Raater Alo

Famous Poems of Taslima Nasrin l তসলিমা নাসরিনের বিখ্যাত কবিতা

Famous Poems of Taslima Nasrin

তসলিমা নাসরিন, বাংলাদেশের নারী লেখিকা ও সমাজসেবিকার অবদানের স্মরণীয় নাম। তার লেখার মাধ্যমে সামাজিক অভিব্যক্তির জন্য একটি মাধ্যম হিসেবে তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন। তসলিমা নাসরিনের কবিতা সম্পর্কে কথা বলা হলে, তার শব্দের শক্তি, মহিলাদের অধিকার এবং সমাজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার উত্তেজনাপূর্ণ লড়াইয়ের কথা বলা হয়।

তসলিমা নাসরিনের কবিতা গ্রন্থে প্রবল ভাবনা, উত্তেজনা, ও মানবতার সমাজবাদী আবেগ অনুভব করা যায়। তার কবিতাগুলি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক নীতির উপর ভিত্তি করে, যা পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।

তসলিমা নাসরিনের কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা মধ্যে “আমার মা”, “অতল জলের গল্প”, “তুমি” ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই কবিতাগুলি মানবতার কথা বলে, মহিলাদের স্বাধীনতা এবং সমাজের অধিকারের প্রতি তার অভিব্যক্তিকর মনোভাব প্রকাশ করে।

তসলিমা নাসরিনের কবিতা গ্রন্থ পাঠকদের সামাজিক মূল্য ও মানবিক দৃষ্টিকোণ দেখানোর জন্য একটি অমূল্য উপহার। এদিকে, এই কবিতা গুলি সাহিত্যিক বিপ্লবের সূচক হিসেবে প্রশংসিত হয়ে উঠেছে। আমাদের এই ব্লগে তসলিমা নাসরিনের বিখ্যাত কবিতা(Famous Poems of Taslima Nasrin) দেওয়া হলো যা আপনাদের ভালো লাগবে।

Famous Poems of Taslima Nasrin l তসলিমা নাসরিনের বিখ্যাত কবিতা লজ্জা l তসলিমা নাসরিনের প্রেমের কবিতা

ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত

ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত,
তবু এখনো কেমন যেন হৃদয় টাটায়-
প্রতারক পুরুষেরা এখনো আঙুল ছুঁলে পাথর শরীর
বয়ে ঝরনার জল ঝরে।
এখনো কেমন যেন কল কল শব্দ শুনি নির্জন
বৈশাখে, মাঘ-চৈত্রে-
ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত,
তবু বিশ্বাসের রোদে পুড়ে নিজেকে অঙ্গার করি।
প্রতারক পুরুষেরা একবার ডাকলেই ভুলে যাই
পেছনের সজল ভৈরবী,
ভুলে যাই মেঘলা আকাশ, না-
ফুরানো দীর্ঘ রাত।
একবার ডাকলেই
সব ভুলে পা বাড়াই নতুন ভুলের দিকে,
একবার ভালোবাসলেই
সব ভুলে কেঁদে উঠি অমল বালিকা।
ভুল প্রেমে তিরিশ বছর গেল
সহস্র বছর যাবে আরো,
তবু বোধ হবে না নির্বোধ বালিকার।

টোপ

যেরকম ছিলে, সেরকমই তুমি আছ
কেবল আমাকে মাঝপথে ডুবিয়েছ
স্বপ্নের জলে উলটো ভাসান এত
আমি ছাড়া আর ভাগ্যে জুটেছে কার!

আগাগোড়া তুমি অবিকল সেই তুমি
বড়শিতে শুধু গেঁথেছ দু’চার খেলা
অলস বিকেল খেলে খেলে পার হলে
রাত্তিরে ভাল নিদ্রাযাপন হয়।

তুমি তো কেবলই নিদ্রার সুখ চেনো
একশো একর জমি নিজস্ব রেখে
এক কাঠা খোঁজো বর্গার তাড়নায়
বর্গার চাষ পৃথক স্বাদের কিনা!

