Raater Alo

Best Poems by Rudra Mohammad Shahidullah l রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শ্রেষ্ঠ কবিতা

Best Poems by Rudra Mohammad Shahidullah l রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শ্রেষ্ঠ কবিতা

Best Poems by Rudra Mohammad Shahidullah l রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শ্রেষ্ঠ কবিতা: আমাদের ব্লগে স্বাগতম, যেখানে আমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রিয় এবং প্রভাবশালী কবিদের একজন রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর গভীর এবং উদ্দীপক কবিতা উদযাপন করি। তার আবেগপূর্ণ শ্লোক এবং গভীর আবেগের অনুরণনের জন্য পরিচিত, শহীদুল্লাহর কবিতা মানুষের অভিজ্ঞতা, প্রেম, বেদনা এবং তার সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের সারাংশকে ধারণ করে।

রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা তীব্র আবেগ ও গভীর চিন্তার ট্যাপেস্ট্রি। তাঁর কাজগুলি কেবল তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রাম এবং বিজয়ের প্রতিফলন নয় বরং বৃহত্তর মানবিক অবস্থার ভাষ্যও। এই ব্লগে, আমরা বাংলা সাহিত্যে এবং এর বাইরেও থিম, শৈলীগত উপাদান এবং তাদের স্থায়ী প্রভাব পরীক্ষা করে তার সেরা কিছু কবিতার সন্ধান করি।

Best Poems by Rudra Mohammad Shahidullah l রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শ্রেষ্ঠ কবিতা

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়

চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী

চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে

আমার না-থাকা জুড়ে।

জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে-

জীবন সুন্দর

আকাশ-বাতাস পাহাড়-সমুদ্র

সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর

আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা

তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়!

বিদায়ের সেহনাই বাজে

নিয়ে যাবার পালকি এসে দাঁড়ায় দুয়ারে

সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে

এই যে বেঁচে ছিলাম

দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেতে হয়

সবাইকে

অজানা গন্তব্যে

হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি

অজান্তেই চমকে ওঠি

জীবন, ফুরালো নাকি!

এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে…

আফিম তবুও ভালো, ধর্ম সে তো হেমলক বিষ

যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ

তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।

জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি

ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে

ক্রমশঃ উঠছে ফুটে ক্ষয়রোগ, রোগেরপ্রকোপ

একদার অন্ধকারে ধর্ম এনে দিয়েছিল আলো,

আজ তার কংকালের হাড় আর পঁচা মাংসগুলো

ফেরি কোরে ফেরে কিছু স্বার্থাণ্বেষী ফাউল মানুষ-

সৃষ্টির অজানা অংশ পূর্ণ করে গালগল্প দিয়ে।

আফিম তবুও ভালো, ধর্ম সে তো হেমলকবিষ।

ধর্মান্ধের ধর্ম নেই, আছে লোভ, ঘৃণ্য চতুরতা,

মানুষের পৃথিবীকে শত খণ্ডে বিভক্ত করেছে

তারা টিকিয়ে রেখেছে শ্রেণীভেদ ঈশ্বরের নামে।

ঈশ্বরের নামে তারা অনাচার করেছে জায়েজ।

হা অন্ধতা! হা মুর্খামি! কতোদূর কোথায় ঈশ্বর!

অজানা শক্তির নামে হত্যাযজ্ঞ কতো রক্তপাত,

কত যে নির্মম ঝড় বয়ে গেল হাজার বছরে!

কোন্ সেই বেহেস্তের হুর আর তহুরাশরাব?

অন্তহীন যৌনাচারে নিমজ্জিত অনন্ত সময়?

যার লোভে মানুষও হয়ে যায় পশুর অধম।

আর কোন দোজখ বা আছে এর চেয়ে ভয়াবহ

ক্ষুধার আগুন সে কি হাবিয়ার চেয়েখুব কম?

সে কি রৌরবের চেয়ে নম্র কোন নরোমআগুন?

ইহকাল ভুলে যারা পরকালে মত্ত হয়েআছে

চলে যাক সব পরপারে বেহেস্তে তাদের

আমরা থাকবো এই পৃথিবীর মাটি জলে নীলে,

দ্বন্দ্বময় সভ্যতার গতিশীল স্রোতের ধারায়

আগামীর স্বপ্নে মুগ্ধ বুনে যাবো সমতার বীজ

ভালবাসার সময় তো নেই

ভালবাসার সময় তো নেই

ব্যস্ত ভীষন কাজে,

হাত রেখো না বুকের গাড় ভাজে।

ঘামের জলে ভিজে সাবাড়

করাল রৌদ্দুরে,

কাছএ পাই না, হৃদয়- রোদ দূরে।

কাজের মাঝে দিন কেটে যায়

কাজের কোলাহল

তৃষ্নাকে ছোয় ঘড়ায় তোলা জল।

নদী আমার বয় না পাশে

স্রোতের দেখা নেই,

আটকে রাখে গেরস্থালির লেই।

তোমার দিকে ফিরবো কখন

বন্দী আমার চোখ

পাহারা দেয় খল সামাজিক নখ।

মানুষের মানচিত্র-১

আহারে বৃষ্টির রা, সোহাগি লো, আমি থাকি দূর পরবাসে।

কান্দে না তোমার বুকে একঝাঁক বুনোপাখি অবুঝ কৈতর?

