Nishir Dak by Samaresh Majumder: স্বাগতম! এখানে আমরা পা রাখছি বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়ে – সমরেশ মজুমদারের রচনা “নিশির ডাক”। এই ব্লগে আমরা আলোচনা করব এই উপন্যাসের গভীরতা, চরিত্র, থিম, এবং সেই বিশেষ কালচারের পটভূমি, যা “নিশির ডাক” কে একটি চিরকালীন ক্লাসিক হিসেবে স্থান দিয়েছে। আপনি যদি বাংলা সাহিত্যের পুরনো পাঠক হন অথবা নতুন কিছু খুঁজছেন, তবে আমাদের সঙ্গে যোগ দিন। সমরেশ মজুমদারের জাদুকরী লেখনীতে মোহিত হয়ে আমরা এই সাহিত্যিক যাত্রায় বেরিয়ে পড়ি, যেখানে রহস্যময়তা এবং গল্প বলার অনন্য কৌশল আপনাকে মুগ্ধ করবে। আসুন, বাংলা সাহিত্যের এই অমূল্য রত্নটি নতুন করে আবিষ্কার করি এবং এই উপন্যাসের সৌন্দর্য উপভোগ করি।
Table of Contents
Nishir Dak by Samaresh Majumder l নিশির ডাক – সমরেশ মজুমদার
টেলিফোনটা যেন আর্তনাদ করছিল। ওটা আছে হল ঘরে। একদিকে খাওয়ার টেবিল অন্যদিকে সোফা, মাঝখানে একটা খাটো দেওয়াল। সেই দেওয়ালের ওপর। নিজের ঘর থেকে চেঁচালো সাগ্নিক, ‘মাসি, শুনতে পাচ্ছ না?’ তারপরেই খেয়াল হল, তাকে দরজা খুলে দিয়েই মাসি জিভ কেটেছিল, ‘এই যা!’
‘কী হল?
‘তোমার রসগোল্লা আনা হয়নি!’
‘ভালো হয়েছে। তোমাকে তো বলেছি মিষ্টি খাব না।’
‘না বললে হবে? মা আমার মাথা খেয়ে ফেলবে। আমি চট করে নিয়ে আসছি, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে নাও।’
মাসি বেরিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু রিসিভারটা তোলার আগেই আর্তনাদ থেমে গেল। মিনিটখানেক অপেক্ষা করার পরও যখন শব্দ বাজলো না, তখন পা বাড়াল সাগ্নিক আর যেন সেটা লক্ষ করেই আবার রিং শুরু হল। খপ। করে রিসিভার তুলে সাগ্নিক বলল, ‘হাই।’
‘হাই,’ একটি মেয়ে শব্দটা বলে হাসল।
বেশ অবাক হল সাগ্নিক। এই ফোন নিশ্চয়ই তার জন্য নয়। কোনও মেয়ের কারণ নেই তাকে ফোন করার।
‘কার সঙ্গে কথা বলছি?
‘বাব্বা! তুমি বাংলা এত ভালো বলো? কার সঙ্গে কথা বলছি?’ শব্দ করে হাসল মেয়েটি, ‘তুমি আমার গলা চিনতে পারছ না, না? মেজাজটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। টেল মি, ক’টা মেয়ে তোমাকে রোজ ফোন করে?’
‘একজনও না।’
‘লায়ার। আমাকে ট্রিলা বলেছে। তোমার মা অফিস থেকে ফেরার আগে ও রোজ তোমাকে ফোন করে! সত্যি কথা বলতে ভয় পাও কেন? শোনো, তুমি ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আইনক্সের সামনে। চলে এসো, প্লিজ।’
লাইনটা কেটে গেল ও-প্রান্ত থেকে। কয়েক সেকেন্ড পরে রিসিভার রাখল সাগ্নিক। কে এই মেয়েটা?যাদবপুরের কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্রীরা ভীষণ মুডি। পড়াশোনার বাইরেও পৃথিবী আছে, এটা ভাবতেই চায় না। প্রত্যেকেই খুব শান্ত এবং কেউ ইংরেজি মিডিয়াম থেকে আসেনি। এই মেয়েটি তার স্বগোত্রের, অর্থাৎ বাংলা মিডিয়ামে পড়েনি। তা ছাড়া সে ট্রিলা নামের কোনও মেয়ের নামও শোনেনি। নামেই মনে হচ্ছে খুব মড মেয়ে। অবশ্য মা একটা কথা প্রায়ই বলে। কথাটা মনে করার চেষ্টা করল সে। কানা ছেলের শখ, নাঃ, কী যেন? রিসিভার তুলে মা-র মোবাইলে ফোন করল সাগ্নিক। মা-র গলা পেতেই জিগ্যেস করল, ‘তুমি একটা কথা প্রায়ই বলো না, ওই যে কানা ছেলের নাম কী যেন?’
‘পদ্মলোচন।’
‘ইয়েস! পদ্মলোচন? লোচন মানে চোখ। তাই তো?’
‘হ্যাঁ। রাখছি।’
হাসল সাগ্নিক। এই ট্রিলা মেয়েটাকে হয়তো আদতে হিপোর মতো দেখতে! কিন্তু এই মেয়েটা, যার নাম সে জানে না, তার সঙ্গে দেখা করতে আইনক্সে যাবে কেন? প্রথমত, তার কোনও দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, মেয়েটাকে সে চিনতেই পারবে না। খামকা যাওয়া আসাই সার হবে। কিন্তু যত সময় এগোল, তত কৌতূহল বাড়ল ওর। সোওয়া পাঁচটা নাগাদ বারমুড়া আর লাল। গেঞ্জি পরে বাড়ি থেকে বেরোল সাগ্নিক। ওদের বাড়ি থেকে সিটি সেন্টার বেশি দূরে নয়। হেঁটে আট মিনিটে চলে এল সে। এসময়ে বেশ ভিড় থাকে, আজও আছে। এপাশ-ওপাশ দেখতে দেখতে সাগ্নিক আইনক্সের সামনে এসে দেখল, ছোট-ছোট দলে ভাগ হওয়া দর্শকরা গল্প করছে। আগের শো ভেঙে গিয়েছে। একটু পরেই ডাক আসতে সকলে লাইন দিয়ে ঢুকতে লাগল। চারপাশে তাকিয়েও কোনও একা মেয়েকে দেখতে পেল না। অবশ্য এমনও হতে পারে, যে ফোন করেছিল, সে তাকে লক্ষ করছে কোনও দোকানের ভিতর থেকে অথবা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে। তবে তার উচিত সামনে এসে দাঁড়ানো। সাগ্নিক একটু হতাশ হয়েই পা বাড়াল। সামনের সিঁড়িতে তিনটে মেয়ে বসে আছে পরনে প্যান্ট আর গেঞ্জি। যে ফোন করেছিল, সে নিশ্চয়ই ওদের কেউ হবে না। ‘হাই কিড!’ শব্দ দুটো ছিটকে আসতেই অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকাল সাগ্নিক। তিনটে মুখের ভিতর তখন চিউইগাম চর্বিত হচ্ছে। তিনজনের নজর দূরের কোনও কিছুর দিকে। কিন্তু শব্দদুটো ওদের একজনই বলেছে। সাগ্নিক দাঁড়াল। একজন ওর দিকে তাকাল। তারপর সঙ্গিনীদের বলল,
‘এনি প্রবলেম?