স্বাদ ভিন্নতা পুরুষ মাত্র চায়
তুমি তো পুরুষই, অধিক কিছু নও।
পুরুষেরা ভাল চোখ খেতে জানে চোখ
আমার আবার কাজলের শখ নেই।

বড়শিতে গাঁথা হৃদপিন্ডের আঁশ
ছিঁড়ে খেতে চাও, তুমি তো পুরুষই খাবে।
সাঁতার জানি না, মধ্যনদীতে ডুবি
অন্ধকে টোপ দেবার মানুষ নেই।

তসলিমা নাসরিনের বিখ্যাত কবিতা l Taslima Nasrin Best Poems l Famous Poems of Taslima Nasrin l

ব্যস্ততা

তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, যা কিছু নিজের ছিল দিয়েছিলাম,
যা কিছুই অর্জন-উপার্জন !
এখন দেখ না ভিখিরির মতো কেমন বসে থাকি !
কেউ ফিরে তাকায় না।
তোমার কেন সময় হবে তাকাবার ! কত রকম কাজ তোমার !
আজকাল তো ব্যস্ততাও বেড়েছে খুব।
সেদিন দেখলাম সেই ভালবাসাগুলো
কাকে যেন দিতে খুব ব্যস্ত তুমি,
যেগুলো তোমাকে আমি দিয়েছিলাম।

Best Poems of Taslima Nasrin l Famous Poems of Taslima Nasrin l তসলিমা নাসরিনের বিখ্যাত কবিতা

হিসেব

কতটুকু ভালোবাসা দিলে,
ক তোড়া গোলাপ দিলে,
কতটুকু সময়, কতটা সমুদ্র দিলে,
কটি নির্ঘুম রাত দিলে, কফোঁটা জল দিলে চোখের –
সব যেদিন ভীষণ আবেগে শোনাচ্ছেলে আমাকে,
বোঝাতে চাইছিলে আমাকে খুব ভালোবাসো;

আমি বুঝে নিলাম-
তুমি আমাকে এখন আর একটুও ভালোবাসোনা।
ভালোবাসা ফুরোলেই মানুষ হিসেব কষতে বসে, তুমিও বসেছো।
ভালোবাসা ততদিনই ভালোবাসা
যতদিন এটি অন্ধ থাকে, বধির থাকে,
যতদিন এটি বেহিসেবি থাকে।

দ্বিখন্ডিত

সে তোমার বাবা, আসলে সে তোমার কেউ নয়
সে তোমার ভাই, আসলে সে তোমার কেউ নয়
সে তোমার বোন, আসলে সে তোমার কেউ নয়
সে তোমার মা, আসলে সে তোমার কেউ নয় ।
তুমি একা
যে তোমাকে বন্ধু বলে, সেও তোমার কেউ নয় ।
তুমি একা।
তুমি যখন কাঁদো, তোমার আঙুল
তোমার চোখের জল মুছে দেয়, সেই আঙুলই তোমার আত্মীয়।
তুমি যখন হাঁটো, তোমার পা
তুমি যখন কথা বলো, তোমার জিভ
তুমি যখন হাসো, তোমার আনন্দিত চোখই তোমার বন্ধু।
তুমি ছাড়া তোমার কেউ নেই
কোন প্রানী বা উদ্ভিদ নেই।
তবু এত যে বলো তুমি তোমার,
তুমিও কি আসলে তোমার ?