কেমনে ফুরায় নিশি? বলো সই, কেমনে- বা কাটাও প্রহর?

পরাণ ছাপায়ে নামে বাউরি বাতাস, দারুণ বৃষ্টির মাসে।

যে বলে সে বলে কথা, কাছে বসে, হাতে খিলিপান দিয়ে কয়-

এতো জল ঝরে তবু পরান ভেজে না কেন, কও তো মরদ?

দুয়ারে লাগায়ে খিল যদি কেউ থাকে তারে কে দেবে দরদ।

শরীরের মোহনায় দেখি তার বুনো ঢেউ রক্ত-মাংসময়।

শরীর গুটায়ে রাখি, শামুকের মতো যাই গুটায়ে ভেতরে।

অন্ধকার চিরে চিরে বিজুলির ধলা দাঁত উপহাসে হাসে,

আমি বলি- ক্ষমা দাও, পরান বন্ধুয়া মোর থাকে পরবাসে,

দেহের রেকাবি খুলে পরানের খিলিপান কে খাওয়াবে তোরে।

গতবার আষাঢ়ও পার হয়ে গেলো তাও নামে না বাদল,

এবার জ্যোষ্ঠিতে মাঠে নেমে গেছে কিষানের লাঙল-জোয়াল।

আমাদের মাঝে দেখো জমির ভাগের মতো কতো শত আল্,

এই দূর পরবাস কবে যাবে? জমিনের আসল আদল।

কবে পাবো? কবে পাবো আল্ হীন একখণ্ড মানব-জমিন?

পরবাস থাকবে না, থাকবে না দূরত্বের এই রীতি-নীতি।

মহুয়ার মদ খেয়ে মত্ত হয়ে থাকা সেই পার্বনের তিথি

কবে পাবো? কবে পাবো শর্তহীন আবাদের নির্বিরোধ দিন?

মনে পড়ে সুদূরের মাস্তুল

পেছনে তাকালে কেন মূক হয়ে আসে ভাষা !

মনে পড়ে সেই সব দুপুরের জলাভূমি,

সেই সব বেতফল, বকুল কুড়ানো ভোর,

আহা সেই রাঙাদির আঁচলতলের উত্তাপ,

মনে পড়ে…

মনে পড়ে, বন্দরে সেই সব কালোরাত,

ঈগলের মতো ডানা সেই বিশাল গভীর রাতে,

একটি কিশোর এসে চুপি চুপি সাগরের কূলে

দাঁড়াতো একাকী

তন্ময় চোখে তার রাশি রাশি বিস্ময় নিয়ে।

কবে তারে ডাক দিয়ে নিয়ে গেলো যৌবন সুচতুর,

কবে তারে ডেকে নিলো মলিন ইটের কালো সভ্যতা !

সবুজ ছায়ার নিচে ঘুমে চোখ ঢুলে এলে

মা যাকে শোনাতো সেই তুষারদেশের কথা,

তার চোখে আজ এতো রাতজাগা ক্লান্তির শোক !

পেছনে তাকালে কেন নিরবতা আসে চোখে !

মনে পড়ে- জ্যোৎস্নায় ঝলোমলো বালুচর,

একটি কিশোর- তার তন্ময় দুটি চোখে

রাশি রাশি কালোজল- সুদূরের মাস্তুল

মনে পড়ে…

দূরে আছো দূরে

তোমাকে পারিনি ছুঁতে, তোমার তোমাকে-

উষ্ণ দেহ ছেনে ছেনে কুড়িয়েছি সুখ,

পরস্পর খুড়ে খুড়ে নিভৃতি খুঁজেছি।

তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।

যেভাবে ঝিনুক খুলে মুক্ত খোঁজে লোকে

আমাকে খুলেই তুমি পেয়েছো অসুখ,

পেয়েছো কিনারাহীন আগুনের নদী।

শরীরের তীব্রতম গভীর উল্লাসে

তোমার চোখের ভাষা বিস্ময়ে পড়েছি-

তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।

জীবনের ’পরে রাখা বিশ্বাসের হাত

কখন শিথিল হয়ে ঝ’রে গেছে পাতা।

কখন হৃদয় ফেলে হৃদপিন্ড ছুঁয়ে

বোসে আছি উদাসীন আনন্দ মেলায়-

তোমাকে পারিনি ছুঁতে-আমার তোমাকে,

ক্ষাপাটে গ্রীবাজ যেন, নীল পটভূমি

তছ নছ কোরে গেছি শান্ত আকাশের।

অঝোর বৃষ্টিতে আমি ভিজিয়েছি হিয়া-

তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।।

গুচ্ছ কবিতা


থাকুক তোমার একটু স্মৃতি থাকুক
একলা থাকার খুব দুপুরে
একটি ঘুঘু ডাকুক

দিচ্ছো ভীষণ যন্ত্রণা
বুঝতে কেন পাছো না ছাই
মানুষ আমি, যন্ত্র না!

