Best Poems by Birendra Chattopadhyay: বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা কবি। তার কবিতায় ভাষিত হয়েছে সমগ্র দুনিয়ার প্রতারিত মানুষের বেদনা, মানবতা-বিরোধী ঘটনার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ তীব্র-প্রতিবাদ। অন্যদিকে রোমান্টিকের মতো সমাজ জীবনের সুন্দর স্বপ্নকে শেষমুহূর্ত পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন।
Best Poems by Birendra Chattopadhyay 2024 l বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা
Table of Contents
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতা l Best Poems by Birendra Chattopadhyay 2024 l
আমার ভারতবর্ষ
আমার ভারতবর্ষ
পঞ্চাশ কোটি নগ্ন মানুষের
যারা সারাদিন রৌদ্রে খাটে, সারারাত ঘুমুতে পারে না
ক্ষুধার জ্বালায়, শীতে ;
কত রাজা আসে যায়, ইতিহাসে ঈর্ষা আর দ্বেষ
আকাশ বিষাক্ত করে
জল কালো করে, বাতাস ধোঁয়ায় কুয়াশায়
ক্রমে অন্ধকার হয় ।
চারদিকে ষড়যন্ত্র, চারদিকে লোভীর প্রলাপ
যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ আসে পরস্পরের মুখে চুমু খেতে খেতে
মাটি কাঁপে সাপের ছোবলে, বাঘের থাবায় ;
আমার ভারতবর্ষ চেনে না তাদের
মানে না তাদের পরোয়ানা ;
তার সন্তানেরা ক্ষুধার জ্বালায়
শীতে চারিদিকের প্রচণ্ড মারের মধ্যে
আজও ঈশ্বরের শিশু, পরস্পরের সহোদর ।
রুটি দাও
হোক পোড়া বাসি ভ্যাজাল মেশানো রুটি
তবু তো জঠরে, বহ্নি নেবানো খাঁটি
এ এক মন্ত্র ! রুটি দাও, রুটি দাও ;
বদলে বন্ধু যা ইচ্ছে নিয়ে যাও :
সমরখণ্ড বা বোখারা তুচ্ছ কথা
হেসে দিতে পারি স্বদেশেরও স্বাধীনতা ।
শুধু দুই বেলা দু’টুকড়ো পোড়া রুটি
পাই যদি তবে সূর্যেরও আগে উঠি,
ঝড়ো সাগরের ঝুটি ধরে দিই নাড়া
উপড়িয়ে আনি কারাকোরামের চূড়া :
হৃদয় বিষাদ চেতনা তুচ্ছ গণি
রুটি পেলে দিই প্রিয়ার চোখের মণি ।
চিড়িয়াখানা
কোলা ব্যাঙের ছা
কথা বলেন না
কথা বললে ভাঙবে ধ্যান
তিনি শুধুই ভাষণ দ্যান
জাগুয়ার
খাবেন না সাগু আর
রোজই বলেন মেজদিকে
খাবেন তিনি শেঠজিকে
রাত দুপুরে তিনটে বানর,
কেবল বলে, “পকেটে পোর ।”
“কাকে রে কাকে ?”
—“সূর্যটাকে ।”
ভোট দিও না হাতিকে,
ভোট দিও তার নাতিকে ।
ভোট দিও না গাধাকে,
ভোট দিও তার দাদাকে ।
ক্রোধ যা অগ্নির মতো
ক্রোধ যা অগ্নির মতো
আমাকে দিও না আর
ঘৃণা যা অগ্নিতে ঘৃত
আমাকে দিও না আর ।
আমার যজ্ঞের ঘোড়া
নিয়ে যাক যুবকেরা
বাঘের সাহস চোখে
আগুনে হাঁটুক তারা ।
আমার বয়স গেছে
আমার সাহস গেছে
যে প্রেম অপ্রেমে জ্বলে
সে আমাকে ছেড়ে গেছে ।
আমার পৃথিবী থেকে
যুবকেরা চলে গেছে
যেখানে জীবন আছে
যেখানে কবিতা আছে…
Best Poems by Birendra Chattopadhyay 2024 l
এই নরকে
কবিরা কোথায় আজ? উত্তরার জলসা-ঘরে এখনো কি নাচ সেখায় তারা?