চরিত্র

তুমি মেয়ে,
তুমি খুব ভাল করে মনে রেখো
তুমি যখন ঘরের চৌকাঠ ডিঙোবে
লোকে তোমাকে আড়চোখে দেখবে।
তুমি যখন গলি ধরে হাঁটতে থাকবে
লোকে তোমার পিছু নেবে, শিস দেবে।
তুমি যখন গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠবে
লোকে তোমাকে চরিত্রহীন বলে গাল দেবে।
যদি তুমি অপদার্থ হও
তুমি পিছু ফিরবে
আর তা না হলে
যেভাবে যাচ্ছ, যাবে।

তসলিমা নাসরিনের বিখ্যাত কবিতা l

যদি মানুষ হয়ে না পারি, পাখি হয়েও ফিরব একদিন

আমার জন্য অপেক্ষা করো মধুপুর নেত্রকোনা
অপেক্ষা করো জয়দেবপুরের চৌরাস্তা
আমি ফিরব। ফিরব ভিড়ে হট্টগোল, খরায় বন্যায়
অপেক্ষা করো চৌচালা ঘর, উঠোন, লেবুতলা, গোল্লাছুটের মাঠ
আমি ফিরব। পূর্ণিমায় গান গাইতে, দোলনায় দুলতে, ছিপ ফেলতে বাঁশবনের পুকুরে-
অপেক্ষা করো আফজাল হোসেন, খায়রুননেসা, অপেক্ষা করো ঈদুল আরা,
আমি ফিরব। ফিরব ভালবাসতে, হাসতে, জীবনের সুতোয় আবার স্বপ্ন গাঁথতে-
অপেক্ষা করো মতিঝিল, শান্তিনগর, অপেক্ষা করো ফেব্রুয়ারি বইমেলা আমি ফিরব।
মেঘ উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, তাকে কফোটা জল দিয়ে দিচ্ছি চোখের,
যেন গোলপুকুর পাড়ের বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টি হয়ে ঝরে।
শীতের পাখিরা যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, ওরা একটি করে পালক ফেলে আসবে
শাপলা পুকুরে, শীতলক্ষায়, বঙ্গোপসাগরে।
ব্রহ্মপুত্র শোনো, আমি ফিরব।
শোনো শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, সীতাকুণ্ড- পাহাড়-আমি ফিরব।
যদি মানুষ হয়ে না পারি, পাখি হয়েও ফিরব একদিন।

আরও প্রেম দিও

আরও প্রেম দিও আমাকে, এত অল্প প্রেমে আমার হয় না, আমি পারি না।

আরও প্রেম দিও, বেশি বেশি প্রেম দিও

যেন আমি রেখে কুলিয়ে উঠতে না পারি,

যেন চোখ ভরে,

হৃদয়ের সবকটি ঘর যেন ভরে যায়

যেন শরীর ভরে, এই তৃষ্ণার্ত শরীর।

প্রেম দিতে দিতে আমাকে অন্ধ করে দাও,

বধির করে দাও, আমি যেন শুধু তোমাকেই দেখি,

কোনও ঘৃণা, কোনও রক্তপাত যেন আমাকে দেখতে না হয়,

আমি যেন আকাশপার থেকে ভেসে আসা তোমার শুভ্র শব্দগুলো শুনি,

কোনও বোমারু বিমানের কর্কশতা, কারও আর্তনাদ, চিৎকার আমার কানে যেন না

পৌঁছোয়।

দীর্ঘকাল অসুখ আর মৃত্যুর কথা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত

দীর্ঘকাল প্রেমহীনতার সঙ্গে পথ চলে আমি ক্লান্ত,

আমাকে শুশ্রুষা দাও, স্নান করিয়ে দাও তোমার শুদ্ধতম জলে।

যদি ভালো না বাসো, তবে বোলো না কিন্তু যে ভালোবাসো না,

মিথ্যে করে হলেও বোলো যে ভালোবাসো,

মিথ্যে করে হলেও প্রেম দিও,

আমি তো সত্যি সত্যি জানবো যে প্রেম দিচ্ছ,

আমি তো কাঁটাকে গোলাপ ভেবে হাতে নেব,

আমি তো টেরই পাবো না আমার আঙুল কেটে গেলে কাঁটায়,

রক্ত শুষে নেবে আঙুল থেকে, এদিকে ভাববো বুঝি চুমৃ খাচ্ছে!।

প্রেম দিও, যত প্রেম সারাজীবনে সঞ্চয় করেছো তার সবটুকু,

কোথাও কিছু লুকিয়ে রেখো না।

আমার তো অল্পতে হয় না, আমার তো যেন তেন প্রেমে মন বসে না,

উতল সমুদ্রের মত চাই, কোনওদিন না ফুরোনো প্রেম চাই,

কলঙ্কী কিশোরীর মত চাই,

কাণ্ডজ্ঞানহীনের মত চাই।

পাগল বলবে তো আমাকে? বলো।

বড় ভয়ে গোপনে গোপনে বাঁচি

মানুষের চরিত্রই এমন
বসলে বলবে না, বসো না
দাঁড়ালে, কি ব্যাপার হাঁটো
আর হাঁটলে, ছি: বসো।
শুয়ে পড়লে ও তাড়া – নাও উঠো,
না শুলে ও স্বষ্তি নেই, একটু তো শুবে !
ওঠ বস করে করে নষ্ঠ হচ্ছে দিন
এখনো মরতে গেলে বলে ওঠে – বাঁচো
না জানি কখন ও বাঁচতে দেখলে বলে উঠবে – ছি: মরো
বড় ভয়ে গোপনে গোপনে বাঁচি।

অভিমান

কাছে যতটুকু পেরেছি আসতে, জেনো
দূরে যেতে আমি তারো চেয়ে বেশী পারি।
ভালোবাসা আমি যতটা নিয়েছি লুফে
তারো চেয়ে পারি গোগ্রাসে নিতে ভালোবাসা হীনতাও।
জন্মের দায়, প্রতিভার পাপ নিয়ে
নিত্য নিয়ত পাথর সরিয়ে হাঁটি।
অতল নিষেধে ডুবতে ডুবতে ভাসি,
আমার কে আছে একা আমি ছাড়া আর ?

সময়

রাত তিনটেয় ঘুম ভেঙে গেলে এখন আর বিরক্ত হই না
রাতে ভালো ঘুম না হলে দিনটা ভাল কাটে না – এমান বলে লোকে ।
দিন যদি ভাল না কাটে তাহলে কি কিছু যায় আসে !
আমার দিনই বা কেন , রাতই বা কেন ?
দিন দিনের মতো বসে থাকে দূরে , আর রাত রাতের মতো ,
ঘুমিয়ে থাকার গায়ে মুখ গুঁজে গুঁটি গুঁটি শুয়ে থাকে জেগে থাকা ।
এসব দিন রাত , এসব সময় , এসব বিয়ে আমার করার কিছুই নেই ,
জীবন আর মৃত্যু একাকার হয়ে গেলে কিছু আর করার থাকে না কিছু না ।
আমি এখন মৃত্যু থেকে জীবনকে বলে কয়েও সরাতে পারি না ,
জীবন থেকে মৃত্যুকে আলগোছে তুলে নিয়ে রাখতে পারি না কোথাও আপাতত ।

প্রত্যাশা

কারুকে দিয়েছ অকাতরে সব ঢেলে
সেও অন্তত কিছু দেবে ভেবেছিলে।
অথচ ফক্কা, শূন্যতা নিয়ে একা
পড়ে থাকো আর দ্রুত সে পালায় দূরে
ভালবেসে কিছু প্রত্যাশা করা ভুল।

আলোকিত ঘর হারিয়ে ধরেছ অন্ধকারের খুঁটি
যারা যায় তারা হেসে চলে যায়, পেছনে দেখে না ফিরে।
তলা ঝেড়ে দিলে, যদিও জোটেনি কানাকড়ি কিছু হাতে
তুমি অভুক্ত, অথচ তোমার সম্পদ খায় তারা
যাদের বেসেছ নিংড়ে নিজেকে ভাল।