‘নট অ্যাট অল। ইউ আর ফাইন। তাই না?
‘শিওর,’তৃতীয়জন বলল।
‘কেন, হোয়াট ডাজ হি ওয়ান্ট?
তিনজন একসঙ্গে তাকাল সাগ্নিকের দিকে।
প্রথমজন বলল, ‘ও মাই, মাই! ইটস হরিবল। আই কান্ট স্ট্যান্ড হেয়ারি লেগস।’
‘মে বি ফুটবলার,’ দ্বিতীয়জন বলল।
‘হেই! হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?’ একজন চেঁচাল।
‘নার্থিং’ বেশ জোরের সঙ্গে বলল সাগ্নিক।
‘না-থিং!’ মেয়েটা ভ্যাঙচাল, ‘ভাঁড়মে যাও।’
‘তোমাদের কেউ আমাকে ফোন করেছিল?’
‘মাই ফুট! গেট লস্ট।’
এই সময় একজন ইউনিফর্ম পরা ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, ‘কী হয়েছে?’
‘হি ইজ টিজিং আস।’ তিনজনের একজন বলল।
‘তাই নাকি?’ সাগ্নিকের দিকে তাকালেন ভদ্রলোক, ‘একা তিনজনকে টিজ করছ? সাহস তো কম নয়। কোথায় থাকো?
‘পাশের ব্লকে,’ সাগ্নিক বলল, ‘আমি ওদের টিজ করিনি। ওরাই আমাকে যা-তা বলছিল। এখন পালটি খেয়েছে।’
‘হয়তো ঠিক বলছ। কিন্তু এখনও মেয়েরা অভিযোগ করলে সেটাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। তোমরা কি ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ রেকর্ড করতে চাও?
একজন দ্রুত মাথা নাড়ল, ‘গিভ হিম অ্যানাদার চান্স।’
‘ওকে। তুমি যেতে পারো। অ্যান্ড ফর ইওর ইনফর্মেশন, তোমরা যেখানে বসে আছ, সেটা বসার জায়গা নয়।’
তিনজনে কোনওমতে উঠে দাঁড়াল। ভদ্রলোক চোখের আড়াল হতেই যেন জিতে গিয়েছে এমন মুখ করে হাতে হাত বাড়াল।
প্রচণ্ড খেপে গিয়েছিল সাগ্নিক। এখন সে নি:সন্দেহ, এই তিনজনের কেউ-ই তাকে ফোন করেছিল। একটা থামের আড়ালে দাঁড়াল সে। মেয়ে তিনটে তাকে দেখতে পাচ্ছে না।
‘খুব ঝাড় দিয়েছে তো? এরা ডেঞ্জারাস মেয়ে।’
মুখ ফিরিয়ে সাগ্নিক দেখল, তার বয়সি একটা ছেলে পাশেদাঁড়িয়ে হাসছে।
‘ডেঞ্জারাস কেন?’ সে প্রশ্ন করল।
‘পাবলিকের সামনে যারা বেইজ্জত করে, তারা ডেঞ্জারাস নয়?
‘তোমাকে করেছে?
“তিনদিন আগে। রোজ এসময় এখানে আসে। আমি বদলা নেবই।’
‘কী করেছিলে তুমি?”
‘ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়েছিল, আলাপ করতে চায়। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করতেই আমাকে ইভটিজার বলে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী! পাবলিক জমে গেল। এই মারে কী সেই মারে! আমি টিজ করিনি বললেও বিশ্বাস করে না। তবে ভিড় হালকা হওয়ার আগেই ওরা হাওয়া হয়ে গিয়েছিল।’ ছেলেটার মুখ বলছে ওর কথাগুলো সত্যি।
‘কীভাবে বদলা নেবে তুমি?’
‘ভাবছি। মাথায় যেগুলো আসছে, সেগুলো ঠিক জোরাল না। হ্যাঁ, আমার নাম শঙ্খ, তোমার?’
‘সাগ্নিক।’
‘কোনও ভালো আইডিয়া থাকলে বলো তো!’
‘সবচেয়ে ভালো সিটি সেন্টারের সিকিউরিটি অফিসারের কাছে গিয়ে কমপ্লেন করা। দুজনে একসঙ্গে যেতে পারি,’ সাগ্নিক পরামর্শ দিল।
খোঁজখবর করে চিফ অফ সিকিউরিটির ঘরের সামনে হাজির হল ওরা। ভদ্রলোক পাঁচ মিনিট পরে ডাকলেন। প্রবীণ মানুষটি ওদের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এনি প্রবলেম? সাগ্নিক শঙ্খর দিকে তাকাল। শঙ্খ বলল, ‘তিনটে মেয়ে সিটি সেন্টারে রোজ বিকেলে আসে। ওরা ছেলেদের অপমান করে মজা দেখতে চায়।’
‘কীরকম?’
সাগ্নিক বলল, ‘উলটোপালটা কমেন্ট করে। কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলে তিনজনেই চিৎকার করে বলে ওদের টিজ করা হয়েছে। আপনি বলুন, আমি একা তিনটে মেয়েকে টিজ করতে পারি?
‘নর্মালি পারো না। আগে বলল, তোমরা কোথায় থাক?’
সাগ্নিক বলল, ‘পাশের ব্লকে। আমার নাম সাগ্নিক মিত্র।‘
‘কী পড়ছ?
‘কম্পিউটার সায়েন্স।’
‘তুমি?’
