Banalata Sen l Bonolata Sen l বনলতা সেন 2024

By raateralo.com

Updated on:

Banalata Sen l Bonolata Sen l বনলতা সেন 2024

Banalata Sen l Bonolata Sen l বনলতা সেন: “বনলতা সেন” কবিতাটি প্রথম প্রকাশ করেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু তার কবিতা পত্রিকায়। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে প্রকাশিত কবিতার পৌষ, ১৩৪২ সংখ্যার মাধ্যমে বনলতা সেন সর্বপ্রথম পাঠকের হাতে এসে পৌঁছায়। কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা ১৩৪৯, ইংরেজি ডিসেম্বর ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তার বনলতা সেন নামক তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করেন। কবিতা-ভবন কর্তৃক প্রকাশিত এক পয়সায় একটি গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত হিসেবে। প্রকাশক ছিলেন জীবনানন্দ দাশ নিজেই। ১৬ পৃষ্ঠার প্রথম সংস্করণে কবিতা ছিল মোট ১২টি। প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছিলেন শম্ভু সাহা।[১] পরবর্তীকালে জীবনানন্দ দাশ ১৯৪৪ এ প্রকাশিত তার চতুর্থ কাব্য মহাপৃথিবীতে উক্ত বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের সকল কবিতাই অন্তর্ভুক্ত করেন। অতএব, মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থেরও প্রথম কবিতা ছিল “বনলতা সেন”।

কবির জীবদ্দশায় বাংলা শ্রাবণ, ১৩৫৯, ইংরেজি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণটি প্রকাশিত হয়। ৪৯ পৃষ্ঠার বর্ধিত কলেবরে প্রকাশিত সংস্করণে আগের ১২টি কবিতার সাথে আরও ১৮টি কবিতা যোগ করে মোট ৩০টি কবিতা প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্যজিৎ রায় ও মূল্য ছিল ২ টাকা। সিগনেট সংস্করণের প্রকাশক ছিলেন দিলীপকুমার গুপ্ত। পরবর্তীতে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটিতেও কবিতাটি সংকলিত হয়। এছাড়া আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের যৌথ সম্পাদনায় ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত আধুনিক বাঙলা কবিতা শীর্ষক গ্রন্থেও কবিতাটি সঙ্কলিত হয়েছিল। কোলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে সুরক্ষিত পাণ্ডুলিপিসমূহের ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ চিহ্নিত ৮ নং খাতায় এ কবিতাটি আছে। তাই, পাণ্ডুলিপির হিসেবে, ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে কবিতাটি লিখিত হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়।

কবিতাটি প্রকাশের সময় সিটি কলেজে টিউটরের চাকুরি হারিয়ে বেকার জীবনানন্দ সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় কোলকাতায় দিনাতিপাত করছিলেন। এ ঘটনার মাত্র কয়েক বৎসর আগে তার বিয়ে হয়েছিল। স্ত্রীর সাথে বনিবনা হবে না কোনোদিন তা ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।

কবিতাটির সঠিক পাঠ নিয়ে প্রশ্ন আছে; কেননা ভিন্ন ভিন্ন সংকলনে ভিন্ন ভিন্ন পাঠ পাওয়া যায়। যদিও সে সবের পার্থক্য ব্যাপক কিছু নয়। তবে ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত পাণ্ডুলিপির কবিতা শীর্ষক গ্রন্থের পাঠটি নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়।


Banalata Sen l Bonolata Sen l বনলতা সেন 2024

বনলতা সেন

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশােকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরাে দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।


চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য; অতি দূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতাে চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।


সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়ােজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখােমুখি বসিবার বনলতা সেন।

কুড়ি বছর পরে

আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি।
আবার বছর কুড়ি পরে
হয়তাে ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে—তখন হলুদ নদী
নরম নরম হয় শর কাশ হােগলায়—মাঠের ভিতরে।
অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর;
ব্যস্ততা নাইকো আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড়ের থেকে খড়
ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল!
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার—
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তােমারে আবার!
হয়তাে এসেছে চাদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু সরু কালাে ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের,
ঝাউয়ের-আমের;
কুড়ি বছরের পরে তখন তােমারে নাই মনে!
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তােমার আমার!

তখন হয়তাে মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে—
 বাবলার গলির অন্ধকারে
 অশথের জানালার ফাকে
 কোথায় লুকায় আপনাকে?
চোখের পাতার মতাে নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে—
সােনালি সােনালি চিল—শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে
কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তােমারে?

হাওয়ার রাত

গভীর হাওয়ার রাত ছিল কাল—অসংখ্য নক্ষত্রের রাত;
সারা রাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে;
মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনাে মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতাে,
কখনাে বিছানা ছিড়ে
নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে;
এক-একবার মনে হচ্ছিল আমার—আধাে ঘুমের ভিতর হয়তাে
 মাথার উপরে মশারি নেই আমার,
স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতাে উড়ছে সে।
কাল এমন চমৎকার রাত ছিল।
সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিল—আকাশে এক তিল ফাক ছিল না;
পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি;
অন্ধকার রাতে অশ্বথের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের মতাে
 ঝলমল করছিলাে সমস্ত নক্ষত্রেরা;
জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার
শালের মতাে জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ।
কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিল।
যে নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার হাজার বছর আগে মরে গিয়েছে।
তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে করে এনেছে;
যে রূপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় মরে যেতে দেখেছি।
কাল তারা অতিদূর আকাশের সীমানার কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে করে
 কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন
মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য?
জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য?
প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?

আড়ষ্ট–অভিভূত হয়ে গেছি আমি,
কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিড়ে ফেলেছে যেন;
আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর
পৃথিবী কীটের মতাে মুছে গিয়েছে কাল!
আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে
আমার জানালার ভিতর দিয়ে শাঁই শাঁই করে,
সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতাে!


হৃদয় ভরে গিয়েছে আমার বিস্তীর্ণ ফেরে সবুজ ঘাসের গন্ধে,
দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে,
মিলননান্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতাে অন্ধকারে চঞ্চল বিরাট সজীব
 রােমশ উচ্ছাসে
জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়!


আমার হৃদয় পৃথিবী ছিড়ে উড়ে গেল,
নীল হাওয়ার সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বলুনের মতাে গেল উড়ে
একটা দূর নক্ষত্রের মাস্তুলকে তারায় তারায় উড়িয়ে নিয়ে চলল
 একটা দুরন্ত শকুনের মতাে।

আমি যদি হতাম

আমি যদি হতাম বনহংস,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনাে এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;


তাহলে আজ এই ফারুনের রাতে
ঝাউয়েরা শাখার পেছনে চাদ উঠতে দেখে
আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশের রূপালী শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম—


তােমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তােমার রক্তের স্পন্দন—
নীল আকাশে খই ক্ষেতের সােনালি ফুলের মতাে অজস্র তারা,
শিরীষ বনের সবুজ, রােমশ নীড়ে
সােনার ডিমের মতাে
ফাল্গুনের চাঁদ।
হয়তাে গুলির শব্দ:
আমাদের তির্যক গতিস্রোত,
আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস,
আমাদের কণ্ঠে উত্তর হাওয়ার গান।


হয়তাে গুলির শব্দ আবার;
আমাদের স্তব্ধতা,
আমাদের শান্তি।
আজকের জীবনের এই টুকরাে টুকরাে মৃত্যু আর থাকত না;

থাকত না আজকের জীবনের টুকরাে সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;
আমি যদি বনহংস হতাম;
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনাে এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।

থাকত না আজকের জীবনের টুকরাে সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;
আমি যদি বনহংস হতাম;
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনাে এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।

ঘাস

কচি লেবুপাতার মতাে নরম সবুজ আলােয়
 পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভােরের বেলা;
কাঁচা বাতাবির মতাে সুবজ ঘাস—তেমনি সুঘ্রাণ
 হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিড়ে নিচ্ছে।
আমারাে ইচ্ছে করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতাে
 গেলাস গেলাস পান করি,
এই ঘাসের শরীর ছানি—চোখে চোখ ঘষি,
 ঘাসের পাখনায় আমার পালক,
ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনাে এক নিবিড় ঘাস-মাতার
 শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।

