বাংলা অনুপ্রেরণামূলক কবিতা (Bengali motivational poems) মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যে কোন কাজের প্রতি। কবিতা সাধারণত উৎসাহ , উপদেশ ও অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্যই লেখা হয়। অনুপ্রেরণামূলক কবিতাকে উপদেশমূলক কবিতাও বলা যাতে পারে।
Bengali Motivational Poems l বাংলা উপদেশমূলক কবিতা
Table of Contents
পারিব না – কালীপ্রসন্ন ঘোষ
‘পারিব না’ একথাটি বলিও না আর, কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার; পাঁচজনে পারে যাহা, তুমিও পারিবে তাহা, পার কি না পার কর যতন আবার একবার না পারিলে দেখ শতবার।
পারিবে না বলে মুখ করিও না ভার, ও কথাটি মুখে যেন না শুনি তোমার। অলস অবোধ যারা কিছুই পারে না তারা, তোমায় তো দেখি নাক তাদের আকার তবে কেন ‘পারিব না’ বল বার বার ?
জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার, হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়, সাঁতার শিখিতে হলে আগে তবে নাম জলে, আছাড়ে করিয়া হেলা ‘হাঁট’ আর বার; পারিব বলিয়া সুখে হও আগুসার।
আদর্শ ছেলে -কুসুমকুমারী দাশ
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ? মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন “মানুষ হইতে হবে” — এই তার পণ, বিপদ আসিলে কাছে হও আগুয়ান, নাই কি শরীরে তব রক্ত মাংস প্রাণ ? হাত, পা সবারই আছে মিছে কেন ভয়, চেতনা রয়েছে যার সে কি পড়ে রয় ? সে ছেলে কে চায় বল কথায়-কথায়, আসে যার চোখে জল মাথা ঘুরে যায় | সাদা প্রাণে হাসি মুখে কর এই পণ — “মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন” | কৃষকের শিশু কিংবা রাজার কুমার সবারি রয়েছে কাজ এ বিশ্ব মাঝার, হাতে প্রাণে খাট সবে শক্তি কর দান তোমরা মানুষ হলে দেশের কল্যাণ
বাংলা অনুপ্রেরণামূলক কবিতা l Bangla Motivational Poems
পঞ্চায়েতের অনি বৌদি, পধান, উপপধান, এইমেলে, এম.পি- সব একেবারে হামলিয়ে পড়ল আমাদের মাটির কুঁইড়েঘরে।
জামবনি ইস্কুলের হেডমাস্টার কোন বিহান বেলায় টিনের আগর খুইলে, হেইকে, ডেইকে, ঘুম ভাঙাই- খবরটা যখন পথম শুনালেক তখন মাকে জড়াই শুয়ে ছিলুম আমি। কুঁড়াঘরের ঘুটঘুইটা আঁধারে হেডমাস্টার মশাইরে দেইখে চোখ কচালে মায়ের পারা আমিও হাঁ – হয়ে ভাইবে ছিলেম। -একি স্বপন দেখছি নাকি- স্যার বইলল, এটা স্বপুন লয়, স্বপুন লয়, সত্যি বইটে। কথাটো শুইনে কেঁইনদে ভাসায়েছিলুম আমরা মা বিটি।
আজ বাপ বেঁইচে থাইকলে আমি মানুষটাকে দেখাইতে পাইত্থম। দেখাইতে পাইতত্থেম বহুত কিছু- আমার বুকের ভিতর যে তেজালো সইনঝা বাতিটা জ্বালায়ে ছিল মানুষটা। সেই বাতিটা আজকে কেমন আমাদের কুঁইড়ে ঘরটাকে আলো কইরেছে। সেটো দেখাইতে পাইত্থম।
আপনারা বইলছেন বটে “তুমাদের মতো মেইয়ারা যদি উঠে আসে তবে ভারতবর্ষ উঠে আসে।” কথাটা খুবই সত্যি, কিন্তু উঠে আসার রাস্তাটা যে এখোন তৈয়ার হয় নাই। খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কি জিনিস। বহুত দম লাগে। বহুত ত্যাজ লাগে…