“আমি শঙ্খ মুখোপাধ্যায়। থাকি সেবা হাসপাতালের সামনে। স্কটিশে পড়ি। এখানে বেড়াতে ভালো লাগে বলে আসি।’
কিন্তু এটা শপিং কমপ্লেক্স। বেড়ানোর জায়গা নয়। ওঁরা কোথায় থাকে তা নিশ্চয়ই জানো?’
‘না। কি করে জানব?’
‘বেশ। চলো, আমাকে দূর থেকে দেখিয়ে দাও।’
এখন সন্ধের মুখ বলেই সিটি সেন্টার জমজমাট। ভিড় বেড়ে গিয়েছে অনেক। প্রচুর সুন্দর-সুন্দর মানুষ দোকানে-দোকানে ঘুরছে। কিন্তু আইনক্সের কাছের সিঁড়িতে এখন অন্য ছেলেমেয়ে বসে আছে। সেই মেয়ে তিনটে নেই।
শঙ্খ বলল, ‘ওই ওখানে বসেছিল ওরা। আপনার কাছে যেতে যে সময় লাগল, তার মধ্যেই হাওয়া হয়ে গিয়েছে।’
‘ঠিক আছে, ব্যাপারটাকে তোমরা ভুলে যেতে চেষ্টা করো, ওকে?’ এই বলে ভদ্রলোক চলে গেলেন।
শঙ্খ অবাক হয়ে বলল, ‘দেখলে? কোনও মেয়ে যদি ওঁর কাছে কমপ্লেন করত, তাহলে তাদের। কি বলতেন ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো।’
সাগ্নিক চারপাশে চোখ ঘুরিয়েও ওদের দেখতে পেল না। সে জিগ্যেস করল, ‘ওরা কি রোজ এখানে আসে?’
‘কি করে বলব? আমি আজ দ্বিতীয়বার ওদের দেখলাম।
আস্তে-আস্তে হেঁটে ওরা সিটি সেন্টারের সামনের গেটের কাছে চলে এল।
সাগ্নিক বলল, “ঠিক আছে। কাল এখানে বিকেল পাঁচটায় আসতে পারবে?
‘পারব।’
‘এসো। কালও ওদের খুঁজব।’
‘তোমার মোবাইল নম্বর কত?
‘আমার মোবাইল নেই,’ কথাটা বলতে একটুও খারাপ লাগল না সাগ্নিকের। কথা বলার মতো লোকের সংখ্যা তার বেশি নয়। মোবাইলের কোনও প্রয়োজনীয়তা সে এখনও টের পাচ্ছে না।
‘ল্যান্ড লাইন?’ শঙ্খ জিগ্যেস করল। ল্যান্ড লাইনের নম্বর বলল সাগ্নিক। সেটা মোবাইলে স্টোর করে শঙ্খ বলল, ‘আচ্ছা চলি। না আসতে পারলে কাল সাড়ে বারোটার মধ্যে তোমার বাড়িতে ফোন করব। বাই।’
শঙ্খ চলে যাওয়ার পরেও মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকল সাগ্নিক। তারপর বাড়ির দিকে পা বাড়াল। ওদের বাড়ি সিটি সেন্টারের পাশের গলি দিয়ে হাঁটলে মিনিট আটেক লাগে। হঠাৎ নিজের নামটা শুনতে পেল সে। কেউ তাকে ডাকছে। একটা মারুতি ৮০০ ব্রেক চেপে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল টুটুলকে। স্টিয়ারিংয়ে বসে হাসছে। ওর পাশের সিটে একটা কায়দাবাজ মেয়ে। ‘উঠে আয়,’ টুকুল ডাকল।
‘নাঃ। বাড়ি যাব।’
‘আমরা সকলেই বাড়ি যাব। তার আগে একটা কফি হোক।’
‘নাঃ। মেজাজ ভালো নেই,’ বলেই খেয়াল হল।
এই সল্টলেকে যত সুন্দরী মেয়ে আছে, টুটুল তাদের সকলকে চেনে। ওকে বললে নিশ্চয়ই হদিস দিতে পারে। তারপরই খেয়াল হল, ওর গাড়িতে উঠলে মা খেপে যাবে। টুটুলকে একদম দেখতে পারে না মা। ওরা সেই ক্লাস ওয়ান থেকে একসঙ্গে পড়ে আসছে, তবু না। মা-র কোনও পরিচিত মহিলা টুটুল সম্পর্কে কিছু বলার পর মা তাকে গম্ভীরমুখে বলেছে, ‘অনেক নতুন বন্ধু হচ্ছে। এখন ওর সঙ্গে না মিশলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।’
‘উঠবি?’
অতএব উঠল সাগ্নিক। পিছনের দরজা খুলে বসতেই গাড়ি ছোটাল টুটুল।
সাগ্নিক বলল, ‘অ্যাই, আস্তে চালাবি!’
মেয়েটির দিকে একটু ঝুঁকে টুটুল বলল, ‘আমার গার্জিয়ান! সেই ছেলেবেলা থেকে জ্ঞান দিয়ে আসছে। ওর নাম সাগ্নিক। সাগ্নিক, তুই একে চিনিস?’
‘না,’ গম্ভীর গলায় বলল সাগ্নিক।
‘ওহো, তুই তো আবার মেয়েদের থেকে হাজার মাইল দূরে!’
সঙ্গে-সঙ্গে হেসে উঠল মেয়েটি, ‘কেন? তোমার কি মেয়েদের ব্যাপারে অ্যালার্জি আছে?’
‘না। সময় নেই।’
টুটুল গাড়ি থামাল কাফেতে। মেয়েটি বেশ লম্বা।
ওরা যখন ভিতরে ঢুকল তখন সাগ্নিকের মনে হল, কমপক্ষে পাঁচ ফুট ন’ ইঞ্চি তো হবেই।
কফির অর্ডার দিয়ে টুটুল জিগ্যেস করল, ‘মেজাজ খারাপ কেন?’
মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল সাগ্নিক। সেটা লক্ষ করে টুটুল বলল, ‘তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ও নয়নতারা। আর এ সাগ্নিক। এবার বল।’
ঘটনাটা বলল সাগ্নিক। শঙ্খর কথাও বলল।
চোখ বন্ধ করল টুটুল, ‘তিনটে মেয়ে? বর্ণনা দে।’ যতটা কাছাকাছি পারে বলল সাগ্নিক।
নয়নতারা জিগ্যেস করল, ‘কী পরেছিল? প্যান্ট না হিপস্টার?’
‘পার্থক্য কী?’