চোখ কেড়েছে চোখ
উড়িয়ে দিলাম ঝরা পাতার শোক।

এ কেমন ভ্রান্তি আমার

এ কেমন ভ্রান্তি আমার !
এলে মনে হয় দূরে স’রে আছো, বহুদূরে,
দূরত্বের পরিধি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে আকাশ।
এলে মনে হয় অন্যরকম জল হাওয়া, প্রকৃতি,
অন্য ভূগোল, বিষুবরেখারা সব অন্য অর্থবহ-
তুমি এলে মনে হয় আকাশে জলের ঘ্রান।

হাত রাখলেই মনে হয় স্পর্শহীন করতল রেখেছো চুলে,
স্নেহ- পলাতক দারুন রুক্ষ আঙুল।
তাকালেই মনে হয় বিপরীত চোখে চেয়ে আছো,
সমর্পন ফিরে যাচ্ছে নগ্ন পায়ে একাকী বিষাদ- ক্লান্ত
করুণ ছায়ার মতো ছায়া থেকে প্রতিচ্ছায়ে।
এলে মনে হয় তুমি কোনদিন আসতে পারোনি..

কুশল শুধালে মনে হয় তুমি আসোনি
পাশে বসলেও মনে হয় তুমি আসোনি।
করাঘাত শুনে মনে হয় তুমি এসেছো,
দুয়ার খুল্লেই মনে হয় তুমি আসোনি।
আসবে বললে মনে হয় অগ্রিম বিপদবার্তা,
আবহাওয়া সংকেত, আট, নয়, নিম্নচাপ, উত্তর, পশ্চিম-
এলে মনে হয় তুমি কোনদিন আসতে পারোনি।

চ’লে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে,
চ’লে গেলে মনে হয় তুমি সমস্ত ভূবনে আছো

একদিন যোগ্য হবো

দেখে নিও, একদিন আমি ঠিক
খুলবো আমার এই দেহের বাকল,
পুরোনো বাঁধন বোলে মমতা হবে না
দেখে নিও, আমি ঠিকই খুলবো এই ক্লান্তি আমার।

প্রাচীন ধুলোর মতো মাকড়শা-মোহ
জ’মে আছে শরীরের প্রতিটি পরতে,
ছিঁড়তে গেলেই খুব ব্যথা পাই দেহে
মনে হয় এরাও আপন ছিলো বুঝি,
তবু এই কষ্টকে একদিন আমি ঠিক খুলে নেবো নিষ্ঠুর হাতে।

দেখে নিও__অমলিনা, দেখে নিও_
পৃথিবী যেমন তার শরীরের থেকে
রাত্রির মোহন পোশাক খুলে দেহে নেয় জ্বলন্ত রোদ,
আমিও তেমনি দেখো,অকাতরে বুকে নেবো সত্যের সব দাহ।

অমলিনা__
আঁধারের মোহ খুব ভীষন মায়াবী
ভীষন কঠিন তাকে ছুঁড়ে ফেলা দুরে,
ভালোবাসা বুকে নিতে দুঃসাহস চাই—

তবু আমি একদিন ঠিকই যোগ্য হবো,
দেহ থেকে খুলে ফেলে ক্লান্ত অক্ষমতার বাকল
ঠিকই তোমার পদতলে বিশ্বাসের অর্ঘ রেখে
ভালোবাসা বুকে নেবো সত্য আগুন
___দেখে নিও।

তোমার জন্য লিখি, তোমাকে লিখি না

আমি তোমাকে কবিতায় লিখি না
গানেও লিখি না।
ক্যানো না আমার গান
আমার সকল কবিতা
তোমার জন্যই লেখা।

আমি তোমাকে কখনো স্বপ্নে দেখি না
কখনো ভাবিও না
ক্যানো না আমার ভাবনা
আমার সকল স্বপ্ন
তোমার জন্যই
একমাত্র তোমার জন্যই।

চাঁদ আকাশের জন্য ওঠে
অথবা আকাশ চাঁদের জন্য
এ-সব অনেক তর্কের ব্যাপার

আমি তোমার জন্য লিখি কিন্তু
তোমাকে কখনো লিখি না।

আমার ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে

আমার ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে ,
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।

ঢেকে রাখে যেমন কুসুম, পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম।
তেমনি তোমার নিবিঢ় চলা, মরমের মূল পথ ধরে।

পুষে রাখে যেমন কুসুম, খোলসের আবরণে মুক্তোর ঘুম।
তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া, ভিতরের নীল বন্দরে।

ভাল আছি ভাল থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।
দিয়ো তোমার মালাখানি, বাউলের এই মনটারে।
আমার ভিতরে বাহিরে…