হায় চিল

হায় চিল, সােনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে।
তােমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতাে তার স্নান চোখ মনে আসে।
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতাে সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আন? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
   বেদনা জাগাতে ভালােবাসে!
হায় চিল, সােনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে।

বুনাে হাঁস

পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে
জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাদের আহ্বানে

বুনাে হাঁস পাখা মেলে—শাঁই শাঁই শব্দ শুনি তার;
এক- -দুই-তিন–চার—অজস্র—অপার—

রাত্রির কিনারা দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া
ইঞ্জিনের মতাে শব্দে; ছুটিতেছে—ছুটিতেছে তারা।

তারপর পড়ে থাকে নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,
হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ—দু একটা কল্পনার হাঁস;

মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ;
উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক

কল্পনার হাঁস সব— পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রঙ মুছে গেলে পর
উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।

শঙ্খমালা

কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তােমারে চাই:
বেতের ফলের মতাে নীলাভ ব্যথিত তােমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি—কুয়াশার পাখনায়—
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলােক
জোনাকির দেহ হতে—খুঁজেছি তােমারে সেইখানে—
ধূসর পেঁচার মতাে ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে বেয়ে
সােনার সিঁড়ির মতাে ধানে আর ধানে
তােমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতাে প্রাণে।

দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;
সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা—
বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,
শিঙের মতন বাঁকা নীল চাদ শােনে যার স্বর।

কড়ির মতাে শাদা মুখ তার,
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে আগুনে হায়।

চোখে তার
যেন শত-শতাব্দীর নীল অন্ধকার!
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতাে—দুধে আর্দ্র—কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।

নগ্ন নির্জন হাত

আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হ’য়ে উঠছে:
আলাের রহস্যময়ী সহােদরার মতাে এই অন্ধকার।

যে আমাকে চিরদিন ভালােবেসেছে।
অথচ যার মুখ আমি কোনােদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতাে
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।

মনে হয় কোন বিলুপ্ত নগরীর কথা
সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে।

ভারতসমুদ্রের তীরে
কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে
অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে
আজ নেই, কোনাে এক নগরী ছিল একদিন,
কোন এক প্রাসাদ ছিল।
মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ
পারস্য গালিচা, কাশ্মিরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল,
আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙক্ষা,
আর তুমি নারী—
এই সব ছিল সেই জগতে একদিন।

অনেক কমলা রঙের রােদ ছিল,
অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিল,
মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিল অনেক;

অনেক কমলা রঙের রােদ ছিল,
অনেক কমলা রঙের রােদ;
আর তুমি ছিলে;
তােমার মুখের রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না,
খুঁজি না।

ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,
অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,
লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ,
অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি,
রামধনু রঙের কাচের জানালা,
ময়ূরের পেখমের মতাে রঙিন পর্দায় পর্দায়
কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরাে দুর কক্ষ ও কক্ষান্তরের
ক্ষণিক আভাস—
আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।

পর্দায়, গালিচায় বক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,
রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!
তােমার নগ্ন নির্জন হাত।

তােমার নগ্ন নির্জন হাত।

শিকার

ভাের;
আকাশের রঙ ঘাসফড়িঙের দেহের মতাে কোমল নীল:
চারিদিকে পেয়ারা ও নােনার গাছ টিয়ার পালকের মতাে সবুজ।
একটি তারা এখন আকাশে রয়েছে:
পাড়াগাঁয়ের বাসরঘরে সব চেয়ে গােধুলি-মদির মেয়েটির মতাে;
কিংবা মিশরের মানসী তার বুকের থেকে যে মুক্তা।
আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিল
হাজার হাজার বছর আগে এক রাতে তেমনি
তেমনি একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনাে।

হিমের রাতে শরীর ‘উম্‌’ রাখবার জন্য দেশােয়ালীরা
সারারাত মাঠে আগুন জ্বেলেছে—
মােরগ ফুলের মতাে লাল আগুন;
শুকননা অশ্বত্থপাতা দুমড়ে এখনাে আগুন জ্বলছে তাদের;

সূর্যের আলােয় তার রঙ কুঙ্কুমের মতাে নেই আর;
হয়ে গেছে রােগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতাে।
সকালের আলােয় টলমল শিশিরে চারিদিকের বন ও আকাশ
ময়ূরের সবুজ নীল ডানার মতাে ঝিলমিল করছে।

ভাের;
সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে
নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতাে অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে
অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে
সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভােরের জন্য অপেক্ষা করছিল
এসেছে সে ভােরের আলােয় নেমে;

কচি বাতাবি লেবুর মতাে সবুজ সুগন্ধি ঘাস ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে;
নদীর তীক্ষ্ণ শীতল ঢেউয়ে সে নামল—

ঘুমহীন ক্লান্ত বিহুল শরীরটাকে স্রোতের মতাে একটা আবেগ দেওয়ার জন্য
অন্ধকারের হিম কুঞ্ছিত জরায়ু ছিড়ে ভােরের রৌদ্রের মতাে
একটা বিস্তীর্ণ উল্লাস পাবার জন্য;
এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সােনার বর্ষার মতাে জেগে উঠে
সাহসের সাথে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য।

একটা অদ্ভুত শব্দ।
নদীর জল মচকাফুলের পাপড়ির মতাে লাল।
আগুন জ্বলল আবার—উষ্ণ লাল হরিণের মাংস তৈরি হয়ে এল।
নক্ষত্রের নিচে ঘাসের বিছানায় বসে অনেক পুরনাে শিশিরভেজা গল্প
সিগারেটের ধোঁয়া;
টেরিকাটা কয়েকটা মানুষের মাথা;
এলােমেলাে কয়েকটা বন্দুক—হিম—নিঃস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম।

হরিণেরা

স্বপ্নের ভিতরে বুঝি—ফাল্গুনের জ্যোৎস্নার ভিতরে
দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে

হরিণেরা; রূপালি চাদের হাত শিশিরের পাতায়;
বাতাস ঝাড়িছে ডানা-মুক্তা ঝরে যায়

পল্লবের ফাকে ফাকে—বনে বনে—হরিণের চোখে;
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলােকে।

হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বােস যেন হাসে
হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে—

বিলুপ্ত ধূসর কোন পৃথিবীর শেফালিকা, আহা,
ফাল্গুনের জ্যোৎস্নায় হরিণেরা জানে শুধু তাহা।

বাতাস ঝাড়িছে ডানা, হীরা ঝরে হরিণের চোখে—
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর হীরার আলােকে।

বেড়াল

সারাদিন একটা বেড়ালের সঙ্গে ঘুরে ফিরে কেবলই আমার দেখা হয়:
গাছের ছায়ায়, রােদের ভিতরে, বাদামী পাতার ভিড়ে;
কোথাও কয়েক টুকরাে মাছের কাঁটার সফলতার পর
তারপর শাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর
নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতাে নিমগ্ন হয়ে আছে দেখি;
কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে,
সারাদিন সূর্যের পিছনে পিছনে চলছে সে।
একবার তাকে দেখা যায়,
একবার হারিয়ে যায় কোথায়।
হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রঙের সূর্যের নরম শরীরে
শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে;
তারপর অন্ধকারকে ছােট ছােট বলের মতাে থাবা দিয়ে লুফে আনল সে,
সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল।

সুদর্শনা

একদিন ম্লান হেসে আমি
তােমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে
শুনেছি কিন্নরকণ্ঠ দেবদারু গাছে,
দেখেছি অমৃতসূর্য আছে।

সব চেয়ে আকাশ নক্ষত্র ঘাস চন্দ্রমল্লিকার রাত্রি ভালাে
তবুও সময় স্থির নয়;
আরেক গভীরতর শেষ রূপ চেয়ে
দেখেছে সে তােমার বলয়।

এই পৃথিবীর ভালাে পরিচিত রােদের মতন
তােমার শরীর; তুমি দান করােনি তাে;
সময় তােমাকে সব দান করে মৃতদান বলে
সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত।

