Fulmoni Upakhyan By Sunil Gangopadhyay – 2024 l সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ফুলমণি উপাখ্যান – 2024

By raateralo.com

Updated on:

Fulmoni Upakhyan By Sunil Gangopadhyay

Fulmoni Upakhyan By Sunil Gangopadhyay: বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।

Fulmoni Upakhyan By Sunil Gangopadhyay l সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ফুলমণি উপাখ্যান

ফুলমণি-উপাখ্যান – ১

দুপুরবেলার কাঁচা ভাত-ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল চন্দনদা।

দিনটা চমৎকার। সকাল থেকেই রিমঝিম ঘন ঘন রে।

বাজারে ইলিশ মাছ সস্তা। এমন দিনে মাকে বলা যায়। বলা যায় খিচুড়ি, খিচুড়ি! পৃথিবীতে আর কোনো খাবার নেই, যার স্বাদ বৃষ্টির দিনে বেশি ভালো হয়ে যায়, খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজার মতন। খাওয়ার পর বাথরুমে না গিয়ে আমি আঁচালাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জলে। সারা গায়ে বৃষ্টির গন্ধ হয়ে গেল।

এরপর একখানা বই বুকে নিয়ে ঘুম না দেওয়ার কোনো মানে হয় না। যত আকর্ষণীয় প্রেমের গল্প বা গোয়েন্দা গল্পই হোক, বিছানায় গা এলিয়ে দেবার পর দু’-চার পাতার বেশি পড়া যায় না, চোখ জুড়িয়ে আসে। খিচুড়ির ঘুমের চরিত্রই আলাদা। এই ঘুম আসে খুব মৃদুভাবে। প্রথমে একটা নাচের ছন্দ শোনা যায়। মনে হয় যেন সুরলোকের চান-গানের আওয়াজ টের পাওয়া যাচ্ছে অবচেতনে। তারপর কোথা থেকে একটা নরম মখমলের চাদর উড়ে এসে ঢেকে দেয় শরীর। কেউ যেন কোমল আঙুল বুলিয়ে দেয় দু’চোখের পাতায়। ছোট ছোট স্বপ্ন ঝিলিক দেয়। তারপর বিছানা, খাট-ফাট সুদ্ধু সব কিছুই ভাসতে থাকে শূন্যে।

আহা, এই রকম দিনেও এত লোককে অফিসে, স্কুলে-কলেজে যেতে হয়। তারা কি দুঃখী! রাস্তায় গোড়ালি-ডোবা জলে, ছপছপিয়ে যাও, তারপর বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকো। এরই মধ্যে কোনো গাড়ি বা ট্যাক্সি তোমার গায়ে কাদা ছিটিয়ে চলে যাবে। হঠাৎ মনে হবে, কোনো কাক এসে বুঝি মাথায় একটা ঠোক্কর মারল, আসলে সেটা পাশের মানুষের ছাতার শিকের খোঁচা। বাইরে ফিনফিনে হাওয়া অথচ বাসের মধ্যে গরম আর ঘাম। অধিকাংশ অফিসেই জানলা দেখা যায় না, জানলা থাকলেও আকাশ দেখা যায় না, দিনের বেলাতেও আলো জ্বলে। বেচারা চাকুরিজীবীরা কি হতভাগ্য!

আমি বাল্যকালে কোনো পাপ করিনি। ইস্কুলে পড়ার সময় খামোকা ক্লাসের অন্য বন্ধুদের বঞ্চিত করে ফার্স্ট-সেকেন্ড হবার চেষ্টা করিনি কক্ষনো। কলেজে লেকচারাররা যখন শেলি-কীটসের কবিতা কাটা-ছেঁড়া করতেন, তখন দিব্যি আড্ডা মারতাম কফি হাউজে, অর্থনীতির কূটকচালি নিয়ে মাথা ঘামাইনি কোনো দিন, ইতিহাসের বই সামনে খুলে হাত মকসো করতাম প্রেমপত্র লেখায়। এই সব সুকৃতির ফলে চাকরির বাজারে আমার দাম কানাকড়ি, স্বেচ্ছায় দাসত্ব খোঁজার জন্য হন্যে হতে হয়নি আমাকে। আমি বেঁচে গেছি। শহরের রাস্তায় যখন মাইনে বাড়াবার মিছিল দেখি, আমার মজা লাগে। আমাকে ওই গড্ডলিকা প্রবাহে কোনোদিনও যোগ দিতে হবে না। আমার কিছু না কিছু খুচরো পয়সা রোজ জুটে যায়, তাই-ই যথেষ্ট।

এমন চমৎকার, মোহময় একটা দিনে যারা চাকরি করছে করুক, আমি খিচুড়ি-ইলিশ মাছ দিয়ে আত্মাকে পরম সন্তুষ্ট করে, বিছানায় শুয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে চলে গিয়েছিলাম ঘুমের দেশে।

আধ ঘণ্টাও ঘুমোইনি, এর মধ্যে মূর্তিমান উপদ্রবের মতন চন্দনদার আবির্ভাব। হাঁটু দিয়ে আমার পিঠে একটা গোঁত্তা মেরে জলদ-গম্ভীর স্বরে ধমক দিয়ে বলল, এই নীলু, ওঠ! ওঠ!

আমি চোখ মেলে প্রথমে চন্দনদাকে চিনতেই পারলাম না। এমনিতেই তার বেশ বড়সড় চেহারা, তার ওপরে আবার একটা খয়েরি রেইন কোট পরে আছে, মনে হয় যেন একটা দৈত্য।

আমি ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কে? কে?

চন্দনদা বলল, দুপুবেলা ষাঁড়ের মতন ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছিস, তোর লজ্জা করে না? পুরুষমানুষ কখনো দুপুরে ঘুমোয়?

দিবানিদ্রার ব্যাপারে নারী জাতিরই কেন একচেটিয়া অধিকার থাকবে, তা আমার বোধগম্য হলো না। কাঁচা ঘুম ভাঙলে মাথায় অনেক কিছু ঢোকেও না। চন্দনদার গলার আওয়াজ ও ভাষা চিনতে পেরে আমি বললাম, খিচুড়ি খাবে? এখনো আছে অনেকটা।

চন্দনদা একটা চেয়ার টেনে বসে বলল, কী আবোল তাবোল বকছিস! আমি হঠাৎ এই অসময়ে খিচুড়ি খেতে যাব কেন?

দু’ হাতে চোখ কচলে বাস্তব জগতে ফিরে এলাম।

চন্দনদাকে বেশ কয়েক মাস বাদে দেখলাম, ওঁদের বাড়িতেও আমি যাইনি অনেকদিন। এর আগে দু’-একটা ঘটনার জন্য চন্দনদা আমার ওপর খানিকটা বিরূপ হয়েছিল। একবার মারবেও বলেছিল। কিন্তু সেসব তো চুকেবকে গেছে। এর মধ্যে আমি তো আর কোনো গণ্ডগোল করিনি, ওদের পারিবারিক ব্যাপারেও নাক গলাইনি, তা হলে হঠাৎ এই বৃষ্টির দিনের প্রাক-বিকেলে চন্দনদা আমাকে হাঁটুর গোঁত্তা লাগাতে এল কেন? অজান্তে কিছু দোষ করে ফেলেছি নাকি?

চন্দনদা গাল চুলকোতে চুলকোতে বলল, ছি ছি ছি, কোনো কম্ম নেই, দুপুরে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস। যুবশক্তির কি অপচয়! এই জন্যই তো দেশটা গোল্লায় যাচ্ছে। আর কিছু কাজ না থাকে তো রাস্তার গাছগুলোতে জল দিলেও তো পারি তাতে শরহটা সবুজ হবে!

এই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার গাছে পাগল ছাড়া কেউ জল দিতে যায়? গাছের বা কি ভাববে। চন্দনদাকে এ কথা বলে লাভ নেই, যা মেজাজ দেখছি, আব বকুনি খেতে হবে।

ভেতরের পকেট থেকে চন্দনদা একটা চুরুট বার করে ঠোটে গুঁজল, তারপ তাকিয়ে রইল আমার দিকে।

আমি বললাম, দেশলাই দেব?

চোখ কটমট করে চন্দনদা বলল, আমার দেশলাই লাগে? উজবুক! জানি না?

হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম। কয়েক বছর ধরে চন্দনদা ধূমপান ত্যাগ কর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সিগারেট বর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু মুখে একটা চুরুট : রাখলে চলে না। সন্ধের সময় সেটা ধরায়। প্রতিদিন একটা চুরুট খাওয়া চাই

এবার রেইন কোটের পকেট থেকে বার করল একটা চৌকো প্যাকেট। দেে মনে হয় মিষ্টির বাক্স। সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই নে, ছোট পাহা থেকে তোদের জন্য সন্দেশ এনেছি।

এ আবার কী ব্যাপার! প্রথমে হাঁটুর গুঁতো, তারপর সন্দেশ? একেই বে হট অ্যাণ্ড কোল্ড ট্রিটমেন্ট। চন্দনদার সব কিছুই অদ্ভুত।

প্যাকেটটা টেবিলের ওপর রাখতে যাচ্ছিলাম, চন্দনদা বলল, খুলে দেখা না? খা একটা! এরকম সন্দেশ কলকাতায় পাবি না!

—পরে খাব, চন্দনদা।

–না, এখনই খা। এত দূর থেকে আনলাম!

মুখে যার টাটকা ইলিশ মাছ ভাজার স্বাদ লেগে আছে, তাকে মিষ্টি খেে বলা অত্যাচারের মতন নয়?

প্যাকেটের বাঁধন খুলে দেখা গেল তার মধ্যে চকোলেট রঙের দশ-বারোাঁ ছোট ছোট সন্দেশ রয়েছে। একটা তুলে মুখে দিতেই হলো। পোড়া পোড়া ক্ষিরে স্বাদ। মন্দ না। আমি সন্দেশ-রসিক নই, তবু মনে হলো, এটা অন্য ধরনের

বললাম, চমৎকার! ছোটপাহাড়ীতে এত ভালো মিষ্টি পাওয়া যায়।

—তোর জন্য দু’রকম সন্দেশ এনেছি, নীলু!

—রক্ষে করো, চন্দনদা, আমি আর খেতে পারব না। একটাই যথেষ্ট।

—তোকে দুটো সন্দেশ খেতে বলিনি, ইডিয়েট। বললাম না, দু’রকম। এক হচ্ছে এই সন্দেশ মানে মিষ্টি। আর একটা সন্দেশ হচ্ছে খবর। খুবই সুখবর তুই একটা চাকরি পেয়েছিস।

—অ্যাঁ?

—কথাটা কানে গেল না তোর? তুই একটা চাকরি পেয়েছিস! চাকরি, চাকরি!

—চাকরি?

অমন ভেটকি মাছের মতন তাকিয়ে রইলি কেন? অন্য যে-কোনো ছেলে এই খবর শুনে লাফিয়ে উঠত!

—আমার এমন ক্ষতি করতে কে বলল তোমাকে, চন্দনদা?

—ক্ষতি? প্রিপস্টারাস! এমন অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি! দেশে লক্ষ লক্ষ বেকার, কেউ কোনো চান্স পায় না, আর তোকে একটা প্লেটে করে সাজিয়ে…

—আমি তো বেকার নই। আমি কি অ্যাপ্লিকেশন করেছি কোথাও? যে চাকরি চায় অথচ পায় না, সে তো বেকার। আর যে চাকরি খোঁজেই না, চাকরির যার দরকার নেই, তাকে কি বেকার বলা যায়?

—তুই বেকার নোস?

—ডিক্‌শিনারি দ্যাখো।

—আমার সঙ্গে চ্যাংড়ামি হচ্ছে, নীলু! ওঠ, জামা পর!

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। যারা ভালো ভালো চাকরি করে, কিংবা ব্যবসায়ে সার্থক, যারা কর্মবীর, তাদের কিছুতেই বোঝানো যায় না আমার যুক্তিটা। সবাইকেই কি চাকরি করতে হবে, কোনো না কোনো কাজের জোয়াল ঘাড়ে নিতে হবে? তা হলে কদমতলায় বসে বাঁশি বাজাবে কে? কে ছবি আঁকবে? যাত্রাদলে নতুন ছেলে আসবে কী করে? এসবও যারা পারে না, স্রেফ বাউণ্ডুলেপনা করার জন্যও তো কিছু মানুষ দরকার। যে-জাতের মধ্যে বাউণ্ডুলে কিংবা ভবঘুরে নেই, সে জাতের কখনো উন্নতি হতে পারে?

আমি হাত জোড় করে বললাম, আমায় ছেড়ে দাও, চন্দনদা। আমার এমন সর্বনাশ করো না।

চন্দনদা চোখ কপালে তুলে বলল, সর্বনাশ? দু’ হাজার সাতশো টাকা মাইনে পাবি।

—চুপ, চুপ, আস্তে। অত টাকার কথা মা শুনতে পেলে কান্নাকাটি করবে।

—মাসিমাকে কষ্ট দিচ্ছিস। দাদার ঘাড়ে বসে খাচ্ছিস। তোর লজ্জা করে না? সবাই বলে, চেনাশুনো সকলেরই মোটামুটি হিল্লে হয়ে গেল, শুধু নীলুটাই গাছ—দামড়া হয়ে রইল। লাফাংগার মতন ঘুরে বেড়ায়, হ্যাংলার মতন লোকের বাড়িতে ঠিক খাওয়ার সময় গিয়ে হাজির হয়—

—বাজে কথা। নেমন্তন্ন না করলে আমি কারুর বাড়িতে যাই না। এমনকি নেমন্তন্ন করলেও সব বাড়িতে যাই না।

—তুই একদিন ভরপেট খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েও লালুদার সঙ্গে টলি ক্লাবে গিয়ে গোগ্রাসে গিলিসনি?

—সেটা অন্য কথা। লালুদা আমাকে জোর করে খাইয়েছে। লালুদা আমাকে দিয়ে একটা কাজ করাতে চাইছিল।

—লালুদাই বলেছে, দরকার হলে তোকে ঘাড় ধরে চাকরির জায়গায় নিতে হবে।

—আমাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে না?

—তা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।

আমি এবার মুচকি হাসলুম। চন্দনদা গোঁয়ার লোক, কাকুতি মিনতি করে ছাড়া পাওয়া যাবে না। ইন্টারভিউতে ফেল করা অতি সহজ। এমনি যদি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে যাই…এর আগেও কেউ কেউ আমাকে দু’-এক জায়গায় জোর করে কাজে ঢুকিয়েছে, সিঙ্গাপুর থেকে আমার এক মামা এসে তো উঠে পড়ে লেগেছিল…সব কটা চাকরি থেকেই আমি অবিলম্বে সগৌরবে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি। চাকরির মালিকদের আমাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত, আমিই একমাত্র, যে বরখাস্ত হলেও আন্দোলন করে না। নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে আসে।

না-ধরানো চুরুটটা দু’বার টেনে চন্দনদা গলা নরম করে বলল, আচ্ছা নীলু, তুই কেন কাজ করতে চাস না বল্ তো? তোর ইচ্ছে করে না, নিজে রোজগার করবি, নিজের পায়ে দাঁড়াবি, লোকজনের মধ্যে মাথা উঁচু করে থাকবি।

-মাথা উঁচু করেই তো আছি। তুমিই বলো, কার মাথা বেশি উঁচু, যে দান করে, না যে দান প্রত্যাখ্যান করে? এ দেশে কত ভালো ভালো ছেলেমেয়ে রয়েছে, পড়াশুনা শেষ করেও কোনো সুযোগ পায় না, তোমাদের মতন লোকেরা ভাবো, আহা বেচারারা… যুবশক্তির অপচয়…তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনকে ডেকে, তোমরা ছিটে ফোঁটা দায় বিলোও! যে-কোনো একটা চাকরি দিয়েই ভাবো তাদের ধন্য করে দিলে! আমি সেই সব ছেলেমেয়েদের পক্ষ থেকে এক জ্বলন্ত প্ৰতিবাদ। আমি দয়া চাই না! আমি দয়া চাই না। সারা জীবন আমি এই ধ্বজা উড়িয়ে যাব!

—তোমাকে সে সুযোগ দেওয়া হবে না, শয়তান। শুধু বাজে কথার ফুলঝুরি। আমরা সবাই খেটে খেটে মরব, আর তুই শুধু মজা করবি—ইয়ার্কি! কালকেই তোকে ছোটপাহড়ীতে যেতে হবে!

—ছোটপাহাড়ীতে কেন?

–সেখানেই তো তোর কাজের ব্যবস্থা হয়েছে!

সঙ্গে-সঙ্গে সব কিছু বদলে গেল। অন্ধকার বাড়িতে পটাপট আলো জ্বলে ওঠার মতন খুশির ধাক্কা লাগল আমার সব কটা ইন্দ্রিয়তে। ছোটপাহাড়ী! সে যে অপূর্ব সুন্দর এক স্থান। সব দিকে গোল হয়ে ঘিরে আছে সবুজ মখমলে ঢাকা পাহাড়। মাঝখানটাতেও এত গাছপালা যে তার ফাঁকে ফাঁকে কিছু বাড়ি—ঘর থাকলেও চোখে পড়ে না। মনে হয় এক সবুজের রাজ্য। দিনে দু’বার বাস যায়, তা ছাড়া তেল-কালি-ধোঁয়ার কোনো উপদ্রব নেই। ছোটপাহাড়ীতে একটা সরু পায়ে-চলা রাস্তার ধারে আমি যত বনতুলসীর ঝাড় দেখেছি, সে রকম বুঝি পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বিনা যত্নে, বিনা প্রয়োজনে এত অসংখ্য ফুল ফুটে আছে, এক একটা ছোট ছোট ফুলের কতরকম রং! সেই সব ফুলের একটা স্নিগ্ধ টান আছে। ওই বনতুলসীর ঝাড়ের কাছে আবার যাবার জন্য আমি যে কোনো মূল্য দিতে রাজি আছি।

—ছোটপাহাড়ীতে কী কাজ, চন্দনদা?

–সেসব পরে বুঝিয়ে দেব। মোট কথা, তোকে যেতেই হবে।

—যেতেই হবে, কী বলছ? ছোটপাহাড়ীতে নিয়ে গিয়ে যদি তুমি আমাকে তোমার কোয়ার্টার ঝাঁট দিতে বলো, তোমার জন্য রান্না করে দিতে বলো, তোমার জুতো পালিশ করে দিতে বলো, সব রাজি আছি।

চন্দনদা এবার হকচকিয়ে গেল, আমার আকস্মিক মতি-পরিবর্তনের কারণটা ধরতে পারল না। বুঝবে কী করে, চন্দনদা সেই বনতুলসীর জঙ্গলের দিকে বোধহয় কোনোদিন চেয়েও দেখেনি।

আমি তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে বললাম, তুমি চা খাবে? এক্ষুনি চা আনছি। আর কী খাবে বলো, গরম গরম কচুরি? ডাল ডিমের ওমলেট?

চন্দনদা বলল, এখন কিছু খাব না। বৃষ্টি অনেকটা কমেছে, চল তোকে বেরোতে হবে।

তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি চাপিয়ে, টেবিলের ড্রয়ার থেকে আমার সঞ্চয় সাত টাকা আশি পয়সা পকেটে নিয়ে নেমে এলাম রাস্তায়। চন্দনদা কোম্পানির গাড়িতে এসেছে। চন্দনদাদের হেড অফিস কলকাতায়, মাঝে মাঝে চন্দনদাকে ছোটপাহাড়ীতে গিয়েও থাকতে হয়।

খাকি পোশাক ও মাথায় টুপি পরা ড্রাইভার তাড়াতাড়ি চন্দনদাকে দেখে নেমে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল। আমি যখন চাকরি করব, তখন কি আমাকেও…। দু’ হাজার সাতশো টাকা মাইনেতে কি গাড়ি দেয়?

চন্দনদার বাড়ির সামনে একটা লাল রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ লালুদা এসেছে, নীপা বউদির বয় ফ্রেন্ড। আজকাল চন্দনদাও লালুদাকে সহ্য করে নিয়েছে। লালুদার অবাধ যাওয়া-আসা আটকাবার কোনো উপায় নেই!

লালুদা ছাড়াও রয়েছে তপনদা। তপনদা কলকাতার বাড়িওয়ালাদের ঝামেলা সহ্য করতে না পেরে পাকাপাকি বম্বে চলে গিয়েছিল, কোনো কাজে আবার এসেছে বোধহয়। তিনজনে ভি সি আর-এ একটা ছবি দেখছিল নিবিষ্টভাবে, চন্দনদা ঘরে ঢুকেই বলল, এখন ওসব বন্ধ করো।

লালুদা বলল, আর একটু দেখে নি, মেয়েটার ডেড বডি খুঁজে পাওয়া গেল কি না—

চন্দনদা বলল, এই জন্যই আমি বসবার ঘরে টি ভি রাখা পছন্দ করি না। ইচ্ছে মতন কথা বলার উপায় নেই।

নীপা বউদি ভি সি আর অফ করে দিয়ে হাসিমুখে বলল, তুমি সিনেমা দেখতে ভালোবাসো না বলে কি আর কেউ দেখতে পারবে না?

চন্দনদা বলল, রান্নাঘরে টি ভি লাগাও, ভি সি আর লাগাও, যত ইচ্ছে দেখো! দেয়ালে গোপাল ঘোষের আঁকা একটা প্রকৃতি-দৃশ্যের ছবি। চন্দনদা ছবি ভালোবাসে, প্রায়ই এ বাড়ির দেয়ালের ছবি বদলে যায়। ছবিটার কাছে গিয়ে চন্দনদা বলল, এঃ, ছবিটা বেঁকে রয়েছে। সেটুকুও তোমরা লক্ষ করো না?

নীপা বউদি বলল, জানলার পাশে কেউ ছবি রাখে? এ দিকের দেয়ালটা আবার তোমার পছন্দ নয়।

নীপা বউদি আর চন্দনদার ঝগড়া বিখ্যাত। যে-কোনো ছুতোয় একবার শুরু হলে কখন যে থামবে তার ঠিক নেই। ওরা অবশ্য বলে, এটা ঝগড়া নয়, মতভেদ, তর্ক-বিতর্ক। কিন্তু সেই তর্ক-বিতর্কে আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যায়।

তপনদা আমার দিকে ভুরু নাচিয়ে বলল, কী রে নীলু, ধরা পড়ে গেলি শেষ পর্যন্ত?

এ বাড়িতে মুমু আমার একমাত্র বন্ধু। তার সাড়া-শব্দ নেই। আমি নীপা বউদিকে জিজ্ঞেস করলুম, মুমু কোথায়?

নীপা বউদি বলল, সাঁতারের ক্লাসে গেছে। আজকাল খুব সাঁতারের ঝোঁক হয়েছে।

আমি চমৎকৃত হলুম। গানের ক্লাস, নাচের ক্লাস, ছবি আঁকার ক্লাস এসব শুনেছি। সাঁতারেরও ক্লাস? তাও এরকম বৃষ্টির দিনে। কোনো ঘরের মধ্যে হয় বোধহয়। লালুদা আমার দিকে তাকিয়ে কান-এঁটো-করা হাসি দিয়ে বলল, আমরা সবাই তোমার জন্য খুব চিন্তিত ছিলাম, নীলাদ্রি। আমাদের চেনাশুনো সকলেই কোনো না কোনো কাজ করে, তুমিই বেকার বসেছিলে। চন্দন তোমার জন্য একটা কাজ জোগাড় করে এনেছে, এটা খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু—

লালুদা একটু থামতেই চন্দনদা ধমক দিয়ে বলল, এর মধ্যে আবার কিন্তু কী আছে?

লালুদা আমার দিকে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বলল, নীলকান্তর এত বড় বড় চুল মাথায়, এইভাবে কি চাকরিতে জয়েন করা চলে?

নীপা বউদি বলল, সত্যি, তুমি ক’মাস চুল কাটোনি!

লালুদা বলল, আহা বেকার ছেলে, পয়সা পাবে কোথায়? সেলুনে নিয়ে গিয়ে ওর চুল কাটিয়ে আনছি!

চন্দনদা বলল, কোনো দরকার নেই। বড় চুল আছে তো কি হয়েছে। লালুদা বলল, বড় চুল থাকলে ক্ষতি নেই বলছ? থাক তবে। কিন্তু–

—আবার কিন্তু?

—আমি যতদিন দেখছি, নীলমণি শুধু পাজামা আর পাঞ্জাবি পরে থাকে। ওর কি প্যান্ট-শার্ট আছে?

তপনদা মুচকি হেসে বলল, ভারতীয় সংবিধানে কোথাও লেখা আছে কি যে, পাজামা-পাঞ্জাবি পরে চাকরি করা যাবে না?

লালুদা বলল, সব কিছুর একটা ডেকোরাম আছে তো! বাড়িতে পাজামা পরা যায়, বেকার অবস্থায় বাইরে ঘোরাঘুরিও করলে ক্ষতি নেই, রাস্তায় ঘাটে পাঞ্জাবি পাজামা পরা ছেলে-ছোকরা দেখলেই বুঝতে পারি বেকার। কিন্তু চাকরির জায়গায় ফিটফাট হয়ে না গেলে লোকে মানবে কেন?

চন্দনদা বলল, হ্যাঁ, প্যান্ট-শার্ট হলে ভালো হয়। কী রে, তোর প্যান্ট শার্ট নেই? লালুদা তাড়াতাড়ি বলল, আমি কিনে দেব। এক জোড়া করে প্যান্ট-শার্ট, শু-মোজা-টাই…এখনো নিউ মার্কেট খোলা আছে, চলো, নীলরতন।

আমাকে নিয়ে একটা গিনিপিগের মতন যেন কাটাছেঁড়া চলছে। এবার মুখ খুলতেই হলো। ভুরু তুলে বললুম, টাই-ও পরতে হবে? দু’ হাজার সাত শো টাকা মাইনে তো আজকাল ব্যাঙ্কের বেয়ারা-দারোয়ানরাও পায়। তাই না নীপা বউদি? তারা কি টাই পরে?

চন্দনদা বলল, ওরে বাবা! এই যে সবাই বলে নীলু নাকি চাকরি করাটাই পছন্দ করে না। এখন দেখছি মাইনে নিয়ে দরাদরি শুরু করেছে!

আমি বললুম, দরাদরি না। ওই যে লালুদা বলল, ডেকোরামের কথা! সব অফিসেই দেখেছি বড়-সাহেব, মেজো-সাহেবরা টাই পরে। যদি খুদে কেরানি আর বেয়ারারাও টাই পরতে শুরু করে, তা হলে ওই সব সাহেবরা চটে যাবে না?

চন্দনদা বলল, টাই দরকার নেই। প্যান্ট-শার্ট হলেই চলবে!

লালুদা বলল, তা হলে চলো, নীলকণ্ঠ, ওগুলো কিনে ফেলা যাক। আমি বললুম, প্যান্ট-শার্ট আমার আছে।

—জুতো-মোজা?

—চটি আছে।

–না, না, ট্রাউজার্সের সঙ্গে চটি একেবারেই চলবে না। শু, ভালো শু।

-সমস্ত পৃথিবীটা আপনার টলি ক্লাব নয় লালুদা, যে প্যান্টের সঙ্গে শু পরতেই হবে। তা ছাড়া, আপনি আমার নামটাই মনে রাখতে পারেন না, আপনি আমার জামা-কাপড় কিনে দেবেন কোন্ অধিকারে?

–তোমার নাম মনে রাখতে পারি না? তোমার নাম ওই যে কী বলে, কী বলে, নীলধ্বজ নয়।

নীপাবউদি বলল, ওর নাম নীললোহিত। শুধু নীলু বলেই তো ডাকতে পারেন।

লালুদা বলল, বড্ডো খটোমটো নাম! নীললোহিত! এ নামের মানে কী। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, লালু মানে কী?

এই সময় দরজা ঠেলে একটা ঝড়ের মতন ঢুকল মুমু। এক হাতে দোলাচ্ছে একটা এয়ার লাইনসের ব্যাগ, অন্য হাতে আইসক্রিমের কোন্। মাত্র কয়েকমাস দেখিনি, তার মধ্যেও যেন অনেকটা বড় হয়ে গেছে মুমু। ওর যে মাত্র তেরো বছর বয়েস, তা মনেই হয় না। একটা আগুন রঙের ফ্রক পরা, মাথার চুল ভিজে হিলবিলে হয়ে আছে।

অন্য কারুর দিকে নজর না দিয়ে সোজা চলে এল আমার কাছে। চোখ পাকিয়ে বলল, অ্যাই ব্লু, অ্যাতোদিন আসোনি কেন? কোথায় ডুব মেরেছিলে?

আমি বললুম, জনতার মধ্যে নির্বাসনে!

মুমু বলল, তার মানে?

আমি বললুম, ইস্কুলে বাংলার মিসকে জিজ্ঞেস করে মানেটা জেনে নিও!

মুমু খপ করে আমার কান ধরে মুলে দিয়ে বলল, ইয়ার্কি হচ্ছে! পাজি। আনরিলায়েল লায়ার!

নীপা বউদি হা-হা করে বলে উঠল, ও কি হচ্ছে মুমু! নীলু তোর চেয়ে কত বড়, তোর কাকা হয়, আর কান ধরছিস্ যে।

মুমু বলল, তুমি জানো না মা, আমাকে ও লিটল প্রিন্স-এর গল্পটা আর্ধেক বলে তারপর বলল, তোকে বইটা দিয়ে যাব, নিজে পড়িস, কালকেই দিয়ে যাব। তারপর থেকে হাওয়া! আর এদিকে আসার নাম নেই। মিথ্যুক একটা!

লালুদা বলল, আহা, বেকার ছেলে, বই কেনার পয়সা কোথায় পাবে! কী বই; নামটা লিখে দিস, আমি এনে দেব।

চন্দনদা মুমুকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, জানিস মুমু, তোর নীলুকাকা এবার খুব জব্দ হবে। ওকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। প্রথম চাকরি পাওয়ার কথাটা শুনে এমন ভাব করল, যেন ওকে হাতে-পায়ে শেকল বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোথাও।

আমি মুমুর দিকে ভুরুর ইঙ্গিত করে বললু, মুমু, আমি ছোটাপাহাড়ী যাচ্ছি। সেই ছোটপাহাড়ী, তোর মনে আছে?

মুমু খিলখিল করে হেসে উঠল।

আজ তপনদা বিশেষ কোনো কথা বলেনি। মুড নেই। অন্য সময় তপনদা কথা শুরু করলে অন্য কেউ পাত্তা পায় না। আজ মৃদু মৃদু হেসে সব শুনে যাচ্ছে।

এবার উঠে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় দুটো চাঁটি মেরে গেয়ে উঠল, জয় যাত্ৰায় যাও গো…এক মাসের বেশি টিকে থেকো গো…।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ফুলমণি উপাখ্যান l ফুলমণি-উপাখ্যান – ২

উন্নতি শব্দটার অনেক রকম মানে হতে পারে। একজন ইস্কুল মাস্টারকে যদি থানার দারোগা করে দেওয়া হয় কিংবা একজন সন্ন্যাসীকে ধরে এনে যদি বসিয়ে দেওয়া হয় রাইটার্স বিল্ডিংসের কোনো বড়বাবুর চেয়ারে, কিংবা একটা ফুলের বাগানে যদি তৈরি হয় দশতলা বাড়ি, এসবও উন্নতি নিশ্চয়ই, আবার ঠোঁট ব্যাঁকাতেও হয়। একটা নিরিবিলি জংলা মতন জায়গা, দু’চারখানা মাত্র বাড়ি আর সরু পায়ে চলা পথ ছাড়া আর কিছুই নেই, আছে শুধু শান্তি ও সৌন্দর্য। সেই জায়গাটায় যদি শুরু হয়ে যায় এক কর্মকাণ্ড, জঙ্গল সাফ করে তৈরি হয় কারখানা, হাসপাতাল, হোটেল, অফিসবাড়ি, তা হলে সেটাও খুব উন্নতির ব্যাপার, কত লোক চাকরি পাবে, কত মানুষের আশ্রয় জুটবে। খুবই আনন্দের কথা। তবু আগেকার জন্য দীর্ঘশ্বাসও থেকে যায়।

ছোটপাহাড়ী এখন বড় হতে চলছে। কাছাকাছি এক জায়গায় পাওয়া গেছে লৌহ ধাতুপিণ্ড, তাই ছুটে আসছে ইস্পাত-বিশেষজ্ঞরা। এখানে এখন শহর হবে। বোধহয় এখন যেটা টাটানগর সেটাও একসময় ছোটপাহাড়ীর মতনই ছিল। চন্দনদাদের কোম্পানিই এখানে অনেকগুলো ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট শুরু করে দিয়েছে, দারুণ উদ্যমে দ্রুত তৈরি হচ্ছে বড় বড় বাড়ি ঘর। সেই রকমই একটা নির্মীয়মাণ কারখানার মিস্তিরি-মজুরদের কাজের ওপর নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাকে। অর্থাৎ কুলির সর্দার। কাজটা আমার বেশ পছন্দের।

ছোটপাহাড়ী জায়গাটা বাংলা আর বিহারের সীমানায়। একটা ছোট্ট নদীর এপার আর ওপার। এখানকার লোকরা হিন্দি-বাংলা দুটোই জানে। হিন্দি বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে নিখুঁত বাংলা বলে। সাঁওতালরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিজেদের ভাষায়, আবার বাংলা যখন বলে, তাতেও যথেষ্ট সাবলীল। সুতরাং এখানে ভাষার ব্যাপারে আমার কোনো অসুবিধে নেই।

পাহাড়গুলোর পায়ের কাছে যে বিস্তীর্ণ বনতুলসীর ঝোপ, সেদিকে এখনো হাত পড়েনি নগর-নির্মাতাদের। আমি প্রতিদিন একবার সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরি, বুক ভরে ঘ্রাণ নিই, চোখ ভরে ছবিটা রেখে দিই। ঠিক করে রেখেছি, বনতুলসীর ঝাড় কাটার কথা উঠলেই আমি এখান থেকে সরে পড়ব। ওদের প্রতি আমি অকৃতজ্ঞ হতে পারব না।

প্রথম দিন এসেই চন্দনদা বলেছিল, তুই আমার কোয়ার্টারে থাকতে পারিস নীলু, আবার নিজস্ব থাকার জায়গাও পেতে পারিস। আমার কোয়ার্টার যথেষ্ট বড়, তুই থাকলে কোনো অসুবিধে নেই, তবে স্বাবলম্বী হতে চাস যদি তা হলে আলাদা, ব্যবস্থা হতে পারে। তুই তো আবার দয়া-টয়া চাস না। প্রথম কয়েকটা দিন আমার এখানে খেয়ে নিবি, তারপর নিজেই রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করবি!

বলাই বাহুল্য, সর্বক্ষণ চন্দনদার অভিভাবকত্বের তলায় থাকার চেয়ে আমার আলাদা থাকাই পছন্দ। আমার জন্য কোনো কোয়ার্টার এখনো তৈরি হয়নি, তবে বড় যে গেস্ট হাউসটি আছে, তার একটি ঘর বরাদ্দ হলো! এই গেস্ট হাউসটি যখন সবে মাত্র তৈরি হচ্ছিল, একতলার একখানা বড় ঘর ছিল বাসযোগ্য, তখন আমি মুমুকে নিয়ে এসেছিলাম এখানে। রাত্তিরবেলা ঘরের মধ্যে সাপ ঢুকে পড়েছিল, সে কি কাণ্ড! সেদিন দারুণ ভয় পেয়েছিলুম, আজ ভাবতে মজা লাগে।

তখন হরিলাল নামে যে চৌকিদারটি ছিল, সে এখনো আছে। আগের মতনই সে সন্ধের পর মহুয়ার নেশা করে বোম্ হয়ে থাকে, কিন্তু অতি সরল ও নির্মল মানুষ। আমাকে দেখেই যে সে চিনতে পারল, তাতে আমি একেবারে অভিভূত। আমার মতন একজন সামান্য মানুষকে সে দু’বছর আগে মাত্র একদিন দেখেই মনে রেখেছে।

আমার ঘরটা দোতলার এক কোণে। এই বাড়িটার খুব কাছেই একটা পাহাড়, মনে হয় যেন হাত বাড়ালেই ছোঁওয়া যাবে। মাঝখানে অবশ্য একটা জঙ্গলও আছে। রাত্তিরে সেখানে শেয়াল ডাকে। শিগগিরই এই জঙ্গলটা কাটা হবে, তখন শেয়ালগুলো যাবে কোথায়?

এখানে খাবার ব্যবস্থা হয়নি এখনো। দু’তলায় রয়েছে দুটো রান্নাঘর, ব্যবহার করতে পারে অতিথিরা, কিংবা বাইরে হোটেলেও খেয়ে আসত পারে। অতিথি প্রায় থাকেই না। সারা বাড়িটাই আমার এখন একার বলা যায়। সকালবেলায় চা, ডিম-টোস্ট কিংবা পুরি-ভুজি হরিলালই বানিয়ে দেয় আমার জন্য। চন্দনদা এক হাজার টাকা অ্যাডভান্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, এখন আমি ইচ্ছে করলে প্রত্যেকদিন ডাবল ডিমের ওমলেট খেতে পারি। এখন আমি বড়লোক, সব সময় পকেটে খচমচ করে টাকা। এত টাকা নিয়ে মানুষ কী করে? ছোটপাহাড়ীতে টাকা খরচ করার কোনো রাস্তাই নেই। না আছে সিনেমা থিয়েটার, না আছে ভালো রেস্তোরাঁ কিংবা ডিস্কো নাচের ব্যবস্থা।

আমাদের জন্য কিছু নেই, কিন্তু মজুর-কামিনদের জন্য অনেক কিছুই আছে। মহুয়ার দোকান, চুল্লুর ঠেক, জুয়ার আড্ডা। ওদের পয়সা খলখলিয়ে চলে যায়। রাত্তিরবেলা ওরা নাচে, গায়, ফুর্তি করে, আর সন্ধের পর থেকে আমাদের কিছুই করার থাকে না। সময় কাটাবার জন্যই আমি রাত্তিরে নিজে রান্না শুরু করেছি, দিনের বেলা হোটেলে খেয়ে নিই।

সকাল ন’টা থেকে ছ’টা পর্যন্ত আমার আপিশ। একটা সুবিধে এই যে, গেস্ট হাউসে দুটো বারোয়ারি সাইকেল আছে। এখানে তো আর ট্যাক্সি-বাস-রিক্সা পাওয়া যাবে না, অফিসারদের নিজস্ব গাড়ি বা জিপ আছে, আমার মতন ক্লাস থ্রি স্টাফদের সাইকেলই সম্বল। আমার কাজের জায়গাটা প্রায় দেড়মাইল দূরে, তৈরি হচ্ছে একটা লম্বাটে দোতলা বাড়ি, সেটা হবে লেবরেটারি। গাঁথনি ও ছাদ ঢালাই হয়ে গেছে, এখন চলছে ভেতরের কাজ। এই সময়েই নাকি মিস্তিরি মজুরেরা কাজে ঢিলে দেয়, খুচখাচ করে সারাদিনে কী যে করে বোঝা যায় না।

সাইকেল চালিয়ে ঠিক ন’টার সময় আমি সেখান হাজির হই। কাজটা খুব সোজা। প্রথমে একটা লম্বা খাতা দেখে মিস্তিরি-জোগাড়ে-কামিনদের নাম হাঁকি। ব্যস, তারপর আর করার কিছু নেই, শুধু কয়েকবার একতলা-দোতলায় চক্কর মারা ছাড়া। চন্দনদার স্পষ্ট নির্দেশ আছে, কুলি-মজুরদের কোনো ক্রমেই বকাবকি করা চলবে না। বকলে ওদের মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে, তখন নানা উপায়ে তারা ফাঁকি মারার ফিকির খুঁজবে। বরং তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করলে তাদের মন ভালো থাকে, কাজে বেশি উৎসাহ পায়। ঠিক সাড়ে বারোটায় বাজিয়ে দিতে হবে ঘণ্টা, এর পর থেকে দু’ঘণ্টা টিফিনের ছুটি।

এই দু’ঘণ্টা ছুটির’ ব্যাপারটায় মিস্তিরি-মজুররা নিজেরাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। পুরো দিনের মজুরি পেয়েও দু’ ঘণ্টা ছুটি। এরকম তারা আগে কখনো দেখেনি। কিন্তু চন্দনদার থিয়োরি হচ্ছে, অফিসের কেরানিবাবুরা যদি টিফিনের নামে দু’ ঘণ্টা ঘুরে বেড়তে পারে তাহলে, মিস্তিরি-মজুররা, যারা শারীরিক পরিশ্রম করে, তাদের টিফিনের ছুটির প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। একটানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করলে কাজের গুণ নষ্ট হয়ে যায়। দু’ঘণ্টা টিফিনের মধ্যে আধ ঘণ্টা ওরা খাবার-দাবার খেয়ে নেবে, বাকি দেড় ঘণ্টা ঘুমোবে কিংবা গড়াবে। তারপর আবার ছটা পর্যন্ত কাজ।

এখন কাজ করছে সেই আঠারো জন নারী-পুরুষ। এরা আমায় ছোটবাবু বলে ডাকতে শুরু করেছে। আমি ছোটপাহাড়ীর ছোটবাবু। একমাত্র হেডমিস্ত্রিরি ইরফান আলী গম্ভীর ধরনের মানুষ, যে আমাকে বাবু বলে না। তার হাতে একটা দামি ঘড়ি, আমি ঘড়িই পরি না, সেইজন্য সে নিজেকে আমার তুলনায় উচ্চশ্রেণীর মানুষ মনে করে।

ছুটির পর আমি সাইকেল চালিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যাই। এক একদিন ভোর বেলাতেও চলে আসি। ছোট্ট নদীটা পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে, ছলোচ্ছল শব্দ করে। আমি জলে পা ডুবিয়ে বসি। এই সময় নিজেকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতি বলে মনে হয়। জলের ওপর ঝুঁকে পড়া গাছপালা আর নদীর সঙ্গে অনায়াসে কথা বলতে পারি।

আমার চাকরির এই সময়টাই সবচেয়ে উপভোগ্য। দূর গ্রামের আদিবাসীরা এদিক দিয়ে যাবার সময় এক ঝলক তাকায়, আমার প্রতি তারা কোনো কৌতূহল প্রকাশ করে না।

এখান থেকে কলকাতায় যেতে খানিকটা বাসে আর বাকিটা ট্রেনে, সাড়ে ছ’ ঘণ্টার বেশি লাগে না। তবু মনে হয় যেন কলকাতা কয়েক লক্ষ মাইল দূরে। এখানে এখনো যান্ত্রিক শব্দের তেমন উৎপাত নেই, আর সন্ধের পর যে নিস্তব্ধতা তা যেন সভ্যতার আগেকার কালের।

আমি কলকাতাকে খুবই ভালোবাসি, কিন্তু একটানা বেশি দিন থাকতে পারি না। মাঝে মাঝে বিচ্ছেদ না হলে প্রেম জমে না।

কলকাতায় থাকার সময় পাহাড়-নদী-জঙ্গলের জন্য মনটা হু-হু করে। আবার অনেকদিন কোনো নিরালা-নিরিবিলি জায়গায় কাটাবার পর আবার কলকাতা মন টানে। এক সঙ্গে দুটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা খুব বিপজ্জনক, কিন্তু প্রকৃতি ও নগরী, এই দু’জনের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে প্রেম চালিয়ে যাওয়া সত্যিকারের আনন্দের।

রাত্তিরবেলা দূর থেকে শোনা যায় মাদলের ধ্বনি। কোনো আদিবাসী গ্রামে উৎসব চলে। আমাদের কামিন-মজুররা সবাই স্থানীয়, অনেকে প্রত্যেকদিন নিজেদের গ্রামে ফিরে যায়, আবার অনেকে এখানেই ঝুপড়ি বানিয়েছে, সেখানেও তারা নাচ-গান করে প্রায়ই।

একদিন রাত আটটার সময় চন্দনদার বাংলোর পাশ দিয়ে ফিরছি, দেখলুম অনেক আলো জ্বলছে, কয়েকজন লোকের গলার আওয়াজ, বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন চারটে গাড়ি। পার্টি চলছে, আমার নেমন্তন্ন হয়নি।

চন্দনদা প্রথম দিনই আমাকে আলাদা থাকার ইঙ্গিত কেন দিয়েছিলেন, তা এর মধ্যেই বুঝে গেছি। আমার স্বাধীনতার জন্য নয়, নিজের পদমর্যাদার কারণ। চন্দনদা ক্লাস ওয়ান অফিসার, এখানকার বড় সাহেব, তাঁর বাড়িতে আমার মতন একজন ক্লাস থ্রি স্টাফের থাকাটা মানায় না। চন্দনদার বাড়িতে তাঁর কাছাকাছি তুল্য অফিসার এবং বড় বড় কন্ট্রাকটররা প্রায়ই আসবে, সেখানে আমার মতন একজনকে ঘুরঘুর করতে দেখলে তারা অবাক হবে, চন্দনদাও আমার পরিচয় দিতে লজ্জা পাবে। চাকরি না করে আমি যদি বেকার হতাম, তা হলে কোনো অসুবিধে ছিল না, চন্দনদা অনায়াসে বলতে পারত, এ আমার একজন ভাই, ক’দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। কিন্তু ক্লাস থ্রি স্টাফ কখনো ক্লাস ওয়ান অফিসারের ভাই হতে পারে না।

আমার ঠিক ওপরের বস্ চন্দনদা নয়, মহিম সরকার। তিনি কনস্ট্রাকশান ইঞ্জিনিয়ার। আরও দুটো বড় বড় বাড়ি তৈরি হচ্ছে, মহিমবাবু সেখানেই ব্যস্ত থাকেন, আমার জায়গাটায় বিশেষ আসেন না। হঠাৎ কখনো একটা চক্কর দিয়ে যান। আমকে তিনি এ বাড়িটার একটা নীল নক্সা গছিয়ে দিয়েছেন, লিনটেন, প্যারাপট, প্লামবিং, ফ্লোর পালিশ এই সব বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন, তা আমার মাথায় ঢোকেনি। বোঝার দরকারটাই বা কী, ওসব তো মহিমবাবুর কাজ। আমার ওপর দায়িত্ব মজুররা কাজের সময় ফাঁকি মারছে কিনা সেটা দেখা, কী কাজ করবে তা ওরাই জানে।

চন্দনদা আমাকে নেমন্তন্ন করে না বটে কিন্তু নিজে এক একদিন সন্ধেবেলা আমার গেস্ট হাউজে এসে হাজির হয়। রান্নাঘরে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করে, কী করছিস্ রে নীলু?