তুমি বরং কুকুর পোষো

তুমি বরং কুকুর পোষো,
প্রভুভক্ত খুনসুটিতে কাটবে তোমার নিবিড় সময়,
তোর জন্য বিড়ালই ঠিক,
বরং তুমি বিড়ালই পোষো
খাঁটি জিনিস চিনতে তোমার ভুল হয়ে যায়
খুঁজে এবার পেয়েছ ঠিক দিক ঠিকানা
লক্ষী সোনা, এখন তুমি বিড়াল এবং কুকুর পোষো
শুকরগুলো তোমার সাথে খাপ খেয়ে যায়,
কাদা ঘাটায় দক্ষতা বেশ সমান সমান।
ঘাটাঘাটির ঘনঘটায় তোমাকে খুব তৃপ্ত দেখি,
তুমি বরং ওই পুকুরেই নাইতে নামো
উংক পাবে, জলও পাবে।
চুল ভেজারও তেমন কোন আশঙ্কা নেই,
ইচ্ছেমত যেমন খুশি নাইতে পারো।
ঘোলা পানির আড়াল পেলে
কে আর পাবে তোমার দেখা।
মাছ শিকারেও নামতে পারো
তুমি বরং ঘোলা পানির মাছ শিকারে
দেখাও তোমার গভীর মেধা।
তুমি তোমার স্বভাব গাছে দাঁড়িয়ে পড়ো
নিরিবিলির স্বপ্ন নিয়ে আর কতকাল?
শুধু শুধুই মগজে এক মোহন ব্যধি
তুমি বরং কুকুর পোষো, বিড়াল পোষো,
কুকুর খুবই প্রভুভক্ত এবং বিড়াল আদরপ্রিয়
তোমার জন্য এমন সামঞ্জস্য তুমি কোথায় পাবে ?

ইশতেহার

পৃথিবীতে মানুষ তখনও ব্যক্তিস্বার্থে ভাগ হয়ে যায়নি ।
ভুমির কোনো মালিকানা হয়নি তখনো ।
তখনো মানুষ শুধু পৃথিবীর সন্তান ।

অরন্য আর মরুভূমির
সমুদ্র আর পাহাড়ের ভাষা তখন আমরা জানি ।
আমরা ভূমিকে কর্ষন করে শস্য জন্মাতে শিখেছি ।
আমরা বিশল্যকরনীর চিকিৎসা জানি
আমরা শীত আর উত্তাপে সহনশীল
ত্বক তৈরি করেছি আমাদের শরীরের ।
আমরা তখন সোমরস, নৃত্য আর
শরীরের পবিত্র উৎসব শিখেছি ।

আমাদের নারীরা জমিনে শস্য ফলায়
আর আমাদের পুরুষেরা শিকার করে ঘাই হরিন।
আমরা সবাই মিলে খাই আর পান করি ।
জ্বলন্ত আগুনকে ঘিরে সবাই আমরা নাচি
আর প্রশংসা করি পৃথিবীর ।
আমরা আমাদের বিস্ময় আর সুন্দরগুলোকে বন্দনা করি ।

পৃথিবীর পূর্নিমা রাতের ঝলোমলো জ্যোৎস্নায়
পৃথিবীর নারী আর পুরুষেরা
পাহাড়ের সবুজ অরন্যে এসে শরীরের উৎসব করে ।

তখন কী আনন্দরঞ্জিত আমাদের বিশ্বাস ।
তখন কী শ্রমমুখর আমাদের দিনমান ।
তখন কী গৌরবময় আমাদের মৃত্যু ।
তারপর –
কৌমজীবন ভেঙে আমরা গড়লাম সামন্ত সমাজ ।
বন্যপ্রানীর বিরুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য অস্ত্রগুলো
আমরা ব্যবহার করলাম আমাদের নিজের বিরুদ্ধে ।
আমাদের কেউ কেউ শ্রমহীনতায় প্রশান্তি খুঁজে পেতে চাইলো ।
দুর্বল মানুষেরা হয়ে উঠলো আমাদের সেবার সামগ্রী ।
আমাদের কারো কারো তর্জনী জীবন ও মৃত্যুর নির্ধারন হলো ।

ভারী জিনিস টানার জন্যে আমরা যে চাকা তৈরি করেছিলাম
তাকে ব্যবহার করলাম আমাদের পায়ের পেশীর আরামের জন্যে ।
আমাদের বন্য অস্ত্র সভ্যতার নামে
গ্রাস করে চললো মানুষের জীবন ও জনপদ ।

আমরা আমাদের চোখকে সুদূরপ্রসারী করার জন্যে দূরবীন
আর সূক্ষ্ নিরীক্ষনের জন্যে অনুবীক্ষন তৈরি করলাম ।
আমাদের পায়ের গতি বর্ধন করলো উড়ন্ত বিমান ।