ঠকতেই হবে ভালবেসে যদি গোপনে কিছুর করো
প্রত্যাশা কোনও, এমনকি ভালবাসাও পাবার আশা।

হাত

আবার আমি তোমার হাতে রাখবো বলে হাত
গুছিয়ে নিয়ে জীবনখানি উজান ডিঙি বেয়ে
এসেছি সেই উঠোনটিতে গভীর করে রাত
দেখছ না কি চাঁদের নীচে দাঁড়িয়ে কাঁদি দুঃখবতী মেয়ে !
আঙুলগুলো কাঁপছে দেখ, হাত বাড়াবেকখন ?
কুয়াশা ভিজে শরীরখানা পাথর হয়ে গেলে ?
হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম বর্ষা ছিল তখন,
তখন তুমি ছিঁড়ে খেতে আস্ত কোনও নারী নাগাল পেলে।
শীতের ভারে ন্যুব্জ বাহু স্পর্শ করে দেখি
ভালবাসার মন মরেছে, শরীর জবুথবু,
যেদিকে যাই, সেদিকে এত ভীষণ লাগে মেকি।
এখনও তুমি তেমন আছ। বয়স গেল, বছর গেল, তবু।
নিজের কাঁধে নিজের হাত নিজেই রেখে বলি :
এসেছিলাম পাশের বাড়ি, এবার তবে চলি।

প্রলাপ

একদিন সমুদ্রের কাছে গিয়ে একটা ঘর বাঁধবো
মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয় পাহাড়ের কাছে।

অমন একলা নির্বাসনের আকাশ চুয়ে শূন্যতার কুয়াশা নামলে
অথৈ জলে ভিজে ভিজে গা কাঁপিয়ে জ্বর আনবো।

আমাকে না হোক, তবু দেখতে এসো।
মানুষ তো অসুখ দেখতেও আসে

কারো কারো জন্য এমন লাগে কেন!

জানি না কেন হঠাৎ কোনও কারণ নেই, কিছু নেই, কারও কারও জন্য খুব 

অন্যরকম লাগে

অন্য রকম লাগে,

কোনও কারণ নেই, তারপরও বুকের মধ্যে চিনচিনে কষ্ট হতে থাকে,

কারুকে খুব দেখতে ইচ্ছে হয়, পেতে ইচ্ছে হয়, কারুর সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে

বসতে ইচ্ছে হয়,

সারাজীবন ধরে সারাজীবনের গল্প করতে ইচ্ছে হয়,

ইচ্ছে হওয়ার কোনও কারণ নেই, তারপরও ইচ্ছে হয়।

ইচ্ছের কোনও লাগাম থাকে না। ইচ্ছেগুলো এক সকাল থেকে আরেক সকাল পর্যন্ত

জ্বালাতে থাকে। প্রতিদিন।

ইচ্ছেগুলো পুরণ হয় না, তারপরও ইচ্ছেগুলো বেশরমের মত পড়ে থাকে,

আশায় আশায় থাকে।

কষ্ট হতে থাকে, কষ্ট হওয়ার কোনও কারণ নেই, তারপরও হতে থাকে,

সময়গুলো নষ্ট হতে থাকে।

কারও কারও জন্য জানি না জীবনের শেষ বয়সে এসেও সেই কিশোরীর মত

কেন অনুভব করি।

কিশোরী বয়সেও যেমন লুকিয়ে রাখতে হত ইচ্ছেগুলো, এখনও হয়।

কি জানি সে, যার জন্য অন্যরকমটি লাগে, যদি

ইচ্ছেগুলো দেখে হাসে!

