ওই পাহাড়ে কি শরীরে স্মরিয়া ফারেসের ফরহাদ,

আজিও পাথর কাটিয়া করিছে জিন্দেগি বরবাদ?

তব জলে আমি ডুবে মরি যদি, নহে তব অপরাধ,

তোমার সলিলে মরিব ডুবিয়া, আমারই সে চির-সাধ!‌

আপনার জ্বালা মিটাতে এসেছি তোমার শীতল তলে,

তোমারে বেদনা হানিতে আসিনি আমার চোখের জলে!

অপরাধ শুধু হৃদয়ের সখী, অপরাধ কারও নয়!

ডুবিতে যে আসে ডুবে সে একাই, তটিনী তেমনই বয়!

* * *

সারিয়া এসেছি আমার জীবনে কূলে ছিল যত কাজ,

এসেছি তোমার শীতল নিতলে জুড়াইতে তাই আজ!

ডাকনিকো তুমি, আপনার ডাকে আপনি এসেছি আমি

যে বুকের ডাক শুনেছি শয়নে স্বপনে দিবস-যামি।

হয়তো আমারে লয়ে অন্যের আজও প্রয়োজন আছে,

মোর প্রয়োজন ফুরাইয়া গেছে চিরতরে মোর কাছে!

– সে কবে বাঁচিতে চায়,

জীবনের সব প্রয়োজন যার জীবনে ফুরায়ে যায়!

জীবন ভরিয়া মিটায়েছি শুধু অপরের প্রয়োজন,

সবার খোরাক জোগায়ে নেহারি উপবাসী মোরই মন!

আপনার পানে ফিরে দেখি আজ – চলিয়া গেছে সময়,

যা হারাবার তা হারাইয়া গেছে, তাহা ফিরিবার নয়!

হারায়েছি সব, বাকি আছি আমি, শুধু সেইটুকু লয়ে

বাঁচিতে পারিনা, যত চলি পথে তত উঠি বোঝা হয়ে!

বহিতে পারি না আর এই বোঝা, নামানু সে ভার হেথা;

তোমার জলের লিখনে লিখিনু আমার গোপন ব্যথা!

ভয় নাই প্রিয়, নিমেষে মুছিয়া যাইবে এ জল-লেখা,

তুমি জল – হেথা দাগ কেটে কভু থাকে না কিছুরই রেখা!

আমার ব্যথায় শুকায়ে যাবে না তব জল কাল হতে,

ঘূর্ণাবর্ত জাগিবে না তব অগাধ গভীর স্রোতে।

হয়তো ঈষৎ উঠিবে দুলিয়া, তারপর উদাসিনী,

বহিয়া চলিবে তব পথে তুমি বাজাইয়া কিঙ্কিণি!

শুধু লীলাভরে তেমনই হয়তো ভাঙিয়া চলিবে কূল,

তুমি রবে, শুধু রবে নাকো আর এ গানের বুলবুল!

তুষার-হৃদয় অকরুণা ওগো, বুঝিয়াছি আমি আজি –

দেওলিয়া হয়ে কেন তব তীরে কাঁদে ‘সাম্পান’-মাঝি!

Read More: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতা

সুপ্তোত্থিতা (Suptothita) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঘুমের দেশে ভাঙিল ঘুম, উঠিল কলস্বর ।