আমার মুখে চন্দনের ফোঁটার মতন ঘাম, গেঞ্জিটাও ভিজে গেছে। পাকা রাঁধুনির মতন গরম কড়াইতে তেল ঢেলে বললুম এই তো ডিমের ঝোল রাঁধছি। এরপর ভাত চড়াব।

চন্দনদা বলল, ডিমের ঝোল, বাঃ বেশ ভালো জিনিস। কটি ডিম নিয়েছিস?

—দুটো। তুমি একটা চেখে দেখবে নাকি?

–কাল কি রেঁধেছিলি?

—ডিম সেদ্ধ আর ডাল।

—পরশু?

—ডাল আর ডিমভাজা!

—রোজ রোজ ডিম খাচ্ছিস, তোর পেট গরম হয়ে যাবে! এখানে মুরগি বেশ সস্তা, একেবারে ফ্রেস দিশি মুরগি, তুই মুগির ঝোল রাঁধতে জানিস না?

—রাঁধতে বেশ ভালোই পারি, চন্দনদা, কিন্তু একটা গোটা মুরগি রাঁধলে খাবে কে? যত ছোটই হোক, পুরো একটা মুরগি খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে ফ্রিজও নেই যে রেখে দেবা।

—বলিস কি, তোর সাতাশ বছর বয়স, একটা আস্ত মুরগি খেতে পারবি না। আমরা তো ওই বয়েসে দু’তিনটে মুরগি উড়িয়ে দিতে পারতুম।

–তোমাদের ছেলেবেলায় নানা রকম অসম্ভব কাজ করতে পারতে, তা জানি। কিন্তু আমার পক্ষে দু’তিন পিসই যথেষ্ট। বাজারে তো কাটা-পোনার মতন কয়েক পিস মুরগির মাংস কিনতে পাওয়া যায় না।

—তার মানে, যারা একা থাকে, তারা মুরগির মাংস রান্না করে খেতে পারবে না? যারা বিবাহিত, কাচ্চা-বাচ্চাওয়ালা সংসারী লোক, তারাই শুধু মুরগি খাবে? এ তো ভারি অন্যায়, অবিচার। তাহলে তুই কী করবি, একটা বিয়ে করে ফেলবি নাকি?

—বিয়ে করার চেয়ে ডিমের ঝোল খাওয়া অনেক সহজ নয়?

–সেটা অবশ্য মন্দ বলিস নি! তাহলে?

চন্দনদা যেন এক গভীর সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। আমি ডিমের ঝোল রেঁধে বেশি করে ভাত চাপালুম। আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে চন্দনদা ঘুমিয়েই পড়ল একসময়।

ডাইনিং রুমে দুটো প্লেট সাজিয়ে আমি ডেকে তুললুম চন্দনদাকে

ঝোল দিয়ে ভাত মেখে এক গেরাশ খেয়ে চন্দনদা বলল, তুই তো বেশ ভালোই রান্না শিখছিস, নীলু। নীপার চেয়ে অনেক ভালো।

অর্ধেকটা খাবার পর হঠাৎ থেমে গিয়ে, আর্কিমিডিসের আবিষ্কারের ভঙ্গিতে চন্দনদা বলে উঠল, যাঃ, আর একটা উপায়ের কথা আমার এতক্ষণ মনেই পড়ে নি। আমিই তো একটা মুরগি নিয়ে এলে পারি। তুই সেটা রান্না করবি। দু’জনে মিলে একটা মুরগি শেষ করতে তো অসুবিধে নেই। তুই ওয়ান ফোৰ্থ, আমি না হয় থ্রি ফোর্থ খাব! তুই দিনের পর দিন মুরগি না খেয়ে থাকবি, তা তো ঠিক নয়।

–তোমাকে আনতে হবে না, আমিই তোমাকে একদিন মুরগি রেঁধে খাওয়াবো!

–কেন, আমাকে আনতে হবে না কেন? তুই ক’ পয়সা মাইনে পাস যে আমাকে খাওয়াবি? প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই অর্ধেকটা পাঠিয়ে দিবি মাসিমাকে। হরিলাল, হরিলাল!

-ও কি, হরিলালকে ডাকছ কেন!

-ওকে দিয়ে মুর্গী আনাব!

—এখন? আমাদের তো খাওয়া হয়ে গেল!

-ধুৎ! মাছ-মাংস না থাকলে কি পুরো খাওয়া হয়? ডিম-টিমগুলো মনে হয় জলখাবার!

রক্ষে করো, চন্দনদা। ভাত খাওয়া হয়ে গেছে, এখন আমি মুরগি রান্না করতেও পারব না, খেতেও পারব না। আর একদিন হবে।

—তোরা এত কম খাস বলে তোদের মনের জোর কম। তা হলে কালই… ও হ্যাঁ, ভালো কথা, আর একটা খবর তোকে দেওয়া হয়নি। মুমু-নীপারা সবাই এখানে বেড়াতে আসতে চাইছে। এখন এত কাজের সময়…

-কবে আসবে?

—চব্বিশ তারিখ থেকে মুমুর কয়েকদিন ছুটি আছে। ঐ লালুটাও বোধহয় আসবে ওদের সঙ্গে।

—লালুদা আসবেই।

–কেন, আসবেই কেন?

-লালুদা এখানে এসে তোমার, আমার, নীপা বউদির নানা রকম উপকার করার সুযোগ ছাড়বে না। পরোপকার করা যে ওর নেশা!

–ও পুরুষদের জন্য কিছু করে না। শুধু মেয়েদের।

—আমার জন্য যে জামা-জুতো কিনে দিতে চাইছিল?

—নীপা সামনে ছিল বলে। নীপাকে ওর টাকার গরম দেখাতে চাইছিল। যাই হোক, লালুটা যদি এসে পড়ে, ওকে আমার বাংলোতে রাখব না। গেস্ট হাউসে ব্যবস্থা করে দেব। তুই যেন তখন লালুকে রেঁধে খাওয়াতে যাসনি!

—সে প্রশ্নই ওঠে না। নীপা বউদি এলে আমি জোর করে প্রত্যেকদিন তোমার বাড়িতে খেতে যাব। তুমি না ডাকলেও যাব

এই সময় দূরে দ্রিদিম দ্রিদিম করে মাদল বেজে উঠল।

খাওয়া থামিয়ে চুপ করে গেল চন্দনদা।

একটু বাদে বলল, এই আওয়াজটা শুনলে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। ছোটবেলায় আমরা দুমকায় থাকতুম, সেই সময়কার কথা মনে পড়ে।

আমি বললুম, যত রাত পর্যন্ত শোনা যায়, আমি জেগে থাকি!

চন্দনদা বলল, আমি যা কাজ করি, আমার পক্ষে রাত্তিরবেলা ওদের গান—বাজনার আসরে গিয়ে বসাটা ঠিক মানায় না। তুই তো গেলেই পারিস, সন্ধেবেলা একা একা থাকিস!

এই কথাটা আমারও মনে হয়েছে। একদিন অন্ধকারে ঐ বাজনা লক্ষ করে যেতে হবে।

আমার আণ্ডারে যে আঠারোজন কাজ করে তাদের মধ্যে রাজমিস্তিরিরা মুসলমান, জলের পাইপ বসাবার কাজ যারা করে তার ওড়িশার হিন্দু আর জোগাড়েরা সাঁওতাল। এরা এক সঙ্গে কাজ করে বটে কিন্তু টিফিনের সময় আলাদা আলাদা বসে। তিনটে দলের তিন রকম খাবার। ঘুমোয় খানিকটা দূরত্ব রেখে।

এদের কারুর সঙ্গে আমার এখনো তেমন ভাব হয়নি। ভাব জমাতে আমার দেরি লাগে। ওদের পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে ঘুরে যাই, দুটো-একটা কথা বলি, ওরাও দু’একটা উত্তর দেয়। রাজমিস্তিরি ও কলের মিস্তিরিরা এই ছোট পাহাড়ীতেই ঝুপড়ি করে আছে, সাঁওতালরা নিজেদের গ্রামে ফিরে যায়। ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা কোন গ্রামে থাক? সে হাত তুলে দিগন্তের দিকে দেখিয়ে বলেছিল, সিই-ই খানে!

হয়তো ওদেরই গ্রামে মাদল বাজে। এখানে ওরা চুপচাপ কাজ করে যায় সারাদিন, সন্ধের পর গ্রামে যখন নাচ-গান করে, তখন ওদের চেহারা নিশ্চয়ই বদলে যায়!

সাঁওতালদের একটি মেয়ে ভারি অদ্ভুত। মেয়েটিকে আমি কখনো কথা বলতে শুনিনি। একটা শব্দও উচ্চারণ করে না। বোবা? সে সব সময় দূরে দূরে একা থাকে। টিফিনের সময় অন্যরা খাওয়ার পর যখন ঘুমোয়, তখনো সে শোয় না, খানিক দূরে হাঁটুতে থুতনিতে ঠেকিয়ে বসে থাকে। খুবই রোগা চেহারা, মুখখানাও সুন্দর নয়। একটা শীর্ণ ভাব আছে বলেই চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে। সব সময় এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে দূরের দিকে।

বোবারা কানেও শুনতে পায় না। এই মেয়েটিকে অন্যরা ফুলমণি ফুলমণি বলে ডাকে, ও তখন মুখ ফেরায়। মিস্তিরি কখন ইট আনতে হবে, কখন বালি, তা বলে দিলে ও বোঝে। ঐ রোগা চেহারা নিয়েও ফুলমণি মাথায় অনেকগুলো ইট নিয়ে উঠে যায় বাঁশের ভারা দিয়ে, সে কাজে ওর গাফিলতি নেই। কিন্তু টিফিনের সময় অন্য তিনটি সাঁওতাল মেয়ে কলকল করে হাসে, এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে, কখনো দু’এক লাইন গানও গেয়ে ওঠে, সেদিকে ফুলমণি ভূক্ষেপও করে না। সে চেয়ে থাকে অন্য দিকে। অনেক সময় সে মাটিতে আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটে।

অনবরত চক্কর দেবার কোনো মানে হয় না, তাই মিস্তিরি-মজুররা যখন কাজ করে তখন আমি একটা চেয়ারে বসে বই পড়ি। আমার উপস্থিতিটাই যথেষ্ট। এদের ফাঁকি দিতেও দেখিনি কখনো। বাইরে ফটফট করছে রোদ, কিন্তু গরম নেই তেমন। চুন-সুরকির গন্ধও আমার খারাপ লাগে না। চাকরিটা আমি উপভোগ করছি বলা যায়।

একদিন দুপুরবেলা মহিমবাবু এসে হাজির। বিকেলে দু’লরি সিমেন্ট আসবে, আমাকে বস্তাগুলো গুনে রাখতে হবে, এই নির্দেশ দিতে দিতে হঠাৎ থেমে গিয়ে তিনি বললেন, একী, আপনি বই পড়ছেন?

যেন বই পড়াটা একটা অত্যাশ্চর্য ব্যাপার! চাকরি করতে এসে দুপুরবেলা চোখের সামনে বই খুলে রাখা মহাপাপ।

মহিমবাবু একদিন বিকেলে আমাকে চায়ের নেমন্তন্ন করেছিলেন। উনি গত দেড় বছর ধরে পাকাপাকি আছেন ছোটপাহাড়ীতে। সস্ত্রীক, বাচ্চা-কাচ্চা নেই, ওঁদের কোয়ার্টারটা বেশ ভালোই, আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শয়নকক্ষ, বাথরুম, রান্নাঘর পর্যন্ত দেখিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ঘরেই একটাও বই বা পত্র-পত্রিকা চোখে পড়েনি।

যারা নিজেরা বই পড়ে না, তারা অপরের বই পড়াটাও যেন শারীরিকভাবে সহ্য করতে পারে না। মহিমবাবু এমন ভাবে আমার বইখানার দিকে তাকিয়ে রইলেন যেন ওঁর গা চুলকোচ্ছে।

প্রথম দু’একদিনেই বুঝে গেছি যে মহিমবাবু আমাকে পছন্দ করতে পারেননি। আমি পছন্দ বা অপছন্দ কোনোটারই যোগ্য নই। এখানে আমাকে উপরন্তু অপছন্দ করার কারণ, আমি বড় সাহেবের লোক! বড় সাহেব কলকাতা থেকে তাঁর এক আত্মীয়কে এনে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। মহিমবাবুর কোনো শালা বা ভাইপো নিশ্চয়ই বেকার বসে আছে, তিনি তার কথা ভেবে বসেছিলেন। আমি মনে মনে বলি, অপেক্ষা করুন মহিমবাবু, ধৈর্য হারাবেন না, আপনার শালা কিংবা ভাইপো ঠিকই চাকরি পাবে!

সেদিন মহিমবাবুকে খাতির দেখাবার জন্য আমি বইটা নামিয়ে রেখেছিলাম। দু’দিন পর উনি আবার এলেন দেড়টার সময়। এখনো টিফিন টাইম শেষ হয়নি, এখন আমি যা খুশি করতে পারি।

ওঁকে দেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললুম, কী—ভালো? বই পড়তে লাগলুম আবার। জর্জ সিমেনোর রহস্য কাহিনী, অতি পাষণ্ড ছাড়া এই বই শেষ না করে কেউ উঠতে পারে না। চন্দনদার বাড়িতে এসব বইয়ের প্রচুর স্টক আছে।

মহিমবাবু ভুরু কুঁচকে উঠে গেলেন দোতলায়।

খানিকবাদে আমার মনঃসংযোগ নষ্ট হলো। ওপরে কিসের যেন একটা গোলমাল হচ্ছে।

মহিমবাবু চেঁচিয়ে ডাকলেন, মিঃ নীললোহিত, মিঃ নীললোহিত, একবার ওপরে আসুন তো!

ক্লাস থ্রি-স্টাফেরা যেমন টাই পরে না, তেমনি তারা মিস্টারও হয় না। আর নীললোহিত নামটার আগে মিস্টার কখনো মানায়? যাদের বাড়িতে একখানাও বই থাকে না, তাদের কাণ্ডজ্ঞান তো এরকম হবেই!

টিফিনেরও সময় ডাকাডাকি খুব অন্যায়। চন্দনদার নীতি-বিরোধী মহিমবাবু কর্মপ্রাণ পুরুষ। বিশ্রাম কাকে বলে জানেন না। কিংবা ওপরওয়ালাদের তিনি বেশি বেশি কাজ দেখাতে চান। এখানে তো ওপরওয়ালা কেউ নেই!

উঠে এলুম ওপরে। মহিমবাবু যদি দোতলা থেকে ডাকার সময় মিস্টার যোগ না করে শুধু আমার নাম ধরে ডাকতেন, তা হলে ওকে বেকায়দায় ফেলার কোনো ইচ্ছে আমার জাগত না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আমার মনে হলো, মহিমাবাবুকে ছোট্ট একটি লেংগি মারা দরকার। সহকর্মীদের সঙ্গে লেংগি মারামারি না করলে আর চাকরির সুখ কী?

মহিমবাবু বললে, দেখুন, দেখুন, আপনি নজর রাখেন না, নাকের ডগায় বই নিয়ে বসে থাকেন, এদিকে এরা কী করে?

আমি নিরীহভাবে বললুম, কী করেছে?

মহিমবাবু বললেন, ডিউটি আওয়ার্সে ফাঁকি! ওয়েস্টেজ অফ মেটিরিয়াল!

হেড মিস্তিরি ইরফান আলি দাঁড়িয়ে আছে মহিমবাবুর পাশে। তার হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়ে আমি বললুম, ডিউটি আওয়ার্স তো এখনো শুরু হয়নি!

–কোম্পানির জিনিস নষ্ট করছে, সেটা দেখছেন না?

—কী নষ্ট করেছে?

—দেয়ালটার দিকে তাকান একবার! ওপরে কি একবারও আসেন না?

মহিমবাবু নিজেই দেয়ালটা আড়াল করে আছেন, দেখব কী করে? এবার কাছে গিয়ে দেখলাম, দেয়ালে আঁকা রয়েছে একটা ছবি। দোতলায় দেয়ালগুলো প্লাস্টার করা হয়েছে কয়েকদিন আগে, এখনো হোয়াইট ওয়াশ করা হয়নি। দু’—একদিনের মধ্যে হবার কথা।

চুন গোলা দিয়ে কেউ একটা আঁকাবাঁকা ছবি এঁকেছে দেয়ালে। একটা গাছ, একটা ছেলে, একটা কুকুর। কাঁচা হাতের কাজ। দু’ দিন বাদে যে-দেওয়াল চুনকাম হবে, সেখানে একটা ছবি এঁকে রাখলে ক্ষতি কি, পরে তো মুছেই যাবে।

আমি বললুম, টিফিনের আগেই আমি একবার ওপরে ঘুরে গেছি। তখন ছিল না। টিফিনের মধ্যেই কেউ এঁকেছে।

আমার কথা গ্রাহ্য না করে মহিমবাবু গলা তুলে জিজ্ঞেস করলেন কে এ কাজ করেছে? কৌন কিয়া?

ইরফান আলি নিজস্ব দলটার দায়িত্ব নিয়ে বলল, হামলোগ নেহি দেখা!

কলের মিস্তিরিরা বলল, আমরা কিছু দেখি নাই। আমরা বারান্দায় ছিলাম।

সাঁওতালরা কোনো উত্তর না দিয়ে কয়েকজন চুপ করে রইল, কয়েকজন মিচকি মিচকি হাসতে লাগল।

এবার এগিয়ে এল এক নিঃশব্দ প্রতিমা। ফুলমণি। তার হাতে একটা ভিজে ন্যাতা।

মহিমবাবু এবার তাঁর গলায় বিস্ময় আর রাগ একসঙ্গে মিশিয়ে বলেন, তুমি কিয়া? কাঁহে কিয়া? অ্যাঁ? কাঁহে কিয়া?

আমি ফুলমণিকে নতুন চোখে দেখলুম। এই বোবা মেয়েটা ছবি আঁকে? আগে ওকে মনে হতো বিষণ্নতার প্রতিমূর্তি।

যে বাড়ি এখনো তৈরি হয়নি, রং করা হয়নি, তার দেয়ালে দু’ চারটে ছবি—টবি থাকা তো দোষের কিছু না। আমার ছবি আঁকার ক্ষমতা থাকলে আমিই আঁকতাম। শুধু বালি, বালি রঙের দেয়াল দেখার কী আছে?

আমি ভেবেছিলাম, নারী জাতির প্রতি সম্ভ্রমবোধে মহিমবাবু গলার আওয়াজটা অন্তত একটু নরম করবেন। তা নয়, খুব রোগা এক অবলাকে দেখে তিনি আরও গর্জন করে বলতে লাগলেন, মুছ দেও, আভি মুছ দেও!

যদি একটি মুখরা মেয়ে হতো, তাহলেও অন্য কথা ছিল। কিন্তু একজন বোবা, তার প্রতি এরকম একতরফা বাক্য ব্যবহার আমার পছন্দ হলো না।

আমি হাত তুলে বললুম, দাঁড়াও, ওটা মুছতে হবে না!

মহিমবাবু আমার ওপরওয়ালা। তিনি হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, অ্যাঁ? কী বললেন?

আমি এই বাড়িটার ইন চার্জ। আমার মতামত না নিয়ে মহিমবাবু এখানে কোনো হুকুম দিতে পারেন না। আমার গলায় যথোচিত গাম্ভীর্য এনে আমি অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললুম, যতদিন না চুনকাম হয়, ততদিন তোমরা যে কোনো দেওয়ালে যা ইচ্ছে ছবি আঁকতে পারো। টিফিন টাইমে।

তারপর মহিমবাবুর দিকে তাকিয়ে খুব বিনীতভাবে বললুম, এটাই চন্দনদার নির্দেশ। চন্দনদা খুব ছবি ভালোবাসেন। উনি নিজে এক সময় দারুণ ছবি আঁকতেন, জানেন না?

ফুলমণি-উপাখ্যান – ৩ l Phulmoni Upokhyan

চন্দনদাকে নিয়ে আর পারা যায় না! সন্ধেবেলা যে মুরগিটা নিয়ে এলো পালক—ফালক ছাড়াবার পরও সেটার ওজন দেড় কিলোর কম নয়। এত বড় একটা মুরগি রান্নার জন্য তেল-মশলা-আলু-পেঁয়াজ জোগাড় করা কি সোজা কথা? তা ছাড়া, এত মাংস খাবে কে?

চন্দনদা বলল, তুই রান্না কর, দেখবি খাওয়ার লোকের অভাব হবে না। হরিলাল, শিবলাল, যাদবলাল কত আছে। দুমকায় আমার দাদু কী বলতেন জানিস? বিরাশি বছর বয়স, তবু রোজ মাছ চাই, মাংস চাই, তিন রকম তরকারি চাই। সব সাজিয়ে দেওয়া হতো, নিজে কিন্তু কিছুই খেতেন না। একটু একটু ছুঁয়ে উঠে পড়তেন। আর বলতেন, আমার টাকা আছে, আমি হুকুম করব সব রান্না হবে, তাতে আমার নাতি-নাতনীরা ভালো করে খেতে পারবে।

আমি বললুম, তা তো বুঝলুম। কিন্তু তোমার বাংলোতে বাবুর্চি আছে, তাকে দিয়ে না রাঁধিয়ে শুধু শুধু আমাকে খাটাচ্ছ। কেন?

চন্দনদা বলল, আরে দুর দুর, বাবুর্চির হাতের রান্না খেয়ে খেয়ে জিভ পচে গেছে। তোর এখানে খেলে বেশ একটা পিকনিক পিকনিক ভাব হয়।

আমি মনে মনে বললুম, দেখাচ্ছি মজা! আজ ভাতের তলা ধরিয়ে দেব, ডালে নুন দেব দু বার, আর মাংসে এমন ঝাল দেব যে কাল সকাল পর্যন্ত হু—হু করে জ্বলবে।

আমার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে চন্দনদা বলল, এক এক সময় মনে হয়, জীবনটা যদি গোড়া থেকে শুরু করা যেত! তোর মতন এই রকম একটা ঘরে থাকতুম, নিজে রান্না করে খেতুম, ইচ্ছে না হলে দু’দিন দাড়ি কামাতুম না। সন্ধের সময় নিজের বাংলোতে থাকি না কেন জানিস? বাড়িতে থাকলেই অন্য অফিসাররা চলে আসে, এসেই অফিসের গল্প শুরু করে। সবসময় অফিসের গল্প। হঠাৎ আবার উঠে বসে বলল, হ্যাঁ, ভালো কথা। মহিমবাবু তোর নামে কী যেন বলছিল! তুই কী করেছিস?

—এই রে। তুমিও তো অফিসের গল্প শুরু করলে!

–না, না, মহিমবাবু তোর নামে অভিযোগ করছিল। তুই নাকি ওয়ার্কারদের লাই দিচ্ছিস, তারা কাজে ফাঁকি দেয়।

-এসব কথা কাল আলোচনা করলে হয় না?

–তোর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে নাকি, মহিমবাবুর?

–চন্দনদা, তুমি এক সময় গভর্মেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলে না?

—হ্যাঁ। কে বলল তোকে?

–তোমার প্রাণের বন্ধু তপনদার কাছ থেকে শুনেছি। তুমি বহরমপুর থেকে কলকাতায় পড়তে এসেছিলে। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স পেয়েও ভর্তি হয়েছিলে আর্ট কলেজে। তোমার বাবা খবর পেয়ে এসে কান ধরে তোমায় টানতে টানতে শিবপুরে নিয়ে গিয়েছিল।

—কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তপনের বানানো, না তুই বানালি? আমার বাবার চোখ রাঙানিটা আমি যথেষ্ট ভয় পেতুম। বাবা দুদে উকিল ছিলেন।

–বাবার ভয়ে তুমি ছবি আঁকা ছেড়েই দিলে? ইঞ্জিনিয়ার হলে বুঝি আর শিল্পী হওয়া যায় না? অনেক ইঞ্জিনিয়ার তো কবিতা লেখেন। কবি যতীন্দ্ৰনাথ সেনগুপ্ত…

—আমার কাজটা যে বড্ড ঝামেলার। চাকরিতে জড়িয়ে পড়ার পর আর চর্চা রাখতে পারিনি।

-নীপা বউদির কাছে তোমার আঁকা কয়েকটা ছবি আমি দেখেছি। নীপা বউদির ইচ্ছে সেগুলো বাঁধিয়ে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখবে। কিন্তু তুমি….

—আরে দুর, দূর, সেগুলো খুব কাঁচা ছবি। লোকে দেখলে হাসবে!

-নীপা বউদির একখানা স্কেচ তুমি বেশ ভালোই এঁকেছো। দেখলে চেনা যায়।

-আমি ঠিক পঁয়তিরিশ সেকেন্ডে মানুষের মুখ আঁকতে পারতুম। এক টানে কিন্তু, কিন্তু, তুই কথা ঘোরাচ্ছিস রে, নীলু? মহিমবাবু তোর নামে নালিশটা করেছে, আমি এসেছি তার বিচার করতে—

—মহিমবাবু তোমাকে আসল কথাটাই বলেননি।

—আসল কথাটা কী শুনি?

–আমার ওখানে যারা কাজ করে, তাদের মধ্যে একটা আদিবাসী মেয়ে দেয়ালে একটা ছবি এঁকেছে, তাতে মহিমবাবুর আপত্তি। আমি ভাবলুম, ছবিটা তোমাকে একবার দেখাব।

—ছবি এঁকেছে মানে কী? ফিগার ড্রয়িং আছে?

—হ্যাঁ, একটা ছোট ছেলে, একটা কুকুর।

—রিয়েলিস্টিক? নাকি বাচ্চারা যে-রকম আঁকে, কিংবা মধুবনী স্টাইলের।

—রিয়েলিস্টিক, মানে, ছেলেটাকে ছেলে বলে চেনা যায়, কুকুরটা অবিকল কুকুর।

ব্যস্তভাবে খাট থেকে নেমে চন্দনদা বলল, চল তো, চল তো, আমি এ পর্যন্ত কোনো আদিবাসীর আঁকা রিয়েলিস্টিক ছবি দেখেনি।

—এখন এই রাত্তিরে যাবে নাকি? কাল সকালে…।

—চল দেখে আসি। এমন কিছু রাত হয়নি।

–রান্নাবান্না?

—সেসব পরে হবে! জামাটা পরে নে।

জিপ এনেছে চন্দনদা, ড্রাইভারকে ছুটি দিয়েছে, নিজেই চালাবে। আজ অন্ধকার নেই, ফটফট করছে জ্যোৎস্না। বাতাসে সেই জ্যোৎস্নার সুঘ্রাণ।

এখনো মাদল বাজেনি, আর কোনো শব্দ নেই, জিপের আওয়াজটাকেই মনে হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র আওয়াজ। আকাশ এত পরিষ্কার যে ছায়াপথ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।

লেবরেটরি বাড়িটায় এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। একটা গুদাম ঘরে সিমেণ্ট জমা থাকে, তার জন্য একজন পাহারাদার থাকার কথা, কিন্তু তার পাত্তা পাওয়া পেল না। চন্দনদার হাতে একটা তিন ব্যাটারির লম্বা টর্চ। আমরা উঠে এলুম তোতলায়। দেয়ালটার ঠিক জায়গায় টর্চের আলো পড়তেই চন্দনদা বিস্ময়ে শিস দিয়ে উঠল।

চতুর্দিকে অন্ধকার, টর্চের জোরালো আলোয় ছবিটা স্পষ্ট দেখা গেল, দিনের বেলার চেয়েও ভালো মনে হলো।

চন্দনদা দু’পাশ থেকে ছবিটা দেখে বলল, তুই ঠিক বলছিস নীলু, এটা কোনো আদিবাসী মেয়ের আঁকা?

—হ্যাঁ। মেয়েটা পিকিউলিয়ার। কানে শুনতে পায়, কথা বলে না।

–এ যে পাকা হাতের কাজ। সামথিং ইউনিক। আদিবাসীরা রিয়েলিস্টিক ছবি, যাকে বলে ফটোগ্রাফিক রিয়েলিস্টিক, সে রকম আঁকতে পারে বলে জানা নেই। এখানে দ্যাখ, যে ছেলেটাকে এঁকেছে, তার ফিগারটা পুরোপুরি প্রোপোরশানেট। তার মানে শরীরের সঙ্গে হাত-পা, মুখের সাইজ একেবারে ঠিক ঠিক। খানিকটা ট্রেইনিং না থাকলে তো এরকম আঁকা যায় না।

—মেয়েটাকে দেখে মনে হয়, ও কিছু জানে না।

—তা তো হতে পারে না। ভালো করে দ্যাখ ছবিটা। গাছতলায় একটা ছেলে বসে আছে, একজন রাখাল, হাতে একটা বাঁশি। সাধারণত এই ছবি আঁকা হলে সবাই বাঁশিটা মুখের কাছে দেয়। বাঁশি বাজাচ্ছে তাই বোঝায়। কিন্তু এখানে বাঁশিটা একটু দূরে ধরা, ছেলেটার মুখ দেখলে মনে হয়, সে এখনো বাঁশি বাজানো শুরু করেনি। বাঁশিটা হাতে নিয়ে কিছু একটা ভাবছে। তার মানে, শিল্পী এখানে ট্র্যাডিশানের চেয়ে একটু আলাদা হতে চেয়েছে। এটা বাঁশি হাতে কেষ্টঠাকুর নয়। আর একটা জিনিস দ্যাখ, গাছ আর ছেলেটা ছবির বাঁ দিকে, তাই ব্যালান্স করবার জন্য ডান দিকের কোণে কুকুরটাকে বসিয়েছে। এটা যে কেষ্টঠাকুর নয়, সাধারণ রাখালের ছবি, সেটাও বোঝানো হয়েছে ঐ কুকুরটাকে দিয়ে। কেষ্টঠাকুরের সঙ্গে কুকুরের অনুষঙ্গ নেই, ময়ূর কিংবা হরিণ-টরিণ কিছু থাকত।

–বাবাঃ, তুমি তো অনেক কিছু বলে ফেললে, চন্দনদা। আমি এত সব বুঝি না।

—ভালো করে দেখলেই বোঝা যায়। মহিমবাবুটা একটা পাঁচ নম্বুরি গাড়ল। এই রকম ছবি নিয়ে কেউ নালিশ করে? ক্যামেরাটা আনলুম না, এর একটা ছবি তুলে রাখা উচিত। কয়েকজনকে দেখাতুম।

–কাল সকালে ক্যামেরা নিয়ে এসো।

—কী দিয়ে এঁকেছে বল তো? সরু আর মোটা, দু’রকম রেখাই আছে। কুকুরটাকে মোটা আউট লাইনে এঁকে গায়ে ছোটো ছোট লোমও দিয়েছে। দুরকম তুলির কাজ?

–না, না, চন্দনদা। ও মেয়েটা তুলি-ফুলি কোথায় পাবে? ওর কাছে কিছু থাকে না। টিফিনের সময় কোনো কাঠি দিয়ে আপন খেয়ালে এঁকেছে।

আরও কিছুক্ষণ ধরে ছবিটা দেখার পর টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে চন্দনদা বলল, তাহলে তো খুব মুশকিল হলো রে নীলু! যে-মেয়ে এরকম ছবি আঁকে, সে একজন খাঁটি শিল্পী, তাকে দিয়ে আমরা মাথায় ইঁট বওয়াবার কাজ করাব? এটা তো একটা সামাজিক অন্যায়।

আমি বললুম, বেশি বাড়াবাড়ি করো না, চন্দনদা? ছবি তো অনেকেই আঁকে। আমি তো দেখেছি, কলকাতার রাস্তায় অনেক সময় কেউ কেউ ফুটপাথের ওপর রঙিন চক দিয়ে বড় বড় ছবি এঁকে ভিক্ষে করে। তারাও তো শিল্পী!

চন্দনদা জোর দিয়ে বলল, না। সেসব ছবি আমিও দেখেছি। সেগুলো ডাল। নিষ্প্রাণ। যেসব ছবিতে একটা অন্তর্দৃষ্টি থাকে, সেগুলোই আসল ছবি হয়। আমি ছবি চিনি।

—যারা বাউল গান করে, কী চমৎকার গলা। তারাও তো গায়ক। কিন্তু তাদের ট্রেনে ভিক্ষে করতে হয়।

—তুলনা দিবি না, খবর্দার তুলনা দিবি না। ভেরি ব্যাড লজিক। বাউলদের ঠিক মতন কদর হয় না বলে শিল্পীদেরও অনাদর করতে হবে? তা ছাড়া, আজকাল ছবির বাজার ভালো। মধুবনী পেইন্টিংসও তো সাধারণ গ্রামের মেয়েরা আঁকে, ভালো দামে বিক্রি হয়। আমি ছবি চিনি, এটা একটা…।

—একখানা ছবি দেখেই কি কোনো শিল্পীকে চেনা যায়!

—এই এতক্ষণে একটা দামি কথা বলেছিস, নীলু। না, শুধু একটা ছবি দেখলে কিছু বলা যায় না। এই ছবিটা কপি হতে পারে। অন্য কারুর ছবি দেখে যদি এঁকে থাকে, তা হলে অবশ্য কিছুই না। কপি করতে দক্ষতা লাগে বটে, সিনেমার বড় বড় হোর্ডিং যারা আঁকে, তারাও একধরনের আঁকিয়ে, কিন্তু শিল্পী নয়। নিজের মাথা থেকে একটা নতুন বিষয়কে নতুন ভাবে আঁকা আলাদা ব্যাপার! কাল সকালে এসে আমি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলব!

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চন্দনদা আবার বললেন, ছবিটা দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল রে আমার!

পরদিন ন’টার সময় এসে আমি চমকে গেলুম। দোতলার দেয়ালের ছবিটা কেউ মুছে ফেলেছে।

মিস্তিরি-মজুররা জমা হচ্ছে একে একে। সবাইকে জিজ্ঞেস করলুম, কেউ কিছু জানে না। ফুলমণি অন্য দিনের মতনই নিস্তব্ধ। কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেয় না। এক সময় ধৈর্য হারিয়ে আমি অন্য একজন সাঁওতালকে জিজ্ঞেস করলুম, এই মেয়েটা কথা বলতে পারে না?

সে বলল, হ্যাঁ গো বাবু, পারে। কিন্তু বলে না।

খানিক বাদে চন্দনদা এসে খুব রাগারাগি করতে লাগল। ক্যামেরা এনেছে সঙ্গে। ফুলমণিকে জেরা করা হলো অনেক, সে শুধু মাথা নাড়ে। তবু আমার সন্দেহ হলো, ফুলমণিই ছবিটি মুছে ফেলেছে।

চন্দনদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, টিফিনের সময় আমি আবার আসছি।

অন্যদিনের মতনই শুরু হয়ে গেলে কাজ। তিনতলার গাঁথনি শুরু হয়েছে, একতলা থেকে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে ইট, বালি, সিমেন্ট। লক্ষ করলুম, ইরফান আলি যেন অন্যদিনের চেয়ে ফুলমণিকে বেশি খাটাচ্ছে। ছবিটা আঁকার জন্য ফুলমণি খানিকটা গুরুত্ব পেয়ে গেছে, সেটা ইরফান আলির পছন্দ হয়নি। যেখানে লাভ-লোকসানের প্রশ্ন নেই সেখানেও মানুষের মনে এক ধরনের ঈর্ষা কাজ করে।

বাঁশের ভারা বেয়ে আমিও উঠে গেলুম দোতলার ছাদে। সিঁড়ি এখনো তৈরি হয়নি। একপাশে কাজ চলেছে, আর এক পাশটা ফাঁকা। এরকম ন্যাড়া ছাদের প্রান্তে এসে নীচের দিকে তাকালে ভয় ভয় করে। খানিকটা দূরেই ছোট ছোট টিলা। বনতুলসীর ঝোপঝাড়টাও দেখা যায় এখান থেকে। ছোট নদীটার ধারে বসে আছে কয়েকটা বক। গোটা চারেক কালো কালো মোষ, এখানে ওদের বলে কাড়া, হেঁটে পার হচ্ছে নদী।

মাঝে মাঝে ফুলমণির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে আমার। সে মাথায় করে ইট আনছে ওপরে, আবার নেমে যাচ্ছে, কোনোদিকে আর দৃষ্টি নেই। এত রোগা মেয়েটা একসঙ্গে বারো-চোদ্দটা ইঁট বয়ে আনছে কী করে? পড়ে না যায়। ইরফান আলি মাঝে মাঝে তাকে অকারণ তাড়া দিয়ে বলছে, ইতনা দের কাঁহে হোতা? জলদি করো, জলদি করো!

টিফিনের সময় হোটেল থেকে খেয়ে এসে আমি দেখলাম, চন্দনদা বসে আছে বারান্দায়। পাশে একটা বড় ব্যাগ।

আমাকে দেখে বলল, খেয়ে এসেছিস? গুড! ওদেরও খাওয়া হয়ে এলো। এবার একটা এক্সপেরিমেন্ট করব।

ব্যাগটা থেকে চন্দনদা বার করল ফুলস্কেপ সাইজের অনেকগুলো কাগজ আর অনেকগুলো পেন্সিল, সেগুলোর একদিকে লাল অন্যদিকে নীল শিস।

আঠারো জন মিস্তিরি-মজুরদের সবাইকে ডেকে চন্দনদা একখানা করে সেই কাগজ ও পেন্সিল ধরিয়ে দিল। তারপর বলল, তোমরা সবাই আঁকো যার যা খুশি। যেমন ইচ্ছে আঁকো। তাড়াতাড়ির কিছু নেই।

বাচ্চাদের যেমন সিট অ্যান্ড ড্র প্রতিযোগিতা হয়, সেই রকম ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গেল আঠারো জন। তিনটি সাঁওতাল মেয়ে শুধু খিলখিলিয়ে হাসে। ফুলমণি সকলের থেকে অনেক দূরে একটা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসল।

চন্দনদা বলল, এদের কাছাকাছি থাকা ঠিক নয়। তাতে ওরা লজ্জা পাবে।

গাড়ি থেকে একটা আইস বক্স আর গেলাস নামিয়ে চন্দনদা চলে এল একটা কোণের ঘরে। আইস বক্স থেকে বেরুল ঠাণ্ডা বিয়ারের বোতল। একটা বোতলের ছিপি খুলে চন্দনদা বলল, তোকে কিন্তু দিচ্ছি না, নীলু। এখানে তুই আমার কর্মচারী। সব অরডিনেট স্টাফ-এর সঙ্গে কাজের সময় বিয়ার খেলে আমার বদনাম হয়ে যাবে।

একটু পরেই এসে হাজির হলেন মহিমবাবু

ঠোটের এক কোণে হেসে চন্দনদাকে বললেন, স্যার, আপনি নাকি কুলি-কামিনদের দিয়ে ছবি আঁকাচ্ছেন?