এদিকে যে শমীবৃক্ষে মন্ত্রপড়া অস্ত্রগুলি কীচকের বাড়ায় আহ্লাদ!
শুনি পাড়ায় পাড়ায় জল্লাদের আস্ফালন ; দেখি ঘরে ঘরে
নরখাদকের রক্তমাখা থাবা, পিশাচের মার…
কবিরা কোথায় আজ? সবাই কি দুর্যোধনের কেনা,
নাকি বিরাট রাজার কৃতদাস ।
আমার সন্তান যাক প্রত্যহ নরকে
আমার সন্তান যাক প্রত্যহ নরকে
ছিঁড়ুক সর্বাঙ্গ তার ভাড়াটে জল্লাদ ;
উপড়ে নিক চক্ষু, জিহ্বা দিবা-দ্বিপ্রহরে
নিশাচর শ্বাপদেরা ; করুক আহ্লাদ
তার শৃঙ্খলিত ছিন্নভিন্ন হাত-পা নিয়ে
শকুনেরা । কতটুকু আসে-যায় তাতে
আমার, যে-আমি করি প্রত্যহ প্রার্থনা,
“তোমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে ।”
যে-আমি তোমার দাস ; কানাকড়ি দিয়ে
কিনেছ আমাকে রাণী, বেঁধেছ শৃঙ্খলে
আমার বিবেক, লজ্জা ; যে-আমি বাংলার
নেতা, কবি, সাংবাদিক, রাত গভীর হ’লে
গোপনে নিজের সন্তানের ছিন্ন শির
ভেট দিই দিল্লীকে ; গঙ্গাজলে হাত ধুয়ে
ভোরবেলা বুক চাপড়ে কেঁদে উঠি, “হায়,
আত্মঘাতী শিশুগুলি রক্তে আছে শুয়ে!”
আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে আশ্চর্য চুমায়
তোমারই দাক্ষিণ্য, রাণী দিয়েছ নিভৃতে ;
এবার পাঠিয়ে দাও প্রকাশ্যে ঘাতক,
বাগানে যে-ক’টি ফুল আছে ছিঁড়ে নিতে ।
প্রত্যেক কাগজে আমি লিখবো ফুলের
ভেতর পোকার নিন্দা, খুনীর বাহবা
প্রত্যহ বাংলার শিশু-গোলাপ ক’টির
সর্বনাশে সরগরম করবো আমি সভা ।
আমার সন্তান যাক প্রত্যহ নরকে
ছিঁড়ুক সর্বাঙ্গ তার ভাড়াটে জল্লাদ ;
উপড়ে নিক চক্ষু, জিহ্বা দিবা-দ্বিপ্রহরে
নিশাচর শ্বাপদেরা ; করুক আহ্লাদ
তার শৃঙ্খলিত ছিন্নভিন্ন হাত-পা নিয়ে
শকুনেরা । কতটুকু আসে-যায় তাতে
আমার, যে-আমি করি প্রত্যহ প্রার্থনা,
“তোমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে ।”
আকাল
সারাবছর অমাবস্যা, সারাবছর
“নেই বৃষ্টি”-র অন্ধকার
এ কোন্ বসুন্ধরা আমার, শোনাস্
বারমাস্যা মাটির হা—হা!
গাঁয়ের মানুষ মাঠে যায় না, শুকনো কুয়ো
জল দেয় না— সারা বছর
হাতের মুঠোয় কান্না ছাড়া আর কিছু নেই ;
সন্ধ্যাবাতি না জ্বলতেই রাজ্যি জুড়ে
শেয়াল ডাকে!
নাকি মানুষ, দিনের আলোয় যাদের দেখলে
পুলিশ পালায়? ঘুমের মধ্যে তারা আসে,
স্বপ্নে আসে সমস্ত রাত!
ফুল্লরা । তুই বুকের জ্বালা বলবি কাকে?