অন্ধকার

গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;
তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া
গুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে।
ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম—পউষের রাতে
কোনােদিন আর জাগব না জেনে
কোনাে দিন জাগব না আমি—কোনােদিন জাগব না আর
হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
তুমি দিনের আলাে নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও,
হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে।
রয়েছে যে অগাধ ঘুম
সে আস্বাদ নষ্ট করবার মতাে শেলতীব্রতা তােমার নেই,
তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও—
জানাে না কি চাঁদ,
নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
জানাে না কি নিশীথ,
আমি অনেক দিন
অনেক অনেক দিন
অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মত মিশে থেকে
হঠাৎ ভােরের আলাের মূখ উচ্ছাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব
বুঝতে পেরেছি আবার;

ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে
মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখখামুখি দাঁড়াবার জন্য
আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;

আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়-বেদনায়—আক্রোশে ভরে গিয়েছে;
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়ােরের
আর্তনাদে উৎসব শুরু করেছে।
হায়, উৎসব!
হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমােতে চেয়েছি আমি,
অন্ধকারের স্তনের ভিতর যােনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতাে মিশে
থাকতে চেয়েছি।

কোনােদিন মানুষ ছিলাম না আমি।
হে নর, হে নারী,
তােমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনােদিন;
আমি অন্য কোনাে নক্ষত্রের জীব নই।
যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ,
সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,
শত শত শূকরের চীৎকার সেখানে,
শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর;
এই সব ভয়াবহ আরতি।

গভীর অন্ধকারে ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
আমাকে কেন জাগাতে চাও?
হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি,
হে হিম হাওয়া,
আমাকে জাগাতে চাও কেন!

অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠব না আর;
তাকিয়ে দেখব না নির্জন বিমিশ্র চাদ বৈতরণীর থেকে
অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে কীর্তিনাশার দিকে।

ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব—ধীরে ধীরে—পউষের রাতে—
কোনােদিন জাগব না জেনে—

কোনােদিন জাগব না আমি কোনােদিন আর।

কমলালেবু

একবার যখন দেহ থেকে বার হ’য়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনাে এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনাে এক পরিচিত মুমুর্ষুর বিছানার কিনারে।

শ্যামলী

শ্যামলী, তােমার মুখ সেকালের শক্তির মতন;
যখন জাহাজে চড়ে যুবকের দল।
সুদূর নতুন দেশে সােনা আছে ব’লে;
মহিলারি প্রতিভায় সে ধাতু উজ্জ্বল
টের পেয়ে, দ্রাক্ষা দুধ ময়ূর-শয্যার কথা ভুলে
সকালের রূঢ় রৌদ্রে ডুবে যেত কোথায় অকূলে।

তােমার মুখের দিকে তাকালে এখনাে
আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রের নীল,
দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা,
বিকেলের উপকণ্ঠে সাগরের চিল,
নক্ষত্র, রাত্রির জল, যুবাদের ক্রন্দন সব—
শ্যামলী, করেছি অনুভব।

অনেক অপরিমেয় যুগ কেটে গেল;
মানুষকে স্থির—স্থিরতর হতে দেবে না সময়;
সে কিছু চেয়েছে বলে এত রক্ত নদী।
অন্ধকার প্রেরণার মতাে মনে হয়
দূর সাগরের শব্দ—শতাব্দীর তীরে এসে ঝরে;
কাল কিছু হয়েছিল,—হবে কি শাশ্বতকাল পরে।

দুজন

‘আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন—কতদিন আমিও তােমাকে
খুঁজি নাকো,—এক নক্ষত্রের নিচে তবু—একই আলাে পৃথিবীর পারে
আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনাে পথের রেখা হ’য়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?’—ব’লে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে;
আজ এই মাঠ সূর্য সহধর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে
প্রাণ তার ভ’রে গেছে।

দুজনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবী ও আকাশের পাশে
আবার প্রথম এল—মনে হয়—যেন কিছু চেয়ে—কিছু একান্ত বিশ্বাসে।
লালচে হলদে পাতা অনুষঙ্গে জাম বট অশ্বথের শাখার ভিতরে
অন্ধকারে নড়ে-চড়ে ঘাসের উপর ঝ’রে পড়ে;
তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল।

যেখানে আকাশে খুব নীরবতা, শান্তি খুব আছে,
হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হ’লে ক্রমে-ক্রমে সেখানে মানুষ
আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে:
সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দুজন, চারিদিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে
হেমন্ত আসিয়া গেছে,—চিলের সােনালী ডানা হয়েছে খয়েরি;
ঘুঘুর পালক যেন ঝ’রে গেছে,—শালিকের নেই আর দেরি,
হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু ক’রে ঘুমােবে সে শিশিরের জলে;
ঝরিছে মরিছে সব এইখানে—বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে।

নারী তার সঙ্গীকে: ‘পৃথিবীর পুরনাে পথের রেখা হ’য়ে যায় ক্ষয়,
জানি আমি,—তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয়
কী নিয়ে থাকিবে বল;—একদিন হৃদয়ে অগাধ ঢের দিয়েছে চেতনা,
তারপর ঝ’রে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না।

অবশেষে

এখানে প্রশান্ত মনে খেলা করে উঁচু উঁচু গাছ।
সবুজ পাতার পরে যখন নেমেছে এসে দুপুরের সূর্যের আঁচ
নদীতে স্মরণ করে একবার পৃথিবীর সকাল বেলাকে।
আবার বিকেল হলে অতিকায় হরিণের মতাে শান্ত থাকে
এই সব গাছগুলাে;—যেন কোনাে দূর থেকে অস্পষ্ট বাতাস
বাঘের ঘ্রাণের মতাে হৃদয়ে জাগায়ে যায় ত্রাস;
চেয়ে দেখ—ইহাদের পরস্পর নিলীম বিন্যাস
নড়ে ওঠে ত্রস্ততায়;—আধাে নীল আকাশের বুকে
হরিণের মতাে দ্রুত ঠ্যাঙের তুরুকে
অন্তর্হিত হয়ে যেতে পারে তারা বটে;
একজোটে কাজ করে মানুষেরা যে রকম ভােটের ব্যালটে;
তবুও বাঘিনী হয়ে বাতাসকে আলিঙ্গন করে —
সাগরের বালি আর রাত্রির নক্ষত্রের তরে।

স্বপ্নের ধ্বনিরা

স্বপ্নের ধ্বনিরা এসে বলে যায়: স্থবিরতা সব চেয়ে ভালাে;
নিস্তব্ধ শীতের রাতে দীপ জ্বেলে
অথবা নিভায়ে দীপ বিছানায় শুয়ে
স্থবিরের চোখে যেন জমে ওঠে অন্য কোন বিকেলের আলাে।

সেই আলাে চিরদিন হয়ে থাকে স্থির;
সব ছেড়ে একদিন আমিও স্থবির
হয়ে যাব; সেদিন শীতের রাতে সােনালি জরির কাজ ফেলে
প্রদীপ নিভায়ে রব বিছানায় শুয়ে;
অন্ধকারে ঠেস দিয়ে জেগে রব
বাদুড়ের আঁকাবাঁকা আকাশের মতাে।

স্থবিরতা, কবে তুমি আসিবে বল তাে।

আমাকে তুমি

আমাকে
তুমি দেখিয়েছিলে একদিন:
মস্ত বড় ময়দান—দেবদারু পামের নিবিড় মাথা—মাইলের পর মাইল;
দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস
দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়;
জোয়ারের মতাে ফিরে আসে আবার;
জানালায় জানালায় অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে:
পৃথিবীকে মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়।
তারপর
দূরে
অনেক দূরে
খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মতাে ধান ভানে—
গান গায়—গান গায়
এই দুপুরের বাতাস।

এক একটা দুপুরে এক একটা পরিপূর্ণ জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় কেন

বিকেলের নরম মুহূর্তে;
নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, হরিণের ছায়ার আসা-যাওয়া;
একটা ধবল চিতল-হরিণীর ছায়া
আতার ধূসর ক্ষীরে গড়া মূর্তির মতাে
নদীর জলে
সমস্ত বিকেলবেলা ধ’রে
স্থির।

মাঝে মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ,
আগুনের—ঘিয়ের ঘ্রাণ;
বিকেলে
অসম্ভব বিষন্নতা।
ঝাউ হরিতকী শাল, নিভন্ত সূর্যে
পিয়াসাল পিয়াল আমলকী দেবদারু—
বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ, জীবনের ফেনা;