চন্দনদা বললেন, হ্যাঁ। আপনাকে কে খবর দিল?

মহিমবাবু বলেন, খবর ঠিক ছড়িয়ে যায়।

চন্দনদা বললেন, আপনি এসেছেন, ভালো করেছেন। বসুন, আপনিও দেখে যাবেন ছবিগুলো।

চেয়ার মাত্র একখানা। জানলা-দরজাও এখনো বসানো হয়নি। মহিমবাবুকে আমারই মতন দাঁড়িয়ে থাকতে হলো।

চন্দনদা মহিমবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, বিয়ার খাবেন? গেলাশ অবশ্য একটাই, আপনাকে বোতল থেকে চুমুক দিতে হবে।

মহিমবাবু জিভ কেটে বললেন, আমার ওসব চলে না। জীবনে কখনো ছুঁইনি। তারপর আমার দিকে চেয়ে তিনি সমর্থন আশা করলেন।

চন্দনদা বললেন, গুড। আপনি বিড়ি-সিগারেট খান না, মদ খান না, কাজে ফাঁকি দেন না, বউয়ের খুব বাধ্য, আপনার তো স্বর্গের টিকিট কাটা হয়েই আছে।

আমি সরে পড়লুম সে ঘর থেকে। মহিমবাবু দাঁড়িয়ে থাকবেন, আমি শুধু শুধু সে শাস্তি পেতে যাই কেন।

মিস্তিরি-মজুররা কেউ একতলার বারান্দায়, কেউ দোতলার সিঁড়িতে বসে ছবি আঁকায় নিমগ্ন। কেউ কেউ এখনো হেসে যাচ্ছে।

ওদের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আমি নেমে গেলুম মাঠে। এদিকে সেদিকে কয়েকটা গাছ পোঁতা হয়েছে মাত্র, পরে বাগান হবে। আজ থেকে তিন-চার বছর বাদে জমজমাট হয়ে যাবে এই জায়গাটা। কত লোক কাজ করবে, কত নোংরা জমা হবে, মানুষের রেষারেষিতে দূষিত হবে বাতাস। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বনতুলসীর জঙ্গল। বনতুলসীর প্রতি মায়া করে তো সভ্যতার অগ্রগতি থেমে থাকবে না।

এখানকার সীমানা-পাঁচিলের ওধারেও কিছু বনতুলসী ফুটে আছে। একটা পাতা ছিঁড়ে গন্ধ নিলাম। এই গন্ধটাই স্মৃতিতে থেকে যাবে।

খানিক বাদে একটা ঘণ্টা বাজার ঝনঝন শব্দ হলো। অর্থাৎ টিফিন টাইম শেষ। অন্য দিন ঐ ঘণ্টা আমি বাজাই।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চন্দনদা বলল, এই নীলু, কাগজগুলো নিয়ে আয়। পরীক্ষার হলের গার্ডের মতন ছাত্রদের কাছ থেকে উত্তরপত্র সংগ্রহ করার মতন আমি ওদের কাছ থেকে ছবিগুলো নিতে লাগলুম। নিতে নিতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। ওরা কি আমাদের সঙ্গে মস্করা করছে নাকি? ফুলমণির কাগজটা নিয়ে আমি কটমট করে তাকালাম তার দিকে। সে মুখ ফিরিয়ে আছে, তার মুখখানা বিষাদ মাখানো।

চন্দনদা বললেন, দেখি দেখি!

একটার পর একটা সব কাগজ উল্টে গিয়ে চন্দনদা হাহাকারের মতন বলে উঠলেন, এ কী? ঐ মেয়েটার কোটা?

কোনো কাগজেই কোনো ছবি নেই। যা আছে তা কহতব্য নয়।

ইরফান আলি এঁকেছে একটা বাড়ির নক্শা। সোজা সোজা দাগে। আর কয়েকজন এঁকেছে কাঠি-কাঠি হাত-পা-ওয়ালা আর গোল মুণ্ডু যেসব মানুষ গুহাচিত্রে আঁকা হয়, সেই রকম কিছু। কেউ এঁকেছে পদ্মফুল, কেউ এঁকেছে পাঁচ ইঞ্চি আমগাছে দেড় ইঞ্চি সাইজের আম ঝুলছে। সাঁওতালরা কেউ কিছু আঁকেনি। সারা কাগজ ভরে কাটাকুটি করেছে। কেউ বা পেন্সিলের চাপে কাগজ ছিঁড়ে ফেলেছে।

প্রত্যেকটা কাগজে আমি নম্বর লিখে দিয়েছিলুম। সুতরাং কে কোন্ কাগজ পেয়েছিল তা আমার আন্দাজ আছে। ফুলমণির কাগজটা এক নম্বর, যে শুধু গোল গোল দাগ দিয়েছে, আর কিছু না।

সেই কাগজটা চন্দনদা উল্টেপাল্টে অনেক ভাবে দেখলেন। তারপর হতাশ ভাবে বললেন, নাঃ কিচ্ছু না! এ কী হলো রে, নীলু?

মহিমবাবু কাগজগুলোকে নিয়ে দ্রুত চোখ বোলালেন। তারপর হ্যা হ্যা করে অট্টহাস্য করে উঠলেন। এরা যে কেউ কোনো ছবি আঁকতে পারেনি, সেটা যেন তাঁরই বিপুল জয়।

চন্দনদা বললেন, সবাই ছবি আঁকতে পারে না ঠিকই, কেউ কেউ একটা সোজা দাগও টানতে পারে না। কিন্তু এতজনেরও মধ্যে একজন অন্তত…কাল দেয়ালে যে ছবিটা দেখলুম।

মহিমবাবু বললেন, বাজে, সব বাজে।

আমি বললুম, চন্দনদা, আমাদের বোধহয় গোড়াতেই একটা ভুল হয়ে গেছে চন্দনদা মুখ তুলে আমার দিকে সরু চোখে তাকাল।

আমি বললুম, আমরা ওদের কাগজ-পেন্সিল দিয়েছি। ওদের মধ্যে অনেকে জীবনে কখনো পেন্সিলই ধরেনি। কলম-পেন্সিল দিয়ে কী করে লিখতে হয়, সেটাও তো শেখা দরকার। হাতেখড়ির সময় বাচ্চাদের কলম ধরতে শেখানো হয় না? এদের হাতেখড়িই হয়নি, এরা আরও শিশু।

চন্দনদা বললেন, এটা একটা পয়েন্ট বটে। এরা পেন্সিল ধরতে জানে না। আমি বললুম, যারা জীবনে কখনো দেশলাই কাঠি জ্বালেনি, তাদের হাতে তুমি একটা দেশলাই দাও জ্বালতে পারবে না। অথচ কাজটা খুব সোজা! মেয়েরা কত সহজে সুই-সুতো দিয়ে শেলাই করে, কিন্তু তুমি আমি চেষ্টা করলে….

মহিমবাবু বললেন, বাদ দিন, এবার এসব কথা বাদ দিন! মিঃ ঘোষাল, আমাদের চার নম্বর প্লটের ঢালাইটা কি কালই হবে? আকাশে মেঘ জমেছে। আজই তা হলে সব ব্যবস্থা করতে হয়।

চন্দনদা মহিমবাবুর মুখের দিকে খানিকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, আমার মাথায় আর একটা আইডিয়া এসেছে। আজ আর টিফিনের পরে কাজ করতে হবে না। ওদের হাফ-ডে ছুটি।

—এমনি এমনি ছুটি দিয়ে দেবেন?

—এমনি এমনি নয়। ওদের দিয়ে আবার ছবি আঁকাব!

—মিঃ ঘোষাল, কোম্পানি ওদের বিনা কাজে মাইনে দেবে?

—কোম্পানির ব্যাপারটা আমি দেখব। বিনা কাজ মানে কী, ছবি আঁকাটা একটা কাজ নয়?

—আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু সেটা কি কোম্পানির কাজ?

—আলবাৎ! আমরা এখানে কারখানা বানাব, শহর বসাব, কিন্তু তাতে স্থানীয় লোকদের জীবনযাত্রার কোনো ক্ষতি যাতে না হয়, সেটা দেখাও আমাদের কোম্পানির দায়িত্ব। জীবনযাত্রা মানে শুধু খাওয়া-পরা আর চাকরি নয়। কালচারাল অ্যাকটিভিটিও তো আছে। কেউ যদি ভালো ছবি আঁকে কিংবা গান গায় কিংবা খেলাধুলোয় ভালো হয়, তাদেরও এনকারেজ করতে হবে। এখন কে কেমন ছবি আঁকে দেখছি, পরে গানের ব্যাপারটা দেখতে হবে। তারপর খেলাধুলোর প্রতিযোগিতা।

আমার দিকে চেয়ে চন্দনদা বললেন, সবাইকে ডাক।

মিস্তিরি মজুররা এর মধ্যে আবার কাজে লেগে গেছে।

আমি বুঝতে পারি, আমার চাকরিটাই এখানে অবান্তর। এরা এখানে ফাঁকি দিতেই শেখেনি। কেউ দেরি করে আসে না, কত দূরের গ্রাম থেকে আসে, তবু ঠিক সময় আসে, ছুটির আগে কেউ পালাবার ছুতো খোঁজে না। মাইনেটা এদের কাছে নিমক, নিমক খেলে তা ঠিক ঠিক শোধ দিতে হবে। আমার কাজটাই বরং ফাঁকির।

কাজ ছেড়ে চলে আসবার জন্য সবাইকে ডাকতে এরা বেশ অবাক হলো। চন্দনদা হাত তুলে সবাইকে চুপ করার ইঙ্গিত দিয়ে বক্তৃতার ঢঙে বলতে লাগল, শোনো, অন্যদিন তোমরা যা কাজ করো, আজ তোমাদের তা করতে হবে না। রোজ রোজ এক কাজ আর ভালো লাগে? আজ তোমরা সবাই ছবি আঁকো। যে যা পার আঁকো। চেষ্টা করলে কিছু না কিছু পারবেই। গামলায় চুন গুলে নাও, তারপর আঙুল দিয়ে কিংবা কাঠি বা বুরুশ দিয়ে যার যেমন খুশি দেয়ালে আঁকো। যার ছবি আমার পছন্দ হবে, তাকে আমি একশো টাকা প্রাইজ দেব।

ইরফান আলি অপ্রসন্ন ভাবে বলল, আজ তিনতলা গাঁথনি আরম্ভ করেছি, এক ধারটা শেষ হয়ে যেত!

চন্দনদা বলল, কাল হবে, কাল হবে। যাও, যাও, সবাই শুরু করো। মিস্তিরি-মজুররা ছত্রভঙ্গ হবার পর চন্দনদা মহিমবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আঁকতে পারেন?

মহিমবাবুর বিয়ার খাওয়ার প্রস্তাবে যে রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সেইরকম ভাবেই প্রায় আঁৎকে উঠে বললেন, ছবি? আমি? না, না, না—

চন্দনদা বলল, তা হলে চলুন, আপনি আর আমি কাজ করতে যাই। চার নম্বর সাইটটা দেখে আসি। এরা আঁকুক। নীলু, তুই চেষ্টা করতে পারিস। এক যাত্রায় আর পৃথক ফল হবে কেন? তোর ছবি ফার্স্ট হলে তুই পাবি একশো টাকা!

চন্দনদার জিপ সশব্দে বেরিয়ে গেল।

এদিকে চুন গোলা শুরু হয়ে গেছে। ছবি আঁকতে পারুক বা না পারুক, চন্দনদার আদেশটাকেও এরা কাজ বলে ধরে নিয়েছে। হতে পারে এটা সাহেবের খেয়াল, কিন্তু এর জন্য তো মাইনে কাটা যাবে না।

ফুলমণি সম্পর্কেই আমার বেশি কৌতূহল। ঐ বোবা মেয়েটা কালকের ছবিটা কেন মুছে দিল আজ সাত সকালে এসে? অত ভালো ছবি আঁকে, ও কি সত্যিই পেন্সিল ধরতে জানে না? কিংবা ও লজ্জা পেয়ে গেছে?

অন্যদের সঙ্গে ফুলমণিও চুন গুলছে।

আমি কিছুক্ষণ বই নিয়ে বসে রইলুম ঘরটার মধ্যে। আধঘণ্টা বাদে অন্যদিনের মতনই বেরিয়ে পড়লুম কাজ ‘পরিদর্শনে। ইরফান আলি ও আর দুজন এক জায়গায় বসে বিড়ি ফুঁকছে। ইরফান আলি হেড মিস্তিরি, চুনের কাজে হাত দিতে বোধহয় তার সম্মানে বাধে।

অন্য অনেকে কিন্তু বিভিন্ন দেয়ালে ছবি আঁকতে শুরু করেছে। কাঠির মাথায় ন্যাকড়া জড়িয়ে তৈরি করেছে বুরুশ। কেউ কেউ আঁকছে শুধু আঙুলে।

ফুলমণি আঁকছে দোতলার একটা দেয়ালে! খুব দ্রুত হাত চালাচ্ছে সে। ঐ দেয়ালে যে রোদ পড়েছে, তার রংটা যেন অন্যরকম। ওঃ হো, উল্টো দিকটা উত্তর, সেদিকটা খোলা। উত্তরের আলো ছবি আঁকার পক্ষে প্রকৃষ্ট, মেয়েটা তা জানল কী করে?

চুনে আঙুল ডুবিয়ে সে লম্বা লম্বা টান দিচ্ছে। কী আঁকছে বোঝাই যাচ্ছে না। মেয়েটার চোখ শুধু আঙুলের ডগায়।

দূর থেকে আমি তার টেকনিকটা লক্ষ করলুম। কখনো আঙুল চ্যাপ্টা করে টানছে মোটা মোটা রেখা, কখনো নখ দিয়ে ফুটিয়ে তুলছে সরু সরু রেখা। তার ডান হাতের একটা নখ বেশ বড়।

ওর মনঃসংযোগের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আমি নেমে গেলুম নীচে। অন্য যে তিনটি সাঁওতাল মেয়ে সব সময় হাসাহাসি করে, তারাও এখন আঁকায় ব্যস্ত, একজন তীর ধুনক হাতে এক বীরপুরুষের রূপ ফুটিয়ে তুলেছে অনেকটা, মন্দ নয় তো ছবিটা!

একা একা একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার মনে হলো, চন্দনদাকেই একটা কিছু পুরস্কার দেওয়া উচিত। এমনিতে চন্দনদাকে আমার খুব একটা পছন্দ নয়। নানা রকম হুজুগ তুলে প্রায়ই নিজের সংসারে নানারকম গোলমাল পাকায়। একবার তো নীপা বউদির সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। বাবা-মায়ের ঝগড়ায় তিতিবিরক্ত হয়ে ওদের মেয়ে মুমু আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল!

কিন্তু একটা কোম্পানির বড়সাহেব হয়ে, নিজের মিস্তিরি-মজুরদের দিয়ে কাজ করাবার বদলে ছবি আঁকাচ্ছে, এ রকম কী ভূভারতে আর কোথা পাওয়া যাবে? চন্দনদার হুজুগগুলো আলাদা ধরনের।

হঠাৎ গোঁ গোঁ শব্দ করে একটা লরি এসে থামল গেটের সামনে। লরি ভর্তি বালি।

অন্যদিন লরিতে সুরকি, বালি, ইঁট বা সমেন্ট এলে ইরফান আলিই সব কিছু বুঝে নেয়। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় পাশে, মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে। আমাদের লোকেরাই ওসব নামিয়ে নেয় লরি থেকে।

আজ তো সে প্রশ্নই ওঠে না।

প্রথম কথা, আমাদের মিস্তিরি মজুররা এখন শিল্পী, তাদের শারীরিক পরিশ্রম করার কথা নয়। শিল্পীর আঙুল এখন বালিতে ডুবতেই পারে না।

দ্বিতীয় কথা, লরিওয়ালা তার লোক দিয়ে যদি মালটা নামিয়ে দিতে চায়, তাতেও শব্দ হবে, শিল্পীদের ব্যাঘাত ঘটবে! অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা যামিনী রায় ছবি আঁকছেন। আর কাছেই কিছু লোক হুসহাস শব্দ করে লরি থেকে বালি নামাচ্ছে, এ দৃশ্য কি কল্পনা করা যায়? আমাদের এই নবীন শিল্পীরা কেউ যে অবনী ঠাকুর বা যামিনী রায় হচ্ছে না, তা কে বলতে পারে?

লরি ড্রাইভার নেমে দাঁড়িয়েছে, তাকে আমি বললুম, আজ মাল নামানো হচ্ছে না, ওয়াপস যাও, কাল আও।

বিকেলবেলা জায়গাটা এত নিস্তব্ধ দেখে লরিওয়ালা কিছুটা কৌতূহলী হয়েছে, আমার কথা শুনে আরও অবাক হলো।

সে জিজ্ঞেস করল, কিউ।

আমি বললুম, মিস্তিরি লোক আভি ছবি আঁকতা হ্যায়। তসবির, তসবির, তসবির বানাতে হ্যায়।

সে বলল, কেয়া?

বিস্ময়ে লোকটির চোয়াল ঝুলে গেছে। কিছুই বুঝতে পারছে না। লোককে চমকে অবাক করে দেওয়াটা আমার প্রিয় খেয়াল। আমি ওকে আরও গুলিয়ে দেবার জন্য এক হাতের পাঞ্জায় পেন্সিল বুলোবার ভঙ্গি করে বললুম, ছবি, ছবি! এই সময় ইরফান আলি ছুটতে ছুটতে এলো। এক মুঠো বালি নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে বলল, কেইসান বালি লায়া? মোটা দানা। ঠিক হ্যায়, ওহি কোনাসে উতারো।

আমি বললুম, আজ বালি উতারোবে না। কাল আনবে।

ইরফান আলি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, আমি জোর করে বললুম, কাল, কাল একদিন পরে বালি এলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।

ইরফান আলিকে জব্দ করে এবং হতভম্ব লরি ড্রাইভারকে ফিরিয়ে দিয়ে আমায় বেশ তৃপ্তি হলো। প্রতিদিন তো আর এরকম ঘটনা ঘটে না।

পাঁচটা বাজার একটু পরে আকাশে ঘনিয়ে এল মেঘ। আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে আলো। এরপর আর ছবি আঁকা যাবে না, ইলেকট্রিসিটিও নেই। ওদের মেয়াদ ছটা পর্যন্ত।

আকাশের অবস্থা দেখেই সাত তাড়াতাড়ি চন্দনদা চলে এল মহিমবাবুকে সঙ্গে নিয়ে। ব্যস্ত হয়ে বলল, যতদূর হয়েছে তাই-ই দেখা যাক। আর দেরি করা যাবে না।

শুরু হলো একতলার দেয়াল থেকে

ইরফান আলি কিছুই আঁকে নি। অন্য দু’জন কলের মিস্তিরিও চুন ছোঁয়নি হয়তো তাদের কোনো রকম সংস্কার আছে।

চন্দনদা ইরফান আলিকে জিজ্ঞেস করল, কী আলিসাহেব, আপনি কিছু আঁকলেন না?

ইরফান আলি চাপা বিদ্রূপের সুরে বলল, আমার একশো টাকার ইনাম দরকার নেই, বড়বাবু। ওরা কেউ নিক।

আমি চন্দনদার হাতে মৃদু চাপ দিলুম। যারা কিছু আঁকেনি, তাদের কোনো চাপ না দেওয়াই ভালো।

একতলার দেয়ালগুলো দেখতে দেখতে এগোলুম আমরা। অন্যদের তুলনায় সাঁওতালদের আঁকাই চোখে পড়ার মতন। তারা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু এঁকেছে। সাঁওতালদের গ্রামে গিয়েও দেখেছি, তারা বাড়ির সামনে আল্পনা দেয়, মাটির দেয়ালে অনেক কিছু এঁকে রাখে। বাসন্তী নামে একটি মেয়ে, যে সব সময় ফিকফিকিয়ে হাসে আর উঁচু স্কেলে কথা বলে, সে এঁকেছে একটা সম্মিলিত নাচের দৃশ্য। সাত-আটটি নারী পুরুষ কোমর ধরাধরি করে আছে।

চন্দনদা সেই ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, বাঃ।

বাসন্তী হেসে উঠে জিজ্ঞেস করল, কেমন গো বাবু?

চন্দনদা আবার বলল, বাঃ!

আমি চন্দনদাকে ওপরে যাবার জন্য তাড়া দিতে লাগলুম।

‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। সবাই শিল্পী হয় না, একজন দু’জনই হয়। কোনো সন্দেহ নেই, ফুলমণিই এখানে একমাত্র শিল্পী। অন্যরা দর্শনীয় কিছু কিছু এঁকেছে বটে। কিন্তু খাঁটি অর্থে ছবি বলতে যা বোঝায়, তা এই একখানাই।

ফুলমণি তখনো ছবিটা শেষ করছিল, আমাদের দেখে এক পাশে সরে গেল। বড় দেয়াল জুড়ে ফুলমণি এঁকেছে একটা ল্যান্ডস্কেপ। পাহাড়ের তলা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট নদী, সেই নদী দিয়ে পার হচ্ছে কয়েকটা মোষ, একটা মোষের পিঠে বসে আছে রাখাল, তার মাথার ওপরে উড়ছে কয়েকটা বক। শুধু চুন নয়, খানিকটা কাঠকয়লাও ব্যবহার করা হয়েছে। চুনের ফ্যাটফেটে সাদা ভাবটার মধ্যে খানিকটা কালো মিশিয়ে গভীরতা আনা হয়েছে অনেকখানি।

চন্দনদা অভিভূত ভাবে একবার ছবিটার দিকে, আর একবার ফুলমণির দিকে তাকাতে লাগল। সত্যিই, বিশ্বাস করা যায় না যে, যে-মেয়েটা সারাদিন মাথায় ইঁট বয়ে জীবিকা অর্জন করে, সে কী করে এমন ছবি আঁকে। লেখাপড়া জানে না, দুনিয়াটা চেনে না। ছবির ইতিহাস সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, অথচ আধুনিক ছবির ধারার সঙ্গে এ ছবির রীতিমত মিল আছে। কোনো রকম শিক্ষা ছাড়া এ রকম ছবি আঁকা যায়?

চন্দনদা ফুলমণির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ও মেঝেন, তোমায় ছবি আঁকা কে শেখাল? তুমি অন্য কোনো ছবি দেখে এটা এঁকেছ?

ফুলমণি কোনো উত্তর দিল না।

আমি বললুম, চন্দনদা, ছাদ থেকে এই নদীটা দেখা যায়। আজ সকালেই আমি দেখেছি!

আমাকে মাথায় করে ইঁট বইতে হয় না, দেয়াল গাঁথতে হয় না, আমি ছাদে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে দূরের দৃশ্যটা উপভোগ করেছিলুম। ফুলমণি সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত ছিল। তার মধ্যেই সে এই দৃশ্যটা দেখল কখন? শুধু দেখেনি, মনে গেঁথে নিয়েছে।

অন্যরা ভিড় করে এই ছবি দেখতে এসেছে। অনেকেই ছবি আঁকতে পারে না, ছবি দেখার চোখও থাকে না। ছবি দেখার অভ্যেস যাদের নেই, তারা রিয়েলিস্টিক ছবি দেখেও বিষয়বস্তু চিনতে পারে না।

আমি ছাদের দৃশ্যটা উল্লেখ করায় ওদের একজন বলল, হ হ, লদী বটে!

অন্য একজন বলল, কালা কালা উগুলান কী, খাঁসী লয়?

বাসন্তী, যে কিছুটা আঁকতে পারে, সে বলল, কানা নাকি তুই, খাঁসী কুথায়, ওগুলান কাড়া, বড় বড় শিং….

চন্দনদা বলল, এই মোষগুলো দ্যাখ, লাইনের কী জোর! একটাও স্ট্যাটিক নয়। প্রত্যেকটার ঘাড় ঘোরানো, পা তোলা আলাদা। কেউ কম জলে, কেউ বেশি জলে। যারা সাধারণ ছবি আঁকে, তারা মোষ আঁকতে গেলে আখাম্বা একটা মোষ এঁকে দেয়। এ ছবি অসাধারণ।

আমি বললাম, পাখিগুলো দ্যাখো। সামান্য একটা করে প্যাচ দিয়েছে, কিন্তু ঠিক বোঝা যায়, ওগুলো কাক কিংবা চিল নয়, উড়ন্ত বক।

চন্দনদা আঙুল তুলে বলল, আমার সবচেয়ে ভালো লাগছে এই মোষটা। এবার আমারও অবাক হবার পালা। চারটে মোষ ঠিক চেনা যাচ্ছে। কিন্তু চন্দনদা যেখানে আঙুল দেখাচ্ছে, সেখানে মোষ কোথায়? প্রথমে মনে হয়েছিল, ছবির মধ্যে এমনি একটা ধ্যাবড়া পড়ে গেছে। ভালো করে দেখে মনে হলো, জলে একটা কিছু ভেসে যাচ্ছে!

আমি বললুম, মোষ কই? ওটা, ওটা যেন জলে ভাসছে একটা তিনকোনা কিছু, অনেকটা যেন মনে হচ্ছে সাইকেলের সিট!

চন্দনদা বিরাট জোরে হা-হা করে হেসে উঠল।

তারপর বলল, তুই যে পিকাসোর ঠিক উলটো বললি! পিকাসোর সেই বিখ্যাত গল্পটা জানিস না?

—কোনটা?

—পিকাসোর বাড়িতে একবার চোর এসেছিল। খুটখাট শব্দে পিকাসোর ঘুম ভেঙে যায়। পিকাসো কে কে বলে চ্যাচাতেই চোরটা বারান্দা দিয়ে লাফিয়ে পালাল। পিকাসো দৌড়ে বারান্দায় এসে এক ঝলক শুধু দেখতে পেলেন গলি দিয়ে সাইকেল চেপে চোরটা দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে! পরদিন সকালে পুলিশ এসে সব খোঁজ খবর নিতে নিতে পিকাসোকে জিজ্ঞেস করল, আপনি চোরটাকে কেমন দেখেছিলেন, একটু বর্ণনা করতে পারবেন? পিকাসো মুখে কিছু না বলে ছবি এঁকে দিলেন। কী আঁকলেন জানিস? একটা মোষের মাথা!

মহিমবাবু এতক্ষণ কোনো কথা বলেননি, এবার বললেন, অ্যাঁ?

চন্দনদা বলল, পিকাসো যা দেখেছিলেন, হুবহু তাই এঁকেছিলেন। একরকম সাইকেল হয়, দুদিকে হ্যান্ডেল উঁচু হয়ে থাকে। রেসিং সাইকেল যাকে বলে। সেই সাইকেলে বসে মাথা নীচু করে কেউ যদি খুব জোরে চালায়, দূর থেকে একটা শিংওয়ালা মোষের মাথাই মনে হবে। এখানে এই ছবিতে, মোষটা সারা শরীর ডুবিয়ে আছে জলে, শুধু মাথার ওপরটা দেখা যাচ্ছে। তাই তোর মনে হচ্ছে সাইকেলের সিট।

মহিমবাবু বললেন, পিকাসো, খুব বড় শিল্পী, না? নাম শুনেছি। দু’একখানা ছবিও দেখেছি। কিছু বোঝা যায় না মাথামুণ্ডু। না বোঝা গেলে সেটা কি করে ভালো ছবি হয় মশাই?

চন্দনদা মহিমবাবুর কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, মশাই, এ বিষয়েও পিকাসোর নিজেরই গল্প আছে। প্যারিসে একটা পার্টিতে একটি খুব সাজগোজ করা মহিলা এসে পিকাসোকে ধরেছিল। নাকি সুরে অনুযোগ করে বলেছিল, মিঃ পিকাসো, আপনার ছবি দেখে কিছুই বুঝতে পারি না। উল্টো না সোজা, তা পর্যন্ত বোঝা যায় না। এরকম ছবি আঁকার কি কোনো মানে আছে? পিকাসো উত্তর দিলেন, ম্যাডাম, আপনি কখনো চীনে ভাষা শুনেছেন? তার একটি বর্ণও বোঝেন? তার মানে কি আপনার ধারণা, চীনে ভাষার কোনো মানে নেই? সমস্ত চাইনিজরা মিনিংলেস ভাষায় কথা বলে? শিখলেই চীনে ভাষার ঐশ্বর্য বোঝা যায়। ছবি দেখাও শিখতে হয়। না শিখে কথা বলতে আসে মূর্খরা

চন্দনদা এবার আমার দিকে ফিরে বলল, নীলু, গাড়ি থেকে আমার ক্যামেরাটা নিয়ে আয়। এটা আবার কেউ মুছে ফেলার আগেই একটা ছবি তুলে রাখব। আর হ্যাঁ, আমি একশো টাকা পুরস্কার দেব বলেছিলাম। এই ছবি তার অনেক বেশি পাওয়ার যোগ্য। আমি দুশো টাকা দিচ্ছি।

পকেট থেকে পার্স বার করে চন্দনদা বলল, কোথায় ফুলমণি?

ভিড় ফাঁক হয়ে গেল, সবাই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ফুলমণি নেই। কয়েকজন ডাকাডাকি করতে লাগল ওর নাম ধরে। চন্দনদা পিকাসোর লম্বা গল্প ফাদার সময় ফুলমণি সরে পড়েছে।

আমি বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, দূরে মাঠের মধ্য দিয়ে ছুটে ছুটে চলে যাচ্ছে ফুলমণি। শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় তাকে দেখাচ্ছে ঠিক যেন, কিসের মতন? কিসের মতন? কিসের মতন? নাঃ, আমার তো শিল্পীর চোখ নেই, কোনো উপমাও আমার মনে এল না!

ফুলমণি-উপাখ্যান – ৪

পরদিন কাজে এল না ফুলমণি।

চন্দনদার দুশো টাকা বাসন্তীর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে সাঁওতালদের অবিশ্বাস করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বাসন্তী টাকাটা দিয়ে দিয়েছে, ফুলমণি নিতেও আপত্তি করেনি জানা গেল। চন্দনদার হাত থেকে নিতে ও লজ্জা পেয়েছিল। ওর এত লজ্জা আমি কখনো দেখিনি।

এরা পয়সা জমাতে জানে না। হাতে পয়সা থাকলে কাজ করতেও চায় না। ফুলমণির রোজ ছিল বাইশ টাকা, একসঙ্গে দুশো টাকা পেয়েছে, এখন কতদিন কাজে আসবে না কে জানে! পর পর তিনদিন পাত্তা পাওয়া গেল না তার।

চন্দনদা অন্যরকম একটা প্ল্যান করে রেখেছিল। এখানে অনেক ট্রেসিং পেপার লাগে, সেগুলো পাঠানো হয় শক্ত কাগজে মোড়া প্যাকেটে। সেই শক্ত কাগজগুলো কেটে কেটে ঠিক মতন সাইজের করা হলো। দু’তিন রকম রংও জোগাড় করেছে চন্দনদা। সেগুলো আমায় দিয়ে বলেছিল, তুই ফুলমণিকে এই কাগজের ওপর রং দিয়ে ছবি আঁকতে বলবি। আঙুল দিয়ে হোক বা যেভাবেই আঁকুক। দেয়ালে চুন দিয়ে আঁকা ছবি কিংবা তার ফটোগ্রাফেরও বিশেষ কোনো মূল্য নেই। কাগজের ওপর আঁকা কয়েকখানা ছবি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নাম করা দু’একজন শিল্পীকে দেখানো যেতে পারে। তার মতামত শুনে বোঝা যাবে, সত্যিই মেয়েটার ছবি আঁকার ক্ষমতা কতখানি।

কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা। কোথায় ফুলমণি? সে নিজে থেকে না এলে তো তাকে জোর করে ধরে আনা যায় না।

আমার ঘরে এসে সন্ধেবেলা চন্দনদা খাটে শুয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটা আজও, আসেনি?

আমি বললুম, নাঃ। ওর গ্রামের অন্য মেয়েদের জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলতে পারে না। আদিবাসীরা কোনো প্রশ্নেরই সরাসরি উত্তর দেয় না। হয় হাসে, অথবা ঘুরিয়ে অন্য কথা বলে। আমি বাসন্তীকে জিজ্ঞেস করলুম, ফুলমণি কেন আসছে না। তার উত্তরে ও প্রথমে খিলখিল করে হাসল। তারপর বলল, আমি যদি এক রোজ না আসি, তুই আমার কথা জিগাস কি, ছোটবাবু? বোলো? এরপর কি ফুলমণি সম্পর্কে আর কৌতূহল দেখানো যায়?

চন্দনদা বলল, দ্যাখ নীলু, আমি ছবি আঁকা কনটিনিউ করিনি বটে, কিন্তু ছবি আমি মোটামুটি বুঝি! আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও মেয়েটা একটা জিনিয়াস। আজকাল ছবির বাজার দারুণ ভালো। একটু নাম করা শিল্পীদের ছবি পনেরো, কুড়ি, তিরিশ, পঞ্চাশ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়। হুসেনের এক এক খানা ছবির দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কিছুদিন আগে একটা গ্যালারিতে একজন প্রায় নতুন শিল্পীর একজিবিশান দেখতে গেসলাম। এক একটা ওয়াটার কালার ছবির দাম ধরেছে পাঁচ হাজার টাকা। আমার ধারণা, এই মেয়েটাও ছবি এঁকে যথেষ্ট রোজগার করতে পারে। একটা গ্রামের অশিক্ষিত গরিব মেয়ে বলে সুযোগ পাবে না, তার গুণের কদর হবে না, কেন?

—একটা কথা জিজ্ঞেস করি, চন্দনদা। এইটাই আমার কাছে ধাঁধার মতন লাগে। সাধারণ গরিব মানুষ, যাদের খাওয়া পরার চিন্তাতেই সারাদিন কেটে যায়, তাদের প্রায় কেউই ছবি-টবির ব্যাপার জানেই না, তবু হঠাৎ দু’একজন ছবি আঁকতে চায় কেন?

–তুই আদিম গুহামানবদের আঁকা ছবি দেখিসনি? তারা কি ছবির বিষয় কিছু জানত? তাদেরও শুধু খাবার জোগাড়ের চিন্তায় দিন কাটত। তখন স্ট্রাগল ফর একজিসটেন্স ছিল সাঙ্ঘতিক। তবু তো তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছবি এঁকেছে।

—অনেকে যে বলে, খুব বৃষ্টির মধ্যে যখন ওরা গুহা থেকে বেরুতে পারত না, তখনই ওরা সময় কাটাবার জন্য দেয়ালের গায়ে ছবি এঁকেছে।

—সময় কাটাবার জন্য অধিকাংশ মানুষই পড়ে পড়ে ঘুমোয়। কিংবা অন্যের সঙ্গে খুনশুটি করে কিংবা সেক্সের তালে থাকে। মাত্র দু’একজনেই ছবি আঁকে। এটাই একটা রহস্য। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে হঠাৎ দু’একজন গানের গলা পায়। দু’একজন কিছু না শিখেও ছবি আঁকতে পারে, দু’একজন করি হয়। শিল্পের লাইনে উন্নতি করতে গেলে সবাইকেই শেষ পর্যন্ত শিখতে হয়, সাধনা করতে হয়। কিন্তু ভেতরে কিছু জিনিস না থাকলে তো হাজার ট্রেইনিং-এও শিল্পী হওয়া যায় না। এক একজনের আবার এই ভেতরের জিনিসটা থাকলেও সুযোগের অভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

আমাদের দেশে এখনো শহরের লোকেরা যত সুযোগ পায়, গ্রামের লোকেরা তার কিছুই পায় না।

—শহরের লোকেরা…ইদানীং সব বড়লোকের ছেলেমেয়েরাই ছবি আঁকা শিখতে যায়, যেখানে সেখানে গানের ইস্কুল, আর কবি, কবিদের তো ইস্কুলও লাগে না, হাজার হাজার কবি, সবাই ভাবে কবিতা লেখাটা খুব সহজ! রিটায়ার্ড জজ, ডকের মজুর, যাবতীয় স্কুল মাস্টার, যাবতীয় প্রেমিক দু’চারলাইন লিখেই ভাবে, এই তো কবিতা হয়ে গেল। আজকাল তো আবার ছন্দ মিলেরও ব্যাপার নেই! তুইও কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিস নাকি কখনো, নীলু?

—রক্ষে করো! দেখছ না আমার হাতের আঙুল, এই আঙুলে কখনো কবিতা বেরুতে পারে? আমি ভুলেও কখনো সে চেষ্টা করিনি!

চন্দনদা উঠে বসে খানিকক্ষণ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই রকম মুখের ভাব দেখলেই বুঝতে পারি, চন্দনদার মাথায় আবার নতুন কোনো প্ল্যান ঘুরছে।

চন্দনদা গাঢ় গলায় বলল, দ্যাখ নীলু, ঐ ফুলমণি মেয়েটার সত্যিকারের প্রতিভা আছে। সেটাকে নষ্ট হতে দেওয়াটা অন্যায়। আমাদের কিছু দায়িত্ব নেই? তা হলে আমরা কিসের মানুষ?

আমি আমতা আমতা করে বললুম, কিন্তু মেয়েটা যদি নিজে না চায়

—ওকে বোঝাতে হবে! ওকে দিয়ে আরও আঁকাতে হবে। আমি ওকে গোল্লায় যেতে দিতে কিছুতেই রাজি নই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, মুশকিল এই, আমি নিজে কিছু করতে পারব না ওর জন্য। আমি কোনো দায়িত্ব নিতে পারব না।

—কেন?

–তার কারণ, ও একটা মেয়ে।

—তাতে কী হয়েছে?

–আরে মেয়ে বলেই তো ঝামেলা। ওর কোনো উপকার করতে গেলেই তোর বউদি খেপে যাবে। সেবারে রোহিণীকে নিয়ে কী কাণ্ড হলো মনে নেই? নীপার ধারণা, কোনো মেয়েকে আমি যদি কিছু সাহায্য করতে যাই, তার মানেই আমি মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছি।

—যাঃ, কী বলছ, চন্দনদা! ফুলমণি সম্পর্কে এ প্রশ্নই ওঠে না। একটা রোগা হাড় জিরজিরে মেয়ে, সাত চড়ে রা কাড়ে না, কোনো কথাই বলে না, তার সঙ্গে আবার প্রেম হতে পারে নাকি!

—তুই বুঝবি না, মেয়েদের যে কিসে কখন ঈর্ষা হয়! তুই আর মেয়েদের সম্পর্কে কতটুকু জানিস! ঐ ফুলমণিটা যদি একটা ছেলে হতো, আমি নিজের টাকা খরচ করে ওকে কোনো আর্টিস্টের কাছে কিছুদিন রেখে দিতাম, ওর ছবির প্রদর্শনী নিয়ে সারাভারতে ঘুরতাম! কিন্তু ওর বেলায় তা পারব না, তোকেই ভার নিতে হবে। তোকে তো আর কেউ প্রেমে পড়ার বদনাম দেবে না, আর বদনাম দিলেই বা তোর কী আসে যায়?

এই সময় হরিলাল হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে এসে খবর দিল, কলকাতা থেকে একটা গাড়ি এসেছে, গাড়ি ভর্তি লোক, তারা চন্দনদাকে খুঁজছে।

আমরা ওপর থেকেই উঁকি মেরে দেখলুম, লালুদার লাল রঙের মারুতি গাড়ি। ভেতরে নীপা বউদি, মুমু আর ওদের বাড়ির রান্নার লোকটি।

লালুদার ঐটুকু গাড়ি থেকে এত জিনিস বেরুতে লাগল যে মনে হলো যেন ম্যাজিক। দু’তিন হাঁড়ি মিষ্টি, অনেক রকমের ফল, বাক্স বাক্স চীজ, বিস্কিট, মাখনের টিন, সার্ডিন মাছের টিন, পাঁউরুটি, জ্যাম, জেলি, আচার…।

এসেই লালুদা ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়ে দিল।

দারুণ ভাবে শুরু হলো রান্নাবান্নার তোড়জোড়। রাত আটটা বেজে গেছে, এ সময় এখানে কোনো দোকান খোলা থাকে না, গ্রামে লোক পাঠিয়ে আনা হলো মুরগি। লালুদা নিজে মদ খায় না, সিগারেট খায় না। অথচ সঙ্গে এনেছে হুইস্কি—ব্র্যান্ডির বোতল, দামি দামি সিগারেটের প্যাকেট। চন্দনদার বাংলোয় আড্ডা চলল রাত পৌনে তিনটে পর্যন্ত।

পরদিন সকাল থেকেই আবার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। লালুদা যেখানে থাকে, সেখানে অন্যদের কথাও বলতে দেয় না, পয়সাও খরচ করতে দেয় না। গ্যাস বিক্রির টাকা যেন অফুরন্ত।

আমাকে ন’টার সময় ঠিক কাজে যেতে হয়। লালুদা সেখানেও উপস্থিত। বাড়ির কনস্ট্রাকশান বিষয়ে আমাকে কত না উপদেশ দিল তার ঠিক নেই। ওটা যে আমার কাজ নয়, তা বলারও সুযোগ পেলুম না। লালুদাকে মহিমবাবুর সঙ্গে ভিড়িয়ে দিতে পারলে হতো। মহিমবাবু এদিকে আসেননি।

পাঁচদিন হয়ে গেল, ফুলমণিরও দেখা নেই।

সন্ধেবেলা চন্দনদা আমায় চুপি চুপি খানিকটা ভর্ৎসনা করে বলল, নীলু, তুই মেয়েটার একটা খবর নিলি না? যদি অসুখ-বিসুখ হয়ে থাকে? ঐ তো রোগা চেহারা, যদি মরে যায়। কাল রবিবার, কাল তুই ওদের গ্রামে যেতে পারিস না?