‘পেট, আই মিন, নাভি দেখতে পেয়েছিলে?
‘ঠিক বুঝতে পারিনি। বলছিল ওরা।’
‘ওপরে টপ বাস্প্যাগোটি।’
‘কী করে বলব?’
‘আমি যেটা পরে আছি, তাকে নর্মাল টপ বলে।
সরু ফিতের মতো স্ট্রাপ লাগানো জামা পরেছিল না আমার মতো।
চোখ বন্ধ করল সাগ্নিক। মুখ তিনটে মনে আসছে, পোশাক অস্পষ্ট। শরীরের দিকে তো তাকায়নি।
টুটুল বলল, ‘অন্তত একটা ক্ল দিবি তো!’
‘ইংরেজি ভালো বলে।’
‘দূর। ও আজকাল সকলেই বলে। মুশকিল হল তুই বলছিস ওরা তিনজন ছিল। দুজন হলে অন্তত সেরকম তিনটে পেয়ারকে আমি চিনি। ছেলেদের টিজ করে আনন্দ পায়। কাছে ঘেঁষতে দেয় না।’
‘রাবিশ!’ নয়নতারা বলল।
‘সত্যি। ওরা নিজেদের প্রেমিক-প্রেমিকা বলে।’
‘তাই?’ চিৎকার করল নয়নতারা।
‘ইয়েস! টম ক্রুজ এলেও পাত্তা পাবে না, ‘টুটুল বলল, ‘তিনটে লেসবি একসঙ্গে ঘুরবে, সেটা তো ঠিক ভাবতে পারছি না।’
‘আমি সিটি সেন্টারে খুব একটা যাই না। ওই ফোন পেয়ে কৌতূহল হল।’
‘হ্যাঁ। ফোনের ডায়লগগুলো বল তো।’
কফিতে চুমুক দিয়ে কথাগুলো বলে গেল সাগ্নিক। ‘ট্রিলা! ট্রিলা কে? চিনিস?’
‘জন্মেও না। ওই নামের কেউ কখনও ফোন করেনি আমাকে।’
‘তা হলে ট্রিলার নাম করল কেন?’
‘পুরোটাই তো বানানো।’
নয়নতারা বলল, ‘এমন হতে পারে, যে ফোন করেছিল সেই ওই তিনজনের কেউ নয়। আলাদা কেউ। সে জানে সাগ্নিকের মা চাকরি করেন। উনি অফিস থেকে ফেরার আগে টেলিফোন করলে সাগ্নিককে পাওয়া যায়।’
কারেক্ট। তা ছাড়া ওরা লেসবি হলে ফোন করত না। তিনজন বলে লেসবি না হওয়ার চান্স বেশি। কিন্তু ফোনে বলেছে আইনক্সের সামনে অপেক্ষা করবে। সেখানে অন্য কোনও মেয়ে ছিল?
‘না। আর কেউ ছিল না।’
‘দাঁড়া,’ পকেট থেকে চ্যাপটা ডিজিটাল ডায়রি বের করে টুটুল বলল, ‘সব নাম তো মনে থাকে না। কিন্তু এটার মধ্যেও যদি বা থাকে, তাহলে জানবি আমার কিছু করার নেই।’
‘এখানে কী আছে?’ নয়নতার জিগ্যেস করল।
‘মেয়েদের নাম।’
‘আমার নামও আছে।’
‘কী করে থাকবে? আজই তো তোমার সঙ্গে আলাপ হল। কাল থেকে থাকবে। আচ্ছা বলল, এন, এন, হ্যাঁ, নয়নতারা, মোবাইল…?
নম্বর বলল নয়নতারা!
‘গুড। হ্যাঁ। কী যেন নামটা? ট্রিলা। টি, টি। টিয়া তিতির, তিয়াস, তৃষ্ণা, ট্রিলা..মাই গড! ট্রিলা নামটা স্টোরে আছে রে!’ বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল টুটুল।
‘তার মানে তোর সঙ্গে আলাপ আছে?”
‘ছিল। অথবা কেউ রেফার করেছিল। একদম ভুলে গিয়েছি। হয়তো একবারের বেশি দেখা হয়নি।’
‘নম্বর নেই?’
‘হ্যাঁ। আছে। মোবাইলে।
নয়নতারা বলল, ‘কিন্তু ওই ট্রিলা যে এই ট্রিলা, তা নাও হতে পারে। একই নামের মেয়ে একজনই থাকবে?’
টুটুল মাথা নাড়ল, ‘ঠিক কথা। তবে ট্রিলা নামটা এত রেয়ার যে, সল্টলেকে দু-তিনজনের বেশি ট্রিলা থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু কীভাবে নামটা এখানে ঢুকল? ধুত, মনেই আসছে না।’
‘টেলিফোন কর না,’ সাগ্নিক বলল।
টুটুল তাকাল নয়নতারার দিকে, ‘তুমি ওকে সাহায্য করবে?
‘কী বলব?’
‘ওর সঙ্গে মিট করতে চাও।’
‘জিগ্যেস করবে, কেন?’
‘আমার নাম করবে। বলবে, আমার ডিজিটাল ডায়রিতে ওর নম্বর আছে। সেখান থেকেই নম্বর নিয়ে তুমি কথা বলছ। সাগ্নিকের ব্যাপারে যদি সে কিছু জানে, তাই দেখা করে জানতে চাও।’
‘যদি বলে সে কিছুই জানে না?’
‘তা হলে জিগ্যেস করবে সাগ্নিককে চেনে কিনা?’
সাগ্নিক আপত্তি করল, ‘আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাবে।’
টুটুল মাথা নাড়ল, ‘কিচ্ছু হবে না। আমরা কোনও ক্রাইম করছি না। আজকাল কেউ এই রকম ফোন পেলে গার্জিয়ানদের কাছে জানায় না!’
নয়নতারা হাত বাড়াল, ‘মোবাইল!’
টুটুল বলল, ‘নিজেরটার বোতাম টেপো। একটু খরচ করো।’
‘অদ্ভুত!’ ঠোঁট বেঁকাল নয়নতারা। তারপর মোবাইল বের করে বলল, ‘নম্বর কত?