শাদা শাদা ছিটকালাে পায়রার ওড়াউড়ি জ্যোৎস্নায়—ছায়ায়,
রাত্রি;
নক্ষত্র ও নক্ষত্রের
অতীত নিস্তব্ধতা।

মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এই সব আলাে প্রেম ও নির্জনতার মতাে।

তুমি

নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারিদিকে উজ্জ্বল আকাশ;
বাতাসে নীলাভ হ’য়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস;
কাঁচপােকা ঘুমিয়েছে—গঙ্গাফড়িং সে-ও ঘুমে;
আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছ তুমি।

মাটির অনেক নিচে চ’লে গেছ? কিংবা দূর আকাশের পারে
তুমি আজ? কোন কথা ভাবছ আঁধারে?
ঐ যে ওখানে পায়রা একা ডাকে জামিরের বনে;
মনে হয় তুমি যেন ঐ পাখি—তুমি ছাড়া সময়ের এ-উদ্ভাবনে

আমার এমন কাছে—আশ্বিনের এত বড় অকূল আকাশে
আর কাকে পাব এই সহজ গভীর অনায়াসে—’
বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারি পাখি গেল উড়ে
প্রকতিস্থ প্রকৃতির মতাে শব্দে—প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে।

ধান কাটা হয়ে গেছে

ধান কাটা হ’য়ে গেছে কবে যেন—ক্ষেতে মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম—সাপের খােলস নীড় শীত।
এই সব উৎরায়ে ঐখানে মাঠের ভিতর।
ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ—কেমন নিবিড়।

ঐখানে একজন শুয়ে আছে—দিনরাত দেখা হ’তাে কত কত দিন,
হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কত অপরাধ;
শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং
আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।

শিরীষের ডালপালা

শিরীষের ডালপালা লেগে আছে বিকেলের মেঘে,
পিপুলের ভরা বুকে চিল নেমে এসেছে এখন;
বিকেলের শিশুসূর্যকে ঘিরে মায়ের আবেগে
করুণ হয়েছে ঝাউবন।

নদীর উজ্জ্বল জল কোরালের মতাে কলরবে
ভেসে নারকোলবনে কেড়ে নেয় কোরালীর প্রাণ;
বিকেল বলেছে এই নদীটিকে: ‘শান্ত হতে হবে—’
অকূল সুপুরিবন স্থির জলে ছায়া ফেলে এক মাইল শান্তি কল্যাণ

হয়ে আছে। তার মুখ মনে পড়ে এ-রকম স্নিগ্ধ পৃথিবীর
পাতাপতঙ্গের কাছে চলে এসে; চারিদিকে রাত্রি নক্ষত্রের আলােড়ন
এখন দয়ার মতাে; তবুও দয়ার মানে মৃত্যুতে স্থির
হয়ে থেকে ভুলে যাওয়া মানুষের সনাতন মন।

হাজার বছর শুধু খেলা করে

হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতাে:
চারিদিকে চিরদিন রাত্রির নিধান;
বালির উপরে জ্যোৎস্না-দেবদারু ছায়া ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মতাে: দ্বারকার,—দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত, ম্লান।
শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের—ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন;
‘মনে আছে?’ সুধাল সে-শুধালাম আমি শুধু ‘বনলতা সেন?’

সুরঞ্জনা

সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছ;
পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন;
কালাে চোখ মেলে ঐ নীলিমা দেখেছ;
গ্রীক হিন্দু ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়ােজন
শুনেছ ফেনিল শব্দে তিলােত্তমা নগরীর গায়ে
কী চেয়েছে? কী পেয়েছে?—গিয়েছে হারায়ে।

বয়স বেড়ে ঢের নরনারীদের;
ঈষৎ নিভেছে সূর্য নক্ষত্রের আলাে;
তবুও সমুদ্র নীল; ঝিনুকের গায়ে আলপনা;
একটি পাখির গান কী রকম ভালাে।
মানুষ কাউকে চায়—তার সেই নিহত উজ্জ্বল
ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনাে সাধনার ফল।

মনে পড়ে কবে এক তারাভরা রাতের বাতাসে
ধর্মাশােকের ছেলে মহেন্দ্রের সাথে
উতরােল বড় সাগরের পথে অন্তিম আকাঙক্ষা নিয়ে প্রাণে
তবুও কাউকে আমি পারিনি বােঝাতে
সেই ইচ্ছা সঙ্ নয় শক্তি নয় কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়,
আরাে আলাে: মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়।

যেন সব অন্ধকার সমুদ্রের ক্লান্ত নাবিকেরা
মক্ষিকার গুঞ্জনের মতাে এক বিহুল বাতাসে
ভূমধ্যসাগরলীন দূর এক সভ্যতার থেকে
আজকের নব সভ্যতায় ফিরে আসে,—
তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রােল
দেহ দিয়ে ভালােবেসে, তবু আজ ভােরের কল্লোল।

মিতভাষণ

তােমার সৌন্দর্য নারি, অতীতের দানের মতন।
ভূমধ্যসাগরের কালাে তরঙ্গের থেকে
ধর্মাশােকের স্পষ্ট আহ্বানের মতাে
আমাদের নিয়ে যায় ডেকে
শান্তির সঙ্রে দিকে—ধর্মে—নির্বাণে;
তােমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে।

অনেক সমুদ্র ঘুরে ক্ষয়ে অন্ধকারে
দেখেছি মণিকা-আলাে হাতে নিয়ে তুমি
সময়ের শতকের মৃত্যু হলে তবু
দাঁড়িয়ে রয়েছ শ্রেয়তর বেলাভূমি:
যা হয়েছে যা হতেছে এখুনি যা হবে
তার স্নিগ্ধ মালতী-সৌরভে।

মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে;
বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথা;
ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সঙ্কল্প স্বপ্নের
উদ্যমের আমূল্য স্পষ্টতা।
তবুও নদী মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলাে
এখনও নারীর মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালাে।

সবিতা

সবিতা, মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি
মনে হয় কোনাে এক বসন্তের রাতে:
ভূমধ্যসাগর ঘিরে যেই সব জাতি,
তাহাদের সাথে
সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন;
মনে পড়ে নিবিড় মেরুন আলাে, মুক্তার শিকারী
রেশম, মদের সার্থবহ,
দুধের মতন শাদা নারী।

অনন্ত রৌদ্রের থেকে তারা
শাশ্বত রাত্রি দিকে তবে
সহসা বিকেলবেলা শেষ হয়ে গেলে
চ’লে যেত কেমন নীরবে।
চারিদিকে ছায়া ঘুম সপ্তর্ষি নক্ষত্র;
মধ্যযুগের অবসান
স্থির ক’রে দিতে গিয়ে ইওরােপ গ্রীস
হতেছে উজ্জ্বল খৃষ্টান।

তবুও অতীত থেকে উঠে এসে তুমি আমি ওরা—
সিন্ধুর রাত্রির জল জানে—
আধেক যেতাম নব পৃথিবীর দিকে;
কেমন অনন্যোপায় হওয়ার আহ্বানে
আমরা আকূল হয়ে উঠে
মানুষকে মানুষের প্রয়াসকে শ্রদ্ধা করা হবে
জেনে তবু পৃথিবীর মৃত সভ্যতায়
যেতাম তাে সাগরের স্নিগ্ধ কলরবে।

এখন অপর আলাে পৃথিবীতে জ্বলে;
কি এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুন!
তােমার নিবিড় কালাে চুলের ভিতরে
কবেকার সমুদ্রের নুন;
তােমার মুখের রেখা আজো।
মৃত কত পৌত্তলিক খৃষ্টান সিন্ধুর
অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগার মতন;
কত আছে—তবু কত দূর।

সুচেতনা

সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাকে
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলােত্তমা হবে;
তবুও তােমার কাছে আমার হৃদয়।

আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রে ঘুরে প্রাণ
পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতাে
ভালােবাসা দিতে গিয়ে তবু,
দেখেছি আমারি হাতে হয়তাে নিহত
ভাই বােন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে;
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।

কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রােদে
দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;
সেই শস্য অগণন মানুষের শব;
শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়
আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়সের মতাে আমাদেরাে প্রাণ
মূক করে রাখে; তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।

