Famous Poems of Nirendranath Chakraborty: কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী – জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলায়। কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন দৈনিক “প্রত্যহ” পত্রিকায়। একসময় যোগ
দেন আনন্দবাজার পত্রিকায় এবং “আনন্দমেলা” পত্রিকাটি তিনি সম্পাদনাও করেছেন।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, কবি জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী বাংলা কবিতার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। বিংশ
শতকের ৫০এর দশকে তাঁর নাম উঠে আসে সমর সেন, সুনীল গঙ্গেপাধ্যায়, মনীন্দ্র রায়, মঙ্গলাচরণ
চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, রাম বসু প্রমুখ কবিদের সাথে।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “নীল নির্জন” প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে নীরেন্দ্র চক্রবর্তী নামে, সিগনেট প্রেস থেকে, যার
প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।
তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “নীল নির্জন” (১৯৫৪), “অন্ধকার বারান্দা” (১৯৬১), “নিরক্ত করবী”
(১৯৬৫), “নক্ষত্রজয়ের জন্য” (১৯৬৯), “কলকাতার যীশু” (১৯৬৯), “উলঙ্গ রাজা (১৯৭১)”, “খোলা মুঠি” (১৯৭৪),
“কবিতার বদলে কবিতা” (১৯৭৬), “আজ সকালে” (১৯৭৮), “পাগলা ঘন্টি” (১৯৮১), “ঘর-দুয়ার” (১৯৮৩),
“সময় বড় কম” (১৯৮৪), “রূপ-কাহিনী” (১৯৮৪), “যাবতীয় ভালোবাসাবাসি” (১৯৮৬), “ঘুমিয়ে পড়ার আগে”
(১৯৮৭), “জঙ্গলে এক উন্মাদিনী” (১৯৮৯), “আয় রঙ্গ” (১৯৯১), “চল্লিশের দিনগুলি” (১৯৯৪), “সত্য সেলুকাস”
(১৯৯৫), “সন্ধ্যারাতের কবিতা” (১৯৯৭), “অন্য গোপাল” (১৯৯৯), “জলের জেলখানা থেকে” (২০০০), “সাকুল্যে
তিনজন” (২০০০), “কবি চেনে সম্পূর্ণ চেনে না” (২০০১), “দেখা হবে” (২০০২), “ভালবাসা মন্দবাসা” (২০০৩),
“মায়াবী বন্ধন” (২০০৪), “জ্যোত্স্নায় একেলা” (২০০৬) প্রভৃতি।
রয়েছে শিশুদের কবিতা সংকলন “শাদা বাঘ”, ছড়ার বই “বিবির ছড়া” প্রভৃতি। রয়েছে “পিতৃপুরুষ” (১৯৭৩)
নামক উপন্যাস, “কবিতার ক্লাস” (১৯৭০) নামক কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থ।
তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “পাঁচশো বছরের কিশোর কবিতা” (১৯৮৮, কবি সরল দে-র সঙ্গে),
আবৃত্তির শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০০৮, কবি কালিদাস ভদ্রের সঙ্গে) প্রভৃতি।
কবির সম্বন্ধে শিশিরকুমার দাশ তাঁর বাংলা সাহিত্য সঙ্গী গ্রন্থে লিখেছেন – “তাঁর ছন্দনৈপুণ্য প্রতিমা নির্মাণ
কুশলতা, শব্দব্যবহারে নিজস্বতা তাঁর কবিতার জনপ্রিয়তার মূলে। প্রকৃতি ও প্রেম, সমকালীন জীবনের ছোট
ছোট ঘটনার মধ্যে নাটকীয় সম্ভাবনা এবং গভীর জীবনচেতনার উপলব্ধি তাঁর কবিতার জগত”।
তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৪ সালে তিনি আকাদেমি পুরস্কার পান “উলঙ্গ রাজা”
কাব্যগ্রন্থের জন্য। ২০০৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সান্মানিক ডি.লিট. প্রদান করেন।
এই পাতা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর প্রতি মিলনসাগরের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
উত্স:ডঃ শিশির কুমার দাশ, সংসদ সাহিত্য সঙ্গী ২০০৩
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা কবিতা সমুচ্চয় ২, ১৯৯৩
www.poetryinternationalweb.net
Famous Poems of Nirendranath Chakraborty 2024l নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বিখ্যাত কবিতা 2024
Table of Contents
কলকাতার যিশু
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
লাল বাতির নিষেধ ছিল না,
তবুও ঝড়ের-বেগে-ধাবমান কলকাতা শহর
অতর্কিতে থেমে গেল ;
ভয়ঙ্কর ভাবে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
ট্যাকসি ও প্রাইভেট, টেম্ পো, বাঘমার্কা ডবলডেকার |
‘গেল গেল’ আর্তনাদে রাস্তায় দু-দিক থেকে যারা
ছুটে এসেছিল —
ঝাঁকামুটে, ফিরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার —
এখন তারাও যেন স্থিরচিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে
লগ্ন হয়ে আছে |
স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,
টালমাটাল পায়ে
রাস্তার এক পার থেকে অন্য-পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটি শিশু |