টুটুল কেটে-কেটে সংখ্যাগুলো বলল। কানে সেট চেপে ইশারায় নয়নতারা বলল, ‘এনগেজড টোন।’
‘ফিসফিসিয়ে বলছ কেন? ল্যান্ডলাইনের নম্বর। ফ্যামিলি প্রপার্টি। রি-ডায়াল করে যাও।’
দ্বিতীয়বারে নয়নতারা চাপা গলায় বলল, ‘রিং হচ্ছে!’ তারপরেই ঢোঁক গেলার মতো করে বলল, ‘হ্যালো! আমি ট্রিলার সঙ্গে কথা বলতে পারি?
স্পিকারটা অন করে দিয়েছিল নয়নতারা। তাই ওরাও স্পষ্ট শুনতে পেল, ‘কে বলছ?
‘আমি নয়নতারা।‘
‘নয়নতারা! ঠিক চিনতে পারলাম না তো!’
‘কী করে চিনবে? তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়ই হয়নি!’
‘ওয়েল, কী বলতে চাও?’
‘দ্যাখ ট্রিলা, আমি মরিয়া হয়ে ফোন করছি।
‘কেন করছ?’
‘সাগ্নিকের জন্য,’ নয়নতারা সাগ্নিকের দিকে তাকিয়ে হাসল।
সাগ্নিক অবাক। সে হাত নেড়ে কিছু বলতে গেল, ইশারায় শান্ত হতে বলল টুটুল।
‘সাগ্নিক?’
‘হ্যাঁ। আমি ওকে ভালোবাসি, প্রচণ্ড ভালোবাসি। ওর জন্যে জীবন দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু মুশকিল হল ও আমায় পাত্তা দিতে চায় না,’ নয়নতারা বলল।
‘আশ্চর্য! এ ব্যাপারে আমি কী করতে পারি?
‘তুমিই পার। আমি যতবার সাগ্নিককে অ্যাপ্রোচ করেছি, ও নিষ্ঠুরের মতো বলেছ, সম্ভব নয়। ও একজনকে ভালোবাসে। সেই একজন তুমি।’
‘আমি?’ ট্রিলার গলায় বিস্ময়।
‘হ্যাঁ। তুমি যদি ওকে বুঝিয়ে বলল, তোমাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হওয়া সম্ভব নয়, তা হলে সাগ্নিককে আমি পেতে পারি। প্লিজ।’
কয়েক সেকেন্ড ট্রিলার গলা শোনা গেল না।
নয়নতারা একবার তার হাতে ধরা মোবাইল সেটটা দেখে নিয়ে বলল, ‘হ্যালো?’
‘আমার নম্বর তুমি কোথায় পেয়েছ?’
‘সাগ্নিক দেয়নি। ও তোমাকে সবসময় আড়ালে লুকিয়ে রাখতে চায়। ওর এক বন্ধু আছে, টুটুল, তার কাছ থেকে পেয়েছি।’
‘টুটুল? মানে…’
‘সল্টলেকেই থাকে। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে।’
‘আশ্চর্য! আমার নম্বর ওর কাছে ছিল!’
‘না থাকলে আমি পেলাম কী করে! তাহলে আমি তোমার সাহায্য পাচ্ছি তো?’ নয়নতারা সাগ্নিকের দিতে তাকাল।
‘কীভাবে সাহায্য করব? এই সাগ্নিক কে, তাই তো বুঝতে পারছি না,’ ট্রিলা বলল।
‘সে কী? তুমি সাগ্নিককে চিনতে পারছ না?
‘না।’
‘যে ছেলে তোমার জন্য আমাকে উপেক্ষা করছে, তাকে তুমি চিনতেই পারছ না? এটা সম্ভব?
‘তাই তো দেখছি। আমি ওকে দেখতে চাই।’
‘তারপর?’
‘তুমি যা চাইছ, তাই হবে। বলব, নিজের রাস্তা দ্যাখো।’
‘গুড। তা হলেও চলবে। আমি টুটুলকে বলব কাল বিকেল পাঁচটায় ওকে নিয়ে সিটি সেন্টারে আসতে। তার আগে আমরা দেখা করে নেব।’
‘ওখানে নয়। ছ’টার সময় কাফেতে। চেনো?’
‘হ্যাঁ চিনি। বাই।’
ফোন অফ করে খিলখিলিয়ে হাসল নয়নতারা,
‘বাপস, কী অ্যাক্টিং করলাম বলো!’
‘দশে বারো!’ টুটুল হাত তুলল, ‘ফাটাফাটি!’
‘কিন্তু এই ট্রিলা তো আমাকে চিনতেই পারল না,’ সাগ্নিক মাথা নাড়ল।
‘কী বলতে চাইছিস?’
‘আমাকে যে চেনে না, সে ওই তিনটে মেয়ের হদিশ দেবে কী করে?’
নয়নতারা বলল, ‘উঁহু। আমার মনে হচ্ছে চেনে। না চিনলে তোমার নাম শোনামাত্রর বলে দিত চেনে না। অনেকটা সময় নিয়ে ভেবে বলেছে চেনে না। মনে হচ্ছে, মিথ্যে কথা বলেছে।’
‘মিথ্যে কথা?’
‘বাঃ। আমি যদি পুরোটা মিথ্যে বলতে পারি তাহলে ও এক-আধটা মিথ্যে বলতে পারে না?’
নয়নতারা হাসল, ‘আচ্ছা, সত্যি যদি আমার মনে হয় তোমার জন্যে জীবন দিতে পারি, তাহলে কী হবে?’
‘ভ্যাট!’ চেঁচিয়ে উঠল সাগ্নিক।
‘ওকে, ওকে! তাহলে কাল ছ’টায় এখানে’, উঠে পড়ল টুটুল। কফির দাম ওই মিটিয়ে দিল। বাড়ির কাছে ওকে নামিয়ে দিয়ে যখন টুটুল গাড়ি ঘোরাচ্ছে তখন নয়নতারা হাত নেড়ে বলল, ‘কাল কিন্তু একদম সেজেগুঁজে ফিট হয়ে আসবে না।’
সন্ধের পর বাড়ি ফিরছি বলে মা কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করলে। মা-র ওই এক দোষ। বলা শুরু করলে আর থামতে পারে না। এক-আধদিন দেরি হতেই পারে, রোজ তো হয় না। তা ছাড়া সে এখন স্কুলের ছাত্র নয়, একথা মা মনে রাখতে চান না। আজ বাবাকেও বলতে হল, ‘কোথাও থামতে হয় সেটাই তুমি ভুলে যাচ্ছ!’