আমাদের কন্ঠস্বর বর্ধিত হলো,
আমাদের ভাষা ও বক্তব্য গ্রন্থিত হলো,
আমরা রচনা করলাম আমাদের অগ্রযাত্রার ইতিহাস ।
আমাদের মস্তিষ্ককে আরো নিখুঁত ও ব্যপক করার জন্যে
আমরা তৈরি করলাম কম্পিউটার ।

আমাদের নির্মিত যন্ত্র শৃঙ্খলিত করলো আমাদের
আমাদের নির্মিত নগর আবদ্ধ করলো আমাদের
আমাদের পুঁজি ও ক্ষমতা অবরুদ্ধ করলো আমাদের
আমাদের নভোযান উৎকেন্দ্রিক করলো আমাদের ।

অস্তিত্ব রক্ষার নামে আমরা তৈরী করলাম মারনাস্ত্র ।
জীবনরক্ষার নামে আমরা তৈরি করলাম
জীবনবিনাশী হাতিয়ার ।
আমরা তৈরি করলাম পৃথিবী নির্মূল-সক্ষম পারমানবিক বোমা ।

একটার পর একটা খাঁচা নির্মান করেছি আমরা ।
আবার সে খাঁচা ভেঙে নতুন খাঁচা বানিয়েছি –
খাঁচার পর খাঁচায় আটকে পড়তে পড়তে
খাঁচার আঘাতে ভাঙতে ভাঙতে, টুকরো টুকরো হয়ে
আজ আমরা একা হয়ে গেছি ।

প্রত্যেকে একা হয়ে গেছি ।
কী ভয়ংকর এই একাকীত্ব !
কী নির্মম এই বান্ধবহীনতা !
কী বেদনাময় এই বিশ্বাসহীনতা !

এই সৌরমন্ডলের
এই পৃথিবীর এক কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে
যে-শিশুর জন্ম ।
দিগন্তবিস্তৃত মাঠে ছুটে বেড়ানোর অদম্য স্বপ্ন
যে-কিশোরের ।
জ্যোৎস্না যাকে প্লাবিত করে ।
বনভূমি যাকে দুর্বিনীত করে ।
নদীর জোয়াড় যাকে ডাকে নশার ডাকের মতো ।
অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ঔপনিবেশিক জোয়াল
গোলাম বানানোর শিক্ষাযন্ত্র ।
অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে
এক হৃদয়হীন ধর্মের আচার ।
অথচ যাকে শৃঙ্খলিত করা হয়েছে স্বপ্নহীন সংস্কারে ।

যে-তরুন উনসত্তরের অন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে
যে-তরুন অস্ত্র হাতে স্বাধীনতাযুদ্ধে গিয়েছে
যে-তরুনের বিশ্বাস, স্বপ্ন, সাধ,
স্বাধীনতা-উত্তরকালে ভেঙে খান খান হয়েছে,
অন্তবে রক্তাক্ত যে-তরুন নিরুপায় দেখেছে নৈরাজ্য,
প্রতারনা আর নির্মমতাকে ।
দুর্ভিক্ষ আর দুঃশাসন যার নির্ভৃত বাসনাগুলো
দুমড়ে মুচড়ে তছনছ করেছে
যে-যুবক দেখেছে এক অদৃশ্য হাতের খেলা
দেখেছে অদৃশ্য এক কালোহাত
যে-যুবক মিছিলে নেমেছে
বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছে
আকন্ঠ মদের নেশায় চুর হয়ে থেকেছে
অনাহারে উড়নচন্ডী ঘুরছে
যে-যুবক ভয়ানক অনিশ্চয়তা আর বাজির মুখে
ছুঁড়ে দিয়েছে নিজেকে
যে-পুরুষ এক শ্যমল নারীর সাথে জীবন বিনিময় করেছে
যে-পুরুষ ক্ষুধা, মৃত্যু আর বেদনার সাথে লড়ছে এখনো,
লড়ছে বৈষম্য আর শ্রেনীর বিরুদ্ধে –
সে আমি ।

আমি একা ।
এই ব্রক্ষ্মান্ডের ভিতর একটি বিন্দুর মতো আমি একা ।
আমার অন্তর রক্তাক্ত ।
আমার মস্তিষ্ক জর্জরিত ।
আমার স্বপ্ন নিয়ন্ত্রিত ।
আমার শবীর লাবন্যহীন ।
আমার জীভ কাটা ।
তবু এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন আমাকে কাতর করে
আমাকে তড়ায়…

আমাদের কৃষকেরা
শূন্য পাকস্থলি আর বুকের ক্ষয়কাশ নিয়ে মাঠে যায় ।
আমাদের নারীরা ক্ষুধায় পীড়িত, হাড্ডিসার ।
আমাদের শ্রমিকেরা স্বাস্থহীন ।
আমাদের শিশুরা অপুষ্ট, বীভৎস-করুন ।
আমাদের অধিকাংশ মানুষ ক্ষুধা, অকালমৃত্যু আর
দীর্ঘশ্বাসের সমুদ্রে ডুবে আছে ।

পৃথিবীর যুদ্ধবাজ লোকদের জটিল পরিচালনায়
ষড়যন্ত্রে আর নির্মমতায়,
আমরা এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা
আর চরম অসহায়ত্বের আবর্তে আটকে পড়েছি ।
কী বেদনাময় এই অনিশ্চয়তা !
আর চরম অসহায়ত্বের আবর্তে আটকা পড়েছি ।
কী বেদনাময় এই অনিশ্চয়তা !
কী বিভৎস এই ভালোবাসাহীনতা !
কী নির্মম এই স্বপ্নহীনতা !