খানিক আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে চৌরঙ্গিপাড়ায় |
এখন রোদ্দুর ফের অতিদীর্ঘ বল্লমের মতো
মেঘের হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে
নেমে আসছে :
মায়াবী আলোয় ভাসছে কলকাতা শহর |
স্টেটবাসের জানালায় মুখ রেখে
একবার আকাশ দেখি, একবার তোমাকে |
ভিখারি-মায়ের শিশু,
কলকাতার যিশু,
সমস্ত ট্রাফিক তুমি মন্ত্রবলে থামিয়ে দিয়েছ |
জনতার আর্তনাদ, অসহিষ্ণু ড্রাইভারের দাঁতের ঘষটানি,
কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ নেই ;
দু-দিকে উদ্যত মৃত্যু, তুমি তার মাঝখান দিয়ে
টলতে টলতে হেঁটে যাও |
যেন মূর্ত মানবতা, সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দে
সমগ্র বিশ্বকে তুমি পেতে চাও
হাতের মুঠোয় | যেন তাই
টালমাটাল পায়ে তুমি
পৃথিবীর এক-কিনার থেকে অন্য-কিনারে চলেছ |
. *************************
উলঙ্গ রাজা
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
৩ জানুয়ারী ১৯৭০, দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত
সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে |
সবাই চেঁচিয়ে বলছে : সাবাশ, সাবাশ !
কারও মনে সংস্কার, কারও ভয় ;
কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে ;
কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক ;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম, চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয় |
গল্পটা সবাই জানে |
কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে
শুধুই প্রশস্তিবাক্য-উচ্চারক কিছু
আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ
স্তাবক ছিল না |
একটি শিশুও ছিল |
সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু |
নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায় |
আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু ;
জমে উঠছে
স্তাবকবৃন্দের ভিড় |
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না |
শিশুটি কোথায় গেল ? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গোপন গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে ?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোনো দূর
নির্জন নদীর ধারে কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায় ?
যাও, তাকে যেমন করেই হোক
খুঁজে আনো |
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক |
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্দ্ধে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক :
রাজা তোর কাপড় কোথায় ?
*************************
এবার মৃত্যুকে মারো
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
১৫ জুন ১৯৯১, দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত
ওইখানে ছড়িয়ে ছিল ছত্রখান হয়ে
চশমার কাচের গুঁড়ো, রক্তমাখা ধুতি শাড়ি, ছেঁড়া
চাদর পাঞ্জাবি, ছড়ি ঘড়ি ও চপ্পল |
ওইখানে ছড়িয়ে ছিল ছিন্নভিন্ন মৃত মানুষেরা |
টুকরো-টুকরো সংবাদ এখনও আনে বয়ে
যে-মঞ্চ সাজানো ছিল, যে-কথা বলবার ছিল, তার স্মৃতি |
এখনও বাতাস
ওইখানে রেখেছে ধরে সহস্রজনের দীর্ঘশ্বাস |
তোমরা যাও | ধুধু
শূন্য ওই মাঠে গিয়ে আবার দাঁড়াও | কিন্তু শুধু
নির্বিকার দাঁড়িয়ে থেকো না |
হাতে হাত রাখো, চক্ষু দু’হাতে ঢেকো না |
কাজ বাকি পড়ে আছে, তাই
এখন সবাই
ভোলো দুঃখ, ভোলো শোক,
যে মালা ছিঁড়েছে, তাকে আবার নূতন করে গাঁথা হোক |
যে-সভা হয়নি শুরু, তাকে ফের শুরু করা চাই,
তাকে খুব শান্ত হাতে তুলে ধরা চাই
সমাপ্তি সুন্দর উত্সবে |
আবার সাজাও মঞ্চ তা হলে, টাঙাও সামিয়ানা |
কথাটা এইজন্য বলছি আরও—
যা জীবন, তাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে |
কী করে বাঁচাবে, যদি অতর্কিতে মৃত্যু দেয় হানা ?
যা মৃত্যু, তা হলে তাকে মারো |
তা হলে নূতন করে জীবনের জয়ধ্বনি দাও,
যা মারে মৃত্যুকে, সেই উদ্বোধনী সংগীত শোনাও |
. *************************
নীলপদ্ম
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া
এ এক আশ্চর্য ব্যথা নিদ্রাহীন নিশীথে আমার
অঙ্গের অঙ্গারে ওঠে জ্বলে, অস্থিমজ্জার গ্রন্থিকে
কঠিন জিহ্বায় খোঁজে, নীলপদ্ম-হৃদয়ের দিকে
বাড়ায় সুদীর্ঘ বাহু, থরোথরো অস্থির আঙুল
মন্ত্রের মুদ্রায় করে ওঠানামা ;
. এ আঙুল কার ?