সটান ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল সাগ্নিক। তারপর কম্পিউটারের সামনে বসল। কিছুতেই মন স্থির হচ্ছিল না। আচ্ছা, ট্রিলা বা নয়নতারা যদি শোনে মা দেরি করার জন্যে ম্যারাথন বকুনি শুরু করেছে, তাহলে নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। বাইরে থেকে মা-র গলা ভেসে এল, ‘এই এক শুরু হয়েছে। কিছু বললেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। অদ্ভুত।’
মিনিটখানেক পরে বাড়ি যখন চুপচাপ, তখন আর একটা ভাবনা মাথায় এল। ট্রিলাদের ব্যাপারটা মা-র কানে গেলে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে? উঃ, পাগল করে দেবে তো! কিন্তু তার দোষ কোথায়? এসব মেয়েদের সে চেনেই না। এরা যদি গায়ে পড়ে তাকে জড়িয়ে গল্প বানায়, তো।
সে কি করতে পারে! কিন্তু আজ মোবাইলে নয়নতারা যখন ট্রিলাকে অনুরোধ করছিল তাকে ছেড়ে দিতে, তখন হাঁ হয়ে গিয়েছিল ও। মনে হচ্ছিল, সত্যি নয়নতারা তাকে ভালোবেসে পেতে চায় আর ট্রিলা ভিলেনের মতো আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে! এখন পর্যন্ত কোনও মেয়ে তাকে প্রেমপত্র লেখা দূরের কথা, কাছে আসারও চেষ্টা করেনি। নয়নতারা যা বলেছে তার সবটাই বানানো। ও নিছক অভিনয় করছিল, তা জেনেও এখন কম্পিউটারের সামনে বসে এক ধরনের আরামে আক্রান্ত হল সাগ্নিক।
ঠিক পাঁচটার সময় বাড়ি থেকে বেরল সাগ্নিক। সকাল থেকে মা নর্মাল। কালকের প্রসঙ্গ যেন। একেবারেই ভুলে গিয়েছে। এমনকী, বেরনোর সময় যখন সাগ্নিক বলল, ‘একটু ঘুরে আসছি, তখন মা শুধু বলল, ‘বেশি দেরি করিস না।’
শঙ্খ নামের ছেলেটা বলেছিল সাড়ে চারটের সময় ফোন করবে। কিন্তু করেনি। এখন সাগ্নিক চায় শঙ্খর সঙ্গে জড়িয়ে ওই মেয়েগুলোর মুখোমুখি হতে। ওরা যে সাধারণ মেয়ে নয়, তা গতকালই বুঝে গিয়েছে সে।
সিটি সেন্টারে এসে দূর থেকে আইনক্সের সামনেটা দেখল সাগ্নিক। এখন শো চলছে বলে সামনে তেমন ভিড় নেই। তিনটে মেয়ের একজনকেও সেখানে দেখা গেল না। তা ছাড়া যা ভিড়, সেখানে কাউকে খুঁজে বের করাই মুশকিল। ঘুরতে-ঘুরতে একটা আইসক্রিম পার্লারের কাছাকাছি এসে সে দাঁড়াল। চটপট নিজেকে একটা থামের আড়ালে নিয়ে গেল। কালকের মেয়ে তিনটে। তিনজনই খুব মন দিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে। ওদের পরনে কালকের জিনস, কিন্তু টপ পালটেছে। শঙ্খ কি এখানে কোথাও দাঁড়িয়ে ওদের লক্ষ করছে? দুটো ছেলে ওদিক থেকে এসে ওদের দেখে দাঁড়িয়ে গেল। এবার মেয়েরা ওদের দেখল। তারপর আইসক্রিম খেতে-খেতে পাশাপাশি হাঁটা শুরু করল। ছেলেদুটোও আসছে পিছন-পিছন। সাগ্নিক একটা নাটক দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল কৌতূহলী হয়ে। ছেলেদুটোর একজন কিছু বলতেই তিনটে মেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। যে মেয়েটা কাল তাকে শাসিয়েছিল, সে গলা তুলে বলল, ‘অ্যাই, ফুটে যা। এখানে এখন পুলিশ ইভটিজার খুঁজছে। পিছনে এলে ধরিয়ে দেব।’ ছেলেদুটো সঙ্গে-সঙ্গে উধাও। ওরা পা বাড়াতেই চতুর্থ মেয়েটিকে দেখতে পেল সাগ্নিক। বেশ মিষ্টি দেখতে, লম্বা, প্যান্ট আর টপ পরা। দেখামাত্রই এই তিনজন যেন কিলবিল করে উঠল। তিনজন জড়িয়ে ধরল নবাগতাকে। সাগ্নিকের মনে পড়ল টুটুলের কথা। ওরা ছেলেদের পছন্দ করে না।
তিনজন শুনে টুটুল একটু ধন্দে পড়েছিল। চতুর্থজন আসায় বোঝা গেল ওরা জোড়ায়-জোড়ায় আছে। আর তাহলে টুটুলের কথাই ঠিক। সাগ্নিক বেরিয়ে এল সিটি সেন্টার থেকে। একটু হেঁটে শেয়ারের অটোয় চেপে কাফেতে চলে এল সে। এখন সন্ধে নামব-নামব করছে। বাইরে টুটুলের গাড়ি দাঁড় করানো দেখে বুঝে গেল ওরা এসে গিয়েছে।
টুটুল আর নয়নতারা পাশাপাশি বসে কথা বলছিল। ওকে দেখে টুটুল বলল, ‘আয়। নতুন কোনও খবর?’