আজ আমরা আবার সেই
বিশ্বাস আর আনন্দকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
সাহস আর সরলতাকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
শ্রম আর উৎসবকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
ভালোবাসা আর প্রশান্তিকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
স্বাস্থ্য আর শরীরের লাবন্যকে ফিরে পেতে চাই
আজ আমরা আবার সেই
কান্নাহীন আর দীর্ঘশ্বাসহীন জীবনের কাছে যেতে চাই
আর আমরা শোষন আর ষঠতা
অকালমৃত্যু আর ক্ষুধার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে চাই ।

আমাদের সমৃদ্ধ এই বিজ্ঞান নিয়ে
আমাদের অভিজ্ঞতাময় এই শিল্পসম্ভার নিয়ে
আমাদের দূরলক্ষ্য আর সুক্ষ্ম বীক্ষন নিয়ে
আমাদের দ্বন্ধময় বেগবান দর্শন নিয়ে
আমরা ফিরে যাবো আমাদের বিশ্বাসের পৃথিবীতে
আমাদের শ্রম, উৎসব, আনন্দ আর প্রশান্তির পৃথিবীতে ।
পরমানুর সঠিক ব্যবহার
আমাদের শস্যের উৎপাদন প্রয়োজনতুল্য করে তুলবে,
আমাদের কারখানাগুলো কখনোই হত্যার অস্ত্র তৈরি করবে না,
আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান নিরোগ করবে পৃথিবীকে;
আমাদের মর্যদার ভিত্তি হবে মেধা, সাহস আর শ্রম ।
আমাদের পুরুষেরা সুলতানের ছবির পুরুষের মতো
স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ আর প্রচন্ড পৌরষদীপ্ত হবে ।
আমাদের নারীরা হবে শ্রমবতী, লক্ষীমন্ত আর লাবন্যময়ী ।
আমাদের শিশুরা হবে পৃথিবীর সুন্দরতম সম্পদন।

আমরা শস্য আর স্বাস্থের, সুন্দর আর গৌরবের
কবিতা লিখবো ।
আমরা গান গাইবো
আমাদের বসন্ত আর বৃষ্টির বন্দনা করে ।
আমরা উৎসব করবো শস্যের
আমরা উৎসব করবো পূর্নিমার
আমরা উৎসবা করবো
আমাদের গৌরবময় মৃত্যু আর বেগমান জীবনের ।

কিন্তু –
এই স্বপ্নের জীবনে যাবার পথ আটকে আছে
সামান্য কিছু মানুষ ।
অস্ত্র আর সেনা-ছাউনিগুলো তাদের দখলে ।
সমাজ পরিচালনার নামে তারা এক ভয়ংকর কারাগার
তৈরী করেছে আমাদের চারপাশে ।

তারা ক্ষুধা দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে
তারা বস্ত্রহীনতা দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে
তারা গৃহহীনতা দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে
তারা জুলুম দিয়ে আমাদের বন্দী করেছে
বুলেট দিয়ে বন্দী করেছে ।

তারা সবচেয়ে কম শ্রম দেয়
আর সবচে বেশি সম্পদ ভোগ করে;
তারা সবচে ভালো খাদ্যগুলো খায়
আর সবচে দামি পোশাকগুলো পরে ।
তাদের পুরুষদের শরীর মেদে আবৃত, কদাকার;
তাদের মেয়েদের মুখের ত্বক দেখা যায় না, প্রসাধনে ঢাকা;
তারা আলস্য আর কর্মহীনতায় কাতর, কুৎসিত ।

তারা আমাদের জীভ কেটে নিতে চায়
তারা আমাদের চোখ উপড়ে ফেলতে চায়
তারা আমাদের মেধা বিকৃত করতে চায়
তারা আমাদের শ্রবন বধির করে দিতে চায়
তারা আমাদের পেশীগুলো অকেজো করে দিতে চায়
আমাদের সন্তানদেরও তারা চায় গোলাম বানাতে ;

একদা অরন্যে
যেভাবে অতিকায় বন্যপ্রানী হত্যা করে
আমরা অরন্যজীবনে শান্তি ফিরিয়ে এনেছি,
আজ এইসব অতিকায় কদাকার বন্যমানুষগুলো
নির্মুল করে
আমরা আবার সমতার পৃথিবী বানাবো
সম্পদ আর আনন্দের পৃথিবী বানাবো
শ্রম আর প্রশান্তির পৃথিবী বানাবো।

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প

তাঁর চোখ বাঁধা হলো।
বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত
করলো তার মুখ।

থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা –
রক্তে একাকার হলো,
জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত
ঝরে পড়লো কংক্রিটে।

মা…..মাগো….. চেঁচিয়ে উঠলো সে।
পাঁচশো পঞ্চান্ন মার্কা আধ-
খাওয়া একটা সিগারেট
প্রথমে স্পর্শ করলো তার বুক।
পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধ
ছড়িয়ে পড়লো ঘরের বাতাসে।
জ্বলন্ত সিগারেটের স্পর্শ
তার দেহে টসটসে আঙুরের
মতো ফোস্কা তুলতে লাগলো।

দ্বিতীয় লাথিতে ধনুকের
মতো বাঁকা হয়ে গেলো দেহ,
এবার সে চিৎকার করতে পারলো না।
তাকে চিৎ করা হলো।
পেটের ওপর উঠে এলো দু’জোড়া বুট,
কালো ও কর্কশ।
কারণ সে তার পাকস্থলির কষ্টের
কথা বলেছিলো ,
বলেছিলো অনাহার ও ক্ষুধার কথা।

সে তার দেহের বস্ত্রহীনতার
কথা বলেছিলো –
বুঝি সে-কারণে ফর ফর
করে টেনে ছিঁড়ে নেয়া হলো তার
সার্ট।
প্যান্ট খোলা হলো। সে এখন
বিবস্ত্র , বীভৎস।

তার দুটো হাত-মুষ্টিবদ্ধ যে-হাত
মিছিলে পতাকার
মতো উড়েছে সক্রোধে,
যে-হাতে সে পোস্টার সেঁটেছে,
বিলিয়েছে লিফলেট,
লোহার হাতুড়ি দিয়ে সেই হাত
ভাঙা হলো।
সেই জীবন্ত হাত , জীবন্ত মানুষের
হাত।

তার দশটি আঙুল-
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে মার মুখ,
ভায়ের শরীর,
প্রেয়সীর চিবুকের তিল।
যে -আঙুলে ছুঁয়েছে সে সাম্যমন্ত্রে দীক্ষিত
সাথীর হাত ,
স্বপ্নবান হাতিয়ার,
বাটখারা দিয়ে সে-আঙুল পেষা হলো।
সেই জীবন্ত আঙুল, মানুষের
জীবন্ত উপমা।

লোহার সাঁড়াশি দিয়ে,
একটি একটি করে উপড়ে নেয়া হলো তার
নির্দোষ নখগুলো।
কী চমৎকার লাল রক্তের রঙ।

সে এখন মৃত।
তার শরীর ঘিরে
থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতো
ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত ,
তাজা লাল রক্ত।

তার থ্যাতলানো একখানা হাত
পড়ে আছে এদেশের মানচিত্রের ওপর,
আর সে হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের
দুর্বিনীত লাভা ।

অভিমানের খেয়া

এতদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই,
পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত
পারিজাতহীন কঠিন পাথরে।

প্রাপ্য পাইনি করাল দুপুরে,
নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা-
এই খেলা আর কতোকাল আর কতটা জীবন!
কিছুটাতো চাই- হোক ভুল, হোক মিথ্যো ও প্রবোধ,
অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন- আর কতোদিন
ভাষাহীন তরু বিশ্বাসী ছায়া কতটা বিলাবে
কতো আর এই রক্ত তিলকে তপ্ত প্রণাম!
জীবনের কাছে জন্ম কি তবে প্রতারণাময়

এতো ক্ষয়, এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে,
এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে কতোটা ক্ষরণ
কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায়।
তুমি জানো নাই- আমি তো জানি,
কতটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে, এতো গান,
এতো হাসি নিয়ে বুকে নিশ্চুপ হয়ে থাকি।

বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এইতো জীবন,
এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত।

তুমি জানো নাই- আমি তো জানি।
মাটি খুঁড়ে কারা শস্য তুলেছে,
মাংসের ঘরে আগুন পুষেছে,
যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নীলিমা চেয়েছে শুধু,
করতলে তারা ধ’রে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার।

পরাজয় এসে কন্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা,
চিতার চাবুক মর্মে হেনেছো মোহন ঘাতক।
তবুতো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়,
পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু।

বৈশাখী মেঘ ঢেকেছে আকাশ,
পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়-
ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ আর কতোদিন
নীল অভিমানে পুড়ে একা আর কতটা জীবন
কতোটা জীবন!!