এই বাহু, এই জিহ্বা ? নিদ্রার আকাশে থাকে বিঁধে
এ কার সুতীক্ষ্ণ তীব্র শায়ক ? অঙ্গের উপকূল
ভাসিয়ে যন্ত্রণা তার জ্বলে ওঠে চিন্তার সমিধে |
এ এক আশ্চর্য সুখ সেই তীব্র ব্যাথার অতলে
স্থিরপ্রভ আনন্দের অনির্বাণ অম্লান শিখায়
রাত্রিদিন জেগে থাকে, হৃদয়ের সব দুঃখ-দায়
নিভিয়ে অশ্রুর স্রোতে ঢাকে তার বঞ্চনার ক্ষতি |
এই ব্যথা নীলপদ্ম-আনন্দের জিহ্বা হয়ে জ্বলে,
এ-আনন্দ ব্যথাম্লান নিদ্রাহীন যন্ত্রণার জ্যোতি |
. *************************
সময়চারী
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।
সারাদিন ধরে বৃষ্টি ঝরচে | নির্জন গলি | অন্ধ আবেগে
উন্মাদ ঝোড়ো হাওয়া হেঁকে যায়, শীর্ণ পথের
স্মৃতির জীর্ণ খোলস নাড়িয়ে ছুটে যায় ; ফের
শার্সিতে বাজে একটানা সুর
বৃষ্টির, মৃদু কান্নার সুর একটানা বাজে | সুর থেকে জেগে
ওঠে ঢেউ, অবসন্ন মনের ভাবনার ঢেউ
জেগে ওঠে, ম্লান ভাবনাকে ঘিরে বৃষ্টির সেই শ্রান্ত নূপুর
থেমে থেমে তবু থামে না, এ কার
পায়ের শব্দ শার্সিতে বাজে ? সারাদিন বাজে | যেন উন্মন
বিষণ্ণ মৃদু গুনগুন গান ঝরে পড়ে, যেন যতো হাহাকার
সুর হয়ে ওঠে, গান হয়ে ফোটে, বৃষ্টির সুরে একটানা কয়
কানে কানে কথা | এই কি সময় ? হায় ভীরু মন,
শ্রান্ত সময় ঝরে যায়, যায়, সময়ের সোনা
ঝরে যায়, এই বৃষ্টির সাথে ঝরে যায় শ্রান্ত সময় |
হায়রে সে-কথা বলা-ই হলো না, হায়রে |
শুধু মেঘে নয় | এই জলঝরা ক্লান্ত হৃদয়ে সারারাত জেগে
যেখানে বৃষ্টি রিমঝিম, ঝরে রিমঝিম, ঝরে রিমঝিম, ধুধু
শ্রান্ত আকাশে জল ঝরে, শুধু
সেখানেই নয় | যেখানে তীক্ষ্ণ রৌদ্রের তীর
আকাশের গায়ে বেঁধে এসে, আর নিমেষে ত্রস্ত ভীরু মেঘে মেঘে
যেন আচমকা দমকা ভয়ের সাড়া পড়ে যায়,
যেখানে নিবিড়
রৌদ্রের প্রেমে ভরে ওঠে মন, সেখানেও হায়
কথোপকথনে ক্লান্তির সুর, সেখানেও দেখো মৃদু আলাপন
হঠাৎ কখন ছিঁড়ে যায়, আর রৌদ্রের সুরে শুধু মনে হয়
প্রতি মুহূর্তে সময় ঝরচে | হায় ভীরু মন,
শ্রান্ত সময় ঝরে যায়, যায়, সময়ের সোনা
ঝরে যায়, এই রৌদ্রেরো সাথে ঝরে পড়ে যায় শ্রান্ত সময় |
হায়রে সে-কথা বলা-ই হলো না, হায়রে |
. *************************
ঢেউ
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।
এখানে ঢেউ আসে না, ভালোবাসে না কেউ, প্রাণে
কী-ব্যথা জ্বলে রাত্রিদিন, মরুকঠিন হাওয়া
কী-ব্যথা হানে জানে না কেউ, জানে না, কাছে পাওয়া
ঘটে না | এরা কোথায় যায় জটিল জমকালো
পোশাকে মুখ লুকিয়ে, দ্যাখো কতো না সাবধানে
আঁচলে কাঁচ বাঁধে সবাই, চেনে না কেউ সোনা ;
এখানে মন বড় কৃপণ, এখানে সেই আলো
ঝরে না, ভেঙে পড়ে না ঢেউ— এখানে থাকবো না |
যে-মাঠে সোনা ফলানো যায়, আগাছা জমে ওঠে
সেখানে, এরা জানে না কেউ কী-রঙে ঝিলিমিল
জীবন,—তাই বাঁচে না কেউ ; দুয়ারে এঁটে খিল
নিজেকে দূরে সরায়, দিন গড়ায় | সেই সোনা
ঝরে না, ভেঙে পড়ে না ঢেউ—- দুয়ারে মাথা কোটে,
এখানে মন বড় কৃপণ —- এখানে থাকবো না |
. *************************
কটাক্ষ
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।
সমস্ত দিয়েছ তুমি | লাজরক্ত ফাল্গুনের আর
উচ্ছ্বসিত চৈত্রের সম্ভার
দিয়েছ | তবুও বলো, ওই দৃষ্টি ঢালে
যত না জ্যোত্স্নার হাসি, সেই তীক্ষ্ম হাসির আড়ালে
তীব্রতম ফাঁকি
তবুও প্রচ্ছন্ন থাকে না কি ?