‘এখানে আসার আগে সিটি সেন্টারে গিয়েছিলাম। কাল ওরা তিনজন ছিল, আজ চারজনকে দেখলাম। মনে হচ্ছে, তোর কথাই ঠিক,’সাগ্নিক বলল।
‘কোন কথা?’ টুটুল চোখ ছোট করল। ‘ওরা পুরুষবিদ্বেষী!’ বাকিটা বলতে গিয়েও থেমে গেল সাগ্নিক।’
নয়নতারা হাত নাড়ল, ‘ছাড়ো তো ওদের কথা। আমি একটু আগে ট্রিলাকে ফোন করেছিলাম। এই চারটে নাগাদ। ও আসছে। টেলিফোনে নাটক শোনানো যায়, কিন্তু সামনাসামনি বসে কী বলা হবে ভেবে নাও।’
টুটুল বলল, ‘যা বলেছ, তাই বলবে। লাইন এক।’
সাগ্নিক আপত্তি জানাল, ‘না, না। আমার সঙ্গে নয়নতারার কোনও সম্পর্ক নেই। গতকালই আমি ওকে প্রথম দেখেছি। আমার জন্যে ও জীবন দিয়ে দেবে বলার মতো কোনও সিচুয়েশন তৈরি হয়নি। টেলিফোনে নাটক করেছে বলে সামনাসামনি তাই করতে হবে, এর কোনও যুক্তি নেই।’
নয়নতারা অদ্ভুত মিষ্টি হাসল, ‘কিন্তু আমার যে বলতে ইচ্ছে করছে।’
সাগ্নিক হাত নাড়ল, ‘প্লিজ, ওরকম ইচ্ছে করার কোনও দরকার নেই। তুমি টুটুলের বন্ধু, সেই সুবাদে আমার সঙ্গে আলাপ। যাকে চেনে না, তার জন্য ওসব বলা ঠিক না।’
টুটুল বলল, ‘এক সেকেন্ড, তুই যে অর্থে আমার বন্ধু, নয়নতারা সেই অর্থে আমার বন্ধু নয়। পরিচয় হয়েছিল, দু-দিন একটু আড্ডা মারলাম, ব্যস। ওর নাম-নম্বর আমার ডিজিটাল ডায়রিতে রয়েছে। এরপর কবে দেখা হবে, জানি না। দেখা হলে সময় থাকলে গল্প করব। অবশ্য ওর যদি আপত্তি না থাকে।’
অবাক হয়ে সাগ্নিক দেখল নয়নতারা মাথা নাড়ছে।
সে বলল, ‘যাক গে!’
খুব হতাশ হলে মনে হচ্ছে!’ নয়নতারার ঠোঁটের কোণ একটু কোঁচকালো।
‘হতাশ হওয়ার কথা উঠছে কেন?’
‘তাহলে বলতে হবে, তুমি মেয়েদের পছন্দ করো না। ওই ওরা যেমন ছেলেদের পছন্দ করে না।’
নয়নতারা গম্ভীর গলায় একথা বলতেই টুটুল শব্দ করে হেসে উঠল, ‘আমাকে একথা কেউ বলতে পারবে না সাগ্নিক।’
মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল সাগ্নিকের। এই সময় দরজার দিকে তাকাতেই হকচকিয়ে গেল সে। কাফেতে ঢুকে চারপাশে তাকাচ্ছে যে, তাকে একটু আগে সে সিটি সেন্টারে দেখে এসেছে। সেই চতুর্থ মেয়েটি।
টুটুল বলল, ‘আরে এই তো ট্রিলা। দু-বছর বাদে দেখছি। আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে দেখতে।’ সে হাত নাড়তেই ট্রিলার চোখ ওদিকে পড়ল।
টুটুল উঠে দাঁড়াল, ‘কেমন আছ? চিনতে পারছ তো?’
‘হ্যাঁ। কঙ্কাদের বাড়িতে আলাপ হয়েছিল,’ শান্ত গলায় বলল ট্রিলা।
‘প্রথম দিন। পরের দিন ভি আই পি বাসস্ট্যান্ডে। অটো স্ট্রাইক ছিল, আমি তোমাকে কোয়ালিটি পর্যন্ত লিফট দিয়েছিলাম। একদম ভুলে গিয়েছিলাম, তোমাকে দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে। বসো। এই হল ট্রিলা আর এ নয়নতারা আর ও আমার বাল্যবন্ধু সাগ্নিক,’ টুটুল পরিচয় করিয়ে দিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কফি চলবে?’
‘এখানে তো চা পাওয়া যায়।’
‘যায়,’ টুটুল উঠে গিয়ে অর্ডার দিয়ে এল।
নয়নতারা বলল, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’
মাথা নাড়ল ট্রিলা, ‘কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
‘তাই! তাহলে সাগ্নিক আমাকে রিফিউজ করছে কেন?’
‘এটা ওর ব্যাপার। আমি কি করতে পারি?’ ট্রিলা মাথা নাড়ল, ‘আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করব বলে এখানে এসেছি,’ সাগ্নিকের দিকে তাকাল ট্রিলা। ওর মুখ এখন বেশ শক্ত। চোখ স্থির।
সাগ্নিক তাকাল।
‘তুমি আমাকে এসবের মধ্যে জড়াচ্ছ কেন?
পরিষ্কার জিগ্যেস করল ট্রিলা।
‘সরি। আমি তোমাকে কিছুর মধ্যে জড়াইনি, তোমাকে আমি চিনিই না,’ সাগ্নিক বলল।
‘তাহলে কি অন্য কোনও ট্রিলার কথা ভেবে বলেছ সাগ্নিক?’ নয়নতারা প্রশ্ন করল।।
‘ফর ইওর ইনফরমেশন, সল্টলেকে ট্রিলা নামে আর কোনও মেয়ে নেই,’ টুটুল বলল।
‘থ্যাঙ্ক ইউ,’ ট্রিলা মাথা নাড়ল।
‘তাহলে কৈফিয়ত দিতে হবে সাগ্নিক।’
টুটুল হাত তুলল, ‘আমি বলছি। সাগ্নিক তোমাকে দূর থেকে দেখেছে। ধরো, সিটি সেন্টারেই দেখতে পেয়েছিল। তোমার বান্ধবীরা নাম ধরে ডাকতে ও নামটা জেনে ফেলেছিল। কিন্তু। তোমাকে ও বিন্দুমাত্র বিরক্ত করেনি। নিজের মনে ভালোবেসে গিয়েছে। সেটা বুঝতে পারেনি নয়নতারা। পরিচয় হওয়ামাত্র প্রেমে পড়ে গেল ওর। কিন্তু সাগ্নিক ওকে জানিয়ে দিল, সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব নয়। কারণ, ওর মনে ট্রিলা নামের একটি মেয়ে আছে। অন্য মেয়ে হলে সরে যেত, কিন্তু নয়নতারা নাছোড়বান্দা! আমাকে বলল ব্যাপারটা। তোমার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু এই যন্ত্রটা সাহায্য করল। ওকে তোমার নম্বরটা দিয়েছিলাম। ক্লিয়ার।’
অবাক হয়ে শুনছিল সাগ্নিক। চমৎকার গল্পের নায়ক হিসেবে নিজেকে ভাবতে হঠাৎ বেশ ভালো লাগল।
সে বলল, ‘দেখলে তো, আমি তোমাকে জড়াইনি। ওরাই টেনেছে। ইট’স নট মাই ফলট।’
‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, যাকে চেনোনা তাকে এত ভালো লেগে গেল যে, ওর মতো সুন্দরী মেয়েকে রিফিউজ করলে? স্ট্রেঞ্জ!’ ট্রিলা বলল।
‘এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই না? হাসল সাগ্নিক।
‘তুমি জানো না, আমি অলরেডি এনগেজড।’
‘হতেই পারে। তাতে আমার কী এসে গেল! তুমি খুনি হতে পারো, লেসবিয়ান হতে পারো, আমি যা ভেবেছি, তাই ভেবে যাব। ডিসটার্ব করব না।’
‘লেসবিয়ান?কী বলতে চাইছ তুমি?’ সোজা হয়ে ফোঁস করল ট্রিলা।
‘এটা কথার কথা। লেসবিয়ান মেয়েরা ছেলেদের এড়িয়ে যায়। তুমি যদি তাই হও, তাতেও
আমার কিছু এসে যায় না,’ সাগ্নিক উদাস।
ট্রিলা উঠে দাঁড়াল, ‘আর এখানে থাকা যাচ্ছে না!’