গাছের শাখে জাগিল পাখি, কুসুমে মধুকর ।

অশ্বশালে জাগিল ঘোড়া, হস্তীশালে হাতি ।

মল্লশালে মল্ল জাগি ফুলায় পুন ছাতি ।

জাগিল পথে প্রহরীদল, দুয়ারে জাগে দ্বারী,

আকাশে চেয়ে নিরখে বেলা জাগিয়া নরনারী ।

উঠিল জাগি রাজাধিরাজ, জাগিল রানীমাতা ।

কচলি আঁখি কুমার-সাথে জাগিল রাজভ্রাতা ।

নিভৃত ঘরে ধূপের বাস, রতন-দীপ জ্বালা,

জাগিয়া উঠি শয্যাতলে শুধালো রাজবালা—

                             ‘কে পরালে মালা ! ‘

খসিয়া-পড়া আঁচলখানি বক্ষে তুলে নিল ।

আপন-পানে নেহারি চেয়ে শরমে শিহরিল ।

ত্রস্ত হয়ে চকিত চোখে চাহিল চারি দিকে—

বিজন গৃহ, রতন-দীপ জ্বলিছে অনিমিখে ।

গলার মালা খুলিয়া লয়ে ধরিয়া দুটি করে

সোনার সূতে যতনে গাঁথা লিখনখানি পড়ে।

পড়িল নাম, পড়িল ধাম, পড়িল লিপি তার,

কোলের ‘পরে বিছায়ে দিয়ে পড়িল শতবার ।

শয়নশেষে রহিল বসে, ভাবিল রাজবালা—

‘আপন ঘরে ঘুমায়ে ছিনু নিতান্ত নিরালা,

                             ‘কে পরালে মালা !’

নূতন-জাগা কুঞ্জবনে কুহরি উঠে পিক,

বসন্তের চুম্বনেতে বিবশ দশ দিক ।

বাতাস ঘরে প্রবেশ করে ব্যাকুল উচ্ছাসে,

নবীনফুলমঞ্জরীর গন্ধ লয়ে আসে ।

জাগিয়া উঠে বৈতালিক গাহিছে জয়গান,

প্রাসাদদ্বারে ললিত স্বরে বাঁশিতে উঠে তান ।

শীতলছায়া নদীর পথে কলসে লয়ে বারি—

কাঁকন বাজে, নূপুর বাজে, চলিছে পুরনারী ।

কাননপথে মর্মরিয়া কাঁপিছে গাছপালা,

আধেক মুদে নয়ন দুটি ভাবিছে রাজবালা—

                             ‘কে পরালে মালা !’

বারেক মালা গলায় পরে, বারেক লহে খুলি—

দুইটি করে চাপিয়া ধরে বুকের কাছে তুলি ।

শয়ন -‘পরে মেলায়ে দিয়ে তৃষিত চেয়ে রয়,

এমনি করে পাইবে যেন অধিক পরিচয় ।

জগতে আজ কত-না ধ্বনি উঠিছে কত ছলে—

একটি আছে গোপন কথা, সে কেহ নাহি বলে ।

বাতাস শুধু কানের কাছে বহিয়া যায় হূহু,

কোকিল শুধু অবিশ্রাম ডাকছে কুহু কুহু ।

নিভৃত ঘরে পরান মন একান্ত উতালা,

শয়নশেষে নীরবে বসে ভাবিছে রাজবালা—

                             ‘কে পরালে মালা !’

কেমন বীর-মুরতি তার মাধুরী দিয়ে মিশা—

দীপ্তিভরা নয়ন-মাঝে তৃপ্তিহীন তৃষা ।

স্বপ্নে তারে দেখেছে যেন এমনি মনে লয়—

ভুলিয়া গেছে রয়েছে শুধু অসীম বিস্ময় ।

পার্শ্বে যেন বসিয়াছিল, ধরিয়াছিল কর,

এখনো তার পরশে যেন সরস কলেবর ।

চমকি মুখ দু হাতে ঢাকে, শরমে টুটে মন,

লজ্জাহীন প্রদীপ কেন নিভে নি সেইক্ষণ !

কন্ঠ হতে ফেলিল হার যেন বিজুলিজ্বালা,

শয়ন-‘পরে লুটায়ে প’ড়ে ভাবিল রাজবালা—

                             ‘কে পরালে মালা !’

এমনি ধীরে একটি করে কাটিছে দিন রাতি ।

বসন্ত সে বিদায় নিল লইয়া যূথীজাতি ।

সঘন মেঘে বরষা আসে, বরষে ঝরঝর্,

কাননে ফুটে নবমালতী কদম্বকেশর ।

স্বচ্ছহাসি শরৎ আসে পূর্ণিমামালিকা,

সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা ।

আসিল শীত সঙ্গে লয়ে দীর্ঘ দুখনিশা,

শিশির-ঝরা কুন্দফুলে হাসিয়া কাঁদে দিশা ।

ফাগুন-মাস আবার এল বহিয়া ফুলডালা,

জানালা-পাশে একেলা বসে ভাবিছে রাজবালা—

                             ‘কে পরালে মালা !’