আমি জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি। যখন থেকে হুঁশ হইছে তখন থেকে শুইনে আসছি “বিটি না মাটি’ ঠাকুমা বইলথক্, পরের ঘরে হেঁইসেল ঠেইলবেক্ তার আবার লিখাপড়া’
গাঁয়ের বাবুরা বইলথক্ “দ্যাখ সাঁঝলি – মন খারাপ কইরলি তো হেইরে গেলি। শুন যে যা বইলছে বলুক্। সে সব কথা এক কানে সিধালে আর এক কানে বার কইরে দিবি।’
তখ্যান বাবুপাড়ার দেঘইরা ঘরে কামিন খাইটতক মা। ক্ষয় রোগের তাড়সে-মায়ের গতরটা ভাঙে নাই অতোটা। মাঝে মইধ্যে জ্বরটর আইত বটে, জ্বর এলে মা চুপচাপ এঙনাতে তালাই পাইতে শুইয়ে থাইকতো। মনে আছে সে ছিল এক জাঁড় কালের সকাল। রোদ উঠেছিল ঝলমলানি ঝিঙা ফুলা রোদ। আমি সে রোদে পিঠ দিয়া গা দুলাই পড়ছিলাম ইতিহাস… কেলাস সেভেনের সামন্ত রাজাদের ইতিহাস।
দে ঘরের গিন্নি লোক পাঠাইছিল বারকতক। মায়ের জ্বর সে তারা শুইনতে নাই চায়! আমাদের দিদি বুঢ়ি তখনো বাঁইচে। ছেঁড়া কম্বল মুড়হি দিয়ে বিড়ি ফুকছিল বুড়হি। শেষতক্ বুড়হি সেদিন পড়া থেকে উঠাই মায়ের কাইজ টুকুন কইরতে পাঠাই ছিল বাবু ঘরে।
পুরানো ফটক ঘেরা উঠান-অতোবড়ো দরদালান- অতোবড়ো বারান্দা, সব ঝাঁট ফাট দিয়ে সাফ সুতরো করে আসছিলুম চইলে, দেঘইরে গিন্নি নাই ছাইড়ল্যাক, একগাদা এটাকাটা-জুঠা বাসন আমার সামনে আইনে ধইরে দিলেক। বইল্লুম “আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো,” বাবু গিন্নির সেকি রাগ’- “কি বইল্লি তুই যতবড়ো মু লয় তত বড়ো কথা? জানিস, তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা সবাই এতক্কাল আমাদের জুঠা বাসন ধুয়ে গুজারে গ্যালো আর তুই আমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবি!” বল্লুম “হ আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো। তোমরা লোক দেখে লাওগা। আমি চইল্লোম” কথাটো বইলে গটগট গটগট কইরে বাবু গিন্নির মুখের সামনে আমি বেড়োই চইলে আইলম।”
তা বাদে সে লিয়ে কি কাইন্ড। কি ঝাম্যালা। বেলা ডুবলে মাহাতোদের ধান কাট্টে বাপ ঘরে ফিরে আইলে দুপাতা লিখাপড়া করা লাত্নির ছোট মুখে বড়ো থুতির কথা সাতকাহন কইরে বইলেছিল বুড়হি দিদি।
মা কুনো রা কাড়ে নাই। আঘর মাসের সইন্ ঝা বেলাই এঙ্গ্নাতে আগুন জ্বেইলে গা-হাত-পা সেঁকছিল মা।
একমাথা ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকানো বাপের পেটানো পাথরের মুখটা ঝইলকে উঠেছিল আগুনের আঁচে। আমি বাপের অমুন চেহারা কুনোদিন দেখি লাই। বাপ সেদিন মা আর দিদি বুড়ির সমুখে আমাকে কাইছে ডেইকে মাথায় হাত বুলাই গম্ গইমা গলায় বইলেছিল –
যা কইরেছিস্! বেশ্ কইরেছিস্। শুন্, তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা- সবাই কইরেছে কামিনগিরি। বাবুঘরে গতর খাটাই খাইয়েছে। তাইতে হইছে টা কি। তাতে হইছে টা কি! ই-কথাটো মনে রাখবি সাঝ্লি, তুই কিন্তু কামিন হবার লাগে জম্মাস লাই। যত বড় লাট সাহেবই হোক কেনে কারু কাছে মাথা নোয়াই নিজের ত্যাজ বিকাবি লাই। এই ত্যাজ টুকুর ল্যাইগে লিখাপড়া শিখাচ্ছি তুকে। না হলে আমাদের মতো হা-ভাতা মানুষের ঘরে আর আছে টা কি?”