আমি চুপ করে রইলুম।

ঐ রকম একটা ইচ্ছে আমার হয়েছিল, কিন্তু ঠিক সাহস পাচ্ছি না। আদিবাসীদের গ্রামে এখন আর চট করে যাওয়া যায় না, ওরা সন্দেহ করে। অবস্থা অনেক বদলে গেছে। ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’-ফাত্রি এখন আর চলে না। আমার মতন একটা ছোকরা গ্রামের মধ্যে ঢুকে একটা মেয়ের খোঁজ করলে ওর স্বামীটাই হয়তো আমাকে ধরে পেঁদিয়ে দেবে। আর যদি তীর ধনুক দিয়ে…

মাথায় অন্য একটা মতলব এসে গেল।

রাত্তিরে খাওয়ার টেবিলে যখন গল্প বেশ জমে উঠেছে, তখন আমি ফস করে বলে উঠলুন, মুমু, কাল সকালে আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবি? একটা মস্ত বনতুলসীর ঝোপ আছে, সেটা পেরিয়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ের পাশে ঝরনা।

মুমু বলল, হ্যাঁ যাব, হ্যাঁ যাব!

লালুদা অমনি বলল, কোথায় যাবে নীলমণি? আমি গাড়ি করে নিয়ে যাব। সবাই মিলে যাব।

আমি বললুম, না গাড়িতে গেলে হবে না। সবাই মিলে গেলেও হবে না। একবার শুধু মুমু আর আমি এই ছোটপাহাড়ীতে এসেছিলুম। তখন যেসব জায়গায় ঘুরেছি এখন আমরা দু’জনে সেই সব জায়গা আর একবার দেখব!

লালুদা বলল, ও, সেই যেবার তুমি মুমুকে নিয়ে ইলোপ করেছিলে, নীলকণ্ঠ? নীপা বউদি হেসে ফেলল।

আমি বললুম, দু’বছর আগে মুমু আরও ছোট ছিল। ওর বয়স তখন এগারো। এগারো বছরের মেয়েকে নিয়ে কেউ কখনো ইলোপ করে?

মুমুটা অতি দুষ্টু। মিচকি হেসে বলল, হ্যাঁ, ঠিকই তো। এই নীলকাকা, তুমি সেবার কী সব মিথ্যে কথা বলে আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলে তো! লালুদা বলল, তারপর তুমি মুমুকে অযোধ্যা পাহাড়ে ছেড়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলে। নীলকমল, আমার সব মনে আছে!

চন্দনদা আমার দিকে তাকিয়ে সমর্থনের হাসি দিল।

মুমু আমার পাসপোর্ট। মুমুর মতন একটি কিশোরী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কোনো আদিবাসীদের গ্রামে গেলে কেউ ভাববে না, আমি কোনো কুমতলবে এসেছি। ফুলমণির গ্রামের কয়েকজন আমাকে চেনে, ওরা আমার কাছে কাজ করে, ওদের মোটেই উগ্র-হিংস্র বলে মনে হয় না, তবু সাবধানের মার নেই। মুমুর মুখখানায় সদ্য কৈশোরের লাবণ্য মাখা, ওকে দেখলেই পছন্দ করে সবাই। পরদিন ভোরবেলা, লালুদা জাগবার আগেই বেরিয়ে পড়লুম আমি আর মুমু। রাত্তিরে বেশ জোর কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভোরের বাতাস রীতিমতো শিরশিরে। বৃষ্টির জলে এখানে কাদা হয় না, মাটিতে সোঁদা সোঁদা ভাব। গাছপালাগুলো সব যেন স্নান করে ফিটফাট সেজে আছে।

মুমু বলল, আগেরবার তো আমরা পাহাড়ের দিকে যাইনি!

আমি বললুম, তুই তো চন্দনদার ওপর রাগ করে, অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পড়লি এক সময়। তারপর তো সন্ধেবেলায় আমরা ফিরে গেলুম কলকাতায়। দুপুরটাতে আমি একা একা এদিকে ঘুরে গেছি। একটা খুব সুন্দর ছোট্ট নদী আছে।

মুমু বলল, অ্যাই ব্লু, আমার যখন আঠেরো বছর বয়স হবে, তখন তুমি আমায় নিয়ে সত্যি ইলোপ করবে? বেশ মজা হবে তা হলে!

আমি বললুম, তুই যা সুন্দর হচ্ছিস দিন দিন, আঠেরো বছরে তোর এত বন্ধু জুটে যাবে যে তখন আমায় প্রায় পাত্তাই দিবি না!

—আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেলে বুঝি অনেক বন্ধু হয়?

—হ্যাঁ, তখনই তো জীবনের শুরু।

—ইস, কবে যে আঠেরো বছর আসবে!

—আর পাঁচ বছর বাদেই।

—এই শোনো ব্লু, আঠেরো বছর বয়েসে যখন আমার অনেক বন্ধু হয়ে যাবে, তখন আমি যদি তোমাকে পাত্তা না দিই, তুমি কিন্তু তখনো আসবে আমার কাছে। তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না।

—আহা-হা-হা, তুই অন্য বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবি, তবু আমি তোর কাছে আসব কেন রে?

—হ্যাঁ তোমাকে আসতেই হবে। আসতেই হবে। বলো আসবে।

–সে আমি এখন কিছু বলতে পারছি না।

–না, তুমি আসবে। প্রমিজ করো। এক্ষুনি প্রমিজ করো। না হলে আমি যাব না! মুমু একটা সোনাঝুরি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে পড়ল।

হালকা সোনালি রঙের শালোয়ার-কামিজ পরে এসেছে আজ, রংটার সঙ্গে ভোরের রোদ্দুরের মিল আছে। মাথার চুল উড়ছে একটু একটু। চোখের কোণে এখনো যেন ঘুম লেগে আছে একটু একটু। ছেলেমানুষীতে ভরা মুখখানাতে রাগ রাগ ভাব।

মেয়েটা সত্যিই খুব রূপসী হবে। এর মধ্যেই লম্বা হয়েছে অনেকটা!

কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত দিয়ে বললুম, পাগলী একটা! পাঁচ বছর আগেকার প্রতিজ্ঞার কি কোনো দাম আছে? পাঁচ বছরে কত কী বদলে যেতে পারে! পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আমি ঠিক এক বছরের ফিলজফি নিয়ে বেঁচে থাকি। মুমু আমার হাত ছাড়িয়ে সরে গিয়ে বলল, এক বছরের ফিলজফি? মানে কী আগে বলো!

আমি বললুম, সেই গল্পটা জানিস না! একজন বিদেশীকে এক রাজা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিল।

—মৃত্যুদণ্ড…মানে ডেথ সেনটেন্স?

-হ্যাঁ। মৃত্যুদণ্ড মানে ডেথ সেনটেন্স। আজকাল অনেক বাংলা কথার ইংরিজিতে মানে বলে দিতে হয়।…রাজা মৃত্যুদণ্ড দেবার পর সেই বিদেশী বলল,

মহারাজ, আমাকে যদি বাঁচিয়ে রাখেন, তা হলে আপনার সবচেয়ে যে প্রিয় ঘোড়াটা, সেটাকে আমি আকাশ দিয়ে ওড়া শিখিয়ে দিতে পারি, আপনি সেটায় চেপে আকাশে ঘুরবেন। মহারাজ শুনে হকচকিয়ে গিয়েও বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে আমি এক বছর সময় দিলাম! লোকটাকে জেলখানায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার পর অন্য একজন কয়েদি বলল, তুমি কি পাগল নাকি? ঐ কথা বললে—ঘোড়া কখনো আকাশে উড়তে পারে? বিদেশীটি বলল, শোনো, এই এক বছরের মধ্যে রাজা মরে যেতে পারেন, ঘোড়াটা মরে যেতে পারে, কিংবা এমন কিছু আবিষ্কার হতে পারে যাতে সত্যি সত্যি ঘোড়াকে আকাশে ওড়ানো যায়। এই সব কথা ভেবে ভেবে আরও অন্তত একটা বছর তো বেশ মজায় কাটানো যাবে। মুমু খিলখিল করে হেসে বলল, আমি এর নাম দিলুম, নীললোহিত-ফিলজফি! এই রাগ, এই হাসি–এর নাম কৈশোর!

বনতুলসীর জঙ্গলটা পার হয়ে আমরা পৌঁছোলুম নদীটার ধারে। এখন মোষেরা পার হচ্ছে না, বকেরাও নেই, তবু নদীটি ফুলমণির আঁকা ছবি হয়ে আছে। আমি বললুম, তুই সাঁতার শিখেছিস, এখন তো জলে ভয় পাস না। মুমু ঠোঁট উল্টে বলল, মোটে একটুখানি জল, এর মধ্যে সাঁতার কাটা যাবে নাকি?

—হেঁটেই পার হতে হবে, তবে এক এক জায়গায় গভীর আছে। মোষ ডুবে যায়। কিন্তু তোর শালোয়ার-কামিজ যে ভিজে যাবে!

—তুমি আগে বললে না কেন? এর তলায় সুইমিং সুট পরে আসতুম!

—এক কাজ করা যেতে পারে। আমি হবো সিন্দবাদ নাবিক আর তুই হবি বুড়ো, শক্ত করে আমার গলাটা ধরে থাকবি, আমি তোকে পিঠে নিয়ে পার কর দেব।

–আমার বুড়ো হতে বয়ে গেছে। ভিজুক গে শালোয়ার!

যে কোনো নদী পার হতে গেলেই আমার দিকশূন্যপুরের কথা মনে পড়ে। সেখানকার নদী অবশ্য বেশ বড়, খানিকটা সাঁতার দিতেই হয়। সেখানকার বালি সোনার দানার মতন। এ নদীতে বালি নেই, শুধু পাথর।

অল্প জল হলেও স্রোতের টান আছে বেশ।

ছুটির দিনে আমি পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আছি। পাজামা ঊরু পর্যন্ত গুটিয়ে নিতে অসুবিধে নেই। চটিগুলো আস্তে ছুঁড়ে দিলুম অন্য পারে। জল বেশ ঠাণ্ডা। মুমু আমার হাত ধরে এগোতে লাগল।

এই সকালবেলা মুমুর হাত ধরে একসঙ্গে নদী পার হবার মধ্যে যে ভালোলাগা, তা শুধু আজকের জন্য নয়, এক বছরের জন্যও নয়, তা চিরকালের।

মাঝখানটায় বেশ জল, মুমুর কোমর পর্যন্ত ডুবে গেল, আমি ওকে জোর করে তুলে নিলুম বুকে। মুমু হাত পা ছুঁড়ে আপত্তি জানাতে লাগল, আমি প্ৰায় দৌড়ে চলে এলুম এ পাড়ে।

পোশাকের ওপরের অংশটা না ভিজলেই হলো। তলার দিকটা ভিজলে তেমন ক্ষতি নেই, গায়ে ঠাণ্ডা বসে না।

এতক্ষণ একটাও মানুষজন দেখিনি, এবার দেখা গেল দুটে বাচ্চা ছেলেকে। ওরা কি একটা দুর্বোধ্য গান গাইছে। এক লাইন একজন, আর এক লাইন অন্যজন।

এদের ডেকে জিজ্ঞেস করলুম, এই, পিঁজরাল গাঁওটা কোন্ দিকে রে?

উত্তর না দিয়ে ছেলে দুটি পাহাড়ের তলা দিয়ে এক দিকে ছুটে গেল অনেকখানি। একটা বড় শিমুল গাছের তলায় থেমে হাতছানি দিয়ে আমাদের ডাকল। কাছে যেতে একজন বলল, এই নীচা দিয়ে চলে যাও। হুই দেখো পিঁজরাল গাঁও।

ওরা আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকেই নির্দেশ না দিয়ে যে এই পর্যন্ত ছুটে এল, সেটাই এদিককার মানুষের বিশেষত্ব। যদি বলতুম, আমাদের এই গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চল তো, তাও যেত অম্লান বদনে। আমি ছেলেদুটোর মাথার চুলে হাত ডুবিয়ে আদর করে দিলুম।

মুমু জিজ্ঞেস করল, আমরা পাহাড়টার ওপরে উঠব না?

—আগে চল পিঁজরাল গ্রামটা ঘুরে আসি।

–সেখানে কী আছে?

–সেখানে একটা মেয়ে আছে, ছবি আঁকে, তোর চেয়ে অনেক বড়, বোধহয় আমার বয়সী, তার সঙ্গে একটু দেখা করতে হবে!

–ও, তুমি একটা অন্য মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ। সে কথা আগে বলোনি।

চন্দনদা ঠিকই বলেছিল, মেয়েদের যে কখন, কেন ঈর্ষা জেগে ওঠে, তা বোঝা দুঃসাধ্য।

মুমু মুখ গোঁজ করে বলল, আমি এখন এই পাহাড়টার টপে উঠব!

আমি হেসে বললুম, তা হলে তোকে একা উঠতে হবে ভাই। আমি আগে গ্রামটায় যাব।

–তুমি পাহাড়ে যাবে না আমার সঙ্গে?

—তুই আমার সঙ্গে গ্রামে যাবি না! কে কার সঙ্গে কখন কোথায় যাবে সেটা আগে ঠিক করা যাক।

–ব্লু, তুমি একটা অতি পাজী, মিথ্যেবাদী, গুড ফর নাথিং, বেবুন, রিস্টারিং বার্নাল, থাণ্ডারিষং টাইফুনস।

—এই আমাকে গালাগালি দিবি না বলছি, মুমু, এখানে কেউ নেই, মেরে তোকে ঠাণ্ডা করে দেব।

—ইস মারো তো দেখি! দেখি তোমার গায়ে কত জোর। আমিও বুঝি মারতে জানি না?

আমি খপ করে মুমুর একটা হাত চেপে ধরে কটমট করে ওর দিকে তাকালুম। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললুম, চল, আগে গ্রামটা ঘুরে আসি চট করে। বেশি বেলা হলে চড়া রোদ উঠে যাবে। বিকেলে পাহাড়ে উঠব।

মুমু এবার দৌড়তে লাগল আমার সঙ্গে। এ সবই আমাদের খেলা।

পিঁজরাল গ্রামে পৌঁছোতে বেশিক্ষণ লাগল না। এখানকার সব লোকই এর মধ্যে জেগে গেছে। একটা গোয়ালে গরুর দুধ দোয়াবার চ্যাঁ চোঁ শব্দ হচ্ছে। সরু রাস্তা দিয়ে ছোটাছুটি করছে মুরগি।

একজন কালো পাথরের তৈরি মূর্তির মতন লোক একটা ছোট মোষের বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলুম, ও মাঝি, ফুলমণি কোন বাড়িতে থাকে?

লোকটি একটুও অবাক হলো না, কোনো রকম কৌতূহলও প্রকাশ করল না। খানিকটা এগিয়ে একটা মেঠো পথ দেখিয়ে বলল, হুই যে তালগাছ, তার পাশে।

আমার আগের অভিজ্ঞতায় জানি, সাঁওতালরা খুবই অতিথিপরায়ণ হয়, মানুষকে সহজেই বন্ধু ভাবে নেয়। কোনো কারণে ওরা খেপে গেলেই মুশকিল। বাইরের কিছু লোক নানা ধরনের বাঁদরামি করে ওদের খেপে যাবার কারণও ঘটিয়েছে।

তালগাছটা পর্যন্ত যাবার আগেই একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল বাসন্তী।

সে হাসিমুখে বলল, আরে ছোটাবাবু, ফুলমণির খবর নিতে এসেছ বুঝি?

নিজের ওপর পুরো দায়িত্ব না দিয়ে আমি বললুম, বড়বাবু পাঠালেন। ও আর কাজ করবে কিনা জানা দরকার। না হলে নতুন লোক নিতে হবে।

বাসন্তী মুমুর দিকে চেয়ে বলল, কী সোন্দর বিটিয়া। তোমার মেয়ে বুঝি?

মুমু লাজুক ভাবে আমার দিকে তাকাল।

আমি বললুম, আমাকে এত বুঢ়ঢ়া ভাবিস বুঝি? আমার এত বড় মেয়ে থাকবে কী করে? এ তো বড়বাবুর মেয়ে।

বাসন্তীকে নিয়ে আমরা ঢুকলুম ফুলমণির বাড়ির আঙিনায়।

কোনো সাঁওতালের বাড়িই আমি অপরিচ্ছন্ন দেখিনি। যত গরিবই হোক, ওরা ঘর-দোর-উঠোন ঝকঝকে তকতকে করে রাখে। মাটির বাড়ির দেয়ালেও একটা ময়লা দাগ থাকে না।

এ বাড়ির উঠোনে একটা খাটিয়ার ওপর বসে আছে এক বৃদ্ধ। মাথার চুল ধপধপে সাদা, চোখে একটা নিকেলের ফ্রেমের চশমা, তার কাচ এত মোটা যে বৃদ্ধটি প্রায় চোখে দেখতে পায়ই না বলা যেতে পারে। বৃদ্ধটির হাতে একটা হুঁকো।

আমাদের পায়ের শব্দ পেতেই বৃদ্ধটি মুখ ফিরিয়ে বললেন, কউন?

আমি বললুম, নমস্কার।

বৃদ্ধটি এবার চোখ কুঁচকে আমাদের দেখার চেষ্টা করে পরিষ্কার বললেন, আপনারা কোথা থেকে আসছেন?

আমি বললুম, ছোটপাহাড়ী থেকে। এ বাড়ির ফুলমণি সেখানে কাজ করে। অনেকদিন যাচ্ছে না—

বাসন্তী বৃদ্ধের কাছে গিয়ে নিজেদের ভাষায় কী সব বোঝাল।

বৃদ্ধ দুবার মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, হাঁ? বসুন, বসুন, এই বসবার জায়গা দে।

বাসন্তী একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে দুটো মাছিয়া নিয়ে এল। সে দুটোতে আমি আর মুমু বসলুম একটা আতা গাছের নীচে।

বাড়ির পেছন দিক থেকে এবার এল ফুলমণি, তার দু’হাতে মাটি লাগা। আমাদের দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

আমি বললুম, কী, ফুলমণি, তুমি আর কাজে যাও না কেন?

ফুলমণি মৃদু গলায় বলল, যাব!

যাক, মেয়েটা তা হলে সত্যিই বোবা নয়। এই প্রথম ও আমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলল। ওর গলার আওয়াজটা খসখসে ধরনের, ইংরিজিতে যাকে বলে হাস্‌কি ভয়েস।

বৃদ্ধ বললেন, ঘরের ছাদটা ফুটো হয়ে গেছে। সেই ছাদটা সারাচ্ছে ক’দিন ধরে। আমি তো কোনো কাজ করতে পারি না—

তারপর ব্যস্ত হয়ে বাসন্তীকে বললেন, আরে বাবুদের জন্য চা নিয়ে আয়। আমি বললুম, না না, আমরা চা খাব না। আমরা এদিকে বেড়াতে এসেছিলুম, এক্ষুনি চলে যাবে।

—তা হলে লাড্ডু খান।

মুমু বলল, আমি এক গেলাস জল খাব।

ফুলমণি জল আনতে ভেতরে চলে গেল।

বাড়িটার মাটির দেয়ালে নানা রকম ছবি আঁকা। রঙিন ছবি। কিন্তু এ ছবিগুলো এমন কিছু দর্শনীয় নয়। বিভিন্ন ঠাকুর-দেবতা, বজরংবলী। গোদা গোদা ধরনের। একেবারে অপটু হাতের কাজ নয়, তবে ফুলমণির আঁকা যে ছবি দুটো আগে দেখেছি, তার সঙ্গে মেলে না।

আমি বৃদ্ধকে বললুম, ফুলমণি তো ভালো ছবি আঁকে। কোথায় শিখল?

বাসন্তী বলল, এগুলো ফুলমণির শ্বশুর এঁকেছে গো!

বৃদ্ধ বললেন, হাঁ, আমি ছবি আঁকতাম। আগে মেলায় মেলায় নিয়ে গিয়ে অনেক ছবি বিক্রি করেছি। এখন চক্ষে দেখি না। ভগবান চোখের রোশনি কমিয়ে দিয়েছে!

যাক। তা হলে একটা পটভূমি আছে। ফুলমণি একেবারে আকাশ থেকে পড়ে ছবি আঁকতে বসেনি। বাড়িতে একটা ছবির কালচার আছে। শ্বশুরের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছে, কিছু শিখেছে। ওর ভেতরে ছবি আঁকার বীজ ছিল, সেটা জল-মাটি পেয়েছে। অনেক সময় শিষ্য ছাড়িয়ে যায় গুরুকে। তাই দেয়ালের এই গোদা গোদা ছবির চেয়ে ফুলমণির ছবির অনেক তফাৎ!

বাসন্তীকে জিজ্ঞেস করলুম, ওর মরদ কোথায়?

বাসন্তী ডান হাতটা দু’বার ঘোরাল। অর্থাৎ নেই। কিন্তু বিয়ে হয়নি, না মরদ ওকে পরিত্যাগ করেছে, না মরে গেছে, তা ঐ একটা ইঙ্গিত থেকে বুঝব কী করে? তবে শ্বশুর যখন আছে তখন বিয়ে হয়েছিল নিশ্চয়ই।

ফুলমণি দুটো কাঁসার গেলাশ, এক ঘটি জল ও একটা কলাই করা প্লেটে কয়েকটা তিলের নাড়ু নিয়ে এল। এরাও অতিথিকে শুধু জল দেয় না।

মুমু আমার দিকে বিপন্ন ভাবে তাকাল। অর্থাৎ সে নাড়ু খাবে না। লোরেটো স্কুলে পড়া মেয়ে তিলের নাড়ু খাবে, তিলের নাড়ুদের অত সৌভাগ্য আজও হয়নি! আমিই একটা মুখে দিলুম। না, খেতে সত্যিই ভালো নয়। একবার একটা বাড়িতে তিলের নাড়ু গোপনে ছুঁড়ে ফেলে দিতে গিয়ে আমায় খুব জব্দ হতে হয়েছিল। এখানে এসব চলবে না।

জলটা খুব ঠাণ্ডা আর সুস্বাদু।

বৃদ্ধ বললেন, আমার আঁকা আরও ছবি দেখবেন? এই, ভিতর থেকে নিয়ে আয় না। আমি কলকাতাতেও গেছি বাবু। যামিনীবাবু ছিলেন না একজনা, যামিনীবাবু খুব বড় আর্টিস, তিনি আমার ছবি দেখেছিলেন। বাঁকুড়ায় তাঁর বাড়িতে ডেকেছিলেন।

ফুলমণি ভেতর থেকে অনেকগুলো বড় বড় কাগজ নিয়ে এল। তাতে রঙিন ছবি আঁকা। তুলি দিয়ে আঁকা হয়েছে। একটু মলিন হয়ে গেছে ছবিগুলো।

আমরা মাছিয়া-দুটো এগিয়ে নিয়ে গেলুম বৃদ্ধের খাটিয়ার কাছে।

বৃদ্ধা চশমা খুলে ঝুঁকে পড়ে বলল, এটা কোন্ ছবি রে?

বাসন্তী বলল, রাম-লছমন আর সীতাজী!

বৃদ্ধ বললেন, হাঁ, এটা ভালো। হনুমানজী সমুদ্র পার হচ্ছে, সেটা দেখা? ডিসেম্বর মাসে এসপ্লানেড অঞ্চলে প্রচুর নতুন ক্যালেন্ডার দেখা যায়, তাতে এই ধরনের ছবি থাকে। কয়েকটা দেখার পরই একঘেয়ে লাগল। কিন্তু ভদ্রতা রক্ষার জন্য সবগুলো দেখতেই হবে। বৃদ্ধ দেখাচ্ছেনও খুব উৎসাহের সঙ্গে।

আমি একবার মুখ তুলে বাসন্তীকে জিজ্ঞেস করলুম, ফুলমণির এ রকম কাগজে আঁকা ছবি নেই?

বাসন্তী ফুলমণিকে বলল, নিয়ে আয় না! আছে তো! ফুলমণি প্রবল ভাবে মাথা নাড়ল।

বাসন্তী বলল, আমি আনছি।

ফুলমণি তার হাত চেপে ধরল। বাসন্তী তবু জোর করে তার হাত ছাড়িয়ে চলে গেল ভেতরে। নিয়ে এল পাঁচখানা ছবি।

প্রথম ছবিটাই সাঙ্ঘাতিক। অনেকখানি ফাঁকা মাঠ, তার মাঝখানে একটা বাচ্চা মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। মাথার ওপর আকাশ। মেয়েটা ছাড়া আর কিছুই নেই বলে মাঠের মধ্যে মেয়েটার একাকিত্ব খুব দারুণ ভাবে ফুটেছে। আকাশের রং লাল, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো লাল, আর মেয়েটার রং মেরুন। রঙের এমন সাহসী ব্যবহার কদাচ দেখা যায় না। ফুলমণি কি গগ্যার ছবি দেখেছে নাকি।

বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন্টা? এটা কোটা?

বাসন্তী বলল, সেই যে একটা ছোট মেয়ে গো। আমরা বলি, বড়কা মাঝির হারিয়ে যাওয়া মেয়ে

বৃদ্ধ বললেন, হাঁ। আমার বহু তার ছবি ফিনিশ করে না। অর্ধেক এঁকে রেখে দেয়। এই ছবিতে চার পাঁচখানা গাছ আঁকা উচিত ছিল কিনা বলুন। বৃষ্টিতে গাছের পাতা খসে পড়ছে, দু-একটা ছাগল-গরু থাকতে পারে, মেয়েটা মাঠে চরাতে নিয়ে গেছে।

আমার কালিদাসের শকুন্তলা নাটকের একটা অংশ মনে পড়ল।

রাজা দুষ্মন্ত ছবি আঁকতে পরতেন। গর্ভবর্তী শকুন্তলাকে তিনি অন্যায় ভাবে তাড়িয়ে দিয়েছেন রাজসভা থেকে। তারপর ছ’বছর কেটে গেছে, হঠাৎ এক জেলের কাছ থেকে আংটিটা ফেরত পেয়ে রাজার সব মনে পড়ে। তখন রাজা দুষ্মন্ত বিরহে হা-হুতাশ করছেন আর শকুন্তলার ছবি এঁকে সেই ছবির সঙ্গে কথা বলছেন। রাজার বিদূষক মাধব্য রাজাকে সান্ত্বনা দিতে আসেন। মাধব্য দেখলেন রাজার আঁকা ছবিটি। দুই সখীর মাঝখানে, আমগাছে হেলান দিয়ে বসে আছে শকুন্তলা। ছবিটার খুব প্রশংসা করতে লাগলেন মাধব্য। তাই শুনে রাজা বললেন, ছবিটা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। পেছনে আঁকা হয়নি মালিনী-নদী, দূরে একটা পাহাড়ও থাকা দরকার। ওখানে হরিণের পাল ঘুরে বেড়ায়, একটা বড় গাছের ডালে ঋষিদের পরিধেয় বল্কল ঝোলে, একটা কৃষ্ণ মৃগ আর বাচ্চা হরিণ ওখানে খেলা করে এই সবও ছবিটার মধ্যে দিতে হবে।

মাধব্য তখন মনে মনে বললেন, সর্বনাশ। এর পর লম্বা দাড়িওয়ালা বুড়ো বুড়ো ঋষিদের ভরিয়ে দিয়ে ইনি ছবিটা একেবারে নষ্ট করে ফেলবেন দেখছি। মাধব্যের এই মন্তব্যেই বোঝা যায়, কালিদাস অতি উচ্চাঙ্গের আর্ট ক্রিটিক ছিলেন।

ফুলমণির এই ছবিটায় আর একটা দাগ টানলেই ছবিটি নষ্ট হয়ে যেত। ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মাঠের মধ্যে একলা হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির কান্নাও যেন শোনা যায়।

চন্দনদা ঠিকই ধরেছিলেন। ফুলমণি সত্যিকারের শিল্পী। ছাই চাপা আগুন। প্রত্যেকটা ছবিই ভালো, কল্পনা ও রঙের খেলায় অভিনব। পুরোপুরি বাস্তব বা ফটোগ্রাফিক করেও সে আঁকে না, ছবির বিষয়টা প্রধান হয় না, গল্প বলার চেষ্টা নেই। রেখা, রং ও আয়তন মিলে কিছুটা রহস্যময়তা এসে যায়। এ রকম ছবি বোঝার সাধ্য ওর শ্বশুরের নেই। অশিক্ষিত, গ্রাম্য পরিবারের এই বধূটির ক্ষমতা খানিকটা যেন অলৌকিকের পর্যায়ে পড়ে।

আমি ফুলমণির দিকে তাকালুম।

শীর্ণ চেহারার এই অসুন্দর মেয়েটির মুখে এখন এমন একটা তীব্রতা ঝলমল করছে, যাতে একটা আলাদা রূপ ফুটে উঠেছে। অন্যদের থেকে এ মেয়েটি একেবারেই আলাদা।

মুমু ফিসফিস করে বলল, নীলকাকা, এই ছবিগুলো একদিনের জন্য নিয়ে যেতে দেবে? বাবাকে দেখাতুম।

মুমু আমার ঠিক মনের কথাই বলল! আমি বৃদ্ধের উদ্দেশে জোরে বললুম ছবিগুলো আমি নিয়ে যেতে পারি? পরে ফেরত দেব!

বৃদ্ধ বললেন, আগে একজন বাবু এসেছিল। দু’বছর আগে। ক’খানা ছবি নিল। বলল, আবার আসবে। আর এল না।

ও তাহলে ফুলমণির প্রতিভার আমরাই প্রথম আবিষ্কারক নই? আগেও কেউ দেখেছে। এবং সেই আগের কারণটি এদের কাছে অবিশ্বাসের কারণ ঘটিয়েছে। এই সব আগের লোকদের নিয়ে মহা জ্বালা হয়, আগের লোকদের জন্য পরের লোকদের ভুগতে হয়।

বললুম, আমি তো ছোটপাহাড়ীতেই থাকি। ফুলমণি কাজ করতে যাবে, ওকে দিয়ে দেব।

বৃদ্ধ নিজের ছবিগুলো আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ঠিক আছে, নিয়ে যান। কেউ যদি বিশ-পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনতে চায় বেচে দেবেন! যা দাম পাওয়া যায়। একশোটা টাকা পেলে একটা বকরি কিনব। বকরির দুধ খেলে আমার তাগৎ হয়।

দু’জনের আঁকা ছবিই গুছিয়ে নিয়ে একটু বাদে আমরা উঠে দাঁড়ালুম।

ফেরার পথে মুমু বলল, এই মেয়েটার যখন খুব মনখারাপ থাকে, তখন ও ছবি আঁকে, তাই না?

আমি চমকে গেলুম। মুমুর কাছ থেকে আমি ওরকম কথা আশা করিনি। মুমু তো ছবির-টবির ধার ধারে না। ফুলমণিদের বাড়িতে ঢোকবার মুখে ও একবার বলেছিল, বড্ড গোবরের গন্ধ! এতক্ষণ ওকে বসিয়ে রেখে শাস্তিই দেওয়া হয়েছে।

আমি বললুম, তাই নাকি। কী করে তুই বুঝলি?

মুমু বলল, আমার মনে হলো।

হয়তো মুমু ঠিকই বুঝেছে। এই মনে হওয়াগুলোর কোনো ব্যাখ্যা করা যায় না।

আরো পড়ুন: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা

ফুলমণি-উপাখ্যান – ৫

নীপা বউদি বলল, এই সব ছবি, সত্যি একটা কামিন এঁকেছে?

চন্দনদা বলল, হ্যাঁ। নীলু ওর বাড়ি দেখে এসেছে। ওর শ্বশুরও ছবি আঁকে, সেগুলোও তো দেখলে।

নীপা বউদি বলল, এত ভালো যে আঁকতে পারে, তাকে দিয়ে তোমরা জনমজুরি করাচ্ছো? যার মাথায় রয়েছে এমন সব দারুণ ছবির আইডিয়া, তার মাথায় ইট বওয়াচ্ছ? চীনের কালচারাল রেভোলিউশানের পরেও তোমাদের শিক্ষা হলো না?

চন্দনদা ছাত্রজীবনে নকশালপন্থী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, সেই প্রসঙ্গে একটা খোঁচা দেওয়া হলো!

চন্দনদা তর্কের মধ্যে না গিয়ে বলল, আমি কী করব বলো! এ ধরনের শিল্পীদের সাহায্য করা সরকারের কাজ। জীবিকার জন্য বেচারা ইঁট বওয়া ছাড়া আর কী করবে?

নীপা বউদি বলল, কেন, তোমাদের কোম্পানিও তো অনেক কিছু করে। পাহাড়ে চড়ার জন্য টাকা দেয়। আর একজন শিল্পীকে দিতে পারে না?

মেয়েদের একটা পর্বত অভিযানের টিমকে স্পনসর করেছিল চন্দনদার কোম্পানি। সেই দলের লিডার ছিল রোহিণী। সেই সময় ঐ পর্বত অভিযান ও রোহিণীর সঙ্গে চন্দনদা একটু বেশি বেশি জড়িয়ে পড়েছিল। সেই ব্যাপারে আর একটি খোঁচা।

চন্দনদা আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল, যার মানে হলো, ফুলমণিকে এনে একবার তোর বউদির সামনে হাজির করাতে হবে। যাতে নীপা বোঝে যে ফুলমণির সঙ্গে প্রেম করা সম্ভব নয়!

নীপা বউদি বৃষ্টি ভেজা মেয়েটার ছবিটা তুলে বলল, এই ছবিটা আমার এত ভালো লাগছে, রেখে দিতে ইচ্ছে করছে। এটা যদি আমি কিনে নিই?

লালুদা এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল, যদিও চুপ করে থাকা তার স্বভাব নয়। এবারে ছবি বিষয়ে নীপা বউদির মতামত সবটা শুনে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেনো না, কেনো! কত দাম? সত্যিই অসাধারণ ছবি। একসেলেন্ট। মাস্টার পিস। কত দাম দিতে হবে, বলো না, নীলমাধব! দুটোও তো কেনা যেতে পারে। এইটা আর ওইটা।

লালুদা অন্য হাতে হনুমানের সমুদ্র পার হবার ছবিটা তুলে ধরল।

নীপা বউদি বলল, ধ্যাৎ। ওটা তো ওর শ্বশুরের আঁকা, একেবারে বাজে। দুটো ছবির তফাত বোঝেন না?

লালুদা সঙ্গে সঙ্গে বলল, অফকোর্স তফাত আছে! খুবই তফাত। কোনো তুলনাই চলে না। বাচ্চা মেয়েটার ছবি, অপূর্ব, অপূর্ব! এটা কিনে ফেলা যাক। নীলাচল, কত দাম দিতে হবে? বেশি করে বলো, যাতে মেয়েটির সাহায্য হয়।

নীপা বউদি বলল, দাঁড়ান, একবার মেয়েটিকে কিছু টাকা দিলে এমন কি সাহায্য হবে? ওর আত্মীয়স্বজনরা সেই টাকা খেয়ে ফেলবে। একটা কিছু ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে আজেবাজে কাজ ছেড়ে ও শুধু ছবি আঁকতে পারে। গভর্নমেন্টের কোনো স্কলারশিপ-টলারশিপ জোগাড় করা যায় না?

চন্দনদা বলল, এমনি এমনি কি হয়? একটা একজিবিশন করা দরকার, ক্রিটিকদের মতামত দরকার। সেসব এখানে বসে কে করবে? কে ওর ব্যাপারে মাথা ঘামাবে?

হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ায় চন্দনদা থেমে গেল। একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে হেসে নিয়ে বলল, একটা কাজ করা যেতে পারে। শিগগিরই আমি কলকাতায় যাব। শুক্‌কুরবার মহরমের ছুটি, শনিবারটা ম্যানেজ করলে পরপর তিন দিন, নীলু, তুইও আমার সঙ্গে কলকাতায় যেতে পারিস। ছবিগুলো নিয়ে চল। আমি তো সময় পাব না, তুই কয়েকজনকে দেখিয়ে আন!

সেই রকমই ব্যবস্থা হলো। লালুদার ছোট গাড়িতে জায়গা হবে না। তাই একসঙ্গেই বেরিয়ে চন্দনদা আর আমি এলুম ট্রেনে, অন্যরা গেল গাড়িতে।

কলকাতায় কোনো বড় আর্টিস্ট কিংবা ক্রিটিককে আমি চিনি না। মানে, আমি অনেককে চিনি, কিন্তু তাঁরা আমায় চেনেন না। এ পর্যন্ত কখনো কোনো শিল্পীর বাড়িতে যাইনি।

শিল্পী শান্তনু চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে আমি হতাশ!

গল্ফ গ্রীনের একটা ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি, চন্দনদাই নিয়ে গেল সেখানে। চন্দনদার সঙ্গে তাঁর আগে থেকেই পরিচয় ছিল। সারা ভারতেই তাঁর খ্যাতি, খুব ব্যস্ত মানুষ, তাই টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হয়েছিল।

শিল্পীদের চেহারা ও চরিত্র সম্পর্কে আমাদের মনের মধ্যে একটা ছবি তৈরি হয়ে আছে। গল্প-উপন্যাসে, সিনেমার আসরে সেই রকম শিল্পীদেরই দেখি, তাঁরা বোহেমিয়ান, মাথায় বাবরি চুল, মুখে দাড়ির জঙ্গল, মদের নেশায় সব সময় চোখ লাল, পোশাক উদ্ভট, তাঁদের স্টুডিয়োতে সব কিছু এলোমেলো ভাবে ছড়ানো, মেয়েদের নিয়ে তাঁরা ছিনিমিনি খেলেন।

কোথায় কী! শান্তনু চৌধুরীর ফ্ল্যাটটা নিখুঁত ভাবে সাজানো, মাথায় অল্প টাক, দাড়ি কামানো, ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা, ফর্সা, গোলগাল চেহারায় তাঁকে মনে হয় এক বিশিষ্ট ভদ্রলোক। বসবার ঘরটির দেয়ালে একটি মাত্র ছবি, দেলাক্রোয়া’র একটি ছবির বড় প্রিন্ট। এখনো যে দেলাক্রোয়া’র এ রকম কোনো ভক্ত আছে, তা আমার জানা ছিল না।

বসবার ঘরে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পর শিল্পী নিজেই এসে আমাদের ডেকে নিয়ে গেলেন তাঁর স্টুডিওতে। উত্তর আর পূর্ব ধার খোলা একটা বড় ঘর, দেয়ালের গায়ে ঠেসান দেওয়া বেশ কয়েকটি ক্যানভাস, ইজেলে একটি অসামাপ্ত ছবি। আগেই শুনেছি, শান্তুনু চৌধুরী প্রতিদিন নিয়ম করে আঁকেন, মাসে অন্তত দুটি অয়েলের ছবি শেষ করেন। তাঁর এক-একটি ছবির দাম অন্তত পঞ্চাশ হাজার টাকা।

চন্দনদার সঙ্গে কথায় কথায় তিনি জানালেন যে, তার এই স্টুডিওতে আর কুলোচ্ছে না, এই গল্ফ গ্রীনেই তাঁর নিজস্ব একটা বাড়ি হচ্ছে, সম্পূর্ণ তিনতলা জুড়ে হবে স্টুডিও। চন্দনদাকে বাড়ির প্ল্যান দেখিয়ে অভিমত নিলেন, সিমেন্ট ও ইঁটের দাম কত যাচ্ছে তার খোঁজ-খবর জানালেন। তারপর আমরা তাঁর ছবিগুলো দেখলাম। ছবি তিনি খুবই ভালো আঁকেন, রঙের ব্যবহার অসামান্য, শিগগিরই তাঁর এই সব ছবির একটা বড় প্রদর্শনী হবে দিল্লিতে।

ইতিমধ্যে চা এসে গেছে।

চন্দনদা আমায় বললেন, নীলু, এবার বার কর।

শান্তনু চৌধুরী ঈষৎ চঞ্চল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ছবি আঁকো নাকি?

চন্দনদা বললেন, না, না, ও আঁকে না, ছোটপাহাড়ীতে একটি আদিবাসী মেয়ে…

ফুলমণির কাহিনীটা বলতে লাগলেন চন্দনদা, শান্তনু চৌধুরী অন্যমনস্কভাবে শুনতে শুনতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, তাই নাকি? বাঃ ইন্টারেস্টিং—দেখি, দেখি, ছবিগুলো দেখি

আমি ছবিগুলো মেলে ধরলুম।

শান্তনু চৌধুরী ছবিগুলোর দিকে দ্রুত চোখ বোলালেন, তাঁর মুখের কোনো ভাবান্তর হলো না।

তিনি বললেন, বাঃ, বেশ ভালো, বেশ ভালো!

বৃষ্টি ভেজা মেয়েটির ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে চন্দনদা জিজ্ঞেস করল, এটা কী রকম লাগছে।

শান্তনু চৌধুরী একই সুরে বললেন, বেশ ভালো, বেশ ভালো।

চন্দনদা জিজ্ঞেস করল, ছবিগুলোর বিশেষ কোনো গুণ আছে বলে আপনার মনে হয়?

শান্তনু চৌধুরী বললেন, বললাম তো, ভালোই এঁকেছে। একজন আদিবাসী মেয়ের পক্ষে, ভালোই বলতে হবে।

তারপরই প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, আপনাদের কোম্পানি এবার কার ছবি দিয়ে ক্যালেন্ডার করছে?

চন্দনদা বলল, খুব সম্ভবত হেমেন মজুমদারের। ওঁর ফ্যামিলির সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। এসব তো আমি একা ঠিক করি না। আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টার…।

শান্তনু চৌধুরী খুব চাপা বিদ্রূপের সুরে বললেন, ওঃ, হেমেন মজুমদার? আচ্ছা! বেশ বেশ।

এরপর তিনি আমাদের দিকে এমন ভাবে তাকালেন, যেটা স্পষ্ট উঠে যাওয়ার ইঙ্গিত।

বোঝাই গেল, ফুলমণির ছবিগুলোকে উনি কোনো গুরুত্বই দেননি। যেটুকু প্রশংসা করেছে, তা নিছক ভদ্রতার। তবে কি ফুলমণির ছবি নিয়ে আমরা বাড়াবাড়ি করছি? আমাদের উচ্ছ্বাস সবটাই ভুল!

দরজার কাছ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে শান্তনু চৌধুরী বললেন, অনেক ইয়াং ছেলেমেয়ে আমাকে ছবি দেখাতে চায়, আমি সময় পাই না, সকলের জন্য সময় দিতে গেলে আমার নিজের কাজ…তবে যতদূর সম্ভব চেষ্টা করি সাহায্য করার।

আমাদের মুখে আর কথা নেই। ফুলমণি সামান্য মনোযোগেরও অযোগ্য!

বাইরে বেরিয়ে আমি খানিকটা রাগের সুরে বললুম, চন্দনদা, শান্তনু চৌধুরীর এত নাম, কিন্তু দেখলে শিল্পী বলে মনেই হয় না। মনে হয়, কোনো বড় অফিসার!