লাজময়ী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Lajmoyi poem by Rabindranath)

কাছে তার যাই যদি কত যেন পায় নিধি

তবু হরষের হাসি ফুটে ফুটে, ফুটে না।

কখন বা মৃদু হেসে আদর করিতে এসে

সহসা সরমে বাধে, মন উঠে উঠে না।

অভিমানে যাই দূরে, কথা তার নাহি ফুরে,

চরণ বারণ-তরে উঠে উঠে, উঠে না।

কাতর নিশ্বাস ফেলি আকুল নয়ন মেলি

চেয়ে থাকে, লাজবাঁধ তবু টুটে টুটে না।

যখন ঘুমায়ে থাকি মুখপানে মেলি আঁখি

চাহি দেখে, দেখি দেখি সাধ যেন মিটে না।

সহসা উঠিলে জাগি, তখন কিসের লাগি

মরমেতে ম’রে গিয়ে কথা যেন ফুটে না!

লাজময়ি তোর চেয়ে দেখি নি লাজুক মেয়ে

প্রেমবরিষার স্রোতে লাজ তবু ছুটে না!

প্রথম চুম্বন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Prothom chumbon Rabindranath Tagore)

স্তব্ধ হল দশ দিক নত করি আঁখি—

বন্ধ করি দিল গান যত ছিল পাখি।

শান্ত হয়ে গেল বায়ু, জলকলস্বর

মুহূর্তে থামিয়া গেল, বনের মর্মর

বনের মর্মের মাঝে মিলাইল ধীরে।

নিস্তরঙ্গ তটিনীর জনশূন্য তীরে

নিঃশব্দে নামিল আসি সায়াহ্নচ্ছায়ায়

নিস্তব্ধ গগনপ্রান্ত নির্বাক্ ধরায়।

সেইক্ষণে বাতায়নে নীরব নির্জন

আমাদের দুজনের প্রথম চুম্বন।

দিক্-দিগন্তরে বাজি উঠিল তখনি

দেবালয়ে আরতির শঙ্খঘণ্টাধ্বনি।

অনন্ত নক্ষত্রলোক উঠিল শিহরি,

আমাদের চক্ষে এল অশ্রুজল ভরি।

অচেনা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Achena poem by Rabindranath)

তোমারে আমি কখনো চিনি নাকো,

লুকানো নহ, তবু লুকানো থাকো।

ছবির মতো ভাবনা পরশিয়া

একটু আছ মনেরে হরষিয়া।

অনেক দিন দিয়েছ তুমি দেখা,

বসেছ পাশে, তবুও আমি একা।

আমার কাছে রহিলে বিদেশিনী,

লইলে শধু নয়ন মম জিনি।

বেদনা কিছু আছে বা তব মনে,

সে ব্যথা ঢাকে তোমারে আবরণে।

শূন্য-পানে চাহিয়া থাকো তুমি,

নিশ্বসিয়া উঠে কাননভূমি।

মৌন তব কী কথা বলে বুঝি,

অর্থ তারি বেড়াই মনে খুঁজি।

চলিয়া যাও তখন মনে বাজে—

চিনি না আমি, তোমারে চিনি না যে।

চিরায়মানা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Chiraymana poem Rabindranath

যেমন আছ তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ।

বেণী নাহয় এলিয়ে রবে, সিঁথি নাহয় বাঁকা হবে,

নাই-বা হল পত্রলেখায় সকল কারুকাজ।

কাঁচল যদি শিথিল থাকে নাইকো তাহে লাজ।

যেমন আছ তেমনি এসো, আর করো না সাজ।।

এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের ‘পরে ফেলে।

ভয় কোরো না – অলক্তরাগ মোছে যদি মুছিয়া যাক,

নূপুর যদি খুলে পড়ে নাহয় রেখে এলে।

খেদ কোরো না মালা হতে মুক্তা খসে গেলে।

এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের ‘পরে ফেলে।

হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে।

ও পার হতে দলে দলে বকের শ্রেণী উড়ে চলে,

থেকে থেকে শূন্য মাঠে বাতাস ওঠে জেগে।

ওই রে গ্রামের গোষ্ঠমুখে ধেনুরা ধায় বেগে।

হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে।।

প্রদীপখানি নিবে যাবে, মিথ্যা কেন জ্বালো?