কে শুনতে চায় একটার পর একটা অসুখের গল্প, যখন
রাত ফুরলে দিন আসে না—শুধু আকাল, শুধু শ্মশান—
শ্মশান জুড়ে ভুতের নৃত্য । যাকে জানতি সূর্য্যি ঠাকুর
সে এখন ডাকাতের রাজা । আকাশ খেয়ে, মাটি খেয়ে
তার খিদে মেটে নি—এবার তোদের খাবে ।
গুলি চলছে
গুলি চলছে, গুলি চলছে, গুলি চলবে — এই না হলে শাসন?
ভাত চাইতে গুলি, মিছিল করলে গুলি, বাংলা বন্ ধ গুলির মুখে
উড়িয়ে দেওয়া চাই ।
দেশের মানুষ না খেয়ে দেয় ট্যাক্স, গুলি কিনতে, পুলিশ ভাড়া
করতে, গুণ্ডা পুষতে ফুরিয়ে যায় তাই ।
একেই বলে গণতন্ত্র ; এরই জন্য কবিতার সর্দার সাহিত্যের মোড়লরা
কেঁদে ভাসান ; যখন
গুলিবিদ্ধ রক্তে ভাসে আমার ঘরের বোন, আমার ভাই ।
যতীন দাসের ফটো
কুৎসিত বাঁকানো মুখে জীবনের অদ্ভুত উত্সব
অফুরন্ত আলোকের উদ্ভাসিত ঐশ্বর্যে, প্লাবনে ;
ধীরে ধীরে সেই মুখ হয়ে এলো আশ্চর্য সুন্দর
অবিশ্রাম তারা-ঝরা জীবনের বর্ষণে ও গানে ।
অনেক দেখেছি ছবি, দেখিনি উন্মত্ত দ্বিপ্রহর
পদ্মার কি মেঘনার নীলকণ্ঠ স্বর্ণায়ু জটায়,
সাপ-খেলানোর নেশা মৃত্যু দিয়ে কেনে বাজিকর
দেখিনি এমন ছবি মথুরায় কিম্বা অযোধ্যায়
কোনদিন! আজ দেখি রঙচটা তথাপি বিচিত্র,
অসুন্দর, তবু মুখ সূর্যের কি সমুদ্রের মিত্র ।
এই ছবি দেখে দেখে স্পষ্ট হ’লো কেন মরা হাড়ে
দধীচি এখনো বজ্র | সব গ্রহ আগুন তো নয়
একথা যেমন সত্য, তবু কেউ পুড়ে যেতে চায়
পৃথিবীকে আলো দিয়ে, কী আশ্চর্য, সে-ই সূর্য হয়!
আশ্চর্য ভাতের গন্ধ
আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে
কারা যেন আজও ভাত রাঁধে
ভাত বাড়ে, ভাত খায়।
আর, আমরা সারা রাত জেগে থাকি
আশ্চর্য ভাতের গন্ধে
প্রার্থনায়, সারা রাত।
রাজা আসে যায়
১
রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়….
দিন বদলায় না!
গোটা পৃথিবীকে গিলে খেতে চায় সে-ই যে ন্যাংটো ছেলেটা
কুকুরের সাথে ভাত নিয়ে তার লড়াই চলছে, চলবে ।
পেটের ভিতর কবে যে আগুন জ্বলেছে এখনো জ্বলবে!
২
রাজা আসে যায় আসে আর যায়
শুধু পোষাকের রং বদলায়
শুধু মুখোশের ঢং বদলায়
পাগলা মেহের আলি
দুই হাতে দিয়ে তালি
এই রাস্তায়, ওই রাস্তায়
এই নাচে ওই গান গায় :
“সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়!”
৩
জননী জন্মভূমি!
সব দেখে সব শুনেও অন্ধ তুমি!
সব জেনে সব বুঝেও বধির তুমি!
তোমার ন্যাংটো ছেলেটা
কবে যে হয়েছে মেহের আলি,
কুকুরের ভাত কেড়ে খায়
দেয় কুকুরকে হাততালি…
তুমি বদলাও না ;
সে-ও বদলায় না!