চন্দনদা বলল, তুই বুঝি ভেবেছিলি, সকালবেলাতেই মাতাল হয়ে একটা মেয়ের গলা জড়িয়ে বসে থাকবে। ওসব নাইনটিনথ সেঞ্চুরির ধারণা! তখন একটা বোহেমিয়ানিজম আর খ্যাপামির যুগ ছিল। এখন শিল্পীরাও সামাজিক মানুষ। মাতলামি আর বেলেল্লাপনা করলে সীরিয়াস কাজ করা যায় না এ যুগে। কী দারুণ কমপিটিশন! ছবি আঁকাও অন্য আর পাঁচটা কাজের মতন একটা কাজ!

এ কথাটা আমার পছন্দ হলো না। ছবি আঁকা, কবিতা লেখা এসব কিছুতেই অন্য কাজের মতন নয়। তা হলে চেষ্টা করলেও সবাই পারে না কেন? যারা পড়াশুনোয় ফার্স্ট হয়, তারা কি এগুলো পারে? চন্দনদাই আগে উল্টোকথা বলেছে।

আমরা গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, এই সময় একজন কেউ বলল, এই চন্দন, এখানে কোথায় এসেছিলি?

একজন প্রায় ছ’ফুট লম্বা, ছিপছিপে ভদ্রলোক, ব্রোঞ্জের মতন গায়ের রং, তীক্ষ্ণ নাক, কৌতূহলী চোখ, দাড়ি কামানো, কিন্তু মাথার চুল বড় বড়, প্যান্টের ওপর ফতুয়া জাতীয় একটা জামা পরা, হাতে একটা ছড়ি, তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে।

ভদ্রলোকের বয়েস চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের মধ্যে, ঋজু শরীর, হাতে ছড়ি নেবার কথা নয়, ওটা বোধ হয় স্টাইল করার জন্য।

তিনি আবার বললেন, শান্তনুর কাছ থেকে ছবি কিনতে এসেছিলি বুঝি? কত টাকা খসল?

চন্দনদা আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, নীলু, এ হচ্ছে অনিন্দ্য দাস। আমরা ইস্কুলে একসঙ্গে পড়েছি।

নাম শুনেই চিনতে পারলুম। ইনিও খুবই বিখ্যাত শিল্পী। কয়েক বছর আগে একটা ফরাসি কাগজে এঁর সম্পর্কে একটা বড় আর্টিকেল বেরিয়েছিল ছবি-টবি দিয়ে, তার অনুবাদ আবার ছাপা হয় বাংলা কাগজে। ফরাসি দেশের সার্টিফিকেট পাওয়ার পরেই এঁকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায় কলকাতায়।

চন্দনদা বলল, না রে, ছবি কিনতে আসিনি। শান্তনু চৌধুরীকে কয়েকটা ছবি দেখাতে এসেছিলুম।

—তুই আবার ছবি আঁকছিস বুঝি? আবার ইচ্ছেটা চাগিয়েছে? টাকা তো কম রোজগার করিস না।

—ধ্যাৎ, আমি কি আঁকব! এগুলো একটা আদিবাসী মেয়ের। আমাদের ভালো লেগেছিল, তাই শান্তনু চৌধুরীকে দেখিয়ে মতামত জানতে এসেছিলুম।

—শালা, তুই আমাকে আগে দেখাসনি কেন? তুই কাকে বেশিদিন চিনিস, আমাকে, না শান্তনুকে? শান্তনু বড় আর্টিস্ট?

–তোর কথাটা মনে পড়েনি, মানে, তুই তো মেইনলি স্কালপ্টর, তুই মূর্তি গড়িস…

—স্কলাপচার করি বলে ছবি বুঝি না? স্কালপ্টররা ছবি আঁকে না? তোদের রদ্যাঁ ছবি আঁকেনি? দেবীপ্রসাদ, রামকিঙ্কর ছবি আঁকেনি?

আমার দিকে ছড়িটা তুলে অনিন্দ্য দাস বললেন, এই ছেলে, হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কি, বার করো ছবিগুলো।

শান্তনু চৌধুরীর তুলনায় অনিন্দ্য দাসকে প্রায় প্রথম নজরেই আমার ভালো লেগে গেল। প্রাণবন্ত মানুষ, মিষ্টি মিষ্টি ভদ্রতার ধার ধারেন না।

দাঁড়িয়ে দঁড়িয়ে কী করে ছবি দেখাব! চন্দনদার গাড়ির বনেটের ওপর মেলে ধরলুম।

অনিন্দ্য দাস বেশ খুঁটিয়ে খুঁচিয়েই পাঁচটা ছবি দেখলেন। তারপর মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কে এঁকেছে?

চন্দনদা ফুলমণির বৃত্তান্ত সবিস্তার বলতে যেতেই অনিন্দ্য দাস তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সে কোথায়?

-সে তো ছোটপাহাড়ীতে থাকে।

—তাকে নিয়ে আয়।

—সেটা খুব মুশকিলের ব্যাপার। আচ্ছা অনিন্দ্য, বল তো, এই ছবিগুলো ঠিক কেমন? মেয়েটার সত্যিই কোনো ট্যালেন্ট আছে?

—ধুস! বোগাস! এ রকম ছবি যে-কেউ আঁকতে পারে। আর্টিস্টকে না দেখলে, তার সঙ্গে কথা না বললে কি ছবি বোঝা যায়? তার কতটা ভিশান আছে, তার ডেপ্থ কতটা, তার স্টাগ্ল করার ক্ষমতা, এ সব না বুঝলে শুধু কটা ছবি দেখে কী হবে?

—আঁকার ক্ষমতা, নতুনত্ব আছে কি না, সেটুকু তো অন্তত—

—আবার বাজে কথা বলছিস, চন্দন! একি ইম্প্রেশানিস্টদের ছবি, যে প্রত্যেকটা ছবিরই আলাদা একটা প্রাণ আছে, আলাদা একটা সত্তা আছে, কে এঁকেছে তা বলে দেবার দরকার হয় না, প্রত্যেকটা ছবিই স্বয়ংসম্পূর্ণ।

আমি বললুম, সব ভালো ছবিই তো এ রকম হয়। ছবি দেখে যা মনে হয়। অনিন্দ্য দাস এক ধমক দিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে তর্ক করো না ছোকরা, তর্ক করো না। যা বলছি শুনে যাও।

আমি তবু প্রতিবাদ করে বললুম, আর্টিস্টদের দেখে, কথা বললেও তো মনে হয় না।

অনিন্দ দাস ঠিক আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরে এবার হে-হে করে হেসে ফেললেন। শান্তনু চৌধুরীর বাড়ির দিকে চোখের ইঙ্গিত করে বললেন, ছবি আঁকলেই কি শিল্পী হওয়া যায়? শান্তনু খুব নাম করেছে, ভালোই আঁকে, নিশ্চয়ই ভালো আঁকে কিন্তু সবই রঙের পোঁচ, বুঝলে, রঙের পোঁচ! ওর মধ্যে যে ফাঁকিবাজি আছে, তা আমরা বুঝি, তোমরা বুঝবে না। স্কালপচার করতে গেলে কব্জির জোর লাগে, আর লাগে এই দুটো এক সঙ্গে।

অনিন্দ্য দাস নিজের মাথায় আর বুকে দুটো টোকা দিলে।

তারপর চন্দনদাকে বললেন, তুই বুঝি শান্তনুর ছবি দিয়ে তোদের কোম্পানির ক্যালেন্ডার করবি ভাবছিস? দে, যত ইচ্ছে তেল দে! কেন, স্কালপচার দিয়ে বুঝি ক্যালেন্ডার করা যায় না? শালা বাঙালিরা ভাস্কর্যের কিছুই বোঝে না। কেষ্টনগরের পুতুল দেখে দেখে চোখ পচে গেছে। কলকাতা শহরে যে মূর্তিগুলো বসিয়েছে, ইচ্ছে করে লাথি মেরে সেগুলো সব ভেঙে দিই!

অনিন্দ্য দাস শান্তনু চৌধুরীর বাড়িতেই যাচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে, উনি শান্তনু চৌধুরীকে একটুও পছন্দ করেন না। তবু দু’জনে নিশ্চয়ই এখন হেসে হেসে গল্প করবেন।

গাড়িতে উঠে চন্দনদা বিমর্ষ ভাবে বলল, কী হলো রে, নীলু। দু-দুজন বিখ্যাত আর্টিস্ট এ ছবিগুলোকে তো পাত্তাই দিল না। আমরা তা হলে বোকার মতন নাচানাচি করেছি?

—কোনো নিরপেক্ষ আর্ট ক্রিটিককে একবার দেখালে হয় না?

–তুই যে অদ্ভুত কথা বললি রে, নীলু! নিরপেক্ষ ক্রিটিক বলে পৃথিবীতে কোনো বস্তু আছে নাকি? সব ক্রিটিকই কোনো না কোনো দিকে হেলে থাকে।

—খবরের কাগজে যাঁরা সমালোচনা লেখেন।

—তুই দেখবি, একই শিল্পীর ছবি, স্টেটসম্যান যাচ্ছেতাই বলে উড়িয়ে দিচ্ছে আর আনন্দবাজার তাকেই মাথায় তুলে নাচছে। আবার এর উল্টোটাও হয়। ছবির জগতে যে-রকম গ্রুপইজম আছে, তা তোর-আমার বোঝার সাধ্য নেই।

–তবু তো কিছু কিছু শিল্পীর নাম সারা দেশেই নাম ছড়িয়ে যায়। তাঁদের ছবির কদর হয়।

—সে হচ্ছে জনসাধারণের বিচার। জনসাধারণই তো আলটিমেট ক্রিটিক। কিন্তু ফুলমণির ছবি জনসাধারণের কাছে পৌঁছোবার কোনো উপায় নেই। কষ্টে—সৃষ্টে একটা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করলেও কেউ আসবে না, ক্রিটিকরা পাত্তা দেবে না। আজকাল গণ্ডায় গণ্ডায় প্রদর্শনী হয় প্রতি সপ্তাহে। বিরাট করে পাবলিসিটি দিতে হবে, উদ্বোধনের দিন মস্ত পার্টি দিয়ে মদের ফোয়ারা বইয়ে দিতে হবে, তবে তো গণ্যমান্যরা আসবে!

—তা হলে আর কিছু করা যাবে না?

—নাঃ।

একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর চন্দনদা জিজ্ঞেস করল, তোর মন খারাপ লাগছে না, নীলু?

—হুঁ।

-কেন মন খারাপ লাগছে জানিস? আমরা সবাই ভেতরে ভেতরে স্বার্থপর। ফুলমণির ছবির কিছু হলো না, সেজন্য আমরা যতটা না দুঃখিত, তার চেয়ে বেশি দুঃখিত এই জন্য যে আমরা ওর উপকার করার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছিলুম, সেটা ব্যর্থ হলো! আমরা হেরে গেলুম। তাই না!

–তাও বলা যেতে পারে।

—মন খারাপ হলে আমার কাবাব আর পরোটা খেতে ইচ্ছে করে। খাবি?

—কাবাব আর পরোটা খুব আনন্দের সময়েও খেতে আমার কোনো আপত্তি থাকে না!

—তা হলে চল পার্ক সার্কাসের দিকে। ওখানে একটা ভালো রেস্তারাঁয়….

হঠাৎ থেমে গিয়ে চন্দনদা গাড়ির ড্রাইভারকে বলল, এই, এই, গাড়ি ঘোরা, চলো তো একবার আলিপুরের দিকে।

আমার বিস্ময় দেখে বলল, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল রে। সিরাজুল তারিক-এর বাড়ি গিয়ে একবার কাবাব খেয়েছিলুম, কী অপূর্ব তার স্বাদ, এখনো জিভে লেগে আছে।

—এখন হঠাৎ তাঁর বাড়িতে গেলেও কি তিনি কাবাব খাওয়াবেন নাকি?

—তুই কি ইডিয়েট রে! নাম শুনে চিনতে পারলি না? সিরাজুল তারিক!

-মানে, যিনি আর্টিস্ট?

—তাছাড়া সিরাজুল তারিক আবার ক’জন আছে? আমার সঙ্গে একদিন আলাপ হয়েছিল। বারবার তিনবার। ওঁর মতামতটাও নেওয়া যাক। উনিও যদি উড়িয়ে দেন, তা হলে ফুলমণির ছবি নিয়ে আমরা আর মাথাই ঘামাব না।—কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করে গেলে কি উনি সময় দেবেন?

—একটা জিনিস লক্ষ করলি তো। বড় কোম্পানির ক্যালেন্ডারে ছবি দেবার জন্য আর্টিস্টরা বেশ ব্যস্ত। অন্তত লাখখানেক টাকা তো পাওয়াই যায়। সিরাজুল সাহেবকে প্রথমে সেই টোপটা দেব। তা হলে ঠিকই সময় পাবেন কথা বলার!

ঠিক আলিপুর নয়, খিদিরপুর ব্রিজের কাছাকাছি সিরাজুল তারিকের পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। ইনি বাংলার প্রবীণ বিখ্যাত শিল্পীদের অন্যতম। মতামতের দিক থেকে খানিকটা ট্র্যাডিশনাল। কিছুদিন আগে খবরের কাগজে ওঁর একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলুম। উনি অল্প বয়েসে অয়েলের কাজ কিছু করেছেন, এখন আর অয়েল ছোঁন না। ওয়াটার কলার আর ওয়াশ-এর কাজই বেশি করেন। আজকালকার অনেক শিল্পীর মতন উনি অ্যাক্রিলিকের চকচকে রং একেবারে পছন্দ করেন না। অয়েল সম্পর্কে উনি একটা গল্পও বলেছেন। আমাদের দেশে তো আগে অয়েলের কাজ হতো না। জাহাঙ্গির বাদশার দরবারে ইংরেজদের দূত হিসেবে গিয়েছিলেন স্যার টমাস রো। অনেক রকম উপহার-উপঢৌকন নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। জিনিসগুলো খুলে খুলে দেখাচ্ছেন। তার মধ্যে একটা অয়েল পেইন্টিং ছিল। সেটা দেখে জাহাঙ্গির বাদশা মুখ কুঁচকে বলেছিলেন, ওটা সরিয়ে নাও, বড্ড’ চকচক করছে।

ওয়াশ-এর ছবির মতনই সিরাজুল তারিক মানুষটি শান্ত, স্নিগ্ধ। চোখ দুটি আশ্চর্য মায়াময়।

নিজেই তিনি দরজা খুলে দিয়ে আমাদের ভেতরে বসালেন। সরু পাজামা ও গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরা, মুখে ধপধপে সাদা দাড়ি, মাথার চুলও সাদা, তবে বেশ পাতলা হয়ে গেছে। গলায় ঝুলছে কালো সুতোয় বাঁধা চশমা। কথা বললেন খুব নরম গলায়। তাঁকে দেখলে ঋষি দরবেশদের কথা মনে পড়ে।

সিরাজুল তারিক সঙ্গে প্রখ্যাত শিল্পী এম এফ হুসেনের চেহারার খানিকটা মিল আছে। কিন্তু হুসেন ফাইভ স্টার হোটেলে উঠলেও রাস্তা দিয়ে খালি পায়ে হাঁটেন, খবরের কাগজের হেডলাইন দেখে সঙ্গে সঙ্গে ছবি এঁকে ফেলেন, এই সব গিমিক সিরাজুল সাহেবের চরিত্রে একেবারেই নেই। তাঁর ছবির বাজার দর বেশ ভালো। তবু তিনি আগেকার চালচলন পাল্টাননি, পুরনো বাড়িটা ছাড়েননি। নিরিবিলিতে থাকতে পছন্দ করেন।

চন্দনদার ক্যালেন্ডারের প্রস্তাবটাকে উনি আমলই দিলেন না। হেসে বললেন, না, না। আমি ছবি দেব কী করে? আমি বছরে পাঁচ-সাতখানার বেশি ছবি আঁকি না। কেউ অর্ডার দিলে তাড়াতাড়ি এঁকে দিতেও পারি না। ছবি আঁকব কি, ফাঁকা ক্যানভাসের সামনে বসে থাকতে থাকতেই দিন কেটে যায়। কত ছবি চোখে ভাসে। সেগুলো এঁকে ফেলার চেয়ে সেগুলো নিয়ে কল্পনায় খেলা করতেই বেশি ভালোবাসি। আমার যে-ক’খানা ছবি বিক্রি হয় আপনাদের দয়ায়, তাতেই বেশ চলে যায়।

চন্দনদা তখন বললেন, আমি একটি মেয়ের আঁকা কয়েকটি ছবি এনেছি। অনুগ্রহ করে একটু দেখবেন?

সিরাজুল সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, অবশ্যই। নিজের ছবি আঁকার চেয়েও ছবি দেখতেই আমি বেশি পছন্দ করি।

প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট ধরে তিনি ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখলেন। একটাও কথা বললেন না। আকাশে মেঘ জমেছে, তিনি আলো জ্বেলে দিলেন ঘরের। ছবিগুলো নিয়ে একবার জানলার কাছে গেলেন, একবার আলোর নীচে ধরলেন, নিজের ইজেলে চাপিয়ে দেখলেন।

তারপর বিহ্বল চোখে চন্দনদার দিকে চেয়ে বললেন, এ আমাকে কী দেখালেন, ঘোষালবাবু? এ ছবি কে এঁকেছেন?

চন্দনদা নার্ভাস গলায় বললেন, এ ছবিগুলো কী ভালো? এর কোনো মূল্য আছে?

সিরাজুল সাহেব বললেন, ভালো মানে কি! আমার আজকের সকালটা ধন্য হয়ে গেল! অসাধারণ! তুলনা নেই। আর মূল্যের কথা বলছেন? এই প্রত্যেকটা ছবির জন্য আমি পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে রাজি আছি। দেবেন আমাকে?

ফুলমণি-উপাখ্যান – ৬

এত দ্রুত যে ব্যাপারগুলো ঘটবে তা আমি ধারণাও করতে পারিনি।

সিরাজুল সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ হলো আকস্মিক ভাবে। খুব ছোটখাটো ঘটনা থেকে কোনো মানুষের নিয়তিটাই বদলে যেতে পারে। চন্দনদার যদি হঠাৎ কাবাব-পরোটা খাবার কথা মনে না পড়ত, তা হলে সিরাজুল সাহেবের কাছে আসাই হতো না। কিংবা, ফুলমণি যদি ছোটপাহাড়ীর বদলে জামসেদপুরে ইট বওয়ার কাজ করতে যেত, তা হলে সে চন্দনদার নজরে পড়ত না, তার ছবি আঁকা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না।

সিরাজুল সাহেব আমাদের ছাড়লেন না, দুপুরে তাঁর বাড়িতেই খেতে হলো। কাবাব-পরোটা নয় অবশ্য, ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ ও ডিমভরা কই মাছের ঝোল। খুব সম্প্রতি তিনি সব রকম মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।

ছবিগুলো সম্পর্কে তিনি উচ্ছ্বসিত!

আমাদের তিনি বোঝালেন ছবিগুলোর বিশেষত্ব কোথায়। যে-কোনো শিল্পীই তার কাছাকাছি পরিবেশ, মানুষজন ও প্রকৃতির যে-বাস্তবতা, তা ফুটিয়ে তুলতে বাধ্য। সমসাময়িক বাস্তবতা সব শিল্পের ভিত্তি। তবে নিছক বাস্তবতা নয় এবং নিছক সমসাময়িকতাও নয়। তার মধ্যে একটা বিশ্বজনীনতা ও চিরকালীনতার ছোঁয়া লাগলেই তা সার্থক শিল্প হয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বললেন, যেমন ধরুন, হ্যামলেট। ওর কাহিনীটা আসলে কী? ডেনমার্কের একটা ছোট্ট রাজ্যের রাজপরিবারের ঘরোয়া কোন্দল। কিন্তু পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের মানুষ ওর রস · অনুভব করতে পারে। কিংবা ধরুন মোনালিসার মুখখানা। লিওনার্দো তো একজন ইতালিয়ান মহিলার মুখ এঁকেছে, তাঁর চোখের সামনে ছিল সমসাময়িক বাস্তবতা, তবু ঐ মহিলার মুখের হাসি চিরকালীন হয়ে গেল।

আমি বললুম, সিরাজ সাহেব, এক আদিবাসী মহিলার ছবি প্রসঙ্গে হ্যামলেট আর মোনালিসার প্রসঙ্গ টানা কি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না।

সিরাজ সাহেব প্রশংসার ব্যাপারে কার্পণ্যে বিশ্বাস করেন না। তিনি বললেন, কেন তুলনা করা যাবে না? আমরা সবাই তো আদিবাসী তাই না? এখানে দেখুন, এই মহিলাটিকে কাছাকাছি যে-সব মানুষজন দেখেছে, গাছপালা, গোরু-মোষ, এই সবই এঁকেছে। ফোক ট্র্যাডিশনও আছে তার রেখার মধ্যে। যামিনী রায়ের মতন মোটা মোটা দাগ। ড্রয়িং-এ হাত পাকা, কিন্তু নিখুঁত ড্রয়িং করেনি, স্টাইলাইজড। এই যে তিনটে মোষ, এই মোষগুলো ছোটপাহাড়ী নয়, সারা পৃথিবীর। এ মেয়েটির অন্তর্দৃষ্টি আছে। এ বড় দুর্লভ, বুঝলেন, খুবই দুর্লভ।

আমি এবার ফস করে জিজ্ঞেস করলুম, আচ্ছা, আপনি তো এত প্ৰশংসা করছেন, কিন্তু শান্তনু চৌধুরী আর অনিন্দ্য দাস একেবারে পাত্তাই দিলেন না কেন? তাঁরাও তো বড় শিল্পী, তাঁরা এ ছবিগুলোর মধ্যে কোনো গুণই দেখতে পেলেন না!

সিরাজ সাহেব চুপ করে গেলেন।

তিনি এতই ভদ্র যে সমসাময়িক কোনো শিল্পী সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে চান না।

চন্দনদা বললেন, ওঁদের অ্যাটিচুড়টা আমি বুঝতে পেরেছি। ওঁদেরও দোষ দেওয়া যায় না, নীলু। কোনো কোনো শিল্পী হয় খুব সেল্ফ সেনটারড! নিজের ছবি ছাড়া আর কিছু নিয়ে মাথা ঘামান না। নিজের সৃষ্টি নিয়েই মগ্ন থাকে। আবার কেউ কেউ গোটা শিল্প জগতটাকে ভালোবাসে, নিজেকে শিল্পী সমাজের সঙ্গে জড়িয়ে রাখে, শিল্প জগতে নতুন কিছু ঘটলেই তারা খুশি হয়ে ওঠে…আমি ঠিক বলছি না সিরাজসাহেব?

সিরাজ সাহেব আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন।

এরপর তিনি আর একটি চমকপ্রদ কথা বললেন।

চন্দনদার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ছোটপাহাড়ীতে কী করে যেতে হয়? আমি মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে চাই। আজই যাওয়া যায় না?

চন্দনদা বলল, আপনি যাবেন সেখানে?

—হ্যাঁ। শুধু এই পাঁচখানা ছবি দেখলেই তো চলবে না। ও আরও কী কী ছবি এঁকেছে দেখতে হবে। ওর আঁকার পদ্ধতিটাও জানা দরকার। ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই!

—ঠিক আছে, আপনি চলে যান মা নীলুর সঙ্গে, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমার অফিসের দু-একটা কাজ, আমায় থাকতে হবে কলকাতায়। নীলু তো আজই ফিরছে।

–আমি যেতে চাই, তার আরও একটা বিশেষ কারণ আছে, ঘোষালবাবু। সামনের সপ্তাহে অ্যাকডেমিতে সারা বাংলা তরুণ শিল্পীদের একটা বড় প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে। ছবি বাছাইয়ের ভার দেওয়া হয়েছে আমার ওপর। আমি এই মেয়েটিকে সুযোগ দিতে চাই। ওর একটা এক্সপোজার হবে। অন্য সব শিল্পীদের ছবির পাশে ওর ছবিও থাকবে, লোকে দেখবে। লোকেরাই ওর বিচার করুক।

—এ তো অতি চমৎকার ব্যাপার। এমন সুযোগ তো আশাই করা যায় না! আমাদের আর কিছু বলতে হবে না। শিল্প-রসিকরাই ওর বিচার করবে!

মেয়েটিকে কলকাতায় আনা যাবে না? প্রদর্শনীতে অন্য শিল্পীরা সবাই থাকবে!

–কেন আনা যাবে না? ওর ভাড়ার টাকা আমি দিয়ে দেব। থাকার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে!

এবার আমি বাধা দিয়ে বললুম, চন্দনদা, ফুলমণি কি আসতে চাইবে? এত লাজুক, কথাই বলতে চায় না, কোনোদিন নিজের জায়গা ছেড়ে বাইরে যায়নি!

সিরাজুল সাহেব বললেন, আমি বুঝিয়ে বলব। আমি তো যাচ্ছি।

চন্দনদা জোর দিয়ে বলল, তাকে আসতেই হবে, যদি সে সত্যিই শিল্পী হতে চায়। শুধু ঘরে বসে ছবি আঁকলেই তো চলে না। শিল্পীকে ছবির ফ্রেমিং পর্যন্ত শিখতে হয়। অন্য কে কী রকম আঁকছে তা জানতে হয়। নিজের অভিজ্ঞতার জগতটাকে বাড়াতে হয়। এই সবই পার্ট অফ দা গেইম। ফুলমণি যদি আসতে না চায়, ছবিগুলো তাকে ফেরত দিয়ে আসবি। বাকি জীবন তা হলে সে ইঁট বওয়া কুলি হয়েই কাটাক। সিরাজুল তারিকের মতন এত বড় একজন শিল্পী নিজে তার কাছে যেতে চাইছেন—

সিরাজুল সাহেব বললেন, আচ্ছা, আগে গিয়েই দেখা যাক না।

চন্দনদা রয়ে গেল কলকাতায়। সিরাজুল সাহবকে নিয়ে আমি ছোটপাহাড়ী পৌঁছোলুম পরের দিন দুপুরবেলা। গেস্ট হাউজে একটা ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমি বললুম, আপনি খেয়ে-দেয়ে এখন বিশ্রাম নিন। কাল সকালবেলা যাওয়া যাবে ফুলমণির গ্রামে।

কিন্তু বৃদ্ধের কি অদম্য উৎসাহ!

তিনি বললেন, ট্রেনে বসে বসে এসেছি, পরিশ্রম তো কিছু হয়নি। বিশ্রামের কী দরকার! চলুন, বিকেলেই দেখা করি আমাদের শিল্পীর সঙ্গে।

আজ ছুটির দিন নয়, ফুলমণি কাজে এসে থাকতে পারে। তার গ্রামে যাবার বদলে আগে একবার কনস্ট্রাকশন সাইটটা দেখা দরকার। অনেকটা হেঁটে যেতে হবে।

সিরাজুল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলুম, আপনাকে আমার সাইকেলে যদি ক্যারি করি, আপত্তি আছে?

উনি হেসে বললেন, আপত্তি কিসের। গেলেই তো হলো।

এত বড় একজন শিল্পীকে আমি আমার সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এটা যেন ভাবাই যায় না। শিল্পীরাও কত সাধারণ মানুষ হয়ে যেতে পারেন!

সিরাজুল সাহবের এক-একখানা ছবির দাম পঁচিশ-তিরিশ হাজার টাকা। ঘরে বসে নিজের ছবি আঁকার বদলে ইনি এতদূর ছুটে এসেছেন এক অজ্ঞাত কুলশীল শিল্পীকে প্রমোট করার জন্য। একেই বলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো!

আমাদের লেবরেটরি বাড়িটার গেটের সামনে নামলুম সাইকেল থেকে। পড়ন্ত বিকেলের আলো হলুদ হয়ে এসেছে। দূরের পাহড়ের চূড়ার কাছে মুকুট হয়ে আছে সূর্য। এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে সেদিকে।

বাড়িটার বাইরের দেয়ালে বাঁশের ভারা বাঁধা। সেই ভারা বেয়ে মাথায় ইঁটের বোঝা নিয়ে উঠছে এক রোগা নারী। রোদ ঝলসাচ্ছে তার পিঠে।

সেই দিকে আঙুল তুলে বললম, ঐ দেখুন আমাদের শিল্পী। সিরাজুল সাহেব অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, কবে আমরা আমাদের দেশের মা-বোনদের এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারব? মেয়েদের কি আমরা অন্য কাজ দিতে পারি না?

আমি বললুম, সিরাজুল সাহেব, মফস্বল শহরে মেথরানী মেয়েরা মাথায় করে গুয়ের পাত্র বয়ে নিয়ে যায়, দেখেননি? এর চেয়ে হীন কাজ কি আর কিছু আছে? কে জানে, সেই মেথরানীদের কেউ ছবি আঁকতে পারে কি না। কিংবা হয়তো আশা ভোঁসলের মতন গানের গলা আছে।

সিরাজুল সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

তারপর বললেন, আমার মেয়ে, আমিনা, তার কথা আপনি শুনেছেন নীলুবাবু?

আমি বললুম, না।

দূরের দিকে চেয়ে তিনি বললেন, সে ছিল আমার চোখের মণি, সে একদিন…যাক, আর একদিন বলব…

সিরাজুল সাহেব হঠাৎ বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ভেতরে এনে আমার ঘরের একমাত্র চেয়ারটিতে তাঁকে বসালুম।

হেড মিস্তিরি ইরফান আলি এসে আমাকে বলল, সাহেব, আমাদের পেমেন্ট এনেছেন, না মহিমবাবু দেবেন?

এখানকার প্রত্যেক মজুরদের আলাদা ভাবে প্রতিদিন টাকা না দিয়ে এক সঙ্গে থোক টাকা দেওয়া হয় ইরফান আলিকে। সে অন্যদের কাজ অনুযায়ী মজুরি দেয়। এ রকমই প্রথা। আমার ছুটি, মহিমবাবুই টাকা আনবেন।

সে কথা বলতে ইরফান আলি খানিকটা অপ্রসন্নভাবে ঘড়ি দেখে বলল, উনি কখন আসবেন, ছুটির সময় হয়ে এল।

আমি বললুম, আপনি সাইকেল নিয়ে মহিমবাবুর কাছে চলে যান না।

এরপর আমি ফুলমণিকে ডাকিয়ে আনলুম এ ঘরে।

একটা মলিন ছাপা শাড়ি পরে আছে ফুলমণি। সেটা অটুটও নয়। লাল ধুলো

লেগে আছে এখানে ওখানে। মুখখানা ঘামে মাখা।

আমি বললুম, ফুলমণি, ইনি হচ্ছেন সিরাজুল তারিক সাহেব। খুব বড় শিল্পী। এঁর আঁকা ছবি দেশ-বিদেশে অনেক জায়গায় দেখানো হয়। তোমার ছবিগুলো এঁর ভালো লেগেছে। তাই তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন।

অন্যদিন ফুলমণি যাকে বলে সাত চড়ে রা কাড়ে না, আজ একজন শিল্পীর কথা শুনে তার প্রতিক্রিয়া হলো।

সে মাটিতে বসে পড়ে সিরাজুল সাহেবের দু’টি পায়ের পাতা স্পর্শ করল।

সিরাজুল সাহেব ব্যস্ত হয়ে বললেন, আরে, না, না, ওঠো মা। ওঠো।

হাত ধরে তিনি ফুলমণিকে তুলতে তুলতে বললে, ইস, এত রোগা কেন? গায়ের জোর না থাকলে ছবি আঁকবে কী করে? মাথায় অতগুলো ইঁট নিয়ে ওঠো, যদি পা পিছলে পড়ে যাও? ভাবলেই ভয় করে।

আমার মনে হলো, আমার কর্তব্য শেষ হয়ে গেল এখানেই। ফুলমণিকে আমি সঁপে দিলাম সিরাজুল সাহেবের হাতে। এবার থেকে উনিই যা কিছু করার করবেন।

পরদিন ভোরে অবশ্য সিরাজুল সাহেবকে ফুলমণিদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে হলো আমাকেই। আমি মহিমবাবুকে বলে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলুম, কিন্তু সিরাজুল সাহেব হেঁটেই যেতে চান। পায়ে হেঁটে নদী পেরুলেন।

এর মধ্যে ফুলমণি সম্পর্কে খানিকটা খোঁজ-খবর পাওয়া গেছে।

ফুলমণির স্বামী মারা গেছে দু’বছর আগে। এর মধ্যে ওর আবার বিয়ে হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল, ওদের সমাজে এরকমই হয়। কিন্তু ফুলমণি বিয়ে না করে রয়ে গেছে শ্বশুরের কাছে। ওর শ্বশুর বৃদ্ধ ও পঙ্গু, তাকে দেখবার আর কেউ নেই। একটা চোদ্দ বছরের ভাতুয়া ছেলেকে ওরা বাড়িতে রেখেছে, ফুলমণি যখন কাজে যায়, তখন সেই ছেলেটি ওর শ্বশুরের দেখাশুনো করে। এই শ্বশুর ফুলমণির ছবি আঁকার গুরুও বটে।

প্রথম দেখে বৃদ্ধকে আমার স্বার্থপর ধরনের মনে হয়ছিল। অবশ্য অসহায় বটে। অসহায় ও দুর্বলেরা বেশি স্বার্থপর হয়ে ওঠে।

এবার আমরা যাবার পর গ্রামের অনেক লোক ভিড় করে দেখতে এল। ফুলমণি সম্পর্কে বাবুশ্রেণীর লোকেরা এত আগ্রহ দেখানোতে ফুলমণি এখানে বেশ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ফুলমণি ছবি আঁকে তা এরা জানে, কিন্তু সেই ছবি নিয়ে বাবুদের এত মাথাব্যথা কেন তা তারা বুঝতে পারে না। অনেকেই বাড়ির দেয়ালের গায়ে ছবি আঁকে, বৃষ্টির জলে তা এক সময় ধুয়ে যায়। ছবির আবার এর চেয়ে বেশি মূল্য আছে নাকি?

আমি এলেবেলে হলেও সিরাজুল সাহেবের চেহারা দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। তিনি একটা ছেঁড়া জামা পরে থাকলেও বোঝা যাবে তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তা ছাড়া, আমি ছোটপাহাড়ীতে চাকরি করি, আমার পক্ষে এ গ্রামে আসাটা খুব একটা আশ্চর্যের কিছু না, কিন্তু সিরাজুল সাহেবের মতন এক সম্ভ্রান্ত মানুষ কলকাতা থেকে এসেছেন ফুলমণির সঙ্গে দেখা করতে, এর মর্ম এখানকার মানুষ বুঝতে পারে না। অনেকগুলো কৌতূহলী, উৎসুক মুখ ঘিরে রইল আমাদের।

সিরাজুল খুব সহজেই ফুলমণির জড়তা কাটিয়ে দিয়েছেন, তিনি ফুলমণির অন্য ছবি দেখতে দেখতে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন। ফুলমণি কী ভাবে ছবি আঁকে, তাও সে ঘরের বারান্দায় বসে তখনই এঁকে দেখাল।

বৃদ্ধটি এত সব ব্যাপারে তেমন খুশি নয়। সে চায় তার ছবি সম্পর্কে কথা বলতে। তাকে বাদ দিয়ে তার পুত্রবধূর অসমাপ্ত ছবিগুলো নিয়ে এত মাতামাতি করা হচ্ছে কেন?

আমাকে একটা কায়দা করতে হলো।

চন্দনদা আমাকে আলাদা ভাবে পাঁচশো টাকা দিয়ে বলেছিল, ফুলমণি যদি কলকাতায় আসতে রাজি হয়, তা হলে ওর শ্বশুরকে এই টাকাটা দিয়ে আসি কয়েকদিনের সংসার খরচের জন্য!

আমি বৃদ্ধকে বললুম, আপনার ছবিগুলো কলকাতায় অনেকের খুব ভালে লেগেছে। সবাই জিজ্ঞেস করছিল আপনার কথা।

বৃদ্ধ ফোকলা দাঁতে হেসে বলল, ভালো লেগেছে? ভালো লেগেছে?

আমি বললুম, হ্যাঁ। আপনার সব ছবি বিক্রি হয়ে গেছে। চারশো টাকায় এই নিন সেই টাকা। একশো টাকা আমি সরিয়ে রাখলুম, ওটা ফুলমণিকে হা খরচ হিসেবে দিতে হবে। ফুলমণি যদি দিন সাতেকও বাইরে থাকে, তার মধে এই বৃদ্ধের জন্য চারশো টাকাই যথেষ্ট!

বৃদ্ধ শিশুর মতন খুশি হয়ে বার বার বলতে লাগলেন, আমার ছবি…শহরে মানুষ দাম দিয়ে কিনেছে? আমি আরও ছবি আঁকব!

কিন্তু ফুলমণিকে নিয়ে যাবার প্রস্তাব শুনে বৃদ্ধের সেই খুশি অন্তর্হিত হয়ে গেল একটুক্ষণ মুখ গোমড়া করে বসে থাকার পর বললেন, না, না, না, ও ব করে একা একা কলকাতায় যাবে? আমার তবিয়ৎ ঠিক থাকলে আমি যেতাম ও যাবে না!

পেছনের দর্শকদের মধ্যে থেকে এক ছোকরা বলল, ফুলমণি কি গান গাইতে না নাচবে? ছবি দেখাবার জন্য ওকে যেতে হবে কেন? শুধু ছবিগুলো নিে গেলেই হয়!

আরও কয়েকজন হ্যা হ্যা করে হেসে বলল, ফুলমণি গান গাইবে না, নাচবে?

মুখচোরা, হার জিরজিরে ফুলমণির গান গাওয়া কিংবা মঞ্চের ওপর নাচে দৃশ্যটা এমনই অবিশ্বাস্য যে অনেকেরই হাসি পায়।

ফুলমণির শ্বশুর জনসমর্থন পেয়ে উৎসাহিত হয়ে বললেন, ও চলে গেে আমাকে দেখবে কে? আমি একা এই খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে মরব?

বাসন্তী এগিয়ে এল ভিড় ঠেলে। ফুলমণির প্রতি তার সহানুভূতি হয়েে সম্প্রতি। সম্ভবত ছবি এঁকে টাকা পাওয়ার ব্যাপারটা তাকে আকৃষ্ট করেছে।

বাসন্তী বলল, যাক না, ফুলমণি। আবার তো ঘুরে আসবে। এই কদিন আমি তোমাকে দেখব।

এরপর ফুলমণির যাওয়ার পক্ষে ও বিপক্ষে নানারকম কথা শুরু হয়ে গেল আমি বসে রইলুম চুপ করে।

খানিকবাদে ফুলমণির শ্বশুর সিরাজুল তারিককে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বলুন না, আপনি বুঝদার মানুষ, ফুলমণির কলকাতায় যাওয়ার কি প্রয়োজন আছে

সিরাজুল সাহেব শান্ত ভাবে বললেন, আছে। গেলে ভালো হয়। ছবির প্রদর্শ হলে অনেকে শিল্পীকে দেখতে চায়। ফুলমণিরও উপকার হবে, জানাশুনা হে অনেক লোকের সঙ্গেই, ও আরও অনেক ছবি দেখবে, শিখতে পারবে।

বৃদ্ধ বললেন, কলকাত্তা বড় খিটকেল জায়গা। আমি তো জানি!

সিরাজুল সাহেব বললেন, ফুলমণিকেই জিজ্ঞেস করা যাক না, ও যেতে চায় কি না। না চাইলে জোর করে তো কেউ নেবে না।

উঠোনে ফুলমণির শ্বশুরের খাটিয়া ঘিরে কথা হচ্ছে আমাদের। ফুলমণি বসে আছে ঘরের দাওয়ায়। সে ছবিগুলো সব গুছিয়ে রাখছে।

সবাই এবার সেদিক তাকাল।

বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, তুই যাবি?

ফুলমণি মাথা তুলল, নীচু গলায়, কিন্তু বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, যাব!

শুনেই মনে হলো সে অনেকক্ষণ আগেই মন ঠিক করে রেখেছে। অন্যদের মতামতের কোনো মূল্য নেই তার কাছে। ঐ একটা শব্দ শুনেই ফুলমণির ওপর আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। মেয়েটা যতই লাজুক হোক, এই ছোট গণ্ডির বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে তার আকর্ষণ আছে, ছবির প্রদর্শনীতে সে উপস্থিত থাকতে চায়, তার মানে প্রকৃত শিল্পী হবার বীজ রয়েছে ওর মধ্যে।

বৃদ্ধ এবার আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, আপনারা তো ওকে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ও ফিরবে কী করে? কোনোদিন একলা কোথাও যায়নি, লোকের সঙ্গে কথা বলতে জানে না।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, আমার সঙ্গে ফিরবে। আমি তো কলকাতায় থাকি না, এখানে চাকরি করি, দু’চার দিনের মধ্যেই আমাকে ফিরতে হবে?

এরপর আর আপত্তির কারণ রইল না।

কিন্তু বাধা এল অন্য দিক থেকে।

সন্ধেবেলা গেস্ট হাউসে এসে উপস্থিত হলেন মহিম সরকার। চোখ সরু করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ নীললোহিত, আপনি নাকি একটা কামিনকে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছেন?

আমি বললুম, হ্যাঁ। কামিন মানে ঐ ফুলমণি, যে খুব ভালো ছবি আঁকে।

মহিমবাবু বললেন, ছবি-ফবি আমি বুঝি না। আমি বুঝি কোম্পানির কাজ। এখানকার একটা ওয়ার্কার মেয়েকে আপনারা কাজ নষ্ট করে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে? অন্য ওয়ার্কাররা কী ভাববে?

—তারা কী ভাববে আমি কি করে জানব বলুন তো?

—তারা চটে যাবে না? একজনকে, একটা মেয়েকে বেশি বেশি খাতির করা হচ্ছে, এটা তারা সহ্য করবে কেন! আপনি এ কাজটা ভালো করছেন না।

—আমি তো নিজের দায়িত্বে নিয়ে যাচ্ছি না, মহিমবাবু। আমাকে চন্দনদা, আই মিন, মিঃ চন্দন ঘোষাল বলেছেন, এটা তাঁরই নির্দেশ।

—মিঃ ঘোষালের পার্সোনাল ব্যাপার হলে আমি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু কোম্পানির কাজ হ্যামপার হলে—

—এটাও কোম্পানির কাজের মধ্যে পড়ে। কোম্পানি ঠিক করেছে, এখানে শুধু বাড়ি আর কারখানা বানালেই চলবে না। স্থানীয় লোকদের উন্নতির দিকটাও দেখতে হবে। অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক দুটো দিকই।

—সেই ছুতোয় একটা ইয়াং মেয়েকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া

—দেখুন মহিমবাবু, ফুলমণি ইয়াং ঠিকই এবং মেয়েও বটে। কিন্তু আপনি যে সেন্‌সে বলছেন, সেটা এখানে খাটে না। ছবি আঁকতে পারাটাই ওর একমাত্র যোগ্যতা। এখানকার একটি মেয়ে যদি শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, তা হলে এই জায়গাটারও তো সুনাম হবে।

—আপনি ওকে নিয়ে যাচ্ছেন, আপনি সদ্য কাজে যোগ দিয়েছেন, এর মধ্যেই ছুটি নিয়েছেন দু’দিন, আবার কলকাতায় চলে যাচ্ছেন—

—আবার ছুটি নেব। চাকরিতে ক্যাজুয়াল লীভ, আর্নড লীভ এসব পাওয়া যায় না?