কে দেখতে পায় চোখের কাছে কাজল আছে কি না আছে,

তরল তব সজল দিঠি মেঘের চেয়ে কালো।

আঁখির পাতা যেমন আছে এমনি থাকা ভালো।

কাজল দিতে প্রদীপখানি মিথ্যা কেন জ্বালো?।

এসো হেসে সহজ বেশে, আর কোরো না সাজ।

গাঁথা যদি না হয় মালা ক্ষতি তাহে নাই গো বালা,

ভূষণ যদি না হয় সারা ভূষণে নাই কাজ।

মেঘ মগন পূর্বগগন, বেলা নাই রে আজ।

এসো হেসে সহজ বেশে, নাই-বা হল সাজ।।

ছল – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Chol poem Rabindranath Tagore

তোমারে পাছে সহজে বুঝি    তাই কি এত লীলার ছল –

বাহিরে যবে হাসির ছটা    ভিতরে থাকে আঁখির জল।

বুঝি গো আমি, বুঝি গো    তব ছলনা –

যে কথা তুমি বলিতে চাও     সে কথা তুমি বল না।।

তোমারে পাছে সহজে ধরি     কিছুরই তব কিনারা নাই –

দশের দলে টানি গো পাছে     কিরূপ তুমি, বিমুখ তাই।

বুঝি গো আমি, বুঝি গো তব     ছলনা –

যে পথে তুমি চলিতে চাও     সে পথে তুমি চল না।।

সবার চেয়ে অধিক চাহ,      তাই কি তুমি ফিরিয়া যাও –

হেলার ভরে খেলার মতো      ভিক্ষাঝুলি ভাসায়ে দাও?

বুঝেছি আমি, বুজেছি    তব ছলনা –

সবার যাহে তৃপ্তি হল     তোমার তাহে হল না।।

নিদ্রিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Nidrita poem Rabindranath Tagore

একদা রাতে নবীন যৌবনে

স্বপ্ন হতে উঠিনু চমকিয়া,

বাহিরে এসে দাঁড়ানু একবার—

ধরার পানে দেখিনু নিরখিয়া ।

শীর্ণ হয়ে এসেছে শুকতারা,

পূর্বতটে হতেছে নিশিভোর ।

আকাশকোণে বিকাশে জাগরণ,

ধরণীতলে ভাঙে নি ঘুমঘোর ।

সমুখে প’ড়ে দীর্ঘ রাজপথ,

দু ধারে তারি দাঁড়ায়ে তরুসার,

নয়ন মেলি সুদূর-পানে চেয়ে

আপন-মনে ভাবিনু একবার—

অরুণ-রাঙা আজি এ নিশিশেষে

ধরার মাঝে নূতন কোন্ দেশে

দুগ্ধফেনশয়ন করি আলা

স্বপ্ন দেখে ঘুমায়ে রাজবালা ।।

অশ্ব চড়ি তখনি বাহিরিনু,

কত যে দেশ বিদেশ হনু পার !