থাকে |
হাসির সম্ভার ফেলে দিয়ে
ফাল্গুনের জ্যোত্স্নাকে নিভিয়ে
বর্ষার কান্নায় তাই খুঁঝেছি তোমাকে |
তুমি তো অশ্রুর মেয়ে, তাই এই অপরাহ্নে যদি
শ্রাবণী লাবণ্যে ভরা নদী
হয়ে ওঠো, যদি হও সমর্পণে শান্ত, তবে আর
কোনো দুঃখ থাকে না আমার |
সমস্ত দিয়েছ তুমি | এইবারে কটাক্ষ নিভিয়ে
নিজেকে কাঁদাও,—-
কী হবে সমস্ত দিয়ে, যদি তার মূল্য দিতে গিয়ে
নিজেকে না দাও !
*************************
গ্রীষ্মের প্রার্থনা
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।
এই যে অসুস্থ রাত্রি, এই
মুমূর্ষু কামনা, বৈশাখের
সূর্যের প্রহার, মৃত্যু,—এর
বিবর্ণ মনকে ভালোবেসে
তৃপ্তি নেই, কিছু তৃপ্তি নেই
গ্রীষ্মের হৃদয় থেকে স্তব
ওঠে ঊর্দ্ধে তাই, যার শেষে
আছে শ্যাম বর্ষার উত্সব |
হে আষাঢ় এসো দগ্ধ মনের
শিয়রে, আবেগ আনো
এই বিবর্ণ প্রাণে, হে আষাঢ়
আশার নিবিড় মোহে
ঢালো প্রাণবারি, উজ্জীবনের
গভীর আবেশে হানো
প্রাণের শিকড়ে বৃষ্টি, ভাসাও
সবুজের সমারোহে |
মৃতের পিঙ্গল স্তব্ধ মনে
সঙ্গীতের ঢেউ | বৈশাখের
ওষ্ঠ নড়ে, মজ্জার মাংসের
ভার ঝরে প্রশান্ত প্রগাঢ়
প্রার্থনার মন্ত্র উচ্চারণে,
. — বর্ষার সম্ভার করো জয় |
ঊর্ধ্বে ওঠে, আরো ঊর্ধ্বে —- আরো
গ্রীষ্মের হৃদয়, এ হৃদয় |
. *************************
মেঘডম্বরু
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।
নেই তার রাত্রি, নেই তার দিন | প্রাণবীণার ঝঙ্কারে
সুরের সহস্র পদ্ম ফুটে ওঠে অতল অশ্রুর
সরোবরে, যন্ত্রণার ঢেউয়ের আঘাতে | সেই সুর
খুঁজে ফিরি রাত্রিদিন | হৃদয়ের বৃন্তে নিরবধি
মুদ্রিতনয়ন পদ্মে যদি না সে শতলক্ষধারে
মন্ত্রবারি ঢালে, তার পাপড়িতে পাপড়িতে যদি না সে
জেগে থাকে নিষ্পলক তবে সে নিষ্ফল, না-ই যদি
ঝড়ের ঝঙ্কার তোলে এই মেঘডম্বরু আকাশে |
আকাশ স্তম্ভিত | মন গম্ভীর | কখন গুরুগুরু
গানের উদ্দাম ঢেউ সমবেত কন্ঠের আওয়াজে
ভেঙে পড়ে | পুঞ্জীভূত মেঘের মৃদঙ্গে পাখোয়াজে
বাজে তার সঙ্গতের বিলম্বিত ধ্বনি | বারে বারে
জীবন লুন্ঠিত যার, গানে তার উজ্জীবন শুরু,
প্রাণ তার পরিপূর্ণ মন্ত্রময় গানের ঝঙ্কারে |
. *************************
সাঁওতাল পরগণার বর্ষা
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।
এ কী উল্লাসে নেমে আসে ঝড়,—- ত্রিকূটের ম্লান চূড়া
হারায়, কোথায় ঢাকা পড়ে যায় মাঠ নদী ; কোথা হতে
ছুটে আসে মেঘ, অন্ধ আবেগে ঢালা গৈরিক স্রোতে
ভাসে কুঁড়েঘর কোঠাবাড়ি, ভাসে দিয়ারা কাংলামারু
গ্রাম, দুরন্ত ঢেউ তোলা এই মাঠের সবুজ টানে
নামে জল, ভাঙে হাওয়ার আঘাতে উদ্ধত দেবদারু |
এই মরকত-আকাশে যখন মহুয়ামাতাল হাওয়া
নামে, আহা ঘুম নামে উঁচুনিচু দিগন্তছোঁয়া মাঠে—
শালবনে নামে, মৃদু আলগোছে শ্লথ পায়ে কেউ হাঁটে
ঢেউতোলা লাল মাটির উপরে, যেন কী শিথিল সুর
পুরোনো নেশার মতো নেমে আসে, হালকা সবুজে ছাওয়া
দু চোখে জড়ানো ঘুম হয়ে ঝরে পড়ন্ত রোদ্দুর |
বিহ্বল ভীরু আকাশে যে তুমি দু হাতে কখন মেঘ
ছড়াও, কোথায় ছুঁড়ে ফেল দাও মহুয়ার ভালোবাসা —
মুছে দিয়ে যাও নীড়ের মমতা, শিথিল মৃত আবেগ,
ঝোড়ো উল্লাসে মেতেছো কোথাও প্রমত্ত বৈশাখ !