—আপনি কি পার্মানেন্ট স্টাফ যে ছুটি পাবেন? আপনার চাকরির মোট তিন সপ্তাহও হয়নি, হে হে হে, এর মধ্যে ছুটি!

—দেখুন, আমাকে চাকরিটা দিয়েছেন মিঃ চন্দন ঘোষাল। তিনিই আমার বস, তাই না? তিনি যে কাজ দেবেন, আমাকে সেই কাজই করতে হবে।

—সে আপনি যাই-ই বলুন মশাই, ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে না। ঝাড়খণ্ডী আন্দোলন চলছে, এখানকার কোনো মেয়েকে বাইরে নিয়ে চলে যাওয়া এর মোটেই ভালো চোখে দেখবে না, এই আমি বলে যাচ্ছি!

মহিম সরকার আমাকে মোটামুটি শাসানি দিয়েই চলে গেলেন।

চন্দনদা এসে পৌঁছলো রাত্তিরের দিকে। মহিম সরকারের আপত্তির কথাট জানাতে চন্দনদা পাত্তাই দিল না। বাঁ হাতে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করে বলল, দুর দুর, ও লোকটা একটা মাথা-মোটা! একটা সাঁওতাল মেয়ের আঁকা ছবি অন্য সব শিল্পীদের সঙ্গে সমান মর্যাদায় একটা বড় প্রদর্শনীতে স্থান পাচ্ছে, এরকম আগে কখনো ঘটেছে? বিরাট ব্যাপার। একজন গুণীর মর্যাদা দেওয়াটা কখনো অপরাধ হতে পারে? ঝাড়খণ্ডী নেতারা এটা ঠিক বুঝবে। ওদের সঙ্গে আমার ভাব আছে

পরদিন সকালেই রওনা হলুম আমরা। বাসে যেতে হবে না, চন্দনদার জি আমাদের রেল স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। ফুলমণির ছবিগুলো ভালোভাবে প্যাক করে নিয়েছেন সিরাজুল সাহেব। একটা পুঁটুলিতে ভরে নিয়ে এসেছে ফুলমণি তার অন্য জিনিসপত্র। পায়ে রবারের চটি, পরনে একটা নীল পাড় সাদা শাড়ি

গেস্ট হাউসের সামনে আমাদের বিদায় জানাতে এসেছে কয়েকজন। বাসন্ত আর ওদের গ্রামের কয়েকটি ছেলে। এবং মহিম সরকার। তিনি এখন দিব্যি হেসে হেসে গল্প করছেন চন্দনদার সঙ্গে। হঠাৎ এক সময় কাছে এসে ফুলমণির দিকে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে তিনি বললেন, ফুলমণি, তোর কিন্তু ফার্স্ট হওয় চাই। তুই প্রাইজ নিয়ে ফিরে এলে আমি সবাইকে মিষ্টি খাওয়াব।

জিপে ওঠার আগে ফুলমণি একবার দূরের মাঠের দিকে ঘুরে তাকালো। আজকে আকাশ সজল মেঘে ঢাকা। পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে না। ডান পাশের জঙ্গলের ভেতর থেকে কয়েকটা মোষকে তাড়িয়ে নিয়ে এল একটা বাচ্চা রাখাল। একটা কুকুর অকারণে সেখানে চ্যাচাচ্ছে, উড়ে গেল এক ঝাঁক কোচ বক।

ফুলমণি যেন তার ছবির পটভূমিকাগুলি একবার দেখে নিল চোখ ভরে।

ফুলমণি-উপাখ্যান – ৭

প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে এলেন লেডি রাণু মুখার্জি।

এতদিন তাঁকে শুধু ছবিতেই দেখেছি। অসাধারণ রূপসী ছিলেন, এখন প্রচুর বয়েস হয়ে গেলেও সেই রূপের আভা যায়নি। একা একা আর চলাফেরা করতে পারেন না, সব সময় তাঁর সঙ্গে একজন সেবিকা থাকে, তবু নাকি তিনি আজও প্রত্যেকটি ছবির প্রদর্শনীতে আসেন। শিল্পের প্রতি এই ভালোবাসা তাঁর বর্ণময় জীবনকে একটা আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।

শিল্পী জগতের এই প্রবাদ-প্রতিমাকে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলুম দূর থেকে।

সিরাজুল সাহেব এই প্রদর্শনীর শিল্পীদের সঙ্গে লেডি রাণুর আলাপ করিয়ে দিতে লাগলেন।

অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের তিনখানা ঘর জুড়ে চলছে এই প্ৰদৰ্শনী। মোট সতেরোজন শিল্পী, সকলেই যে বয়েসে নবীন তা নয়। কেউ কেউ এসেছে বারাসত, বনগাঁ, ঝাড়গ্রাম, দুর্গাপুর থেকে। তবে কলকাতার ছেলেমেয়েদের সংখ্যাই খুব বেশি। সতেরোজনের মধ্যে একজন শুধু অসুস্থ বলে আসতে পারে নি।

অন্য শিল্পীদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো ফুলমণিকে। আজও পায়ে সেই রবারের চটি, নীল পাড় সাদা শাড়ি, বিশেষত্বের এই যে আজ তার মাথার চুল ভালো ভাবে আঁচড়ানো, তাতে একগুচ্ছ সাদা ফুল গোঁজা।

ছোটপাহাড়ী থেকে এনে ফুলমণিকে আর কোথায় তুলব, চন্দনদার কথা মতন নিয়ে গিয়েছিলুম নীপা বউদির কাছে। নীপা বউদি বেশ আগ্রহ করেই ফুলমণিকে স্থান দিয়েছে। আজকাল সব মহিলাদের মধ্যেই একটু একটু উইমেন্‌ লিব-এর ছোঁয়া আছে, তাই একজন নারী হয়ে অন্য একটি নারীকে সাহায্য করতে নীপা বউদির কোনো কার্পণ্য নেই।

মুশকিল হয়েছিল লালুদাকে নিয়ে। এই সর্বঘটে কাঁঠালি কলাটি যথারীতি সে বাড়িতে উপস্থিত। ফুলমণি সম্পর্কে নীপা বউদির উৎসাহ দেখে লালুদা উৎসাহ চতুর্গুণ বেড়ে গেল। ফুলমণি দু’খানা মাত্র নীল-পাড় শাড়ি ছাড়া আর কিছুই আনেনি শুনে লালুদা লাফিয়ে উঠে বলল, সে কি, অত বড় আ একজিবিশানে যাবে, রেডি রাণু আসবেন, সাজিয়ে গুছিয়ে পাঠানো দরকার তাহলে ওর তো জন্য একজোড়া বেনারসী কিনে আনি?

নীপা বউদি বললে, বেনারসী? কেন, ও কি বিয়ে করতে যাচ্ছে নাকি?

লালুদা বলল, তা হলে সিল্ক টাঙ্গাইল!

নীপা বউদি বলল, আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি! ও অন্ত সেজেগুজে যাবে কেন? ওর যা স্বাভাবিক পোশাক, তা পরেই যাবে। তাতে ওর আত্মসম্মান বাড়বে।

–তা হলে এক সেট রুপোর গয়না কিনে আনা যাক। ওরা রুপোর গয়ন খুব পরে আমি দেখেছি!

—কোনো দরকার নেই। বেশি সাজগোজ করে ও যাবে কেন?

—আহা, বুঝছ না নীপা। লোকের চোখে পড়া দরকার, বুঝলে না, আজকাল পাবলিসিটির যুগ।

—ছবি ভালো লাগলেই লোকে ওকে চিনবে।

–তা হলে অন্তত কয়েকটা ভালো সাবান।

নীপা বউদির ধমক খেয়ে লালুদা শেষ পর্যন্ত নিরস্ত হলো বটে, কিন্তু কোনে অছিলাতেই টাকা খরচ করার সুযোগ না পেয়ে মর্মাহত হলো খুব

নীপা বউদি যে ফুলমণির পোশাক নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করেনি, তাতে আমিও খুশি হয়েছি। এক সাঁওতাল গ্রামের মেয়ে কেন কলকাতার মেয়েদের মত সাজতে যাবে। ওর নিজের পোশাকই তো ওর অহংকার। ও যেমন, ঠিক তেমনই ওকে মানবে।

এখন যে ফুলমণি অন্য শিল্পীদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে ওকে একটুও বেমানান লাগছে না। পোশাক নয়, আসল তো মুখ। নিরক্ষর, গ্রাম্য মেয়ে হলেও ফুলমণি বোকা নয়। শিল্পীসুলভ একটা প্রত্যয়ের ছাপ আছে ওর মুখে। এখানকার অন্য ছবিগুলো দেখে ও নিশ্চয়ই বুঝেছে যে ও নিজেও অন্যদের চেয়ে কম কিছু নয়।

সতেরো জনের মধ্যে ফুলমণি ছাড়াও আরও পাঁচটি মেয়ে আছে, তারাও কেউ উগ্র সাজগোজ করেনি। সহজ-অনাড়ম্বর পোশাক। ফ্যাশানেবল মহিলার সচরাচর ভালো শিল্পী হয় না।

সিরাজুল তারিক অন্য শিল্পীদের সঙ্গে লেডি রাণুর পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে ফুলমণির কাছে এসে বললেন, এই মেয়েটি, জানেন, কোথাও শেখেনি, একট রিমোট গ্রামে থাকে, কিন্তু অসাধারণ ছবি এঁকেছে।

লেডি রাণু বললেন, তাই নাকি? তাহলে তো ওর ছবিই আগে দেখতে হয়।

প্রত্যেকেরই চারখানা করে ছবি টাঙানো হয়েছে। ফুলমণির ছবিগুলোর কাছে গিয়ে দেখতে দেখতে লেডি রাণু বলতে লাগলেন, বাঃ বেশ তো। সত্যি ভালো।

তারপর ফুলমণিকে জিজ্ঞেস করলেন, অনেক রকম লাইন দেখছি, তুমি কতগুলো তুলি ব্যবহার করো?

সিরাজুল সাহেব বললেন, ও তো তুলি দিয়ে আঁকে না।

ফুলমণি তার একটা হাত তুলে পাঞ্জাটা মেলে ধরল।

সিরাজুল সাহেব বললেন, ও শুধু আঙুলের ডগা আর নখ দিয়ে আঁকে। আমি নিজে দেখেছি আঁকতে। ফ্যানটাস্টিক!

লেডি রাণু খুবই অবাক হলেন। আরও অনেক প্রশংসা করে চলে গেলেন অন্য ছবির দিকে।

লোক কম হয়নি। প্রেস, চিত্র সমালোচক, ফটোগ্রাফার, শিল্পীদের আত্মীয়—স্বজন এবং কিছু দর্শক। নীপা বউদিরা আজ আসতে পারেনি, কাল আসবে, বলেছে।

ফুলমণির ছবিগুলোর কাছে কিছু দর্শক দেখলেই আমি তাদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াই, তাদের মন্তব্য শোনার চেষ্টা করি। সবাই যে একবাক্যে প্রশংসা করছে তা নয়। কেউ কেউ শুধু চোখ বুলিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ খুঁটিয়ে দেখছে। কেউ বলছে, বাঃ, মন্দ নয়।

দু’জন নামকরা সমালোচক সিরাজুল সাহেবের কাছে যেচে প্রশংসা করে গেলেন। আলাপ করলেন ফুলমণির সঙ্গে। ফুলমণি একটা-দুটো প্রশ্নের উত্তরও দিল। ওঁদের মধ্যে একজন শুধু প্রশংসাই করে গেলেন, আর একজন রঙের ব্যবহার নিয়ে কয়েকটি পরামর্শ দিলেন ফুলমণিকে। দু’জনের ব্যবহারই বেশ আন্তরিক। চন্দনদা সমালোচকদের সম্পর্কে বড় কঠিন মন্তব্য করেছিলেন। এই তো এঁরা নিজে থেকেই এসেছেন। এখানে মদের ফোয়ারা নেই, খাওয়া-দাওয়ার এলাহি ব্যবস্থা নেই, শুধু চা আর দুটো করে সিঙ্গাড়া।

কিছু কিছু খ্যাতিমান শিল্পীরাও আসছেন, কয়েকজনকে চেনা যায়। এঁরা তরুণদের কাজ সম্পর্কে কৌতূহলী, এক একজনকে ঘিরে ছোটখাটো দল হয়ে যাচ্ছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের সদলবলে চলাই রীতি। আমি লক্ষ করলুম, এরা প্রায় সকলেই ছবিগুলোর দিকে ওপর ওপর চোখ বুলোলেন শুধু, তারপর ভক্তদের সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন। এঁদের পাকা চোখ, এক ঝলক দেখেই বুঝে নেন। কোনো কোনো তরুণ শিল্পী তার গুরুস্থানীয়কে জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজের ছবিগুলোর কাছে। এক একজন শিল্পী এতই ভদ্র এবং উদার যে সবাইকে বিলিয়ে যাচ্ছেন প্রশংসা।

সিরাজুল তারিক সাহেব চলে গেলেন একটু আগে।

.

আমার ওপর নির্দেশ দিয়ে গেছেন, ফুলমণিকে নিয়ে শেষপর্যন্ত থেকে যেতে। আটটার সময় বন্ধ হবে। থাকতে আমার খারাপ লাগবে না। এতগুলি শিল্পীর এত রকমের ছবি, এতদিনের নিষ্ঠা, ভাবনা, রঙের পরীক্ষা, সব মিলিয়ে পরিবেশটা একেবারে অন্য রকম। যেন একটা চমৎকার উদ্যান।

কোনো বিখ্যাত শিল্পীকে ফুলমণি তার নিজের ছবির কাছে নিয়ে যাবে, সে প্রশ্নই ওঠে না। সে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। আমিও কারুকে অনুরোধ করতে পারছি না, কেউ যদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, আপনার এত উৎসাহ কেন, মশাই? ঐ মেয়েটা আপনার কে হয়?

আমি দূর থেকে অন্যদের প্রতিক্রিয়া দেখছি। কেউ ফুলমণির ছবির সামনে থামছে, কেউ থামছে না। তবে একটা ব্যাপার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত একজনও কেউ বলেনি যে এ আদিবাসী মেয়েটির আঁকা ছবি নিম্নমানের, এই প্রদর্শনীর উপযুক্ত নয়! ফুলমণির ছবি দয়া করে রাখা হয়নি, কিংবা চন্দনদা -সিরাজুল সাহেবের হুজুগে পক্ষপাতিত্ব নয়। অন্য শিল্পীদের সমান যোগ্যতা তার আছে।

আমাদের দেশে প্রদর্শনীর মাঝখানে ছবি কেউ কিনতে চাইলে ‘সোলড’ লিখে দেওয়া হয় না, শুধু একটা লাল টিপ দেওয়া হয়। ফুলমণির ছবি কেউ কেনে কিনা সে সম্পর্কে আমার দারুণ কৌতূহল। সিরাজুল সাহেব অবশ্য বলেছিলেন; আমাদের দেশে সাধারণ বাঙালি দর্শকরা তো ছবি কেনে না, তাদের পয়সা নেই। ছবি কেনে গোয়েঙ্কা, ডালমিয়া, বিড়লা, রুশি মোদিরা। তারা নতুনদের প্রদর্শনীতে চট করে আসে না, তাদের প্রতিনিধিদের ধরে আনতে হবে।

তবে এরই মধ্যে একটি মাত্র ছবিতে লাল টিপ পড়েছে। কৌশিক শূর নামে একজনের আধা বিমূর্ত ছবি। কৌশিক শূরের বয়েস বড় জোর সাতাশ, মুখ ভর্তি দাড়ি, চোখ দুটি স্বপ্নময়।

সাড়ে সাতটার সময় এলেন বিশ্বদেব রায়চৌধুরী, এঁর খ্যাতি ভারত জোড়া। দীর্ঘকায়, সুপুরুষ, সদা হাস্যময় মুখ। তাঁর কোনো এক ভাবশিষ্যের ছবি আছে এখানে, খুব সম্ভবত সেইজন্যই তিনি এসেছেন।

ঘুরতে ঘুরতে তিনি ফুলমণির দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন।

অ্যাকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের প্রদর্শনীতে মাথায় ফুল গোঁজা একটি সাঁওতাল মেয়েকে তো আর প্রতিদিন দেখা যায় না। কোনো চাষী, জেলে, মজুর, তাঁতি কোনোদিন এখানে আসে না। এসব ছবি তাদের জন্য নয়। শিল্প-সাহিত্য গোটা ব্যাপারটা থেকেই আমাদের দেশের শতকরা আশিজন বাদ।

বিশ্বদেব রায়চৌধুরীর বিস্ময় স্বাভাবিক।

কয়েকজন তরুণ শিল্পী ফুলমণিকে ওঁর কাছে নিয়ে গেল। আমি দূর থেকে দেখলাম, উনি ফুলমণির সঙ্গে আগ্রহ নিয়ে দুচারটে কথা বললেন, ফুলমণির ছবিও দেখলেন!

তারপর তিনি অন্যদিকে মন দিতে আমি ফুলমণিকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলুম।

জিজ্ঞেস করলুম, ওঁকে চিনতে পেরেছ? শিল্পী! উনি কী বললেন তোমাকে?

ফুলমণি সরু করে হেসে, দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, উনার ভালো লাগে নাই।

কথাটা আমার বিশ্বাস হলো না। বিশ্বদেব রায়চৌধুরী যে-ধরনের মানুষ, খারাপ লাগলেও তো সে কথা মুখে বলবেন না। তিনি এখন এত উঁচুতে উঠে গেছেন যে কারুকেই আর ছোট করার দরকার হয় না ওঁর।

পাশ থেকে আর একটি মেয়ে বলল, না, না, উনি ছবিগুলোকে খারাপ বলেন নি। প্রশংসাই করেছেন। শুধু বললেন, যে-কাগজে আঁকা হয়েছে, তাতে রং বেশিদিন থাকবে না। ভালো কাগজে কিংবা ক্যানভাস ব্যবহার করা উচিত।

আমি ভাবলুম, ভালো কাগজ কিংবা ক্যানভাস কেনার পয়সা ও পাবে কোথায়? সিরাজুল সাহেব ঝোঁকের মাথায় বলেছিলেন, ফুলমণির ছবির প্রত্যেকটির দাম পাঁচ হাজার টাকা। এখানে ছবির মেটেরিয়াল অনুযায়ী দাম ধরা হয়েছে। ফুলমণির একটা ছবির দাম সাত শো, অন্যগুলো এক হাজার, দেড় হাজার, দু’হাজার। বিক্রি হয় কি না সেইটাই পরীক্ষা। ধরা যাক সব কটাই বিক্রি হয়ে গেল। তারপর ফুলমণি কী করবে? ঐ কটা টাকায় ওর কত দিন চলবে? ওর শ্বশুর বেশ কিছুটা নিয়ে নেবে, পাড়া প্রতিবেশীরাও ভাগ বসাবে। বড় ভোজ হবে। ফুলমণি কি আবার ইট বওয়ার কাজে ফিরে যাবে?

অন্য আর পাঁচজন শিল্পীর মতন ফুলমণি শুধু ছবি আঁকার সাধনা করে যাবে, এর কি কোনো উপায় নেই?

চন্দনদার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।

সিগারেট টানার জন্য বাইরে এলুম, ফুলমণিও এল আমার সঙ্গে। অ্যাকাডেমির সামনের প্রাঙ্গণে সবসময়েই ভিড় থাকে, এখন অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। বিদ্যুতের চমক বৃষ্টির খবর দিল। অনেকগুলো ফুলের গন্ধ আসছে এক সঙ্গে।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ফুলমণি, কেমন লাগছে এখানে?

ফুলমণি হাসল।

কথা তো বলেই না প্রায়, ঐ হাসিটুকুও যথেষ্ট।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলুম, যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায়, তুমি কলকাতায় থেকে যেতে পারবে? এখানে ইচ্ছে মতন ছবি আঁকবে।

আমার চোখের দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে ফুলমণি বলল, কী জানি!

আর কিছু বলার আগেই ভেতরে একটা গোলমাল শুনতে পেলুম। কে যেন রেগেমেগে চিৎকার করছে।

আর্ট এক্‌জিবিশানে সবাই মৃদু স্বরে কথা বলে। এখানে চীৎকার অস্বাভাবিক। ছুটে গেলুম হলের মধ্যে।

এখন দর্শক আর নেই বলতে গেলে। সবাই প্রায় শিল্পী বা তাদের বন্ধুবান্ধব বিশ্বদেব রায়চৌধুরী দূরের এক কোণে ছবি দেখছেন, আর ফুলমণির ছবির সামনে একজন মজবুত, দীর্ঘকায়, ঈগল-নাশা পুরুষ, অনিন্দ্য দাস! হাতে বেতের ছড়ি।

ছড়িটা তুলে বললেন, কোথায় চন্দন ঘোষাল কোথায়? ডাক সেই শালাকে। আদিবাসী মেয়ের আঁকা ছবি? কোন কালচার? এথনিক? আমার সঙ্গে ফেরোজি! চন্দন ঘোষালকে চিনি না? আমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত। ছবি আঁকার খুব শখ ছিল। ছবির হ্রস্বি-দীর্ঘি জ্ঞান নেই, তবু আঁকবে। এই সব এঁকেছে, নিজের নামে ছবি ঝোলাবার মুরোদ নেই, এখন সাঁওতাল মেয়ের নামে চালাচ্ছে।

আমাকে দেখতে পেয়ে গলা চড়িয়ে অনিন্দ্য দাস জিজ্ঞেস করলেন, অ্যাই যে, এই ছেলে—ইদিকে আয়। চন্দন কোথায়?

আমি বললুম, তিনি আসেননি।

—পালিয়ে থাকছে! সাহস নেই! ওর কি এত পয়সার খাঁকতি হয়েছে যে ছবির বাজারে ঢুকতে চায়? আদিবাসী আর্ট, শালা! মধুবনী পেইন্টিং এখন বালিগঞ্জে তৈরি হয়, আমি জানি না? কালিঘাটের পটের ভ্যাজাল, আর্ট কলেজের ছাত্ররা এঁকে সাপ্লাই দিচ্ছে! চন্দন আসেনি কেন? তোরা যে বলছিলি…কোথায় সেই মাগিটা কোথায়? মাগিটাকে শো কর, দেখি সে কেমন আঁকে।

আমার মাথায় রাগ চড়ে গেল।

অনিন্দ্য দাস যত বড় শিল্পীই হোক না কেন, আমি তার ধমক খেতে যাব কোন্ দুঃখে?

আমি বললুম, আপনাকে আমি প্রমাণ দিতে যাব কেন? আপনার ইচ্ছে না হয় বিশ্বাস করবেন না! হাতের ছড়িটা আমার কাঁধে ঠেকিয়ে অনিন্দ্য দাস বললেন, আলবাৎ প্রমাণ দিতে হবে! আর্টের বাজারে জোচ্চুরি আমরা সহ্য করব না। ফল্স নামে ছবি বেচা, আমাদের সকলের বদনাম হবে!

বিশ্বদেব রায়চৌধুরী কাছে এগিয়ে এসে সস্নেহ ভর্ৎসনার সঙ্গে বললেন, কী হলো অনিন্দ্য, এত রাগারাগি করছ কেন?

অনিন্দ্য দাস বললেন, আপনি চুপ করুন তো। আপনি কিছু জানেন না, কী সব নখরাবাজি চলছে চারদিকে। আমি মাগিটাকে দেখতে চাই, সে কেমন ছবি আঁকে। এটা কিছু অন্যায় বলিনি!

কথা বলতে বলতে অনিন্দ্য দাস একটুখানি দুলে যেতেই বোঝা গেল, তিনি বেশ খানিকটা মদ্য পান করে এসেছেন। তাঁর মাথায় কোনো যুক্তিবোধ কাজ করছে না।

বিশ্বদেব রায়চৌধুরী বুঝলেন, এখানে আর কথা বলতে গেলে তার মান থাকবে না। তিনি আস্তে আস্তে সরে পড়লেন।

অন্য একজন কেউ বলল, মেয়েটি তো এখানেই ছিল। বোধহয় বাইরে গেছে।

কোথায়, কোথায়, বলতে বলতে অনিন্দ্য দাস দরজার দিকে এগোলেন। আমাকেও সঙ্গে যেতে হলো।

ফুলমণি জলের ফোয়ারাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি পড়ছে দু’এক ফোঁটা।

ফুলমণিকে দেখে হা হা শব্দ অট্টহাসি দিয়ে উঠলেন অনিন্দ্য দাস।

তারপর বললেন, এই মেয়ে! একে তো রেল লাইনের ধার থেকে ধরে এনেছে! একটা সাঁওতাল মেয়েকে এনে দাঁড় করালেই হলো! ও ওর বাপের জন্মে তুলি ধরতে শিখেছে? আমি বাজি ফেলতে পারি!

ফুলমণির কাছে গিয়ে তিনি আবার বললেন, এই মেয়ে, তুই ছবি আঁকতে পারিস? সত্যি করে বল্!

ফুলমণি কোনো উত্তর দিল না, ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

ফস করে পকেট থেকে একটা তুলি বার করে অনিন্দ্য দাস বললেন, এটা ধর তো! ছবি এঁকে দেখাতে হবে না, শুধু তুলিটা কেমন ভাবে ধরিস, সেটা দেখব!

আমি বললাম, ও তুলি দিয়ে আঁকে না।

—তবে কি ইয়ের ইয়ে দিয়ে আঁকে!

–ও শুধু আঙুল দিয়ে আঁকে।

আবার একখানা জোর হাসি দিলেন অনিন্দ্য দাস। আমাকে একটা খোঁচা মেরে বললেন, আঙুলে দিয়ে…একি বাবা কপালে ফোঁটা কাটা? তোর কপালে মেয়েটা ফোঁটা দিয়েছে নাকি রে?

ফুলমণির একটা হাত চেপে ধরে তিনি বললেন, দেখি দেখি, আঙুলগুলো দেখি! এ যে সব চ্যাড়োশ!

ফুলমণি জোর করে হাতটা ছাড়িয়ে নিল।

অনিন্দ্য দাস বললেন, ইঃ, তেজ আছে! ক’ পয়সা পেয়েছিস?

ফুলমণির গালে এক আঙুলের ঠোনা মেরে বললেন, মুখটা ফেরা তো। হুঁ, প্রোফাইলটা ইন্টারেস্টিং।

হঠাৎ আমার মনে হলো, আমি একটা সাঁওতাল ছেলে। ঝাড়খণ্ডের সমর্থক। আমার গ্রামের একটি মেয়েকে অপমান করছে কলকাতার এক বাবু। আমার রক্ত গরম হয়ে গেল।

আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে অনিন্দ্য দাসের কলার চেপে ধরে বললুম, ছেড়ে দিন ওকে। অসভ্য কোথাকার।

অনিন্দ্য দাস আমাকে মারার জন্য ছড়ি তুললেন।

আর কয়েকজন মাঝখানে এসে পড়ে ঠেলে সরিয়ে দিল দু’জনকে

কেউ একজন আমাকে টানতে টানতে নিয়ে এল ভেতরে। জোর করে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। রাগে তখনও আমি হাঁপাচ্ছি। অনিন্দ্য দাসের কয়েকটা দাঁত ভেঙে দেওয়া উচিত ছিল।

যে ছেলেটি আমাকে টেনে এনেছে, সে বলল, চুপ করে একটু বসুন। অনিন্দ্য দাস লোক খারাপ নন। যখন তখন মাথা গরম করেন। কিন্তু গ্রেট সোল। আপনার সঙ্গে যদি ভাব হয় একবার, দেখবেন আপনার জন্য সর্বস্ব দিয়ে দেবেন।

আমি বললুম, আমার দরকার নেই ভাব করার। যে ওরকম মুখ খারাপ করে…।

–ওনার মুখটাই ওরকম, মনটা পরিষ্কার!

—ফুলমণিকে ও যদি আবার কিছু বলে?

—না, ফুলমণি বাথরুমে গেছে।

পাশ থেকে আর একজন বলল, অনিন্দ্যদা চলে গেলেন। কী বলতে বলতে গেলেন জানো, এখানকার সব কটা ছবি বোগাস! সব ফল্স।

ঐ দু’জন খুব হাসতে লাগল।

একজন বলল, কাল দেখবি অনিন্দ্যদা এসে খুব প্রশংসা করবে। আজ পেটে একটু বেশি পড়েছে।

কর্তৃপক্ষস্থানীয় একজন ভদ্রলোক আমার সামনে এসে বললেন, আপনারা এখানে মারামারি শুরু করেছিলেন? ছি ছি ছি। এখানে কোনোদিন ওসব হয় না। আমি আহতভাবে বললুম, আপনি শুধু আমাকে বলছেন? আমি কি শুরু করেছি। অনিন্দ্যবাবু যা-তা বলতে শুরু করলেন।

-অনিন্দ্যবাবু একজন নামকরা আর্টিস্ট। তার মুখে মুখে আপনি কথা বলতে গেলেন কেন? আপনি কে?

—আমি ছবি আঁকতে পারি না বটে, কিন্তু আমি একজন ভদ্রলোক।

—সিরাজুল সাহেবকে বলব।

—যা খুশি বলবেন। আমি চলে যাচ্ছি, আর আসব না।

আটটা বেজে গেছে। বন্ধ করার সময়ও হয়ে গেছে। চলে এলুম বাইরে। ফুলমণি এখনো বাথরুম থেকে ফেরেনি।

এতক্ষণ পর্যন্ত এই পরিবেশটা সম্পর্কে যে ভালো লাগা ছিল, একজন লোক এসে তা নষ্ট করে দিল। এখানে চন্দনদার উপস্থিত থাকা উচিত ছিল। অন্তত প্ৰথম দিনটা। কিন্তু চন্দনদা নিজে সব ব্যবস্থা করে দিলেও সামনে আসতে চাইছে না। নীপা বউদিকে বোঝাতে চায় যে ফুলমণি সম্পর্কে যাবতীয় উৎসাহ শুধু আমার

একে একে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে। ফুলমণি এতক্ষণ কী করছে বাথরুমে? সেদিকে খানিকটা এগিয়ে গেলুম, কিন্তু মেয়েদের বাথরুমের মধ্যে ঢুকে তো দেখা যায় না।

বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে সঙ্গে মাঝে মাঝে গজরাচ্ছে আকাশ।

আসল বৃষ্টি শুরু হয়নি, ঝোড়ো বাতসের সঙ্গে বড় ফোঁটা এসে গায়ে লাগছে। এই রকম সময়ে বেড়াতে মজা লাগে। ফুলমণি যদি চায়, এক্ষুনি বাড়ি না ফিরে ময়দানে খানিকক্ষণ ঘোরা যেতে পারে। কলকাতার ময়দানের একটা দারুণ রূপ আছে, সেটা দেখলে ওর ভালো লাগবে আশা করি। চৌরঙ্গির একদিকে আলোকোজ্জ্বল বড় বড় বাড়ি, আর একদিকে অন্ধকার।

আরও একটা সিগারেট শেষ হয়ে গেল, ফুলমণি তবু আসছে না কেন? এবারে বোধহয় গেট ফেট বন্ধ করে দেবে! না, পেছন দিকের হলের নাটক এখনো ভাঙেনি।

বাথরুমের মধ্যে গিয়ে ফুলমণি অসুস্থ হয়ে পড়ল নাকি?

একটি যুবতী খটখটে জুতোর শব্দ তুলে বেরিয়ে আসছে বাথরুম থেকে চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, কিছু মনে করবেন না। বাথরুমে কি আর কেউ আছে? আমার একজন আত্মীয় ঢুকেছিলেন—

মেয়েটি সপ্রতিভ ভাবে বলল, না, আর কাউকে দেখলুম না তো!

তারপর সে নিজেই আর একবার উঁকি দিয়ে এসে বলল, না, কেউ নেই।

আমি বললুম, কেউ নেই? তা হলে…তাহলে আমি একবার নিজে দেখে আসতে পারি?

মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, যান না। আমি দাঁড়াচ্ছি।

কপালে আমার এও ছিল, মেয়েদের বাথরুম পরিদর্শন করতে হবে। তাও কি না ফাঁকা। মেয়েদের বাথরুমের দেয়ালে কিছু লেখা থাকে কি না সে বিষয়ে আমার কৌতূহল ছিল যথেষ্ট, কিন্তু এখন সেসব দেখার সময় নয়।

নিঃসন্দেহ বলা যায় ভেতরে কেউ নেই।

যুবতীটি অপেক্ষা করছে, বলল, পেলেন না?

আমি দু’দিকে মাথা নাড়লুম।

-কী রকম দেখতে বলুন তো?

—নীল-পাড় সাদা শাড়ি পরা, মাথায় ফুল গোঁজা, রোগা, আপনারই বয়েসী হবে বোধহয়।

—না, সে-রকম কারুকে দেখিনি। দেখুন বোধহয় বাইরে অপেক্ষা করছেন।

যুবতীটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি প্রায় দৌড়ে চলে এলুম গেটের বাইরে। সেখানে কেউ নেই। রাস্তার ওপারে নিশ্চয়ই যাবে না।

ফিরে এসে অ্যাকাডেমির ঘরগুলো খুঁজলুম তন্নতন্ন করে।

যদি ভুল করে থিয়েটার হলের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তাই অপেক্ষা করলুম নাটক শেষ হওয়া পর্যন্ত। পৌনে ন’টায় হুড়হুড় করে বেরিয়ে এল বহু নারী পুরুষ, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমি পরীক্ষা করলুম প্রত্যেকটা মুখ। সবাই বেরিয়ে গেলে মঞ্চ এবং গ্রীনরুম দেখতেও বাকি রাখলুম না।

ফুলমণি কোথাও নেই।

আমার বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। এ কী হলো? আমাকে কিছু না বলে কোথায় যাবে ফুলমণি? অনিন্দ্য দাসের বিশ্রী ব্যবহারে রাগ করে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। তা হলেই তো সর্বনাশ। ফুলমণি কলকাতার কিছুই চেনে না। এত গাড়ি—ঘোড়ার রাস্তা কী করে পার হতে হয় জানে না।

সামনের রাস্তার এদিক থেকে ওদিক, ময়দানের খানিকটা অংশে খোঁজাখুঁজি করেও কোনো লাভ হলো না।

তা হলে কি নীপা বউদির বাড়িতে ফিরে গেছে? ঠিকানাও তো জানে না। আসবার সময় ট্যাক্সিতে এসেছি, সেই সব রাস্তা মনে রেখেছে? গ্রামের লোক শহরে এলে দিশেহারা হয়ে যায়, সমস্ত রাস্তাই তাদের এক রকম মনে হয়। তবে যদি ফুলমণির স্মৃতিশক্তি অসাধারণ হয়, বলা তো যায় না!

এ ছাড়া আর তো কিছু করবারও নেই। একটা ট্যাক্সি পেয়েই বললুম, খুব জলদি, সুইন হো স্ট্রিট—

ঠিক তখনই আকাশ ফাটিয়ে বৃষ্টি নামল। চড়চড়াৎ শব্দে বিদ্যুৎ চিরে গেল কলকাতার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত।

নীপা বউদি আর লালুদা টিভিতে সিনেমা দেখছে।

বুকের ধড়ফড়ানি অতি কষ্টে সামলে আমি জিজ্ঞেস করলুম, ফুলমণি কী করছে? কখন ফিরল? নীপা বউদি বলল, ফুলমণি! সে একা ফিরবে কী করে? তোমার সঙ্গে আসেনি?

আমি ধপাস করে বসে পড়লুম সোফায়! হাতের তালু ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। পায়ে জোর নেই!

সব শুনে লালুদা চক্ষু গোল গোল করে বলল, কেস সিরিয়াস! মেয়েটা যদি সত্যি সত্যি হারিয়ে যায়, আদিবাসী মেয়ে, আমাদের নামে অ্যাবডাকশান চার্জ আনতে পারে। ওহে নিলাম্বুজ, এটা কী করলে?

আমি কী করব বলুন! ও বাথরুমে গেল, তখনও কি আমি ওর পেছন পেছন যাব?

—তাও যাওয়া উচিত ছিল—

নীপা বউদি বলল, তুমি হুট করে চলে এলে? ওখানেই আছে নিশ্চয়ই যাবে কোথায়!

—আমি সব জায়গায় দেখেছি। কেউ নেই। এখন আর লোকজনই নেই বলতে গেলে!

–হয়তো কোনো গাছ-টাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে!

মুমু পাশের ঘরে পড়তে বসেছিল। উঠে এসে সব শুনছে। সেও বলল, নীলকাকা, তুমি ওকে হারিয়ে ফেললে? এখন কী হবে?

সবাই আমার নামে দোষ দিচ্ছে! আমি যেন চুরির দায়ে ধরা পড়েছি।

লালুদা বলল, এক্ষুনি তো একটা ব্যবস্থা করতে হয়। চলো বেরোই। থানায় একটা ডায়েরি করতে হবে। নীলমণিকে যদি অ্যারেস্ট করে, তার জন্য জামিনের ব্যবস্থা করতে হবে।

নীপা বউদি চমকে উঠে বলল, কেন, নীলুকে অ্যারেস্ট করবে কেন?

মুমু একগাল হেসে বলল, বেশ হবে! নীলকাকাকে জেলে ভরে রাখলে খুব মজা হবে! আমরা দেখতে যাব!

রাত হয়ে গেছে, তাই মুমুর বায়না সত্ত্বেও তাকে সঙ্গে নেওয়া হলো না, কাল তার ইস্কুল আছে। লালুদার সঙ্গে নীপা বউদি আর আমি বেরিয়ে পড়লুম। বৃষ্টি হঠাৎ থেমে গেছে।

একটা গাড়ি থাকলে কত সুবিধে। নীপা বউদির কথায় থানায় না গিয়ে আমরা আগে গেলুম অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের কাছে।

সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল, ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল, রেড রোড়, রেস কোর্স এই সব চক্কর দিয়ে প্রায় পুরো ময়দানটাই ঘুরে দেখা হলো। ফুচকা, আলুকাবলির দোকানগুলোও উঠে গেছে, দু’একটা থেমে থাকা গাড়িতে রয়েছে কয়েক জোড়া দুঃসাহসী প্রেমিক-প্রেমিকা, কিছু গোপন মদ্যপায়ী ও কিছু পুলিশ ছাড়া আর কেউ নেই।

লালুদা বলল, মেট্রো রেলের কাজের জন্য অনেক আদিবাসী ওয়ার্কার আনিয়েছে। তারা ময়দানের মধ্যে এক জায়গায় ঝুপড়ি বেঁধে আছে। আমার মনে হয় মেয়েটা সেখানে চলে গেছে। হয়তো কোনো দেশোয়ালির সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে।

নীপা বউদি বলল, সেখানে আমরা যাব কী করে?

লালুদা বলল, দ্যাখোই না!

সত্যি লালুদা অসাধ্যসাধন করতে পারে।

টাটা সেন্টারের কাছাকাছি উল্টো দিকে গাড়িটা থামাল লালুদা। এখানে মেট্রো রেলের অনেকগুলো গুদাম ঘর, শেড আছে। মাঝখান দিয়ে একটা সরু পথ, অন্ধকার। লালুদার গাড়িতে টর্চও থাকে, লোডশেডিংয়ের সময়ের জন্য। নীপা বউদিকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে লালুদা শুধু আমাকে নিয়ে ভেতরে যেতে চাইল, নীপা বউদি রাজি হলো না। এত রাতে নীপা বউদির পক্ষে একা গাড়িতে বসে থাকা বিপজ্জনক।

ভিতরে ঢুকে দেখা গেল, এক জায়গায় রয়েছে অনেকগুলো ঝুপড়ি। কলকাতার একেবারে বুকের ওপর একটা আদিবাসী গ্রাম। একজন গার্ড প্রথমে আমাদের বাধা দিয়েছিল, লালুদা তার হাতে একটি কুড়ি টাকার নোট গুঁজে দিতে সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল আমাদের।

কিছু লোক এক জায়গায় গোল হয়ে বসে আছে, মাঝখানে জ্বলছে একটা হ্যাজাক। সেখানে হাত ধরাধরি করে নাচছে দুটি মেয়ে। অন্যরা হাততালি দিচ্ছে। তাদের পাশে পাশে দিশি মদের বোতল।

প্রথমে আমার বুকটা ছাঁৎ করে উঠেছিল। যে দু’জন নাচছে, তাদের মধ্যে একজন ফুলমণি নয়? সেই রকম নীলপাড় শাড়ি, মাথায় ফুল গোঁজা।

ফুলমণি যদি আমাকে কিছু না বলে চলে এসে এখানে এসে নাচত, তা হলে আমি একে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারতুম না। না, এ দুটি মেয়ের একজনও ফুলমণি নয়।

আমাদের দেখে নাচ থেকে গেল। ওরা মনে করল, আমরা পুলিশ। ওরা যদিও বে-আইনি কিছু করছে না, মদটা ওদের খাদ্যের মধ্যে পড়ে, আর নিজেরাই নাচ গানে মেতে আছে—তবু বিনা কারণেও পুলিশের ঝামেলা করতে তো বাধা নেই! ওদের সব বুঝিয়ে বলা হলো। ছোটপাহাড়ী থেকে কেউ এসেছে? ফুলমণি নামে কোনো মেয়েকে চেনে?

এরা এসেছে বীরভূম থেকে। ছোটপাহাড়ী কোথায় তা এরা জানে না।

এখানে ফুলমণি নামে কেউ নেই।

লালুদা অদম্য। গাড়িতে ফিরে এসে বলল, আমার মাথায় আর একটা আইডিয়া এসেছে! কী বলো তো?