সেই ভয়ে লুকিয়ে রাখি ইচ্ছে, সেই ভয়ে আড়াল করে রাখি কষ্ট।

হেঁটে যাই, যেন কিছুই হয়নি, যেন আর সবার মত সুখী মানুষ আমিও, হেঁটে যাই।

মুক্তি

যদি ভুলে যাবার হয়, ভুলে যাও।
দূরে বসে বসে মোবাইলে, ইমেইলে হঠাৎ হঠাৎ জ্বালিয়ো না,
দূরে বসে বসে নীরবতার বরফ ছুড়ে ছুড়ে এভাবে বিরক্তও করো না।

ভুলে গেলে এইটুকু অন্তত বুঝবো ভুলে গেছো,
ভুলে গেলে পা কামড়ে রাখা জুতোগুলো খুলে একটু খালি পায়ে হাঁটবো,
ভুলে গেলে অপেক্ষার কাপড়চোপড় খুলে একটু স্নান করবো,
ভুলে গেলে পুরোনো গানগুলো আবার বাজাবো,
ভুলে গেলে সবগুলো জানালা খুলে একটু এলোমেলো শোবো।
রোদ বা জোৎস্না এসে শরীরময় লুকোচুরি খেলে খেলুক, আমি না হয় ঘুমোবো,

ঘুমোবো ঘুমোবো করেও নিশ্চিন্তের একটুখানি ঘুম ঘুমোতে পারিনা কত দীর্ঘদিন!
কেবল অপেক্ষায় গেছে। না ঘুমিয়ে গেছে। জানালায় দাঁড়িয়ে গেছে।

কেউ আমাকে মনে রাখছে, কেউ আমাকে মনে মনে খুব চাইছে, সমস্তটা চাইছে,
কেউ দিনে রাতে যে কোনও সময় দরজায় কড়া নাড়বে,
সামনে তখন দাঁড়াতে হবে নিখুঁত, যেন চুল, যেন মুখ, যেন চোখ, ঠোঁট,
যেন বুক, চিবুক এইমাত্র জন্মেছে, কোথাও ভাঙেনি, আঁচড় লাগেনি, ধুলোবালি ছোঁয়নি।
হাসতে হবে রূপকথার রাজকন্যার মতো,
তার ক্ষিধে পায় যদি, চায়ের তৃষ্ঞা পায় যদি!
সবকিছু হাতের কাছে রাখতে হবে নিখুঁত!
ভালোবাসতে হবে নিখুঁত!
নিমগ্ন হতে হবে নিখুঁত!
ক্ষুদ্র হতে হবে নিখুঁত!
দুঃস্বপ্নকে কত কাল সুখ নামে ডেকে ডেকে নিজেকে ভুলিয়েছি!

ভুলে যেতে হলে ভুলে যাও, বাঁচি।
যত মনে রাখবে, যত চাইবে আমাকে, যত কাছে আসবে,
যত বলবে ভালোবাসো, তত আমি বন্দি হতে থাকবো তোমার হৃদয়ে, তোমার জালে,
তোমার পায়ের তলায়, তোমার হাতের মুঠোয়, তোমার দশনখে।

ভুলে যাও, মুখের রংচংগুলো ধুয়ে একটু হালকা হই, একটুখানি আমি হই।

তালাকনামা

যে কোনও দূরত্বে গেলে তুমি আর আমার থাকো না
তুমি হও যার-তার খেলুড়ে পুরুষ।

যে কোনও শরীরে গিয়ে
শকুনের মতো খুঁটে খুঁটে রূপ ও মাংস তুমি আহার করো
গণিকা ও প্রেমিকার শরীরে কোনও পার্থক্য বোঝো না।

কবিতার চে’ চাতুর্য বোঝো ভাল,
রাত্রি এলে রক্তের ভেতর টকাশ-টকাশ দৌড়ে যায়
একশো একটা লাগামহীন ঘোড়া,
রোমকূপে পূর্বপুরুষ নেচে উঠে তাধিন-তাধিন।
আমি জোস্নার কথা তোমাকে অনেক বলেছি
তুমি অমাবস্যা ও পূর্ণিমার কোনও পার্থক্য বোঝো না।
ভালবাসার চে’ প্রাচুর্য বোঝো বেশি
যে কারও গোড়ালির নীচ থেকে চেটে খাও
এক ফোঁটা মদ, লক্ষ গ্যালন মদে আমুণ্ডু ডুবে
তবু তোমার তৃষ্ণা ঘোচে না।
তোমাকে স্বপ্নের অথা অনেক বলেছি
সমুদ্র ও নর্দমার ভেতরে তুমি কোনও পার্থক্য বোঝো না।
যে কোনও দূরত্বে গেলে তুমি হও যার-তার খেলুড়ে পুরুষ।