আমি জামবনির কুইরি পাড়ার শিবু কুইরির বিটি সাঁঝলি, কবেকার সেই কেলাস সেভেনের কথা ভাবতে যায়ে কাগজওয়ালা টিভিওয়ালাদের সামনে এখুন কি যে বলি…
তালপাতার রদ দিয়ে ঘেরা গোবুর লতার এঙ্গনাতে লুকে এখন লুকাকার। তার মাঝে বাঁশি বাজাই, জিপগাড়িতে চেইপে আগুপিছু পুলিশ লিয়ে মন্ত্রী আইল্যাক ছুটে। ‘কুথায় সাঁঝলি কুইরি কুথায়’, বইলতে বইলতে বন্দুকধারী পুলিশ লিয়ে সুজা আমাদের মাটির কুইড়ে ঘরে,
হেডমাস্টার বইললে ‘পনাম কর, সাঁঝলি পনামকর’ মন্ত্রী তখন পিঠ চাপড়াইল্যাক। পিঠ চাপরাই বইল্লেক, “তুমি কামিন খেইটে মাইধ্যমিকে পথম হইছ, তাই তুমারে দেইখতে আইলম্, সত্যিই বড় গরীব অবস্থা বটে। তুমাদের মতো মিয়ারা যাতে উঠে আসে তার লাগেই তো আমাদের পার্টি, তার লাগেই তো আমাদের সরকার। – এই লাও, দশ হাজার টাকার চেকটা এখুন লাও। শুন আমরা তুমাকে আরো ফুল দিব, সম্মর্ধ্বনা দিব, আরো দ্যাদার টাকা তুলে দিব।– এই টিবির লোক, কাগুজের লোক, কারা আছেন, ই-দিকে আসেন।“
তক্ষুনি ছোট বড় কতরকমের সব ঝইলকে উঠল ক্যামেরা, ঝইলকে উঠল মন্ত্রীর মুখ। না না মন্ত্রী লয়, মন্ত্রী লয়, ঝইলকে উঠল আমার বাপের মুখ। গন্ গনা আগুনের পারা আগুন মানুষের মুখ। আমি তক্ষুনি বইলে উঠলম- “না না ই টাকা আমার নাই লাইগব্যাক। আর আপনারা যে আমায় ফুল দিব্যান, সম্মর্ধ্বনা দিব্যান বইলছেন তাও আমার নাই লাইগব্যাক।’
মন্ত্রী তখন ঢোক গিলল্যাক। গাঁয়ের সেই দেঘইর্যা গিন্নির বড় ব্যাটা এখুন পাটির বড় ল্যাতা। ভিড় ঠেলে সে আইসে বইলল্যাক- “ ক্যানে, কি হইছেরে সাঁঝলি, তুই তো আমাদের বাড়ি কামিন ছিলি। বল তর কি কি লাইগব্যাক, বল, তর কি কি লাইগব্যাক খুলে বল খালি,”
বইল্ লম – “ আমার পারা শয়ে শয়ে আর অনেক সাঁঝলি আছে। আর শিবু কুইরির বিটি আছে গাঁ গিরামে। তারা যদ্দিন অন্ধকারে পইড়ে থাইকবেক তারা যদ্দিন লিখ-পড়ার লাগে কাঁইদে বুলব্যাক্। তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগব্যাক্। শুইনছ্যান আপনারা তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগ্ ব্যাক।“
পড়ালেখা করে যেই – মদনমোহন তর্কালঙ্কার
লেখা পড়া করে যেই। গাড়ী ঘোড়া চড়ে সেই।। লেখা পড়া যেই জানে। সব লোক তারে মানে।। কটু ভাষী নাহি হবে। মিছা কথা নাহি কবে।। পর ধন নাহি লবে। চিরদিন সুখে রবে।। পিতামাতা গুরুজনে। সেবা কর কায় মনে।।
আমার পণ – মদনমোহন তর্কালঙ্কার
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি , সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে , আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে। ভাইবোন সকলেরে যেন ভালোবাসি , এক সাথে থাকি যেন সবে মিলেমিশি। ভালো ছেলেদের সাথে মিশে করি খেলা , পাঠের সময় যেন নাহি করি হেলা। সুখী যেন নাহি হই আর কারো দুখে , মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে। সাবধানে যেন লোভ সামলিয়ে থাকি , কিছুতে কাহারে যেন নাহি দেই ফাঁকি। ঝগড়া না করি যেন কভু কারো সনে , সকালে উঠিয়া এই বলি মনে মনে।
সাত সাগরের মাঝি – ফররুখ আহমদ
কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানি না তা । নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা । দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা। তবু জাগলে না ? তবু, তুমি জাগলে না ? সাত সাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে ডাকো জাহাজ, অচল ছবি সে, তসবির যেন দাঁড়ায়ে রয়েছে আজ । হালে পানি নাই, পাল তার ওড়ে নাকো, হে নাবিক! তুমি মিনতি আমার রাখো;
তুমি ওঠে এসো, তুমি ওঠে এসো মাঝি মাল্লার দলে দেখবে তোমার কিশতি আবার ভেসেছে সাগর জলে, নীল দরিয়ায় যেন সে পূর্ণ চাঁদ মেঘ তরঙ্গ কেটে কেটে চলে ভেঙে চলে সব বাঁধ । তবু তুমি জাগো, কখন সকাল ঝরেছে হাসনাহেনা এখনো তোমার ঘুম ভাঙলো না ? তবু, তুমি জাগলে না ? দুয়ারে সাপের গর্জন শোনো নাকি ? কত অসংখ্য ক্ষুদধিতের সেথা ভির, হে মাঝি ! তোমার বেসাতি ছড়াও, শোনো, নইলে যে-সব ভেঙে হবে চৌচির ।