একদা এক ধূসরসন্ধ্যায়

ঘুমের দেশে লভিনু পুরদ্বার ।

সবাই সেথা অচল অচেতন,

কোথাও জেগে নাইকো জনপ্রাণী,

নদীর তীরে জলের কলতানে

ঘুমায়ে আছে বিপুল পুরীখানি ।

ফেলিতে পদ সাহস নাহি মানি,

নিমেষে পাছে সকল দেশ জাগে ।

প্রাসাদ মাঝে পশিনু সাবধানে,

শঙ্কা মোর চলিল আগে আগে ।

ঘুমায় রাজা, ঘুমায় রানীমাতা,

কুমার-সাথে ঘুমায় রাজভ্রাতা ।

একটি ঘরে রত্নদীপ জ্বালা,

ঘুমায়ে সেথা রয়েছে রাজবালা ।।

কমলফুল বিমল শেজখানি,

নিলীন তাহে কোমল তনুলতা ।

মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে,

বাজিল বুকে সুখের মত ব্যাথা ।

মেঘের মত গুচ্ছ কেশরাশি

শিথান ঢাকি পড়েছে ভারে ভারে ।

একটি বাহু বক্ষ-‘পরে পড়ি,

একটি বাহু লুটায় এক ধারে ।

আঁচলখানি পড়েছে খসি পাশে,

কাঁচলখানি পড়িবে বুঝি টুটি—

পত্রপুটে রয়েছে যেন ঢাকা

অনাঘ্রাত পূজার ফুল দুটি ।

দেখিনু তারে, উপমা নাহি জানি—

ঘুমের দেশে স্বপন একখানি,

পালঙ্কেতে মগন রাজবালা

আপন ভরা লাবণ্যে নিরালা ।।

ব্যাকুল বুকে চাপিনু দুই বাহু,

না মানে বাধা হৃদয়কম্পন ।

ভূতলে বসি আনত করি শির

মুদিত আঁখি করিনু চুম্বন ।

পাতার ফাঁকে আঁখির তারা দুটি,

তাহারি পানে চাহিনু একমনে—

দ্বারের ফাঁকে দেখিতে চাহি যেন

কী আছে কোথা নিভৃত নিকেতনে ।

ভূর্জপাতে কাজলমসী দিয়ে

লিখিয়া দিনু আপন নামধাম ।

লিখিনু, ‘অয়ি নিদ্রানিমগনা,

আমার প্রাণ তোমারে সঁপিলাম ।’

যতন করে কনক-সুতে গাঁথি

রতন-হারে বাঁধিয়া দিনু পাঁতি—

ঘুমের দেশে ঘুমায়ে রাজবালা,

তাহারি গলে পরায়ে দিনু মালা ।।

কাউকে ভালোবেসেছিলাম – জীবনানন্দ দাশ

কাউকে ভালোবেসেছিলাম জানি

তবুও ভালোবাসা,

দুপুরবেলার সূর্যে ভোরের শিশির

নেমে আসা,

ভোরের দিকে হৃদয় ফেরাই

যাই চলে যাই-

নীল সকালে যাই চলে যাই-

একটি নদী একটি অরূণ

শিউলি শিশির পাখি-

‘আমরা মায়ার মনের জিনিস

মায়াবিনীর বেলায় শুধু জাগি’

বলছে সে কোন্‌ ত্রিকোণ থেকে

ছায়ার পরিভাষা।

কাউকে ভালোবেসেছিলাম, জানি,

তবুও ভালোবাসা।

সে কোন্‌ সুদূর মরুর মনে চলে গেছ

হায়, যাযাবর তুমি,

সেইখানে কি মিলবে বনহংসী বাঁধা বাসা!

হায় বলিভূক, কখন ভেবেছিলে

মাটি ছেড়ে দূর আকাশের নীলে

ধূসর ডানার অগ্নি ছেড়ে দিলে

মিটে যাবে মায়াময়ী মাটির পিপাসা।

১৩৩৩ – জীবনানন্দ দাশ

তোমার শরীর —

তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌ দিকে জানি নি তা — মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোনদিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন

চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে

কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে!

কত দেহ এল, গেল, হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে

দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে

নক্ষত্রের তলে

বসে আছি — সমুদ্রের জলে

দেহ ধুয়ে নিয়া

তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!

তোমার শরীর —

তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌দিকে — ফলে গেছে কতবার,

ঝরে গেছে তৃণ!

*

আমারে চাও না তুমি আজ আর, জানি;

তোমার শরীর ছানি

মিটায় পিপাসা

কে সে আজ! — তোমার রক্তের ভালোবাসা

দিয়েছ কাহারে!

কে বা সেই! — আমি এই সমুদ্রের পারে

বসে আছি একা আজ — ঐ দূর নক্ষত্রের কাছে

আজ আর প্রশ্ন নাই — মাঝরাতে ঘুম লেগে আছে

চক্ষে তার — এলোমেলো রয়েছে আকাশ!

উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা! — তারই তলে পৃথিবীর ঘাস

ফলে ওঠে — পৃথিবীর তৃণ

ঝড়ে পড়ে — পৃথিবীর রাত্রি আর দিন

কেটে যায়!

উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা — তারই তলে হায়!

*

জানি আমি — আমি যাব চলে

তোমার অনেক আগে;

তারপর, সমুদ্র গাহিবে গান বহুদিন —

আকাশে আকাশে যাবে জ্বলে

নক্ষত্র অনেক রাত আরো,

নক্ষত্র অনেক রাত আরো,

(যদিও তোমারও

রাত্রি আর দিন শেষ হবে

একদিন কবে!)