বাতাসে লাশের গন্ধ

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে-
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়

বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে,
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার।
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।

এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা, -একি তবে নষ্ট জন্ম
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল

জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ সেই পুরোনো শকুন।

বাতাশে লাশের গন্ধ-
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দোলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ-
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়।

এ চোখে ঘুম আসে না। সারারাত আমার ঘুম আসে না-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ,
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি
ঘুমোতে পারিনা-

রক্তের কাফনে মোড়া কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন-
স্বাধীনতা, সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।

ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

খুব কাছে এসো না

খুব কাছে এসো না কোন দিন
যতটা কাছে এলে কাছে আসা বলে লোকে
এ চোখ থেকে ঐ চোখের কাছে থাকা
এক পা বাড়ানো থেকে অন্য পায়ের সাথে চলা
কিংবা ধরো রেল লাইনের পাশাপাশি শুয়ে
অবিরাম বয়ে চলা ।
যে কাছাকাছির মাঝে বিন্দু খানেক দূরত্বও আছে
মেঘের মেয়ে অতো কাছে এসোনা কোন দিন
দিব্যি দিলাম মেঘের বাড়ীর, আকাশ কিংবা আলোর সারির।

তার চেয়ে বরং দূরেই থেকো
যেমন দূরে থাকে ছোঁয়া, থেকে স্পর্শ
রোদ্দুরের বু্‌ক, থেকে উত্তাপ
শীতলতা, থেকে উষ্ণতা
প্রেমে্‌র, খুব গভীর ম্যাপে যেমন লুকিয়ে থাকে ভালোবাসা
তেমন দূরেত্বেই থেকে যেও-
এক ইঞ্চিতেও কভু বলতে পারবে না কেউ
কতটা কাছা কাছি এসেছিলে বলে দূরত্বের পরিমাপ দিতে পারেনি পৃথিবী।

এক গ্লাস অন্ধকার হাতে

এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি।

শুন্যতার দিকে চোখ, শুন্যতা চোখের ভেতরও–

এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি।

বিলুপ্ত বনস্পতির ছায়া, বিলুপ্ত হরিণ।

মৌসুমী পাখির ঝাঁক পালকের অন্তরালে

তুষারের গহন সৌরভ ব’য়ে আর আনে না এখন।

দৃশ্যমান প্রযুক্তির জটাজুটে অবরুদ্ব কাল,

পূর্ণিমার চাঁদ থেকে ঝ’রে পড়ে সোনালী অসুখ।

ডাক শুনে পেছনে তাকাই– কেউ নেই।

এক গ্লাস অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে আছি একা….

সমকালীন সুন্দরীগণ অতিদ্রুত উঠে যাচ্ছে

অভিজাত বেডরুমে,

মূল্যবান আসবাবপত্রের মতন নির্বিকার।

সভ্যতা তাকিয়ে আছে তার অন্তর্গত ক্ষয়

আর প্রশংসিত পচনের দিকে।

উজ্জ্বলতার দিকে চোখ, চেয়ে আছি–

ডীপ ফ্রিজে হিমায়িত কষ্টের পাশেই প্রলোভন,

অতৃপ্ত শরীরগুলো খুঁজে নিচ্ছে চোরাপথ– সেক্সড্রেন।

রুগ্নতার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা বিলাচ্ছে অপচয়–

মায়াবী আলোর নিচে চমৎকার হৈ চৈ, নীল রক্ত, নীল ছবি

জেগে ওঠে একখন্ড ধারালো ইস্পাত–চকচকে,

খুলির ভেতরে তার নড়াচড়া টের পাই শুধু।

ইতিমধ্যে ককটেলে ছিন্নভিন্ন পরিচয়,সম্পর্ক,পদবী–

উজ্জ্বলতার ভেতরে ফণা তুলে আর এক ভিন্ন অন্ধকার।

গ্লাসভর্তি অন্ধকার উল্টে দিই এই অন্ধকারে।

অবেলায় শঙ্খধ্বনি

অতোটা হৃদয় প্রয়োজন নেই,

কিছুটা শরীর কিছুটা মাংস মাধবীও চাই।

এতোটা গ্রহণ এতো প্রশংসা প্রয়োজন নেই

কিছুটা আঘাত অবহেলা চাই প্রত্যাখান।

সাহস আমাকে প্ররোচনা দেয়

জীবন কিছুটা যাতনা শেখায়,

ক্ষুধা ও খরার এই অবেলায়

অতোটা ফুলের প্রয়োজন নেই।

বুকে ঘৃণা নিয়ে নীলিমার কথা

অনাহারে ভোগা মানুষের ব্যথা

প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই-

করুণাকাতর বিনীত বাহুরা ফিরে যাও ঘরে।

নষ্ট যুবক ভ্রষ্ট আঁধারে কাঁদো কিছুদিন

কিছুদিন বিষে দহনে দ্বিধায় নিজেকে পোড়াও

না হলে মাটির মমতা তোমাতে হবে না সুঠাম,

না হলে আঁধার আরো কিছুদিন ভাসাবে তোমাকে।

অতোটা প্রেমের প্রয়োজন নেই

ভাষাহীন মুখ নিরীহ জীবন

প্রয়োজন নেই- প্রয়োজন নেই

কিছুটা হিংস্র বিদ্রোহ চাই কিছুটা আঘাত

রক্তে কিছুটা উত্তাপ চাই, উষ্ণতা চাই

চাই কিছু লাল তীব্র আগুন।

Exit mobile version