সুচেতনা, এই পথে আলাে জ্বেলে—এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মণীষীর কাজ;
এ বাতাস কি পরম সূর্যকরােজ্জ্বল;—
প্রায় তত দূর ভালাে মানব-সমাজ
আমাদের মতাে ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গড়ে দেব, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।

মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,
হলেই ভালাে হত অনুভব ক’রে;
এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভােরে;
দেখেছি যা হ’লাে হবে মানুষের যা হবার নয়—
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।

অঘ্রাণ প্রান্তরে

‘জানি আমি তােমার দু-চোখ আজ আমাকে খোঁজে না
আর পৃথিবীর পরে—’
বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশ্বথপাতা পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে
শুকনাে মিয়ােনাে ছেড়া,—অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;
হেমন্ত এসেছে তবু; বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানাে পাতার
মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে-সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার
ছড়িয়ে পড়েছে জলে,—কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে
হাঁটলামচিল উড়ে চলে গেছে—কুয়াশার প্রান্তরের পথে
দু-একটা সজারুর আসা যাওয়া; উচ্ছ্বল কলার ঝড়ে উড়ে
চুপে সন্ধ্যার বাতাসে
লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে;
আমাদের জীবনের অনেক অতীত ব্যাপ্তি আজো যেন
লেগে আছে বহতা পাখায়
ঐ সব পাখিদের; ঐ সব দূর দূর ধানক্ষেতে ছাতকুড়ােমাখা
ক্লান্ত জামের শাখায়;
নীলচে ঘাসের ফুলে ফড়িঙের হৃদয়ের মতাে নীরবতা
ছড়িয়ে রয়েছে এই প্রান্তরের বুকে আজ…হেঁটে চলি…আজ কোনাে কথা
নেই আর আমাদের; মাঠের কিনারে ঢের ঝরা ঝাউফল
পড়ে আছে; শান্ত চোখে তার বিকেলের মতন অতল
কিছু আছে; খড়কুটো উড়ে এসে লেগে আছে শাড়ির ভিতরে,
সজনে পাতার গুড়ি চুলে বেধে গিয়ে নড়ে চড়ে;
পতঙ্গ পালক জল—চারিদিকে সূর্যের উজ্জ্বলতা নাশ;

আলেয়ার মতাে ঐ ধানগুলাে নড়ে শূন্যে কি রকম অবাধ আকাশ
হয়ে যায়; সময়ও অপার—তাকে প্রেম আশা চেতনার কণা
ধরে আছে বলে সে-ও সনাতন;—কিন্তু এই ব্যর্থ ধারণা
সরিয়ে মেয়েটি তার আঁচলের চোরকাঁটা বেছে
প্রান্তর নক্ষত্র নদী আকাশের থেকে স’রে গেছে।
যেই স্পষ্ট নির্লিপ্তিতে—তাইই ঠিক, —ওখানে স্নিগ্ধ হয় সব।
অপ্রেমে বা প্রেমে নয়—নিখিলের বৃক্ষ নিজ বিকাশে নীরব।

পথহাঁটা

কি এক ইশারা যেন মনে রেখে একা একা শহরের পথ থেকে পথে
অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে;
তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে:

সারারাত গ্যাসলাইট আপনার কাজ বুঝে ভালাে করে জ্বলে।
কেউ ভুল করে নাকো—ইট বাড়ি সাইনবাের্ড জানালা কপাট ছাদ সব
চুপ হ’য়ে ঘুমাবার প্রয়ােজন বােধ করে আকাশের তলে।

একা একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;
তখন অনেক রাত-তখন অনেক তারা মনুমেণ্ট মিনারের মাথা
নির্জনে ঘিরেছে এসে,—মনে হয় কোনােদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব

আর কিছু দেখেছি কি: একরাশ তারা-আর-মনুমেণ্ট-ভরা কলকাতা?
চোখ নিচে নেমে যায়—চুরুট নীরবে জ্বলে—বাতাসে অনেক ধুলাে খড়;
চোখ বুজে একপাশে সরে যাই—গাছ থেকে অনেক বাদামী জীর্ণপাতা

উড়ে গেছে; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর
কেন যেন: আজো আমি জানিনাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর।

হাজার বছর তুমি

আজ বিকেলের ধূসর আলােয়
তােমার সাথে দেখা
এতটা দিন পথ চলেছি—শেষে
কালাে মেঘের কেয়াবনের জলহিজলের দেশে
আমি তােমার পাত শিশির
হাতের তুলির রেখা

বেতের ফলের মতন আমার স্নান
চোখের তুমি হাজার বছর র’য়ে গেছ, আহা
সময় তােমার হাড়ের স্রোতে লেখা
সকল দারা-সুতের শিয়র ছেড়ে আমি একা

আকাশ আলাে পাহাড় শিশির
সে কত পৃথিবীর
তােমাকে শেখা যে কত রমণীর
সে কত রজনীর
আঁধার অবচেতন থেকে শেখা।

ভালােবেসেছিলাম

কাউকে ভালােবেসেছিলাম জানি
তবুও ভালােবাসা,
দুপুরবেলার সূর্যে ভােরের
শিশির নেমে আসা,
ভােরের দিকে হৃদয় ফেরাই
যাই চ’লে যাই—
নীল সকালে যাই চ’লে যাই—
একটি নদী একটি অরুণ
শিউলি শিশির পাখি—
‘আমরা মায়ার মনের জিনিস
মায়াবিনীর বেলায় শুধু জাগি’
বলছে সে কোন্ ত্রিকোণ থেকে
ছায়ার পরিভাষা।
কাউকে ভালােবেসেছিলাম, জানি,
তবুও ভালােবাসা।
সে কোন্ সুদূর মরুর মনে চলে গেছ।
হায়, যাযাবর তুমি
সেইখানে কি মিলবে বনহংসী বাঁধা বাসা!

হায় বলিভুক্, কখন ভেবেছিলে
মাটি ছেড়ে দূর আকাশের নীলে
ধূসর ডানার অগ্নি ছেড়ে দিলে
মিটে যাবে মায়াময়ী মাটির পিপাসা।

হে প্রেম

(তোমার সাথে আমার ভালােবাসা
চলাে কেবল সুমুখপানে চলা
সূর্যডানায়—ঈগল পুরুষ জুলাে
সময়সাগর শুকিয়ে গেলে,সেই সােনালি বালির
মরুভূমির সঙ্গে কথা বলা)
তােমার সাথে এই তাে ভালােবাসা
নরনারীর অঙ্গ প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদলে আমার প্রেম
হে মীনকেতন, তােমার নারী ভালাে—ভালাে
দিকের থেকে দিগন্তের এই তাে আমি-এলাম।
হে প্রেম, তুমি গৃহবলিভুকের শান্ত কাতর ডানা ধ’রে
মহান যাযাবরের নিজের সূর্যে ফিরে আসা
হে মীনকেতন, তােমার নারী অমর জানি (আমি),
অমরতর (তবুও) আরও বলয় আকাশ আরও
আলাের পিপাসা—

তুমি আমি

ভােরের বেলায় তুমি আমি—
নীল আকাশের ভরতপাখির গানে
কবে যে এই ধুলােমাটির পৃথিবীতে
প্রথম দেখেছিলাম
কেন এসেছিলাম এ সব আলাের অভিযানে
আজকে আবার সকালে এসে সেই কথা কি তুমি
পাখির গানের আলাের সিঁড়ি-সূর্যে উঠে ভাবাে
(এই সৃষ্টির) অলখ আলাের থেকে এসেছিলাম
আবার কবে আলােয় মিশে যাব
অন্ধকারের এ ছাড়া কি নেইকো কোনাে মানে?
ইতিহাসে ভাইয়ের-বুকে-ভাই
গল্প ছবি প্রেম—কি শুধু জ্বলন্ত মিথ্যাই
সকই ছাই করে দিয়ে আঁধার সসম্মানে
বসেছে কি তােমার আমার—
ভােরের সাগরকণ্ঠী পাখির গানে?