তুমি দেখছ না, এরা চলে কোন আলেয়ার পিছে পিছে ? চলে ক্রমাগত পথ ছেড়ে আরও নিচে ! হে মাঝি ! তোমার সেতারা নেভেনি একথা জানো তো তুমি, তোমার চাঁদনি রাতের স্বপ্ন দেখেছে এ মরুভূমি, দেখো জমা হল লালা রায়হান তোমার দিগন্তরে; তবু কেন তুমি ভয় পাও, কেন কাঁপো অজ্ঞাত ডরে ! তোমার জাহাজ হয়েছে কি বানচাল, মেঘ কি তোমার সেতারা করে আড়াল ? তাই কি অচল জাহাজ ভাঙা হাল তাই কি কাঁপছে সমুদ্র ক্ষুধাতুর বাতাস কাঁপানো তোমার ও ফাঁকা পাল ? জানি না, তবু ডাকছি তোমাকে সাত দরিয়ার মাঝি, প্রবাল দ্বীপের নারিকেল শাখা বাতাসে উঠেছে বাজি ?
এ ঘুমে তোমার মাঝিমাল্লার ধৈর্য নেইকো আর, সাত সমুদ্র নীল আকাশে তোলে বিষ ফেনভার, এদিকে অচেনা যাত্রী চলেছে আকাশের পথ ধরে নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা । বেসাতি তোমার পূর্ণ করে কে মারজানে মর্মরে ? ঘুমঘোরে তুমি শুনছ কেবল দুঃস্বপ্নের গাঁথা ।
উচ্ছৃঙ্খল রাত্রির আজো মেটেনি কি সব দেনা ? সকাল হয়েছে । তবু জাগলে না ? তবু তুমি জাগলে না ? তুমি কি ভুলেছ লবঙ্গ ফুল, এলাচের মৌসুমী, যেখানে ধূলিতে কাঁকরে দিনের জাফরান খোলে কলি, যেখানে মুগ্ধ ইয়াসমিনের শুভ্র ললাট চুমি পরীর দেশের স্বপ্ন সেহেলি জাগে গুলে বকাওলি ? ভুলেছ কি সেই প্রথম সফর জাহাজ চলেছে ভেসে অজানা ফুলের দেশে, ভুলেছ কি সেই জমরুদ তোলা স্বপ্ন সবার চোখে ঝলসে চন্দ্রলোকে, পাল তুলে কোথা জাহাজ চলেছে কেটে কেটে নোনা পানি, অশ্রান্ত সন্ধানী ।
পাঞ্জেরি – ফররুখ আহমদ
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি? এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে? সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে? তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে; অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি। রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি? দীঘল রাতের শ্রান্তসফর শেষে কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে? এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী। তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে; সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি। রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি? বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে, বুঝি মৌসুমী হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে, বুঝি কুয়াশায়, জোছনা- মায়ায় জাহাজের পাল দেখে। আহা, পেরেশান মুসাফির দল। দরিয়া কিনারে জাগে তক্দিরে নিরাশায় ছবি এঁকে! পথহারা এই দরিয়া- সোঁতারা ঘুরে চলেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে? তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে; একাকী রাতের ম্লান জুলমাত হেরি! রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি? শুধু গাফলতে শুধু খেয়ালের ভুলে, দরিয়া- অথই ভ্রান্তি- নিয়াছি ভুলে, আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী। মোদের খেলায় ধুলায় লুটায়ে পড়ি। কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী। সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারি, ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি। ওকি বাতাসের হাহাকার,- ও কি রোনাজারি ক্ষুধিতের! ও কি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের! ও কি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী। পাঞ্জেরি! জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি, জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি! দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!!