আমি চলে যাব, তবু, সমুদ্রের ভাষা

রয়ে যাবে — তোমার পিপাসা

ফুরাবে না পৃথিবীর ধুলো মাটি তৃণ

রহিবে তোমার তরে — রাত্রি আর দিন

রয়ে যাবে রয়ে যাবে তোমার শরীর,

আর এই পৃথিবীর মানুষের ভিড়।

*

আমারে খুজিয়াছিলে তুমি একদিন —

কখন হারায়ে যাই — এই ভয়ে নয়ন মলিন

করেছিলে তুমি! —

জানি আমি; তবু, এই পৃথিবীর ফসলের ভূমি

আকাশের তারার মতন

ফলিয়া ওঠে না রোজ — দেহ ঝরে — ঝরে যায় মন

তার আগে!

এই বর্তমান — তার দু — পায়ের দাগে

মুছে যায় পৃথিবীর পর,

একদিন হয়েছে যা তার রেখা, ধূলার অক্ষর!

আমারে হারায়ে আজ চোখ ম্লান করিবে না তুমি —

জানি আমি; পৃথিবীর ফসলের ভূমি

আকাশের তারার মতন

ফলিয়া ওঠে না রোজ —

দেহ ঝরে, তার আগে আমাদের ঝরে যায় মন!

*

আমার পায়ের তলে ঝরে যায় তৃণ —

তার আগে এই রাত্রি — দিন

পড়িতেছে ঝরে!

এই রাত্রি, এই দিন রেখেছিলে ভরে

তোমার পায়ের শব্দে, শুনেছি তা আমি!

কখন গিয়েছে তবু থামি

সেই শব্দে! — গেছ তুমি চলে

সেই দিন সেই রাত্রি ফুরায়েছে বলে!

আমার পায়ের তলে ঝরে নাই তৃণ —

তবু সেই রাত্রি আর দিন

পড়ে গেল ঝ’রে।

সেই রাত্রি — সেই দিন — তোমার পায়ের শব্দে রেখেছিলে ভরে!

*

জানি আমি, খুঁজিবে না আজিকে আমারে

তুমি আর; নক্ষত্রের পারে

যদি আমি চলে যাই,

পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই

যদি আমি —

আমারে খুঁজিতে তবু আসিবে না আজ;

তোমার পায়ের শব্দ গেল কবে থামি

আমার এ নক্ষত্রের তলে! —

জানি তবু, নদীর জলের মতো পা তোমার চলে —

তোমার শরীর আজ ঝরে

রাত্রির ঢেউয়ের মতো কোনো এক ঢেউয়ের উপরে!

যদি আজ পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই

যদি আমি চলে যাই

নক্ষত্রের পারে —

জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

*

তুমি যদি রহিতে দাঁড়ায়ে!

নক্ষত্র সরিয়া যায়, তবু যদি তোমার দু — পায়ে

হারায়ে ফেলিতে পথ — চলার পিপাসা! —

একবারে ভালোবেসে — যদি ভালোবাসিতে চাহিতে তুমি সেই ভালোবাসা।

আমার এখানে এসে যেতে যদি থামি! —

কিন্তু তুমি চলে গেছ, তবু কেন আমি

রয়েছি দাঁড়ায়ে!

নক্ষত্র সরিয়া যায় — তবু কেন আমার এ পায়ে

হারায়ে ফেলেছি পথ চলার পিপাসা!

একবার ভালোবেসে কেন আমি ভালোবাসি সেই ভালোবাসা!

*

চলিতে চাহিয়াছিলে তুমি একদিন

আমার এ পথে — কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন।

জানি আমি, আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই।

তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি! — তাই আস নাই

আমার এখানে তুমি আর!

একদিন কত কথা বলেছিলে, তবু বলিবার

সেইদিনও ছিল না তো কিছু — তবু বলিবার

আমার এ পথে তুমি এসেছিলে — বলেছিলে কত কথা —

কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন;

আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই;

তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি — তাই আস নাই!

*

তোমার দু চোখ দিয়ে একদিন কতবার চেয়েছ আমারে।

আলো অন্ধকারে

তোমার পায়ের শব্দ কতবার শুনিয়াছি আমি!

নিকটে নিকটে আমি ছিলাম তোমার তবু সেইদিন —

আজ রাত্রে আসিয়াছি নামি

এই দূর সমুদ্রের জলে!

যে নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন, দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে!

সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে

বালকের মতো এক — তারপর, গিয়েছি হারায়ে

সমুদ্রের জলে,

নক্ষত্রের তলে!