ঘুমভাঙা রাতে শোনে কেউ, শোনে দূর থেকে ভেসে-আসা
দুরন্তঘন গুরুগুরু সেই ডাক |
. *************************
পরম – ক্ষণ
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।
কখন নামে রাত্রি, জ্বালায় কাংলামারুর মাঠ
নিপুণ হাসির ছোঁয়ায়, ভাসায় অরণ্যপ্রাঙ্গণ,
এ-কূল ও-কূল দু-কূল ভাসায় | মাঝখানে তার মন
জ্যোত্স্না-ধোয়া দ্বীপের মতো প্রহর জাগে | আর
লক্ষকোটি ভাবনা ঘিরে জলের মৃদু ছাঁট
ঘুমের ছোঁয়া ছড়ায় | নাকি এই এলো মৌসুম
ঢেউয়ের সাথে প্রহর জাগার ? হায়রে দ্যাখো তার
এক চোখে নীল স্বপ্ন জ্বলে, অন্য চোখে ঘুম |
কাংলামারু মাঠের ধুধু পথ—
সেইখানে ঘুম ছড়িয়ে নামে ঘুমের বুড়ী, তার
সামনে দাঁড়ায় এমন শপথ কার ?
দাঁড়ায় কঠিন স্বপ্ন-খোদাই মেহুঙ্গী পর্বত |
শূন্য মাঠে শান্তি | ধুধু সহস্র চিন্তার
গ্রন্থি খুলি | সকল আলো নিবলে পরম-ক্ষণ
স্তব্ধ পায়ে নামবে | দূরে কাংলামারুর মাঠে
একলা অশথ গাছের নীচে চাঁদের ছায়া হাঁটে ;
রাত্রি ছিঁড়ে স্বপ্ন ওঠে, স্বপ্ন ছিঁড়ে মন |
. *************************
পূর্বরাগ
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।
আরো কতকাল এভাবে কলম ঠেলতে বলো,
আরো কতকাল সন্ধ্যাসকালে লেখা-লেখা খেলা খেলতে বলো ?
কতোকাল, বলো আরো কতোকাল
দূরে থেকে আমি দেখবো লুকিয়ে
রাতের প্রগাঢ় পর্দা সরিয়ে উঁকিঝুঁকি মারে সোনালি সকাল,
হিজলের ফ্রেমে ফুটে ওঠে শিশুসূর্যের মুখ ?
আলোর স্নিগ্ধ ঘ্রাণে উন্মন দু-একটা ছোটো পাখি উড়ে যায়
মৃদু উত্সুক
চঞ্চল দুটি ছোটো পাখা নেড়ে ;
মানুষেরা নামে মাঠে, পথেঘাটে বাড়ে কলরব ব্যস্ত হাওয়ায় |
বাড়ে রোদ্দুর, ডানা ঝাপটিয়ে
তেঁতুলের ডাল থেকে উড়ে যায় লোভী মাছরাঙা—
হঠাৎ ছোঁ মেরে
নীল জলে তোলে ঢেউয়ের কাঁপন,
কাঁপে ঝিরিঝিরি বাতাসের শাড়ি, যেন ঘুমভাঙা
করুণকান্না বেদনার মতো ; অলস দুপুর
ধীরে ধীরে চলে গড়িয়ে ছড়িয়ে
ক্লান্তির সুর |
. চেয়ে দ্যাখো মন,
এই ক্লান্তি এ-শ্রান্তিকে ঘিরে আবার কখন
মন-কেড়ে-নেওয়া মায়াবী বিকেল বিছিয়েছে জাল
নিপুণ নেশায় | গেল গেল সব, ভেঙে গেল সব, উল্লাসে ঢালা
এই অরণ্য আবার, আবার ; শেষবার বুঝি
ভালোবাসে নেবে | শিরীষে শিমুলে কথা চলে, আর
ডালে ডালে নামে লজ্জার লাল,
লাগে থরোথরো শিহরন, তার