হয়তাে বা তাই হবে—তবু আজকে আলােয় আমি
এই পৃথিবীর প্রথম ভােরের
সূর্য পাখি নারী
দেখে কি আর আদিম আঁধার ভেবে নিতে পারি
যদিও গহিন থেকে এলাম—গহন আমায় টানে।

আলাে নদীর স্মরণে

ধ্বনি পাখির আলাে নদীর স্মরণে এসেছি।
আবার তুমি আমি
ভেবেছিলাম আমরা দুজন
মিশরীয় মামি
ঘুমিয়ে আছি সকাল বিকাল
ভােরের হাওয়া সবুজ পাতার নড়া
আমলকীডাল শাল
রুপালি বৃষ্টি পড়া
হয়ে গিয়েছিলাম তুমি আমি।

আমরা কত নগরী হাটে জ্বলে
রক্ত আগুন আবছা অবক্ষয়ে
অসময়ের অন্ধকারে মরেছি বারবার
তবুও আলাে সাহস প্রাণ চেয়েছি হৃদয়ে
দূর ইতিহাসযানী।

কোথাও নীড় বেঁধেছিলাম
ভেঙে গেলে কেঁদেছিলাম
ফেনার শীর্ষে হেসেছিলাম
জীবন ভালােবেসেছিলাম
আলাে—আরও আলাের প্রায়াণী।

আজকে মানুষ চলে গেলে তবু
মানব র’য়ে যাবে,
পাতা শিশির ইতিহাসের বেলা
হয়ে যাবে গভীরতরভাবে
নরনারীর নিজের রাজধানী।

মকরসংক্রান্তি প্রাণে

মকরসংক্রান্তি প্রাণে
তুমি আমার মনে এলে।
বালুঘড়ি বিকল রাতের বেলা।
থেকে-থেকে পড়ছে মনে
সে কোন্ ধূসর বেবিলনে
কবের গ্রীসের অলিভবনে
তােমার সাথে সূর্যতীরে।
হয়েছিল খেলা।

জানি সবই ফুরিয়ে গেল অতল সনাতনে
থেকে-থেকে তাবা নদীর জলের উৎসারণে
জলদেবীর মতন জেগে জানিয়ে গেছ তুমি
চম্বা কনকবতী এখন সুধার মরুভূমি
মরুভূমি—মরীচিকা—মায়ামৃগের মেলা।

তবুও আবার সূর্য নিয়ে এক রজনী
আমার—তােমার—আধুনিকের
শতঘ্নী আঘাত
জননটের মতন নেচে-কবে
কী হারাল সে কার মনে রবে
তােমার—আমার—
সে কার অবহেলা।

অন্ধকারে

অন্ধকারে থেকে-থেকে হাওয়ার আঘাত মাঠের ওপর দিয়ে
স্মরণ করায় আজকে কারা মৃত;
তাদের স্মৃতিবার্ষিকী আজ নদী পাথর ঘাস পৃথিবীর মনে
ধীরে ধীরে হতেছে বিবৃত।
এ সুর ভালাে;—পৃথিবীতে তবুও এক প্রেম রয়েছে তার
সুসমাচার ছায়াপথের নক্ষত্রদের মতাে,
নারী ও তার পুরুষ নিয়ে,—ইতিহাসের রাত্রি নিভিয়ে,
আকাশ-আশার শীর্ষে ওরা হয় না আহত।

তবু আঁধার চুপে চুপে সকলই গ্রাস করে ফেলে, নারি,
সে শীত শুধু সেণ্টিগ্রেডের নয়;
সে অন্তিমতা সে শূন্যতা কে জানে কোন্ অর্থপ্রবীণ সময়প্রকৃতির:
তুমি জান, তােমার মুখে তাকিয়ে মনে হয়।
প্রকৃতি তখন তােমার নাভির ভিতরে আমি লীন
হয়ে আছি দেখে
অন্তবিহীন অন্ধকারের জন্মদান করে
অমৃতযােগ অন্ধকারের থেকে।

সূর্যে অনেক কাজ হয়েছে সারাটা দিন; অনেক প্রেম-জীবনজয় আলাের প্রেরণা
বধ করেছি। সুদীর্ঘকাল জেগে
অনেক শনি শেয়াল শকুন জ্যোতির্ময় ঘােষণা করা গেছে।
আবার সকল মুছে ফেলে বিঘূর্ণনের বেগে
যযাতিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়ে গেছে জীবনরাজ্য থেকে।
অসূয়া অসারতা দ্বিধা ঘুচিয়ে নতুন দিন
জাগাতে চেয়ে নানা স্কুলের গণনাহীন ক্যাম্প খুলেছে যারা—
তাদের হয়ে ত্রিশঙ্কুকে বিঁধিয়েছি বডকিন।

দেখে গেছি শতাব্দীময় রক্তনদীরাশির দুরত্যয়
আত্মপ্রসাদ ভেঙে দিতে প্রাণের নদী এসে
পড়ি-পড়ি করে নিখিল আত্মীয়তায় পড়ল ঝ’রে প্রায়;
দেখে গেছি করুণ ইতিহাসকে ভালােবেসে
আসি-আসি করে প্রাণের সাহস সূর্য সকাল এল প্রায়;
কিছুই তবু এলনাকো;—সময়কে যা দেবার সবই দিয়ে
কোটি আলােকবর্ষ পরে আকাশ, তােমার মনের কথা আজ
পেয়েছি অনাথ আমার সুদর্শনাকে বুকে নিয়ে।

অমৃতযােগ

জন্মেছিল—চেয়েছিল—ভালােবেসেছিল
কম বেশি প্রাণকল্যাণে
মানুষ এ পৃথিবীর মানুষকে; তবু
মৃত্যুরই পূর্ণতর মানে।

তাহলে সময় আজ তুমি।
সময়সিন্ধুর মতাে রূপে
এখানে শিশির থেমে আছে
ঘাসের বুকের ’পরে চুপে।

আমিও অনেক শূন্য অনুশীলনের
ধাঁধার ভিতর থেকে উঠে
হংসের ডানার মতো আজ
নীড়ের হংসীর পক্ষপুটে।

এখানে মরণশীল হংস নেই আর;
আর পাখপাখালির নীড় নেই গাছে;
এখানে পৃথিবী নেই, সৃষ্টি নেই, তুমি
আমি আর অনন্ত রাত্রির বৃক্ষ আছে।

হৃদয় তুমি

হৃদয় তুমি সেই নারীকে ভালােবাস তাই
আকাশের ঐ অগ্নিবলয় ভােরের বেলা এসে
প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে অমেয় কাল হৃদয়সূর্য হবে
তােমার চেয়েও বেশি সেই নারীকে ভালােবেসে।
বাসুক—তবু সবের চেয়ে আলাের কথা এই:
আমি তাকে সময়পরিক্রমার পথে আবছায়াতে দেখে
নিজের মূল্যে রয়ে গেছে বলেই ভালােবাসি।
শরীর ঘেঁষে ভালােবাসে তবু তাে অনেকে।

কাজ-অকাজের ঠাসবুনােনির ফাঁকের থেকে আমি
দেখেছি আমায়, দেখেছি যেন বিকেলবেলার জলে
থমকে ভাসা মেঘের মতাে নীলাকাশের পথে
থেমে আছে; অথবা থেমে চলে
জানি না মেঘ; ভালােবেসে অথবা কৌতুহলে
জানি না নারীসূর্য আমায় অলােকিত করে
নিজের অস্তকক্ষে নেমে সূর্যপ্রক্রিয়ায়
চলে গেছে ভিতরে।

যে যার নিজের বিহিত কাজে। সকলই ঠিক-এইরকমভাবে
সারাটি দিন আমার হৃদয় ব্যাপ্ত করে রাখে।
স্বতই আমি যে গাল তিল যে হাত ভালােবাসি
রাত্রি হলে সে হাত—সেই সুদূর হাত এখনও আমাকে
জানি না বিশ্বশৃঙ্খলাকে আঘাত করে ভালােবাসে কিনা;
সীমা সময় প্রকৃতি তাতে চূর্ণ হয়ে যেত;
সকলই তবু স্থির রয়েছে—এই স্থিরতা তবু
তােমার আমার অজাত সব শিশুরও অভিপ্রেত।