রাত্রে, অন্ধকারে!

তোমার পায়ের শব্দ শুনিব না তবু আজ — জানি আমি,

আজ তবু আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

*

তোমার শরীর —

তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর, মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন।

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌দিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন

চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে

কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে

কত দেহ এল, গেল — হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে

দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে

নক্ষত্রের তলে

বসে আছি — সমুদ্রের জলে

দেহ ধুয়ে নিয়া

তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!

ক্ষণিকা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Khonika poem Rabindranath Tagore

খোলো খোলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা –

খুঁজে নিতে দাও সেই আনন্দের হারানো কণিকা।

কবে সে যে এসেছিল আমার হৃদয়ে যুগান্তরে

গোধূলিবেলার পান্থ জনশূন্য এ মোর প্রান্তরে

লয়ে তার ভীরু দীপশিখা!

দিগন্তের কোন্ পারে চলে গেল আমার ক্ষণিকা।।

ভালোবাসা – মহাদেব সাহা

ভালোবাসা তুমি এমনি সুদূর

স্বপ্নের চে’ও দূরে,

সুনীল সাগরে তোমাকে পাবে না

আকাশে ক্লান্ত উড়ে!

ভালোবাসা তুমি এমনি উধাও

এমনি কি অগোচর

তোমার ঠিকানা মানচিত্রের

উড়ন্ত ডাকঘর

সেও কি জানে না? এমনি নিখোঁজ

এমনি নিরুদ্দেশ

পাবে না তোমাকে মেধা ও মনন

কিংবা অভিনিবেশ?

তুমি কি তাহলে অদৃশ্য এতো

এতোই লোকোত্তর,

সব প্রশ্নের সম্মুখে তুমি

স্থবির এবং জড়?

ভালোবাসা তবে এমনি সুদূর

এমনি অলীক তুমি

এমনি স্বপ্ন? ছোঁওনি কি কভু

বাস্তবতার ভূমি?

তাই বা কীভাবে ভালোবাসা আমি

দেখেছি পরস্পর

ধুলো ও মাটিতে বেঁধেছো তোমার

নশ্বরতার ঘর!

ভালোবাসা, বলো, দেখিনি তোমাকে

সলজ্জ চঞ্চল,

মুগ্ধ মেঘের মতোই কখনো

কারো তৃষ্ণার জল।

চিঠি দিও – মহাদেব সাহা Chithi Dio Kobita Mahadev Saha

করুণা করেও হলে চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখাে প্রিয়, বেশী হলে কেটে ফেলাে তাও,
এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তােমার শাড়ির মতাে
অক্ষরের পাড় বােনা একখানি চিঠি।
চুলের মতােন কোনাে চিহ্ন দিও বিস্ময় বােঝাতে যদি চাও
সমুদ্র বােঝাতে চাও, মেঘ চাও, ফুল পাখি, সবুজ পাহাড়
বর্ণনা আলস্য লাগে তােমার চোখের মতাে চিহ্ন কিছু দিও।
আজোতো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি
আসবেন অচেনা রাজার লােক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌছে দেবে।
এক কোণে শীতের শিবির দিও এক ফোঁটা, সেন্টের শিশির চেয়ে
তৃণমূল থেকে তােলা ঘ্রাণ
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখাে, তােমার কুশল ।
ওইতাে রাজার লােক যায় ক্যাম্বিসের জুতাে পায়ে, কাঁধে ব্যাগ,
হাতে কাগজের একগুচ্ছ সীজন ফ্লাওয়ার
কারাে কৃষ্ণচূড়া, কারাে উদাসীন উইলাের ঝোপ, কারাে নিবিড় বকুল
এর কিছুই আমার নয় আমি অকারণ।
হাওয়ায় চিৎকার তুলে বলি, আমার কি কোনাে কিছু নাই?
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখে একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছােটো নাম,
টুকিটাকি হয়তাে হারিয়ে গেছে কিছু হয়তাে পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোনাে দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনাে কখনাে বড়াে একা লাগে, তাই লিখাে
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, মিথ্যা করেও হলে বলাে, ভালােবাসি।

প্রেমিক হতে গেলে কবিতা – রুদ্র গোস্বামী Premik Hote Gele by Rudra Goswami

ওই যে ছেলেটাকে দেখছ, পছন্দ মতো ফুল ফুটল না বলে
মাটি থেকে উপড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো গাছটাকে ?
ছেলেটার ভীষণ জেদ , ও কখনও প্রেমিক হতে পারবে না ।

এই তো সেদিন কাঁচের জানালা দিয়ে রোদ ঢুকছিল বলে
কাঁচওয়ালার বাড়িতে গিয়ে তাঁকে কী বকা !
কাঁচওয়ালাতো থ’ !
সাদা কাঁচে রোদ ঢুকবে না এমন আবার হয় !