কপালে তীব্র সিঁদুরের জ্বালা
জ্বলে ওঠে | দ্যাখো জ্বলে ওঠে সাদা ঝরোঝরো-শাখা ঝাউয়ের শিয়রে
তৃতীয়ার তনুতন্বী চাঁদের বঙ্কিম ভুরু
আকাশের কালো হৃদয়ে হঠাৎ |
মাঠে মাঠে নামে ছায়াছায়া-ঘুম, সারা রাত ধরে
আধো তন্দ্রার গলিঘুঁজি দিয়ে ম্লান ঝুরুঝুরু
হাওয়া হেঁটে যায়,
শিরশিরে শীতে কাঁপানো হাওয়ায়
চাঁদের তীক্ষ্ণ বঙ্কিম ভুরু কেঁপে ওঠে ; যেন এই ধুধু মাঠ
মাঠ নয়, নদী নদী নয়, ঘুম ঘুম নয়, এই
মাঠ-নদী-বন যেন মিছিমিছি শুয়ে আছে, কেউ ফিরে তাকালেই
ডানা ঝাপটিয়ে একসার সাদা বকের মতন
উড়ে যাবে এরা | ভাবি, আর মনে ভয় নামে, নামে ছায়াছায়া ভয়
সারা মন জুড়ে ; মায়াবী কপাট
প্রাণপণে ঠেলি, পালাবো | কোথায় পালাবো ? ধবল ছায়াছায়া ভয়
নেমে আসে, আর ম্লান চোখ নিয়ে চেয়ে থাকে মন,
মনের দীর্ঘ ছায়া বড়ো হয় |
এই-যে প্রথম সূর্যের সাড়া, উদাস দুপুর,
বিকেলের মধুমালঞ্চমায়া, রাত্রির থরোথরো শিহরণ,
ছায়াছায়া ভয়, ঝরোঝরো-শাখা ঝাউয়ের শিয়রে
বাতাসের ছড়ে টেনে যাওয়া ম্লান কান্নার সুর—
বলো, এ শুধু নিজেকে লুকিয়ে
শুধু চোখে-দেখা দেখে যাবো, আমি সকালের মন, দুপুরের মন,
রাত্রির মন খুঁজে দেখবো না ? শুধু ফাঁকি দিয়ে
চোখে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে যাবো সব ?
. তা হলে আমি কি
কেউ নই ? আমি সকালের নই, দুপুরের নই,
রাত্রিরো নই ? তাহলে, তাহলে
এই-যে আকাশে প্রগাঢ় সূর্য সারাদিন জ্বলে
এই-যে রাত্রে লক্ষ-হীরার চোখ ঝিকিমিকি—
আমি তো এদের চিনি না | তাহলে
আরো কতোকাল এভাবে কলম, ঠেলতে বলো,
আরো কতোকাল সন্ধ্যাসকালে লেখা-লেখা খেলা খেলতে বলো ?
কতোকাল, বলো আরো কতোকাল
পারানির কড়ি ফাঁকি দেওয়া যাবে, সারাদিনমান
খেয়াঘাটে বসে এই মূঢ় আশা লালন করবো ?
এখনো যায়নি সময়, এখনো তুমি বলো,
নিজেকে গোপন রাখবার যত উদ্ধত আশা
যা-কিছু গর্ব
সব গেল কিনা ভেঙেচুরে ? হায়, হৃদয়ের সুরে
ম্লান ছলোছলো
কান্নাকরুণ মিনতির ভাষা
ফুটলো না তবু, ফুটে উঠলো না ; তবু আজীবন
জীবনের সাথে, মৃত্যুর সাথে,
সকালের সাথে, রাত্রির সাথে
যে-মায়ারঙ্গে
মেতেছিলে তুমি, উচ্ছল ছয় ঋতুর সঙ্গে
নিজেকে লুকিয়ে যে-খেলায় তুমি মেতেছিলে, মন,
এখনো তাতেই মত্ত ? জানো না সে-খেলায় কার
জয় হলো, কার শুধু পরাজয় ?