৪
শুধু পোষাকের রং বদলায়
শুধু পোষাকের ঢং বদলায়…
রাস্তা কারও একার নয়
ধর্ম যখন বিজ্ঞানকে বলে রাস্তা ছাড়াে!’ বিজ্ঞান কি রাস্তা ছেড়ে দেয়?
পােপের ভয়ে দেশান্তরী হয়েছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। সারাদিন
একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে পায়চারি করতেন গ্যালিলিও গ্যালিলেই ;
তাঁকে পাহাড়া দেবার জন্য বসে থাকতাে একজন ধর্মের পেয়াদা, যার
চোখের পাতা বাতাসেও নড়তাে না।
বিজ্ঞান কি তখন থেমে ছিল? তীর্থের পাণ্ডাদের হই হই, তাদের লাল
চোখ কি পেরেছিল পৃথিকে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে, সূর্যকে
তার চারদিকে ওঠবােস করাতে?
ধর্ম যতদিন দুঃখী মানুষকে বেঁচে থাকার সাহস দেয়, ততদিন
রাস্তা নিয়ে কারও সঙ্গে তার ঝগড়া থাকে না। রাস্তা কারও
একার নয়।
বরং তাকেই একদিন রাস্তা ছাড়তে হয়, যার স্পর্ধা আকাশ
ছুঁয়ে যায়।
বিজ্ঞান যখন প্রেমের গান ভুলে ভাড়াটে জল্লাদের পােশাক গায়ে চাপায়, আর
রাজনীতির বাদশারা পয়সা দিয়ে তার ইজ্জত কিনে নেয়,
আর তার গলা থেকেও ধর্মের ষাঁড়েদের মতােই কর্কশ
আদেশ শােনা যায় : ‘রাস্তা ছাড়াে! নইলে –
পৃথিবীর কালাে সাদা হলুদ মানুষের গান, তাদের স্বপ্ন
এক মুহূর্ত সেই চিঙ্কার শুনে থমকে তাকায়।
তারপর যার যেদিকে রাস্তা, সেদিকে মুখ করেই তারা সামনে,
আরও সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
কেউ কারােকে রাস্তা ছেড়ে দেয় না, যতদিন এই পৃথিবীতে গান থাকে,
গানের মানুষ থাকে, স্বপ্ন থাকে..
ক্ষুদিরামের ফাঁসি
সে এক অদ্ভুত রাত্রি! থমথমে রক্তমাখা মুখগুলি জ্বরে
অকথ্য প্রলাপ বলে, দীপ-নেভা অন্ধকার বিছানায়, ঝড়ে
বুকগুলি তোলপাড় । জানালায় জল্লাদের হাতের মতন
কালো হাওয়া নড়ে চড়ে, হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে । নেকড়ের গর্জন
নগরেও শোনা যায় ; কুয়াশায় ঝাঁপ দেয় সারিবদ্ধ বাঘ—
সে এক অদ্ভুত রাত্রি ; ক্লান্তির শিয়রে ক্রান্তি লেখে পূর্বরাগ!
সেই রাত্রে ফিস্ ফিস্ রুগী আর নার্সের অস্ফুট গলায়
ভয়, শুধু ভয় কাঁপে, তারপর ধীরে ধীরে কেটে যায় ভয়—
কে যেন নির্ভীক হাসে । ভীষণ কঠিন হাসি প্রত্যেক দরজায়
বিবর্ণ রাত্রির চোখে চোখ রাখে, কথা বলে, ছড়ায় বিস্ময় ।
অন্ধকারে সেই হাসি আলো যেন, জ্বেলে দিল সমস্ত বন্দর ;
ঘরে ঘরে যুবতীরা খিল তোলে, যুবকের ছেড়ে যায় জ্বর ।
ধীরে রাত্রি স’রে যায় । শুদ্ধ ভোরে স্নান সেরে বাইরে এলাম…
ফাঁসির মঞ্চে কাল হেসে গেছ, গেয়ে গেছ, তুমি ক্ষুদিরাম!
আরো পড়ুন: শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অমৃত বাণী : এক অপূর্ব আধ্যাত্মিক ভ্রমণ