‘তোমাকে আমি কিছু বলিনি। শুধু কী-কী সম্ভাবনা থাকতে পারে, তাই জানাচ্ছিলাম। যদি আঘাত দিয়ে থাকি, তা হলে দুঃখিত,’ সাগ্নিক উঠে দাঁড়াল।
‘দয়া করে আমার কথা কাউকে বলোনা,’ ট্রিলা ঠোঁট কামড়াল।
‘বলতে চাইনি। বিশ্বাস করো। আপনার বান্ধবীরা বাধ্য করল বলতে।’
‘তার মানে?’ বাঁকা চোখে তাকাল ট্রিলা।
‘গতকাল একটি মেয়ে ফোন করে বলল, তুমি রোজ নাকি ফোনে আমার সঙ্গে গল্প করো। সে। আমার সঙ্গে আলাপ করতে উৎসাহিত হয়েছে একথা শুনে। আমি গেলাম। তিনজনে মিলে। অকারণে আমাকে অপমান করে খুব মজা পেল। আমি জোর পেলাম এই ভেবে, তুমিও আমাকে নিয়ে বানিয়ে বন্ধুদের কাছে গল্প করেছ। তুমি পারলে আমি পারব না কেন?’ সাগ্নিক হাসল।
‘মাই গড। ওরা তোমাকে ফোন করছিল? নম্বর পেল কোথায়?’ ট্রিলা সত্যি অবাক।
‘আমি জানি না। তোমার বান্ধবী ওরা? জিগ্যেস করে জেনে নিও।’
‘আমার বান্ধবী কী করে জানলে?’
‘আজ এখানে আসার আগে ওদের সঙ্গে দেখা করে এসেছ সিটি সেন্টারে গিয়ে। ভুল বলছি?’
ট্রিলা তাকাল। তারপর আচমকাই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল কাফে থেকে।
টুটুল বলল, ‘আমার বিশ্বাস, ট্রিলা সত্যি কথা বলছে।’
‘কী করে বিশ্বাস করছ?’ নয়নতারা জিগ্যেস করল।
‘মুখ দেখে। সমবয়সি ছেলেদের নম্বর জোগাড় করে ফোন করে রাগানো, এই মেয়েগুলো মজা বলে ভাবে। সাগ্নিকের নম্বর পেয়ে গিয়েছিল কোনওভাবে, ট্রিলার নাম বলেছে। আবার অন্য কাউকে ফোন করার সময় ওদের একজনের নাম বলবে। তবে ট্রিলা নিশ্চয়ই ওদের একজন। তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে সুস্থ হত মেয়েটা।’
নয়নতারা কপট ধমক দিল, ‘অ্যাই চুপ। আমি কত কষ্ট করে ট্রিলার হাত থেকে বের করে। আনলাম সাগ্নিককে আর তুমি এখন ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে বলছ?মরুক মেয়েটা। চলো।’
কফির দাম মিটিয়ে বাইরে এসে গাড়িতে উঠল ওরা। সামনের সিটে টুটুলের পাশে নয়নতারা। গাড়ি চললে নয়নতারা জিগ্যেস করল, ‘তাহলে কি তোমার সঙ্গে খুব শিগগির দেখা হচ্ছে না?’
‘নাঃ। বেশি দেখাদেখি হওয়া বিপজ্জনক!’ টুটুল বলল।
পিছন ফিরে হাত বাড়াল নয়নতারা, ‘হাতটা মেলাও।’
‘কেন?’
‘মেলাও না?
সাগ্নিক হাত বাড়াল। তার হাত আচমকা কাঁপছে!
‘এ কী! হাত কাঁপছে কেন?
‘ঠিক আছে।’
‘আমি একটা কথা বলি?’ নয়নতারা বলল।
‘আমি গাড়ি চালাচ্ছি, খেয়াল থাকে যেন?’ টুটুল হাসল।
‘কী কথা?’ সাগ্নিকের গলার স্বর অন্যরকম শোনাল।
‘এখন থেকে আর তুমিনয়, তুই। ঠিক আছে?
হাত সরিয়ে নিল সাগ্নিক।
‘আমার সঙ্গে তোর অন্যরকম সম্পর্ক হতে পারে না, তা তোর চোখ দেখে বুঝে গিয়েছি, নয়নতারা বলল।
‘চোখ দেখে?’ সাগ্নিক অবাক।
‘যখন ট্রিলার সঙ্গে কথা বলছিলি।’
সাগ্নিককে ঠিক জায়গায় নামিয়ে দিয়ে টুটুল বলল, ‘চলি!’
নয়নতারা মুখ বের করে বলল, ‘ভালো থাকিস।’ গাড়ি চলে গেল।
বাড়ি ফিরতেই মা বলল, ‘আজও দেরি করলি? বললাম বলে, আবার রাগ করে দরজা বন্ধ করিস যেন!’
‘সরি মা।’
‘ও হ্যাঁ। একটা মেয়ে ফোন করেছিল। বলল, তোকে বলতে সমস্ত ব্যাপারটার জন্য সে দুঃখিত। কী অদ্ভুত নাম মেয়েটার। ইলা না টিলা! কী ব্যাপার রে?’
বুঝতে পারছি না। আমারও অদ্ভুত লাগছে।’
আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে এল সাগ্নিক। তার মনে হচ্ছিল ওই ফোনটা আবার আসবে! আসবেই!