সকল অঙ্গে তীক্ষ্ণ প্রহার,
ম্লান ছলোছলো ঢেউ ভেঙে পড়ে, মনের দীর্ঘ ছায়া বড়ো হয় |
আমি তো রয়েছি নিজেকে নিয়েই মুগ্ধ, যাইনি
কোনোখানে, আমি বাড়াইনি হাত,
আলুথালু যতো শিশুরা হঠাৎ
দু হাতে আমাকে জড়ালো, আমি তো তাদের চাইনি,–
তারাই চাইলো আমাকে | কে জানে
দুটি প্রসারিত কোমল মুঠিতে সব কিছু এরা
কেন পেতে চায়, হেসে ওঠে কেন ; সে-হাসির মানে
কী, আমি কখনো ভাবিনি ; ভেবেছি
এই হাসিটুকু—
একে আমি গানে বেঁধে নেবো, তার সুর নিয়ে সারাদিন কাটাছেঁড়া
করেছি, ভরেছি গানে তাকে,— আজ
সে গানের কী-যে মানে তা তো আমি নিজেই জানি না |
জানি না হৃদয় চেয়েছিল কিনা
কখনো কাউকে |
. কোন্ সমুদ্রে গানের জাহাজ
সাধ করে ভরাডুবি হতে চায়, সে-কার কান্না
সারা রাত ভরে শুনেছি, আমার মনে নেই তা তো
কার রুখু রুখু
ম্লান চুলে যেন বিষণ্ণ আশা ঝরে পড়েছিল, মনে পড়ে না তো |
তখন ভেবেছি, আমার গান না
যদি এই ঝরা হাহাকারটুকু
সুরে সুরে পারে বেঁধে নিতে তবে ব্যর্থ, ব্যর্থ
সবকিছু ; সেই হাহাকার – তার সুর নিয়ে সারাদিন কাটাছেঁড়া
করেছি, ভরেছি গানে তাকে,—- আজ
যতো গান তারা কোন্ কথা বলে,
সে-কথার কী-যে মানে তা তো আমি নিজেই জানি না |
সারাদিন গান বাঁধবার ছলে
কিছু না চাইতে
জীবনের কাছে যেটুকু পেলাম,
ফাঁকি দিয়ে পাওয়া যাবে না, হৃদয়, তারো পুরো দাম
দিয়ে যেতে হবে, নইলে সে-দেখা
কিছু না, সে-পাওয়া কিছু না | তাহলে
আরো কতোকাল এভাবে কলম ঠেলতে বলো,
আরো কতোকাল সন্ধ্যাসকাল লেখা-লেখা খেলতে বলো ?
. *************************
আরো পড়ুন: নিশির ডাক – সমরেশ মজুমদার
কান্না
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।
পার হয়ে গিয়ে অজস্র ঢেউ,
. অজস্র জল সাঁতরে
পাওয়া যায় এক দুর্লভ মণি
. সাতসমুদ্র হাতড়ে |
যার হাতে থাকে সেই মণিদীপ
. তারই চারপাশে তীর্থ
জমে ওঠে, সেই মণিকে হারালে
. ভেঙে যায় মধুনীড় তো ;
চোখের সীমানা ছাড়িয়ে
চলে যায় সেই মণিদীপ, আর
. যতো গান— যায় হারিয়ে |
তবু থাকে গান, থাকে সে—
তুষারশুভ্র হাসি হয়ে থাকে
. জীবনের ফাঁকে ফাঁকে সে ;
যদি বা কখনো মনে পড়ে যায়
. বন্ধুকে পরিজনকে—
এ হাসি তখন কান্নার মতো
. ধুয়ে দিয়ে যায় মনকে |
জীবনে যখন নেই, কিছু নেই,
. আলো না, মধুর গান না—-
হাসি হয়ে ঝরে চোখের কোনায়
. শিশিরের মতো কান্না |
. *************************
প্রেমিকের তুমি
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
মেঘ বসু সম্পাদিত ‘হে প্রেম’ কাব্য সংকলন, ২০১১, থেকে নেওয়া।
চুলের ফিতায় ঝুল-কাঁটাতারে আরও একবার
শেষবার ধাঁপ দিতে আজ
বড় সাধ হয় | আজ দুর্বল হাঁটুতে
আরও একবার, শেষবার,
নবীন প্রতিজ্ঞা, জোর অনুভব করে নিয়ে ধ্বংসের পাহাড়
বেয়ে টান উঠে যেতে ইচ্ছা হয়
মেঘলোকে | মনে হয়,
স্মৃতির পাতাল কিংবা অভ্রভেদী পাহাড়ের চূড়া
ব্যতীত কোথাও তার ভূমি নেই |
প্রেমিকের নেই | তাই অতল পাতালে
অথবা পাহাড়ে তার দৃষ্টি ধায় |
মনে হয়, অন্ধকারে কোটি জোনাকির শবদেহ
মাড়িয়ে আবার ঝুল-কাঁটাতারে চুলের ফিতায়—
ভীষণ লাফিয়ে পড়ি | অথবা হাঁটুতে
নবীন রক্তের জোর অনুভব করে নিয়ে যুগল পাহাড়
ভেঙে উঠে যাই মেঘলোকে |
আরও একবার যাই, আরও একবার, শেষবার |
হৃদয়-সময়-স্বপ্ন
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।
আর কেন, হে হৃদয়, বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে সারাদিন
কী লাভ চিন্তার ভেলা ভাসিয়ে ? অস্পষ্ট দূর তটে
যদি ফিরে যেতে চাও, লোনাগন্ধ হাওয়ার ঝাপটে
যদি সেই ব্যথানম্র মেয়ের বিষণ্ণ ভালোবাসা
মনে পড়ে যদি চোখে ছায়া নামে করুণ মসৃণ,
সমুদ্রের থেকে ঘরে, ঘর ছেড়ে সমুদ্রে আবার
ইচ্ছার অস্থির শীর্ণ সেতু বেয়ে এই যাওয়া-আসা
আর কেন ? হে হৃদয়, এই পারাপার কেন আর ?