লালুদার মাথার আইডিয়া আন্দাজ করার মতো প্রতিভা আমার নেই।

লালুদা বলল, কলকাতায় অনেক মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। রাইট? সেখানে অনেক মিস্ত্রি-মজুর কাজ করে, রাইট? মেয়েরা মাথায় করে ইট বয়ে নিয়ে যায়? সে-রকম কোনো বাড়িতে মজুরনীদের কাজ করতে দেখে ফুলমণির দেশের কথা মনে পড়ে গেছে। ফুলমণি ওমনি তাদের কাছে ছুটে গেছে। কী—যেতে পারে না? তুমি কী বলো, নীলধ্বজ?

নীলধ্বজ নামে কোনো ব্যক্তি নিশ্চয়ই এ বিষয়ে কিছু মতামত দিতে পারত, কিন্তু আমার মাথাটা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। কিছুই ভাবতে পারছি না।

লালুদা বলল, লেটস গো!

চৌরঙ্গির ওপরেই তৈরি হচ্ছে একটা এগারোতলা বাড়ি। গাড়ি চলে এল সেখানে। চারজন গার্ড মালপত্র পাহারা দিচ্ছে, কোনো মিস্তিরিমজুর রাত্তিরে সেখানে থাকে না।

এরপর থিয়েটার রোড।

এখানে যে বাড়িটা তৈরি হচ্ছে তার কন্ট্রাক্টর লালুদার চেনা।

দারোয়ানরা বসে বসে রুটি পাকাচ্ছে, লালুদা তাদের ঘরে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করল, সুখেন্দুবাবু হ্যায়?

পাগল না হলে সুখেন্দুবাবু নামে কন্ট্রাক্টরের এত রাতে এখানে থাকার কথা নয়। কিন্তু ও নামটা বলে দারোয়ানদের কাছে নিজের দর বাড়িয়ে নিল লালুদা। তারপর আসল কথাটা পাড়ল।

দারোয়ানদের মধ্যে একজন বেশ রসিক। সে জানালো যে ফুলমণি নামে কেউ নেই। আজ নতুন কোনো মেয়ে আসেনি। মুসলমান কামিন এখানে থাকে, তাদের কারুকে লাগবে?

নীপা বউদি বিরক্ত হয়ে বলল, দুর, এ ভাবে খোঁজা যায় নাকি? এটা পাগলামি হচ্ছে।

লালুদা বলল, তবে তো থানায় যেতেই হয়, হাসপাতালগুলোতেও খোঁজ নিতে হবে।

যাওয়া হলো ওয়াটগঞ্জ থানায়। ময়দান অঞ্চল ওই থানার এক্তিয়ারে।

এখানে নীপা বউদি গাড়িতেই বসে রইল। লালুদা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আমাকে বলল, কথাবার্তা যা বলার আমিই বলল, বুঝলে নীলরতন। তুমি চুপ করে থাকবে। নইলে তোমাকে যদি ফস করে অ্যারেস্ট করে ফেলে! অবশ্য অ্যারেস্ট করলেও তোমাকে ছাড়াবার ক্ষমতা আমার আছে।

দারোগাবাবু পাতলা কাগজে তামাক ভরে সিগারেট বানাচ্ছেন।

লালুদা দরজার কাছ থেকেই সাড়ম্বরে বলল, নমস্কার। কী খবর, ভালো? দারোগা প্রতি-নমস্কার না দিয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? টেবিলের ওপর হাত দিয়ে ঝুঁকে লালুদা বলল, একটি আদিবাসী মেয়ে, বুঝলেন, ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়েস হবে, সন্ধে থেকে হারিয়ে গেছে।

দারোগা ভুরু নাচিয়ে বলল, হারিয়ে গেছে, না পালিয়ে গেছে? কোথায় মাইফেল বসেছিল?

—মাইফেল মানে? ও, না, না, সেসব কিছু না। ফুলমণিকে পাওয়া যাচ্ছে না।

—ফুলমণি নামে আদিবাসী মেয়ে? কোনো আদিবাসী মেয়ে কক্ষনো হারায় না। সেরকম কোনো রেকর্ড নেই আজ অবধি।

—হ্যাঁ, হারিয়েছে। ফ্যাক্ট। ডায়েরি লিখুন।

—মার্ডার-ফার্ডার করে আসেননি তো? রাত সাড়ে এগারোটায় হঠাৎ একটা আদিবাসী মেয়ে সম্পর্কে এত দরদ?

—না, না, সে ছবি আঁকে।

—ছবি আঁকে! ও-ও-ও। ছবি আঁকলে আর মার্ডার করা যায় না?

—আপনি আমার কথা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না।

—আপনার কথা কিছু বুঝতেই পারছি না মশাই!

—জয়েন্ট পুলিশ কমিশনার আমার বন্ধু! আমার ফার্স্ট ফ্রেন্ড!

–সে কথা আগে বলেননি কেন? জয়েন্ট সি পি কিংবা সি পি কিংবা কোনে আই জি যদি আপনার বন্ধু হয় তা হলে আপনি মার্ডার-ফার্ডার যা খুশি করতে পারেন সেসব বুঝবে লালবাজার। এখানে কেন?

—আই ইনসিস্ট!

—আপনি সরুন না মশাই। ওই ছেলেটিকে বসতে দিন!

দারোগা আমার দিকে ভুরুর ইঙ্গিত করে বলল, কী হয়েছে বলো তো ভাই ঠিক দু’ লাইনে বলবে, বেশি সময় নষ্ট করবে না।

আমি মুখস্থ কবিতার ভঙ্গিতে বললুম, ছোটপাহাড়ী থেকে একটি সাঁওতা মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছিল, সে ভালো ছবি আঁকে। আজ তার ছবির প্রদর্শ ছিল অ্যাকাডেমিতে। সন্ধের পর থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তা পরনে…

—ব্যস, ব্যস, দু’ লাইন হয়ে গেছে। মেয়েটার ছবি কোথায়?

—ওর ছবি তো অ্যাকাডেমিতে টাঙানো হয়েছে।

—ওই ছবির কথা বলছি না। ফটোগ্রাফ। মেয়েটির ফটোগ্রাফ।

—তা তো তোলা হয়নি।

—কেন হয়নি?

লালুদা বাধা দিয়ে বলল, সে কি আমাদের আত্মীয় যে তার ছবি তুলে রাখব?

দারোগা লালুদাকে ধমক দিয়ে বলল, আত্মীয় যদি না হয় তা হলে সে হারিয়ে গেছে বলে আপনার এত মাথাব্যথা কেন?

তারপর দারোগা আমাকে বলল, চিন্তার কিছু নেই। বাড়ি যান। সে নিশ্চয় নিজের দেশে ফিরে গেছে। কলকাতা শহরের মতন একটা জঘন্য জায়গা তা ভালো লাগবে কেন? আমারই ভালো লাগে না। চান তো ডায়েরি লিখে নিচ্ছি কোনো দরকার নেই যদিও!

থানা থেকে বেরিয়ে এসে লালুদা বলল, ও ব্যাটারা খুঁজবে না। পলিটিক্যা লিডার ছাড়া আর কারুর কথা শোনেই না। লালবাজারে গিয়ে প্রেশার দিতে হবে

বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশ এখনো থমথমে, চমক দিচ্ছে বিদ্যুৎ। সিনেমা নাইট শো ভেঙেছে, তাই রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেল হঠাৎ। দোতলা বা ভর্তি মানুষ! সন্ধে থেকে কিছু খাইনি। খিদের কথা এতক্ষণ মনেও পড়েনি। এখ গোরুর গাড়ির চাকার মতন ঘর্ঘর শব্দে জেগে উঠল খিদে।

লালুদা বলল, কলকাতা শহরে এত গাড়ি-ঘোড়া, ট্রাম-বাস, তার মধ্যে গ্রামে একটা অবলা মেয়ে…একটা বনের হরিণীকে এনে যদি কলকাতার জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়, তা হলে কী অবস্থা হবে বলো তো!

আমি থ। এত রাত্রে আচমকা কবিত্ব শক্তি জেগে উঠল লালুদার। ফুলমণি…বনের হরিণী।

ফুলমণি-উপাখ্যান – ৮

পরদিন সকাল এগারোটার মধ্যেও কোনো খবর পাওয়া গেল না। হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নেওয়া হয়েছে, এমনকি এক পুলিশ বন্ধুকে ধরে মর্গেও ঘুরে এসেছে লালুদা। ফুলমণি যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে।

সিরাজুল সাহেবের বাড়িতে যাওয়া হলো।

অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে আমার ঝগড়ার ঘটনাটা এর মধ্যেই তাঁর কানে এসেছে। দু’জন তরুণ শিল্পী বসে আছে তাঁর ঘরে। আমার কাছে সব বিবরণ শুনে তাঁর মুখে দুঃখের ছায়া পড়ল, কিন্তু কোনো মন্তব্য করলেন না।

একটু পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন ওকে নিয়ে এলাম ওর গ্রাম থেকে। ওখানেই বেশ ছিল। শহরে কত খারাপ লোক আছে।

একজন শিল্পী বলল, শুনেছি কিছু লোক কলকাতা থেকে মেয়ে ধরে ধরে বম্বেতে বিক্রি করে দিয়ে আসে। আরব দেশগুলোতে অনেক মেয়ে চালান হয়।

সিরাজুল সাহেব বললেন, ওর কাছে কি টাকাপয়সা কিছু ছিল? এমনকি হতে পারে যে, আমাদের শিল্পী বন্ধুটির কথাবার্তায় ও অপমানিত বোধ করেছে তাই তক্ষুনি হাওড়ায় গিয়ে ট্রেনে চেপে তাতে ছোটপাহাড়ীতে ফিরে গেছে?

ফুলমণিকে আমি একশো টাকা দিয়েছিলুম। কিন্তু ও কি নিজে নিজে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে?

সিরাজুল সাহেব বললেন, রাস্তার লোককে জিজ্ঞেস করে করে হাওড়া পৌঁছে যাওয়া খুবই সম্ভব। ফুলমণি কথা কম বলে বটে, কিন্তু বোকা তো সে নয়। বোকা মানুষেরা শিল্পী হতে পারে না।

একজন শিল্পী বলল, যাই বলুন স্যার, আঙুল দিয়ে ছবি আঁকাটা ঠিক প্রপার আর্ট ফর্ম নয়। ওকে তুলি ধরতে শেখাতে হবে।

সিরাজুল সাহেব বললেন, ওসব কথা এখন থাক। আগে মেয়েটির নিরাপত্তা…আচ্ছা, ছোটপাহাড়ীতে টেলিফোন করে জানা যায় না?

আমি বললুম, ওখানে এখনো টেলিফোন যায়নি। আমি ভাবছি, আজই আমি একবার চলে যাব।

সিরাজুল সাহেব বললেন, কাল আমার একটা খুব জরুরি মিটিং আছে বটে, তবু আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারি। থাক কাজ। হ্যাঁ, চলুন আমি যাব।

একজন শিল্পী বলল, সে কী স্যার? আজ বিকেলে আপনার …

সিরাজুল সাহেব বললেন, তাতে কী হয়েছে। তোমরা ম্যানেজ করবে। আমি যাব—কটায় ট্রেন আছে, নীলুবাবু?

তরুণ শিল্পীটি বলল, আজ সিরাজুল সাহেবের জন্মদিন। সন্ধেবেলা একটা অনুষ্ঠান আছে, অনেকে আসবে এ বাড়িতে।

সিরাজুল সাহেব তবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে বাধা দিয়ে আমি বললুম, আপনার যাওয়ার কী দরকার? আমি গিয়ে খবর নিয়ে আসছি। ফুলমণিকে ওখানে পাওয়া গেলে আপনাকে জানাব, আমি ফিরেই দেখা করব।

অন্য শিল্পীটি বলল, সব দোষ অনিন্দ্য দাসের। উনি যা খুশি করবেন। কিন্তু ওর মুখের ওপর কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।

সিরাজুল সাহেব মিনতির সুরে বললেন, আমার বাড়িতে ওসব কথা আলোচনা করো না, প্লিজ!

অর্থাৎ সিরাজুল সাহেব নিজে তো নিন্দে করবেনই না, অন্য কারুর মুখে নিন্দে শুনতেও চান না।

এত কাণ্ডের মধ্যেও আমার এই একটি পরম লাভ হলো, সিরাজুল সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হলো।

বড় মাপের মানুষ না হলে কি বড় শিল্পী হওয়া যায়? এই প্রশ্নটা অনেকদিন ধরে আমার মাথায় ঘুরছিল।

দরজা পর্যন্ত আমাকে পৌঁছে দিতে এসে সিরাজুল সাহেব মৃদু গলায় বললেন, আপনি একলা একলা যাবেন, যদি আপনার কিছু রাহা খরচ…

আমি বললুম, আমি তো ওখানে চাকরি করি। আমাকে তো এমনিই যেতে হতো। চন্দনদাকে খবরটা জানান দরকার।

সিরাজুল সাহেব বললেন, তাড়াতাড়ি ঘুরে আসুন। ভালো খবর নিয়ে আসুন। উনি আমার হাত ধরলেন। আমি বললুম, দোয়া করবেন!

এখানকার খবরাখবরের ভার রইল লালুদার ওপর। লালুদা বলল, কোনো চিন্তা করো না। ফুলমণির খোঁজ পেলেই আমি তোমাকে কুরিয়ার সার্ভিসে জানিয়ে দেব। এমনকি নিজেও চলে যেতে পারি।

নীপা বউদি বললেন, নীলু, তুমি তোমার চন্দনদাকে বিশেষ ব্যস্ত হতে বারণ করো। ফুলমণি যদি ছোটপাহাড়ীতে না গিয়ে থাকে, এখানে তার সন্ধান পাওয়া যাবেই। মেয়েটা তো আর উধাও হয়ে যেতে পারে না।

লালুদা বলল, না, না, চন্দনের এখন কলকাতায় আসার দরকার নেই। সে কত কাজে ব্যস্ত। আমরা এদিকটা ঠিক ম্যানেজ করে নেব। সন্ধেবেলা অ্যাকাডেমিতে আর্ট এক্‌জবিশনেও আমি বসে থাকব।

যে-যার তালে আছে। চন্দনদা কলকাতায় না থাকলে লালুদার পক্ষে ও বাড়িতে আড্ডা জমানোর বেশি সুবিধে হয়।

হাওড়ার বাসে চাপবার সময় আমার মনে হলো, অনিন্দ্য দাসের বাড়ি দমদম উনি বিয়ে-টিয়ে করেননি। একা থাকেন। ছোটপাহাড়ী যাবার আগে ওঁর নাকে একটা ঘুষি মেরে যাওয়া উচিত নয় কি! যত নষ্টের গোড়া!

কিন্তু দমদম একেবারে উল্টো দিকে। সেখান থেকে ঘুরে হাওড়ায় যেতে হলে আর ছোটপাহাডীর ট্রেন পাব না। সেই জন্যই অনিন্দ্য দাস আমার হাতের ঘুষি থেকে বেঁচে গেলেন। কিংবা আমি ওর লাঠির আঘাত থেকে বেঁচে গেলুম বোধহয়।

হাওড়া স্টেশনে শান্তনু চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। উনি ললিতকলা অ্যাকাডেমির কোনো মিটিং-এ যোগ দিতে মাদ্রাজ যাচ্ছেন। চন্দনদার পেছনে এক তল্পিবাহক হিসেবে উনি আমাকে একবার মাত্র দেখেছেন, আমাকে ওঁর চেনার কথা নয়। তবু উনি চিনতে পারলেন। ট্রেনটা এখনো আসনি, আমরা অপেক্ষা করছি, উনি হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকলেন কাছে।

ছাই রঙের স্যুট ও টাই পরা, নিখুঁত পোশাক। মসৃণ মুখ। পাট করা চুল। উচ্চ মধ্যবিত্তের পরিচয় ওঁর সর্ব অঙ্গে লেখা, কেউ আর্টিস্ট হিসেবে ভুল করবে না। অথচ ভালো ছবি আঁকেন।

শান্তনু চৌধুরী খানিকটা ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বললেন, শুনুন, সেদিন আপনার নামটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। আপনি চন্দনের ভাই, তাই না?

কথা না বাড়িয়ে আমি মাথা নেড়ে দিলুম।

শান্তনু চৌধুরী বললেন, অনিন্দ্য নাকি এক কাণ্ড করেছে? আপনাকে আর ঐ মেয়েটিকে নিয়ে…ঠিক কী হয়েছিল। বলুন তো?

মানুষের চরিত্রে যতগুলো খারাপ দিক থাকে, তার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হলো অসাক্ষাতে কোনো বন্ধুর নিন্দে উপভোগ করা। শান্তনু চৌধুরীকে সবাই অনিন্দ্য দাসের খুব বন্ধু বলে জানে।

এ ব্যাপারটাতে আমি প্রশ্রয় দেব কেন? আমি উল্টে বললুম, আপনি কী শুনেছেন?

শান্তনু চৌধুরী একঝলক হেসে বললেন, অনিন্দ্য নাকি ঐ সাঁওতাল মেয়েটার কাপড় ধরে টেনেছে সবার সামনে?

এবার বোঝা গেল যে, শান্তনু চৌধুরী নিখুঁত ভদ্রতার প্রতিমূর্তি হলেও ওঁর ঝোঁক আদিরসের দিকে।

মাথা নেড়ে বললুম, হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন।

শান্তনু চৌধুরী বললেন, আর একবার কী হয়েছিল জানেন? একটা পার্টিতে অনিন্দ্য এমন বেসামাল হয়ে গেল, ক্যালকাটা ক্লাবের মেম্বার মিস্টার নানপুরিয়ার বউকে, সে মেয়েটি একবার মিস ইন্ডিয়া হয়েছিল, সবার সামনে অনিন্দ্য তাকে বলল, তোমার ঐ ইয়েদুটো, বুঝলেন না, ইয়ে ঐ দুটো কি ফল্স? লজ্জায় আমরা মুখ তুলতে পারি না। তারপর থেকে মিসেস নানপুরিয়ার দিকে তাকালেই আমার ওর ইয়েদুটোর দিকে, ফল্স না আসল..

ট্রেন ঢুকতেই একটা শোরগোল পড়ে গেল।

শান্তনু চৌধুরী এ. সি ফার্স্ট ক্লাসে যাবেন, তাঁকে আর দেখা গেল না।

আমার শরীর মন কেমন যেন অসাড় হয়ে গেছে, ট্রেন চলতে শুরু করার পরেই আমি ঘুমে ঢুলতে লাগলাম।

এই দূরপাল্লায় ট্রেনটা বালুঘাই স্টেশনে এক মিনিটের জন্য থামে। কেন অত ছোট স্টেশনে থামে তা কে জানে! আমার পক্ষে সুবিধেজনক।

একটাই মুশকিল, রেলস্টেশন থেকে ছোটপাহাড়ী যেতে বাস ছাড়া উপায় নেই। রাত আটটায় শেষ বাস ছেড়ে যায়। এই ট্রেনটা লেট করলেই চিত্তির!

ঠিক লেট হলো দেড় ঘণ্টা।

আজকাল যেহেতু ছোটপাহাড়ীতে নানা রকম কনস্ট্রাকশন চলছে, তাই মালপত্র নিয়ে অনেক ট্রাক যায়। ট্রাকগুলোর দিন-রাত্রি জ্ঞান নেই। চন্দনদা প্রথম দিনই আমাকে বলে দিয়েছিল, যদি কোনোদিন বালুঘাই স্টেশনে পৌঁছে বাস মিস্‌ করিস, তা হলে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে হাত দেখাবি, কোনো না কোনো ট্রাক তোকে পৌঁছে দেবে।

এত ছোট স্টেশনে দশ-পনেরো জনের বেশি যাত্রী ওঠানামা করে না। অনেক আগেই আমার ঘুম ভেঙে গেছে, তবু ঘুম ঘুম চোখে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে আমি বড়রাস্তার দিকে এগোতে যাচ্ছি, এমন সময় কে যেন ডাকল, মিঃ নীললোহিত!

দৈববাণী নাকি? কিন্তু ঠাকুরদেবতারা কি আমাকে মিস্টার বলবে? কে জানে, আজকাল হয়তো ঠাকুরদেবতারা খুব হিন্দি ফিল্ম দেখে।

প্রায় যেন মাটি ফুঁড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন মহিম সরকার। আমার হাত ধরে বললেন, আরে মশাই, আপনাকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছেন না? চলুন, আমার জিপ আছে। ঐ যে ডানদিকে।

আমি বললুম, আপনি এখানে কেন?

আসলে আমার মাথা থেকে ঘুম কাটেনি। মহিম সরকারকে দেখে তো আমার খুশি হবারই কথা।

উনি ওঁর কোনো আত্মীয়কে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছেন। বেশ সহজে আমি লিফ্ট পেয়ে গেলুম। তবু যেন আমার মনে হচ্ছে, হাইওয়েতে গিয়ে আমাকে হাত দেখিয়ে কোনো ট্রাক থামাতে হবে।

আমাকে টেনে তুলে মহিম সরকার ড্রাইভারের পাশের সিটে বসিয়ে দিলেন। জিপ চালাচ্ছেন উনি নিজে।

গাড়ি স্টার্ট দেবার পর মহিম সরকার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কী খবর বলুন। কলকাতায় সব ঠিকঠাক হলো?

আমি বললুম, হ্যাঁ, খবর খুব ভালো, খুব ভালো। যে-জন্য গিয়েছিলুম, অত্যন্ত সাকসেসফুল। ছোটপাহাড়ীর খবর কী?

—ছোটপাহাড়ীর খবর ঠিকই আছে। আপনার ওখানকার তেতলায় কনস্ট্রাকশন অনেকটা হয়ে গেছে। মিঃ নীললোহিত, ছাদ ঢালাইয়ের সময় কিন্তু আপনাকে উপস্থিত থাকতে হবে। জানেন তো, ঢালাই একবার থেমে গেলে কত ক্ষতি হয়?

—থাকব। নিশ্চয়ই থাকব। ফুলমণি আবার কাজ করবে?

–ফুলমণি?

—আপনি এত চমকে যাচ্ছেন কেন? ফুলমণি, যে ভালো ছবি আঁকে। সে ফিরেছে নিশ্চয়ই?

—তাকে তো আপনি সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন কলকাতায়।

—হ্যাঁ, কিন্তু সেকি একলা ফিরতে পারে না?

—তা তো আমি জানি না। কিন্তু নীললোহিত, আমি যতদূর জানি, সে ফেরেনি। সবাই জানে,আপনি তাকে কলকাতায় নিয়ে গেছেন। আপনিও আর ফিরবেন না, সে-ও ফিরবে না।

—আরে মোলো যা! আমার ফেরার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক? ফুলমণি আমার কে?

হঠাৎ যেন একটা ঝাঁকুনি খেয়ে আমি সজাগ হলুম। এসব আমি কী বলছি? লালুদা আর নীপা বউদি পইপই করে বলে দিয়েছিল, ফুলমণির হারিয়ে যাবার খবরটা যেন চন্দনদার আগে অন্য কারুকে জানানো না হয়। ঘুমের ঘোরে আমার গুলিয়ে গেছে সব কিছু।

মহিমবাবু আমার দিকে ত্যারছা চোখে তাকিয়ে আছেন।

কথা ঘোরাবার জন্য আমি বললুম, আমাকে মিস্টার মিস্টার বলেন কেন, মহিমবাবু? আমি ক্লাস থ্রি স্টাফ, আপনার মতন তো অফিসার নই। আপনার থেকে আমি বয়েসেও অনেক ছোট। আমাকে শুধু নাম ধরে ডাকবেন।

–ও, এ-কথাটা প্রথম দিন বললেই পারতেন। আমি ভেবেছিলাম বড় সাহেবের ভাই।

—সিগারেট খাবেন? এখানে বৃষ্টি হয়নি? কাল কলকাতায় কী তুমুল বৃষ্টি

—ফুলমণিকে কোথায় রেখে এলেন?

এ যে ভবী ভোলবার নয়। ঘুরে ফিরে আবার সেই ফুলমণির কথা। কেন যে মহিমবাবুর জিপে উঠলুম!

–ও তো কলকাতাতেই রয়ে গেছে। ওর একজিবিশান যতদিন চলবে…ওর ছবির খুব নাম হয়েছে, বুঝলেন।

—তবে কেন জিজ্ঞেস করলেন ফুলমণি ফিরেছে কি না?

—ওটা এমনই আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলুম।

—হু।

আমি বুঝব কী করে মহিমবাবু এর মধ্যে তাঁর শালা কিংবা ভাইপোর চাকরি মনে মনে পাকা করে ফেলেছেন। বাকি রাস্তা তিনি আমার সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। আমি গল্প জমাবার চেষ্টা করলেও হুঁ-হাঁ করে সারলেন।

জঙ্গলটা পেরিয়ে ছোটপাহাড়ীতে পৌঁছে বাজারে কাছটায় এসে মহিমবাবু বললেন, একটা মুশকিল হয়েছে, আমার জিপে ডিজেল খুব কম, আপনার গেস্ট হাউসে পৌঁছোতে গেলে…আমার গাড়ি সম্পূর্ণ উল্টো দিকে…যদি ডিজেল একেবারে ফুরিয়ে যায়? আপনি এইটুকু হেঁটে যেতে পারবেন?•

লোকটা মহা কিপ্যুস তো। দেড় ঘণ্টা জিপ চালিয়ে এল, আর দশ মিনিট চালালেই ডিজেল ফুরিয়ে যাবে? আসলে আমাকে অবজ্ঞা দেখাতে চায়।

তবু ওঁকে খাতির করে বললাম, না, না, আমার বাড়ি বাঁ দিকে, আপনি এখান থেকে ঘুরে চলে যান। আমি এইটুকু রাস্তা স্বচ্ছন্দে হেঁটে যেতে পারব। মালপত্র কিছু নেই, আপনি যে এতটা পৌঁছে দিলেন, তাতেই কত উপকার হলো। ট্রাক ধরে এলে পয়সা লাগত!

গাড়ি থেকে নেমে বললুম, আচ্ছা। কাল দেখা হবে।

মহিমবাবু বললেন, নিশ্চয়ই

ছোট্ট বাজার, অনেক আগেই আলো-টালো নিবিয়ে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারের পেছনে একটা নতুন কুলি বস্তি, ক্ষীণ গান-বাজনার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে সেখানে।

আমার রাস্তা ডান দিকে, সম্পূর্ণ অন্ধকার।

এরকম অন্ধকার, এরকম নিস্তব্ধতা কলকাতায় দেখা যায় না। গাড়ি-টাড়ি তো দূরের কথা, একটাও মানুষ নেই পথে। দু’ পাশে এখনো প্রচুর ফাঁকা মাঠ, দূরে দূরে বাড়ি, সেসব বাড়ির লোকেরা ঘুমিয়ে পড়ে নটা-সাড়ে নটার মধ্যে। টি ভি নেই তো ভদ্রলোকেরা জেগে থাকবে কী করে?

গেস্ট হাউসে নয়, আগে যেতে হবে চন্দনদার বাড়িতে।

চন্দনদা কোনো কোনোদিন দেড়টা-দুটো পর্যন্ত জেগে পড়াশুনো করে, আবার কখনো ঘুমিয়ে পড়ে রাত দশটার মধ্যে—কোনো ঠিক নেই। আজ ঘুমিয়ে পড়লেও জাগাতেই হবে। ফুলমণির দায়িত্বটা আমি এবার চন্দনদার ওপর দিয়ে দিতে চাই, আমি আর পারছি না।

কাছেই পাহাড় ও জঙ্গল আছে বটে কিন্তু নির্জন রাস্তায় হঠাৎ হিংস্র জন্তু—জানোয়ারের ভয় নেই। তবে সাপ বেরোয় প্রায়ই। বিশেষত বৃষ্টির দিনে। সাপ তাড়াবার শ্রেষ্ঠ উপায় মাটিতে জোরে জোরে শব্দ করা। আমি চটি দিয়ে ধপাস ধপাস করে এগোতে লাগলুন।

নিজের পায়ে আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাওয়ার কথা নয়। হঠাৎ যেন আরও কয়েকটা পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল।

পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, অন্ধকারের মধ্যেই চলন্ত অন্ধকার হয়ে গোটা কয়েক লোক ছুটে আসছে। ওরা কারা কে জানে, আমি সরে দাঁড়ালুম এক পাশে

লোকগুলো কিন্তু আমারই কাছে এসে থেমে গেল এবং ঘিরে ফেলল। মিস্তিরি—কুলি শ্রেণীর মানুষ, কয়েকজনের হাতে লাঠি।

একজন জিজ্ঞেস করল, এ বাবু, ফুলমণি কোথায়?

লোকগুলোকে ঠিক চিনতে পারছি না। ওরকম রুক্ষ স্বরের প্রশ্ন আমার পছন্দ হলো না। ফুলমণি, সে কৈফিয়ৎ যদি দিতে হয় তার শ্বশুরকে দেব, এরা কারা!

জিজ্ঞেস করলুম, তোমরা কে?

সেই লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, ফুলমণি কোথায়?

-সে কলকাতায় আছে।

—তাকে আনলি না কেন?

—তার কাজ এখনো শেষ হয়নি।

–তুই নিয়ে গেছিস, তুই আনবি না?

–সে এখন…

আমার কথাটা শেষ করতে দিল না, একজন আমার মাথায় চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। আর একজন পিঠে মারল লাঠির বাড়ি।

আমি লাফিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করে বললুম, আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, আমার কোনো দোষ নেই, ফুলমণি…।

ওরা আমাকে কোনো কথা বলতে দিতে চায় না। সবাই চালালো কিল-চড়—ঘুষি। এবার পালানো ছাড়া উপায় নেই। দৌড় মারবার চেষ্টা করতেই একজন আমার পায়ে খুব জোরে একটা লাঠির ঘা কষালো। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলুম, পাথুরে রাস্তায় কপালটা ঠুকে গেল, ছেঁচে গেল নাক।

এবার একজন আমার মাথা ঘেঁষে কাঁধে যে জিনিসটা দিয়ে মারল সেটা লাঠি না লোহার রড? যা-ই হোক, তাতে কিছু আসে যায় না, মোট কথা আমার মাথা ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে বুঝতে পারছি। আরও মারছে, আর কত মারবে!

সেই অবস্থায় আমার মনে পড়ল, ভাগ্যিস সিরাজুল তারিক সহেব আমার সঙ্গে আসেননি। যদি তাঁকেও এরা…

আমি গড়াবার চেষ্টা করেও পারছিলুম না। আর কিছু চিন্তাও করতে পারছি না কেন? চোখের মধ্যে যেন অনবরত বিদ্যুতের ঝিলিক দিচ্ছে। আমি কি অজ্ঞান হচ্ছি, না মরে যাচ্ছি? মৃত্যুর সময় বুঝি চোখে এরকম ঝিলিক খেলে। এরা আমাকে শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলল? ছি ছি ছি ছি।

একেবারে শেষ মুহূর্তে আমি টের পেলাম বৃষ্টি নেমেছে।

আমার শেষ চিন্তাটা এই যে, ছোটপাহাড়ীতে আমার চাকরির এই শেষ। এক মাসের মাইনেটাও পেলুম না? এরা আমাকে পুরো একটা মাসও চাকরি করতে দিল না। আজ মাসের ঊনতিরিশ তারিখ। মায়ের হাতে তুলে দিতে পারলুম না একটা টাকাও। আমি একটা অপদার্থ!

ফুলমণি-উপাখ্যান – ৯

চিরকাল একজনের দোষে অন্য একজন মার খায়।

হিরোসিমা-নাগাসাকিতে যে হাজার হাজার মানুষ অ্যাটম বোমার ঘা খেয়ে মরেছিল, তারা কি যুদ্ধ বাধাবার জন্য দায়ী ছিল? দাঙ্গার সময় মরে শুধু নিরীহ লোকেরা, যারা অস্ত্র ধরতেই জানে না। দুই গুণ্ডার দলের বোমা মারামারির সময় শিয়ালদার কাছ প্রাণ দিয়েছিল শুধু একটি স্কুলের মেয়ে!

আড়াই বছর আগে ছোটপাহাড়ী থেকে একজন কন্ট্রাকটর নাকি একটি বেশ ডবকা আদিবাসী মেয়েকে ফুসলে নিয়ে গিয়েছিল। তা আমি জানব কী করে? সেই কারণে ছোটপাহাড়ীর লোকেরা সন্দেহপ্রবণ হয়ে আছে। আমি কি ফুলমণিকে ফুসল নিয়ে গেছি নাকি? আহা, একে ফুসলানি বলে, আমি তার হাতও ধরিনি একবার, সব মিলিয়ে তার সঙ্গে আড়াইখানা বাক্য বিনিময় হয়েছে কিনা সন্দেহ। আড়াই বছর আগেকার সেই ঠিকাদার পালিয়ে গিয়ে দিব্যি মজা মারল, তাকে কেউ ধরতে ছুঁতে পারল না, তার বদলে মার খেয়ে মরলুম আমি!

না, ঠিক মরিনি অবশ্য। বেকারের জান খুব কড়া হয়। বেকাররা যদি পটাপট মরে যেত, তা হলে তো এদেশের অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত।

বেকাররা মরে না, তারা রক্তবীজের মতন বাড়ে।

মাথা ও ঘাড়ের ঘা শুকিয়ে গেছে, ঝামেলা বাঁধিয়েছে বাঁ পাটা। ঢাউস একটা প্লাস্টারের পোশাক পরিয়ে আমায় বিছানায় শুইয়ে রেখেছে এক মাস। হাঁটুর মালাইচাকি আর গোড়ালি নাকি টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।

মাকে বলা হয়েছে যে আমি পাহাড়ে ট্রেকিং করতে গিয়ে এক খাদে পড়ে গিয়েছিলুম। দুর্ঘটনার চেয়ে মানুষের হাতে মার খাওয়া মায়েদের চোখে বেশি ভয়াবহ। কারণ যারা মেরেছে তারা আবার মারার চেষ্টা করতে পারে। আমি অবশ্য হালফিল আর ছোটপাহাড়ীতে যাচ্ছি না।

নীপা বউদিরা প্রায়ই আমাকে দেখতে আসে। চন্দনদা দুবার ঘুরে গেছে। প্রায় প্রতিদিন আসে লালুদা। লালুদা এলেই আমি মুখের ওপর চাদর টেনে, ঘাপটি মেরে ঘুমের ভান করে থাকি। লালুদার বাক্যস্রোত কি রোজ সহ্য করা যায়? অথচ একটা মানুষকে বাড়িতে আসতে বারণ করা যায়?

লালুদা আসে দুপুরের দিকে। নিজস্ব ব্যবসা, যখন তখন ছুটি। আমার সন্দেহ হচ্ছে লালুদা এই সুযোগে আমার বউদির সঙ্গে প্রেম করার চেষ্টা করবে। বউদি সকালের ইস্কুলে পড়াতে যায়, সারা দুপুর বাড়িতে থাকে। বিবাহিতা বৌদের সঙ্গে প্রেম করা লালুদার দ্বিতীয় পেশা।

আমার বউদি দুটো মিষ্টি কথায় গলে যাবার মতন মেয়ে নয়। লালুদার কাঁঠালি কলা মার্কা ঠোঁট কোনো মেয়ের পছন্দ হবেই বা কেন? কিন্তু লালুদার এটি মোক্ষম অস্ত্র আছে। পরোপকার। আমাদের বাথরুমের সিস্টার্ন থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়া আজ পর্যন্ত কেউ বন্ধ করতে পারেনি, তলায় গামলা পেতে রাখতে হয়, লালুদা কোথা থেকে এক জাদুকর মিস্ত্রি নিয়ে এসে সেটা সারিয়ে দিল। ঠিকে ঝি. দেশে গিয়ে আর ফেরেনি, লালুদা এনে দিয়েছে এক আদর্শ কাজের মেয়ে, যে মাইনে কম নেয়, ফাঁকি মারে না। মা ও বউদির কাছে লালুদার ভাবমূর্তি বেশ উজ্জ্বল।

আমাকে প্রায়ই সান্ত্বনা দিয়ে লালুদা বলে, তোমার কোনো চিন্তা নেই, নীলকণ্ঠ, তুমি সেরে উঠলেই তোমাকে আমি অন্য চাকরি জোগাড় করে দেব। ওরকম ধাদ্ধাড়া গোবিন্দপুরেও যেতে হবে না।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আবার চাকরি। আমার কপালে চাকরি সয় না।

মুমু একদিন এসে বলল, অ্যাই ব্লু, তুমি সবসময় শুয়ে থাক কেন? লেজি বোন্‌স! শুধু শুয়ে থাকলে তুমি আরও লেজি হয়ে যাবে, আর কোনোদিন হাঁটতে পারবে না।

মুমু এলেই ঘরের মধ্যে টাটকা বাতাস খেলে যায়। জবা ফুলের মতন একটা লাল টকটকে ফ্রক পরে এসেছে মুমু। হাতে একটা চেকোলেট বার। বাচ্ছা ছেলেকে লোভ দেখাবার মতন করে বলল, তুমি যদি আজ হাঁটতে পার, তোমাকে এই চকোলেট খাওয়াব।

আমার হাত ধরে টেনে বিছানা থেকে নামাল মুমু। তারপর সুর করে বলল, হাঁটি হাঁটি পা পা, খোকাবাবু আসছে সরে যা।

মুমুর কাঁধে ভর দিয়ে এক দিকের দেয়াল পর্যন্ত গেলুম। হাঁটুতে ব্যথা লাগছে বেশ, কিন্তু অসহ্য নয়।

মুমু বলল, রোজ একটু হাঁটতে হয়, না হলে জয়েন্টগুলো খারাপ হয়ে যায়।

–তুই কোথা থেকে জানলি রে, মুমু?

—আমার একবার পা ভেঙেছিল না? প্রত্যেকেরই একবার করে পা ভাঙে।

—তা ঠিক বলেছিস। যাদের একবারও পা ভাঙে না, তারা পায়ের মর্ম বোঝে না।

—ব্লু, সেবারে তুমি আমাকে দিকশূন্যপুরে নিয়ে যাবে বলে আমাকে বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড়ে রেখে এলে। আমার আর দিকশূন্যপুর দেখা হলো না। একবার নিয়ে যাবে না?.

–তোর বয়েসী মেয়েদের সেখানে যেতে নেই।

—তাহলে তখন বলেছিলে কেন?

—তখন তোকে ভোলাবার জন্য…তোর তখন খুব মন খারাপ ছিল।

–কেন আমার বয়েসীদের দিকশূন্যপুর যেতে নেই?

—ওখানে যারা যায়, তার সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে যায়, আর ফেরার কথা চিন্তা করে না। তোর এখনো পড়াশুনা বাকি, আরও অনেক কিছু বাকি।

—তুমি যাও কেন? তুমি তো ফিরে আস!

—ওখানে বন্দনাদি বলে একজন আমাকে খুব ভালোবাসে। তাকে দেখতে যাই। ওখানে কেউ শুধু শুধু বেড়াতে গেলে অন্যরা পছন্দ করে না। শুধু আমার পারমিশান আছে। আমি দু’একজনকে দিকশূন্যপুরে পৌঁছে দিয়েছি।

—ওখানে কী আছে বলো না।

—খুব সুন্দর জায়গা, যার যেমন ইচ্ছে সেইভাবে থাকতে পারে। প্রত্যেকেই নিজের জিনিসটা তৈরি করে নেয়, কোনো কিছুরই অভাব নেই। যার যেটা বেশি আছে, সে সেটা অন্যকে দেয়, এইরকম ভাবে বদলাবদলি হয়।

—কারা ওখানে গিয়ে থাকে?

—যারা খুব দুঃখী, যাদের কেউ ঠকিয়েছে, খুব আঘাত দিয়েছে, তারা যায়, ওখানে গিয়ে সব দুঃখ ভুলে যায়।

—কোথায় জায়গাটা? কত দূরে?

—সে এক নিরুদ্দেশের দেশ। ঠিকানা বলতে নেই!

মুমু অনেকদিন পর আমাকে দিকশূন্যপুরের কথা মনে পড়িয়ে দিল।

দিকশূন্যপুর আমাকে টানে। বন্দনাদি, রোহিলা, জয়দীপ, বসন্ত রাও এদের দেখিনি কতদিন।

যেদিন আমার পায়ের প্লাস্টার কাটা হলো, সেদিন বিকেলে এল চন্দনদা। মুখখানা গম্ভীর। একটা না-জ্বালা চুরুট মুখে দিয়ে বসে রইল চুপ করে।

আমি একসময় বললুম, আর দু’দিন পরেই পুরোপুরি ফিট হয়ে যাব। মধ্যপ্রদেশে আমার এক বন্ধু চাকরি পেয়েছে, আমাকে নেমন্তন্ন করেছে, ওর ওখানে থেকে ঘুরে আসব ভাবছি। বস্তারের জঙ্গল।

চন্দনদা বলল, হুঁ, বস্তারের জঙ্গল। তুই জঙ্গল খুব ভালোবাসিস, তাই না, নীলু! সুন্দরবনে গেছিস?

—অনেকবার।

—আমাকে একবার নিয়ে যাবি? আমি সুন্দরবন দেখিনি। আচ্ছা, না থাক।

—থাক কেন? সুন্দরবন তো যে-কোনোদিন যাওয়া যায়। তোমার ছুটি থাকলে এই উইকএন্ডেই চলো।

—নাঃ, এখন সুন্দরবন যাব না।

চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে একবার জানলার ধারে গিয়ে বাইরে উঁকি দিল চন্দনদা। আমার টেবিলের ওপর বইগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ফুলমণির খবর পাওয়া গেছে, শুনেছিস তো?

—না তো! কোথায়?

—লালু তোকে বলেনি?

—লালুদা ঠিক দরকারের কথা ছাড়া অন্য সব কথা বলে। কোথায় আছে ফুলমণি! ছোটপাহাড়ীতে ফিরে গেছে?

—সেখানে ফেরেনি। ফুলমণি থাকে অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে।

আমি দারুণ চমকে গেলুম এবার। অনিন্দ্য দাস? সেই দুর্মুখ শিল্পী? যিনি সেই রাতে ফুলমণিকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন?

চন্দনদা বলল, নাঃ, জোর-টোরের ব্যাপার নেই। প্রেমের ব্যাপার। যাতে যার মজে মন কিবা হাঁড়ি কিবা ডোম!

—অনিন্দ্যবাবু কখন ফুলমণির প্রেমে পড়লেন?