নদী নক্ষত্র মানুষ

এখানে জলের পাশে বসবে কি? জলঝিরি এ নদীর নাম;
অপরূপ; আমি তবু ঝাউবনী বলি একে—আস্তে বললাম।
নদীর দুপারে ঢের উচু উঁচু ঝাউবন, নীড়—
চুপচাপ ঘাসের ওপরে বসে কিছুক্ষণ তারপরে আমরা দুজনে
কোনাে কথা খুঁজে তবু পেলাম না আর যেন—
নদী যেন ঢের দূরে—আমাদের মনে
এ মুহূর্ত এ আকাশ নেই আর আজ;
বিষন্নতা: তাও নেই—পাতা ঝরবার
স্বর শুনি, ঢেউ নড়বার শব্দ পাই;
এই পৃথিবীতে যেন কিছু নেই আর।

একদিন—জানি আমি সম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষা ছিল আমাদের মনে;
‘নক্ষত্রের নিচে শিশিরের গল্প শােনায়েছি শুনেছি দুজনে
চোখাচোখি বসে থেকে; হাতে হাত নিশ্বাসে নিশ্বাস
জানতে মিশে গেছে—যেমন মাটির গন্ধ হৃদয়ে ফোটাতে চায়, ঘাস,
ধান খই দূর্বাঘাসে যেমন মাটির ইচ্ছা নিজেকে রাখতে চায় ঢেকে
একদিন পৃথিবীর বিলােড়ন রৌদ্র রক্ত আহ্বানের থেকে
দূরে সরে প্রেম আর আকঙক্ষার ঘরে বসে আমাদের ব্যাপৃত হৃদয়
আকাশ ও এ মাটিকে পেয়েছিল এক তিলে—’ বললাম; আস্তে তখন
সে বললে’ শেষ সত্য নদী নয়,—মন—’

আমি তাকে: ‘হয়তাে নতুন কোনাে রূপে
আমাদের ভালােবাসা পথ কেটে নেবে এই পৃথিবীতে;—
আমরা দুজনে এই বসে আছি আজ—ইচ্ছাহীন;—
শালিক পায়রা মেঘ পড়বেলার এই দিন
চারিদিকে;
এখানে গাছের পাতা যেতেছে হলুদ হয়ে—নিঃশব্দে উল্কার মতাে ঝ’রে
একদিন তুমি এসে তবু এই হলুদ আঁচল রেখে ঘাসের ভিতরে
শান্তি পাবে; সন্ধ্যার জলের দিকে শূন্য চোখে রবেনাকো তাকিয়ে এমন
অস্পষ্ট সংকটে এসে—মুখে কথা ফুরােবে না—এখন যা গভীর গােপন
প্রাণের চারুণা পাবে অন্ধকারে; ব্যাপ্তি পাবে; যেইসব কথা
ভুলে গেছ—যে নিয়ম অনুভূতি কবেকার সহজ স্পষ্টতা
হারিয়েছে-নতুন জীবন পাবে তারা সব—’ ব’লে মনে হল কোলাহল
মানুষের শােচনার শব্দ যেন;নদীদের অন্ধকার জল
জীবনকৈ স্থিরভাবে ব্যবহার করে নিতে বলে
প্রেমের নিকটে গিয়ে—কিন্তু অপ্রেমের ফলাফলে
নিজের জ্ঞানের গতির প্রবাহ থেকে চ্যুত হতে হয়:
যে রকম এই নদী আর এই নারী নিজ বাস্তবতা নিয়ে তন্ময়।

সে

আমাকে সে নিয়েছিল ডেকে:
বলেছিল: ‘এ নদীর জল
তােমার চোখের মতাে ম্লান বেতফল
সব ক্লান্তি বিহুলতা থেকে
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি
এই নদী তুমি।’

‘এর নাম ধানসিড়ি বুঝি?’
মাছরাঙাদের বললাম;
গম্ভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিল নাম।
আজও আমি মেয়েটিকে খুঁজি;
জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে
কোথায় যে চ’লে গেছে মেয়ে।

সময়ের অবিরল শাদা আর কালাে
বুনােনির ফাক থেকে এসে
মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালােবেসে
ঢের আগে নারী এক-তবু চোখ-ঝলসানাে আলাে
ভালােবেসে যােলাে-আনা নাগরিক যদি
হয়ে বরং হ’তাে ধানসিড়ি নদী।

তােমাকে

ভেবেছিলাম এ কথা স্থির মেনে নিতে পারি:
নিউট্র ও ইলেকট্রনের অন্ধ সাগরে
ওদেরই জাদুবলে তুমি হয়েছ আজ নারী;
ওদেরই দয়ার ফলে আমি প্রেমিক তােমার তরে।

তবুও এ ভুল হৃদয়ঙ্গম—মহাসৃষ্টির মানে
হয়তাে ঠিক এমনভাবে উৎসারিত নয়।
তা যদি হতাে তবে যেদিন নিজেরই পরামর্শে সজ্ঞানে
আমাকে তুমি দিয়েছিলে অব্যর্থ হৃদয়
সে স্বাদ হয়ে যেত কি আজ হেমন্তে আবার ক্ষয়।
শীতের পড়ি-পড়ি বেলায় ফসল কেটে নিচ্ছে চাষা ঘরে;
নদী বুকে প্রকৃতি জল রেখেছে, তবু রক্তের উদয়
এসে সবই আচ্ছাদিত করে।

আজ শতকে মানুষ নারী শূন্য হ’তে এসে
চলেছে শূন্যে—আঁধার থেকে অপরিসীম আরও
অন্ধকারের ভেতরে গিয়ে মেশে।
এছাড়া কোনাে সত্য নেই—উপায় নেই কারও।

এরই ভেতর অন্য এক গভীরত্র নিরুপয়তা আছে;
মানুষ ও তার চিরস্থায়ী মানবছায়া ছাড়া
জানে না কেউ; প্রলম্বিত নীল আকাশের কাছে।
কোনােদিনও পৌছােবে না সাড়া।

তবু সবই ঠিক হয়েছে; কবের আদি পৃথিবী থেকে তুমি
কত গ্লানি রক্ত আঁধার বিহুলতার থেকে
চলেছ আজও তিলধারণের মতন পটভূমি
দান না করে নিজেরই গালে সে তিলবিন্দু রেখে।

কার্তিকের ভােরে:১৩৪০

কার্তিকের ভােরবেলা কবে
চোখে মুখে চুলের ওপরে
যে শিশির ঝরল তা
শালিক ঝরাল ব’লে ঝরে

আমলকী গাছ ছুঁয়ে তিনটি শালিক
কার্তিকের রােদে আর জলে
আমারই হৃদয় দিয়ে চেনা তিন নারীর মতন;
সূর্য? না কি সূর্যের চপ্পলে

পা গলিয়ে পৃথিবীতে এসে
পৃথিবীর থেকে উড়ে যায়
এ জীবনে ঢের শালিক দেখেছি
তবু সেই তিনজন শালিক কোথায়।

তােমায় আমি দেখেছিলাম

তােমায় অমি দেখেছিলাম ঢের
শাদা কালাে রঙের সাগরের
কিনারে এক দেশে
রাতের শেষে—দিনের বেলার শেষে।

এখন তােমায় দেখি না তবু আর
সাতটি সাগর তেরাে নদীর পার
যেখানে আছে পাঁচটি মরুভূমি
তার ওপারে গেছ কি চলে তুমি
ঘাসের শান্তি শিশির ভালােবেসে!