ছেলেটার খুব জেদ, ও শুধু দেখে আর চেনে
বুঝতে জানে না ।
প্রেমিক হতে গেলে ঋতু বুঝতে হয়
যেমন কোন ঋতুটার বুক ভরতি বিষ
কোন ঋতুটা ভীষণ একা একা, কোন ঋতুটা প্লাবন
কোন ঋতুতে খুব কৃষ্ণচূড়া ফোটে
ছেলেটা ঋতুই জানে না
ও শুধু দেখে আর চেনে, বুঝতে জানে না ।

ছেলেটা কখনো প্রেমিক হতে পারবে না
প্রেমিক হতে গেলে গাছ হতে হয় ।
ছায়ার মতো শান্ত হতে হয় ।
বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে হয় ।
জেদি মানুষেরা কখনও গাছ হতে পছন্দ করে না ।
তারা শুধু আকাশ হতে চায় ।

স্পর্শ – অসীম সাহা

তোমার শরীরে হাত আকাশ নীলিমা স্পর্শ করে

ভূমণ্ডল ছেয়ে যায় মধ্যরাতে বৃষ্টির মতন

মুহূর্তে মিলায় দুঃখ, দুঃখ আমাকে মিলায়

জলের অতল থেকে জেগে ওঠে মগ্ন চরাচর

দেশ হয় দেশ, নদী হয় পূনর্বার নদী

নৈঃশব্দ্য নিরুণ হাতে করতালি দেয়

নিসর্গ উন্মুক্ত করে সারাদেহে নগ্ন শরীর

কোন খানে রাখি তুলে দেহের বিস্তার

তোমার শরীরে হাত দীর্ঘতর আমার শরীর;

তোমার শরীরে হাত সূর্যোদয়, মেঘে রৌদ্র

জন্মান্তর আমার আবার;

তোমার শরীরে হাত একদিন, এই জন্মে শুধু একবার!

সার্থক রজনী – জসীমউদ্দীন

আজকে রাতরে যাইতে দেব না, শুধু শুধু কথা কয়ে,

তারা ফুটাইব, হাসি ছড়াইব আঁধারের লোকালয়ে।

গোলাপী ঠোঁটের কৌটায় করে রাখিব রাতেরে ভরি,

তোমার দু-খানি রঙিন বাহুর বাঁধনে তাহারে ধরি।

আজকের রাত শুধু আজকের-যত ভাল ভাল কথা,

কয়ে আর কয়ে ফুটাইব তাতে যত স্বপনের লতা!

আজকের রাত, মেরু কুহেলির এক ফোঁটা সরু চাঁদ,

আজের রাত-শত নিরাশার একটি পূরিত সাধ।

আজের রাতেরে জড়ায়ে রাখিব তোমার সোনার গায়,

আজকের রাতেরে দোলায় দোলাব তবনিশ্বাস বায়।

আজকের রাতে কথা কব আমি-যত ভাল ভাল কথা,

কথার ফুলেতে সাজাইয়া দেব তোমার দেহের লতা!

কথায় কথায় উড়ে যাব আমি, ছড়াইয়া যাব আর,

মরে যাব আমি নিঃশেষ হয়ে বিস্মৃতি পারাবার।

দিবসে যা হয় হইবে তখন, রাতের পেয়ালা ভরি,

দেহ-মদিরার সোনালী পানীয় উথলি যাইবে পড়ি।

আজকের রাতে বল, ভালবাসি বল বল তুমি মোর,

না হয় ভুলিও যখন হইবে তোমার রজনী ভোর-

আমার রজনী ভোর হবেনাক, এ রাত জহর-জাম,

পান করে আমি শেষ-নাহি-হওয়া নিদ্রা যে লভিলাম।

raateralo.com

Leave a Comment