—অনিন্দ্য তো প্রেমে পড়েনি, সে প্রেম-ট্রেমে বিশ্বাসই করে না। এক্ষেত্রে অনিন্দ্যই হচ্ছে ডোম, তার প্রেমে পড়েছে ফুলমণি।

—কী উল্টোপাল্টা বলছ, চন্দনদা? ফুলমণি কারুর প্রেমে পড়তে পারে নাকি? মানে…অনিন্দ্যবাবুকে সে কতটুকু দেখেছে?

—শোন, তুই কানু রায়কে চিনিস? কানু রায় ছবি আঁকে না। কিন্তু সে সব ছোট-বড় শিল্পীদের চেনে, আর্ট ওয়ার্লড-এ ঘোরাফেরা করে। সেই কানু রায় গিয়েছিল অনিন্দ্যর বাড়িতে। সে দেখে এসেছে, ওরা দু’জনে বেশ মজায় আছে, দু’জনেই ছবি আঁকছে। ফুলমণি নাকি তাকে বলেছে যে অ্যাকাডেমির প্রদর্শনীতে সে যত শিল্পীদের দেখেছে, তাদের কারুকেই তার সত্যিকারের পুরুষ বলে মনে হয়নি। অনিন্দ্য তাকে বকাবকি করলেও তাকে দেখা মাত্র ফুলমণি মুগ্ধ হয়েছে। তার চোখে অনিন্দ্যই সত্যিকারের পুরুষ এবং শিল্পী। তাই অনিন্দ্য একটা ইঙ্গিত করা মাত্র ফুলমণি তার সঙ্গে চলে গেছে।

—ফুলমণি এত কথা বলতে পারে?

—এখন হয়তো তার মুখে কথা ফুটেছে

—অনিন্দ্যবাবু তো দমদমে থাকেন, তাই না?

—দমদমে এরকমভাবে একটা মেয়েকে নিয়ে থাকা চলত না। সুন্দরবনে অনিন্দ্যদের একটা লাট আছে। চাষবাস হয়, মাছের চাষ হয়, একটা বাড়িও তৈরি করেছে। সেখানে অনিন্দ্য প্রায় ছবি আঁকতে বা মূর্তি গড়তে যায়। ও এমনিতেই কারুকে গ্রাহ্য করে না, আর সেখানে তো সমাজ বলতে কিছু নেই।

—ফুলমণি কারুকে কিছু না বলে অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে চলে যাবে, এটা যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, চন্দনদা। যাই হোক, যদি সত্যি হয়, ফুলমণি তা হলে ভালোই আছে। ওর জন্য ছোটপাহাড়ীতে তোমাদের আর কোনো গোলমাল হয়নি তো?

—নাঃ! তোকে মারধোর করার পর ওরা খানিকটা স্কেয়ার্ড হয়ে গেছে। আমরাও পুলিশ প্রোটেকশান নিয়েছিলাম। আমি এখানে আসবার দু’দিন আগে শুনলাম, ফুলমণি তার শ্বশুরের নামে দুশো টাকা পাঠিয়েছে মনিঅর্ডার করে। তাতে লোকে বুঝে গেল যে সে স্বেচ্ছায় অন্য কোনো জায়গায় রয়েছে। এরপর আর আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। বুড়োটা বেশ মজাতেই আছে! এর মধ্যে আবার তার কোনো এক ভাইপো বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে এসেছে ঐ বাড়িতে। তারা বুড়োকে খুব আদর যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। তার মানে, বুড়ো চোখ বুজলেই বাড়িটা হাতিয়ে নেবে।

—ফুলমণিকে নিয়ে তাহলে আর আমাদের মাথা ঘামাতে হবে না? যাক বাঁচা গেল!

—তুই অবশ্য ইচ্ছে করলে একবার দেখে আসতে পারিস, নীলু, কানু রায়ের কথা কতটা সত্যি। আমি অবশ্য তোকে যেতে বলছি না। তোর কোনো দায়িত্ব নেই, তুই যথেষ্ট ভুগেছিস।

—যেতে হলে আমরা দুজনেই তো একসঙ্গে…

–আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না রে।

–কেন?

—নীপা দারুণ রেগে আছে। ফুলমণি অনিন্দ্যর কাছে আছে শুনেই বলল, তোমার বন্ধু একটা দুশ্চরিত্র। তোমরা পুরুষরা সবাই এরকম। ফুলমণির ছবি নিয়ে মাতামাতি করে তোমরা আসলে নিজেদের আর্ট-বোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছিলে, ওর জীবনটার কোনো মূল্য দাওনি। ওর শেকড় ছিঁড়ে ওকে ছোট পাহাড়ী থেকে উপড়ে আনার কী দরকার ছিল? এখন যদি আমি যাই…

—অনিন্দ্য দাস বুঝি আগেও এরকম করেছে।

—ওকে ছোটবেলা থেকে চিনি তো। মেয়েদের মন ভোলাতে একেবারে ওস্তাদ। ওর টেকনিকটা কী জানিস, ও মেয়েদের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে না, প্রেম জানায় না, প্রথমেই রুক্ষভাবে কথা বলে, এমনকি দুমদাম গালাগালি দেয়। আশ্চর্য! তাতেই অনেক মেয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। চেহারাটা তো রাফ, মেয়েরা মনে করে ও একেবারে রিয়েল মাচো, হি-ম্যান! কয়েক বছর আগে হাইকোর্টের এক জজের মেয়ে, দারুণ সুন্দরী, ওর জন্য একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিল।

–সে মেয়েটি এখন কোথায়?

-কে জানে!

—তুমি না গেলে আমিও যাব না, চন্দনদা?

–যাস না। আমি মোটেই যেতে বলছি না। অনিন্দ্যদের গ্রামটার নাম বোয়ালভাসি, ক্যানিং থেকে লঞ্চে যেতে হয় গোসাবা, সেখান থেকে মাইল চারেক দূরে গ্রাম। ও, তোকে আর এসব কথা বলছি কেন, তুই তো সুন্দরবনের সবই চিনিস।

চন্দনদা চলে যাবার পর বোয়ালভাসি নামটা আমার মাথায় ঘুরতে লাগল অনবরত। এক একটা নাম, এক একটা শব্দ হঠাৎ মনে গেঁথে যায় কেন যেন! গোসাবার কাছে রাঙাবেলিয়া, সাতজেলিয়া, সজনেখালি এই সব গ্রাম আমি চিনি, গেছি কয়েকবার। কিন্তু বোয়ালভাসির নাম আমি আগে শুনিনি। এককালে এই সব অঞ্চল ছিল হ্যামিলটন সাহেবের জমিদারি, সাহেব চলে যাবার পর কিছু কিছু সমৃদ্ধ বাঙালি সেখানে ফার্মিং শুরু করেছিল।

রাস্তায় বেরুতে শুরু করার দু’তিনদিন বাদেই বুঝতে পারলুম, বোয়ালভাসি গ্রামটা আমাকে চুম্বকের মতন টানছে।

একটা অদম্য কৌতূহল, অনিন্দ্য দাসের মতন মানুষের সঙ্গে ফুলমণির কী করে জোড় মিলল, সেটা শুধু দেখে আসা।

তা হলে মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে যাবার আগে একবার সুন্দরবনটাই ঘুরে আসা যাক।

গোসাবা পৌঁছে একটা সাইকেল ভ্যান ধরলুম। নিজের দুটো পা ছাড়া এটাই এখানকার প্রধান যানবাহন। ভ্যানচালককে বললুম, বোয়ালভাসি যাব গো, দাসবাবুদের খামারে।

ভ্যানচালক বলল, সেখানে তো দুটো দাসবাবুর খামার। কেনটায় যাবেন?

বললুম, একজন দাসবাবু, খুব লম্বা, ছবি-টবি আঁকেন, তাকে চেনো? সে বলল, অ। যে-বাবু মেয়েছেলে দাঁড় করিয়ে তার মূর্তি বানায়, সে তো? হ্যাঁ চিনি।

বোঝা গেল, অনিন্দ্য দাস সেখানেও বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। ভ্যানচালক মাইল চারেক ইঁটের রাস্তায় চালিয়ে নিয়ে এসে একটা নদীর ধারে থেমে বলল, এবার খেয়া নৌকায় পার হয়ে যান। ঐ যে দেখা যাচ্ছে ওপারে দাসবাবুদের খামার

খেয়ার নৌকায় ওঠার পর আমার ভয় ভয় করতে লাগল।

অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল। উনি এখন কী রকম মেজাজে আছেন কে জানে। উনি যদি মনে করেন আমি অপমানের শোধ নিতে এসেছি! এখন আর ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। এখন বেলা তিনটে, আশা করি এখনই উনি মৌজ করে বসেননি!

খেয়াঘাট থেকে একটা সরু পথ গেছে দাসদের খামারের দিকে। খানিকটা ইঁটের দেয়াল, খানিকটা কঞ্চির বেড়া দিয়ে ঘেরা। গেটটা খোলাই রয়েছে। তারপর মস্ত বড় একটা উঠোন, একপাশে দুটো ধানের গোলা, অন্য পাশে একটা মস্ত বড় বাড়ি। প্রশস্ত বারান্দা, ওপরে টিনের চাল। উঠোনে হাঁস-মুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে, পাঁচটা ছাগলছানা লাফাচ্ছে এক ছাগ-মাতার পেছন পেছন, আর এই সব কিছুর মাঝখানে, গনগনে রোদে দাঁড়িয়ে একটা পাথরের চাঁইতে ছেনি চালাচ্ছেন অনিন্দ্য দাস। পরনে শুধু জিনসের টাউজার্স, খালি গা, মাথায় টোকা।

আমার প্রথমেই আশ্চর্য লাগল পাথরটা দেখে।

সুন্দরবন জলকাদার দেশ, এখানে এক টুকরো পাথর নেই, পাহাড় বহুদূর। এখানে এতবড় পাথর এল কী করে?

আমার ধারণা ছিল, আজকালকার ভাস্কররা প্রথমে প্লাস্টার অফ প্যারিসের মূর্তি বানিয়ে তারপর ব্রোঞ্জ কাস্টিং করেন। এখনো পাথর কুঁদে কুঁদে মুর্তি বানানো হয়! অনিন্দ্য দাসের মতন দীর্ঘকায় বলশালী পুরুষ না হলে সম্ভবও না।

কোথা থেকে একটা কুকুর হঠৎ ঘেউ ঘেউ করে উঠতেই অনিন্দ্য দাস আমার দিকে ফিরে তাকালেন। চোখ কুঁচকে দেখলেন কয়েক মুহূর্ত।

তারপর বললন, তুমি কে! তোমায় আগে যেন কোথায় দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে।

আমি হাত তুলে বললুম, নমস্কার। হ্যাঁ, আপনি আমাকে আগে দেখেছেন। আমি চন্দন ঘোষালের ছোট ভাইয়ের মতন। আমি এদিকে সাতজেলিয়ায় এসেছিলুম একজনের কাছে, শুনলুম আপনি এখানেই স্টুডিও বানিয়েছেন, তাই আপনার কাজ দেখতে এসে পড়লুম। আপনাকে ডিস্টার্ব করলুম বোধহয়।

অনিন্দ্য দাস একগাল হাসলেন। মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, না তুমি সাতজেলিয়ায় আসনি। তুমি শালা এখানে স্পায়িং করতে এসেছ। দেখতে এসেছ, ফুলমণিকে আমি খেয়ে ফেলেচি না আস্ত রেখিচি!

তারপর চেঁচিয়ে দু’জনকে ডাকলেন। প্রথমে বললেন, ফুলমণি, এদিকে এসো গো! দ্যাখো, তোমার বাপের বাড়ির লোক এসেছে!

আবার বললেন, নিরাপদ, একটা টুল নিয়ে আয়। কুটুমকে বসতে দে।

আগে এল একজন বাঁটকুল ধরনের লোক। আমার কাছে একটা টুল পেতে দিল।

অনিন্দ্য দাস খাতির করে বললেন, বসো, বসো ছোকরা। তোমাদের ছবিউলি মেয়েটাকে আমি টেনে হিঁচড়েও আনিনি, এখানে জোর করে ধরেও রাখিনি। সে এলেই জিজ্ঞেস করো, নিজের ইচ্ছেতে এসেছে কি না।

অনিন্দ্য দাসের কথা শুনব কী, আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে নেমে এল ফুলমণি। এ কোন্ ফুলমণি? তাকে যে চেনাই যায় না। একটা বাটিক প্রিন্টের শাড়ি পরে আছে সে, মাথার চুল খোলা, এই দেড় মাসেই তার স্বাস্থ্য ফিরেছে অনেক। শীর্ণ ভাবটা মোটেই নেই, মসৃণতা এসেছে চামড়ায়, চোখের দৃষ্টিতে গভীরতা। সে এখন তাকিয়ে থাকার মতন সুন্দর। আগে বোঝা যায়নি, তার মুখখানা বেশ ধারালো।

কী করে ফুলমণির এতটা পরিবর্তন হলো? একজন পুরুষের সঙ্গে উদ্দাম ভালোবাসা, না পেট ভরে দু’বেলা খাওয়া, নাকি মনের ফুর্তি?

ফুলমণি আমাকে দেখে অবাক হয়েছে ঠিকই। কাছে এসে বলল, নমস্কার ছোটবাবু।

কানু রায় তো মিথ্যে বলেনি—ফুলমণির মুখে কথা ফুটেছে। আগে সে নিজের থেকে কোনো কথাই বলত না।

কিন্তু হঠাৎ এক রাশ অভিমান ঢুকে গেল আমার গলার মধ্যে। ফুলমণির সঙ্গে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করল না। অ্যাকাডেমি থেকে অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে চলে আসার আগে ও একবার আমাকে বলে আসারও প্রয়োজন মনে করেনি? আমি ওর ছোটবাবু নই, কেউ নই।

অনিন্দ্য দাস বলল, হাঁড়িয়া আনিসনি? নিয়ে আয়। তোর নিজের লোককে খাওয়া!

নিরাপদ নামে বাঁটকুল লোকটিই নিয়ে এল কাচের জগ ভর্তি হাঁড়িয়া আর কয়েকটা গেলাস।

অনিন্দ্য দাস এক চুমুকে এক গেলাস সাবাড় করে বলল, ফুলমণি ফার্স্ট ক্লাস হাঁড়িয়া বানায়। খেয়ে দ্যাখো! সেদিন, বুঝলে, অ্যাকাডেমিতে তুমি আমার সঙ্গে ঝঞ্ঝাট করেছিলে, আমার বেশ রাগই হয়েছিল, ভাগ্যিস তোমায় মেরে বসিনি। তোমার দোষ নেই, তুমি তো আমাকে চেনো না। আমি গেটের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, দেখি যে এই মেয়েটাও এসেছে। আমি ওকে বললুম, অ্যাই ছুঁড়ি, তুই এই সব বাবুদের মধ্যে কী কচ্ছিস? যদি সত্যি ছবি আঁকতে চাস, ছবি আঁকা শিখতে চাস তো আয় আমার সঙ্গে। অমনি সুড়সুড় করে চলে এল।

আমি গেলাস হাতে নিয়ে চুপ করে তাকিয়ে রইলুম।

অনিন্দ্য দাস আবার বলল, ওকে এনে ভালো করিচি কি না বলো! চেহারায় কেমন চেকনাই হয়েছে, দেখেছ? বুলু দেখেছ, বুলু!

অনিন্দ্য দাস ফুলমণির নিম্ন শরীরের চাপড় মারলেন দু’বার।

আমার দিকে তাকিয়ে আধখানা ঠোটে হেসে বলল, বুলু মানে জানো? ওদের ভাষায় ঊরুকে বলে বুলু! আরও অনেকগুলো সাঁওতালি কথা শিখেছি। এরা পাগলকে বলে কঙ্কা। এ বেটী প্রায়ই আমাকে বলে কঙ্কা, কঙ্কা, প্রথমে বুঝতুম না। পাহাড়কে বলে বুরু। ঠোঁট হচ্ছে লুটি আর বুক হচ্ছে কোড়াম্। আঙুল হচ্ছে কাটুকা। বেশ, না? এই সব শব্দ বাংলা ভাষাতেও নিয়ে নেওয়া উচিত। আর পড়হাও-কুঁড়ি মানে কী বলো তো? ছাত্রী! এই মেয়েটা আমার পড়হাও-কুঁড়ি! অবশ্য আমি ওকে ছবি আঁকতে দিই না এখনো।

এবার আমি একটু চমকে উঠলুম।

অনিন্দ্য দাস বললেন, কেন আঁকতে দিই না জানো? আরে বাবা, ছবিই বলো, আর যে-কোনো শিল্পই বলো, আগে ফর্মটা ভালো করে শিখে নিয়ে তারপর ফর্ম ভাঙতে হয়। না ভাঙলে নতুন কিছু গড়া যায় না। শিল্পের ফর্ম ভাঙতে গেলে জীবনটাকেও কিছু ভাঙচুর করতে হয়। চাকরি-বাকরি, রোজগার, রোজ রাত্তিরে ক’খানা হাতে গড়া রুটি আর তরকারি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া, বছরের পর বছর এরকম জীবন কাটিয়ে শিল্প হয় না। ওকে ওর আগেকার জীবনের বাপের নাম ভুলিয়ে দিচ্ছি। সব উল্টো পাল্টা হয়ে যাক! আর একটা কথা। অশিক্ষিত পটুত্বের আমি ইয়ে মারি। ওসব দিন চলে গেছে। শিখতে হয়, সব গোড়া থেকে শিখতে হয়। ভেতরে মালমশলা আছে বলে দু’চারখানা ছবি এঁকে ফেলল, কিন্তু তা দিয়ে শিল্প হয় না। দু’দিনে একঘেয়ে হয়ে যায়। ফোক আর্ট সব একইরকম। মহৎ শিল্পীর হাতে হাজাররকম খেলা। জীবনটাকে শিল্প করে না নিলে তা হয় না। ফুলমণিকে আমি বলেছি, এখন এক বছর শুধু সোজা সোজা দাগ টেনে যা। চোখ বুজে মানুষের মুখটা দেখতে শেখ।

শুধু ফুলমণিই বদলে যায়নি, অনিন্দ্য দাসকেও আমার আজ সম্পূর্ণ নতুন মানুষ মনে হলো, লম্বা লম্বা লেকচার দিচ্ছেন বটে, তবু ওঁর কোনো কথাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

হঠাৎ ফুলমণিকে কাছে ডেকে তিনি ওর কোমর জড়িয়ে ধরে বললেন, এ মেয়েটার প্রোফাইলটা দারুণ! প্রথম দেখেই মনে হয়েছিল মাগিটাকে পাথরে ধরতে হবে।

পরক্ষণেই ফুলমণিকে সরিয়ে দিয়ে বললেন, অ্যাই হারামজাদী, আর মোটাবি না বলে দিচ্ছি। যদি দেখি আরও মুটিয়েছিস, মেরে একেবারে পাট করে দেব! ফুলমণিকে এখনো কোনোক্রমেই মোটা বলা যায় না। আমি অনেক আদিবাসী পল্লীতে ঘুরেছি। সাঁওতাল, ওরাওঁ, হো, মুণ্ডা, লোধদের মধ্যে এ পর্যন্ত একজনও স্থূলকায়া মহিলা দেখিনি।

অনিন্দ্য দাসের এই সব ভাষা শুনলেও ফুলমণি মিটমিটিয়ে হাসছে।

আমি পাথরটার পেছন দিকে বসে আছি। অনিন্দ্য দাস ডাকতেই সামনের দিকে গিয়ে অবাক হলুম। ফুলমণির অনেকখানি প্রতিমূর্তি গড়া হয়ে গেছে। তার নগ্ন প্রতিমূর্তি।

আমি ভাস্কর্য কিছুই বুঝি না। তবে দেখেই মুগ্ধ হলুম। এর সঙ্গে দেবীপ্রসাদ, রামকিঙ্করের কোনো মিল নেই। হেনরি মূর বা রদ্যার ধরনেরও নয়। অনেকটা যেন রিলিফের মতন। পাথরটা পাথরই থাকছে, তার মধ্য থেকে একটা বেশ চিনতে পারার মতন মূর্তি ফুটে বেরুচ্ছে।

অনিন্দ্য দাস বললেন, আমি আর্টকে কমার্সিয়াল করিনি। আমার মূর্তি বেচি না। শেষ হবার পর এটা কোথায় বসাবো জানো—চমটা ব্লকে, নদীর মোহনার ধারে। সমুদ্র দিয়ে জাহাজ যাবে, নৌকোর মাঝিরা দেখবে। জঙ্গলের বাঘেরা এসে মূর্তিটাকে আদর করবে। কয়েক শো বছর বাদে লোকেরা ভাববে, সুন্দরবনের নরম মাটিতে একটা পাথরের মূর্তি গজিয়ে উঠল কী করে? নিশ্চয়ই আকাশ থেকে দেবতারা ফেলেছে! সেইভাবে আমি দেবতা হয়ে যাব। হা-হা-হা-হা।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, পাথরটা আপনি আনলেন কী করে?

অনিন্দ্য দাস বললেন, বাজে প্রশ্ন। নৌকোয় আনিয়েছি। ঘাটশিলা থেকে। আর একটা মূর্তি দেখবে। এসো।

বাড়ির পেছন দিকে একটা বাগান। সেখানে একটা প্রমাণ সাইজের মূর্তি বসানো আছে। সেটাও ফুলমণির। কঠিন পাথরের মধ্যে ফুলমণির লাজুক ভাবটা কী আশ্চর্য ফুটেছে। অনিন্দ্য দাস সত্যিই শক্তিশালী শিল্পী।

অনিন্দ্য দাস বললেন, অ্যাই ফুলমণি, তুই এই মূর্তিটার পাশে দাঁড়া।

আমাকে বললেন, একবার দ্যাখো, খুঁটিয়ে দ্যাখো, ফুলমণির চেহারার সঙ্গে মূর্তিটায় কিন্তু মিল নেই। অথচ মিল আছে। এই অথচ মিলটাই আসল! ক’জন শালা এটা বোঝে?

বাঁটকুল লোকটি এবার এসে বলল, আপনারা এবার খাবেন না? বিকেল হয়ে গেল!

অনিন্দ্য দাস বললেন, কী রেঁধেছিস। নিয়ে আয় না শুয়ার। বকবক করছিস কেন?

নিরাপদ সঙ্গে সঙ্গে এক ডেকচি খিচুড়ি নিয়ে এল। কলাপাতায় বেড়ে দিয়ে গেল হাতে হাতে। বিকেল সাড়ে চারটের সময় এই ওদের দুপুরের খাবার। শুধু কলাপাতায় খানিকটা খিচুড়ি, ভেতরে অবশ্য আলু-টালু আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়া। অনিন্দ্য দাস খিচুড়ি খেতে খেতেই হাঁড়িয়ার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। ফুলমণিও হাঁড়িয়া খেয়ে যাচ্ছে সমানে।

আমি খানিকটা খিচুড়ি খেয়ে পাতাটা নামিয়ে রাখলুম।

অনিন্দ্য দাস ধমক দিয়ে বললেন, এই, এই, ও কী, আরও নাও। নিরাপদ ওকে খিচুড়ি দে। বেগুনভাজা কোথায়? হারামজাদা, আজ একটু মাছও জোগাড় করতে পারলি না? সবাই বলে সুন্দরবন মাছের দেশ, অথচ এখানেই মাছ পাওয় যায় না। সব কলকাতায় চলে যায়।

আমি বললুম, না, আমি আর খাব না।

—কেন খাবে না? ঐটুকু খেলে পেট ভরে? খাও খাও।

–না, আমাকে এবার যেতে হবে। এরপর আর ফেরার লঞ্চ পাব না।

—ফিরবে কেন? কে মাথার দিব্যি দিয়েছে, চাঁদু? এখানে থেকে যাবে উঠোনে খাটিয়া পেতে দেব রাত্তিরে। এই গরমে আমার সবাই উঠোনে শুই। ভয় নেই, বাঘ আসবে না।

মাটি থেকে আমার ঝোলাটা তুলে নিয়ে বললুম, আমাকে ফিরতেই হবে আজ।

ফুলমণি ঈষৎ নেশাগ্রস্ত গলায় বলল, কেন যাবে? থাকো, থাকো।

এই প্রথম আমি ফুলমণির দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ফুলমণি তোমাকে নিয়ে এই যে মূর্তিটা গড়েছে, তোমার কেমন লেগেছে?

ফুলমণির মুখ হাসিতে ঝলমল করে উঠল।

অনিন্দ্য দাসের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, মূর্তি তো গড়ে নাই।

তারপর আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলল, উ গড়াইছে।

ওরে বাবা এত প্ৰেম!

হাতের কলাপাতায় খিচুড়ি নিয়েই ওরা আমাকে বিদায় দিতে এল গেট পর্যন্ত ফুলমণি কঞ্চির বেড়ায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে, অনিন্দ্য দাস তার এঁটো হাত ফুলমণির কাঁধে রাখলেন। আমাকে বললেন, এই ছেলে, আবার আসিস। যখন খুশি চলে আসবি।

ওদের দুজনের গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভঙ্গিটা আমার চোখে লেগে রইল। আমি আর এখানে কখনো আসব না।

ফুলমণি-উপাখ্যান – ১০

ফুলমণির কাহিনী এখানেই শেষ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু গল্প-উপন্যাসে এরকম একটা সুখের মিলন হলেও সেটা হয় ইচ্ছাপূরণ। বাস্তব বড় নিষ্ঠুর! ফুলমণি আর অনিন্দ্য দাসের মতো দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ কি সারাজীবন একসঙ্গে কাটাতে পারে।

বোয়ালভাসিতে ওদের দুজনের উদ্দাম জীবনের একটা টুকরো ছবি আমি দেখে এসেছি, তা আসলে এক ধরনের পিকনিক। ভারি চমৎকার, খুব লোভনীয় কিন্তু পিকনিক একটানা কতদিন চলে?

ফুলমণির জীবনে আরও অনেক ঘটনা ঘটে গেছে, আমার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই অবশ্য, কিন্তু খবরগুলো আমার কানে এসেছে।

অনিন্দ্য দাস কোনো এক জায়গায় বাঁধা পড়ে থাকার মানুষ নন। সেই জন্য তিনি বিয়েই করেননি। মেয়েরা তাঁর মাথায় উত্তেজনা জোগায়, তাঁর কাজে গতি আনে। তিনি প্রেরণা-ট্রেরণায় বিশ্বাস করেন না। স্নায়বিক উত্তেজনা আর ফুর্তিই তাঁর কাছে প্রধান।

এ কথাও শুনেছি, তিনি কোনো মেয়েকেই প্রতারণা করেন না। তাঁর বিবেক পরিষ্কার। যে মেয়েকে তাঁর পছন্দ হয়, তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, এই তুমি আসবে আমার সঙ্গে? বোয়ালভাসির খামারে গিয়ে থাকবে? যে রাজি হয় না, তাকে তিনি জোর করেন না। তার দিকে আর ফিরেও তাকান না। আর যে মন্ত্রমুগ্ধের মতন রাজি হয়ে যায়, সে যায় নিজের দায়িত্বে, কোনো প্ৰতিশ্ৰুতি নেই, ভবিষ্যৎ নিয়ে গাঁটছড়া বাঁধার কোনো সম্ভাবনাও নেই।

ফুলমণির সঙ্গে অনিন্দ্য দাসের পিকনিক সাত মাসেই শেষ হয়ে গেছে। ফুলমণির ছিপছিপে ধারালো শরীরটা ভাস্কর্যের বিষয়বস্তু হিসেবে অনিন্দ্য দাসের পছন্দ হয়েছিল। ফুলমণিকে মডেল করে দুটো মূর্তি গড়েছেন তিনি। বিষয়বস্তু হিসেবে সে ফুরিয়ে গেছে। যে বিষয়বস্তু একবার ব্যবহার করা হয়ে যায়, তার প্রতি শিল্পীদের আর কোনো আকর্ষণ থাকে না। এরপর ফুলমণি একটি সাধারণ নারী।

কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে একদিন অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি ছিলাম অন্য টেবিলে, উনি অনেক দূরে। চোখাচোখি হতেও আমি চেনার কোনো ভাব দেখাইনি, উনিই উঠে এলেন একসময়।

খানিকটা অন্যমনস্কভাবে বললেন, কী খবর, নীলু? চন্দন এখন কোথায় থাকে? সেই ছোটপাহাড়ীতে? ওর ওখানে একবার যাব। কী করে ছোটপাহাড়ীতে যেতে হয় বলো তো? কোন স্টেশনে নামতে হয়? সেই মেয়েটার কোনো খবর জানো?

—তার খবর তো আমার জানবার কথা নয়। আমি ছোটপাহাড়ীতে আর যাই না।

—হ্যাঁ, একদিন রাগ করে চলে গেল…আমি ভাবলুম আবার হয়তো আসবে একবার।

অন্য একজন চেনা লোক অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে কথা বলা শুরু করতেই তিনি আমাকে যেন ভুলে গেলেন! সেই লোকটির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন দরজার দিকে।

আমাকে দেখে ফুলমণির কথা একবার মনে পড়েছিল অনিন্দ্য দাসের। কিন্তু সেই মনে হওয়ার কোনো গভীরতা নেই। কয়েক মিনিটের জন্য স্মৃতির আন্দোলন। ছোটপাহাড়ীতে তিনি সত্যি সত্যি ফুলমণিকে আর দেখতে যাবেন না, আমার কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত ছোটপাহাড়ী যাবার সন্ধানও নিলেন না।

সিরাজুল তারিক সাহেবও ফুলমণি সম্পর্কে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে সংস্পর্শ ঘটার পর থেকেই তিনি ফুলমণি সম্পর্কে আর একটি কথা বলেননি কখনো। কলকাতার শিল্প জগতে ফুলমণির নামটা কয়েকটা দিনের জন্য উঠেই আবার মিলিয়ে গেছে বুদবুদের মতন। প্রদর্শনীতে ফুলমণির একটি মাত্র ছবি বিক্রি হয়েছিল। দু’ হাজার টাকায় কিনেছিলেন প্রখ্যাত একজন শিল্পী। ছবিটাই তাঁর পছন্দ হয়েছিল। ছবির শিল্পী সম্পর্কে তিনি কোনো কৌতূহল দেখাননি।

ভবিষ্যতে অনিন্দ্য দাসের ভাস্কর্য প্রসঙ্গে ফুলমণির নামটা কখনো উঠবে কিনা সন্দেহ। অনিন্দ্য দাসের ভাষায় ‘অথচ মিল আছে’ কজনের নজরে পড়বে? চন্দনদা যদি ফুলমণির ছবি নিয়ে ব্যবসা করতে চাইতেন, নীপা বউদির ঈর্ষা-ফির্সা অগ্রাহ্য করে ওর পেছনে টাকা ঢালতেন, ওকে ছবি আঁকার সব সুযোগ করে দিতেন, তাহলে ফুলমণির প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আশা ছিল, ওর ছবিও বিক্রি হতো। সেই রকম একজন প্রফেশনাল প্রমোটারের দরকার ছিল, নিছক শখের পরোপকারীরা বেশি দূর যেতে পারে না। অনিন্দ্য দাস একবার ছুঁয়ে দিয়েছেন বলে আমরা আর কেউ ফুলমণির দিকে তাকাইনি।

অনিন্দ্য দাস ছোটপাহাড়ীতে গেলেও অবশ্য ফুলমণির দেখা পেতেন না। চন্দনদার কাছে শুনেছি, ফুলমণি ছোটপাহাড়ীতে ফিরলেও তার শ্বশুরের ভাইপো তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সে লোকটি বাড়ি, জমিজমা দখল করে বসেছে, সে ও বাড়ির একটা বিধবা বউকে ঠাঁই দেবে কেন? ফুলমণির নামে নানা বদনাম দেওয়া, এমনকি তাকে ডাইনি সাজানোও সে লোকটির পক্ষে সহজ। একলা একটা মেয়ের তুলনায় একজন বিবাহিত, সংসারী মানুষকে সব সমাজই বেশি বিশ্বাস করে।

ফুলমণি ছোটপাহাড়ীতে নেই, সে আবার হারিয়ে গেছে।

এরপরেও কেটে গেছে এক বছর।

আমি আবার গা আলগা করে ঘুরে বেড়াই, কেউ আমাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। দাদা অবশ্য প্রায়ই রাগারাগি করে, কিন্তু আমার বউদির মতে প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে একজন অন্তত বাউণ্ডুলে বা ভবঘুরে বা অভিযাত্রী থাকা উচিত, না হলে সে সমাজটা বর্ণহীন হয়ে যায়, সেই সুবাদে আমি বাড়িতে দুবেলা খেতে পাই।

মাঝে মাঝে অন্যের ফাই ফরমাস খেটে আমার কিছু কিছু রোজগার হয়।

কেউ কেউ আমার হাত দিয়ে জরুরি কাগজপত্র পাটনা কিংবা ভূপালে পাঠায়। কারুর হয়তো বৃদ্ধা মা কিংবা অশক্ত ঠাকুর্দাকে কাশী কিংবা এলাহাবাদ পৌঁছে দেবার কোনো লোক নেই, তখন আমি আছি। ট্রেন ভাড়া ছাড়াও হাতখরচ মন্দ জোটে না।

লালুদার এক আত্মীয় থাকে ঝুমরি তিলাইয়ায়, তাকে একটা সম্পত্তির দলিল পৌঁছে দিতে হবে, সেই ভারটা পেয়ে গেলুম আমি। টাকাপয়সার ব্যাপারে লালুদা উদার, আমাকে হাতখরচ দিয়েছে পাঁচশো টাকা।

একটা স্টেশনে ট্রেন পাল্টাতে হবে, বসে আছি প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে।

ট্রেনের পাত্তা নেই। একটা মালগাড়ি থেমে আছে অদূরে, সেটা না গেলে আর ট্রেন আসবে না। গোটা স্টেশনটায় ভ্যান ভ্যান করছে মাছি। কিছু বাসি কচুরি, তরকারি আর দরবেশ যা বিক্রি হচ্ছে, তা মানুষের অখাদ্য, মাছিরই খাদ্য।

রেললাইন থেকে পোড়া কয়লা কুড়োচ্ছে গোটা পাঁচেক নানা বয়সী মেয়ে। প্ল্যাটফর্মে ওদেরই কেউ একটা বাচ্চাকে শুইয়ে রেখেছে, চিৎ হয়ে বাচ্চাটা ট্যাট্যা করে কাঁদছে।

অলসভাবে তাকিয়েছিলুম, এক সময় চোখ আটকে গেল।

কোনো সন্দেহ নেই, ঐ মেয়েগুলোর মধ্যে একজন ফুলমণি। আবার সেই আগেকার মতন রোগা চেহারা, পরনের নীলপাড় সাদা শাড়িটা যেমন ময়লা, তেমনি ছেঁড়া, মাথার চুল জট পাকিয়ে গেছে। মাথায় ঝুড়ি ভরে কয়লা তুলে তুলে প্ল্যাটফর্মের অনেক দূরে একটা কোণে জড়ো করে রাখছে।

হোক না ফুলমণি, তাতে আমার কী আসে যায়? ছবি আঁকা ছেড়ে কেউ যদি কয়লা-কুড়োনি হয়, আমি তার কী করব?

অন্য কোনো কাজ নেই, সঙ্গে একটা বইও নেই, তাই বসে বসে দেখতে লাগলুম মেয়েগুলোকে। একটি মেয়েরও স্বাস্থ্য ভালো নয়। কয়লা তুলে দু’বেলার অন্ন জোটে না বোধহয়।

ঝুড়ি খালি করে ফেরার সময় মেয়েরা কেউ না কেউ বাচ্চাটাকে একটু আদর করে যাচ্ছে। ওটা কার বাচ্চা? ফুলমণির? খুবই স্বাভাবিক।

কাছেই নিশ্চয়ই ওদের ঝুপড়ি আছে। সেখানেই জীবন কেটে যাচ্ছে, এক একটা রেল স্টেশনে অনেকগুলো পরগাছার জীবিকার সংস্থান হয়।

ফুলমণি যদি নিজে থেকে এসে আমার সঙ্গে কথা না বলত, তাহলে পরবর্তী চিন্তাটা আমার মাথাতেই আসত না।

অন্য মেয়েরা মাঝে মাঝে কলকল করে কথা বলে উঠছে, কিন্তু ফুলমণি আগের মতনই নীরব। ফুলমণি অন্যদের মতন নয়। ওর নীরবতা ওর অহংকার।

আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে ফুলমণি একবার থমকে দাঁড়াল। নীরবতা ভেঙে বলল, ছোটবাবু।

কবে আমার চাকরি গেছে, আমি আর ছোটবাবু নই, কোনো বাবুই নই, তবু এই ডাক শুনে যেন আমি ধন্য হয়ে গেলুম।

আমি শুধু বললুম, ফুলমণি।

ব্যস ঐটুকুই। আর কোনো বাক্য বিনিময় হলো না। ফুলমণি আবার লাইনে নেমে গেল।

কী কথা বলব ওকে? ওর অতীত ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করে কী লাভ? কয়লা কুড়িয়ে যার দিন চলে, তার ছবি আঁকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

প্ল্যাটফর্ম থেকে রেল লাইন বেশ নীচু। ঝুড়িভর্তি কয়লা নিয়ে ওপরে উঠতে মেয়েদের বেশ কষ্ট হচ্ছে। একবার ফুলমণি উঠতে গিয়ে তার কয়লার ঝুড়িটা উল্টে গেল। তখনই আমার মাথায় এল সেই চিন্তাটা।

আমি উঠে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ফুলমণিকে টেনে তুললুম ওপরে। জিজ্ঞেস করলুম, ফুলমণি আমার সঙ্গে যাবে।

—কোথায়?

–অনেক দূরে, পোড়া কয়লা কুড়োবার চেয়ে কোনো খারাপ কাজ সেখানে করতে হবে না।

ফুলমণি এদিক ওদিক তাকাল। খালি ঝুড়িটা সারিয়ে নিল খানিকটা। তারপর বলল, যাব।

অনিন্দ্য দাসের আহ্বানে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছিল ফুলমণি। ঠিক সেই রকমভাবেই রাজি হয়ে গেল আমার এক কথায়! ফুলমণি স্থাণু হতে চায় না। পরিবেশ বদলাতে চায় সবসময়। অনিন্দ্য দাস যেমন বলেছিল, ও জীবনকে ভাঙছে!

হাতের ধুলো ঝেড়ে ফুলমণি বাচ্চাটাকে একবার গাল টিপে দিল।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, এ বাচ্চাটা তোমার?

ফুলমণি বলল, না, আমার বাচ্চাটা এই টুকুন হয়েই মরে গেছে।

আমি মনে মনে বললুম একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। বাচ্চা-কাচ্চা সঙ্গে থাকলে ঝামেলা হতো।

স্টেশনের বাইরে বাস দাঁড়িয়ে আছে।

বাস পাল্টাতে হলো তিনবার। ফুলমণি আর একবারও জিজ্ঞেস করল না, কোথায় যাচ্ছি।

সন্ধে হয়ে এসেছে। শেষবার বাস থেকে নেমে আমি জিজ্ঞেস করলুম, সাঁতার জানো?

ফুলমণি দুবার মাথা ঝাঁকালো।

এবার খানিকটা জঙ্গলের পথ। দুপুরে দুবার আমরা শুধু ঝালমুড়ি খেয়েছি। ফুলমণির শরীর দুর্বল। খিদেয় নিশ্চয়ই আরও কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু মুখে তার কোনো চিহ্ন নেই। অনিশ্চিতের দিকে যাত্রা ওকে টানছে।

জঙ্গলের রাস্তাটা ছমছমে অন্ধকার। কোনো একটা প্রাণী পাশ দিয়ে ছুটে যেতেই ফুলমণি থমকে গিয়ে আমার হাত চেপে ধরল।

এই প্রথম আমার হাত ধরল ফুলমণি। প্রথম ও শেষবার।

আধ ঘণ্টার মধ্যে আমরা পৌঁছোলুম নদীটার কাছে। বেশ চওড়া নদী, স্রোত আছে, তবে খুব গভীর নয়। মাঝখানটায় শুধু সাঁতারে যেতে হবে।

ওপারে মিটমিট করে দু’-চারটে আলো জ্বলছে। দূরে পাহাড়ের মাথায় পাতা—পোড়া আগুন।

আমি ফুলমণির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললুম, এই নদী পার হয়ে সোজা চলে যাও। ওপারে দিকশূন্যপুর নামে একটা গাঁ আছে। সেখানে আছে বন্দনাদি। তার কাছে গিয়ে বলবে, নীলু তোমাকে পাঠিয়েছে। ব্যস, তোমার আর কিছু চিন্তা করতে হবে না। তুমি খাবার পাবে। থাকার জায়গা পাবে। তোমার যা খুশি তাই করতে পার। ইচ্ছে হলে ছবিও আঁকতে পার। বসন্ত রাও, রোহিলা এরাও ছবি আঁকে। ওরা তোমাকে রং-তুলি দেবে।

ফুলমণি জিজ্ঞেস করল, তুমি যাবে না?

আমি বললুম, ওখানে সবাই একলা যায়। তোমার কোনো ভয় নেই। দিকশূন্যপুরের বন্দনাদিকে আমার নাম করলেই হবে। আমি এখন গেলে ফিরতে পারব না। আমি যে অন্য লোকের কাজ নিয়ে এসেছি।

হাঁটু পর্যন্ত জলে আমি গেলুম ওর সঙ্গে সঙ্গে, তারপর থেমে পড়ে বললুম, এবার তুমি একা যাও

ফুলমণি নিষ্পলকভাবে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর জল ঠেলে এগিয়ে গেল। একটু পরে তাকে আর দেখা গেল না। শুধু শোনা যেতে লাগল জলের শব্দ।

হাঁটু জলে আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ।

যাও ফুলমণি দিকশূন্যপুরে। ওখানে কেউ তোমাকে ছোট করবে না। ওখানে ওরা যে সবাই সমান। কেউ তোমাকে আদিবাসী বলে আলাদা করে দেখবে না। কারণ ওরা মনে করে সকলেই এই পৃথিবীর আদিবাসী। ওখানে কাজের কোনো অভাব নেই, কারণ কারুর লোভ নেই। ওরা নিজের জন্য কিছু রাখতে চায় না। অন্যকে দিয়ে আনন্দ পায়, সবাই অন্যকে দেয় বলে সবার সব কিছু থাকে। ওখানে দুঃখ আছে, সব মানুষের দুঃখ থাকে, কিন্তু ওখানে অপমান নেই। দিকশূন্যপুরে কোনো নিয়ম নেই, মানুষের ইচ্ছেটাই নিয়ম।

(সমাপ্ত)

raateralo.com

Leave a Comment