আর কেন, হে সময়, অন্তহীন উজ্জ্বল প্রভায়
কেন আর উদ্ভাসিত হতে চাও ? মনের গভীরে
যে-সঙ্গীত ঝড়ে গেছে, তারো ম্লান আকর্ষণ ছিঁড়ে
এখনো হওনি মুক্ত | শিশুর অস্ফুট মৃদু ভাষা
প্রণয়কাকলি কান্না বিস্মৃতির অতল গুহায়
যদি জেগে উঠে ফের তবে এই আকাঙ্ক্ষা আবার
সম্মুখে চলার কেন ? ফিরে ফিরে এই যাওয়া-আসা
আর কেন ? হে সময়, এই পারাপার কেন আর ?
হে স্বপ্ন, চিন্তার জ্যোতি, হৃদয়ের সময়ের গ্লানি
তোমাকে করেছে স্পর্শ, তোমাকেও | উজ্জ্বল জ্যোতির
চক্র নিভে আসে, সঙ্গী-সঙ্গীতের প্রশান্ত গম্ভীর
সমস্ত মূর্ছনা স্তব্ধ | আলো নেই, নীরন্ধ্র হতাশা
এবার, এখন | মৃদু কান্নার অসহ্য কানাকানি |
হে স্বপ্ন, হে ছিন্নপক্ষ বিহঙ্গম, তাহলে আবার
দিগন্তবিসারী সাধ কেন ? তবে এই যাওয়া-আসা
আর কেন ? প্রাণতীর্থে এই পারাপার কেন আর ?
চিন্তার অঙ্গারে দগ্ধ এ-হৃদয়, সম্মুখের দিকে
সময় চলে না | স্বপ্ন-বিহঙ্গের হিরন্ময় সাধ
হাওয়ার ঝাপটে ঝরে গেছে | তবু আশ্চর্য অগাধ
শান্তি নামে এ-হৃদয়ে, সময়ে, কান্নায়, স্বপ্নে, শোকে
সুগম্ভীর শান্তি নামে |
. এইবার আমার আমিকে
হৃদয় সময় স্বপ্ন সাধ থেকে ছিন্ন করো, আর
প্রসন্ন সান্ত্বনা ঢালো অন্তহীন জ্যোত্স্নার আলোকে |
হে অনন্য, আর কেন, এইবারে খোলো সিংহদ্বার |
. *************************
দুই দিন
কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জন’, ১৯৬৯ থেকে নেওয়া।
মাঘের অন্তিমে বৃষ্টি | ফাল্গুনের প্রথম সকাল
মাঠে মাঠে বিচ্ছুরিত, রাত্রির কুয়াশা
রৌদ্রের সর্বাঙ্গে ম্লান ভীরু ভালোবাসা
হয়ে ঝরে | মাটিতে লক্ষ্মীর
প্রসন্ন পায়ের চিহ্ন খুঁজে ফেরে দুঃস্থ ভাঙাহাল
বিশীর্ণ গ্রামীণকন্যা | ইতস্তত লাঙলের ফালে
বলিষ্ঠ কর্ষণে মগ্ন শান্ত ধীরস্থির
কয়েকটি কৃষক | এই ফাল্গুনের উজ্জ্বল সকালে
যখন আশ্চর্য স্বপ্ন প্রান্তরের গায়ে
ছড়িয়ে গিয়েছে, ঝরে কৃষকের ঘাম
নরম মাটিতে, বললাম
মাঠের কন্যাকে, ‘চলো ঘরে চলো |’ আঁচলের থেকে
ছড়িয়ে শস্যের বীজ বললো সে, ‘সময় কোথায় ?
এখন শিশুর সাধ ছড়িয়ে গিয়েছে শস্যহীন
প্রান্তরের মনে ; সেই সাধকে অপূর্ণ ফেলে রেখে
এখন কি ঘরে ফেরা যায় ?
এখন অনেক কাজ, এসো তুমি অন্য একদিন |’
আরেক দিনের কথা | অঘ্রানের রাত্রির শিশির
ঝরে পড়ে মৃতবত্সা প্রান্তরের বুকে ;
ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা মাঠঘাট, মাঠের শিশুকে
ছিঁড়ে এনে গৃহস্থের ঘরে ঘরে শস্যের উত্সব |
সারাদিন উত্সবের ভিড়
দেখে দেখে ক্লান্ত চোখ ; এইবারে রাত্রির আরাম
হৃদয়ে নিঃশব্দে ঝরে, ব্যস্ত কলরব
গ্রামান্তে নিস্তব্ধপ্রায় | আবার বললাম
গ্রামের কন্যাকে, ‘চলো, মাঠে চলো |’ বললো সে, ‘সময় কোথায় ?
ফসল উঠেছে ঘরে, চেয়ে দ্যাখো, নবান্নের গান
কৃষাণী বধূর কন্ঠে, এমন অঘ্রান
আসেনি কখনো বুঝি | এখন কি রিক্ত শস্যহীন
মৃতবত্সা মাঠে যাওয়া যায় ?
এখন অনেক কাজ, এসো তুমি অন্য একদিন |’