যার-তার পুরুষকে আমি আমার বলি না

Also Read: বাংলা অনুপ্রেরণামূলক কবিতা

Best Poems of Taslima Nasrin l Taslima Nasrin Best Poems l Famous Poems of Taslima Nasrin

পারো তো ধর্ষণ করো

আর ধর্ষিতা হয়ো না, আর না

আর যেন কোনও দুঃসংবাদ কোথাও না শুনি যে তোমাকে ধর্ষণ করেছে

কোনও এক হারামজাদা বা কোনও হারামজাদার দল।

আমি আর দেখতে চাই না একটি ধর্ষিতারও কাতর করুণ মুখ,

আর দেখতে চাই না পুরুষের পত্রিকায় পুরুষ সাংবাদিকের লেখা সংবাদ

পড়তে পড়তে কোনও পুরুষ পাঠকের আরও একবার মনে মনে ধর্ষণ করা ধর্ষিতাকে।

ধর্ষিতা হয়ো না, বরং ধর্ষণ করতে আসা পুরুষের পুরুষাঙ্গ কেটে ধরিয়ে দাও হাতে,

অথবা ঝুলিয়ে দাও গলায়,

খোকারা এখন চুষতে থাক যার যার দিগ্বিজয়ী অঙ্গ, চুষতে থাক নিরূপায় ঝুলে থাকা

অণ্ডকোষ, গিলতে থাক এসবের রস, কষ।

ধর্ষিতা হয়ো না,পারো তো পুরুষকে পদানত করো, পরাভূত করো,

পতিত করো, পয়মাল করো

পারো তো ধর্ষণ করো,

পারো তো ওদের পুরুষত্ব নষ্ট করো।

লোকে বলবে, ছি ছি, বলুক।

লোকে বলবে এমন কী নির্যাতিতা নারীরাও যে তুমি তো মন্দ পুরুষের মতই,

বলুক, বলুক যে এ তো কোনও সমাধান নয়, বলুক যে তুমি তো তবে ভালো নও

বলুক, কিছুতে কান দিও না, তোমার ভালো হওয়ার দরকার নেই,

শত সহস্র বছর তুমি ভালো ছিলে মেয়ে, এবার একটু মন্দ হও।

চলো সবাই মিলে আমরা মন্দ হই,

মন্দ হওয়ার মত ভালো আর কী আছে কোথায়!


লজ্জা

পূর্ণিমাকে ধর্ষণ করছে এগারোটি মুসলমান পুরুষ, ভর দুপুরে।

ধর্ষণ করছে কারণ পূর্ণিমা মেয়েটি হিন্দু।

পূর্ণিমাকে পূর্ণিমার বাড়ির উঠোনে ফেলে ধর্ষণ করছে তারা।

পূর্ণিমার মাকে তারা ঘরের খুঁটিতে বেঁধে রেখেছে,

চোখদুটো খোলা মার, তিনি দেখতে পাচ্ছেন তার কিশোরী কন্যার বিস্ফারিত চোখ,

যন্ত্রণায় কাতর শরীর।

পূর্ণিমার বোনটি উপুড় হয়ে পড়ে আছে মাকে শক্ত করে ধরে।

উঠোনে হুড়োহুড়ি, পূর্ণিমার মা পাথর-কণ্ঠে মিনতি করছেন, বাবারা, এক সাথে না,

একজন একজন কইরা যাও ওর কাছে।

এগারোটি উত্তেজিত পুরুষাঙ্গে তখন ধর্মের নিশান উড়ছে।

পূর্ণিমার কান্না ছাপিয়ে পূর্ণিমার মার, গ্রামের কুলবধূটির তুমুল চিৎকারে তখন দুপুর

দ্বিখণ্ডিত, তিনি ভিক্ষে চাইছেন বাবাদের কাছে, –‘যা করার আমারে করো, ওরে ছাইড়া দেও।’

মুসলমানেরা পূর্ণিমাকে ছেড়ে দেয়নি,

পূর্ণিমার মাকেও দেয়নি,

ছ বছর বয়সী ছোট বোনটিকেও দেয়নি। 

কেন দেবে! সবাই যে ওরা হিন্দু!