বটের পাতায় কে কার নাম লিখে
(গভীরভাবে) ভালােবেসেছিল সে নামটিকে
হরির নাম নয় সে আমি জানি,
জল ভাসে আর সময় ভাসে—বটের পাতাখানি
আর সে নারী কোথায় গেছে ভেসে।

আবহমান

পৃথিবী এখন ক্রমে হতেছে নিঝুম।
সকলেরই চোখ ক্রমে বিজড়িত হ’য়ে যেন আসে;
যদিও আকাশ সিন্ধু ভ’রে গেল অগ্নির উল্লাসে;
যেমন যখন বিকেলবেলা কাটা হয় খেতের গোধূম
চিলের কান্নার মতো শব্দ ক’রে মেঠো ইঁদুরের ভিড় ফসলের ঘুম

গাঢ় ক’রে দিয়ে যায়। —এইবার কুয়াশায় যাত্রা সকলের।
সমুদ্রের রোল থেকে একটি আবেগ নিয়ে কেউ
নদীর তরঙ্গে— ক্রমে— তুষারের স্তূপে তার ঢেউ

একবার টের পাবে— দ্বিতীয় বারের
সময় আসার আগে নিজেকেই পাবে না সে টের

এইখানে সময়কে যতদূর দেখা যায় চোখে
নির্জন খেতের দিকে চেয়ে দেখি দাঁড়ায়েছে অভিভূত চাষা;
এখনো চালাতে আছে পৃথিবীর প্রথম তামাশা
সকল সময় পান ক’রে ফেলে জলের মতন এক ঢোঁকে;
অঘ্রাণের বিকেলের কমলা আলোকে
নিড়ানো খেতের কাজ ক’রে যায় ধীরে;
একটি পাখির মতো ডিনামাইটের ’পরে ব’সে।
পৃথিবীর মহত্তর অভিজ্ঞতা নিজের মনের মুদ্রাদোষে
নষ্ট হ’য়ে খ’সে যায় চারিদিকে আমিষ তিমিরে;
সোনালি সূর্যের সাথে মিশে গিয়ে মানুষটা আছে পিছু ফিরে।

ভোরের স্ফটিক রৌদ্রে নগরী মলিন হ’য়ে আসে।
মানুষের উৎসাহের কাছ থেকে শুরু হ’লো মানুষের বৃত্তি আদায়।
যদি কেউ কানাকড়ি দিতে পারে বুকের উপরে হাত রেখে
তবে সে প্রেতের মতো ভেসে গিয়ে সিংহদরজায়
আঘাত হানিতে গিয়ে মিশে যায় অন্ধকার বিম্বের মতন।
অভিভূত হ’য়ে আছে— চেয়ে দ্যাখো— বেদনার নিজের নিয়ম।

নেউলধূসর নদী আপনার কাজ বুঝে প্রবাহিত হয়;
জলপাই-অরণ্যের ওই পারে পাহাড়ের মেধাবী নীলিমা;
ওই দিকে সৃষ্টি যেন উষ্ণ স্থির প্রেমের বিষয়;
প্রিয়ের হাতের মতো লেগে আছে ঘড়ির সময় ভুলে গিয়ে
আকাশের প্রসারিত হাতের ভিতরে।

সেই আদি অরণির যুগ থেকে শুরু ক’রে আজ
অনেক মনীষা, প্রেম, নিমীল ফসলরাশি ঘরে

এসে গেছে মানুষের বেদনা ও সংবেদনাময়।
পৃথিবীর রাজপথে— রক্তপথে— অন্ধকার অববাহিকায়
এখনো মানুষ তবু খোঁড়া ঠ্যাঙে তৈমুরের মতো বার হয়।
তাহার পায়ের নিচে তৃণের নিকটে তৃণ মূক অপেক্ষায়;
তাহার মাথার ’পরে সূর্য, স্বাতী, সরমার ভিড়;
এদের নৃত্যের রোলে অবহিত হ’য়ে থেকে ক্রমে একদিন
কবে তার ক্ষুদ্র হেমন্তের বেলা হবে নিসর্গের চেয়েও প্রবীণ?

চেয়েছে মাটির দিকে— ভূগর্ভে তেলের দিকে
সমস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অবিরল যারা,
মাথার উপরে চেয়ে দেখেছে এবার;
দূরবীনে কিমাকার সিংহের সাড়া
পাওয়া যায় শরতের নির্মেঘ রাতে।
বুকের উপরে হাত রেখে দেয় তা’রা।
যদিও গিয়েছে ঢের ক্যারাভান ম’রে,
মশালের কেরোসিনে মানুষেরা অনেক পাহারা
দিয়ে গেছে তেল, সোনা, কয়লা ও রমণীকে চেয়ে;
চিরদিন এই সব হৃদয় ও রুধিরের ধারা।
মাটিও আশ্চর্য সত্য। ডান হাত অন্ধকারে ফেলে
নক্ষত্রও প্রামাণিক; পরলোক রেখেছে সে জ্বেলে;
অনৃত সে আমাদের মৃত্যুকে ছাড়া।


মোমের আলোয় আজ গ্রন্থের কাছে ব’সে— অথবা ভোরের বেলা নদীর ভিতরে
আমরা যতটা দূর চ’লে যাই— চেয়ে দেখি আরো-কিছু আছে তারপরে।
অনির্দিষ্ট আকাশের পানে উড়ে হরিয়াল আমারো বিবরে
ছায়া ফেলে। ঘুরোনো সিঁড়ির পথ বেয়ে যারা উঠে যায় ধবল মিনারে,
কিংবা যারা ঘুমন্তের মতো জেগে পায়চারি করে সিংহদ্বারে,
অথবা যে-সব থাম সমীচীন মিস্ত্রির হাত থেকে উঠে গেছে বিদ্যুতের তারে,
তাহারা ছবির মতো পরিতৃপ্ত বিবেকের রেখায় রয়েছে অনিমেষ।

হয়তো অনেক এগিয়ে তা’রা দেখে গেছে মানুষের পরম আয়ুর পারে শেষ
জলের রঙের মতো স্বচ্ছ রোদে একটিও বোল্‌তার নেই অবলেশ।

তাই তা’রা লোষ্ট্রের মতন স্তব্ধ। আমাদেরো জীবনের লিপ্ত অভিধানে
বৰ্জাইস অক্ষরে লেখা আছে অন্ধকার দলিলের মানে।
সৃষ্টির ভিতরে তবু কিছুই সুদীর্ঘতম নয়— এই জ্ঞানে
লোকসানী বাজারের বাক্সের আতাফল মারীগুটিকার মতো পেকে
নিজের বীজের তরে জোর ক’রে সূর্যকে নিয়ে আসে ডেকে।
অকৃত্রিম নীল আলো খেলা করে ঢের আগে মৃত প্রেমিকের শব থেকে।

একটি আলোক নিয়ে ব’সে থাকা চিরদিন;
নদীর জলের মতো স্বচ্ছ এক প্রত্যাশাকে নিয়ে;
সে-সবের দিন শেষ হ’য়ে গেছে
এখন সৃষ্টির মনে— অথবা মনীষীদের প্রাণের ভিতরে।
সৃষ্টি আমাদের শত শতাব্দীর সাথে ওঠে বেড়ে।
একদিন ছিলো যাহা অরণ্যের রোদে— বালুচরে,
সে আজ নিজেকে চেনে মানুষের হৃদয়ের প্রতিভাকে নেড়ে।
আমরা জটিল ঢের হ’য়ে গেছি— বহুদিন পুরাতন গ্রহে বেঁচে থেকে।
যদি কেউ বলে এসে: ‘এই সেই নারী,
একে তুমি চেয়েছিলে; এই সেই বিশুদ্ধ সমাজ—’
তবুও দর্পণে অগ্নি দেখে কবে ফুরায়ে গিয়েছে কার কাজ?

আমাদের মৃত্যু নেই আজ আর,
যদিও অনেক মৃত্যুপরম্পরা ছিলো ইতিহাসে;
বিস্তৃত প্রাসাদে তারা দেয়ালের অব্‌লঙ ছবি;
নানারূপ ক্ষতি ক্ষয়ে নানা দিকে ম’রে গেছি— মনে পড়ে বটে
এই সব ছবি দেখে; বন্দীর মতন তবু নিস্তব্ধ পটে
নেই কোনো দেবদত্ত, উদয়ন, চিত্রসেনী স্থানু।
এক দরজায় ঢুকে বহিষ্কৃত হ’য়ে গেছে অন্য এক দুয়ারের দিকে
অমেয় আলোয় হেঁটে তা’রা সব।

(আমাদের পূর্বপুরুষেরা কোন্ বাতাসের শব্দ শুনেছিলো;
তারপর হয়েছিলো পাথরের মতন নীরব?)
আমাদের মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
কাচের গেলাসে জলে উজ্জ্বল শফরী;
সমুদ্রের দিবারৌদ্রে আরক্তিম হাঙরের মতো;
তারপর অন্য গ্রহ নক্ষত্রেরা আমাদের ঘড়ির ভিতরে
যা হয়েছে, যা হতেছে, অথবা যা হবে সব এক সাথে প্রচারিত করে।
সৃষ্টির নাড়ীর ’পরে হাত রেখে টের পাওয়া যায়
অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে র’য়ে গেছে অমোঘ আমোদ;
তবু তা’রা করেনাকো পরস্পরের ঋণশোধ।

আরো পড়ুন: জীবনানন্দ দাশের ১০০ টি উক্তি

raateralo.com

Leave a Comment