মনুষ্যত্ব – কুসুমকুমারী দাশ
একদিন লিখেছিনু আদর্শ যে হবে “কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে” | আজ লিখিতেছি বড় দুঃখ লয়ে প্রাণে তোমরা মানুষ হবে কাহার কল্যাণে ? মানুষ গড়িয়া ওঠে কোন্ উপাদানে ; বাঙালি বোঝেনি তাহা এখনো জীবনে— পুঁথি হাতে পাঠ শেখা—দু-চারটে পাশ আজিকার দিনে তাহে মিলে না আশ্বাস, চাই শৌর্য, চাই বীর্য, তেজে ভরা মন “মানুষ হইতে হবে” হবে এই পণ— বিপদ আসিলে কাছে হবে আগুয়ান দুই খানি বাহু বিশ্বে সবারি সমান— দাতার যে দান তাহা সকলেই পায় কেউ ছোট কেউ বড় কেন হয়ে যায়! কেন তবে পদতলে পড়ি বারবার ? “মনুষ্যত্ব” জাগাইলে পাইব উদ্ধার— | যত অপমান, যত লাঞ্ছনা পীড়ন একতার বলে সব হইবে দমন! তেজীয়ান, বলীয়ান সেই ছেলে চাই সোনার বাংলা আজি হারায়েছে তাই | আবার গড়িতে হবে বীর শিশুদল, বাংলার রূপ যাহে হবে সমুজ্জ্বল—
আদর্শ ছেলে – কুসুমকুমারী দাশ
আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে? মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন ‘মানুষ হইতে হবে’- এই তার পণ। বিপদ আসিলে কাছে হও আগুয়ান নাই কি শরীরে তব রক্ত, মাংস, প্রাণ? হাত পা সবারই আছে, মিছে কেন ভয়? চেতনা রয়েছে যার, সে কি পড়ে রয়? সে ছেলে কে চাই বল, কথায় কথায় আসে যার চোখে জল, মাথা ঘুরে যায়? মনে প্রাণে খাট সবে, শক্তি কর দান, তোমরা ‘মানুষ’ হলে দেশের কল্যাণ।
ছাড়পত্র – সুকান্ত ভট্টাচার্য
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে তার মুখে খবর পেলুমঃ সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক, নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে। খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলিত, উদ্ভাসিত কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়। সে ভাষা বোঝে না কেউ, কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার। আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা। পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে। এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। অবশেষে সব কাজ সেরে আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে করে যাব আশীর্বাদ, তারপর হব ইতিহাস।।
আঠারো বছর বয়স – সুকান্ত ভট্টাচার্য
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি, আঠারো বছর বয়সেই অহরহ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
আঠারো বছর বয়সের নেই ভয় পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা, এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়- আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।
এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে, প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।
আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা, এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।
আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান, দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।
আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো, এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।
তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি, এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে, বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।
এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয় পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে, এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়- এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।।
পণ্ডশ্রম – শামসুর রাহমান
এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে। কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতারবিলে, আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে। দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে, কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে। কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল? কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল। যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরেছে চিলে, পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে। সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি, যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই। মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু, ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু! ছুটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে? নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে; কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে। ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম? বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।
বিপদে মোরে রক্ষা করো – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়। দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা, দুঃখে যেন করিতে পারি জয়। সহায় মোর না যদি জুটে নিজের বল না যেন টুটে, সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি লভিলে শুধু বঞ্চনা নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।
আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা, তরিতে পারি শকতি যেন রয়। আমার ভার লাঘব করি নাই বা দিলে সান্ত্বনা, বহিতে পারি এমনি যেন হয়। নম্রশিরে সুখের দিনে তোমারি মুখ লইব চিনে, দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা তোমারে যেন না করি সংশয়।
খোকার সাধ – কাজী নজরুল ইসলাম
আমি হব সকাল বেলার পাখি সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি। সূয্যিমামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে, ‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’- মা বলবেন রেগে। বলব আমি, ‘আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক, হয়নি সকাল- তাই বলে কি সকাল হবে না ক? আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে? তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!’ ঊষা দিদির ওঠার আগে উঠব পাহাড়-চূড়ে, দেখব নিচে ঘুমায় শহর শীতের কাঁথা মুড়ে, ঘুমায় সাগর বালুচরে নদীর মোহনায়, বলব আমি ‘ভোর হল যে, সাগর ছুটে আয়! ঝর্ণা মাসি বলবে হাসি’, ‘খোকন এলি নাকি?’ বলব আমি নই কো খোকন, ঘুম-জাগানো পাখি!’ ফুলের বনে ফুল ফোটাব, অন্ধকারে আলো, সূয্যিমামা বলবে উঠে, ‘খোকন, ছিলে ভাল?’ বলব ‘মামা, কথা কওয়ার নাই ক সময় আর, তোমার আলোর রথ চালিয়ে ভাঙ ঘুমের দ্বার।’ রবির আগে চলব আমি ঘুম-ভাঙা গান গেয়ে, জাগবে সাগর, পাহাড় নদী, ঘুমের ছেলেমেয়ে!
উছলি’ উঠিছে যেন দিকে দিকে প্রাণ! আপনার অগোচরে গেয়ে উঠি গান আগমনী আনন্দের! অকারণে আঁখি পু’রে আসে অশ্রু-জলে! মিলনের রাখী কে যেন বাঁধিয়া দেয় ধরণীর সাথে! পুষ্পঞ্জলি ভরি’ দু’টি মাটি মাখা হাতে ধরণী এগিয়ে আসে, দেয় উপহার। ও যেন কনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী আমার!- সহসা চমকি’ উঠি! হায় মোর শিশু জাগিয়া কাঁদিছ ঘরে, খাওনি ক’ কিছু কালি হ’তে সারাদিন তাপস নিষ্ঠুর, কাঁদ’ মোর ঘরে নিত্য তুমি ক্ষুধাতুর!
পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার, দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে!-মোর অধিকার আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ পুত্র হ’য়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ আমার দুয়ার ধরি! কে বাজাবে বাঁশি? কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি? কোথা পাব পুষ্পাসব?-ধুতুরা-গেলাস ভরিয়া করেছি পান নয়ন-নির্যাস!….
আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই, ও যেন কাঁদিছে শুধু-নাই, কিছু নাই!
কাণ্ডারী হুশিয়ার! – কাজী নজরুল ইসলাম
১ দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার! দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ, ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ? কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত। এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!
২ তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান! যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান! ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান, ইহাদের পথে, নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার!!
৩ অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ, কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ! “হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!
৪ গিরি-সংকট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ, পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ কান্ডারী! তুমি ভূলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ? ‘করে হানাহানি, তবু চল টানি’, নিয়াছ যে মহাভার!
৫ কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর, বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর! ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।
৬ ফাঁসির মঞ্চে যারা গেয়ে গেল জীবনের জয়গান, আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান? আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান? দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!
প্রতিদান – জসীম উদ্দীন
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর, আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর। যে মোরে করিল পথের বিবাগী, – পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি। দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর ; আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর।
আমার এ কুল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কুল বাঁধি, যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি; সে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ, আমি দেই তারে বুকভরা গান; কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর, আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি, রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ান ফুল-মালঞ্চ ধরি । যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বার্ণী, আমি লয়ে সখি, তারি মুখখানি, কত ঠাঁই হতে কত কি যে আনি, সাজাই নিরন্তর, আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।