এমন ভেঙ্গে চুরে ভালো কেউ বাসেনি আগে

কী হচ্ছে আমার এসব!

যেন তুমি ছাড়া জগতে কোনও মানুষ নেই, কোনও কবি নেই, কোনও পুরুষ নেই, কোনও

প্রেমিক নেই, কোনও হৃদয় নেই!

আমার বুঝি খুব মন বসছে সংসারকাজে?

বুঝি মন বসছে লেখায় পড়ায়?

আমার বুঝি ইচ্ছে হচ্ছে হাজারটা পড়ে থাকা কাজগুলোর দিকে তাকাতে?

সভা সমিতিতে যেতে?

অনেক হয়েছে ওসব, এবার অন্য কিছু হোক,

অন্য কিছুতে মন পড়ে থাক, অন্য কিছু অমল আনন্দ দিক।

মন নিয়েই যত ঝামেলা আসলে, মন কোনও একটা জায়গায় পড়ে রইলো তো পড়েই রইল।

মনটাকে নিয়ে অন্য কোথাও বসন্তের রঙের মত যে ছিটিয়ে দেব, তা হয় না।

সবারই হয়ত সবকিছু হয় না, আমার যা হয় না তা হয় না।

তুমি কাল জাগালে, গভীর রাত্তিরে ঘুম থেকে তুলে প্রেমের কথা শোনালে,

মনে হয়েছিল যেন স্বপ্ন দেখছি

স্বপ্নই তো, এ তো একরকম স্বপ্নই,

আমাকে কেউ এমন করে ভালোবাসার কথা বলেনি আগে,

ঘুমের মেয়েকে এভাবে জাগিয়ে কেউ চুমু খেতে চায়নি

আমাকে এত আশ্চর্য সুন্দর শব্দগুচ্ছ কেউ শোনায়নি কোনওদিন

এত প্রেম কেউ দেয়নি,

এমন ভেঙে চুরে ভালো কেউ বাসেনি।

তুমি এত প্রেমিক কী করে হলে!

কী করে এত বড় প্রেমিক হলে তুমি? এত প্রেম কেন জানো? শেখালো কে?

যে রকম প্রেম পাওয়ার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করেছি, স্বপ্ন দেখেছি, পাইনি

আর এই শেষ বয়সে এসে যখন এই শরীর খেয়ে নিচ্ছে একশ একটা অসুখ-পোকা

যখন মরে যাবো, যখন মরে যাচ্ছি — তখন যদি থোকা থোকা প্রেম এসে ঘর ভরিয়ে দেয়,

মন ভরিয়ে দেয়, তখন সবকিছুকে স্বপ্নই তো মনে হবে,

স্বপ্নই মনে হয়।

তোমাকে অনেক সময় রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হয় না,

হঠাৎ ঝড়ে উড়ে হৃদয়ের উঠোনে

যেন অনেক প্রত্যাশিত অনেক কালের দেখা স্বপ্ন এসে দাঁড়ালে।

আগে কখনও আমার মনে হয়নি ঘুম থেকে অমন আচমকা জেগে উঠতে আমি আসলে

খুব ভালোবাসি

আগে কখনও আমার মনে হয়নি কিছু উষ্ণ শব্দ আমার শীতলতাকে একেবারে পাহাড়ের

চুড়োয় পাঠিয়ে দিতে পারে

আগে কখনও আমি জানিনি যে কিছু মোহন শব্দের গায়ে চুমু খেতে খেতে আমি রাতকে

ভোর করতে পারি।

Exit mobile version